বাবা মানে পৃথিবী | বাবা মানে হাজার বিকেল

 বাবাকে নিয়ে স্ট্যাটাস

বাবাকে নিয়ে স্ট্যাটাস

-আব্বা আপনি একটা খান!

-নারে বাজান আমার মুখে পান।


আমার কেন যেন মনে হল আব্বা ইচ্ছে করেই মুখে পানের বাহানায় আমার রসগোল্লা বা কালোজাম কোনটাতেই ভাগ বসালেন না।নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা নামের বটবৃক্ষগুলো প্রচুর অভিনয় জানেন।


আমি আমার প্রিয় কালোজাম ও রসগোল্লা খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুললাম!

আহ!রসগোল্লা তো নয় যেন ঘি খেলাম!

এখনো হাতে ঘ্রান লেগে আছে।


-আব্বা!আমার হাত শুঁকেন!কি সুন্দর ঘিয়ের ঘ্রান-না?


বাবা আমার হাত শুঁকে বলেন-হুম!


-আব্বা আপনার রসগোল্লা খেতে মন চায় না?

-নাহ!রসগোল্লা হলো ছোটদের খাবার-বড়রা খাওয়া ঠিক না।


আমি বহুদিন তা-ই জানতাম;রসগোল্লা  ছোটদের খাবার!


রসগোল্লা ছোটদের খাবার কিনা ঠিক জানিনা কিন্তু এটা বড়লোকের খাবার এটা জেনে গেছি।গরীবের জন্য জিলাপি!


দুইটা রসগোল্লা আট আনা!সোজা কথা?

সের হিসাবে কিনলে রসগোল্লা পাঁচ টাকা, আর জিলাপি তিন টাকা সের।


এটা ১৯৬৮ সালের কোন এক বসন্ত প্রভাতের কথা!তখন রোববার সাপ্তাহিক ছুটি থাকত!


বাবার সাথে মিরপুর শাহ আলী(রঃ)

মাজার শরীফের ঢালের একটু আগে সরকারী কাঁচা বাজারে গেছি বাজার করতে।সাপ্তাহিক বাজার।


বাবার কাঁধে একটা ভার তাতে এক কাদি সাগর কলা,আমার হাতে আমাদের পালের সবচাইতে সুন্দর,নাদুসনুদুস মোরগটা।মোরগের দু'পা পাটের সুতলি দিয়ে বাঁধা।মাঝে মধ্যেই মোরগটা ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করছে!


বাসা থেকে যাওয়ার পথে বদমাশ মোরগ কোন মুরগী দেখলেই ছটফট করে উঠেছে কিংবা আমার হাতে থেকেই ডেকে উঠেছে-

-কুক্কুরুক কুউক!কুক্কুরুক কুউক!


আমি আর বাবা কলার কাদি আর মোরগ বেচার জন্য বসে আছি…বেচা হলে আগে আমারে রসগোল্লা খাওয়াবেন,নাপিতের কাছে চুল কাটাবেন-তারপর বাজার সওদা করে বাড়ি যাব।


ঘন্টা দুয়েক পর কলার কাদি চার টাকা আর মোরগ তিন টাকায় বিক্রি হয়ে গেল!

খোলা কাঁচাবাজারে বসে থাকতে থাকতে সকালের রোদে কপাল ঘেমে উঠল।আমি কপালের ঘাম মুছি আর বিরক্ত হই।


-কপাল ঘামলে বউ আদর করে!


আমি লজ্জা পাই-আব্বা!


বাবা আফসোস করে বলতে লাগলেন

-মোরগটা পাঁচ টাকায় বেচতে পারলে মোটামুটি বেড় পাওয়া যেত।


বাবা বোধহয় বাজেট সংকটে আছেন।

বাবার হাতে ব্যালেন্স এখন সাড়ে ছয় টাকা।আট আনার গল্পতো শুরুতেই করেছি।


আমি মনের আনন্দে বাবার বুড়ো আঙ্গুল ধরে হাঁটছি।এই গলি ওই গলি ঘুরে নাপিত গলিতে পৌঁছুলাম।

বাবার ইচ্ছা আমার চুল বাটিছাঁট দেওয়া,আমি স্কয়ার ছাঁট দেয়ার পক্ষে।

অতঃপর শীল বাবু আমার চুলে স্কয়ার ছাঁট দিয়ে দিলেন।


সারা গায়ে ছোটছোট চুল লেগে আছে।কিছুক্ষন পরপর কুটকুট করে কামড়ায়।ক্যারোলিন সার্টে ছোট ছোট অসংখ্য চুল।মাথা ওয়াশ ছিল সেই আমলে এক বিরল বস্তু।


ওসব বাড়িতে গিয়ে কর।সেলুনে মাথা ওয়াশের প্রচলন তখন ছিল কিনা তাও জানিনা…!আমার কখনো সেলুনে চুল কাটানো হয় নাই;হয় পাড়ার ভিতর-'অ্যাই চুল কাটাবেন,চুল'?বলে ডেকে যাওয়া ভ্রাম্যমান নরসুন্দর,অথবা বাজার সংলগ্ন ফুটপাথ কিংবা খালি জায়গায় বসা শীলবাবুরা জলচৌকিতে বসিয়ে চুল কেটে দিতেন।


সামনে কাঠের ছোট লাঠিতে বাঁধা থাকত বেলজিয়াম কাঁচের অতি সস্তা আয়না।

সেই আয়নার আবার পেছনের পারদ বা পায়রা উঠে গেছে অনেক আগেই।

আয়নায় নিজের চেহারার চাইতে আয়নার পেছনের বস্তুকে ভাল দেখা যেত।


আরো আট আনা চলে গেল আমার পেছনে।অথচ ন্যাড়া করলে বাবার ভাষায় গর্দান মোটা হত;চুল ও মাথার স্বাস্থ্য ভাল থাকত,উপরন্ত চার আনা পয়সা বেঁচে যেত!


কত দোকান ঘুরে ঘুরে যে বাবা মাছ কিনতেন মেজাজ খারাপ হয়ে যেত।

তারপর কাঁচা তরকারি,যেসব আমাদের ক্ষেতে চাষ হতনা সেগুলো কিনে দুই হাতে দুই পাটের ব্যাগ ভরে আব্বা হেঁটেই বাড়ি রওনা দিলেন।


দুই হাতে তার কম করে হলেও আধ মণ ওজনের বাজার সদাই।

বাজারে কিছুক্ষন পরপর-'লাগে মিনতি,লাগে মিনতি' বলে খালি ঝাঁকা নিয়ে এক শ্রেনীর লোক হাঁকডাক করছিল।এরা টাকার বিনিময়ে মাথায় করে দুরদুরান্তে মাল পরিবহন করে থাকে।


মিরপুর মাজার থেকে কাজিপাড়া আধমন মাল নিতে এক টাকা চায়।বাবা অনেকক্ষন খেঁচাখেঁচি করলেন।


-আট আনায় যাইবা মিয়ারা?


মিয়ারা কেউ রাজি হল না।তিনি রাগে গজগজ করছেন আর খানিক পরপর ব্যাগ দু'টো রাস্তার পাশে নামিয়ে দম নিচ্ছেন।আমিও বাবার পিছনে পিছনে হাঁটছি।


অর্ধেক পথ গিয়ে ডান হাতের ব্যাগের কয়রা ছিঁড়ে গেল।বাবা ক্লান্তিতে রাস্তায় বসে পড়লেন।আম্মার উপর গরম তিনি।


-মূর্খ্য মহিলা!বলছিলাম ব্যাগের কয়রা গুলো একটু চেক করে রাখতে-রাখে নাই।


ছেঁড়া কয়রা ভাল কয়রার সাথে গিট্টু দিয়ে বিশেষ কায়দায় পথ চলছেন তিনি।


আহারে আমার বাবা!এই যে পয়সা বাঁচানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা তিনি করছেন-এসব কার জন্য?তার জন্য?

অবশ্যই না।

তিনি আমাদের চার ভাইবোনের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য নিরন্তর খেঁটে যান……


তার শরীর ঘেমে নেয়ে উঠে।তার ঘামের গন্ধ আমার কাছে সুগন্ধি আতরের মত লাগছে!

বাজারে তার ভারের লাঠিটা হারিয়ে ফেলেছেন-নইলে ভারের দুই মাথায় দুইটা ব্যাগ ঝুলিয়ে কখন বাড়ি পৌঁছে যেতেন।


এক সময় কচ্ছপের মত ধীর পায়ে পথ চলতে চলতে বাবা কাজিপাড়া চলে এলেন!


আমার বড় বোন মীনা,ছোট দুইবোন সাজু,বিউটি চিৎকার করে উঠল।


-আব্বা আইছে রে!আব্বা আইছে রে!


বাবা তার তিন কন্যার হাতে চুল বাঁধার ক্লিপ,রঙ্গীন ফিতা আর একগোছা করে কাঁচের চুড়ি ধরিয়ে দেন।তিন কন্যা খুশিতে আটখানা।সবার জন্য আধা সের রঙ্গীন মুরালি!


সবশেষে আমার জন্য প্লাস্টিকের বাঁশি!

কখন কিনলেন এই বাঁশি?আমি বাঁশিতে ফুঁ দেই আর চিৎকার করি-'ডেলি ডেলি রবিবারটা ক্যান আসে নারে………'!


বাবার পথশ্রম সার্থক!পুত্র কন্যাদের এই স্বর্গীয় আনন্দে বাবা গুনগুন করে গাইছেন-'আমার ঘরখানায় কে বিরাজ করে…'!


                      শেষ~


-রসগোল্লা             

-লেখনীতে_সাইফুল_আলম


এমন আরও বাবা ও মায়ের গল্প পড়ুন।