এক প্রবাসীর বুক ফাটা কষ্ট | প্রবাসী কষ্টের গল্প

 প্রবাসীদের কষ্টের স্ট্যাটাস

প্রবাসীদের কষ্টের স্ট্যাটাস

(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)

আঠারো বছর পর দেশে ফিরছে হারুণ। তার শ্যাম কুচকানো মুখশ্রীতে ছলকাচ্ছে আনন্দের লহর। ছেলেমেয়ের জন্য বাক্সবন্দি করে এনেছে শত সুখের ভান্ডার। বারবার ট্রেনের জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখছে এখন কোন স্টেশন। নামবে পোড়াদাহ তে। মাত্র তো ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে এখনো অনেকটুকু যাত্রা। যখন ছেলেটার বছর নয়মাস ছিলো আর মেয়ের বয়স দুবছর তখন দেশ ছেড়েছিলো হারুণ। স্ত্রী শামীমাকে আশ্বাস দিয়ে বলেছিলো,

 "কাইন্দো না বউ, মাত্র তো এক বছর। ঘুরলেই শ্যাষ। আমি চইলা আমু খুব জলদি"


সেই আসা আর হলো না। শত মাইল দূরের অজানা অচেনা দেশে পাসপোর্ট হারিয়ে ফেললো হারুণ। শিক্ষিত সে নয়। দেশ, পরিবেশ সব ই অচেনা। ফলে আইনের ফাঁদে ভীষণভাবে জরিয়ে পড়লো। মধ্যপ্রাচ্যের রুঢ় আইনের চোখে ফাঁকি দিয়ে প্রথম কিছু বছর কম ভোগান্তি হয় নি হারুণের। তখনের জামানায় যোগাযোগ এতো সহজ ছিলো না। মাস পার হয়, বছর পার হয় হারুণের খোঁজ নেই। স্ত্রী শামীমা পাগলের মত আচারণ করতে লাগে। যে সুখের আশায় এতোটা বিচ্ছেদ সেই সুখের দেখা নেই। অবশেষে একদিন পাশের বাড়ি রহমত ভরদুপুরে ছুটে আসে। 

"ভাবী, ও ভাবী হারুন্ন্যা ফোন দেছে"


প্রথমে কানকে বিশ্বাস করতে পারে না শামীমা। কাঁপা হাতে ফোনটি হাতে ধরে। ধরা গলায় অনেক কষ্টে বলে,

 "হ্যালো"

 "কিরাম আছো বউ?"


নিজেকে আটকাতে পারে না শামীমা। হু হু করে কেঁদে উঠে। মানুষটির কন্ঠ একবছর পর শুনছে যেন সে। কতশত কথা জমে আছে অথচ মুখথেকে যেনো কিছুই বের হচ্ছে না। শুধু অশ্রু ঝড়ছে স্বচ্ছ আঁখিদ্বয় দিয়ে। হারুণ অধৈর্য হয়, বলে,

 "কথা কও না কে রে"

"আপনি আইবেন না?"


বউ এর আহাজারিতে বুক ফেটে যায়। তবুও খুব কষ্টে বলে,

 "আমু বউ, আমু। খুব জলদি আমু"


সেই প্রতিশ্রুতি ক্ষুন্ন হয় সময়ের টানে। প্রথম অনেক বছর লুকিয়ে চুকিয়ে বেআইনী ভাবে কাজ করতে থাকে হারুণ৷ আয় বেশি নয়। তবে সেই আয় দেশের জন্য অনেক। অবশেষে দেশে আসতে থাকে টাকা। ছেলেমেয়ে বড় হতে থাকে। মেয়েটা স্কুলে ভর্তি হয়। কিন্তু সেই দৃশ্য দেখার মতো সৌভাগ্য হয় না হারুণের৷ কারণ তার কাছে দুটো পথ, হয় এই মানুষগুলোর সুখ নয় মানুষগুলোর সাথে কাটানো মূহুর্ত। সুখের লোভে মুহূর্তগুলোকে বিসর্জণ দেয় হারুণ। বছর দুয়েক বাদে এক শেখের সাথে পরিচয় হয়। পরিচয়টা বেশ অদ্ভুত। শেখের বউ তখন প্রসব যন্ত্রণাতে কাতরাচ্ছিলো। হারুণের বন্ধুর ট্যাক্সি সেদিন হারুণ চালাচ্ছিলো। এটা বেআইনী বটে কিন্তু এই কিছুবছর যাবৎ সে এটাই করছিলো সে। শেখের স্ত্রীকে হাসপাতাল অবধি নিয়ে গেলে জানা যায় তার রক্তের প্রয়োজন। রক্তশূন্যতায় বাচ্চা এবং মা দুজনের ই বিপদ হতে পারে। ভাগ্যবশত হারুণের সাথে রক্তের গ্রুপ মিলে যায়। ফলে শেখের স্ত্রী এবং বাচ্চা বেঁচে যায় সম্পূর্ণ ভীনদেশী বাঙ্গালীর উদারতায়। এই উদারতার বদৌলতে শেখ তাকে পাসপোর্ট জনিত ঝামেলা থেকে মুক্তি পেতে সহায়তা করে। শুধু তাই নয় তার কাগজপত্র ও বানিয়ে দেয় আইনগতভাবে। ধীরে ধীরে সবটা গুছিয়ে নিতে থাকে হারুণ। আয় বাড়ে। নিজেকে খুব কষ্টে চালিয়ে সব টাকা দেশে পাঠাতে শুরু করে সে। দেশে জমি কেনে, পাকা বাড়ি হয়। ছেলের পড়াশোনায় যেনো কমতি না থাকে তাই পার্ট টাইম করতে লাগলো হারুণ। এমন দিন গেছে বাইশ ঘন্টা ডিউটি দিয়েছে হারুণ। মসজিদে ঘুমিয়েছে। রোজার মাস আসছে মেস ছেড়ে মসজিদেই থাকতো যেনো টাকা খরচা না নয়। দিন শেষে আপন বলতে সেখানের বাঙ্গালী শ্রমিকরাই। খা খা করতো হৃদয়। ছেলে-মেয়ে বউ এর মুখ দেখতে হাপিয়ে উঠলো। ঝিমিয়ে আসতো শুন্য হৃদয়। অবশেষে মোবাইল কিনলো সে। ভিডিও করে ছেলে, বউকে দেখতো। কিন্তু সেই সময়টাও ছিলো ক্ষীন। শামীমা মাঝে মাঝে শুধাতো,

 "আইবেন কবে?"

 "আমু বউ আমু, তোমার জন্য এখানের স্বর্ণ কিনে আনুম"

 "আপনি আসেন, আপনি তো আমার স্বর্ণ। ওই নির্জীব সোনা আমার লাগতো না"


অবশেষে আজ আঠারো বছর পর আসা দেশে। মেয়েটার বিয়ে। ছেলে এখন ভার্সিটিতে পড়ে। হারুণ বুড়ো হয়েছে। সেই যৌবণ আর নেই। চামড়া কুঁচকেছে। বল কমে গিয়েছে। মুখে কাঁচাপাকা দাঁড়ি। চুলেও ধরেছে পাঁক। পোড়াদাহ স্টেশনে নামলো সে। সাথে পাঁচটা বড় বড় বাক্স। মেয়ের জন্য বিয়ের সব জিনিস এখানে। কুলিকে কড়া পাঁচশত টাকা দিলো সে। এখন যাবার পালা বাড়ি। স্ত্রীকে জানায় নি আজ ই বাড়ি আসছে। সে জানে আসতে আরোও দু দিন। তর সয় নি যে আর দূরত্ব। দেশে এখন অরাজকতা। তবুও ট্রেনে করে ছুটে আসা। একটা গাড়িতে করে রওনা দিলো বাড়ির পথে। ঝলসানো রোদে মুখের হাসি মলিন হলো না হারুনের। সেই গ্রাম এখন আর গ্রাম নেই। পাঁকা রাস্তা, বিদ্যুতের খুটি। নিজের বাড়ির পথটাও অজানা লাগছে। বাড়ির কাছে আসতেই গাড়ি থেমে গেলো। বিয়ে বাড়িতে শুনশান নীরবতা। চকচকে বাড়ি কয়লা পোড়া হয়ে গেছে যেন। থমকে গেলো হারুণের কদম। বুকে কামড় পড়লো। মানুষের ভিড় গেট থেকেই। পা এগুতে চাইলো না অচেনা ভয়ে। বৃদ্ধ শরীর অসাড় হতে লাগলো। অনেক কষ্টে কদম এগিয়ে নিলো সে। ভীড় ঠেলে ভেতরে যেতেই আর্তনাদ কানে আসতে লাগলো। বুক স্তব্ধ হয়ে গেলো যখন উঠানে সাদা কাপড়ে মোড়া অনেকগুলো দেহ। অজানা সেই ভয় কালো রুপ নিয়ে জেঁকে ধরলো হৃদয়। হারুণকে দেখে প্রথমে না চিনলেও অবশেষে চিনলো পাশের বাড়ির রহমত। কান্না জর্জরিত কন্ঠে বলে উঠলো,

 "হারুণ্ণ্যা আইসোস ভাই?"

 "কি তা হইছে এখানে? বউ কই? আর ইকরা? আলিফ? ওরা কোনে?"


হারুণের আকুল, অস্থির কন্ঠে ডুকরে উঠে রহমত। কাঁপা আঙ্গুল তুলে উঠানে শায়িত সফেদ কাঁপড়ে মোড়ানো সেই দেহগুলোর দিকে। গতরাতে বিদ্যুতের তার থেকে আচমকা আগুন ধরে লাইনে। নিমিষেই সেই আগুণ ছড়িয়ে যায় প্রতিটি লাইনে। নিবিড় রাতে শান্তির ঘুমে ছিলো শামীমা আর বাকিরা। যখন ঘুম ভাঙ্গলো পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছিলো বাড়ি। বের হবার মতো পরিস্থিতিও ছিলো না। সব জায়গায় দাউদাউ করে জ্বলছিলো লেলিহান শিখা। আশেপাশের মানুষ টের পেতে পেতে সময় লাগলো। তারা ছুটে এলো আগুন নিভাতে। দমকল এলো ভোরে। কিন্তু ততসময়ে পুড়ে ছাই হয়ে গেলো সুখগুলো। হারুণ ধপ করে বসে পড়লো। চোখ ঝাপসা হয়ে গেলো। বুক নিংড়ে হাহাকার বের হলো। সশব্দে কান্নায় ভাঙ্গলো বৃদ্ধ ঠোঁট। সে ফিরলো বটেই, কিন্তু সেই ফেরাটা খুব দেরি হয়ে গেলো। যে সুখের তল্লাশে এতো কষ্ট, সেই সুখ এখন আগুনের লেলিহান শিখায় ছাই হয়ে বাতাসে মিশে গেছে। পোড়া জ্বলন্ত স্ত্রীর মরদেহের কাছে যেয়ে বিলাপ করতে লাগলো হারুণ,

 "বউ, আমি আইছি। আমি ফিরয়্যা আইছি। ও বউ৷ আমি ফিরছি"


||সমাপ্ত||


-ফেরা

মুশফিকা রহমান মৈথি

 

প্রবাসীদের জীবনের গল্প পড়ুন।