রহস্যময়ী নারী
মাঝরাতে মিরার ডাক শুনলাম জানালার পাশে,
- 'এই, একটু আসবা বাইরে?'
আমি তো নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারলাম না। মিরা আমায় ডাকছে, এও কি সম্ভব? তাও আবার মাঝরাতে? নিজের কাছেই ব্যাপারটা স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিলো।
তবুও সেই স্বপ্নকে ছুঁতেই দরজা খুলে বেরিয়ে গেলাম বাইরে।
মিরা আমাদের প্রতিবেশী, দু'মাস হলো ভাড়া এসেছে আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে। আমি খুবই ভদ্র টাইপের ছেলে, দু'সেকেন্ডের বেশি কোনো মেয়ের দিকে তাকাতে পারি না। মিরার দিকে ঝাড়া দশ মিনিট তাকিয়ে রইলাম। এত্তো সুন্দর মেয়েটা! ওকে না পেলে যে জীবন বৃথা।
কিন্তু, ওকে মনের কথাটা কিভাবে বলি? ছোট বোন-টোনও নাই কোনো যে কোনোরকম ম্যাসেজ পাঠাবো বা মোবাইল নাম্বার-এফবি আইডি জেনে নিবো। শেষমেষ ঠিক করলাম নিজেরই কিছু করতে হবে।
মিরা বিকেলে ছাদে যায় ফুল গাছে পানি দিতে। আমিও গেলাম একদিন। গিয়ে এপাশ-ওপাশ করি, হাঁটাহাঁটি করি, মিরার সামনে যেতে পারিনা। শেষে একবুক সাহস সঞ্চয় করে মিরার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। অনেক কষ্টে মুখটা খুললাম। কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোলো না। কি বলবো বুঝতে পারছি না।
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিজের সমস্ত সাহস এক করে বুকভরে শ্বাস নিয়ে শেষে বললাম,
- 'পানি দেন গাছে?'
মিরা বিরক্তি নিয়ে ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
- 'জ্বি, পানি দেই।'
ব্যস, মিরার সাথে কথা বলার আমার ওখানেই শেষ। মাথা নিচু করে চলে আসলাম নিচে। আর কোনোদিন মিরার সামনে যাইনি।
সেই মিরাই আজ রাতে আমায় ডাকতে এসেছে। কি অদ্ভুত না?
মিরা চুপচাপ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে। আমি মিরার পিছুপিছু উঠে পড়লাম ছাদে। মাঝরাত, পুরো শহর ঘুমের দেশে পাড়ি দিয়েছে, নিঝুম হয়ে আছে চারদিক। ছাদটা জোছনার আলোয় ভেসে যাচ্ছে। ছাদে উঠেই মিরা আমার দিকে তাকালো। চাঁদের আলোয় কি যে অপূর্ব লাগছে ওকে দেখতে!
মিরা ছাদের কিনারে গিয়ে বসলো। আমি বসলাম তার পাশে।
মিরা আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
- 'তোমায় একটা গল্প বলি?'
আমি বললাম,
- 'বলো।'
- 'তুমি কি জানো, পৃথিবীতে এমন অনেক জীব আছে, যাদের সম্পর্কে মানুষ কিচ্ছু জানে না, দেখতেও পারে না।'
- 'জানি।'
- 'সেই জীবদের মধ্যেই এক প্রকার আছে, যারা গভীর রাতে মানুষকে ডাকে, তাদের প্রিয় মানুষের কণ্ঠ নকল করে। সেই জীবটা ডাকে একবার, দুবার, কিন্তু তিনবার ডাকতে পারে না। কেউ যদি তিনবারের আগেই ডাকের উত্তর দিয়ে দেয়, তবে সে ফাঁদে পড়ে যায় জীবটার। জীবটা তখন লোকটার প্রিয় মানুষের রুপ ধরে নিয়ে লোকটাকে আকর্ষণ করতে থাকে, তাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে যেতে থাকে কোথাও। মজার ব্যাপার, সেই প্রিয় মানুষকে ঐ লোকটা ছাড়া আর কেউ দেখতে পারে না। এরপর জীবটা ঐ লোকটাকে নিয়ে যায় বিপদজনক কোনো জায়গায়। শেষে, তার জীবন নিয়ে নেয়।'
আমি মিরার দিকে তাকিয়ে রইলাম। কিছু বললাম না।
মিরা বলতে থাকলো,
- 'এই ছাদের ঐ সাইডে রেলিং দেয়া নেই। আমি এখন ঐ ধার দিয়ে হেঁটে যাবো। তুমি আসবে আমার পিছুপিছু। এরপর একসময় আমি ছাদের ধার ছেড়ে আরো সামনে চলে যাবো।তুমিও আমার পিছু নিবে। তোমার লাশটা পড়ে থাকবে নিচে।'
মিরা উঠে দাঁড়ালো। আমিও দাঁড়ালাম। মিরার পিছে পিছে হাঁটতে থাকলাম। মিরা ছাদের ধারে চলে গেল। আরেক পা এগোলেই ছাদের শেষ, এরপর শূন্যতা।
আমি এসময়েই ডাকলাম,
- 'একটু শুনবেন?'
মিরা অবাক হয়ে তাকালো।
আমি বললাম,
- 'আপনি আমাকে নিশির ডাকের গল্প শুনিয়েছেন। এ গল্প আমি জানি। তিন ডাকের কথাও আমি জানি। আপনি প্রথমবার ডাকতেই আমি বুঝেছিলাম আপনি মিরা নন, তবুও আপনার পিছু নিয়েছি। কেন, জানেন?'
মিরা মাথা নাড়লো।
- 'কারণ, আমি মিরাকে শেষবারের মতো দেখতে চাচ্ছিলাম। আমি জানতাম, মিরা কোনোভাবেই আমার হবে না। আজ বিকেলে ওকে এক ছেলের সাথে হাত ধরাধরি করে হাঁটতে দেখেছি আমি। এরপর থেকে আমার মন ভেঙে গেছে। আমি চাইছিলাম একবার, শুধু একবার মিরার সাথে কথা বলতে। আপনি ডাকতেই আমি বুঝলাম সে সুযোগ আমি পাবো। হোক নকল মিরা, তবুও মিরা তো। আমার আর দুঃখ নেই। আপনি এখন যেখানে নিয়ে যেতে চাইবেন আমাকে, আমি সেখানেই যাবো।'
মিরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। এরপর উধাও হয়ে গেল।
এরপর থেকে, প্রতিরাতেই মিরা আসে আমার কাছে, মিষ্টি করে ডাকে। আমি এক ডাকেই তার পিছু নেই। ছাদে বসে সারারাত গল্প করি আমরা। ভোরের আলো ফুটতেই মিরা বিদায় নেয়।
আমাদের রাতগুলো এভাবেই কেটে যায়।
সমাপ্ত....
ছোটগল্প- নৈশবাস
লেখা-সোয়েব বাশার