বউ শাশুড়ির ভালোবাসা | বউ শাশুড়ি | বউ শাশুড়ির সম্পর্ক

 বউ শাশুড়ির সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত

বউ শাশুড়ির সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত

আমার গুনধর ছেলে আমার বৌমা রিমির সাথে কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে ঠাস করে রিমির গালে চড় মেরে বসলো! অথচ এখানে রিমির কোন দোষই ছিলনা। আমার খুব রাগ হলো ছেলের উপর, আমি সাথে সাথেই উঠে গিয়ে ছেলের গালে কষে এক চড় মেরে দিলাম। আমার এমন আচরণে ওরা দুজনেই অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে! 

ছেলে নয়ন মা--আ আ বলে থেমে গেল। 

বললাম মা বলে ডাকবি না আমাকে। মেয়ে মানুষের গায়ে হাত তোলা খুবই সহজ তাইনা? 


ও আমার ঘরের লক্ষী, আমার মেয়ে, আমার বৌমা, তোর কেনা দাসী নয়। আগামীতে যেন এমন কাজ আর না করিস সেই শিক্ষা টা দিয়ে দিলাম। নয়ন রাগ করে রিমিকে বাইরে রেখেই রুমের দরজা লাগিয়ে দিল। আমি ও আমার রুমে চলে আসলাম।।

কিছুক্ষণ পর রিমি এসে পায়ের কাছে বসে বলছে মা

তুমি তোমার ছেলেকে কেন মারলে, আমার গায়ে না হয় হাত তুলেছে, সেজন্যে আমার সামনেই তাকে মারলে কেন মা?


বললাম চুপচাপ বসে থাক, কানের কাছে বকবক করবি না। স্বামীর জন্য দরদ উতলায় পড়তেছে তাই না? ও দরজা না খুললে আমার পাশে ঘুমিয়ে পড়।

বিয়ে হয়েছে তো মাত্র বছর খানেক,তাই ভালোবাসা ও আবেগে ভরপুর হয়ে আছো,একটু পুরনো হলে বুঝবা। 

পুরুষ মানুষ কে অত প্রশ্রয় দিতে হয় না, তাহলে বাকি জীবন পস্তাবি। আজকে একটু চড় মারবে কালকে আরেকটু করবে, এই করতে করতে হাত এসে যাবে। তারপর কেঁদে ও কূল পাবি না। 


সকালবেলা নয়ন রিমি রিমি করে চিৎকার করে ডাকছে। রিমি দৌড়ে গেল। রিমি কে বলছে আমার মা তো এখন আর আমার মা নেই,নিয়েছো তো বশ করে । তাহলে এই ঘরে আমার আর থাকার ও কোন প্রয়োজন নাই। আমার সব কাপড়চোপড় ও ব্যবহারের জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে দাও আমি আলাদা বাসায় চলে যাব। তুমি থাকো তোমার মায়ের সাথে। রিমি পারবো না বলে রান্নাঘরে  চলে গেল নাস্তা বানাতে। এদিকে আমার ছেলে রাগ করে না খেয়ে অফিসে চলে গেল। 

রিমিটার চোখ ছলছল করছে। 


বললাম চিন্তা করিস না তোর স্বামী হারিয়ে যাবে না ও ঠিকঠাক মতো ঘরে ফিরে আসবে।

আমার ছেলে তো আমি চিনি, ও আমাকে অন্ধের মতো ভালোবাসে। আর ওদের রক্তে মাতৃভক্তি অনেক বেশি। নয়নের বাবা ও এমনটাই ছিলেন। তার মাতৃভক্তি ছিল অবাক করার মতো,মায়ের সেবা যত্নে বিন্দুমাত্র ত্রুটি রাখতো না। মায়ের আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতো। 

এখন তো তোরা শহরে আলাদা বাসায় থাকিস ঝামেলাহীন ভাবে আমাদের সময় এরকম ছিল না। 


আমাদের সময়ে অল্প বয়সেই বিয়ে দিয়ে দিতো। আমার বেলা ও তাই হয়েছিল। অল্প বয়সেই বড় ঘরে সংসারের বড় বউ হয়ে এসেছিলাম আমি। সকালবেলা ধান সিদ্ধ থেকে শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত কোন বিশ্রাম ছিল না, খাওয়া দাওয়ারও কোন ঠিক থাকতো না। তারপর আবার আমার শাশুড়ির যখন যেটা হুকুম করতো সাথে সাথেই পালন করতে হতো একটু এদিক সেদিক হলে নয়নের বাবা আসার সাথে সাথে বিচার দিতো আর নয়নের বাবা আমার শাশুড়ির সামনেই গায়ে হাত তুলতো, আমার শাশুড়ি কিছুই বলতো না। 


নয়নের বাবার শারীরিক আঘাতে পরপর আমার তিনটা বাচ্চাই নষ্ট হয়ে যায়। তারপর কয়েক বছর কেটে যায় আমার আর কোন সন্তান হয় না। আমি আল্লাহর কাছে অনেক কান্নাকাটি করতাম, আল্লাহ আমাকে একটা সন্তান দাও। 

তারপর একদিন শাশুড়ি মারা গেল, বিশ্বাস কর আমি একটু কাঁদিনি বরং ক্ষোভ প্রকাশ করেছি মনে মনে। আর প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আমার যদি ছেলে সন্তান হয় তার বউকে আমি মেয়ে বানিয়ে রাখবো। তার গায়ে নোখের আঁচড় ও লাগতে দিবো না। 


শাশুড়ির মৃত্যুর তিন বছর পর নয়নের জন্ম হয়। নয়নের জন্মের দুই বছর পর ওর বাবাও মারা যায়। নয়নের বাবার মৃত্যুও কিন্তু স্বাভাবিক ছিল না। সেদিন আমি ও "মেঝ জা" মিলে ঢেকিতে চালের গুঁড়া করছিলাম এর মধ্যে নয়ন হাঁটতে হাঁটতে পুকুর পাড়ে চলে গেছে আমি খেয়াল করিনি। সেটা নয়নের বাবা দেখে নয়নকে কোলে নিয়ে আসে আর হাতে নিয়ে আসে কাঠের লাকড়ি। আর সেই লাকড়ি দিয়ে তিনি  সমস্ত শক্তি দিয়ে আমার শরীরে আঘাত করতে করতে ক্লান্ত হয়ে সে নিজেই স্ট্রোক করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।


 সেদিনও আমি একটুও চোখের পানি ফেলিনি।

তারপর নয়ন যখন থেকে বুঝতে শিখেছে ওর মধ্যেও আমি ওর বাবার মতই মাতৃভক্তি দেখতে পাই। আমি একটু অসুস্থ হলে সারারাত জেগে থাকতো, বলতাম বাবা তুই ঘুমিয়ে পড় আমার অসুস্থতা আস্তে আস্তে সেরে যাবে।

যখন নয়ন ভার্সিটিতে ভর্তি হয় তখন ও হোস্টেলে থাকবেনা, কি আর করার তারপর শহরে এসে মা ছেলে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করলাম। 

তারপর নয়ন পড়াশোনা শেষ করে ভালো কোম্পানিতে চাকরি পায়। কিন্তু কোনদিন আমার নয়ন আমাকে সালাম না করে অফিসে যেত না। আবার অফিস থেকে ফিরে সারাদিনের খোঁজ খবর নিতো আমি কি খেয়েছি না খেয়েছি। তারপর ভালো একটা মেয়ে খুঁজতে লাগলাম যাকে আমি মেয়ে বানাতে পারবো, বৌমা নয়। 


আজ আমার ছেলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমি চাই সন্তান হিসেবে আমার কাছে যেমন তেমনি স্ত্রীর কাছে ও একজন ভালো স্বামী হোক।


রাতে নয়ন বাসায় ফিরেছে। ওর কি মনে হয়েছে জানিনা রিমিকে ডেকে নিয়ে ওর কাছে ক্ষমা চাচ্ছে।

তারপর দুইজন মিলে আমার কাছে আসলো। 

বললো মা তুমি ঠিক করেছো আমি আসলেই ভুল করেছিলাম,

এমন ভুল আর কোনদিন হবে না মা।


___ বললাম বাবা তোরা দুজনেই এখানে আছিস। আমি আর কতদিন বাঁচবো আমি জানিনা তবে আমি চাই তুই একজন ভালো স্বামী হ। তোর বাবার মতো অন্ধভক্ত হ‌ইসনা। 

একটা মেয়ে বউ হয়ে আসে অনেক স্বপ্ন নিয়ে। 

শুধুমাত্র সংসারের ঘানি টানা ও বাচ্চার জন্ম দেওয়া কে সংসার বলে না, সেখানে ভালোবাসা, বিশ্বাসের সম্পর্ক ও একে অপরকে প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ থাকাটা ভীষণ জরুরী, তাহলেই সংসার পরিপূর্ণভাবে রূপ নেয়। 


সব রাগ স্ত্রীর উপর ঝাড়তে নেই কারণ সেও মানুষ। সংসারে রাগ,অভিমান,ক্ষোভ, দুঃখ, ব্যথা, ভাঙাগড়া সবই থাকবে হাঁপিয়ে গেলে চলবে না। সেগুলো একে অপরের দিকে তাকিয়ে সব সহ্য করে একে অপরের পাশে থেকে সমাধান করতে হবে। বদমেজাজি হয়ে পান থেকে চুন খসলেই স্ত্রীর গায়ে হাত তোলা যাবে না।


ওরা দুজনেই আমার কথা শুনে কাঁদছে। আমিও  পুরনো স্মৃতি মনে করে চোখের পানি আটকাতে পারলাম না। 

রিমি পাশে থেকে এসে আঁচল দিয়ে আমার চোখের পানি মুছে দিচ্ছে।

 ওদের কান্না থামানোর জন্য আমি মিথ্যা হাঁসি দিয়ে কষ্টগুলোকে আড়াল করার চেষ্টা করলাম। তবুও বারবার কেন জানি চোখ ভিজে যাচ্ছে। 

তারপর দুইজনকেই বুকে জড়িয়ে নিলাম।


-আমার_শিক্ষা

-Rozina_Rose


আমাদের নতুন ওয়েব সাইটে এমন গল্প পড়ুন।