বাচ্চা না হওয়ার কষ্ট | অবহেলার কষ্টের স্ট্যাটাস

 অবহেলার কষ্টের গল্প

অবহেলার কষ্টের গল্প

বড় ভাবীর মুখ মলিন হয়ে আছে। ডাক্তারের কাছ থেকে আসার পর থেকেই এমন।কারোর সাথে কোন কথা টথা বলছে না। আমি দু' তিন বার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে এসেছি,'কী হয়েছে বলো তো ভাবী, এমন মুখ গোমড়া কেন তোমার? ডাক্তার কী বলেছে?'

ভাবী আমার দিকে তাকালোও না পর্যন্ত। পরপর তিনবার যাওয়ার পরেও যখন কিছু বললো না তখন আর যেতে ইচ্ছে করলো না কাছে। শুধু শুধু কাউকে বিরক্ত করে কী লাভ?  যদি সে যেচে না উত্তর দেয়! হতেও পারে শেষমেশ কোন দুঃসংবাদ শুনেই এসেছেন তিনি।এটা আগেই সন্দেহ ছিল আমাদের। ভাবীর অন‍্যসব বোনগুলোও এমন।বড় তিনটের বিয়ে হয়েছে,  একটারও সন্তান হয়নি। ভাবীর বিয়েরও দিন কম হয়নি। প্রায় ছয় বছর।এই এতদিনেও যেহেতু বাচ্চা কাচ্চা হলো না তবে আর হবে বলে মনে হয় না! তবুও আম্মার আদর! নিজের মেয়ে নেই।তাই বড় শখ করে ভাবীকে ঘরে এনেছেন। ভাবীর গায়ের রং দুধে আলতা না।অনেকটা ময়লাই। তবে চোখে কী জানি একটা কিছু আছে। দেখলেই মায়া হয়। ভীষণ ভীষণ মায়া! নয়তো কী এতো কিছু জেনে,মানে যার অন‍্য তিনটে বড় বোনের বাচ্চাকাচ্চা নাই, তবুও তাকেই ঘরের বউ করেন!

ভাইয়া তো প্রথমে রাজীই ছিল না।না গায়ের রং দেখে নয়, সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা শূন‍্যের কোঠায় বলে। আমিও আম্মাকে বলেছিলাম,'আজীবন শুধু খামখেয়ালি করে গেলে,এটা মানুষের বিয়ে , পুতুলের বিয়ে তো না। '

আম্মা গাঢ় হেসে বলেছিলেন,'তোরা যা ভয় পাচ্ছিস তার কিছুই হবে না।ওর সন্তান ঠিকই হবে। আমি আল্লার উপর বিশ্বাস রেখে বলছি।'

আমি কিংবা ভাইয়া সেই বিয়ের ব্যাপারে সত‍্যিই সুমত দেইনি। যদিও বিয়ের পর ভাবীর ব্যাবহার আমাদের মুগ্ধ করেছে এবং তার ভালোবাসার কাছে ভাইয়া পরাজিত হয়েছে। আমার বলতে একটুও বাঁধবে না যে জগতে এমন নম্র -ভদ্র আর চরিত্রবান মেয়ে মিলানো কঠিন। তবে যাকে দিয়ে কোন ভবিষ্যৎ নেই তাকে কেন বিয়ে করে ঘরে আনতে হলো?

আম্মা এখনও হাসপাতাল থেকে ফিরেননি। ঘুম থেকে উঠে দেখি বাড়িতে দুজনের কেউই বাড়িতে নেই। পরে শুনেছি ডাক্তারের কাছে গেছে।ভাবী এসে গেলেও আম্মা আসেননি এখনও। মনে হয় রিপোর্ট নিয়ে ফিরবেন। ভাইয়া আজ এক মাস যাবৎ জাপান। তার অফিসের কী এক কাজে যেতে হলো। ওখানে তিনি তিন মাস থাকবেন।

'

ভাবীর জন্য ভীষণ মায়া হয় আমার। কী দুঃখ ভাবীর! সন্তানহীন মায়ের যে কী দুঃখ তা কেবল আরেক সন্তানহীন মাই বুঝবে। কিন্তু কাছে থাকা মানুষগুলোও তো খানিক বুঝতে পারে। ভাবীকে কেউ কোনদিন বকেনি তার সন্তানহীনতার জন্য। তবুও তাকে রোজ বিকেলে বিছানায় পড়ে থেকে বালিশে মুখ ঢেকে কাঁদতে দেখেছি। আবার তার উপর রাগ হয় এই ভেবে যে কেন তার আমাদের বাড়িতেই আসতে হলো! মানুষের কত শখ থাকে তার ভাইয়ের ছোট্ট সন্তানকে হাত ধরে খোলা রাস্তায় নিয়ে হাঁটবে।জানলা খুলে বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটার অদ্ভুত অদ্ভুত নাম রাখবে দুজন মিলে। কখনো মজাচ্ছলে কাঁদিয়ে ফেলে আবার সেই কান্না নিজেই থামাবে। এইসব কিছু শখ আমারও ছিল। কিন্তু পূরণ হলো কই?

ভাইয়ার জন্যও মায়া হয় আমার। এমন খোদাভক্ত মানুষটার কপাল অত খারাপ কেন? ভাবীকে ভুলেও একটা কটু কথা বলতে দেখিনি কোনদিন তাকে।তার প্রতি রাগ হতেও দেখিনি। তবুও তার কপালটা এমন?

নাকি আল্লাহ তার প্রিয় মানুষদেরই এভাবে পরীক্ষা নেন?

'

সন্ধ্যা বেলায় আম্মা আসলেন হাসপাতাল থেকে রিপোর্ট নিয়ে।তার মুখ আরো কালো। চোখে কেমন কান্না কান্না ভাব। মনে হচ্ছে এই এক্ষুনি তিনি কেঁদে ফেলবেন। আম্মাকে আসতে দেখেই ভাবী বোধহয় কিছু ঠাহর করতে পেরেছেন।তাই হু হু করে কেঁদে উঠলেন।আম্মাও কাছে এসে ভাবীকে জড়িয়ে ধরে প্রাণ ভরে কাঁদলেন। তাদের কান্না দেখে আমার ভীষণ কষ্ট হতে লাগলো। মনে হচ্ছিল, পৃথিবীতে কারোর সন্তান- সন্ততি না থাকলে কী আসে যায়? যদি ভালোবাসা থাকে! আমার কোন ভাইপু- ভাইঝির প্রয়োজন নাই। আমার শুধু একজন ভালো ভাবীর প্রয়োজন।যে ভাবী নিজেদের বোনের মতো করে তুই তোকারি করে ডাকে। খাবার নিয়ে ঝগড়া করে।

ঘুম থেকে টেনে তুলে বলে,কলেজ যাবে কখন?

ভাত বেড়ে দিয়ে মাছের কাঁটাটা আগল করে দেয়। সামান্য জ্বর হলে মাথায় জলপট্টি বেঁধে দিয়ে বলে,'আল্লার নাম জপ,আজ রাতেই সেরে যাবে। আমার শুধু এমন একটা ভাবীই চাই।

ঘর থেকে বের হয়ে দৌড়ে গেলাম উঠোনে। গিয়ে বললাম,'কাঁদছো কেন তোমরা?'

ভাবী কথা বললো না। আম্মা বললেন,'নয়ন,তোর যে কোনদিন চাচ্চু ডাক শোনা হয়ে উঠবে না বাপধন। ডাক্তার বলেছে---'

আম্মা আবার কাঁদছেন।ভাবীও।

আমি বললাম,'প্লিজ তোমরা একটু থামো। আচ্ছা, বাচ্চা কাচ্চা হবে না এতে এমন কী হয়েছে বলো? বাচ্চা কী মানুষ বানাতে পারে?নাকি ডাক্তাররা পারে? আচ্ছা ডাক্তাররাই যদি বানাতে পারতো তবে শিরীন আন্টি আজও নিঃস্বন্তান কেন? তিনি তো বড় ডাক্তার। তিনি পারেন না একটা সন্তান বানিয়ে ফেলতে?'

আম্মা খানিক সময় চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন,'তোর ভাইয়া শুনলে তো সর্বনাশ হবে!আমায় দোষবে। বৌমার সাথে আগের মতো আর সম্পর্ক রাখবে না!'

আমি বললাম,'কে বলেছে তোমায় ভাইয়া এমন করবে? ভাইয়াকে আগে জানিয়ে দেখো না!'

আম্মা বললেন,'ছেলেটা বাইরে আছে। এখন কী তাকে এমন একটা খারাপ সংবাদ দেয়া যায়!'

আমি কোন কথা না বলে নিজেই ফোন দিলাম ভাইয়াকে। লাউডস্পিকার অন করে ভাইয়াকে বললাম,'ভাইয়া,একটা দুঃসংবাদ আছে।বলবো?'

ভাইয়া বললো,'বল।'

আমি সরাসরি বললাম,'ভাবী নাকি কোনদিন মা হতে পারবে না ডাক্তার বললো। এখন কী তুমি এর জন্য আম্মাকে দোষবে? ভাবীর সাথে সম্পর্ক নষ্ট করে দিবে?'

ভাইয়া ও পাশ থেকে খানিক সময় নিয়ে উত্তর দিলো। বললো,'নয়ন, আমার আল্লার উপর আস্থা আছে। তিনি যাকে ইচ্ছে তাকে সন্তান দিবেন আর যাকে ইচ্ছে দিবেন না। এবং এর জন্য আমি কাউকে দোষ দিতেও পারি না কিংবা কারোর সাথে সম্পর্কও চুকিয়ে দিতে পারি না। তুই নিশ্চয় ইব্রাহিম নবী সম্পর্কে জানিস। আল্লাহ তাকে বৃদ্ধ বয়সে সন্তান দিয়েছিলেন।মূলত ইহাই সত‍্য। আমি আল্লার উপর আর কোন সত‍্যকেই মানতে পারি না।আর তুই তোর ভাবীকে বলে দিস,সে যদি ধৈর্যশীল হয় তবে আল্লাহ তার ফল ঠিকই একদিন দিবেন,আর আমার ভালোবাসা তার প্রতি হাজার গুণ বেড়ে যাবে, বেড়ে যাবে আমার জন্মদাত্রী মায়ের প্রতি শ্রদ্ধাও।'

ভাইয়ার কথা শেষ হওয়ার আগেই আম্মা আমার হাত থেকে মোবাইল ফোন কেড়ে নিলেন। তারপর কাঁদতে কাঁদতে ভাইয়াকে বললেন,'মাসুদ, তোমার মঙ্গল হোক বাবা। আমি মিথ্যে বলেছি তোমাদের সাথে। আমি পরীক্ষা করে দেখতে চেয়েছি বৌমার কোনদিন সন্তান হবে না এমন কথা শুনে তোমাদের প্রতিক্রিয়া কী হয়! আসলে সত্যি কথাটি হলো, তুমি সন্তানের বাবা হতে চলেছো। আল্লাহ তোমার সন্তানকে সহি সালামতে পৃথিবীর আলো দেখান এই দোয়া করি।'

আম্মার মুখ থেকে সুসংবাদটা শুনে ভাইয়া শুকরিয়া আদায় করে বললেন,'আম্মা,আমি দুটো সংবাদেই সমান খুশি। কারণ, সন্তান দেয়ার মালিক 

যেমন আল্লাহ,না দেয়ায় মালিকও আল্লাহ। তার যখন ইচ্ছে হবে তখন দিবেন।এর জন্য ধৈর্য্য হারা হওয়া যাবে না বরং ধৈর্যশীল হতে হবে। আল্লাহ তো ধৈর্য‍্যশীলদেরই ভালোবাসেন।' 

ভাইয়ার কথা শুনে আম্মা আর ভাবী শব্দ করে কাঁদছেন। কিন্তু আমি কাঁদলাম না। নিজের চোখের দু ফোঁটা জলকে আড়ালে মুছে ফেলে মনে মনে বললাম, পৃথিবীর সকল মানুষ যদি এমন ধৈর্যশীল হতো তবে পৃথিবী হতো আরো সুন্দর, সংসার হতো সত‍্যিই স্বর্গের।

'

পরীক্ষা

অনন্য_শফিক


আমাদের নতুন ওয়েব সাইটে এমন আরও একটি গল্প পড়ে আসুন।