গল্পঃ_এক_জীবন_প্রেম | প্রেম ভালোবাসার গল্প

প্রেমের কাহিনী

প্রেমের কাহিনী

 বিয়ের ঠিক একসপ্তাহ আগে রোড এক্সিডেন্টে আমার হবু বর আদিবের পা-দুটো পঙ্গু হয়ে যায়। ডাক্তার বলে দেয়,‘পা দুটো ঠিক হবে কি-না, তার নিশ্চয়তা নেই;হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। না হওয়ার চান্সই বেশি।’


একথা শুনে আমার পরিবার সরাসরি এ বিয়ে ভেঙে দেয়।

পরিবারের এ সিদ্ধান্ত আমি মেনে নিতে পারছিলাম না। আমাদের চার বছর প্রনয়ের পর বহু কাঠ-খড় পুড়িয়ে দুই পরিবারকে মানিয়েছি বিয়ের জন্য।এর মধ্যে আদিবের এক্সিডেন্ট হওয়ায় আমার পরিবার বিয়েটা ভেঙে দিয়েছে।  


.


বড় ভাইয়া সবাইকে বলে বুঝিয়েছে,

– 'আবেগের কারনে তিশা এখন আদিবকে বিয়ে করতে চাইছে সারাজীবন আদিবের সেবা-যত্ন করতে পারবে না।'


সবাই ভাইয়া কথাটাকেই মূল্য দিয়ে আমার বিয়েটা ভেঙে দিয়েছে। আমার পরিবারের সিদ্ধান্ত শুনে হাসপাতালের বেডে শুয়েই আমার হবু বর আদিব বলেছে,


– 'তিশা যদি নিজের মুখে একথা বলে তাহলে আমি দ্বিতীয়বার তিশাকে বিয়ে করার দুঃসাহস করবো না।'


এদিকে আমার ভাইয়া আদিবের মুখের ওপর বলে দিয়েছে,


– 'পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে তিশা বিয়ে করবে না।'


.


আমি পড়েছি মহা ফ্যাসাদে।এদিকে আমার ভালোবাসা, আরেকদিকে আমার পরিবার।


বড় ভাইয়া আবার আরেক জায়গায় আমার বিয়ে ঠিক করেছে। এতো বড় বিপদের মধ্যে আদিবকে ফেলে 

আমি অন্য কারো সংসার করতে পারবো না।


অনেক কষ্টে মাকে বুঝিয়েছি।এখন মা সবাইকে বোঝাতে পারলেই হয়। কোনকিছুতেই আমার মন বসছে না। এরমাঝেই বাবা আমার রুমে এলেন।


আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, 

-- 'মা রে, কোনো বাবা-মা তার সন্তানের খারাপ চায় না।সবাই চায় তার সন্তান সারাজীবন সুখে থাকুক। আমিও চাই তুইও জীবনে সুখে থাক।তোর মায়ের থেকে আমি আজ সব শুনলাম। তুই যদি আদিবকে বিয়ে করে সুখী থাকিস তাহলে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু যেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিস ভেবে নিয়েছিস তো?


-- 'হ্যাঁ,বাবা।সব ভেবে-চিন্তেই বলেছি।'


-- 'আচ্ছা ঠিক আছে। তাহলে আগের তারিখেই তোদের বিয়ে হবে।আমি আদিবের পরিবারের সাথে কথা বলছি।'


বাবার কথা শুনে আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম। 

.

.

.

অবশেষে আমার জীবনে বিয়ের দিনটা ঘনিয়ে এলো। পার্লার থেকে মেয়েরা এসে আমাকে বৌ সাজাচ্ছে।আমরা মনটা আজকে অনেক খারাপ।আজকে সবাইকে ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি চলে যাব।এ কয়টা দিন বড়ভাইয়া-ছোটভাইয়া কেউ আমার সাথে কথা বলে নি। বাবাও প্রয়োজন ছাড়া কোন কথা বলে নি। তবে বিয়ের অনুষ্ঠানের ডেকোরেশনে কোন কমতি রাখে নি।


পরিবারের সকলের ইচ্ছে ছিল, তাদের একমাত্র মেয়ের বিয়ে অনেক ধুমধাম করে দিবে। বিয়েটা আমার ইচ্ছাতে হলেও তারা কোনকিছুর কমতি রাখে নি।


আত্মীয়-স্বজন,পাড়া-প্রতিবেশীরা আমাকে নিয়ে কানাঘুষা করছে- দুনিয়ায় এতো ছেলে থাকতে আমি কেনো সেচ্ছায় পঙ্গু ছেলেকে বিয়ে করছি।আরো অনেক হাবিজাবি কথা-বার্তা।


.


বরযাত্রী চলে এলো। কিন্তু আমার বর এলো না। সকলের খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষে আমাকে বিদায় দেওয়া হলো।আমি দুই ভাইয়াকে জড়িয়ে অনেকক্ষন কাঁদলাম।


এতোদিন তারা আমার সাথে কথা না বললেও বিদায়ের বেলায় আমাকে ধরে তারাও অনেকক্ষন কাঁদলো। বর ছাড়াই আমি বিয়ের গাড়িতে উঠলাম। আমিই মনে হয় একমাত্র মেয়ে,যে কিনা বর ছাড়াই শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি।


আর পাঁচটা মেয়ের মতো আমারও খুব স্বপ্ন ছিল, ঘোড়ায় চেপে বর আসবে।বিয়ে করে ঘোড়ায় চড়ে শ্বশুরবাড়ি যাবো।কিন্তু আমার স্বপ্নটা স্বপ্নই থেকে গেল।


.


শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার পর শ্বাশুড়িমা আমায় বরণ করে ঘরে তুললেন। বসার ঘরে ঢুকে দেখি আদিব হাসিমুখে  শেরওয়ানী-পাগড়ী পড়ে হুইলচেয়ারে বসে আছে।


আমায় দেখে একটা মুচকি হাসি দিল। ওর হাসি দেখে আমারও অনেক খুশি লাগলো।এরপর কাজি এসে আমাদের বিয়ে পড়ানো শুরু করলো। তিনবার 'কবুল' পড়ে দুজন একই বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেলাম।


এরপর চললো আমাদের কয়েক দফা ফটোসেশান। ছবি তোলা শেষে ফ্রেশ হয়ে দুজনেই বাসরঘরে গেলাম। ঘরে ঢুকেই আদিবের পা ধরে সালাম করলাম।


আদিব হতবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলে,

-- 'আরে,,আরে,, কি করছো তুমি?পায়ে হাত দিচ্ছো কেনো?'


আমি মুখ ভেংচে উত্তর দিলাম, 

-- 'কেনো সিনেমায় দেখো নি বাসরঘরে বরকে বৌ সালাম করে?'


আমার কথা শুনে আদিব হাহা করে হেসে দিলো।তারপর আমার হাত দুটো ধরে বললো,


-- 'চারবছর ধরে আমাকে যেমন ভালোবাসছো আগামী দিনগুলোতেও ঠিক সেরকমই ভালোবেসো...

আমাকে কখনো একা করে যেও না। তুমি ছাড়া আমি যে আমি যে বড্ড অসহায়।'


-- 'তুমি এতোদিন আমাকে এই চিনেছো?'


-- 'না..না..আমি তা বলি নি।মাঝে মাঝে দেখি এত বছরের  ভালোবাসার বিয়ের পরও ভেঙে যায় সামান্য থেকে সামান্যতম কারনে। আর তার ওপর আমি হচ্ছি পঙ্গু, সকলের বোঝা।'


খেয়াল করলাম কথাগুলো বলতে বলতে আদিবের চোখে পানি এসে পড়েছে। সাবধানে আমার কাছ থেকে পানি আড়াল করতে চাইছে।


আমিও না দেখার ভান করে ওকে বললাম, 

-- 'আমাকে যখন কেউ বিশ্বাস করে,ভরসা করে তখন আমি তাকে বিশ্বাসের মূল্য রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করি। আর কখনো নিজেকে তুমি পঙ্গু বলবেনা। তুমি আমার হাজবেন্ড, আমার মাথার তাজ। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আমি তোমার সাথে কাটাতে চাই।'

.

.

.

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দুজনেই ফ্রেশ হয়ে নিচে নাস্তা করতে গেলাম। সেখানে অনেকক্ষণ আড্ডা দিলাম ননদী দেবরদের সাথে। পাশের বাড়ির কিছু মানুষ আমাকে দেখতে আসছে। নতুন বউ বলে কথা। সবাই বেশ ভালো কথা, দোয়া করছিল আমরা যাতে অনেক সুখী হই,সারাজীবন একসাথে থাকি।


এসব কথা শুনে বেশ ভালোই লাগছিল। কিন্তু একজনের কথা শুনে আমি পুরোই থ! মানুষের চিন্তা ভাবনা এতো নিচু হয় কীভাবে? সম্পর্কে তিনি আমার  দূরসম্পর্কের চাচী শাশুড়ী।


তিনি আমাকে বলেন,

-- 'দেখতে মাশাআল্লাহ অনেক সুন্দর তুমি বৌমা। শুনলাম তোমার বাপের বাড়িও অনেক ধনী।তা আদিবের মতো পঙ্গু ছেলেকে বিয়ে করলা কেন?


ওতো কোন ভালো চা*করিও করেনা। পঙ্গু হওয়ার পর মনে হয় চা*করীটাও গেছে। ওর বাপ-ভাইয়ের টাকায় আর কয়দিন চলবা?


আমার তো মনে হয় তোমারও কোন সমস্যা আছে? নাহলে তোমার বাপ-মা জেনেশুনে পঙ্গু ছেলের কাছে এতো সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে দেয়?'


ওনার কথা শুনে আমার রাগে শরীর জ্বলে যাচ্ছে। মনে চাচ্ছে মুখের ওপর উত্তর দিয়ে দিই। কিন্তু  ভদ্রতার জন্য কিছু বললাম না। প্রথমত,তিনি বয়স্ক, দ্বিতীয়ত আমি ঘরের নতুন বউ।নিজেকে শান্ত রাখলাম।


আমার পাশ থেকে আদিব উত্তর দিলো,

-- 'চাচি আপনি ঠিকই ধরেছেন।আর ওর সাথে কথা বলে কোন লাভ নেই।কারন আপনাদের বৌমা বোবা-বধির আপনার কথা শুনলেও বুঝবে না।


মা এজন্যই এমন আমার জন্য এমন বৌ এনেছে যাতে আমার সেবাযত্ন করতে করতে বিরক্ত হলেও মুখে যাতে বলতে না পারে।'


আদিবের মুখে এমন উত্তর শুনে আমি ভীষণ হাসি পেলো। আদিবের কথা শুনে চাচি ক্ষেপে গিয়ে বললেন, 


-- 'আমার সাথে তুই মশকরা করিস? তোর বৌ যে বোবাকালা না তা আমি জানি। কাল বিয়ে করতে না করতে আজই বৌয়ের চা*মচা*মি করছিস, না জানি কয়েকদিন পর তোর মায়ের কি হয়?'


-- 'এখানে চা*মচা*মির কি দেখলেন চাচি? আপনি তিশাকে প্রশ্ন করছিলেন,ওর উত্তরটা আমি দিয়ে দিলাম।'


-- 'বৌ নিয়ে এত বাহাদুরি করিস না,দেখিস তোর এত সুন্দর বউ তোকে রেখে পরপুরুষের সাথে ভাগবে।'


-- 'চাচি মুখ সামলে কথা বলেন।' (রেগে গিয়ে)


আদিব আরো কিছু বলতে চাচ্ছিল আমি চোখের ইশারায় নিষেধ করলাম। এরপর শাশুড়ীমা এসে আমাদের রুমে পাঠিয়ে দিল বৌভাতের জন্য রেডি হতে। বৌভাত খুব বেশি বড় করে হবে না।ঘনি*ষ্ঠ আত্মীয় স্বজনদের নিয়ে ঘরোয়াভাবে হবে।


.


সাজগোজ করে আমাদের দুজনের রেডি হতে হতে দুপুর হয়ে গেলো। আমাদের বাড়ি থেকে বাবা, দুই ভাইয়া কেউ আসলো না।আমাদের নেওয়ার জন্য শুধু মেজ মামা,ছোট মামা, ফুপা আর কয়েকজন বাচ্চা পাঠিয়েছে।


আমার পরিবারের কেউ না আসায় আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন বেশ রেগে গেল। আমার শ্বশুর, আদিব আমাকে রুমে নিয়ে এসে যা বলল তাতে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম।আমার দুচোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগল।


(চলবে)...


গল্পঃ_এক_জীবন_প্রেম

প্রথম পর্ব || ০১


----------------------------------------

গল্পঃ_এক_জীবন_প্রেম

দ্বিতীয় পর্ব || ০২


আমার পরিবারের কেউ না আসায় আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন বেশ রেগে গেলো। আমার শ্বশুর, আদিব আমাকে রুমে নিয়ে এসে যা বললো তাতে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম।আমার দুচোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগল। 


আমার শ্বশুর অনেকটা রেগেই আমাকে বললো,

-- 'বৌমা মানছি আদিবের সাথে তোমার পরিবার তোমাকে বিয়ে দিতে চায় নি, তাই বলে আমাদের আত্মীয় স্বজনদের সামনে এভাবে মাথা নিচু করাবে।


যেখানে সবাই জানতে চাইছে মেয়ের বাবা, ভাইয়েরা কই, তাদের সাথে পরিচিত হতে চাই সেই আমি কি উত্তর দিব তাদের তুমিই বলে দাও? বিয়েটা যেহেতু হয়ে গিয়েছে সেখানে এতো সিনক্রিয়েট করার কি আছে? যেহেতু তোমার পরিবারই প্রথম নাটক শুরু করেছে তাহলে আমরা বাদ যাব কেনো?


শোনো বৌমা, আজকে তোমার সাথে আদিব তোমাদের বাড়ি যাবে না। আর তুমি তোমার মামাদের সাথে চলে যাও।যেদিন তোমার পরিবার মানবে সেদিন ফিরে এসো এবাড়িতে তার আগে নয়।'


কথাগুলো বলে শ্বশুর আব্বা চলে গেলেন। আদিব স্তব্ধ হয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।


আমি ওর দুবাহু ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলাম, 

-- 'আমি কি করবো আদিব? বলো... 

সবাই আমাকে ভুল বুঝছে। তুমি প্লিজ আমার সাথে আমাদের বাড়ি চলো, দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।'


-- 'দেখো তিশা আমার নিজের একটা আত্মসম্মানবোধ আছে। একমাত্র তোমাকে ভালোবাসি বলে তোমাকে বিয়ে করেছি, না হলে কখনোই এত অপমানের পর বিয়ের করতাম না।এখন বলতেই পারো, আমি পঙ্গু মানুষ তুমিই আমাকে করুনা করে বিয়ে করেছো।আর তুমি যদি ভেবে থাকো তুমি আমাকে বিয়ে করেছো সেটা আমার সাত কপালের ভাগ্য তাহলে সেটা ভুল। 


তুমি হয়ত জানো না তিশা বিয়ের প্রথম থেকেই তোমার বড়ভাই,বাবা আমাকে যা ইচ্ছে তাই অপমান করে যাচ্ছে। তোমার বড়ভাই বলেছে, 'তোমাকে গলা টিপে মে*রে ফেলবে তবুও আমার মত পঙ্গুর কাছে বিয়ে দিবে না।' একটা এরপর যখন বিয়ে পুরোপুরি ঠিক হলো তখন আমাকে শর্ত দিলো আমার মতো পঙ্গু ছেলেকে তারা বাড়ির জামাই হিসেবে মানতে পারবে না তাই নিজের বিয়েতে বরযাত্রীতে বর-ই যেতে পারে নি।'


-- 'কিহ? বাবা,বড়ভাইয়া,ছোটভাইয়া ওনারা তোমাকে বিয়েতে যেতে নিষেধ করেছিল? কিন্তু ওনারা যে বললো তুমি বিয়ে করতে আমাদের বাসায় যেতে পারবে না।'


-- 'হ্যাঁ, তোমাকে জানাতে নিষেধ করেছিল।আমাকে বলেছে আমি হুইলচেয়ারে বসে কখনো যাতে তোমাদের বাড়ি না যাই। আমি তাতেও রাজি ছিলাম। আর আজ তোমার পরিবার কি করলো আমাদের সাথে? মেয়ের বৌভাতে তার পরিবারই আসলো না।এটা কি আমার জন্য অপমান না? এতোকিছুর পরেও তোমার যদি মনে হয় তোমার সাথে আমার যাওয়া উচিত তাহলে আমি যাব। আমি জানি আজকে তোমাদের বাড়ি গেলে আজও অপমান করবে তোমার বাবা-ভাইয়েরা।'


-- 'না কখনো না,যে বাড়িতে আমার হাজবেন্ডকে অপমান করে সেই আমিও পা রাখব না। আর তোমাকে  আমি ভীষণ ভালোবাসি কখনো নিজেকে 

পঙ্গু বলে ছোট করবেনা। আমি তোমার সবকিছু জেনেই তোমাকে বিয়ে করেছি।'


আমি আদিবের চোখের পানি মুছে দিলাম। আমিও নিজের চোখের পানি মুছে ড্রয়িং রুমে গিয়ে মামাদের সাথে বাসায় না যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানালাম। তারপর মামারাও চলে গেলেন। শ্বাশুড়ি আম্মা এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে অনেক আদর করলো।রুমে এসে দেখি বড়ভাইয়া,ছোটভাইয়া অনেকগুলো কল দিয়েছে। আমি কল ব্যাক না করে তাদের ব্লক করলাম।


ব্লক করার আগে তাদের একটা ম্যা*সেজ দিলাম,

-- 'তোমরা এতদিন আদিবের সাথে যা করেছো, তাতে তোমরা ঘৃণা পাওয়ার যোগ্য।যদি আমাকে বাসায় নিতে চাও, তাহলে তোমরা নিজে এসে আদিবের পরিবারের থেকে ক্ষমা চেয়ে আমাদের দুজনকে নিয়ে যেও।যদি তা করতে না পারো তাহলে কখনো আমার সাথে যোগাযোগ করবে না। ভালো থেকো।'


ব্লক করে অনেকক্ষন কাঁদলাম। তাদের সাথে আবার কবে দেখা হবে জানি না। আমি জানি আমার পরিবারের আত্মসম্মানবোধ অনেক বেশি। তারা কখনোই ক্ষমা চেয়ে আমাদের ফিরিয়ে নিতে আসবেনা। তাদের প্রতি সকল আশা মাটিচাপা দিয়ে নিজের কাজে মন দিলাম। 


.


বেশ কিছুদিন কে*টে গেছে এর মাঝে। আমার পরিবার থেকে কেউ আসে নি। এমন কি কেউ অন্য নাম্বার দিয়ে একটাবার কলও করে নি। তাদের কথা না শুনে আমি আমার ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করেছি বলে এতো ক্ষোভ,এতো রাগ থাকবে!


আদিবের পরিবারের সাথে ভালোই দিন কা*টছে। ভেবেছিলাম আমার পরিবারের খা*রাপ ব্যবহারের জন্য শ্বশুরবাড়ির লোকজন আমার সাথে মিশবে না।কিন্তু না,সবাই আমাকে ভীষণ আদর করে ছোট বৌ হিসেবে। আদিবের বাবা-মা, বড় দুই ভাই,ভাবী আমার ছোট ননদ সবাই আমাকে অনেক ভালোবাসে। তবে মাঝে মাঝে আমার পরিবারের কথা, মায়ের কথা বেশি মনে পড়ে।


বিয়ের পর থেকে আশেপাশের লোকজনের কানাঘুষা বেড়েই চলছে। আমি কেন আদিবকে বিয়ে করলাম?এ নিয়ে লোকজনের মাথাব্যথার কমতি নেই। তাদের কথা শুনতে শুনতে আমি একপ্রকার হাঁপিয়ে উঠেছি।আমি জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে যেকোনো কিছুর বিনিময়ে হলেও আদিবকে সুস্থ করে তোলা আর লোকজনের মুখ বন্ধ করা। 


.


আদিবকে ডাক্তারের কাছে এসেছি ওর পায়ের চিকিৎসা করাতে। আমার বিশ্বাস একদিন না একদিন আদিব ঠিকই সুস্থ হবে।নিজের পায়ে দাঁড়াবে। কিন্তু  ডাক্তার রির্পোটগুলো দেখে যা বললো তা শুনে আমার আশার আলো নিমেষেই অন্ধকারে ডুবে গেলো!


ডাক্তার বললো,

-- 'আপনার হাজবেন্ডের পা দুটো সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।এক্সিডেন্টে পায়ের রগগুলো বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঠিক হওয়ার চান্স ১০% এবং ৯০% ই অনিশ্চয়তার মধ্যে।'


আমি হন্তদন্ত হয়ে বললাম,

-- '১০% চান্স তো আছে? এটাই অনেক। আল্লাহ চাইলে নিশ্চয়ই আদিব সুস্থ হবে।'


-- 'হ্যাঁ, যদি পা ঠিক হয় তাহলে বলা যাবে অলৌকিকভাবে। আপনারা আল্লাহর ওপর ভরসা রাখুন। পা দুটো ঠিক হলে হতেও পারে। ওনাকে নিয়মিত ঔষধ খাওয়াবেন,পায়ের বিশেষ যত্ন নিবেন। মাঝেমধ্যে একটু দাঁড়া করানোরও চেষ্টা করবেন। ইনশাআল্লাহ সুস্থ হয়ে যাবে।'


-- 'ধন্যবাদ ডক্টর।'


আদিবকে নিয়ে ডাক্তারের চেম্বার থেকে ফিরে আসলাম। ডাক্তারের কথা শুনে আমার মনটা একেবারে ভেঙে গিয়েছে। আদিবের দিকে তাকিয়ে 

দেখি ওর মুখটা ভার হয়ে আছে।


আদিবের দিকে তাকিয়ে  একটা হাসি দিয়ে বললাম,

-- 'আরে বোকা ছেলে, মুখটা এমন ভার করে রেখেছো কেনো? ডাক্তার তো বললোই এখনো ১০% চান্স আছে সুস্থ হওয়ার , তাহলে আর চিন্তা কি?'


-- 'তিশা আমার জন্য তোমার কত কষ্ট হয় আমি জানি। আমার সেবাযত্ন করতে হয়,লোকজনের কটুকথা শুনতে হয়।'


-- 'আমি কি একবারও বলেছি আমার কষ্ট হয়? আর লোকজন কি বলে তা শুনে আমার কাজ নেই।চলো ওই যে ফুচকার স্টল আছে সেখানে গিয়ে ফুচকা খাই।'


-- 'না তিশা আমার ভালো লাগছে না।বাসায় চলো।'


ওর মুখে হাসি ফুটানোর জন্য আমিও একটু মজা করে বললাম, 


-- 'বিয়ের আগে তো কতো বলতা, ‘একবার বিয়েটা হয়ে নেক তারপর আর লুকিয়ে না সকলের সামনে বসে ফুচকা খাবো।’ এখন কি প্রেমিকা নই বলে আমার কদর কমে গেছে?'


-- 'আরে না,চলো... ' (হেসে দিয়ে)


অনেকদিন পর দুজনে একসাথে বসে তৃপ্তির সাথে ফুচকা খেলাম। সেখানেই বসে বসে আরো কিছুক্ষন গল্প করে বাসায় চলে আসলাম। 


.


এর মাঝে এক মাস কেটে গেছে। আদিব চাকরীর প্রস্তুতি নিচ্ছে। পাশাপাশি অনলাইনে একটা জব করছে। ওর পায়ের যত্ন বিশেষভাবে করছি, যদিও 

অবস্থার তেমন উন্নতি নেই।তবে আমিও এত সহজে হাল ছাড়ার মেয়ে না। আল্লাহর কাছে মনেপ্রানে আদিবের সুস্থতার জন্য দোয়া করছি,আমার  বিশ্বাস আল্লাহ আমাকে নিরাশ করবে না।


ঘরের টুকটাক কাজ করছি। আমার ছোট ননদ এসে বললো, 

-- 'আমার মা নাকি আমাকে দেখতে এসেছে।'


মায়ের কথা শুনে চোখে পানি চলে এলো।আমি তাড়াতাড়ি বসার ঘরে গেলাম। গিয়ে দেখি মা বসে আছে। দৌড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলাম। কতদিন মাকে দেখি না,মাকে স্পর্শ করতে পারি না। আমাকে জড়িয়ে মা-ও কেঁদে ফেললেন।


মা আমাকে বললেন,

-- 'এতো জেদ তোর তিশা? মাকে ছাড়া এতোদিন থাকলি কীভাবে?একটাদিন ফোন পর্যন্ত করলি না।'


মাকে জড়িয়েই বাবা,ভাইয়াদের সব কাহিনি বললাম। আমার কথা শুনে মা অনেক অবাক হলেন।


আমি  মাকে জিজ্ঞেস করলাম,

-- 'মা, যদি বাবা এ বিয়েতে রাজিই না থাকেন তাহলে কেন এতো ধুমধাম করে বিয়ের আয়োজন করলেন? তারপর আমার বৌভাতে না এসে শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে তাদের আত্মীয়দের সামনে মাথা হেট করালেন?'


-- 'তোর বয়স বেশি হয় নি তাই তুই অত বুঝিস না। আমরাও কিন্তু তোকে বিয়ে দিয়ে কম কথার সম্মুখীন হই নি। মানুষের কথা তীরের চেয়েও বিষাক্ত। মানুষের কথা তো আর আমরা আটকে রাখতে পারব না।


তোর বাবা ভেবেছিল তোর সাথে আদিবের বিয়ে না হলে তুই যদি আবার নিজের ক্ষতি করে বসিস তাই এ বিয়েতে মত দিয়েছিল। কিন্তু যখন লোকজন, আত্মীয় স্বজন তোকে নিয়ে খা*রাপ কথা বলছিলো - ‘তুই কেনো আদিবকে বিয়ে করছিস?কোন স্বার্থে? কোন লোভে?’


আরো নানা বাজে কথা। তখন তোর বাবা রেগে গিয়ে সব দোষ আদিবের ওপর দিলো। তিয়াশ (তিশার বড়ভাইয়া) ক্ষেপে গিয়েছিল। তাদের ধারণা, আদিব আর ওর পরিবারের প্ররোচনায় তুই ওদের পঙ্গু ছেলেকে বিয়ে করতে চাইতিস। তবে আদিবের সাথে খারাপ ব্যবহার করা মোটেও ভালো হয় নি।'


-- 'মা,কারো প্ররোচনায় পড়ে আমি বিয়ে করি নি।তুমি অন্তত একথা বলো না।'


-- 'তোর বাবা তো এটাও বলছে আজ যদি আদিবের জায়গায় আমার মেয়ে পঙ্গু হতো তাহলে কি ওরা মেনে নিতো? কোনোভাবেই মেনে নিতো না।তাহলে তোর শ্বশুরবাড়ির লোকজন আমাদের ওপর রেগে থাকার কোনো কারণ নেই। তবে আদিবের আমাদের পরিবার সত্যিই অনেক খা*রাপ ব্যবহার করছে।


যাইহোক, তুইও আর রাগ করে থাকিস না,আজ বাড়ি চল।তোর বাবা- ভাইয়েরাও ভেতরে ভেতরে কষ্ট পাচ্ছে। তোকে দেখলে অনেক খুশি হবে।'


-- 'না,মা। সেদিন যাই নি আর আজও যাব না। যেদিন  বাবা-ভাইয়া আসবে সেদিন আমি ঠিকই যাব তার আগে না।'


-- 'তোর বাবা-ভাই কখনোই..... '


মা আর পুরো কথাটা শেষ করতে পারলেন না, এর মধ্যেই শাশুমা চলে আসলেন, সাথে দুই ভাবী নাস্তা নিয়ে আসলেন।আমার শ্বাশুড়ি কোনোরকম কুশল বিনিময় করে চলে গেলেন। বুঝলাম মায়ের ওপর তিনিও 

রেগে আছেন। ভাবীরা আবার মায়ের সাথে অনেকক্ষন গল্প করলেন তারপর আদিবের সাথেও কিছুক্ষন কথা বলে দুপুরের দিকে মা চলে গেলেন।


অনেকবার খাওয়ার জন্য অনুরোধ করলাম কিন্তু মা না খেয়েই চলে গেলেন। যাওয়ার সময় আমার জন্য মা শাড়ি আর ওর জন্য পাঞ্জাবি দিয়ে গেল। আদিবের হাতে দিতেই ও পাঞ্জাবি খাটের ওপর কিছুটা ছুঁড়ে রাখলো।


আমি ওর দিকে তাকাতেই, আমার চোখের ভাষা বুঝে বললো,


-- 'আমার অনেক পাঞ্জাবি আছে।এখন এটা পরবো না।রেখে দাও।'


আমি ওর কথা স্পষ্টই বুঝলাম, আমি ওকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে, ‘রাগ আমার বাবা-ভাইয়ের ওপর থাকতে পারে।মায়ের উপহার দেওয়া পাঞ্জাবিটাকে এভাবে অবমাননা করা উচিত নয়।’ আমার কথা শুনে ও কোন উত্তর দিল না।একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেল।


পরিবারের জন্যও আমার ভেতরটাও যে পুড়ে কয়লা হয়ে যাচ্ছে সেটা তো কেউ বুঝতে পারছে না।

.

.

.

বিকেলে ছাদ থেকে জামাকাপড় এনে রুমে আসতেই আদিবকে দাঁড়াতে দেখে আমি খুশিতে একটা চিৎকার দিলাম।কিন্তু আমার খুশিটা বেশিক্ষন স্হায়ী হলো না......


গল্পঃ_এক_জীবন_প্রেম

তৃতীয় পর্ব || ০৩


বিকেলে ছাদ থেকে জামাকাপড় এনে রুমে আসতেই আদিবকে দাঁড়াতে দেখে আমি খুশিতে একটা চিৎকার দিলাম।কিন্তু আমার খুশিটা বেশিক্ষন স্হায়ী হলো না..


আদিবের পা দুটো কাঁপতে কাঁপতে ও পড়ে গেল।আমি দৌড়ে গিয়ে ওকে উঠালাম।আমি ওকে দাঁড়া করানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু ওর পা দুটো কাঁপার কারনে দাঁড়াতে পারল না। শরীরও ঘামে পুরো ভিজে গেছে। মনে মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম।অবশেষে আল্লাহ আমার ডাকে সাড়া দিয়েছেন।মনের মাঝে আবারও আশার আলো দেখতে পেলাম। 


রাতে আদিবের পায়ের ভালো ট্রিটমেন্টের জন্য ওর আব্বা, বড়ভাইদের সাথে পরামর্শ করলাম।পরদিনই আমি,আদিব, ওর বড়ভাই ডাক্তার কাছে নিয়ে গেলাম। সেখানে  তারা অনেকগুলো টেস্ট করানোর পর আদিবের পায়ের জন্য ইন্ডিয়ার এক ডাক্তারকে দেখানোর জন্য পরামর্শ দিল। 


.


বাড়ি এসে সকলের সাথে কথা বলে জরুরি ভিত্তিতে সব কাগজপত্র ঠিক করে আদিবকে দশদিনের ভিতর ইন্ডিয়া নেওয়া হলো। আদিবের সাথে আমি, বড় ভাইভাবী, আব্বা গিয়েছি।সেখানে আদিবের পায়ে ছোটখাটো একটা অস্ত্রপাচার করা হয়।প্রায় পনেরো দিনের মতো বেডরেস্টের পর আদিব স্ক্যাচ ব্যবহার করে দাঁড়াতে পারে। অল্প অল্প হাঁটতে পারে। বেশিক্ষন হাঁটতে পারে না, ক্লান্ত হয়ে যায়। ডাক্তার বলেছে আস্তে আস্তে আবার আগের মতো সুস্থ হয়ে যাবে।


.


প্রায় দেড়মাস পরে আমরা ইন্ডিয়া থেকে ফিরলাম। আদিব স্ক্যাচ ব্যবহার করেই এখন হাঁটে। বাড়ি আসার পর আম্মা আমাকে আর আদিবকে দেখে সেকি কান্না! 


আমাকে বলে,

-- 'তুমি শুধু আমার বৌমা না,তুমি আমার মেয়ে। তোমার জন্য আজ আমার আদিব নতুন করে বাঁচতে পারবে।নিজের পায়ে হাঁটতে পারবে। তোমার জন্য মন থেকে অনেক দোয়া,তুমি জীবনে অনেক সুখি হও আমার ছেলেকে নিয়ে। তোমার মত এমন একটা বৌমা পেয়ে আমার অনেক গর্ব লাগছে।'


আমি মুচকি হেসে বললাম, 

-- 'সবার আগে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া করা উচিত। মানুষ তো মাত্র উছিলা।'


তবুও বাড়ির সকলে আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। 


---

--------

আদিব এখন সম্পূর্ণ সুস্হ। হাঁটাচলা করতে কোন অসুবিধা হয় না। একটা ব্যাংকে চা*কুরীও পেয়েছে। আজকেই ওর অফিসের প্রথম দিন। ইদানীং আমার কেনো জানি মাঝে মাঝে ভয় হয় আদিব কি আমাকে কখনো ছেড়ে চলে যাবে?


অফিস থেকে ফেরার সময় আমার জন্য একমুঠ রেশমি চুড়ি এনেছে।সেদিকে আমার হেলদোল নেই। আমার মাথায় কিসব হাবিজাবি চিন্তা-ভাবনা ঘুরছে।


আমি আদিবের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 

-- 'তোমার সাথে কি কোনো মেয়ে কলিগ আছে?'


আমার কথা শুনে আদিব জোরে হেসে দিলো।


-- 'ওহহ,আচ্ছা এই জন্যই তোমাকে এমন চিন্তিত দেখাচ্ছে? (আবার হেসে দিয়ে)


হ্যাঁ,আছে তো। একজন মেয়ে কলিগ আছে। তবে আমার থেকে মিনিমাম সাত-আট বছরের বড়।তোমার চিন্তার কোন কারন নেই যদি আমার চেয়ে বয়সে ছোট হতোও তবুও আমি দূরে দূরে থাকতাম। কারন তুমিই যে আমার একমাত্র প্রিয়তমা। বিশস্ত অর্ধাঙ্গিনী। হাজার বাঁধা আসলেও তো তোমার হাত আমি ছাড়বো না যেমনটা তুমি আমার পাশে ছিলে হাজারো সমস্যা মোকাবিলা করে।'


আমি কেঁদে দিয়ে বললাম, 

-- 'কথা দিলে তো?'


-- 'হ্যাঁ আমার পা*গলি।'


আমি ওর কানে কাছে  গিয়ে লাজুক মুখে ফিসফিস করে বললাম, 


-- 'ওই শোনো...একটা কথা বলার ছিলো।কিন্তু আমার না ভীষণ লজ্জা করছে।' (চোখ ঢেকে)


-- 'তাহলে বলে ফেলো, আমার কাছে আবার লজ্জা কিসের?'


-- 'উঁহু,আমার অনেক লজ্জা করছে তোমাকে কথাটা বলতে। ইদানীং আমার আসলে খাওয়ার প্রতি অরুচি লাগছে, খেতে বসলেই বমি আসে, মাঝে মাঝে আচার খেতে ইচ্ছা করে, এবার তুমি বুঝে নাও... '

(কথাটা বলে আমি আবারও হাত দিয়ে চোখ ঢাকলাম) 


-- 'তোমার শরীর অসুস্থ এটা বলতে এতো লজ্জা? আচ্ছা আজকে ভাবীকে বলে দিব কালকে যাতে তোমাকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যায়। মনে হয় তোমার ফুড পয়জনিং হয়েছে।' (আদিব হাসি চেপে স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই কথাটা বললো)


-- 'গা*ধা কোথাকার! আমার ফুড পয়জনিং হয়েছে তোকে কে বলেছে রে? আমি কি একবারও বলেছি? আমার চোখ দেখে অন্য সময় সব বলে দিতে পারো আর এখন কেনো বুঝছো না? কি বলতে চাইছি আমি?'

(কিছুটা চিল্লিয়ে)


-- 'থাক থাক মহারানী আর চিল্লাতে হবে না।আমার অনাগত প্রিন্স/প্রিন্সেস শুনলে কষ্ট পাবে, যে ওদের আম্মু ওর বাবার সাথে ঝগড়া করছে।' (মুচকি হাসি দিয়ে) 


আদিবের কথা শুনে তিশা আরো ক্ষেপে গেল।নাক ফুলিয়ে বললে,

-- 'তাহলে এত ঢং দেখানোর কি হলো? ফালতু লোক কোথাকার... '


-- 'আরে আরে রাগ করছো কেনো? আমি তো দেখছিলাম আমার মিষ্টি বউটা আমার কাছে কেমন লজ্জা পাচ্ছিল,আবার আমি না বোঝার ভান ধরায় কেমন ক্ষেপে যাচ্ছিল।"


-- 'একটা কথা রাখবে?আমাকে আমাদের বাসায় কিছুদিনের জন্য দিয়ে আসবে।বাসায় যাওয়ার জন্য মন ছুটে গেছে। কতদিন সবাইকে একসাথে দেখি না। আর জানোই তো একটা মেয়ের এই অবস্থায় তার মাকে কতোটা প্রয়োজন... '


-- 'আচ্ছা মায়ের সাথে গিয়ে কথা বলে দেখি। জানোই তো আমাদের পরিবারে মায়ের কথাই সব কথা।'


.


আদিব ওর মায়ের কাছে গিয়ে আমার কথাটা বলাতে আগুনে ঘি ঢালার মতো হলো। আমি আমার রুম থেকেই শুনতে পেলাম আমার পরিবারের সম্পর্কে আজেবাজে কথা বলছে। তারা ছেলেপক্ষ হয়ে কেনো তারা মেয়েপক্ষের কাছে ছোট হবে।আরো অনেক কথা...


ওনার কথা শুনে আমার চোখে পানি চলে এলো।আমি তাড়াতাড়ি ওয়াশরুমে চলে গেলাম।সেখানে কিছুক্ষণ কেঁদে চোখে-মুখে পানি দিয়ে বেরিয়ে এলাম।এসে দেখি আদিব চুপ করে মাথা নিচু করে বিছানায় বসে আছে। আমিও কিছু না জানার ভান ধরে ওর পাশে গিয়ে বসলাম। 


ও আমার হাত দুটো জড়িয়ে ধরে বলে,

-- 'তিশা, মা তোমাকে এই অবস্থায় জার্নি করতে নিষেধ করেছে।তুমি মাকে প্লিজ ভুল বুঝো না। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি দু-একদিনের মধ্যে তোমাকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে তোমাদের বাসায় নিয়ে যাব।'


আমি ওর মিথ্যা আশ্বাস শুনে চুপ করে রইলাম। 

.

.

.

দেখতে দেখতে নয় মাস কে*টে গেছে।বেবি হওয়ার সময়ও প্রায় ঘনিয়ে এসেছে। বাসায় আর যেতে পারি নি। আদিব যদিও নিয়ে যেতে চেয়েছিল কিন্তু আমিই মিথ্যা কথা বলে যেতে চাই নি। এরমাঝে মা আমাকে 

দুবার দেখে গেছেন। আশ্বাস দিয়ে গেছেন বেবি হলে বাবা আর রাগ করে থাকতে পারবে না। বাবার মাঝে এখনই আমার জন্য অনেক দূর্বলতা দেখতে পায় মা। আমিও সেইদিনের অপেক্ষায় আছি যেদিন আমার বেবি এসে দু'পক্ষের মনোমালিন্য হিসাব শেষ করবে।


হঠাৎ করেই আমার পেইন উঠে।আমি তাড়াতাড়ি আদিবকে কল করি, ও তখন অফিসে। আদিব জানায় ও অফিস থেকে ছুটি নিয়ে এখুনি আসছে।ভাবীদের নিয়ে যাতে হাসপাতালে যাই।আম্মা, দুই ভাবী আমাকে নিয়ে হাসপাতালে গেলো। যাওয়ার আগে আমার মাকেও খবর দেওয়া হলো। হাসপাতালে যাওয়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই আমাকে ওটিরুমে নেওয়া হলো। 


ততক্ষণে আদিব আর তিশার মা হাসপাতালে পৌঁছে যায়। ওটিরুম থেকে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনতে পেয়ে আদিব মনে মনে আলহামদুলিল্লাহ পড়ে নেয়।


নার্স এসে জানায় আদিবের ছেলে সন্তান হয়েছে। বাচ্চা ও মা দুজনেই সুস্থ আছে।নার্সের কথা শুনে আদিব আবারও মনে মনে 'আলহামদুলিল্লাহ' পড়ে নেয়। 


দুইদিন পরে তিশাকে আর ওর ছেলেকে হাসপাতাল থেকে বাড়ি নিয়ে যায়। পুরো বাড়ি আনন্দে ভরে যায়। তিশার সবচেয়ে বেশি হাসি পায় যখন ছেলেকে নিয়ে আদিব দুষ্টুমি করে,তখন আদিবকেও বাচ্চাদের মতো মনে হয়। তএবার তিশা সিদ্ধান্ত নেয় ওর বাবাকে ফোন করবে। সব ভেবেচিন্তে তিশা কল করে ওর বাবাকে। ওপাশ থেকে কল রিসিভ করার পর তিশার বাবার কর্মকাণ্ডে তিশা পুরোই অবাক হয়ে যায়।


তিশার কন্ঠস্বর শুনে ওর বাবা হাউমাউ করে কান্না করে দেয়। 


-- 'বাবা, তুমি কাঁদছো?'

(আদিবকে বিয়ের সময় অপমান করা নিয়ে বাবাকে অনেক কড়া কথা বলার ছিল। কিন্তু বাবার কান্না দেখে আমি আর বলতে পারলাম না।--মনে মনে...)


-- 'তোর সাথে,জামাইয়ের সাথে অনেক অন্যায় করেছি আমরা। আমাদের তুই মাফ করে দিস। এতদিন নিজের দাম্ভিকতাকেই মনের মধ্যে পুষে রেখেছিলাম। কিন্তু মনের মাঝে একবিন্দুও শান্তি পাই নি। আজ একবছর পরে তোর কন্ঠস্বর শুনে মনে শান্তি পেলাম। তোর কথা ভেবে ভেবে  একটা রাতও ঠিকমত শান্তিতে ঘুমাতে পারি নি'


-- 'তবুও তো তুমি তোমার এই মেয়েটাকে একটাবারের জন্যও দেখতে আসো নি। নিজের জেদটাকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছো।(কেঁদে দিয়ে)

এখন আসো প্লিজ তোমার নাতিটাকে দেখে যাও। নাকি এখনো আসবে না?'


-- 'হ্যাঁ মা আসব। তোকে- জামাইকে প্রাপ্য সম্মান নিয়ে আমাদের বাড়ি নিয়ে আসব। জামাই আবার রাগ ধরবে না তো?'


-- 'তুমি যদি নিজে আসো তাহলে রাগ করবে না।'


বাবার সাথে প্রায় একঘন্টা কথা বলে ফোনটা রাখলাম। আজ আমার মনেও অন্যরকম প্রশান্তি বইছে।মনে হচ্ছে সুখের সাগরে ভেসে যাব।কিন্তু এতো সুখ আমার কপালে সইবে তো?

.


ঠিক দুইদিন পর ঘরের কাজ করছি। হঠাং কলিংবেলটা বেজে উঠল। সাধারনত এ দুপুরের দিকটায় কেউ আসে না।আমি গিয়ে দরজা খোলার পর অবাক হয়ে গেছি। আমাদের বাড়ির সবাই এসেছে। তারা কেউই আমাকে বলে নি তারা যে আসবে। অনেক খাবার-দাবার,বাবুর জন্য জিনিসপত্র আরো অনেক কিছু সাথে নিয়ে এসেছে। বাবা-ভাইয়া আমাকে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না!


আমার পরিবারের সবাইকে দেখে আমার শাশুড়ী রুমে গিয়ে মুখ গোমড়া করে বসে রইলেন। সাথে অন্য সবাইকেও আসতে নিষেধ করলেন।আমার শ্বশুরবাড়ির সবাইকে ডাকতে বললেন বাবা। আমি শাশুড়ীকে গিয়ে ডাক দিতেই তিনি আরেক দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে রইলেন।আমি গিয়ে আম্মাকে 

বললাম, ‘আমার বাড়ির লোকজন এসেছেন আসুন আপনি..’


তিনি পাশে বসে থাকা ননদকে গলার স্বর নামিয়ে বললেন,

-- 'আমার ছেলে আজ সম্পূর্ণ সুস্থ দেখে ওনারা আজ এসেছেন ঢং দেখাতে, এতদিন কই ছিল তাদের আলগা পিরিত।'


আম্মার কথা শুনে আমার ভীষণ রাগ লাগলো। এতদিন তার মুখের ওপর কোন কথা বলি নি।


কিন্তু আজ বললাম আমি বললাম, 

-- 'আপনি ঠিক কি বললেন আম্মা? বুঝতে পারলাম না।'


তিনি আমতা আমতা করে বললেন,

-- 'না কিছু না,, তুমি গিয়ে নাস্তা রেডি করো। আমি এখুনি আসছি।'


আমি যাওয়ার কিছুক্ষন পরই আম্মা আসলেন। কিছুটা গোমড়ামুখ করেই সকলের সাথে কথা বললেন।দুপুরে খাওয়ার সময় বড়ভাইয়া বললেন, 

আজকে আমাদেরকেতাদের সাথে নিয়ে যেতে চান। বাবাও ভাইয়ার সাথে একমত দিলেন। আমিও ভীষণ খুশি হলাম। কিন্তু আপত্তি করলেন আমার শ্বাশুড়ি।


-- 'পরে কোনদিন আদিব বৌমাকে নিয়ে আপনাদের বাড়ি যাবে, আজ না। আমার মনটায় কেমন কু-ডাক ডাকছে।' (আদিবের মা)


-- 'আরে..আজকে গেলে অসুবিধা কি? শুক্রবার-শনিবার তো এমনিই বন্ধ, আবার রবিবারেও সরকারি ছুটি পড়েছে।তাই বলছিলাম তিনদিন আমাদের বাড়ি মেয়ে আর জামাই বেড়িয়ে আসুক। তিনদিনের এমন ছুটি তো আর সবসময় আসে না।' (তিশার বাবা)


-- 'তবুও.... '

-- 'আম্মা, আপনি প্লিজ আর আপত্তি করবেন না। কতদিন বাসায় যাই না।কিচ্ছু হবে না দেখবেন।আমি এখুনি আদিবকে ফোন করে কথা বলছি।আর জামাকাপড়ও গুছিয়ে নিই।'

.

.

.

দুপুরে খাওয়া-দাওয়া শেষে জামাকাপড় গুছিয়ে আদিবকে বিকালের দিকে ফোন দিই। আমার পরিবারের লোকজন এই বাড়িতে এসেছে শুনে আদিব অনেক খুশিও হয় আবার অবাকও হয়।


-- 'কিহ! তুমি এতোক্ষণে এই কথা বলছো?'


-- 'তাহলে কখন বলতাম? এতোক্ষণ অনেক বিজি ছিলাম। শোনো তোমার অফিস তো আর কিছুক্ষনের মধ্যেই ছুটি হয়ে যাবে, তাই না? একটু তাড়াতাড়ি আসার চেষ্টা করো প্লিজ।'


-- 'পাঁচটায় অফিস ছুটি হবে।কিন্তু আগামী তিনদিনের ছুটি থাকায় বেশিরভাগ মানুষই আজ বেড়াতে যাবে।যার কারনে রাস্তায় আজ অনেক জ্যাম থাকবে। আর জ্যাম ছুটতে ছুটতে চার-পাঁচ ঘন্টা লেগে যাবে সেটা তো আর তোমার অজানা নয়।আমার আসতে আসতেও লেট হবে এটা ধরে নাও।'


-- 'আমি একটা বুদ্ধি দিই।তুমি না লঞ্চে করে চলে আসো। বাসায় আসতে আসতে একঘন্টা লাগবে।আর কোন জ্যাম-ট্যাম ভয় নেই।


-- 'মাথা খা*রাপ নাকি।তুমি জানো না আমি সাঁতার পারি না তাই লঞ্চে উঠিনা।নদীপথে যাতায়াত করতে আমার ভীষন ভয় লাগে। লাস্ট কবে উঠেছি তাও মনে নেই।আর উঠলেও সাথে পরিচিত কাউকে নিয়ে উঠি। বলা তো যায় না যদি লঞ্চ-টঞ্চ ডুবে মা*রা যাই।'


-- "ফালতু কথা বাদ দাও। এই সমস্ত কথা আর বলবে না। আর তুমি যা ভালো মনে করো,, তাই করো।'


কিছুটা অভিমান করে ফোনটা কেটে দিলাম। 


কিছুক্ষন আবার আদিব ফোন করলো। আমি কলটা রিসিভ করলাম না। আবারও কল করলো আমি আবারও রিসিভ করলাম না। এমন করে অনেকগুলো কল করলো।শেষমেষ বাধ্য হয়ে কলটা রিসিভ করলাম।


-- 'কি হলো রাগ করেছো তিশা?'


আমি কোন উত্তর দিলাম না।


-- 'আরে শোনো,, আমি তোমার কথাটা ভেবেই লঞ্চঘাটে এসেছি।লঞ্চ দিয়েই আসবো,এবার খুশি তো?'


-- 'হ্যাঁ,খুব খুশি। তাড়াতাড়ি আর সাবধানে চলে এসো।'


আমি সবাইকে গিয়ে বললাম, ‘আদিব লঞ্চে করে আসছে। তাই জ্যামের কোনো চিন্তা নেই। খুব তাড়াতাড়িই চলে আসবে।’


প্রায় দু'ঘন্টা হয়ে গেছে অথচ আদিবের ফেরার কোন নাম নেই। অথচ একঘন্টা, সর্বোচ্চ দেড়ঘন্টার মধ্যে পৌঁছানোর কথা।ব্যস্ততার কারনে কলও করতে পারি নি। সন্ধ্যায় আমি সকলের জন্য নাস্তা বানাচ্ছি আর আমার ননদ রিনি টিভি দেখছে।


হঠাৎ রিনি চিৎকার দিয়ে আমাকে ডেকে বললো,

-- 'ভা--বী,ভাবী এই দেখো আমাদের শহরের লঞ্চঘাটে মাছের ট্রলারের সাথে ধাক্কা লেগে একটা লঞ্চ ডুবে গেছে।'


লঞ্চ ডোবার কাহিনি শুনে  আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল।আমি থরথর করে কাঁপছি। রিনির কথা শুনে সকলে নিউজ দেখার জন্য ড্রয়িংরুমে চলে আসলো,তাদের সাথে আমি যোগ দিলাম। আধাঘন্টা আগে লঞ্চটা ডুবেছে। আর সেই সময়টাতে আদিবেরও লঞ্চে উঠার কথা। আর ও যদি লঞ্চে উঠে থাকে,তাহলে......


না আমি কিছু ভাবতে পারছি না।আমি তাড়াতাড়ি ওকে কল দিলাম। কিন্তু ওর ফোনটা বন্ধ দেখাচ্ছে। ‘এই মুহূর্তে সংযোগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না কথাটা শোনা মাত্রই আমার বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল।’


আম্মা তখুনি কান্না শুরু করে দিল আর আমাকে গা*লিগা*লাজ করা শুরু করে দিল।


-- 'এই অলক্ষ্মী মেয়েটা সব কিছুর জন্য দায়ী।আমার ছেলের কিছু হলে তোকে আমি ছা*ড়বো না।'


বাড়ি জুড়ে সকলের কান্নার রোল পড়ে গেল।


গল্পঃ_এক_জীবন_প্রেম

শেষ পর্ব || ০৪


সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নিল এখুনি লঞ্চঘাটে যাবে।সকলের সাথে আমিও গেলাম।বাসায় শুধু বড়ভাবী,রিনি আর আমার ছোট্ট ছেলেটা রইলো।আমাকে অবশ্য কেউ নিতে চায় নি। সবাই বলেছে আমার ছেলেকে দেখতে, আর কোন দুশ্চিন্তা না করতে। কিন্তু দুশ্চিন্তা না করতে বললেই তো আর দুশ্চিন্তা ছাড়া থাকা যায় না।আমি সকলের সাথে এক প্রকার জোর করেই গেলাম।


আদিবের জন্য আমার ভীষণ চিন্তা হচ্ছে। দোয়া করছি যেভাবেই হোক আদিব যেন ফিরে আসে। টানা তিনদিনের ছুটি থাকায় রাস্তায় অনেক জ্যাম পড়লো। সন্ধ্যার দিকে সিএনজি-বাসের সংঘর্ষের ফলে বহু মানুষ আহত হয়েছে। সেজন্য অর্ধেক রাস্তা বন্ধ।


আমরা কোনরকম লঞ্চঘাটে পৌঁছালাম। জানতে পারলাম বেশিরভাগ মানুষ উদ্ধার করা হয়ে গিয়েছে। কাউকে জীবিত অবস্থায় আবার কাউকে মৃ*ত।

 একপাশে অনেকগুলো লা*শ জড়ো করে রাখা হয়েছে। এখানে আসার পর ভয়ে আমার শরীরে কাঁপুনি ধরে গেল। চারপাশে মানুষের কান্নার আহাজারিতে আমি নিজেই কাঁদতে ভুলে গেলাম।


মনে হচ্ছিল আমি মাথা ঘুরে পড়ে যাব।নিজেকে অনেক কষ্টে দাঁড় করিয়ে রাখলাম। আদিবের বড়ভাই আর আমার বড়ভাইয়া দুজনে গিয়ে জড়ো করা লা*শের মধ্যে খুঁজলো।সেখানেও আদিবকে খুঁজে পেল না। খোঁজ করে জানা গেল এখনো চার-পাঁচজনকে উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি। তাদের কথা শুনে আমাদের সকলের কান্নাটা বেড়ে গেল।


সকলে ধরেই নিলো ওই অজ্ঞাত লোকেদের মাঝে আদিবও আছে। আমার শাশুড়ী এই কথাটা শুনে পা*গলের মতো আচরণ করা করলো।তিনি রাস্তায় আদিবের বয়সী যাকে দেখছেন তাকেই বলছেন, ‘আমার আদিব মরে নি;আমার আদিব বেঁচে আছে।এই তো আমার মানিক’


.


আমার শ্বাশুড়িকে অনেক কষ্ট করে বাড়ি আনা হলো। বাড়ি আসার পরে দেখি আত্মীয়স্বজন দিয়ে বাড়ি ভরে গেছে। পুরো বাড়িতে মরা কান্না জুড়ে গেল। সকলে কাঁদছে, কেবল আমিই কাঁদছি না।এমনকি আমার দুধের শিশুটাও কাঁদছে।আর আমি নিশ্চুপ হয়ে বসে আছি।আমি বিশ্বাসই 

করতে পারছি না আদিব যে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।


অনেকেই আমাকে বলছে চিৎকার করে কাঁদতে।কাঁদলে মনটা হালকা হতো। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আমি কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছি,আর দুঃস্বপ্নটা ভেঙে গেলে আমি আবার আগের জায়গায় ফিরে যাব।আমার মাথাটা কেমন জানি ভার হয়ে আসছে,চারপাশে অন্ধকার হয়ে এলো। এরপর আর মনে নেই পরে নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করি। বড়ভাবী আমার পাশে আছেন। বাবুকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছেন।আমাকে নড়াচড়া করতে

দেখেই বললেন,


-- 'বোন আমার বাবুটা সন্ধ্যা থেকে কষ্ট পাচ্ছে। ওর দিকেও তো তোমার একটু খেয়াল রাখা উচিত। এখন গভীর রাত ওকে একটু বুকে জ*ড়িয়ে আদর করো, ওকে খাওয়াও।যা হবার তা তবেই কেউ আমরা ফিরাতে পারবো না। তুমি নিজেকে একটু শক্ত করো।'


সত্যিই আদিবের চিন্তায় বাবুর কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। বাবুকে কোলে নেওয়ার পর বুক ফে*টে কান্না আসলো। জোরে জোরে চিৎকার করে কাঁদলাম। 

.

.

.

পরদিন পুরো বাড়িতে থমথমে অবস্থা। বাড়ির আত্মীয়স্বজন, আমার বাড়ির সকলে চলে গিয়েছে।বড়ভাবী ছাড়া কেউ আমার সাথে কথা বলছে না।আমার শাশুড়ী কিছুক্ষন পরপর কাঁদছে আমাকে বকছে।আব্বা,আদিবের বড়ভাইও আমার ওপর বেশ ক্ষিপ্ত। তাদের কথা অনুযায়ী আমি যদি আদিবকে লঞ্চে আসার পরামর্শ না দিতাম তাহলে আজকের এ দুর্দিন দেখতে হতো না। আমি কি কখনো জানতাম, লঞ্চটা ডুবে যাবে....

তাহলে তো কখনোই বলতাম না।


বিকেল পর্যন্ত লঞ্চঘাটে অনেক খোঁজাখুজি করেও আদিবের কোন খবর পাওয়া যায় নি। আমি রুমে বসে বাবুকে ঘুম পাড়াচ্ছি আর আদিবের কথা ভেবে ভেবে নিরবে চোখের জল ফেলছি।হুট করে আমার শাশুড়ী রুমে ঢুকলেন। আমার কোল থেকে আমার ছেলেকে এক প্রকার কেঁড়ে নিলেন। আমি কিছু বুঝে উঠার আগে আমার চুলের মুঠি আমার গালে দুই-তিনটা থা*প্পড় দিয়ে বললেন, 


-- 'মুখপুড়ি অপয়া অলক্ষ্মী কোথাকার! আমার ছেলেটাকে খে*য়ে এখানে বসে নাটক করছে। তুই আমার ছেলের জীবনে আসার পর আদিবের জীবনে সব অঘটন ঘটে যাচ্ছে। বিয়ের এক সপ্তাহ আগে এক্সিডেন্টে পা দুটো হারাতে বসেছিল একমাত্র তোর কারনে। আর এখন আমার ছেলেকে খে*য়ে ফেললি। কয়দিন পর দেখা যাবে আদিবের ছেলেটাকেও খেয়ে ফেলবি।আর তোকে এ বাড়িতে রাখব না।বের হ.... '


আমি কিছু বলার আগেই আমার চুল ধরে হি*ড়হি*ড় করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে সদর দরজা লাগিয়ে দিলেন, সবাইকে শাসালেন কেউ যাতে দরজা না খোলে।আমি অনেকক্ষণ দরজা ধাক্কালাম, কেউ দরজা খুলল না। অনেক কাঁদলাম, দরজার বাইরেই বসে রইলাম। শরীরটা ভীষণ খা*রাপ লাগছে।


গতকাল রাত থেকে অনেক ঝাপটা বয়ে গেছে আমার ওপর দিয়ে আমি আর সহ্য করতে পারছি না। রাত নয়টার দিকে আমার শ্বশুর কোন কাজে 

বাইরে যাওয়ার জন্য দরজা খুললেন।তাকে দেখামাত্র আমি তার পা জড়িয়ে অনেক কাঁদলাম। কিছু বলতে পারলাম না।কারণ কান্নার কারনে গলা বসে গেছে। তিনি আমাকে অগ্রাহ্য করে চলে গেলেন।আর বললেন,


-- 'তোমার শাশুড়ী যা করেছে একদম ঠিক করেছে।আমার ছেলের এমন অবস্থার জন্য দায়ী একমাত্র তুমি।আমার ছেলেই নেই তোমাকে রেখে কি করবো? আর আদিবের ছেলে আমাদের কাছেই থাকবে।'


আমি ওনার কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলাম।মানুষ কু*কুরের প্রতিও মায়া দেখায় কিন্তু ওনি আমাকে পা ঝাড়া দিয়ে ফেলে রেখে চলে গেলেন। তবুও আমি গেলাম না।দরজার সামনেই শুয়ে রইলাম। 


গভীর রাত কয়টা ঠিক আমি জানি না।তবে চারপাশ নিরব। হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজ পেলাম। দেখলাম বড়ভাবী আর ভাই। বড়ভাবী আমাকে জড়িয়ে ধরে ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বললেন, 


-- 'দেখেছো তোমার মা-টা কতো নিষ্ঠুর! এমন ভাব ধরছে যেন তিনি নিজেই একমাত্র ছেলের শোকে কষ্ট পাচ্ছেন, আর তিশা ওর বউ হয়ে ওর কোন কষ্ট নেই।কোনো মেয়ে কি চায় তার হাজবেন্ড ম*রে যাক? এটা যে একটা দূর্ঘটনা সেটা তোমরা কেউ বুঝতে চাইছো না। কালকে যাওয়ার সময় তো দেখলাম রাস্তায় এক্সিডেন্ট হয়েছিল সেখানে যদি আদিব থাকতো তখন কি তোমার মা এই মেয়েটার দোষ দিতো পারতো? আর তোমরা... তোমরাও মায়ের সাথে তাল মিলিয়ে যাচ্ছো, কেউ মুখ ফুটে কিছু বলার সাহস পাচ্ছ না।'


ভাই কিছু বললেন না। চুপ করে ভাবীর কথাগুলো শুনে গেলেন। কথাগুলো বলে ভাবী আর ভাই আমাকে রুমে নিয়ে গেলেন। ঘড়িতে দেখলাম রাত একটা বাজে। আমার ছেলেটা রুশার (ভাবীর মেয়ে) সাথে ঘুমিয়ে আছে।

আমার জন্য ভাবী তাড়াতাড়ি খাবার গরম করে নিয়ে আসলেন। আমাকে খাইয়ে দিতে দিতে বললেন, 


-- 'মায়া-দয়া বলতে এদের মনের মধ্যে কিছু নেই। বোন আমার, বড়বোন হিসেবে তোমাকে একটা অনুরোধ করি তুমি কালকে সকালেই তোমার বাপের বাড়ি চলে যাও। এখন হাজার চাইলেও বাবুকে তোমার কাছে দিবে না। কয়দিন পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আম্মাকে বুঝিয়ে বাবুকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দিব। এখন তুমি যতোই এখানে থাকার চেষ্টা করবে ততই তাদের হিং*স্র আচরণের শিকার হবে।'


ভাবীর কথা শুনে আমি তাকে ধরে কেঁদে ফেললাম। 



সকালে আমি ভাবীর রুমে বসে আছি।ভাই-ভাবী ছাড়া কেউ জানে না আমি যে এ বাড়িতে আছি।সকলে জানে আমি চলে গেছি।ভাবী বারবার আমাকে অনুরোধ করছে আমি যাতে আমার ভাইয়াদের কল করে আমাকে নিয়ে যেতে বলি। ছোটভাইয়া অবশ্য কল দিয়েছিল ভোরে আদিবের কোন খবর পাওয়া গেছে কি না জানতে!


আমার শ্বশুরবাড়িতে যে এতো কাহিনি হয়েছে সেগুলো বলি নি।শুনলে সাথে সাথে এসে আমাকে নিয়ে তো যাবেই সাথে বাড়িসুদ্ধ সবাইকে কথা শুনিয়ে যাবে এই ভয়ে আমি কিছু বলি নি।আমি চাই না এই শোকের সময় আমার জন্য আবার নতুন কোন ঘটনা ঘটুক। এই দুইটা দিনে আমার জীবনটা পুরোই ওলট-পালট হয়ে গেল।বারবার আদিবের সাথে বলা শেষ কথাগুলো কানে বাজছে - ‘আমি লঞ্চে উঠতে ভয় পাই। সাঁতার জানি না।’


হঠাৎ করেই আমার ফোনটা বেজে উঠল। দেখলাম আননোন ন*ম্বর থেকে কল এসেছে। মন-মে*জাজ এমনিতেই ভালো ফোনটা ধরার কোন ইচ্ছে ছিল না। তবুও কলটা রিসিভ করলাম। রিসিভ করার পর ওপর প্রান্তে থাকা লোকটা আমাকে আদিবের খবর জানালো,


-- 'আসসালামু আলাইকুম, আপনি কি আদিব সাহেবের ওয়াইফ?'


-- 'জ্-জ্বি! কেনো? আদিবের কোন খবর পেয়েছেন?'


-- 'হ্যাঁ,আদিব এখন হাসপাতালে ভর্তি। আপনি কেমন ওয়াইফ উনার? দুইদিন ধরে হাজবেন্ড হাসপাতালে রোড এক্সিডেন্ট করে মৃ*ত্যুর সাথে লড়ছে আর আপনাদের কোন খবর নেই।আপনি হাসপাতালের ঠিকানা টেক্সট করে দিচ্ছি আপনারা এখুনি আসুন।'


-- 'হ্যাঁ..হ্যাঁ অবশ্যই।আমরা এখুনি আসছি।'


ফোনটা রেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। আল্লাহর কাছে অনেক অনেক শুকরিয়া আমার আদিব বেঁ*চে আছে। আমি তাড়াতাড়ি আম্মাকে ডাকতে গেলাম। আম্মাকে ডাক দিতেই আম্মা তেড়ে এলেন।


-- 'মুখপুড়ি তুই এখনো যাস নি? আর তোর ওই মুখে আম্মা বলে ডাকবি না... '


-- 'আম্মা আপনার ছেলে বেঁচে আছে।হাসপাতাল থেকে একজন কল করে বলেছে।রোড এ*ক্সি*ডেন্ট করে দুইদিন ধরে ও হাসপাতালে আছে।আমাদের এখুনি যেতে বলেছে।' (তাড়াহুড়ো আম্মাকে কি বললাম নিজেও জানি না)


-- 'রোড এ*ক্সি*ডেন্ট? ও কি তাহলে লঞ্চে করে আসে নি?'


-- 'জানি না আম্মা, আপনারা তাড়াতাড়ি রেডি হোন।আব্বাকেও গিয়ে বলুন।'


আমি তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বাবুকে দিয়ে ভাবীর কাছে দিয়ে গেলাম।আদিবের বড়ভাই,আমি,আম্মা,আব্বা সকলে মিলে হাসপাতালে গেলাম। হাসপাতালে যাওয়ার পর ওই লোকটা আমার শ্বশুর-শাশুড়িকে উদ্দেশ্য করে বললেন,


-- 'আপনার ছেলে যে এখানে এক্সিডেন্ট করে দুইদিন ধরে পড়ে আছে সেই খেয়াল আছে। ছেলের প্রতি কি কোনো দরদ নেই? দুইদিন পর আজ ওনার জ্ঞান ফিরেছে।ওনার থেকে না*ম্বার নিয়ে ওনার ওয়াইফকে কল করলাম।' (কিছুটা রাগী সুরে)


আব্বা বললেন, 

-- 'আসলে আমরা জানতাম আদিব লঞ্চ দিয়ে আসবে। তো লঞ্চ ডোবার ঘটনা শোনার পর থেকে লঞ্চ ঘাটেই সবসময় যোগাযোগ রেখেছি। আপনি আমাদের যে উপকার করলেন তার ঋন কোনদিন শোধ করতে পারব না।চিরকৃতজ্ঞ আমরা। আপনি যে না থাকলে কি হতো?'

লোকটির হাত ধরে আমার শ্বশুর কথাগুলো বললেন। 


-- 'ওহহ,আচ্ছা এই ঘটনা। সরি না জেনেই আপনাদের কতো কথা বলে ফেললাম। আসলে দুইদিন হয়ে গেছে অথচ আপনারা কোনো খবর নেন নাই।আমার ছোটভাইও আপনার ছেলের সাথে এক্সিডেন্ট করেছিল। ওর সাথে আপনার ছেলেকেও আমরা হাসপাতালে নিয়ে আসি। আপনার ছেলে মাথায় অনেক আঘাত পেয়েছিল।প্রচুর র*ক্তক্ষরণ হয়েছে। তারপর কত কষ্ট করে র*ক্ত জোগাড় করেওনাকে র*ক্ত দেওয়া হয়েছে। আল্লাহর রহমতে এখন আগের চেয়ে সুস্থ।'


-- 'আপনাকে কি বলে যে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করবো বুঝতে পারছি না। তা আপনার ছোটভাই ভালো আছেন?'


-- 'জ্বি, আল্লাহর রহমতে ভালো আছে।আজকে আমার ভাইকে নিয়ে যাবো।আর আপনারা এমন করে বলবেন না, আদিবও তো আমার ভাইয়ের মতো।'


আমরা আদিবের সাথে দেখা করতে গেলাম। আদিবকে দেখে বেশ সুস্থ মনে হলো। ডাক্তারের সাথে কথা বলে জানা গেল আজকে চাইলেই আমরা আদিবকে নিয়ে যেতে পারি।আমরাও আর ওকে হাসপাতালে রাখলাম না। হাসপাতালের বিল দেওয়ার সময় ওই লোকটার ভাইয়েরটাও আব্বা দিলেন। লোকটা অনেক না করলেন। আব্বা বললেন, 


-- 'আরে আপনারাও তো আমার ছেলের মতো। আমাদের এতবড় উপকার করল আপনার জন্য সামান্য এটুকু করতে পারবো না।'


-- 'না,আঙ্কেল ধন্যবাদ। আমাদের বিল দেওয়া লাগবে না। উপকার করে যদি তার বিনিময়ে কিছু নিই তাহলে এ উপকারের কোনো মূল্য নেই।আপনি আমাদের জন্য মন থেকে দোয়া করবেন এটাই আমার চাওয়া।'


লোকটার কথা শুনে আমরা সবাই রীতিমতো মুগ্ধ। বর্তমান যুগেও এমন ভালো মানুষ আছে? অবশ্য ভালো মানুষ আছে বলেই দুনিয়া টিকে আছে।

আব্বা অনেক জোরাজোরি করে হাসপাতালের বিল দিয়ে আসলেন।



বাড়ি আসার পর আদিবের কাছ থেকে পুরো ঘটনা শুনলাম।


-- 'তিশার কথা শুনে আমি লঞ্চঘাটে যাই লঞ্চ দিয়ে আসার জন্য।এমনকি লঞ্চে উঠেও যাই। কিন্তু লঞ্চে এত বেশি মানুষ ছিল যে আমার মনের ভিতর আরো ভয় ঢুকলো,যদি বেশি মানুষের জন্য লঞ্চ ডুবে যায়।এমনিতেও তো আমি নৌপথে যাতায়াত করতে অনেক ভয় পাই।


লঞ্চ ছাড়ার পাঁচ মিনিট আগে আমি নেমে যাই।ভাবলাম জীবনের মূল্য থেকে সময়ের মূল্য বেশি হতে পারে না। বাড়ি যেতে দেরী হলে হোক,তিশাকে আমি মানিয়ে নেব। আমি তখনি সিএনজি নিয়ে রওনা দিই।কিন্তু আমার কপালে যে দূর্ঘটনা লেখা সেটাকে তো আর ফিরাতে পারবো না। সিএনজি-বাসের এক্সিডেন্ট হলো।আমি মাথায় প্রচন্ড আঘাত পাই।অনেক র*ক্তক্ষরন হয়।আমার ফোনটাও ভেঙে যায়।যার কারণে তোমরা কল করে দেখছো বন্ধ। এরপরের কাহিনি তো তোমরা জানোই।'


-- 'লঞ্চ ডোবার কাহিনি শোনার পর আমরা চারচত্তর রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় যে শুনলাম কিছুক্ষন আগে এক্সিডেন্ট হয়েছে সেইখানেই কি.... '(তিশা)


-- 'হ্যাঁ।'


আদিবের কথা শোনার পর আব্বা-আম্মা আমাকে বললেন,


-- "বৌমা আমরা তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম। আসলে ছেলের শোকে মাথা ঠিক ছিল না। তোমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম।তুমি আমাদের মাফ করে দিও।'


তাদের আসল রূপ আমার দেখা হয়ে গিয়েছে। একটা মেয়ে কখনোই চায় না তার স্বামী মা*রা গিয়ে সে বিধবা হোক।তবুও সকলে মেয়েদের ওপরই সব দোষ দেওয়ার চেষ্টা করে। আজ বুঝতে পারলাম সেদিন বিয়ের আগে যদি আদিবের জায়গায় আমার পায়ের সমস্যা হতো তারা কখনোই আমাকে বাড়ির বৌ বানাতো না। আমার জন্মদাতা বাবা ভুল কিছুই বলেন নি।


আমি কিছুই বললাম না মাথা নিচু করে রইলাম।আমাকে তাড়িয়ে দেওয়ার কথা শুনে আদিব অনেকটাই রেগে গেল।পুরো কাহিনি শুনলে না জানি কোন কান্ড ঘটায়। আমি কিছু বলার আগেই আদিব বলে উঠল,


-- 'আমি ম*রে গেছি শুনেই তিশাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলে! বাহ্।

আমার ম*রালা*শ দেখা পর্যন্ত বাড়িতে রাখলে না। ছিহ্!! তোমাদের ওপর আমার ঘৃণা হচ্ছে। যে মেয়েটা আমার মতো পঙ্গু ছেলেকে বিয়ে করে লোকজনের কথা শুনলো, আমাকে সেবা করে ভালো করে তুললো তার সাথে তোমরা এই ব্যবহারটা কীভাবে করলে? উপকারকারীর প্রতি এতো অকৃতঘ্ন হলে কি করে?তোমাদের বিবেকে কি এতটুকু বাঁধল না।'


-- 'থাক আদিব এসব কথা বাদ দাও।তোমার শরীরটা বেশি ভালো না তার ওপর এমন উত্তেজিত হয়ে কথা বলা উচিত না। আগে সুস্থ হয়ে নাও।' (বড়ভাবী)


-- 'তাই বলে আব্বু-আম্মু তিশার সাথে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিবে.... ' (আদিব)


-- 'থাক, আদিব বাদ দাও।তোমাকে সুস্থ অবস্থায় ফিরে পেয়েছি এটাই অনেক।' (তিশা)

.

.

.

বাবু হওয়ার পর থেকেই অনেক ঝা*মেলা লেগে আছে তাই ঠিকমতো নামটাও রাখি নি। আজকে বাবুর নাম রেখেছেন আমার শাশুড়ী। আদিবের নামের সাথে মিলিয়ে সাদিব। আমার পরিবারের সবাইকে এবাড়িতে দাওয়াত করা হয়েছে। আজ দুই পরিবারের মধ্যে নেই কোনো রাগ, ক্ষোভ, বিবাদ।আছে শুধু ভালোবাসা আর সম্মান। জীবনের প্রতিটি দিন সকলের সাথে এভাবেই আনন্দে কাটাতে চাই।


-----(সমাপ্ত)-----


পর্বের আরও গল্প পড়ুন।