অবহেলা কষ্টের গল্প
দেখ, দেখ স্বামী মারা গেছে চব্বিশ ঘণ্টা হয়নি অথচ চোখে এক ফোঁটা পানিও নেই।"
প্রতিবেশীদের ফিসফিসানি কানে আসতেই লতা চমকে উঠে। নিজের অজান্তেই হাত দুটো চলে যায় চোখের কোণে। তাইতো!
এই প্রথম সে টের পায় তার চোখ দুটো আসলেই শুকনো । প্রায় বোধহীন, বোবা মুখে বসে থাকা সদ্য বিধবা ত্রিশ পেরোনো লতা লজ্জায় ভেতরে ভেতরে আরও চুপসে যায়।
হারুন সাহেব মারা গেছেন চব্বিশ ঘণ্টা পার হয়নি। এখন তো তার শোকে দুঃখে আছাড়পিছাড় দিয়েই কাঁদবারই কথা ছিল! লোকজন সেটাই আশা করেছিলেন । অথচ তার চোখে পানি নেই। হয়তো দেখেও খুব বেশি শোকাতুর লাগছে না তাকে। ব্যাপারটা যে খুব স্বাভাবিক নয় সেটা পর্যন্ত এতক্ষণ লতা বুঝতে পারেনি।
ওঁর আব্বা যখন মারা যান স্বামীর শোকে আম্মা টানা দুইদিন না খেয়ে ছিলেন। একটু পর পর জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিলেন তিঁনি ।
তারও কি এখন উচিত নয় স্বামীর জন্য তেমনই করে শোক প্রকাশ করা?!
কিন্তু, সে পারছে না কেন?
বছর তিনেক আগের কথা। লতার কাছের এক বান্ধবী রোড এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছিল। স্ত্রীর মৃত্যুতে স্বামী ভদ্রলোক কিছুক্ষন মুখ কাচুমাচু করে রাখা ছাড়া আর কোনো বিশেষ শোকের প্রকাশ দেখাননি। তাতে অবশ্য সমাজের মানুষ কিছুই বলেনি তাকে । এই সমাজে স্ত্রীর মৃত্যুতে পুরুষদের তীব্র শোক প্রকাশ না করলেও চলে।
লতা জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। ঐ তো সাদা কাপড়ে জড়িয়ে লোকটা এখন খাটিয়াতে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। কী শান্ত দেখাচ্ছে মানুষটাকে। অথচ মাত্র গতকাল সকালেও লোকটা অফিসে যাবার সময় সামান্য ব্যাপার নিয়ে অনায়াসে "মাতারি" বলে গালি দিয়েছিল তাকে। তেজ দেখিয়ে মারতে এসেছিল। যদিও ঘটনা তেমন বড়ো কিছু ছিল না।
আজ তার সব তেজ আর শক্তি নিঃশেষ। কত অসহায়ই না দেখাচ্ছে এখন মানুষটাকে।
লতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। লোকটার বরাবরই উগ্র মেজাজ ছিল। রাগ সামলাতে না পারলে চুলের মুঠি ধরে দুই, চারটা কিল ঘুষি লাগিয়ে দিত তাকে যখন তখন। বলত, তার আয়ে খেলে পরলে এসব নাকি সহ্য করতে হবে লতাকে। আম্মাকে সেকথা জানালে বলেছিলেন, রাগী মানুষের মন নাকি ভালো হয়। মেয়েদের অত অধৈর্য হওয়া ভালো নয়। সংসার করতে না পারলে সমাজ নাকি লতাকেই দোষী করবে।
পিতৃহীন মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে সে। এই সমাজকে বড্ড ভয় তার। তাই মুখ বুজে থেকে গিয়েছিল এখানেই।
দেয়ার হাত না থাকলেও পাওয়ার খুব লোভ ছিল লোকটার। মানুষটাকে খুশি করতে কতবার যে সে মায়ের সামনে দাঁড়িয়েছে, ভাইয়ের কাছে হাত পেতেছে তার হিসেব নেই। তবুও কি খুশি করা গিয়েছিল..!?
মানুষটার উপর বড্ড বিশ্বাসও ছিল এক সময়। সেটা হারিয়েছিল সেদিন, যেদিন বাবুর দেখাশোনার জন্য রাখা মেয়েটাকে স্বামীর সাথে সে হাতে নাতে ধরেছিল রাত দুপুরে।
শ্বাশুড়ি সেদিন বলেছিলেন, পুরুষদের এই সমস্ত একটু আধটু দোষ নাকি থাকেই। শান্তি চাইলে সে যেন ঘরের বাইরে এসব কথা বলে না বেড়ায় ।
আশ্চর্য ব্যাপার চাপে পড়ে শ্বাশুড়ির কথা মতো স্বামীর কুকীর্তি চাপা দিয়েছিল সে।
তাতে অবশ্য মানুষটার স্বাভাবের পরিবর্তন হয়নি কিছুই।
তবে লোকটা লতার কিছু উপকার করেছিল। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিল তার মধ্যে থাকা হাজারটা দোষত্রুটি। বিয়ে না হলে যেগুলো তার অজানা থেকে যেত। স্বামীর সংসার করতে হলে নারীদের নাকি প্রভুভক্ত কুকুরের মতো হয়ে চলতে হয়। এই কথাও সে প্রথম শুনেছিল হারুন সাহেবেরই মুখে। ফালতু পরিবার থেকে এসেছে বলে লতা নাকি সুশিক্ষাটা পায়নি বলত সব সময় ।
কথাগুলো শুনতে শুনতে বারোটা বছরে একেবারে মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল লতার।
তারপরও কী অবলিলায়ই না সে এই প্রাণহীন সম্পর্কটাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। হয়তো টানতো আরও অনেক বছর।
আচ্ছা,গতকাল মানুষটার হঠাৎ মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে সে কি একটু হলেও হাফ ছেড়েছিল? কিছু সময়ের জন্য কি নিজেকে মুক্ত বলে মনে হয়েছিল তার? অল্প সময়ের জন্য হলেও কি উচিত শিক্ষা হয়েছে ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল সে?
আচ্ছা, স্বামীর মৃত্যুতে তার কি কোনো ক্ষতি হয়ে যায়নি? তাদের সন্তান কি পিতৃহারা হয়নি?
তবে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা কেন এখনও তাকে কাতর করছে না?
তাদের কি কোনো সুখস্মৃতি নেই? কেন সেসব মনে পড়ছে না?
হঠাৎ দাদীর কথা মনে পড়ে লতার। শেষ দিকে কথায় কথায় বৃদ্ধ স্বামীকে প্রচুর গালমন্দ করতেন তিনি। লতার ভীষণ মায়া লাগত। দাদাজান তখন বয়সের ভারে ন্যুজ্ব, চলৎ-শক্তিহীন মানুষ । বুঝত না কেন দাদীর এত নিষ্ঠুরতা, রাগ এই অসহায় মানুষটার উপর। আজ মনে হলো,দাদীজানের মনেও কি এমন তীব্র কোনো ক্ষোভের পাহাড় জমে ছিল?
মানুষটাকে একটু পরেই নিয়ে সমাহিত করা হবে।
যে মানুষটা গতকাল সকালেও স্ত্রীকে অশ্রাব্য গালিগালাজ করে জুতা ছুড়ে মেরেছিল। ঘাড় ধরে ঘর থেকে বের করে দেবার হুমকি দিয়েছিল বারবার । বিকালেই তার হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হলো।
আর আজ কিছুক্ষন পর সে নিজেই এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে চিরদিনের মতো।
জীবন অনিশ্চিত জেনেও কেন সেই জীবন নিয়ে আমাদের এত বড়াই?
লতা নির্লজ্জের মতো পানিহীন চোখে বসে থাকে।
পাড়া প্রতিবেশী ফিসফিস করে বলে,
"দেখ, দেখ স্বামী মারা গেছে অথচ চোখে এক ফোঁটা পানি নেই।"
সেই ফিসফিসানিতেও লতার চোখে পানি আসে না ।
সে শান্ত মুখে কেবল বিড়বিড় করে,
যে সমাজ নষ্ট স্বামীর কর্ম তার স্ত্রীকেই চাপা দিতে বাধ্য করে। যেখানে স্ত্রীর চুলের মুঠি ধরে স্বামীরা অনায়াসে অত্যাচারের অধিকার রাখে। প্রতিনিয়ত অশ্রাব্য গালিগালাজ করা স্বামীকেও মাথায় তুলে না রাখলে যে সমাজ নারীর দিকেই বাঁকা আঙুল উঠায়। সম্মানের ভয়ে যে সমাজে নারীদের বছরের পর বছর সুখী স্ত্রীর অভিনয় করে চলতে হয়।
সে সমাজ কী করে বুঝবে কতটুকু আঘাতে, অবহেলায়,অভিমানে মানুষটির মৃত্যুতেও চোখ দু'টো এমনই শুকনো রয়ে যায় !
-গল্পঃ জীবন যেখানে যেমন
মাহবুবা আরিফ সুমি