বাস্তব জীবন নিয়ে স্ট্যাটাস | বাস্তব জীবনের কষ্টের গল্প

 জীবনের কিছু বাস্তব কথা স্ট্যাটাস

জীবনের কিছু বাস্তব কথা স্ট্যাটাস

আমার বিয়ের জন্য আব্বাকে একটা সোনার টিকলি বানাতে বলেছি। আর কিছু লাগুক বা না লাগুক একটা সোনার টিকলি আমার চাই ই।


আজ বাদে কাল বিয়ে। এনামুলের সাথে আমার স্বমন্ধ যখন আসে। প্রথমে রাজি হইনি। কিন্তু যখন জানলাম ছেলে ফায়ার সার্ভিস কর্মী তখন না চাইতেও রাজি হয়ে গেলাম। শত হোক দেশ সেবার কাজে যে নিজেকে নিবেদন করেছে। সে আর যাই হোক খারাপ মানুষ অন্তত হবে না। তাছাড়া আগুন নিয়ে আমার মারাত্মক ফোবিয়া আছে।


দাদীজান যেদিন আগুনে পুড়ে মারা যান। সেদিন খালের পানিও ছিলো পোড়া বেগুনের ভেতটার মতো ভ্যাপসা গরম। চৈত্র মাস, মাথার ওপর সারাক্ষন চিল কাক টহল দেয়। পুকুর বিল সব শুকিয়ে বুড়ো মানুষের চামড়ার মতো খটখটে। সেরকম এক দুপুরে দাদীজানকে মহল্লার আলিমুদ্দি চাচা হানাদারদের হাতে তুলে দিলো। আব্বার বয়স তখন ছয় কি সাত বছর। তবুও যতবার তিনি এই কথাগুলো বলেন। প্রতিবারই বলবেন,


-- "তিশা মা, আম্মা সেই দিন রসুণ বাগাড় দিয়ে কঁচু শাক রানছিলো। এত সোয়াদের সালুন আল্লাহ জীবনে আর দ্বিতীয়বার খাওনের সুযোগ দেয় নাই। আম্মার পোড়া মুখটার লগে সব দুনিয়া থেইক্যা উইঠ্যা গেলো।"


আব্বার সামনেই দাদীজানকে ঘরে আঁটকে রেখে ওরা জ্যান্ত আগুনে পুড়িয়ে দেয়। আর উঠানের বৈশাখী আম গাছটার সাথে হাত পা বাঁধা আব্বা মরার মতো পড়ে থাকেন টানা দুই দিন। ভয়ে কেউ মুখে এক ফোঁটা পানি পর্যন্ত দিতে আসেনি!


দাদাজান যুদ্ধ শেষে আর ফেরেননি। আব্বা মানুষ হয়েছেন তার নানা বাড়িতে। মামাদের কাছে। তাই আব্বার মামাকে আমি দাদা বলে জানি।


এলাকায় এখন আব্বার বড় টীনের দোকান। সবাই বেশ সমীহ করে চলে। তবুও ইন্টার মিডিয়েট পাশ আমার জন্য আব্বা কেনো একজন ফায়ার সার্ভিস কর্মীকে জামাই হিসেবে বাছলেন। সে নিয়ে আমার মনে দ্বন্দ কাটেনা।


ইতিউতি করে একদিন আব্বাকে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম,


-- "আব্বা, আপনি কি একজন ব্যাবসায়ী বা চাকুরীজীবির সাথে আমার বিয়ে দিতে পারতেন না বলেন? উনি কয় টাকাই বা বেতন পান? তার ওপর এক মুহুর্তও জীবনের নিশ্চয়তা নেই। আগুন নেভাতে গিয়ে যদি মরে টরে যায়? তখন? আপনার মেয়ে বিধবা হবে না বলেন?"


আব্বা আমার কথায় মৃদু হাসলেন। কাছে টেনে মাথায় হাত রেখে শুধু বললেন,


-- " হায়াত মউতের মালিক আল্লাহ। কপালে মরন থাকলে মানুষ নিজের আরামের বিছানায় কোলবালিশ জড়ায় ধইরাও মইরা যায় রে মা। আর যদি টাকা পয়সার কথা বলিস। তাইলে বলবো টাকায় পেট ভরলেও মন কি ভরে? কিন্তু মহব্বতে মন ভরে। শরীর জুড়ায়। তুই সুখী হবি দেখিস।"


আমার গল্পটা এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারতো। রুপকথার গল্পের মতো বেহিসেবী সুখ আমার জন্য আসেনি।


এনামুল আংটি পরাতে এসে আমাকে তার মোবাইল নাম্বার দিয়ে যায়। লজ্জা কাটিয়ে প্রায় নিয়মিতই আমাদের কথা হতো। ওর মেসে কোন বারে কি মেন্যু সেটাও আমার মুখস্ত। কী রঙ ভালো লাগে, কোন মাছ পছন্দ। শুঁটকি খায় কি খায় না? চিংড়িতে এলার্জি আছে কিনা। কাঁঠালের এঁচোড় শীমের দানা দিয়ে খেতে ভীষন ভালোবাসে। সব, সব জানি আমি।


আজ যখন বাড়িতে অচেনা নাম্বার থেকে ফোন কল এলো। আমি রান্নাঘরে আব্বার জন্য টিফিন বাটি সাজাচ্ছি। শনিবার, আব্বা দোকানে যাবে। আম্মা চুলা থেকে গরম ডালের পাতিল নামিয়ে পাশে রেখেছেন। আরেক কড়াইয়ে কাতলা মাছ আলু টমেটো দিয়ে ঝোল করে রান্না।


এনামুলের কন্ঠ একেবারে অন্যরকম শোনাচ্ছে। 'হ্যালো, কেমন আছো তিশাপাখি' না বলে, ও বললো,

-- "আমি মনে হয় মারা যাবো তিশা, আগুনে আমার সারা গা ঝলসে গেছে। আমাকে মাফ করে দিও।"


কথা শেষ করেই লাইন কেটে দিলো এনামুল। আমি ফোন কানে নিয়েই আম্মা আম্মা করে পড়ে গেলাম রান্নাঘরের মেঝেয়। গরম ডালের পাতিল উপুড় হয়ে পড়ে আছে আমার ডান পায়ের ওপর।


আমি পাগলের মতো কাঁদছি আর চিৎকার করে বলছি,


-- "আম্মা, এনামুল মারা যাচ্ছে আম্মা এনামুল মারা যাচ্ছে। আব্বাকে ডাকো এক্ষন। শিগগির ডাকো!"


আম্মা ডিম ভেঙে পায়ে মাখিয়ে দিয়েছে। অসহ্য যন্ত্রনায় আমি স্থির থাকতে পারছিনা। এনামুলের কেমন লাগছে তাহলে এখন? সারা শরীর মরিচ পোড়ার মতো জ্বলছে? শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে? ব্যাথা করছে খুব বেশি?


এর মাঝে আব্বা আমাকে মিথ্যে স্বান্তনা দিয়ে বললেন,


উনি চিটাগং যাবেন। এনামুলকে সাথে করে মানিকগঞ্জ নিয়ে আসবেন। আমার বিয়ের আর বারো দিন বাকি। কেনা কাটাও প্রায় সব করা শেষ। টকটকে লাল বেনারসি, সোনার টিকলি,  বালা, এনামুলের পাঞ্জাবি, সবকিছু। 


পায়ের অনেকখানি পুড়ে বিশ্রী ক্ষত হয়ে গেছে। তবুও আব্বার সাথে আমি যেতে চাইলাম। উনি রাজি হলেন না। আগুন তো উনিও ভীষন ভয় পান। দাদীজানের কথা মনে পড়ে যায় হয়তো!


এনামুলের নাম্বার বন্ধ। ঘরে টিভি অন করে বসে আছি আমরা। কোথাও যদি এনামুলকে একবারের জন্য হলেও দেখা যায়। কাল রাত দশটায় যখন কথা হয়েছিলো তখন ও বলেছিলো, সামনের শুক্রবার বাড়ি আসবে। ব্যাগ গুছিয়েই রেখেছে। শুধু বাসে ওঠার অপেক্ষা।


অপেক্ষা তো আমিও করছি। কখন দেখা হবে আমাদের?


আব্বা ঘরে ঢুকেই আমাকে জাপটে ধরেছেন। কোনো কথা বলছেন না। আমি স্বাভাবিক স্বরেই বললাম,


-- "চলেন আব্বা, উনাকে শেষ একবার দেখবো।"


না শেষবার আমি এনামুলের মুখটা দেখতে পারিনি। পোড়া লাশ বলে শুধু কাছের স্বজন ছাড়া কাউকেই দেখতে দেয়া হয়নি। ফ্রিজিং গাড়িটা ধরে শুধু কিছু মুহুর্ত নিরব দাঁড়িয়ে থাকলাম।


আব্বা আমাকে সেখান থেকে সরিয়ে নিতে এলেন। আব্বার চোখেও পানি থই থই করছে। পোড়া পা টেনে টেনে আমি বাড়ির দিকে হাঁটছি। আর কিছুদিন বাদেই বর সেজে এনামুলের ফেরার কথা ছিলো। অথচ ফিরে এলো লাশ হয়ে! নির্বাক নিথর একটা পোড়া লাশ!


দাদীজানকে পুড়িয়েছিলো বর্বর হানাদারেরা। আর আমার এনামুল পুড়ে গেলো স্বাধীন দেশের আগুনে।


শুধু মাঝখানে কেটে গেলো পঞ্চাশ বছর!


(সমাপ্ত)...


গল্প || "পুনরাবৃত্তি"

লেখা || নূর হেলেন


সংসার জীবনের গল্প পড়ুন।