এই ঘর এই সংসার
"আমি রাশিদের ওয়াইফ, নাফসি।"
হায় হায়, কি বলছে এই সব, আমার হাসব্যান্ড নাকি ওর হাসব্যান্ড!
—---------- —---------- —----------
ডোর বেল বাজতেই জিজ্ঞেস করলাম -কে?
আগন্তুক বললো-
–রাশিদ ইসলাম কি আছেন?
ডোর ভিউয়ার দিয়ে দেখলাম, একদমই চেনা কেউ মনে হচ্ছে না। একজন মহিলা ছোট একটা বাচ্চাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।আমার হাসব্যান্ডের নাম বলছে, তাঁর কাছে এসেছে এই মহিলা কিন্তু আমি চিনতে পারছি না। ভাবলাম আমার হাসব্যান্ডের নাম যেহেতু ঠিক বলছে তাহলে আগন্তুক ঠিক ঠিকানাতেই এসেছে, ওর পরিচিতই কেউ হবে তাই দরজা খুলে দিলাম।
আপাদমস্তক নিংড়ে দেখেও চিনতে পারলাম না।
ওর এমন কোন্ আত্মীয় হতে পারে যাকে আমি চিনি না? মহিলা না বলে মেয়েও বলা যায় ওকে, আমার চাইতে বয়স অনেক কম। ওর সাথের বাচ্চাটার বয়স এক বছর বা এমনই হবে।
আমি আবারো জিজ্ঞেস করলাম-
–কাকে চাই বলুন তো, আমি কিন্তু আপনাকে চিনতে পারিনি।
–বললাম না, রাশিদ, মানে রাশিদ ইসলামের কাছে এসেছি।
–নাম তো ঠিকই বলছেন কিন্তু আপনি ওর কে হোন? আমি তো আপনাকে চিনতে পারছিনা।
–আমি রাশিদের ওয়াইফ, নাফসি।
হায় হায় সে কি বলছে এই সব, আমার হাসব্যান্ড নাকি ওর হাসব্যান্ড!
আমি কি শুনছি , এই মেয়ে কি বলে? কেউ যেন গরম সীসা ঢেলে দিয়েছে আমার কানে, এত উত্তপ্ত মনে হলো এই কথা। মাথাটা কেমন যেন চক্কর দিলো, দরজাটা ধরে ফেললাম।
আমি যেন কোন দূঃস্বপ্ন দেখছি। আমি কিছু বলার আগেই মেয়েটা চট করে সোফায় বসে গেলো।
ব্যাস্ত ভঙ্গিতে বললো,
–আপু আপনি কি ওর বড় বোন? আপু কিছু মনে করবেন না, এভাবে আসাটা আমার ঠিক হয়নি কিন্তু আর কোন উপায় ছিল না আমি আসতে বাধ্য হয়েছি।
আমাকে রাশিদের বড় বোন মনে হয়? কি বলে এই মেয়ে! আমার আর রাশিদের বয়সের গ্যাপ সাত বছর আর এই মেয়ে আমাকে রাশিদের বড় বোন বলছে?
আমি রাগি গলায় বললাম -
–বললেই হলো, তুমি রাশিদের ওয়াইফ,কি প্রমাণ আছে? এভাবে নির্লজ্জের মতো কেউ বিয়ে করে? ছিঃ ছিঃ।
–আপু বুঝতে পারছি খুব রাগ হয়েছেন।সব প্রমাণ আছে আমার কাছে। আপনাদের না জানিয়ে আমরা বিয়ে করে ফেলেছি, আমাদের বাচ্চাও হয়ে গেছে রাগ হওয়ারই কথা কিন্তু বিশ্বাস করুন কিছুই করার ছিলো না আমার। ও বললো ফ্যামেলিতে সমস্যা, জানানো সম্ভব নয় তাই বিয়ে করে ফেলেছি কাউকে না জানিয়ে। ওকে যতই বলি এখন তোমার বাসায় যাই আমাদের বাচ্চাকে দেখে অন্তত আমাদের বিয়ে মেনে নিবে কিন্তু ও রাজি হয় না। সে কঠিন ভাবে নিষেধ করেছে কখনো তার বাসায় যেন না আসি। ওর বাবা নাকি অসম্ভব রাগি একেবারে খুন করে ফেলবে। আসলেই কি তাই আপু? আপনি ডাকেন উনাদের। আমি নিজেই কথা বলবো। আজ আমার সব ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। ও ইদানিং খুব টালবাহানা শুরু করেছে, আগে রাতে খুব কম থাকলেও যেতো, দিনের বেলায় যেতো, ছুটির দিনে বেশি যেতো। এখন ছুটির দিনে বিভিন্ন সমস্যার কথা বলে, যায় না। ভাবে আমি বুঝতে পারছি না, সে আমাকে বোকা বানাতে চাইছে, আমাকে ফাঁদে ফেলে সম্পর্ক করে এখন সরে পড়তে চাইছে। আমি আমার সন্তানের স্বীকৃতি চাই। এত সহজে ওকে ছেড়ে দেবো?
আপনার মা বাবা বাসায় নেই? নাকি তাঁরা আসলে বেঁচে নেই, আমাকে মিথ্যে বলেছে?
আমি কিছুই বলতে পারছি না, আমার মাথা কাজ করছে না। শুধু চিন্তা করছি এত বড় ধোঁকা রাশিদ আমাকে কিভাবে দিতে পারলো তাও আবার এত দিন ধরে বা এত বছর ধরে, নাকি সারা জীবন ধরে?
নাফসি মেয়েটা খুব ছটফট করছে, বাচ্চাটাও খুব চঞ্চল, ওকে সামলাতে নাফসি হিমসিম খাচ্ছে। এক মুহুর্তেই আমার পৃথিবী অন্ধকারে ছেয়ে গেছে, একেবারে অচেনা লাগছে সব কিছু, রাশিদকে আমার কাছে অচেনা লাগছে, খুব অচেনা। আমার সামনে বসে আছে তাঁর সুন্দরী তরুণী বৌ। আমি কি আসলেই বুড়ি হয়ে গেছি? আমার ছেলে এখন কলেজে আর মেয়ে স্কুলে ও ক্লাস নাইনে পড়ে, আমার বিয়ের বয়স প্রায় উনিশ বছর। উনিশ বছর কম সময় তো নয়! উনিশ বছর আগে আমি ছিলাম উনিশ বছরের সদ্য তরুণী। এত দিনে আমি কি বুড়ি হয়ে গেলাম রাশিদের কাছে, কখন থেকে, কবে থেকে আমার প্রয়োজন শেষ হয়ে গেলো ওর কাছে, যে, অন্য আরেকজনের দরকার হলো? ওর আচরণে কখনো তো বুঝতে পারিনি, নাকি ও খুব ভালো সুদক্ষ অভিনেতা? তাঁর সঙ্গে বিয়ের পরে অবিবাহিত শব্দটা মুছে বিবাহিত শব্দটা জুড়ে গেছে, তাঁর স্ত্রী হয়েছি, তাঁর সন্তান গর্ভে ধারণ করে নতুন পরিচয়ে পরিচিত হয়েছি মা হিসেবে, তার মা বাবা ভাই বোনদের প্রতি দায়িত্ব পালন করেছি বৌ হিসেবে। এমন কিছু কি বাকি আছে, এমন কোন অপূর্ণতা আছে যার জন্য তাঁকে অন্য জনকে নিজের জীবনে জড়াতে হলো?
–এই আপু , আপনি কোন কথা বলছেন না কেন?
এই বলে নাফসি গায়ে হাত দিয়ে একটু ধাক্কা দিলো।
আমি অসম্ভব রেগে গেলাম, চিৎকার করে বললাম-
–আমাকে একদম ছোবে না, একদম না।
–আসলে আপু বার বার আপনাকে ডাকার পরেও কোন সাড়া দিচ্ছিলেন না তো তাই ..
–নিজে নিজে বিয়ে করতে পেরেছ, এখন কেন আমার সংসারে উঠে এসেছ, এই মুহূর্তে বের হও বলছি।
আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছিলাম না।
নাফসি বলতে লাগলো-
–আপু আপনি একটু বসুন, এভাবে কাঁপছেন কেন? একটু বসুন, আমার ভয় লাগছে, আবার কি না কি হয়ে যায়। আপু এই আপু আপনি শান্ত হোন, আমি চলে যাবো, প্লিজ আপনি শান্ত হোন।
আমি বসে বললাম-
–তোমার হাসব্যান্ডকে কল দাও। এখনই কল দাও, বল এখনই বাসায় আসতে । আমি জানতে চাই সব কিছু। তুমি তোমার অধিকার আদায় করতে চাও আর আমি আমার অধিকার যাচাই করতে চাই।
–আপু আমি আসলে বুঝতে পারছি না, আপনার অধিকারের কথা আসছে কেন?
–কারণ আমি রাশিদের স্ত্রী, আমার দুইটা সন্তানও আছে। কল দাও এখনই। না, ঠিক আছে, আমি কল দিচ্ছি।
নাফসিকে দেখলাম কপালে হাত দিয়ে বসে পড়েছে। কি যেন বলছে, আমার কানে সেই সব কথা আসছে না।
আমি মোবাইলে রাশিদের নাম্বার খুঁজে পাচ্ছি না। কেন খুঁজে পাচ্ছি না, ও অফিসে পৌঁছেও তো আমাকে কল দিয়েছিলো, তাহলে কেন পাচ্ছি না? আমার হাত কাঁপছে, পেলাম ওর নাম্বার। কল দিতেই ও অবাক হয়ে বললো-
–কি হয়েছে, তুমি তো এই সময় কল দাও না, সব কিছু ঠিক আছে?
–তুমি এই মুহুর্তে বাসায় আস।
–কি হয়েছে? তোমার কি শরীর খারাপ করেছে পাপড়ি?
–তুমি তাড়াতাড়ি বাসায় আস।
এর পরে আর কিছু না বলে কল কেটে দিলাম। ওর অফিস থেকে বাসায় আসতে বিশ মিনিট থেকে আধঘণ্টা লাগতে পারে, জ্যাম না থাকলে আরো তাড়াতাড়ি আসবে। অফিস থেকে আমাদের বাসায় খুব বেশি দূরে নয়।
রাশিদ বাসায় ঢুকে অস্থির হয়ে গেলো, দরজা খোলাই ছিলো। জিজ্ঞেস করতে লাগলো কি হয়েছে। নাফসির দিকে চোখ পড়তেই জিজ্ঞেস করলো-
–উনি কে?
–আমি বাঁকা করে বললাম তুমি উনাকে চেনো না? জিজ্ঞেস করছো উনি কে?
–আমি কি করে চিনবো?
–ওরে বাবা কি বলে, নাফসিকে চিনতে পারছো না ওর বাচ্চাকেও চিনতে পারছ না?
–কি আশ্চর্য আমি কি করে এদের চিনবো?
এবার নাফসি দাঁড়িয়ে বলল-
–আপু আমিও তো উনাকে চিনি না।
–মানে কি? কি অভিনয় শুরু করলে? এটাই তো রাশিদ ইসলাম, তুমি যার কাছে এসেছ।
–আমি যেই রাশিদের কাছে এসেছি উনি তো সেই রাশিদ না।
আমার মুখ হা হয়ে গেলো। বললাম-
–তুমি কল দাও তোমার হাসব্যান্ডকে, বল, এখানে আসতে।
নাফসি কল দিলো, কথা বললো।
জানতে পারলাম নাফসির কাছ থেকে, নিচে সিকিউরিটি গার্ডকে যখন বলা হলো রাশিদ ইসলামের বাসায় আসবে তখন 4A ফ্ল্যাট এর কথাই বলেছে গার্ড।
আরেক রাশিদ ইসলাম এসে হাজির হলো কিছুক্ষণের মধ্যেই, সে বাসাতেই ছিলো। বাচ্চাটা একদম বাবার মতো দেখতে হয়েছে। এই রাশিদ থাকে 9A তে। রাশিদের বাবাকে চিনলেও কখনো কথা হয়নি ছেলে কিংবা বাবার সাথে রাশিদের।
এর পরে আমরাই নিয়ে গেলাম নাফসিকে রাশিদদের বাসায়। রাশিদের মা বাবা খুব কষ্ট পেলেন, সেটাই তো স্বাভাবিক।আমাদের যতটুকু বোঝানোর বুঝালাম তাঁদের। নাফসি, রাশিদকেও অনেক কথা বললো আমার রাশিদ। তবে নাতিকে পেয়ে উনারা সমস্ত অভিমান ভুলে গেলেন। একমাত্র ছেলের সন্তান তাঁদের হৃদয় জয় করে নিলো।
বাসায় এসে রাশিদ হাসতে হাসতে শেষ। সে বললো-
–কি ভেবেছ, আমার বৌ এসেছে? সত্যিই এমন হলে কি করতে?
–তোমাকে খুন করতাম।
–খুন তো হয়েই গেছি সেই উনিশ বছর আগে।
আমি অঝোরে কাঁদছে লাগলাম। ও আমাকে বুকে টেনে নিলো। আস্থা, ভালোবাসা আর নির্ভরতার চাদরে যেন জড়িয়ে গেলাম। ও বলতে লাগলো-
–পাপড়ি কেন এমন করে কাঁদছ। এটা তো একটা ভুল বোঝাবুঝি। এমন করে কাঁদে না।
আমি কেঁদেই চলেছি, কিছুতেই নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছি না, তাঁর শার্ট ভিজে যাচ্ছে আমার কান্নায়। কেন এমন করে কাঁদছি জানি না, হয়তো খুশিতে, হয়তো তাঁকে ভুল বুঝার কারণে লজ্জায়, হয়তো এত দিনে তাঁকে চিনতে না পারার কারণে অনুশোচনায়, হয়তো আমার সংসার আমার স্বামী শুধুই আমার থাকার কারণে আনন্দে, হয়তো এই সবগুলো কারণেই- কোন বাঁধা না মেনে অশ্রুধারা বয়েই চলেছে।
-ছোট_গল্প
-এই_রাশিদ_সেই_রাশিদ_না
ফাহমিদা_লাইজু