বাস্তব জীবনের কিছু গল্প
আপনি কখনো সন্তান নিতে পারবেন না। আচ্ছা এই শর্তে আপনার কোন আপত্তি নেই তো?
আমি আশ্চর্য হয়ে তাকালাম লোকটার দিকে। তার নাম ছাবেত চৌধুরী। কিছুক্ষণ আগে তিনি আর তাঁর এক খালা আমাকে দেখতে এসেছেন। তিনি যখন বললেন, আমার সাথে আলাদা কথা বলতে চান তখন দেখলাম বুন্দি ফুফুর মুখ শুকিয়ে গেছে। সে ব্যাপারটা কাটিয়ে যেতে চেয়েছিলো, সে কিছুতেই চাইছিলো না পাত্র আমার সাথে আলাদা করে কথা বলুক।
আমার বাবা বললেন, দু'জনে আলাদা কথা বলাই ভালো, জানাশোনা হবে। বাবার কথা টপকিয়ে বুন্দি ফুপু তার কথা জোড়ালো করতে পারলো না। তাই ছাদে দু'টো চেয়ার দেয়া হলো যেন আমরা কথা বলতে পারি।
আমাদের দুই রুমের বাসা আর ছোট একটা ডাইনিং স্পেস। ঘরের ভেতরে ঠাসাঠাসি অবস্থা। তাই পাঁচ তলা থেকে বেয়ে বেয়ে সাত তলার ছাদে উঠলাম। ছাবেত সাহেবের মনে হয় কষ্ট হলো। বয়স চল্লিশের মধ্যে হবে লোকটার। এই বয়সে সিঁড়ি বাইতে কষ্ট হবার কথা না কিন্তু তার মনে হয় অভ্যাস নেই। গাড়িতে চড়ে এসেছেন, সব সময় লিফটে উঠানামা করেন হয়তো। যাকে বলে একেবারে আয়েশী জীবন। বুন্দি ফুফু আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। তাঁকে ছোটখাটো ঘটক বলা যায়।বুন্দি ফুফু এর আগেও আমার জন্য কয়েকটা বিয়ের প্রস্তাব এনেছে। প্রতিবারই কিছু না কিছু সমস্যার কারণে কথা আর সামনের দিকে আগায়নি।আমি পড়াশোনায় মোটামুটি, এখনো শেষ হয়নি, তিন বাসায় গিয়ে তিনটা বাচ্চাকে পড়াই, যন্ত্রের মতো জীবন। পড়া শেষ করে কোন চাকরির চেষ্টা করবো।
বুন্দি ফুফুর মতে খুব সহজে বিয়ে হওয়ার মতো কোন যোগ্যতা আমার নেই, সে বলে "দেখতেও তো তুই আহামরি কিছু না, বাপেরও টাকা পয়সা নেই তাহলে কি দেখে তোর বিয়ে হবে?"
বুন্দি ফুফুর কথাটা আমার মাথায় গেঁথে গেছে। আমারো তাই মনে হয়। তাই আমি এই ব্যাপারটা মেলাতে পারছি না, বুন্দি ফুফু আমার জন্য এত ভালো একটা প্রস্তাব এনেছে! আমার মতো একজনকে ছাবেত সাহেবের তো বিয়ে করার কথা নয়, যদি..
আমার ভাবনায় ছেদ পড়লো। ছাবেত বললেন-
–আপনি কিছু বলছেন না যে?
আমি কি উত্তর দেবো বুঝতে পারছি না। আসলে বিয়ের আগেই এই সব নিয়ে কথা বলাটা আমাকে কেমন যেন অস্বস্তি দিচ্ছে।
তিনি আবার বললেন-
–আপনার ফুপু বলেছেন, আমার শর্তে রাজি আছেন আপনারা, তাই তো দেখতে আসা। সব কথা তো হয়েই গেছে। এখন কথা বলতে চাইলাম দুজনে দুজনকে একটু জানাশোনার জন্য।
এবার মুখ একটু তুলে বললাম -
–আমি আসলে কোন শর্তের কথা জানি না।
ছাবেত আশ্চর্য হয়ে বললেন-
–কি বলেন? তাহলে আপনার ফুপু যে বললেন সব কিছু বলা হয়েছে!
আচ্ছা আমিই তাহলে সব কিছু ক্লিয়ার করে বলছি।
আমার ছেলের বয়স তিন বছর। ওর মা নেই। আমার সেকেন্ড বিয়ে করতে চাওয়া মূলতঃ ছেলের জন্যই। মা হয়ে ওকে দেখাশোনা করবে আর আদর স্নেহে বড় করে তুলবে- এমন একজনকেই খুঁজছি। কিন্তু..
আমার মতো মেয়েকে বিয়ে করতে চাওয়ার পেছনে আমার মনে যেই, "যদি … প্রশ্নটা" এসেছিলো তার উত্তর পেয়ে গেলাম। আমার মতো মেয়েকে বিয়ে করতে আগ্রহের কারণ বুঝতে পারলাম। ডিভোর্স হয়ে যাওয়া, বৌ মরে যাওয়া, বয়ষ্ক পুরুষ এমন পাত্ররাই আমাদের মতো ফ্যামেলির মেয়েকে বিয়ে করতে চায়। অনেকটা ভৃত্যের মতো দায়িত্ব পালন করানোর জন্য। আগেকার দিনে দাসী হিসেবে নেয়া হতো আধুনিক কালে বিয়ে নামক বন্ধন লাগিয়ে।এই সব মেয়েদের উত্তম সজ্জাসঙ্গী, কাজে পটু আর সন্তান পালনে দক্ষ হতে হয়। এখানে পাত্রী দেখতে কেমন, বাবার অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন সেটা খুব একটা দেখা হয় না। এমন মেয়েদের খুব অসহায় মনে করা হয়। যারা যে কোন কিছু মেনে নিয়ে নীরবে সংসার করবে।
আমার অজান্তেই আমার কপাল কুঁচকে গেলো।
আমার কপাল কুঁচকানো দেখে সে চুপ করে গেলো, কথা শেষ করলো না আমার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো আমার মনোভাব। আমি কপাল ঠিক করে একটু হাসি হাসি মুখ করতে চেষ্টা করলাম। মাথা তুলে তাকালাম। শত হলেও অভাবে জর্জরিত কন্যাদায়গ্রস্থ পিতার কন্যা আমি। এমন সুপাত্রের সামনে আমার কপাল কুঁচকানো মানায় না!
আমার অস্বস্তি ভাবটা এখন কেটে গেছে পুরোপুরি। শুনেই দেখি কি বলে লোকটা।
আমি বললাম-
–কিন্তু কি?
–আপনি দেখছি কিছুই জানেন না, ব্যাপারটা কেমন হলো না?
–সমস্যা নেই আপনি বলুন ।
–আমার ছেলে আমার জান, আমার পৃথিবী। ওর কোন সৎ ভাই-বোন হোক সেটা কিছুতেই চাই না আমি। ওর অযত্ন, অবহেলা আমি সহ্য করতে পারবো না। তাই যাকে বিয়ে করবো সে কখনো সন্তান নিতে পারবে না।
হঠাৎ আমার কেমন যেন অনুভূতি হলো। এত ছোট একটা বাচ্চার মা নেই মনে হতেই কষ্ট হলো। কিন্তু কোন শর্ত দিয়ে সম্পর্কের শুরু হলে সেটা কতটা ভালো হবে?
নিজের মনকে কিছুটা সামলে বললাম -
–আপনি সরাসরি আমার কাছে বললেন আপনার শর্তের কথা - এটা শুনে খুব ভালো লাগলো। বিয়ের পরে নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়ে আটকে ফেলতে, অনেকেই কিছু না জানিয়ে ছলনা করে বিয়ে করে। আপনি তেমন না । তবে ,
বিয়ের পরে দেখা যায় কত মেয়ের সন্তান হয় না। একটা সন্তানের জন্য কত কিছুই না করে। এটা তো আর নিজেদের হাতে নেই, সৃষ্টিকর্তা চাইলে দেবেন। তবে প্রতিটা নারী মাতৃত্বের স্বাদ পেতে চায়। অন্যের সন্তানকে তাই বলে ভালোবাসবো না, সেটা তো নয় কিন্তু নিজের দেহের ভেতরে ভ্রুণ থেকে শুরু করে জন্ম পর্যন্ত সময়ের স্রোতে ভেসে শীতলতা অনুভব করতে চায় একজন নারী। স্বাভাবিক ভাবেই আমার ভেতরেও এই স্বপ্ন লালায়িত।
–তাহলে আপনি রাজি নন?
–আসলে হঠাৎ করে শর্তের কথা জানতে পারলাম তো, ভাববার জন্য একটু সময় দিতে হবে , বাসায় সবার সাথে আলোচনা করতে হবে।
–অবশ্যই। আরেকটা কথা বলার আছে।
–জ্বী বলুন।
–অনেক সময় অসাবধানতায় কনসিভ হয়ে যায় তখন আরো বেশি সমস্যায় পড়তে হবে । তাই আমি আপনাকে জানিয়ে রাখছি- বিয়ের পরেই আপনার লাইগেশন করে ফেলতে হবে। খুব ছোট্ট একটা অপারেশন, কোন জটিলতা নেই, কোন সমস্যা হবে না। সব চাইতে বড় হসপিটালে অপারেশন করাবো।
এই কথাটা সহ্য করা আমার পক্ষে কঠিন হয়ে গেলো। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম -
–এই কথাটাও বুন্দি ফুফু জানে?
–জানে। তাকে সব কিছু খুলে বলেছি, তাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা এডভান্স ও করেছি কিন্তু সে কেন আপনাদের কাছে গোপন করলো বুঝতে পারছি না। সে বলেছিলো আপনাদের পক্ষ থেকে কোন আপত্তি নেই।
আমি বললাম -
–কোন দিন আপনি আর সন্তান চান না, আপনার ছেলের ভবিষ্যতের সুখের কথা চিন্তা করে, তাহলে সেই জন্য ব্যবস্থাটা আপনাকেই নেয়া উচিত না?
–মানে?
–আমার জানা মতে, সন্তান না নিতে চাইলে পুরুষরাও অপারেশন করে বন্ধ্যাকরণ বা ভ্যাসেকটমি করতে পারে । তো আপনিও তো বন্ধ্যা হতে পারেন। তাহলে আপনি যাকে বিয়ে করবেন তাকে এই অপারেশনের ভেতর দিয়ে যেতে হবে না। সন্তান যেহেতু আপনি চান না তো ব্যবস্থা আপনাকেই নেয়া উচিত না?
ছাবেত উত্তেজিত হয়ে গেলেন-
–কি? আমাকে বন্ধ্যা হতে বলছেন?
আমার সাথে বিয়ে হলে আপনি কতটা সুখে থাকবেন বুঝতে পারছেন? কোন কিছুর অভাব হবে না, আপনার বাবা-মায়ের দায়িত্বও আমার। সেই সব কিছু তো আপনার ফুফুকে বলেছি।
–আমার মতো আনম্যারেড মেয়েকে লাইগেশন করানোর কথা বলতে পারছেন, এর কারণ আমি এক দরিদ্র পিতার মেয়ে বলে। কেন পৃথিবীর সমস্ত সৎ মায়েদের কি বন্ধ্যা হতে হয়? তাদের কি সন্তান হয় না?আমি মানছি অনেক সৎ মা অনেক অত্যাচার করে, নিজের সন্তান মনে করে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এমনটাই দেখা যায় তাই তো সৎ মায়েদের নামটা এত কলুষিত। কিন্তু সবাই তো এক রকম না। এমন অনেক সৎ মা আছে যে দেখলে মনেই হবে না হয় সৎ মা, সৎ সন্তানকে অসম্ভব ভালোবাসে, নিজের ইচ্ছেতেই কখনো সন্তান নেয় না আর ।
জীবনে ভালো ভাবে বেঁচে থাকতে অবশ্যই টাকার প্রয়োজন কিন্তু আমি মনে করি শাক ভাত খেয়ে মনে শান্তি নিয়ে প্রতিদিন সুখনিদ্রা যাওয়াই জীবনের সব চাইতে বড় সুখ।
–আপনি কি আমাকে অপমান করছেন?
–ছি ছি অপমান করবো কেন? সমস্যা বাঁধিয়েছে বুন্দি ফুফু।এবার চলুন যাই। বুন্দি ফুফুকে গিয়ে না হয় সব কিছু জিজ্ঞেস করি।
বুন্দি ফুফুর উপর ছাবেত আর তার খালা খুব রাগ দেখালো আর বললো খুব তাড়াতাড়ি সব টাকা ফেরত দিতে, না হলে খুব খারাপ হবে।
বাবা বুন্দি ফুফুকে বাসা থেকে চলে যেতে বললেন। কোন দিন যেন আমাদের বাসায় না আসে সেটাও বলে দিলেন।
বুন্দি ফুফু ফোঁস ফোঁস করতে করতে বেরিয়ে গেলো।
চলে যাবার আগে বাবা ছাবেতকে বললেন-
–আপনার শুধু প্রথম শর্তটা থাকলে হয়তো সমস্যা ছিলো না মানা যেতো কিন্তু দ্বিতীয় শর্তটা মানা অসম্ভব। আপনি যেমন আপনার সন্তানের ভালোর কথা চিন্তা করছেন আমিও আমার সন্তানের ভালোর কথাই চিন্তা করছি।অভাব মানুষকে কত কিছু বাধ্য করায়।আপনার অনেক টাকা আছে, আপনার শর্ত মানা মেয়ে হয়তো পেয়েও যাবেন। কিন্তু আমার মেয়ে হয়তো সেই মেয়ে না।
(সমাপ্ত)
ছোট গল্প
-শর্ত
-ফাহমিদা_লাইজু