বউ শাশুড়ির সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত | বউ শাশুড়ির ভালোবাসা

 বউ শাশুড়ির সম্পর্ক

বউ শাশুড়ির সম্পর্ক

আমার পেটে যখন সন্তান এলো তখন সিদ্ধান্ত নিলাম, সন্তানের জন্ম শ্বশুরবাড়িতে হবে। বাবার বাড়িতে যাবো না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারি নি। 


  গর্ভধারণের পর থেকে লক্ষ্য করলাম প্রবল ভাবে পেটে ব্য'থা করছে। ব্য'থাটা এতো তীব্র ছিলো যে, চলাফেরা করা কষ্টকর হয়ে পড়লো। 

  স্বামীকে বললে, সে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো। ডাক্তার বললেন, বিশ্রামে থাকতে।


  কিন্তু দু একদিন আমাকে শুয়ে বসে থাকতে দেখে শাশুড়ির মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। 

  তিনি একদিন রুমে এসে কাটা কাটা উচ্চারণে বললেন,"সন্তান তো আমিও ধারণা করেছি। কিন্তু তখন তো তোমার মতো এভাবে শুয়ে বসে থাকি নি! এসব ঢং বাদ দাও।"

  তারপর রুম থেকে বেরুনোর সময় গজগজ করে বললেন,"যত্তোসব ফাঁ'কিবাজ! কাজ না করার বাহানা!"


  ডাক্তারের কথা আর মানা সম্ভব হলো না। প্রবল ব্য'থা নিয়ে সংসারের কাজ করে যেতে লাগলাম। কাজ বেশি করতে হতো। কারণ কাজের লোক রাখা শাশুড়ি পছন্দ করতেন না।


  আমার স্বামী ব্যবসায়ী। কিন্তু তখন তার ব্যবসা খারাপ যাচ্ছিলো। তাই আগের মতো খরচ করতে পারছিলো না। গর্ভকালীন সময়ে মেয়েদের যে বাড়তি পুষ্টিকর খাবার খেতে হয় এটা সে বুঝতো। সে তার সাধ্য অনুযায়ী আমার জন্য দুধ, ডিম, ফলমূল কিনে আনতো। বাড়ির সবার জন্য এসব খাবার কেনার সাধ্য তার ছিলো না। অবশ্য আমার শ্বশুর তখনো চাকরি করতেন। এসব খাবার তিনি অনায়াসে কিনতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে এবং ছেলের আর্থিক স'মস্যার কথা বিবেচনা না করে ছেলের ওপর ক্ষেপে গেলেন। 


  আমাকে শুনিয়ে একদিন আমার স্বামীকে বললেন,"তোকে জন্ম দিয়েছি, লালন পালন করে বড়ো করেছি। আর আজ তুই বাবা মাকে দুধ, ডিম, ফলমূল না খাইয়ে পরের ঘরের মেয়েকে খাওয়াচ্ছিস? এতো নিচে নামলি কী করে তুই?"

  শাশুড়ি তখন বললেন,"বউ পেয়েছে, এখন কি আর বাবা মা'র কথা মনে থাকবে? নিমক হারাম ছেলে!"

  স্বামী তখন নরম স্বরে বললো,"আমার এখন ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না। তাই সবার জন্য ওসব খাবার কিনতে পারছি না। বউকে তো বিলাসিতা করে খাওয়াচ্ছি না। এখন ওর পুষ্টিকর খাবার দরকার।"

  তারপর বললো,"কথা দিচ্ছি, ব্যবসার মন্দা কেটে গেলে আপনাদের জন্য ভালো খাবার প্রতিদিন কিনবো।"

  এরপর বললো,"বাবা, আপনি তো এখনো আয় করেন। আপনি চাইলে তো ওসব খাবার কিনতে পারেন।"

  শ্বশুর ধমকে বললেন,"চুপ থাক। কথা বেশি বলিস তুই। আমরা কিছু বুঝি না, তাই না? প্রেম উতলে পড়ছে বউয়ের জন্য।"

স্বামী সে রাতে বি'ষণ্ণ গলায় আমাকে বললো,"সামান্য কিছু পুষ্টিকর খাবার তোমাকে দিতে চেয়েছিলাম। তাও পারলাম না।"

  ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম,"তুমি মন খারাপ কোরো না। তোমার অবস্থা বুঝতে পারছি।"


  শারীরিক য'ন্ত্রণা, ঠিক ভাবে খেতে না পারা এবং সংসারের কাজের ধকলে শরীর দ্রুত খারাপ হয়ে যেতে লাগলো। একটা সময় কোমর, হাত, পা ব্যথা শুরু হলো। য'ন্ত্রণায় এবং দুর্বলতায় রাতে এক ফোঁটা ঘুম হতো না।


  র'ক্তশূন্যতায় এবং পুষ্টিহীনতায় আমার অবস্থার যখন খুব বেশি অবনতি হয়ে গেলো তখন পেটের বাচ্চার কথা ভেবে ভয় পেয়ে গেলাম। ভাবলাম, ওর যদি কিছু হয়ে যায়? সেই ভয় থেকে অত:পর শ্বশুরবাড়িতে সন্তান জন্ম দেয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে বাধ্য হলাম। 

  এবং ভগ্ন কণ্ঠে স্বামীকে বললাম,"আমাকে বাবার বাড়িতে নিয়ে চলো।"

  সে আমার কথা রাখলো।


  বাবার বাড়ি যাওয়ার পর আমার করুন অবস্থা দেখে বাবা মা হুহু করে কেঁদে দিলেন। যাই হোক, যথা সময়ে আমার একটা ছেলে সন্তান হলো। যদিও ওর ওজন প্রয়োজনের তুলনায় কম ছিলো, তার মধ‍্যে পুষ্টিহীনতা ছিলো অনেক।তবে আল্লাহর রহমতে আমি এবং ছেলে দুজনই সুস্থ থাকলাম। এক ছেলে ছাড়া আমার আর বাচ্ছা হলোনা। অনেক চেষ্টা করেও আর মা হতে পারলাম না, এই ছেলেকে বুকে নিয়েই জীবন কাটাতে লাগলাম।


২.

তিরিশ বছর পরের কথা। স্বামী এবং শ্বশুর শাশুড়ি মারা গেছেন। ছেলেকে বিয়ে করালাম। 

  তারপর পুত্রবধূ যখন গর্ভবতী হলো, তখন বউয়ের হাত ধরে বললাম,"মাগো, তোমার যখনই কোনো স'মস্যা হবে আমাকে বলবে। আর তোমার এখন ঘরের কাজ করার দরকার নেই।"


  আমি নিজে ছেলের বউয়ের দেখাশোনা করছি। সুষম খাবার খেতে দিচ্ছি, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছি। 


  মাস খানিক পর ছেলে এক সন্ধ্যায় আমাকে এসে বললো,"আজ শ্বশুর ফোন করে মেয়েকে বাবার বাড়ি যেতে বলেছিলেন। বলেছিলেন, এই সময় বাবার বাড়িতে মেয়েদের যত্ন ঠিক ভাবে হয়। শ্বশুরবাড়িতে হয় না। শুনে আমার বউ কি বললো জানো?"

  বললাম,"কী বললো?"

  "বললো,'না বাবা, বাড়ি যাবো না। সন্তান এখানে হবে। শাশুড়ি মা এতো ভালো যে, বলে বোঝাতে পারবো না। তিনি আমাকে আপন সন্তানের মতো ভালোবাসেন। সার্বক্ষণিক আমার খেয়াল রাখেন। তোমরা নিশ্চিন্তে থাকো'।"


   শুনে চোখ দুটো হঠাৎ ভিজে উঠতে চাইলো। কোনো রকমে নিজেকে আটকালাম।


  কিন্তু ছেলে চলে যাওয়ার পর আর আটকানোর চেষ্টা করলাম না। চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়তে লাগলো। নিজে গর্ভকালীন সময়ে শ্বশুরবাড়িতে এমন ভালোবাসা পাই নি বলে কি? নাকি আনন্দে? কে জানে!

যা ই হোক অন্তত একটা মেয়ে তার শাশুড়ির উপর ভরসা করে এই কথাটা বলতে পারলো। তার জীবনটা আমার মতো হলোনা এটা ভেবেই শান্তি পেলাম।


সব শাশুড়িদেরকে বলবো আপনার জীবন যেমন তেমন কেটে গেছে কিন্তু নিজের ছেলের বউয়ের পাশে একটু বন্ধুর মতো থাকুন, বিশেষ করে তার গর্ভকালীন সময়ে তখন মেয়েটা খুব অসহায়। আপনার একটু সুন্দর ব‍্যবহারে সে তার জীবন ফিরে পাবে। স্বামীদেরকে বলবো আপনার মা বাবা পাশে না থাকলেও আপনি একটু পাশে থাকবেন। তাকে সাহস দিবেন, বুকে আগলে রাখবেন, তার খেয়াল রাখবেন। সবার সামনে না পারলেও গোপনে তার ভরসার মানুষ হয়ে থাকবেন এটাই আপনাদের প্রতি অনুরোধ।


ফাতেমা বেগম 

-নারী


বউ শাশুড়ির গল্প পড়ুন।