বাস্তব জীবনের গল্প | বাস্তব জীবন নিয়ে স্ট্যাটাস

 বাস্তব জীবনের কিছু গল্প

বাস্তব জীবনের কিছু গল্প

আজ আমার বাসররাত। সারাঘর খুব  সুন্দর  করে সাজানো। আমি খাটের মাঝখানে  বসে আছি। খাটটা অসম্ভব  সুন্দর  করে কাঠগোলাপ  দিয়ে  সাজানো  হয়েছে। এমনকি  আমার সব গহনাগুলোও কাঠগোলাপ  দিয়ে  বানানো হয়েছে। ঘরের মধ্যে  একটা  মিষ্টি ঘ্রাণ মৌ মৌ করছে। এই ঘ্রাণই আমাকে বারবার সুদূর অতীতে নিয়ে  যাচ্ছে। 


 আমি মিলা। এইটুকুই আমার পরিচয়। আমি জানি না আমার বাবার নাম কি? মার নাম কি? কোথায় আমার বাড়ি?  আমি কিছুই  জানি না। তবে একসময়  সব ছিল  এটা মনে করতে পারি। আর মনে করতে পারি আমার বড় বোনের  নাম শিলা।  আমরা পিঠাপিঠি দুবোন। আমার খেলার সাথী চায়না,ছুম্মা, মনি,শিলু ও আসাদ। গ্রামে আমাদের  বাড়ি ছিল। বাড়ির   সামনের দিকে নদী ছিল আর পিছনে  অনেক  ধানের  ক্ষেত ছিল। বাড়িতে দাদা-দাদি,  বাবা-মা,  কাকা- কাকি আরও অনেক  মানুষ  ছিল। সারাদিন  কেটে যেত খেলতে খেলতে। সবাই  মিলে একসাথে  নদীতে গোসল  করা। মায়ের  কোলে শুয়ে ঘুম পাড়ানীর গান শুনতে  শুনতে  ঘুমিয়ে  পড়া, বাবা অফিস  থেকে  ফেরার পথে  প্রতিদিন কিছু না কিছু  নিয়ে   বাড়ি ফেরা, বন্ধুদের সাথে লুকোচুরি  খেলা এমন অসংখ্য  ছোট ছোট  স্মৃতি আমার শুধু  মনে আছে। যেগুলো আমার জীবনে মূল্যবান সুখ স্মৃতি,আমার অস্তিত্ব।  অনেক  যত্নে  এই স্মৃতি গুলো  আগলে আমি বেঁচে  আছি। 


তখন আমার বয়স কতো হবে  সম্ভবত  পাঁচ  ছয়। এখনকার দিনের মতো ঘটা করে জন্মদিন  পালন করা হতো না। বেশি  হলে মা পায়েস  রান্না করে মসজিদে  মিলাদ দিতো। সেজন্য  কতো বছর  সঠিক  বলতে পারবো না, তবে তখনও  স্কুলে  যেতাম না এটা মনে আছে। একদিন  বাড়িতে  খুব আয়োজন। ভালো  ভালো  রান্না হচ্ছে, সবাই  বাড়িঘর গোছগাছ  করতে ব্যস্ত।  কিছুক্ষণ পর পর দাদার  হাঁকডাক। এটা হলো না,ওটা হলো না। আমরা ছোটরা  কিছু  বুঝতে  পারছি  না। কি হলো বাড়িতে?  তারপর  শুনলাম  কাকার বিয়ে। ঢাকা থেকে মেহমান আসবে  তাই  এতো আয়োজন। কয়েকদিন  পর শুনলাম  আমাদেরকে ঢাকায় যেতে হবে। সেখানেই বিয়ে  নতুন  কাকি আসবে। সে কি আনন্দ  আমাদের। কাকা ঢাকায় চাকরি  করতো। বাড়িতে  আসার সময় আমাদের  জন্য  কতো কিছু  নিয়ে আসতো। কতো গল্প  করতো ঢাকার  রাস্তায়  লাল নীল বাততি জ্বলে, অনেক  বড় বড় গাড়ি,অনেক  বড় বড় দালান, ঘরের  মধ্যে  বাথরুম,কল ঘুরালেই পানি পড়ে, রান্না  করতে খড়ি লাগে না। আরো কতো গল্প  শুনতাম। সেই  ঢাকায়  আমরা সবাই  যাবো। কি মজা! মা আমাদের  দুবোনের জন্য  কাপড় কিনে অনেক  সুন্দর  সুন্দর  জামা বানিয়ে দিলেন। আমাদের  আনন্দ  আর ধরে  না। প্রতিদিন কতোবার যে মার কাছে  জানতে চাইতাম আমরা  কবে যাবো, কবে বড় গাড়িতে চড়বো।


অবশেষে  এলো সেই  মহেন্দ্রক্ষণ। আমরা সকাল  সকাল নদীতে  গোসল  করে  নতুন  জামা পড়ে  ভাত খেয়ে রওনা  দিলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। বড় গাড়ি  দেখে  যতটা  না খুশি হয়েছিলাম কিন্তু গাড়ি  চলার পর তারচেয়েও বেশি  মাকে বিরক্ত  করছিলাম। শরীর  খারাপ  লাগছিল। বারবার  বমি হচ্ছিল। মা খুব  আদর করে কোলের মধ্যে  ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিল। যখন  ঘুম  ভাঙলো তখন দেখি চারপাশে  শুধু  পানি আর পানি। আমরা সবাই  বড় একটা  লঞ্চের মধ্যে। বাবা আমাদের  সবাইকে  মুড়ি মাখানো খাওয়ালো। এতো মজার মুড়ি আমি জীবনেও খাইনি। আবার গাড়িতে উঠে  চোখ  বন্ধ করে মায়ের  কোলে ঘুমিয়ে গেলাম। এবার ঘুম ভেঙে  কাকার বাসায়। পরেরদিন  বিয়ে। বড়দের  শুধু  কাজ আর কাজ। আমাদের শুধু  খেলা আর মজা আর বারবার  কল ছেড়ে  পানি নিয়ে খেলা করা। ঝর্ণা ছেড়ে  বারেবারে  ভেজা। কি আনন্দ  যখন তখন বৃষ্টিতে ভেজা!


বিয়ের দিন বাসায় অনেক  লোকের ভিড়। দুপুরে বরযাত্রী যাবে। মা আমাদের  দুবোনকে সাবান শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করিয়ে  লাল জামা পড়িয়ে দুই  হাত ভর্তি লাল কাঁচের , কানে সোনার দুল, মাথায় দুই  ঝুঁটি  করে খুব  সুন্দর  করে সাজিয়ে দিয়েছিল। আমরা দুবোন খুশিতে  নেচে নেচে বেড়াচ্ছিলাম। সবাই  ঘুরে ঘুরে  আমাদের  দেখছিল আর আদর করে  বলছিল পরীর মতো লাগছে।  কে জানতো এটাই আমাকে মায়ের শেষ  সাজানো। আমরা সবাই  বড় একটা গাড়িতে করে নতুন কাকিদের বাসায় আসলাম। এসে দেখি টুকটুকে একটা  লাল বউ স্টেজে বসে আছে।  কি যে সুন্দর  লাগছে!  আমরা দু বোন  নতুন  কাকির কোলে গিয়ে বসলাম। কিছুক্ষণ  পর আমরা দুবোন  ঘুরে  ঘুরে  সবকিছু  দেখছিলাম। হঠাৎ  দেখি  গেটের  সামনে একটা গাছের  নিচে কিছু  ফুল পড়ে  আছে। ফুলগুলো দেখতে খুব  সুন্দর। সাদার  মাঝখানে  হলুদ রঙের, আকারেও একটু বড়। খুব মিষ্টি  ঘ্রাণ। আগে কখনো  এই ফুল দেখিনি। নাম জানার প্রশ্নই আসে না। পরে  বড় হয়ে নাম জেনেছি  কাঠগোলাপ। আমরা দুজন গাছ  ঝাঁকি  দিয়ে  ফুল পাড়ছিলাম।  কিছুক্ষণ  পর দুটো ছেলে  আমাদের  থেকে বড়  শার্ট প্যান্ট পড়া আমাদের  কাছে  এসে গাছ ঝাঁকি  দিয়ে  ফুল  পেড়ে দিচ্ছিল  আর গল্প করছিল। আমরা ফুল ভালোবাসি কিনা, আরো ফুল নিবো কিনা। ওরা বলল সামনেই  ওদের বাড়ি। ওদের  অনেক  বড় বাগান  অনেক  রকম ফুলের গাছ । আমরা ওদের  সাথে গেলে অনেক  ফুল দিবে। আমরা দুবোন তো মহা খুশি। আমরা বললাম  তোমরা নিয়ে  আসো আমরা এখানে  থাকি। ওরা বলল, তোমাদের  দারোয়ান  তো আমাদের  আর ঢুকতে দিবে না। তোমরা চলো যেয়েই ফুল নিয়ে  চলে আসবে বেশি  দেরি  হবে না। খুব বলছিল  কোন ভয় নেই, যাবে আর ফুল নিয়ে  চলে  আসবে। তারপর বলল ঠিক  আছে  একজন চলো। প্রথমে আমার বড় বোনকে নেওয়ার জন্য  হাত ধরে  টানাটানি  করতে লাগলো। ও কিছুতেই  যাবে না। তারপর  আমার হাত ধরে বলল, তুমি  লক্ষ্মী মেয়ে তুমি চল। কোন ভয় নেই  আমরা যাবো আর ফুল নিয়ে চলে আসবো। তোমার বোন এখানে দাঁড়িয়ে  একশত পর্যন্ত গুনতে গুনতেই আমরা চলে আসবো। ফুলের লোভ তো ছিলই আমি যেতে রাজি হলাম।


আমরা কিছু  দূর গিয়ে একটা গলি থেকে অারেক গলি তারপর  আরেক  গলি যেয়ে একটা বড় রাস্তার পাশে  সুন্দর  একটা  বাড়ির  সামনে থামলাম। আমি যতোই বলছি ফুল নিবো না আমি বাড়ি যাবো। ওরা আমার কথা শুনছে না। এবার একটা ছেলে বললো, তোমরা দুজন এখানে  দাঁড়াও।  আমি ফুল নিয়ে আসছি। আমরা দুজন  রাস্তার  পাশে  অপেক্ষা  করছি। কিছুক্ষণ  পর আমার সাথের ছেলেটা বললো, ওমা!  তোমার  কানের দুল  তো খুলে গেছে, আমি লাগিয়ে  দেই। কিছুক্ষণ  চেষ্টা  করার পর বললো, লাগাতে পারিনি। আমার হাতে কাগজে মোড়ানো একটা  কিছু  দিয়ে বলল, এটা কোথাও খুলবে না  সোজা মাকে দিবে। আমি শিলার কাছে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে গেলাম। এবার আমার সাথের ছেলেটা  বলল,তুমি দাঁড়াও আমি ওকে নিয়ে আসি। আমি দাঁড়িয়ে  আছি ওরা আর আসে না। আমিতো  ভয়ে কান্না  করতে করতে দৌড়। শিলার কাছে  যাওয়ার  জন্য  দৌড়াতে  থাকি কিন্তু কোথাও শিলাকে পাচ্ছি  না। রাস্তায়  বড় বড় গাড়ি দেখেই ভয় লাগচ্ছে  আবার শিলাকে পাচ্ছি  না। আমিতো হাউমাউ  করে কাঁদছি আর শিলাকে ডাকছি, মাকে ডাকছি, বাবাকে ডাকছি। কিন্তু  কেউ  আমার কাছে  আসছে না।

 

হঠাৎ  দেখি বড় একটা রেলগাড়ি আস্তে  আস্তে  থামছে। অনেক  লোকের  ভিড়। আমি এক মুহূর্তে কান্না ভুলে অবাক  হয়ে রেলগাড়ি  দেখতে লাগলাম। অনেক  লোক  গাড়ি  থেকে  নামছে। আমি আস্তে  আস্তে  গাড়ির  দিকে  এগিয়ে  গেলাম। দেখলাম  অনেক  লোক  গাড়িতে উঠছে। আমিও কি মনে করে উঠে  পড়লাম। অবাক  হয়ে সবকিছু  দেখতে লাগলাম। শিলার কথা,মার কথা  ভুলে গেলাম। ঘুরতে ঘুরতে  কখন যে গাড়ি  ছেড়ে  দিয়েছে আমি খেয়ালই করিনি। খুব  মজা লাগছিল, আমার মতো আরও ছোট ছোট অনেক  বাচ্চা  ছিল। অনেক  লোকের ভিড়, অনেক  শব্দ। আমি এক জায়গায়  বসে কখন  যেন ঘুমিয়ে  পড়েছিলাম। যখন ঘুম  ভাঙলো, দেখি চারদিকে  অন্ধকার। পাশে বাবা-মা, শিলা কেউ  নেই।  আমি চিৎকার করে কান্না করছি,আমি বাবার কাছে যাবো,মার কাছে যাবো,শিলার কাছে যাবো। সবাই  জিজ্ঞেস  করছে তোমার বাবার নাম কি? মার নাম কি? কার সাথে  এসেছো? কোথা থেকে  এসেছো? আমি কিছুই বলতে পারছি  না। শুধু  কান্না করছি আর বলছি  বাবার কাছে  যাবো, মার কাছে যাবো। আমাকে নিয়ে  একটা হুড়োস্থল কাণ্ড শুরু  হয়ে গেল। কেউ  আমার কান্না থামাতে পারছে না। একজন  লোক  এগিয়ে  এসে আমাকে কোলে নিয়ে  আদর করে বলল,ঠিক আছে  আমি তোমাকে তোমার  বাবা মার কাছে  নিয়ে  যাবো।এবার কান্না থামিয়ে এগুলো আগে খাও। আমার হাতে  এক প্যাকেট বিস্কুট, দুইটা কলা, কিছু  চকলেট  দিলো আর সবাইকে  ভিড় কমাতে বলল। উনি আমার সাথে হেসে হেসে  খুব  মজা করে কথা  বলছিল। আমাকে হাসানো চেষ্টা  করছিল। দুরের  গাছপালা  ঘরবাড়ি  দেখাচ্ছি। ধীরে  ধীরে  আমার কান্না  কমে আসলে উনি আমাকে কোলে বসিয়ে অল্প  অল্প  করে বিস্কুট  কলা মুখে তুলে দিচ্ছিল আর আমার কাছ থেকে  জেনে নিচ্ছিল আমার নাম,ঠিকানা , কয় ভাইবোন, বাড়ি কোথায়? বাবার নাম কি? কি করে? ঢাকায়  কেন এসেছি?  বোন কোথায়?  কাকার নাম কি? আমি খাচ্ছি লাম আর উত্তর  দিচ্ছিলাম। কিন্তু আমার উত্তর শুনে আমার কোন ঠিকানা  উদ্ধার  করা গেল না। এবার বলল, সবাই  তোমার  বাবাকে কি বলে ডাকতো? আমি বললাম  মিয়া  ভাই, বড় ভাই, বড় কাকা আর দাদা- দাদি ডাকতো বড় মিয়া বলে। এবার সবাই  হতাশ হলো।   একজন  বললো, তুমি কিভাবে  ট্রেনে এলে? আমি একে একে সব বললাম  আর আমার হাতে  কাগজে মুড়িয়ে  যে জিনিস  দিয়েছিল। সেটা  আমার জামার ছোট  পকেটে  রেখে দিয়েছিলাম  সেটা দেখালাম। খুলে দেখা গেল একটা গোল চাড়া পেঁচিয়ে  দিয়েছে। সবাই  তখন বুঝতে  পারলো আমি ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছিলাম। উনি  এবার বললেন  তুমি ঘুমিয়ে পড় সকালে তোমার বাবা মার কাছে যাবো। আমি বললাম,  তুমি কে? উনি বললেন , তোমার ভালো  কাকু। আমি ভালো  কাকুর কোলে জড়সড়  হয়ে ঘুমিয়ে  পড়লাম। 


সেই  রাতে আমার প্রচণ্ড জ্বর এসেছিল। জ্বরের  ঘোরে  বাবা-মা, শিলা,দাদা-দাদি  সবাইকে খুঁজছিলাম। কোন উপায় না পেয়ে  ট্রেন থেকে নেমে আমাকে খুলনা শিশু হাসপাতালে  ভর্তি করা হলো। দুই দিন  আমার কোন জ্ঞান ছিল  না। কয়েকদিন  পর আমি একটু সুস্থ হলে ভালো  কাকু আমাকে আবার ঢাকায় এনে কমলাপুর  রেলস্টেশনে  আশেপাশে  থানায় খোঁজ খবর করল। প্রত্যেক থানায় আমার ছবি দিয়ে  রাখল । আশেপাশে এরিয়াতে কোন বাসায় বিয়ে  হয়েছে কিনা, কোন বাসার মেয়ে  হারিয়ে  গেছে  কিনা খোঁজ  নিতে বলল।সব থানায় ভালো  কাকুর  ঠিকানা রেখে আসলো।  কয়েকটি পত্রিকায় নিখোঁজ  সংবাদও ছাপা  হল । কিন্তু  কোথাও  থেকে কোন  খবর পাওয়া গেল না। এতো বড় ঢাকা  শহরে শুধুমাত্র দুটো  নামের ভিত্তিতে কিভাবে  আমার বাবা-মাকে  খুঁজে  পাবে।  এক নিমিষেই  যেন  আমার বাবা-মা  হাওয়াই মিলিয়ে গেল। কোথাও  আমার বাবা-মার কোন খোঁজ  খবর  পাওয়া গেল না। জানি না আমাকে না পেয়ে বাবা- মা বেঁচে  আাছে কিনা। আমাকে নিয়ে  ভালো  কাকু আবার  খুলনায় ফিরে  এলো। ভালো কাকু তার সাধ্যমতো আমার বাবা-মাকে  খোঁজার চেষ্টা  করেছিল। কিন্তু কোনো  খবর পাওয়া  গেল না।


ভালো কাকুর নাম মেজবাহ  উল হাসান। সবাই  হাসান স্যার বলেই ডাকে। উনি খুলনা খালিশপুর  প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। কিছুদিন আগে একটা সড়ক দুর্ঘটনায় ভালোকাকুর সাত বছরের  মেয়ে হীরা আর স্ত্রী  মারা যান। কিছুদিন আমি কান্নাকাটি করতে করতে ভালো  কাকুর  সাথে থাকতে শিখে গেলাম। কিন্তু  সমস্যা  হলো আমি কখনো  ভালো  কাকুকে চোখে আড়াল  হতে দিতাম না। সবসময়  ভয় পেতাম এই বুঝি ভালো  কাকুকে হারিয়ে  ফেলবো। প্রথম প্রথম আমাকে নিয়ে  সব জায়গায়  যেতে হতো। এক সময় একা থাকাও শিখে গেলাম। ভালো কাকুর পরিচয়ে আমি বড় হতে লাগলাম। কবে কখন যেন ভালো  কাকু ভালো  বাবা হয়ে গেল। আমাদের  বাবা মেয়ের  দিন  ভালোই কাটতে লাগলো। 


আমার  হাসবেন্ড  রাতুল। ওর সাথে আমার পরিচয়টাও হয় অদ্ভুতভাবে। আমি তখন  খুলনা  বি এল কলেজ  অর্থনীতিতে অর্নাস থার্ড ইয়ারে পড়ি। আমার তেমন কোন বন্ধু  ছিল  না। সহজে সবার সাথে মিশতে পারতাম  না সবসময়  ভয় হতো। আমার একমাত্র  বান্ধবী  রুমা আর আমি  ক্যাম্পাসের মাঠে বসে গল্প  করছিলাম। এমন সময় একটা ছেলে  আমাদের  পাশ দিয়ে  যাওয়ার সময় ফোনে কথা  বলছিল ঃহ্যালো শিলা এইটুকু শুনেই আমি দৌড়ে  গিয়ে  তাকে বলেছিলাম শিলার সাথে কথা  বলছেন। শিলার বোনের  নাম কি মিলা? আমার এমন অদ্ভুত  প্রশ্ন শুনে উনি তো অবাক  হয়ে আমাকে বলল মানে। আমি তখনই  আমার ভুল বুঝতে পেরে সরি বলে চলে আসি। এমন আমার প্রায়ই হতো শিলার নাম,খেলার সাথীদের কারো নাম শুনলে নিজেকে ঠিক  রাখতে পারতাম না। কোথায়  বাড়ি খোঁজ খবর  নেয়া শুরু করে দিতাম। এরপর থেকে  আমাদের  দেখলে রাতুল  এসে আমাদের  কাছে  বসত। রুমার সাথেই বেশি গল্প  হতো। জানতে পারলাম ও আমাদের  ডিপার্টমেন্টের পড়ে এক বছরের সিনিয়র। ওর বোনের  নাম শিলা। একদিন  ও রুমাদের বাসায় যেয়ে  আমার সম্পর্কে  সব জানে। আস্তে  আস্তে  আমাদের  মধ্যে  ভালো  বন্ধুত্ব হয়ে যায়। একদিন  রাতুল প্রস্তাব করে বাংলাদেশের  যত নদী তীরবর্তী  গ্রাম আছে আমরা সব গ্রামে যাবো। খেলার সাথীদের নাম আর শিলার নাম মিলিয়ে বাবা-মাকে  খুঁজে  বের  করবো। আমারও মনে হলো এভাবে তো কখনো  খোঁজা  হয়নি। যেই ভাবা সেই কাজ শুরু  করে দিলাম। আমরা দুজনে টিউশনি  করা শুরু  করলাম। সেই  টাকা দিয়ে  সময় সুযোগ  পেলেই  আমরা গ্রামে খুঁজতে  যেতাম। প্রথমে তিনজন যেতাম। মাঝে মাঝে আমি আর রাতুল যেতাম, বেশি  দূরে  হলে রাতুল একাই  যেত। কতো গ্রামে  যে গেছি, একসময়  আমি বুঝতে  পারি এভাবে খুঁজে  পাওয়া  অসম্ভব।  কিন্তু রাতুল  হার মানবে না ও আমার বাবা- মাকে খুঁজে  দিবেই। রাতুলের চোখেমুখে একটা  অদ্ভুত  সারল্য আছে। যা দেখে ওকে সহজেই  বিশ্বাস  করা যায়। রাতুলও কখনো বন্ধুত্বের গণ্ডি  অতিক্রম  করেনি। সেই  বিশ্বাস  থেকেই  দুজনে একসাথে  পথচলার সিদ্ধান্ত। 


এখন আমাদের  দুজনের  নিজস্ব  একটা পরিচয়  হয়েছে। রাতুল  সরকারি  কলেজের প্রভাষক।  আমি সমাজ কল্যাণ অফিসার। দুজনের  পোস্টিং ঢাকায়। একান্ত  ঘরোয়া  পরিবেশে শুধুমাত্র দুই  পরিবারের  উপস্থিতিতে কাজি ডেকে  রেজিষ্টি করে আমাদের  বিয়ে। ঐ ঘটনার পর থেকে  আমি কখনো  গহনা পরিনি, সাজুগুজুও করিনি। আজ রুমা জোর করে হালকা মেকাব করে চোখে কাজল দিয়ে  হালকা  গোলাপি  লিপস্টিক  দিয়ে  সাজিয়ে  দিয়েছে।  আমি অফ হোয়াইট রঙের  জমিন চওড়া সোনালী পাড়ের  শাড়ি ও সোনালী  ব্লাউজ পড়ে কাঠগোলাপ  ফুলের গহনা পড়ে  বসে আছি। নিজেকে  কাঠগোলাপ  মনে হচ্ছে। কাঁদতে  কাঁদতে  চোখের  পানি শুখিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু  আজ অনেকদিন পর কিছুতেই  চোখের  পানি  আটকিয়ে রাখতে পারছি  না। আমি আকুল  হয়ে বসে কাঁদছি। কোথায়  আমার বাবা - মা আছে?  কেমন আছে? শিলা কি আমাকে  খুঁজতে  যেয়ে হারিয়ে  গেছে  নাকি বাবা-মার সাথে  আছে। আমি মনেপ্রাণে চাই  ও বাবা-মার আদর ভালোবাসায় বেঁচে  থাকুক। কেন যেন আজ খুব  ওদের কথা বেশি  মনে পড়ছে আর দু-চোখ  বেয়ে পানি  পড়ছে। এমন সময়  কুট করে দরজা খোলার শব্দ হলে আমি চোখ  তুলে তাকিয়ে  দেখি  আমার শ্বশুর - শাশুড়ী, রাতুল,শিলা,ভালো বাবা। আমি দৌড়ে  গিয়ে  শাশুড়ী  মাকে জড়িয়ে  ধরে  হাউমাউ  করে কাঁদতে  থাকি। দুই  পাশ থেকে  শ্বশুর  - শাশুড়ী ও আমাকে জড়িয়ে  ধরে কাঁদতে  থাকে আর বলে আমরা তোর শ্বশুর  শাশুড়ী  না। তোর হারিয়ে  যাওয়া  বাবা-মা  আর তুই  আমাদের  হারিয়ে  যাওয়া মেয়ে মিলা। আজ থেকে  আমরা সবাই  একসাথে থাকবো। একথা শুনে আমি আরো জোরে আমার বাবা-মাকে  জড়িয়ে     ধরলাম।  অবাক  হয়ে লক্ষ্য  করলাম  অনেক দিন পর আমার বাবা- মার গায়ের গন্ধ  পাচ্ছি।  সব বাবা- মার গায়ের  গন্ধ  কি এক! নাকি এটা ভালোবাসার গন্ধ! আমি মনে মনে আল্লাহ তায়ালা  কাছে হাজার শুকরিয়া  জানাচ্ছি আল্লাহ  শুধু  আমার কাছ থেকে  কেড়ে নেয়নি  দিয়েছেন ও দুহাত  ভরে। আজ বুঝতে পারছি  বাবা-মা  আমার কাছে না থাকলেও  তাদের  দোয়া  সবসময় আমার সাথে ছিল। যেখানেই থাকো বাবা- মা ভালো  থেকো। তোমরা থাকবে আমার হৃদয়ে, বিশ্বাসে, ভালোবাসায়,ভালোলাগায়,শ্রদ্ধায়।


গল্পঃ

কাঠগোলাপ 

ফারহানা জেসমিন 


এমন আরও গল্প পড়ুন।