বউ শাশুড়ির সম্পর্ক | শিক্ষামূলক গল্প

 মায়ের ভালোবাসা

মায়ের ভালোবাসা

আমার স্ত্রী ঝুমুর আমার মাকে একদম সহ্য করতে পারে না।মা তো বৃদ্ধ। অনেকদিন যাবৎ ঘরে বিছানায় পড়া। বিছানা থেকে উঠতেই পারেন না। মাঝে মধ্যেই তিনি বিছানা, কাপড়- চোপড় নষ্ট করে ফেলেন। সেদিনও এমন হলো। ঝুমুর একেবারে বমি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেল। তারপর সে রাতেই সে বললো,'পবন, তুমি কী তোমার মাকে বাড়ি থেকে বের করবে নাকি আমায় বের করবে?'

আমি অবাক হয়ে বললাম,'এটা কী বলছো নিঝুম? আমার মাকে আমি বের করে দিবো মানে? যে মা বিছানা থেকেই উঠতে পারেন না তাকে কীভাবে আমি ঘর থেকে বের করে দেই!'

নিঝুম বললো,'আমি তোমার কাছ থেকে কোন অজুহাত শুনতে চাই না। আমার সন্তানেরা এই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকতে থাকতে অসুখ বাঁধিয়ে ফেলছে! তাছাড়া  এটা কী তোমার একার মা?পিউলিকে বলো। ওর কাছে নিয়ে রাখুক।পিউলি তো আবার মার কলিজা!কলিজাকে ফোন করে বলো!'

আমি বললাম,'নিঝুম,কী সব আবোল তাবোল বকছো!উনি আমার জন্মদাত্রী মা বুঝলে!'

নিঝুম বললো,'মা না ছাই তা আমার জানার অত দরকার নাই। তুমি যদি তোমার সন্তান আর স্ত্রী চাও আপাতত মাকে এখান থেকে সড়াতে হবে।পিউলিদের বাড়িতে গিয়ে মাকে দিয়ে আসো। সমস্যা নাই তো। তুমি তার অর্ধেক খরচা দিবে।'

আমি অনুনয় করে বললাম,'নিঝুম, এমন করো না প্লিজ!মা খুব অসুস্থ। এমন অবস্থায় তার সাথে এমন অবিচার করলে পাপ হবে। কঠিন পাপ হবে!'

ঝুমুর বললো,'এটা পাপ আর আমার ছেলে মেয়ে দুটো যে তোমার মায়ের জন্য অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে,আমি নিজে বমি করতে করতে শেষ হয়ে যাচ্ছি, কিছু খেতে পর্যন্ত পারছি না এটা পাপ না? পুরুষ জাতটাই এমন।সব সময় এক তরফা বিচার করে!আরে বাবা, মাকে তো তুমি আর জাহান্নামের আগুনে ফেলে দিয়ে আসছো না। দিয়ে আসছো বোনের বাড়িতে।আর এমনি এমনি তো দিয়ে আসছো না। দিয়ে আসছো তোমার সন্তানদের ভালোর জন্য।এটা বুঝতে পারছো না কেন তুমি?'

তবুও আমার মানতে কষ্ট হয়। আমার খুব করে মনে পড়ে আমার জন্য মার ত্যাগের কথা।ওই যে আমায় ছোট্ট রেখে বাবা মারা গেলেন তখন কিন্তু মার বয়স একেবারেই কাঁচা।নানা আর মামারা কত যে চেষ্টা করলেন মাকে নতুন বিয়ে দিতে।মা কিছুতেই রাজি হলেন না। বললেন, আমার সন্তানরে রাইখা আমি বিয়া বসতে পারবো না।তোমরা আমার কাছে আইসা এইসব বলবা না।

সেই মাকে আমি কী করে তাড়িয়ে দিবো!

নিঝুম বললো,'বুঝেছি তুমি পারবে না।বলেই সে জলদি করে ব্যাগপত্র গুছিয়ে ফেললো। তারপর ছেলে মেয়েকে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে যেতে বললো,'থাকো তোমার মাকে নিয়েই থাকো।'

আমার তখন কী যে হলো!আমি বললাম,'নিঝুম,তুমি যেও না।থাকো।প্লিজ থাকো!'

নিঝুম বললো,'আমি কতবার বলবো যে আমার সমস্যা হয় থাকতে এখানে। আমার ছেলে মেয়ের সমস্যা হয়!'

মা সবকিছু শুনলেন।আর ডাকলেন আমায় সঙ্গে সঙ্গে।আমি মার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। মা বললেন,'পবন,তুই আসলেই একটা বেকুব।বউমারে যাইতে দিস না।দেখস না এদের অসুখ হয়ে যাচ্ছে দু'দিন পর পর। এরচেয়ে তুই পিউলিকে ফোন কর।ওর সন্তান সন্তুতি নাই। তাছাড়া ঘেন্না টেন্নাও ওর কম।সে তো চাই ই আমি তার কাছে গিয়ে থাকি। কিন্তু আমিই তো না করি!ফোন কর ওকে!'

আমি নিজে ফোন করলাম না পিউলিকে। ফোন করলেন মা-ই।মা ফোন করে হাসি হাসি মুখে বললেন,'পিউলি, আমার না খুব শখ হচ্ছে তোর এইখানে গিয়ে কয়টা দিন থাকবার!'

পিউলি আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠে সেদিন বিকেলেই গাড়ি নিয়ে ছুটে এলো। মাকে নিয়ে চলে গেল।মা চলে যাওয়ার সময় আমার নাকে মুখে হাত বুলিয়ে দিলেন।গালে কপালে চুমু খেলেন। তারপর আমার ছেলে মেয়ে দুটোর দিকে তাকিয়ে রইলেন।মার হয়তো ইচ্ছে করছিলো ওদের কাছে টেনে চুমু খান। কিন্তু সাহস করতে পারেননি ওদের কাছে ডাকার!যদি নিঝুম বকে দেয়!ধমক দেয়!

'

মা চলে যাওয়ার পর বাড়িটা কেমন নিরব নিস্তব্ধ হয়ে গেছে।মার বিছানার দিকে তাকালে ভেতরটা কেমন খা খা করে উঠে। চোখে কিলবিল করে উঠে জল।মুখ ভেঙে কান্না এসে যায়।

আর নিঝুমের হলো আমার উল্টো।কী আনন্দ যে তার হলো!আনন্দে সে ঘর দোর পরিষ্কার করতে লাগলো। গতরাতে হঠাৎ করে সে বললো,'পবন,ছেলে মেয়ের খেলার জায়গা নাই।আমি ভাবছি মার খাটটা সরিয়ে ওখানে ওদের খেলার জায়গা করে দিবো।'

আমি বললাম,'কী বলছো এটা তুমি নিঝুম?'

নিঝুম বললো,'রেগে যাচ্ছো কেন?মার খাট কী আমি ভেঙে ফেলতেছি?জাস্ট এখান থেকে সরিয়ে অন্য কোথাও রাখবো।আর তা করছি তোমার ছেলে মেয়ের জন্যই। ওদের ভালো কী তুমি চাও না?'

আমি কোন কথা বললাম না।চুপ করে রইলাম।

'

পরদিন সন্ধ্যা বেলায় অফিস থেকে ফিরে চমকে উঠলাম।মার খাট নাই এখানে। খাটের জায়গায় একটা দোলনা, খেলনা পত্তর।ছেলে মেয়েরা খেলছে।আমি-----

'

'

'

'

'

'

আমি চিৎকার করে উঠে বললাম,'নিঝুমু, সমস্যা কী তোমার?তোমায় নিষেধ করা সত্ত্বেও তুমি মার খাট এখান থেকে সরিয়েছো কেন?'

নিঝুম ঠান্ডা গলায় বললো,'আশ্চর্য! তুমি এভাবে হঠাৎ খেপে যাচ্ছো কেন?খাট সরানো কী ভীষণ অপরাধ হয়ে গেছে?'

'হ্যা অপরাধ হয়ে গেছে। তুমি জানো না মায়ের খাটটা এখানে ষাট বছর ধরে আছে? এই খাট কয়েকবার রিপেয়ার করানো হয়েছে। তবু চেঞ্জ করা হয়নি।মার পছন্দের খাট এটা। বাবার রেখে যাওয়া স্মৃতিও।এখান থেকে খাটটা সরিয়ে তুমি ভালো করোনি! তুমি খুব বাড় বেড়েছো!'

নিঝুম বললো,'মায়ের উপর নিজের সন্তানদের চেয়েও বেশি দরদ হয়ে গেল? আমি কী ইচ্ছে করে এটা করেছি।ছেলে মেয়েরা খেলাধুলা করতে চায়।

ওদের খেলাধুলা করার জায়গা নাই তাই এটা করতে হয়েছে।'

'তুমি কী মাকে এই জন্যই বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছো? মাকে তাড়িয়ে দিয়ে তার শুয়ার জায়গায় খেলার মাঠ ।মানে মার বুকের উপর তোমার ছেলে মেয়ে খেলবে?'

'হ্যা খেলবে।এটা ওদের খেলার বয়স। ঘরে বসে থেকে থেকে আমার ছেলে মেয়েরা প্রতিবন্ধী হয়ে যাবে না!'

'খেলার জন্য আরো জায়গা আছে।ছাদে খেলুক।'

'ছাদে? তুমি কী আমার ছেলে মেয়েদের মারতে চাচ্ছো?'

'আশ্চর্য!ছাদে রেলিং দেয়া আছে। ওখান খেললে সমস্যা কী?'

'সমস্যা আছে না নাই এই বিষয়ে আমি তোমার সাথে বাহাস করতে পারবো না। তোমার জন্য টেবিলে খাবার দিচ্ছি।হাত মুখ ধুয়ে খেয়ে নাও!'

'

আমার যা রাগ পাচ্ছে! ইচ্ছে করছে এইসব দোলনা, খেলনা পত্তর এখান থেকে সরিয়ে নিতে কিন্তু সরিয়ে নিতে পারছি না। সরিয়ে নিলে ছেলে মেয়েরা কষ্ট পাবে। ওরা উল্টাপাল্টা বুঝবে। ভাববে ওদের মা ওদের ভালো চায় কিন্তু বাবা চায় না। ওদের মা ভালো কিন্তু বাবা ভালো না। আমি চাই না আমার সন্তানেরা আমায় কোনভাবেই ভুল বুঝুক। 

'

রাতে হঠাৎ করে আমি সবকিছু ভুলে যাওয়ার বাহানা করলাম এবং শান্ত শিষ্ঠ ভাবে খাওয়া দাওয়ার পর ছেলে মেয়েদের সাথে গল্প করে ওদের ঘুম পাড়ালাম। তারপর ঝুমুরকে বললাম,'নিঝুম,চলো ছাদে যাই!'

নিঝুম বললো,'ছাদে কেন?তাও এই অত রাতে?'

'আকাশ দেখবো।'

নিঝুম বললো,'আজ আকাশে চাঁদ নাই।সব অন্ধকার। আকাশ দেখা যাবে না।'

'কিন্তু তাকিয়ে তো থাকা যাবে।আসো অন্ধকার দেখি গিয়ে। অন্ধকারের ভেতর তাকিয়ে তাকিয়ে একটুকু আলো খুঁজে পাই কি না দেখি গিয়ে!'

নিঝুম হাসলো। হেসে আমার হাত চেপে ধরে বললো,'চলো।'

'

আমরা গিয়ে ছাদের একপাশে বসলাম। একজনের হাতের ভেতর অন্য জনের হাত। নিঝুম আমার গায়ে তার শরীরের ভর ছেড়ে রেখেছে।ওর চুল এসে পড়ে আছে আমার মুখের উপর।

আমি আস্তে করে বললাম,'নিঝুম?'

নিঝুম বললো,'হুম।'

আমি এবার বললাম,'আচ্ছা নিঝুম,তোমার সবচেয়ে কাছের মানুষ কে?'

নিঝুম বললো,'কে নয় কারা হবে।'

আমি বললাম,'কারা?'

নিঝুম বললো,'আমাদের ছেলে মেয়ে। ধূসর আর ঝিনুক।'

'আচ্ছা ধরো তুমি একদিন বৃদ্ধ হয়ে গেছো। তুমি আর চলতে পারো না। শরীরে বল নাই। তখন যদি তোমার সবচেয়ে কাছের মানুষটা তোমায় বলে ,মা তুমি এখানে থাকলে আমার প্রবলেম হচ্ছে। আমার স্ত্রীর প্রবলেম, বাচ্চাদের প্রবলেম, তুমি বরং এখান থেকে অন্য কোথাও চলে যাও। কিংবা তোমার ছেলে মেয়েরা যদি তোমায় এই বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও দিয়ে আসে তখন তোমার কেমন লাগবে?'

নিঝুম কথা বলে না।ভাবতে থাকে। অনেক্ষণ ভাবে। ভেবে বলে,'আমি এমন করে আগে ভাবিনি।সরি!আমরা ইচ্ছে করলেই সমস্যাটা সলভ করতে পারতাম।আসলে আমার জেদের বশে এসব করা উচিৎ হয়নি।ছেলে মেয়েদের জন্য ছাদেই খেলার জায়গা করতে পারতাম।'

আমি তখন ধরা গলায় বললাম,'আমারও ভুল আছে। আমিও ভুল করেছি। আমিও সুন্দর করে তোমায় বুঝাতে পারতাম। আর মার প্রতি আমারও অবহেলা আছে। অবহেলা না থাকলে তাকে কিছুতেই এই বাড়ি থেকে চলে যেতে দিতে পারতাম না। আমি জানি শরীর থেকে রুহ বেরিয়ে গেলে যতোটুকু কষ্ট হয় তারচে কম কষ্ট হয়নি মার। এই ঘরটা মার অস্তিত্ব। তাছাড়া আমাদের এই কাজটার প্রভাব পড়বে আমাদের ছেলে মেয়েদের উপর।তারা এই বয়স থেকেই শিখে যাবে মা খুব গুরুত্বপূর্ণ কেউ না। তাকে ইচ্ছে করলে ঘর থেকেও বের করে দেয়া যায়।এতে কোন সমস্যা হয় না!'

নিঝুম খুব আবেগপ্রবণ হয়ে গেল। তারপর ভেজা গলায় বললো,'আমি নিজে যাবো। কাল গিয়ে মাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবো এখানে।' আমি বললাম,'না তুমি যাবে না। আমি যাবো। আমার মাকে আমি নিজে গিয়ে নিয়ে আসবো।'নিঝুম আমার হাতটা আরো শক্ত করে চেপে ধরলো। তারপর বললো,'যাও আমরা সবাই মিলে যাবো।আমি, তুমি, ধূসর,ঝিনুক আমরা সবাই মিলে যাবো। মা দেখবে তখন খুব খুশি হবে! সবকিছু ভুলে যাবে। আমরা মার পা ছুঁয়ে মাপ চেয়ে নিবো।মা ঠিক আমাদের মাফ করে দিবেন!'

আমি অন্ধকারের ভেতরই আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা আঙুল তুলে বললাম,'ওই দেখো আলো।'

নিঝুম বললো,'কোথায়?'

আমি বললাম,'ওই যে তারাটাই।'

নিঝুম আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইল। তাকিয়েই রইলো।

'

                  ---সমাপ্ত---


মায়ের ভালোবাসার গল্প পড়ুন।