সংসারের গল্প
মেজো আপাকে ছোটবেলা থেকেই আমি বেশ অপছন্দ করতাম। ও সবসময় ক্লাসে প্রথম হত। বাবা মায়ের আদর্শ সন্তান। নাচের স্কুলে যায় প্রতি শনিবারে। শুক্রবার সকালে ওর গানের টিচার আসেন। সব ক্ষেত্রে ও সফল।
আমি মাঝে মাঝে হেসে বলতাম, “জীবনে কখনো সেকেন্ড না হলে বুঝবি কি করে ফার্স্ট হলে যে আলাদা আনন্দ হয়”।
ও কিছু বলতো না মিটমিট করে হাসতো।
মেজো আপার একহারা গড়ন। চোখে পরার মতন ছিপছিপে সুন্দর। আমার খুব হিংসে হতো ওকে দেখে। আমি ডানপিটে। দৌড়ে বেড়াই। হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা গুলোতে অনেক সময় এক থেকে দশের মধ্যে থাকি না। কিন্তু আমি ওর মতন দিন রাত বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে বসে থাকি না।
ছোটবেলায় ওকে আমার একই সঙ্গে খুব ভালো লাগত আবার খুব অপছন্দ ও করতাম। ওর দোষ ছিল বাড়ির সবাই ওকে একটু বাড়াবাড়ি রকমের পছন্দ করে। আর না করেই যাবে কোথায়? ওর সম্পর্কে একটা প্রচলিত কথা ছিল ও সাত চড়ে রা করে না।
আমার মেজো আপার নাম শবনম। ওকে কি কারণে আমি মেজো আপা ডাকি সেটার ও কিন্তু কোনো যুক্তি নেই। নাঈম ভাইয়া সবার বড়, শবনম আপা দ্বিতীয় আর আমি লুনা সবার ছোট।
আমি নাঈম ভাইয়াকে বড় ভাইয়া ডাকি। বড় আপু বলে ওকে সম্বোধন করাটা স্বাভাবিক ছিল। অথবা শবনম আপু। আমি সেই যে ওকে মেজো আপা ডাকা শুরু করলাম আমাদের সব কাজিনরা ওকে মেজো আপা ডাকা শুরু করল।
ও যখন মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলো একটু বিরক্তি নিয়েই আমাদের সবাইকে বলল ওকে অন্তত বড় আপু বা শবনম আপু ডাকতে। আমরা সবাই এক যোগে প্রতিবাদ করলাম। ততদিনে ও সবার মেজো আপা।
মেজো আপা স্কুল আর কলেজের পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলো। ওই ভালো ছাত্রী যা হয় আর কি ঢাকা মেডিকেল কলেজেও চান্স পেয়ে গেল। আমি তখন টানা হ্যাঁচড়া করে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা দিচ্ছি।
আম্মা আমার দিকে হতাশ চোখে তাকিয়ে থাকে। টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো না করলে ও আমি এস এস সিতে খুব ভালো রেজাল্ট করলাম।
মেজ আপা খুশি হলো সবচেয়ে বেশি। ওর টিউশনির টাকা দিয়ে আমাকে একটা খুব দামি জামা আর অয়েল পেইন্টিং এর সেট কিনে দিলো। আমার মাথায় তখন ছবি আঁকার ভূত চেপেছে।
আমার ধারণা ছিল আমার ভালো রেজাল্ট দেখে ও মনে মনে দুঃখ পাবে। কিন্তু ব্যাপার দেখা গেলো উল্টো।
ও সবাইকে বলল লুনাটা বরাবরই বেশি বুদ্ধিমতী । ওর বেশি পড়তে হয় না বলে সবাই ওকে ফাঁকিবাজ ভাবে। সেদিন আমি নিশ্চিত হলাম ও আসলে ও ভালো মানুষ। নয়তো মন থেকে খুশি হতে পারতো না। হিংসের কালো মেঘ ওর মুখ তখন ও অন্ধকার করেনি।
মেডিক্যালে থার্ড ইয়ারে পড়ার সময় আপার বিয়ে নিয়ে আত্মীয় স্বজনদের কানাঘুষা শুরু হলো। মেয়ের তো গায়ের রং শ্যামলা। এখন থেকেই বিয়ের পাত্র না দেখলে মেয়ে লাবণ্য নষ্ট হয়ে যাবে ইত্যাদি।
আমার চোখ খুলে গেলো হঠাৎ। এই যে ও এতো ভালো ছাত্রী ওর এতো গুন সব এক নিমিষে বাতিল হয়ে গেলো গায়ের রং শ্যামলা দেখে। অথচ ছোটবেলায় আমি ওর মতন করেই সাজতে চাইতাম। ও যখন ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক দিতো ওকে অন্যরকম দেখাতো। ওর কাজল টানা চোখ মায়ার আঁধার। অন্তত আমার তাই মনে হতো।
মেজো আপা মেডিকেল ফাইনাল ইয়ারে উঠে অবশ্য আম্মার দুশ্চিন্তা দূর করে দিল। আম্মার লক্ষি মেয়েকে নিয়ে বেশি চিন্তা করতে হলো না। ও ঠিকঠাক একজন রাজপুত্র নিয়ে
আসলেন।
শফিক ভাই রাজপুত্রই বটে। শফিক ভাই ইঞ্জিনিয়ার। ভালো চাকরি করেন। খুব মিষ্টি করে কথা বলেন। ওদের ঢাকায় নিজেদের বাড়ি আছে। মাঝারি গড়নের শফিক ভাইয়ের এক মাথা কালো চুল আর ফর্সা গায়ের রং।
বাড়ির সবাই হাফ ছেড়ে বাঁচল। আত্মীয় স্বজন যারা এতদিন মুখ রোচক গল্পের অপেক্ষায় ছিল তারা একটু বেজার হলো। মেজ আপার বিয়ের সুবাদে ওকে কিছু কটু কথা শোনাতে পারত সেটা থেকে বঞ্চিত হল এজন্যে হয়ত।
আমার অবশ্য মনে হতো মেজো আপা তমাল ভাইকে পছন্দ করে। ছাত্র অবস্থা থেকে রাজনীতিতে জড়িত তমাল ভাই আমাদের পড়শী ছিলেন। আমাদের বাড়ির উল্টো দিকে বাসা। শ্যামলা লম্বা তমাল ভাইকে দেখলে মেজো আপার মুখ বাড়াবাড়ি রকমের উজ্জ্বল হয়ে যেত।
পরে অবশ্য জেনেছিলাম আমার ধারণা ঠিক ছিল। আম্মার চোখ রাঙানি খেয়ে মেজো আপা আর তমাল ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেনি। ভালো মেয়েরা এমনই হয়।
যথা সময়ে ধুম ধাম করে আপার বিয়ে হলো। সারা বাড়িতে নীল রঙের মরিচ বাতি লাগানো হলো। মেজো আপার প্রিয় রং নীল। আমি ফাজলামি করে আম্মাকে বললাম দুলাভাইকে আমি নীল গোলানো শরবত খাওয়াবো। মেজো আপার এতো নীল রং পছন্দ।
মেজো আপা সেদিন একটু রাগ করলো আমার সাথে বলল," লুনা তোর সব ব্যাপারে ফাজলামি।"
মেজো আপা এই বাড়ি ছেড়ে যাবার পর বুঝলাম ও আসলে আমার কত প্রিয়। হয়তো বিকাল বেলায় ফুচকা নিয়ে ফিরেছি। ওর জন্যে বাড়তি টক এনেছি। ভুল করে ওর ঘরে ঢুকেছি। পরে মনে হয়েছে ও আর এই বাড়িতে থাকে না।
বেলি ফুলের মালা নিয়ে ওর ঘরে ঢুকেছি। আমার মনেই নেই ও এ বাড়িতে থাকে না। মা অবশ্য ওর ঘরটা যেমন ছিল তেমন ভাবেই গুছিয়ে রেখেছে। বিয়ের পরে প্রথমবার যখন বেড়াতে এলো আমি খেয়াল করলাম ও আগে যেমন মোটা করে কাজল দিত সেভাবে আর দেয়নি।
নিচের চোখের কোলে হালকা কাজল, শাড়িটার আঁচল আবার অন্য কাঁধে উঠিয়ে পরেছে। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম কপালের টিপ কোথায়? আপা বলল ও বাড়ির লোকে নাকি টিপ পরা পছন্দ করে না।
এর পরে ধীরে ধীরে ওর অনেক পরিবর্তন আসল। আমরা সবাই মিলে কক্সেস বাজার গেলাম। ও আসতে পারলো না । ওর নাকি খালাতো ননদের বিয়ে। আমি আমার বন্ধুদের সঙ্গে মালয়েশিয়া যাচ্ছি বেড়াতে। ওর তখন পাঁচ মাসের প্রেগন্যান্সি। আমার সঙ্গে যাবার প্রশ্নই আসে না।
একটু একটু করে আমাদের সংযোগ কেটে গেলো। আমি বছর তিনেক পরে আর ওকে মিস করতাম না। ওর সঙ্গে দেখা হতো পালা পার্বনে। বা কারো বিয়েতে। মাসে একবার বাড়ি আসতো। তখন হয়তো আড্ডা হতো। কিন্তু আমি আগের মতো আর ওকে ফোন করতাম না।
এমনি তে ও আম্মার টুকটাক কথা কানে আসে। যে কারণে শফিক ভাইদের পরিবারকে আমার খুব সুবিধার মনে হয় না। মেজো আপার কোন মামা শ্বশুর নাকি ওর মুখের ওপর বলেছে কালো মানুষের হাতের রান্না খেতে তার ভালো লাগে না। আবার ওদের বাড়ির লোকেদের জন্য নাকি আলাদা করে ইফতারির বাজার করে পাঠাতে হবে।
প্রতি ঈদে মা ওদের বাড়িতে শপিং করে পাঠায়। আমার মন খারাপ হয়। আমি জানি মা তার মেয়ের শ্যামলা গায়ের রং পুষিয়ে দেবার জন্য এতো সব চেষ্টা করেন। আহারে বেচারা আপা যেন ডিমের খোসার ওপরে হাটছে সবসময়। পা ফসকালেই ডিম ভেঙে যাবে এমন কিছু।
গত সপ্তাহে আপা বেড়াতে এসেছে। সঙ্গে ওর দুই কন্যা। দুই জনই শান্ত শিষ্ট। হবেই বা না কেন? ওদের মা তার ডাক্তারি পেশা ছেড়ে এখন পুরোপুরি গৃহিনী। দুই মেয়ে মানুষ করছে। ওদের দাদা বাড়ির লোকে চাপা গর্ব করে বাবার মতন গায়ের রং পেয়েছে দুই কন্যা।
মেজো আপা সেদিন এসে আম্মার ঘরে আলাদা করে কথা বলল। আম্মা আমাকে ডেকে কিছুক্ষন পরে একটা বায়ো ডেটা ধরিয়ে দিলেন। মেজো আপার চাচাতো দেবরের বিয়ের প্রস্তাব এসেছে আমার জন্যে। আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বায়ো ডেটা পড়লাম। বায়ো ডেটা পড়ে রাগে আমার শরীর জলে গেলো। ওদের পরিবারের সব সদস্যদের প্রফেশন লেখা আছে শুধু আমার ডাক্তার আপার পেশা সম্বন্ধে লেখা নেই।
আমি আম্মাকে বললাম," যারা তোমার মেয়েকে এতো বড় অপমান করল তুমি তাদের সঙ্গে সম্বন্ধ করবে না। আর আপাকে কিছু বলার দরকার নেই। তুমি বলবে আমার নিজের পছন্দ আছে।"
আম্মা বলল," আমার চোখে পরেনি । আর শবনম ও কিছু বলেনি।"
আমার অনেক রাগ হলো। ভাবলাম একবার বলি ওর কোনো কিছুই তোমার চোখে পরেনি । তোমার মন রাখতে গিয়ে ওর এমন রূপান্তর হয়েছে যে আমি ওকে আর চিনতে পারি না।
গভীর রাতে সেদিন ঘুম ভেঙে গেল। মেজো আপা বারান্দার গ্রিল ধরে বাইরে দেখছে। আবছা আলোয় মনে হলো ওর গাল দুটো ভেজা। আমি ওর কাছে গেলাম না। ওর দীর্ঘশ্বাস বুঝি অনন্ত নক্ষত্র বীথিতে মিলিয়ে যায়। আর দিনের বেলা ঠিক ভালো মেয়ের ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় করে মেজো আপা।
সমাপ্ত
মেজো আপা
ছোট গল্প
ফারহানা সিনথিয়া