গল্প:ডিভোর্স পেপার | ডিভোর্সের গল্প

 ডিভোর্স নিয়ে কিছু কথা

ডিভোর্স নিয়ে কিছু কথা

ডিভোর্স হয়ে গেলেই ভালো। যেহেতু আমরা দুই পরিবার মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এটাই তোমাদের জন্য ভালো হবে। দুই দিন পর পর তোমাদের মধ্যে এত সব ঝামেলা হয় আর আমাদের মিটিং এ বসতে হয়! এর থেকে ভালো তোমরাও যেহেতু ডিভোর্স চাইছ, তাহলে এবার হয়েই যাক। 


আমার মেয়ে রেহা আর মেয়ের জামাই সামন্তর উদ্দেশ্যে কথাগুলো বললাম। 


ওরা দুজন এমনভাবে বসে আছে যেন কেউ কারো মুখ দেখে ফেললে ফোস্কা পড়ে যাবে। এমন একটা অবস্থা যেন দু'জন দু'জনকে সহ্যই করতে পারছে না, চেহারাও দেখতে চায় না। ভাবতেই অবাক লাগে সব মিটে গেলে ওরাই আবার কবুতরের মতো বসে থাকে। 

আমার কথার উত্তরে কিছুই বললো না ওরা কেউ।


 সামন্তর মা -বাবাকে বললাম-

–কি বলেন আপনারা?

সামন্তর বাবা মাথা দুলিয়ে সায় দিলো । আপা বলল-

–আসলেই, একদম অসহ্য হয়ে গেছি আপা। ওদের এই বয়সেও এমন ধরণের আচরণ মেনে নিতে পারি না, আমি তো হাই ব্লাড প্রেশারের রোগী। এদের অবস্থা দেখে আমার প্রেশার বেড়ে যায় কবে যে স্ট্রোক করে বিছানায় পড়ে যাবো।


রেহা বলে উঠলো-

–আম্মু আমার কি দোষ বল?ওর এক্স এর সাথে এখনো কেন কানেক্ট আছে সে?


সামন্ত বললো-

–মুখ সামলে কথা বল সে আমার এক্স না, আমার ফ্রেন্ড, জাস্ট ফ্রেন্ড।


–জাস্ট ফ্রেন্ড হলে কি লাভ ইমুজি দিতে হয়? সব ছবিতে লাভের ছড়াছড়ি।


–লাভ রিয়েক্ট দিলে কি হয়?তোমারও তো কত কত ফ্রেন্ড লাভ রিয়েক্ট দেয় আমি কি বলি?


–আমার..


রেহার কথা শেষ করতে দিলাম না, এক ধমকে চুপ করিয়ে দিলাম।

–একদম চুপ, তোমরা আর একটাও কথা বলবে না। আমার মাথা ধরে গেছে তোমাদের এই সব ফালতু ছেলেমানুসি কান্ড দেখে দেখে। এই চার দিন থেকে রেহা এখানে আছে, তোমাদের ঝগড়া কমছেই না, কথা হলেই ঝগড়া, একজন আরেক জনকে দোষারোপ। এত দিন অনেক বুঝিয়েছি , আর না। যদি দুজনের প্রতি দুজনের এতই অভিযোগ তাহলে দরকার নেই আর এক সাথে থাকার। ডিভোর্স হয়ে যাক। 


রেহার বাবা ক্লান্তভাবে হাই তুলতে তুলতে সামন্তর বাবাকে বললো-

–ভাই সাহেব, তাহলে ঐ কথাই রইলো, আপনার পরিচিত উকিলের কাছে আমরা কাল যাচ্ছি । কখন গেলে আপনার সুবিধা হয়?


–বিকেলে চলেন। কাল একটু আগেই অফিস থেকে বের হয়ে আপনার অফিসের সামনে থাকবো। আমি পৌঁছে কল দেবো আপনাকে।


–আচ্ছা তাহলে কথা ফাইনাল। আমরা এবার তাহলে উঠি।


আমি বললাম– 

–কি বলেন ভাই, সব কিছু রেডি, খেয়ে যাবেন। এর পরে তো আর আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকবে না, এভাবে হয়তো আসা যাওয়াও হবে না।


সামন্তর মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো-

–না না, আপা । ওদের সম্পর্ক শেষ হলেও আমাদের সম্পর্ক এমনই যেন থাকে। ছেলের শ্বশুর বাড়ির কত ভালো আত্মীয় পেয়েছিলাম, এখন ওদের জন্য সব শেষ। 

এর পরে তো ধরেন সামন্ত আবার বিয়ে করবে, কেমন না কেমন আত্মীয় হয়? আপা খুব খারাপ লাগছে, বুঝলেন।


–আসলেই আপা , আজ হোক কাল হোক রেহাও তো আবার বিয়ে করবে, সারা জীবন তো আর একা থাকবে না। সেই ছেলেই বা কেমন হবে আর শ্বশুরবাড়ির লোকজনই বা কেমন হবে? জানেনই তো মেয়ের শ্বশুর বাড়ি ভালো জোটে কপাল গুণে। আপনাদের মতো ভালো মানুষ কয় জন আছে? আপনারা আমার মেয়েকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসেন। আপনাদের ওখানে রেহা থাকলে আমি কোন টেনশন করি না।


আমি আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম এতক্ষণ রাগে গজগজ করতে থাকা রেহা আর সামন্ত দুজরনেই যেন চেহারার রং কিছুটা বদলে গেলো, একটু যেন থমকে গেলো, একটু যেন ধাক্কা খেলো। ডিভোর্সের পরের অবস্থা নিয়ে ওরা হয়তো ভাবেনি, ভাববার প্রয়োজনও হয়তো বোধ করেনি। জীবন যেন ওদের কাছে অনেকটা অ্যাডভেঞ্চারের মতো , যেখানে শুধুই সুখ অনুভব করা , বাস্তবতা বা কষ্ট সেখানে অবাঞ্ছিত। এটা শুধু ওদের ক্ষেত্রে না, এমন আরো ঘটনা আশপাশে দেখছি। হুটহাট সম্পর্ক, বিয়ের জন্য বাবা-মাকে অনেকটা বাধ্য করানো এর পরে ঝগড়া ঝাটি, এর পরে ডিভোর্স। এরা যেন কোন কিছুতেই সময় নিয়ে বুঝতে চায় না, সময় নেয়া মানে সময় নষ্ট মনে হয় ওদের কাছে। আমরা কি আমাদের সন্তানদের সঠিক শিক্ষা দিতে ভুল করছি নাকি এটা সময়ের তালের সমস্যা? হিসেব মেলাতে পারি না।


রেহা বলল-

–এই সব কি বল? আবার বিয়ের কথা আসছে কেন? আমি কখনো আব্বু আম্মুর কথা খারাপ কিছু বলেছি? ঝামেলা তো বাঁধায় সামন্ত।


সামন্ত আবার ক্ষেপে উঠলো -

–আমি ঝামেলা করি? তুমি কিছুই কর না? সেইদিন তুমি বাইরে যাবে বললে, আমি জ্যামে পরায় দেরি হয়ে গেলো তুমি রেগে গেলে, ঝগড়া শুরু হলো।


–আর তুমি তো ফ্রেন্ডদের সাথে ঘন্টা ঘন্টা সময় কাটিয়ে আস, কোন জিনিস আনতে বললে মনে থাকে না সেই সব কি? তুমি চেঞ্জ হলেই তো সব কিছু ঠিক হয়ে যায়।


–তোমার চেঞ্জ দরকার আমার না। তোমার জন্য আমার ফ্রেন্ড সার্কেল ছেড়ে দিতে হবে? তুমি যা চাইবে আমাকে তাই করতে হবে? থাক তুমি তোমার মতো আর খুঁজে নাও ভালো একজনকে যে তোমার কথায় উঠবে বসবে।


–আমারো ঠেকা পড়েনি তোমার সাথে থেকে পঁচে মরার। আমার যখন এত দোষ আলাদা হয়ে যাওয়াই ভালো। অন্য কাউকে নিয়ে তুমি ভালো থাকো, এনজয় করো তোমার লাইফ, আমিই তো তোমার জীবনের কাঁটা, আর থাকবে না এই কাঁটা।


আমি বললাম-


–অন্যকে চেঞ্জ করার আগে তোমরা আগে নিজেদের নিজেরা চেঞ্জ কর। যে কারণে ঝামলা হয় সেই সব না করার চেষ্টা কর। সব সময় যে দোষী ব্যক্তিই দোষী থাকবে যে দোষারোপ করছে সেই সঠিক সেটা তো নাও হতে পারে। তোমরা কি কর? কেউ নিজেকে ছোট করতে চাও না, মনে কর নিজে যেটা চাইছ, বলছ বা করছ সেটাই ঠিক। যদি নিজের নিজের সিদ্ধান্ত এ্যাপ্লাই না হয় তাহলে ছোট হয়ে যাবে। এটা কেমন কথা? একজন মানুষের সব কিছু ঠিক হবে? তোমরা কেউ কাউকে বিশ্বাস কর না, সম্মান কর না। যেটা হচ্ছে সম্পর্কের মূল ভীত সেই ভীতই তোমাদের নেই। তোমরা অধৈর্য, কোন কিছুতে ধৈর্য নেই, এখনই সব চাই, কোন অপেক্ষা নেই। তোমরা ঝগড়া করলে যে কোন কিছু বলে ফেল, মুখের কোন কন্ট্রোল নেই। 


সামন্তর মা বললো-

–এভাবে আসলেই কোন সম্পর্ক চলতে পারে না,স্থায়ী হতে পারে না। তোমরা তো কি চাও সেটা নিজেরাও জানো না। সবটাইতে গুরুত্বপূর্ণ হলো তোমাদের নিজেদের ভালো লাগাকেই শুধু তোমারা গুরুত্ব দাও অন্যের ভালো লাগা, সুবিধা অসুবিধা কিছুই দেখ না। 

আমি তো বলেছি যদি আমাদের জন্য সমস্যা হয় যদি আলাদা বাসায় থাকতে চাও, তাহলে আলাদা হয়ে যাও। তোমরা অন্য বাসায় থাক।


–কি যে বলেন আপা, আলাদা থাকলে এরা খুনোখুনি করে ফেলবে।


সামন্তর বাবা বললো-

এখন এই সব কথার কোন মানে নেই, যা সিদ্ধান্ত নেয়ার তা তো নিয়েই নিয়েছি।


রেহার বাবা বললো-

ঠিক বলেছেন ভাই সাহেব। এই এক বছরে রেহা কয়বার চলে এসেছে?  আমরা ওদের নিয়ে কতবার মিটিং এ বসেছি? সব ভুলে গেলেন? কোন লাভ হয়েছে বুঝিয়ে? এই সব কথা অনেক বার এদের বোঝানো হয়েছে। আসলে কি আমাদের সন্তানরা বিবেকহীন, স্বার্থপর। ওরা আমাদের কথা তো চিন্তা করেই না, নিজেদের নিয়েও চিন্তা করে না। আসলে এরা বুঝেই না সম্পর্কের মানে। ওরা কি চায় সেটাই হয়তো ভালো ভাবে বুঝে না।

ডিভোর্স হওয়ার মতো ওদের মধ্যে কোন কারণ নেই তারপরেও ওরা যখন বলছে ডিভোর্স হয়ে যাক এর পরে রেহার ব্যাপারে আমার আর কিছুই বলার থাকবে না। ওর যা ইচ্ছে করুক।


ওদেরকে ইগনোর করে আমরা চারজন ডাইনিং এ বসে গেলাম। খাবার পরিবেশন করে চারজনই খেতে বসে গেলাম।


রেহা বলতে লাগলো -

–বাহ্ এখানে তাঁদের ছেলে মেয়েদের ডিভোর্সের কথা চলছে আর তারা নিশ্চিন্তে খেতে বসে গেছে, আমাদের কোন কথাই শুনছে না।


আমি বললাম -

–তোমাদের জন্য আমরা খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিবো? চিন্তা করতে করতে পাগল হবো?

আর কি কি করতে হবে তোমাদের জন্য? তোমাদের মা বাবা হয়েছি দেখে সব কিছু সহ্য করতে হবে? এক বছরে তোমাদের এই সব দেখে দেখে ক্লান্ত হয়ে গেছি। তোমাদের সমস্যা তোমরা নিজেরা ছাড়া কেউ সলভ করতে পারবে না।

 আর কি শুনবো আর কি দেখবো? ডিভোর্সের কথা? সেটা তো ফাইনাল হয়েই গেলো। তোমার বাবা আর শশুর কাল গিয়ে উকিলের সাথে কথা বলে সব ঠিক করবে। 


এর পরে আমরা খাওয়া শুরু করলাম কিন্তু কেউ ঠিক মতো খেতে পারলাম না। সন্তান যত বড় ভুলই করুক না কেন তাদের সমস্যা, অশান্তি মা-বাবার বুকে সব সময় পেরেকের মতো বিঁধে। আমি জানি টেবিলে বসা আমরা চারজন ভিন্ন আঙ্গিকে চিন্তা করলেও চিন্তার বিষয় একটাই। আহ্ ওরা যদি বুঝতো!


সামন্তরা চলে যাওয়ার পরে রেহা দরজা আটকে বসে রইলো। আমি কয়েকবার ডাকলাম খাওয়ার জন্য। সে দরজা খোলেনি। রেহার বাবা বললো, এই সব আর প্রশ্রয়ই দিবে না।


 রেহার বাবা একটা খাম আমার হাতে দিয়ে রেহাকে শুনিয়ে বললো, এই ডিভোর্স পেপারে রেহাকে সাইন করে রাখতে বলবে।


 বাবা মেয়ে কারো সাথে কেউ ঠিকমতো কথা বলছে না কয়দিন থেকে।

আমি তাকিয়ে দেখলাম রেহা যেন হঠাৎ রক্তশূন্য হয়ে গেছে। ভয় আর আতঙ্ক ওকে ঘিরে ধরেছে।


রেহা বসা থেকে উঠে এসে কাতর কন্ঠে বললো-

–আব্বু তোমরাই তো আমাদের বোঝাতে সব কিছু ঠিক করে ফেলতে, ডিভোর্স কোন সমাধান নয় তাহলে কেন এখন তোমরা এমন করছ?


–আমরা এমন করছি, তোমরাই তো ডিভোর্স  চাইলে এখন কি হয়েছে?


–সামন্তর সাথে আমার কথা হয়েছে, সেও ডিভোর্স চায় না। 


–তাতে কি হয়েছে? দুইদিন ঠিক থেকে আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে তোমাদের।


–আর এমন হবে না আব্বু।


এবার আমি চেঁচিয়ে বললাম-

–সব কিছু খেলা পেয়েছ? আর কোন কথাই শুনবো না তোমাদের। সামন্তর সাথে যোগাযোগ একদম বন্ধ। এবার আমরা যা সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেটা মানতেই হবে।


রেহা কাঁদো কাঁদো মুখ করে রুমে চলে গেলো। আমার মনটা মুচড়ে উঠলো। 


পরেরদিন সকালে মেইন ডোর চাপানো পেলাম। ডাইনিং টেবিলে একটুকরো কাগজ পেলাম -

"আম্মু-আব্বু তোমাদের বলছি, আমি আর সামন্ত দুজন দুজনকে ছেড়ে কখনো থাকতে পারবো না, আমরা কখনো ডিভোর্স দিতে পারবো না। সামন্ত অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে। আমরা দুজনে কোথায় যাচ্ছি তোমাদের বলবো না, যদি তোমাদের মত পাল্টাও তাহলে মেসেজ দিও, চলে আসবো।

রেহা।"


রেহার বাবাকে ডেকে উঠিয়ে চিরকুটা দেখালাম। সে কিছু বলল আগেই মোবাইলে রিং হচ্ছে। দেখলাম রেহার শাশুড়ি কল করেছে। রিসিভ করতেই  বললো-

–আমাদের প্ল্যান সাকসেসফুল ফুল আপা। আমি তো ভয় পাচ্ছিলাম সামন্ত খাম খুলে যদি ডিভোর্স পেপার দেখতে চায় আর তখন সাদা কাগজ বেরিয়ে আসে তখন তো সব কিছু ফাঁস হয়ে যাবে। যাই হোক আপা, সামন্ত একবারও খামটা ধরেও দেখেনি। কি অস্থিরতা যে ওর মধ্যে দেখেছি খামটা দেখার পরে। আমাদের অভিনয় চালিয়ে যেতেও কষ্ট হয়েছে, কি বলেন?এখন যদি সব কিছু ঠিক হয়, তবেই হলো। 

আপা এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলার পরে আমি শুধু বললাম -

আপা তাই যেন হয়, এই দোয়াই করি।


কেন জানি না আমার চোখ ছলছল করে উঠলো।


রেহার বাবা সেটা লক্ষ্য করলো। সে আমার হাতটা আলতো করে ধরে কাছে বসিয়ে বলল-

–চিন্তা করো না রিমু, সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।


-ছোট_গল্প

-খাম

-ফাহমিদা_লাইজু


এমন আরও বাস্তব রোমান্টিক গল্প।