অবহেলা কষ্টের গল্প | বিধবা নারী ২০২৪

বিধবা বিবাহ

বিধবা বিবাহ

ফুলশয্যার রাত। বিছানায় আমার সাথে আমার দু বছরের ছেলে ভূবনও আছে। ভূবন পিতৃহারা এবং আমি বিধবা তা জানা সত্ত্বেও ফরহাদ আমায় বিয়ে করতে রাজি হয়। অবশ্য আমার বাবা ভূবনকে নিজের কাছে রেখে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ফরহাদ এতে রাজি হলো না।সে বললো,'বাবা, আমি এমন ভয়ঙ্কর একটা কাজ করতে পারবো না। এমনিতেই এই ছেলেটা পিতৃহারা। এখন আমি তাকে কিছুতেই মাতৃহারা করতে পারবো না।নিজে আল্লাহও সয়তে পারবে না এটা।'

শুনে আমি কী যে খুশি হয়েছিলাম।

কিন্তু আজ ফুলশয্যার রাতে হঠাৎ ফরহাদকে তার মা ডেকে নিয়ে যায়। তারপর চেঁচিয়ে বলে উঠে,'তোকে জন্ম দিয়ে আমি ভুল করেছি। মানুষ পুরুষ জন্ম দেয় আর আমি জন্ম দিয়েছি একটা কাপুরুষ!'

ফরহাদ অবাক হয়ে বললো,'কী বলছো মা এসব?'

মা বললেন,'আরো বলবো।সব বলে শেষ করিনি এখনও।এক কাজ কর তুই।তোর বৌয়ের শাড়ি চুড়ি খুলে ওইগুলো নিজে পরে নে। তারপর ঘুমটা দিয়ে বউ সেজে বসে থাক খাটের উপর।আর তোর বউকে শেরওয়ানী টুপি পরা। তুই এটারই যোগ্য!'

ফরহাদ ভীষণ লজ্জিত হয়ে বললো,'মা,বাড়ি ভর্তি মেহমান, পাড়া প্রতিবেশী।ওরা সব শুনছে। ছিঃ!'

মা তখন আরো চেঁচিয়ে উঠলেন। চেঁচিয়ে উঠে বললেন,'তোর কী আসলেও লাজ লজ্জা আছে?যদি লজ্জা থাকতো তবে কী দুই বছরের একটা ছেলে সহ তুই একটা বিধবা মেয়েরে বিয়ে করতি?কান খুলে একবার শুনিস তো লোকেরা কী বলাবলি করছে! তোকে নিয়ে তো তোর বাড়ির চাচা -চাচীরাই সন্দেহ করছে। তারা বলাবলি করছে এই মেয়ের সাথে তোর আগে থেকে খারাপ সম্পর্ক ছিল। বাচ্চাটাও নাকি তোর!'

ফরহাদ সঙ্গে সঙ্গে করুণ এবং লজ্জিত গলায় বললো,'ছিঃ মা ছিঃ! মানুষ বলছে বলে সঙ্গে সঙ্গে তুমিও এমন একটা পঁচা কথা বলতে পারলে তোমার সন্তান আর তোমার পুত্রবধূ প্রসঙ্গে?'

মা সঙ্গে সঙ্গে চেৎ করে উঠে বললেন,'কে আমার পুত্রবধূ?ওই যে বিধবাটা? সন্তান সহ যে এ বাড়িতে পাড় হয়েছে আমাদের নাচাতে।একে আমি কোনদিন পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নিতে পারবো না। কোনদিন না!'

মা আর ফরহাদের সবগুলো কথা শুনছি আমি। আমার চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়ছে। কিন্তু কী করবো আমি?আমি তো এ বাড়ির বউ। তাছাড়া ফরহাদ আমায় বিয়ে করেছে তার নিজের ইচ্ছেতে।সে সমাজকে শিক্ষা দিবে বলে আমায় বিয়ে করেছে। কিন্তু এবার তো তার ঘরকেই সে মানাতে পারছে না। বুঝাতে পারছে না নিজের মাকে। বাইরের মানুষ আর সমাজকে কীভাবে সে বুঝাবে?

ফরহাদ তবুও বললো,'মা, তুমি কী জানো না আমাদের নবীজির প্রথম স্ত্রী খাদিজা রাঃ বিধবা ছিলেন?'

মা তখন এমন মুখ ঝাড়া দিলেন! বললেন,'তুই কী সাধু পুরুষ! নবীর সাথে তুলনা দেস নিজেরে!'

ফরহাদ বললো,'মা তুমি কেন যে বুঝতে পারছো না! আচ্ছা তোমার একটা মেয়ে যদি এমন হতো তখন?'

মা তাকে আবার ধমকে উঠলেন।আর বললেন,'তোর বউ যদি এই ছেলে তার বাপের বাড়িত রাইখা আসতে পারে তাইলে সে এই বাড়িত থাকতে পারবে। আর নয়তো থাকতে পারবে না।'

ফরহাদ সঙ্গে সঙ্গে বললো,'আমি একটা ছেলেকে কিছুতেই মাতৃহারা করতে পারবো না।'

'বাহ বাহ! তাইলে তো ভালই।যা ছেলে আর তার মারে নিয়া আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে যা।'

'

ফুলশয্যার রাত।লোকে বলে এরচেয়ে সুন্দর এবং পবিত্র রাত আর হতেই পারে না। কিন্তু আমাদের বেলায় এ রাতটা এমন কাল রাত হলো কেন!

ফরহাদ মন খারাপ করে ঘরে ঢুকলো। তারপর ঘুমন্ত ভূবনকে কোলে নিয়ে আমার হাত টেনে ধরে বললো,'উঠো।'

আমি কাঁদছি। কাঁদতে কাঁদতে আমি বললাম,'কোথায় যাবো আমরা?'

ফরহাদ বললো,'আল্লার দুনিয়ায় আমাদের এই তিনটা মানুষের থাকার জায়গার অভাব হবে না নিশ্চয়। তিনি তো সবজান্তা। তিনি কী দেখছেন না তার বান্দা কী ভয়ঙ্কর বিপদে পড়েছে!'

আমি সঙ্গে সঙ্গে ফরহাদের হাত ধরে উঠে দাঁড়ালাম। তারপর ঘর থেকে বের হলাম ওর সাথে। পেছন থেকে মা বললেন,'আর কোনদিন ফিরিস না বেয়াদব ছেলে। কোনদিন না।'

ফরহাদ কথা বললো না।আমি কেঁদে উঠলাম। ফরহাদ তাড়াতাড়ি আমার মুখ চেপে ধরে বললো,'আর কান্না নয়। এই বাড়িতেই মাটি চাপা দিয়ে যাচ্ছি আমরা আমাদের কান্না।এটা আমাদের ভাগ্যে ছিল।তাকদীর একটা মস্ত বিষয়।একে অস্বীকার করার শক্তি তোমার এবং আমার নাই!'

'

আমরা আশ্রয় নিলাম ফরহাদের দূর সম্পর্কের এক ফুপুর বাসায়।ওই ফুপু নিজেও বিধবা।বড় কষ্ট করে নিজের সন্তানদের বড় করেছেন। তাকে কেউ বিয়ে করতে এগিয়ে আসেনি।তার সন্তানেরা এখন বড় বড় চাকুরে। তিনি আমাদের দুঃখটা বুঝলেন। তাদের ওখানে আমাদের তিনি থাকতে দিলেন এবং ফরহাদকে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিলেন। ফরহাদের কথা সত্যি হলো। আসলেই মহান আল্লাহ গাফুরুর রাহীম। তিনি দয়ার সাগর। তিনি তো জানেন তার বান্দার বিপদ সম্পর্কে!

'

দীর্ঘ ছ'বছর পরের কথা।

ফরহাদের মেজো বোনের নাম টিউলিপ।সে ফরহাদের চেয়ে বয়সে এক বছরের ছোট। টিউলিপের এক মেয়ে। মেয়ের বয়স চার। টিউলিপের স্বামী হঠাৎ বাস এক্সিডেন্টে মারা গেছে।কী সর্বনাশের কথা! টিউলিপের শাশুড়ি আস্ত একটা দারোগী।সে তার ছেলের মৃত্যুর জন্য টিউলিপকেই দায়ী করে। কারণ টিউলিপ ছিল ফরহাদদের বাসায়। তাকে নেয়ার জন্যই বাসে করে আসছিল তার স্বামী।

টিউলিপের শাশুড়ি একরকম ঘাড় ধাক্কা দিয়েই মেয়ে সমেত টিউলিপকে বাড়ি থেকে বের করে দিলো। টিউলিপ বেচারী আর কী করবে! সে অসহায়ের মতো তার মার সাথেই এসে বাস করতে লাগলো। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো ফরহাদের অন্য ভাই আর তাদের স্ত্রীদের ব্যাপারটা সহ্য হচ্ছিল না।তারা তাদের ঘাড়ে উটকো ঝামেলা রাখা পছন্দ করছিলো না।তারা উঠে পড়ে লাগনো টিউলিপকে একটা বিয়ে দিয়ে দিতে।

এখন ফরহাদের মাও অসুস্থ। তার শরীরে নানান রোগ এসে বাসা বেঁধেছে।বাড়িতেও তার কোন দাপট নেই। কেউ বুড়ো মানুষের কথা কানে তুলতে চায় না। অবশেষে তিনি তার ভুল বুঝতে পারলেন। কেন জানি তার হঠাৎ মনে হলো সে রাতের নিষ্ঠুরতার কথা। এই জন্যই তিনি আমাদের ঠিকানা খুঁজে বের করলেন। তারপর এখানে এসে আমার হাত ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন।

আমি অবাক হয়ে বললাম,'কী হয়েছে মা?'

তিনি কাঁদতে কাঁদতে বললেন,'আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে!আমি আগে বুঝতে পারিনি বউমা। অহংকারের বশে সেদিন অনেক কিছু করে ফেলেছি। তোমাদেরকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছি। আল্লাহ আমায় এরজন্য উচিত শিক্ষা দিয়েছেন। আমার টিউলিপকে তিনি বিধবা করে দিয়েছেন। এখন আমি বুঝতে পারছি একটা বিধবা মেয়ের কত কষ্ট।আর মেয়েটার মায়ের কত দুশ্চিন্তা।'

রাতে ফরহাদ ফিরলো বাসায়।সে মাকে দেখেই অবাক হলো।শত হোক মার প্রতি তো সন্তান সব সময়ই দূর্বল থাকে। ফরহাদ মার কাছ থেকে সবকিছু শুনে কেঁদে ফেললো।


মা বললেন,'তোরা আমায় ক্ষমা করে দে বাবা?'

আমরা উভয়েই তখন গলা মিলিয়ে বললাম,'আমরা সবকিছু ভুলে গেছি মা।'

মা তখন বললেন,'তোরা যদি সবকিছু ভুলে গিয়ে থাকিস তবে এক্ষুনি আমার সাথে আমার নাতীকে নিয়ে বাড়িতে চল।'

ফরহাদ বললো,'যাবো মা।'

'

সে রাতে নয় আমরা বাড়ি ফিরলাম পরদিন সকাল বেলা।ভাগ্যের লিখা গুলো আসলে কেউ খন্ডাতে পারে না। আমাদের বাড়ি ফেরার মাস চারেক পরেই একজন ধণাঢ্য মহিলা এলেন আমাদের বাড়িতে। তিনি বিধবা মেয়ে খুঁজছেন। সন্তান সহ হলে আরো ভালো।আমরা ভাবলাম তিনি হয়তোবা আমাদের সাহায্য টাহায্য করবেন। কিন্তু তার কথা শুনে অবাক হলাম। তিনি বলছেন, তার ছোট ছেলে সদ্য এমবি- বি - এস পাশ করা ডাক্তার। ছেলের ইচ্ছে বিধবা মেয়ে বিয়ে করবে। মহিলা নিজেও এতে রাজি। তাই তিনি নিজেই এমন পাত্রীর সন্ধানে নেমে পড়েছেন।

আমার শাশুড়ি মা সেই মহিলাকে জড়িয়ে ধরে তখন কান্নায় ভেঙে পড়েন।আমি জানি এই কান্নাটা তার যতোটা না আনন্দের তারচেয়ে বেশি তার করা ভুলের জন্য।তার মনের অন্ধকারের জন্য। হয়তোবা তিনি কাঁদতে কাঁদতে ভাবছেন,আমি কেন এই মহিলার মতো হতে পারলাম না! আমার চিন্তা ভাবনা কেন এতো ছোট,এতো সংকীর্ণ!অল্প বয়সী বিধবারাও তো এ সমাজের মানুষ।তারা আমাদের বোন, আমাদের মা।বিধবা কেউ তো নিজের ইচ্ছায় হয় না। এবং সবচেয়ে বড়ো কথা বিধবাদের সম্মান দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন আমাদের নবী সাঃ। বিধবা বিয়ে যদি সম্মানের না হতো তবে আমাদের নবী সাঃ তার প্রথম বিয়েটা কোন বিধবা রমণীকে করতেন না!

'

বিধবা_বিবাহ

অনন্য_শফিক


এমন আরও গল্প পড়ুন‌।