মেয়েদের জীবন কাহিনী
তুমি মেয়ে মানুষ , তোমার কাজ হইল খালি শুনবা আর চুপচাপ হুকুম তামিল করবা , বুঝলা ?
মেয়ে মানুষ হইয়া সব ব্যাপারে নাক গলাইতে আসবা
না ।
রাহেলার স্বামী মকবুল খুবই কর্কশ গলায় বললেন রাহেলাকে । মকবুল পাটোয়ারী গ্রামের অবস্থাপন্ন মহাজন । সুদের কারবার করে তার বিষয় আসয় নয়া পয়সার মতো ঝলকায় আজকাল ।
তার প্রথম বউটা যখন মারা যায় তখন মকবুলের বয়স প্রায় চল্লিশ ছুঁই ছুঁই । ততোদিনে তিনি চার সন্তানের জনক । যদিও বাচ্চারা ততোদিনে সবাই বেশ বড়োসড় তবুও মকবুলের বাচ্চাদের জন্য তখন নতুন মায়ের দরকার । বিয়ে করে আনলেন গরীব ঘরের সুন্দরী , পনের বছরের বালিকা রাহেলা
বানুকে ।
রাহেলা বানুর আবার পড়াশুনার বেজায় শখ আবার সে গ্রামের স্কুলের নবম শ্রেনীর ভালো ছাত্রীও বটে ।
বিয়েতে কিছুতেই মত ছিল না তার কিন্তুু বাপ মায়ের কান্নাকাটির কাছে হার মানতে হলো তাকে । পরে রাহেলাও ভেবে দেখল । মকবুলের সাথে বিয়ে হলে , রাহেলার বাপকে মকবুল টাকা, কড়ি এমনকি চাষের জমিও দেবে । তার বাপকে আর অন্যের জমিতে বর্গা দিতে হবে না । ভাইবোনগুলোর আর অনাহারে অর্ধাহারে থাকতে হবে না । মায়ের হাপানির চিকিৎসা আর ওষুধপথ্যির ব্যাবস্থা হবে ।
মকবুল আদোর সোহাগ করে রাহেলাকে তবে কোন কথা বা তর্ক করা একদম পছন্দ করে না । রাহেলাকে স্কুলে যেতে বারণ করতেই রাহেলা মকবুল কে পাল্টা প্রশ্ন করল ,
- কেন্ আপনে না কইসিলেন আমারে স্কুলে যাইতে দিবেন । লেহাপড়া করতে দিবেন ?
এতেই মকবুল ভিষণ রেগে গেল , মুখে মুখে তর্ক করার জন্য ।
এই টুকু লেখা হতেই রশ্মি চৌধুরী শুনতে পেল তার স্বামী ইরফান চৌধুরী রশ্নি রশ্নি বলে ডাকছে ।
- কি বলবে বল ।
- রাত তো অনেক হলো । ঘুমাতে এসো রশ্নি ।
- আসছি ।
রশ্নি বাতি নিভিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়ল ইরফানের পাশে ।
- তুমি আজকাল আমার কোন যত্ন নাও না কেন বল তো , রশ্নি ।
- তাই বুঝি ? কেন তিন বেলা রেঁধে বেড়ে খাওয়াচ্ছি তো । চাকরিটা ছেড়ে দিতে বললে ছেড়ে দিলাম । পাঁচ বছর পর বাচ্চা নিতে বলেছ তাতেও আপত্তি করিনি ।
- না মানে তোমার এই সব লেখালেখি ।
- কি লেখালেখিও ছেড়ে দিতে বলছ ?
এবার ইরফান একটু গলাখাকাড়ি দিয়ে বলল , না মানে আপু(ইরফানের বড় বোন ) বলছিল তুমি নাকি কিসব পুরুষ বিদ্বেষী লেখা লেখো ।
- আমি নারীদের দুঃখ দুর্দশা আর অধিকার নিয়ে লিখি আর পুরুষ বিদ্বেষী লেখা লিখলেই বা ওনার সমস্যা কোথায় ?
- শোন রশ্নি, মেয়ে মানুষ যত কম বোঝে সংসারে ততোই সুখ বুঝলে ?
- হুমম্ বুঝলাম । আচ্ছা বল তো করোনার সময় যখন তোমার চাকরিটা চলে গেল । তখন যদি আমি কম বুঝতাম । যদি আমার চাকরিটা না থাকত তখন কিভাবে সংসার চলত বলো তো ?
- চলে যেত যে কোনভাবে । কারো জন্য কি আর কিছু থেমে থাকে বল ?
আর কিছু বলল না রশ্নি । পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল ।
সারাদিনের কাজের পর রশ্মির ঐ এতটুকুন সুখ একটু লেখালেখি । নিজের জীবনের চারপাশে বয়ে যাওয়া ঘটনা প্রবাহগুলো একটু সাজিয়ে আর নিজের মনমতো চরিত্রের নাম দিলেই তার গল্প দাঁড়িয়ে যায় ।
রাহেলা বানুর গল্পটা তার শ্বশুরবাড়ির ।
রশ্মিদের পাশের ফ্লাটে থাকেন পারভীন ভাবি । ওনারা হাজবেন্ট ওয়াইফ দুজনেই ডাক্তার । পারভীন ভাবির মতো উচ্চ শিক্ষিত একজন মানুষও সেদিন বলছিলেন ,
- রাগ না থাকলে আবার পুরুষ মানুষ কিসের !
- মেয়েদের জান খুব শক্ত , কই মাছের প্রাণ । সেদিন ননদীনির মুখে শুনতে পেয়ে জিজ্ঞেস করেছিল রশ্মি , এমনটা মনে হওয়ার কারণ কি ?
তো সে বলল , দেখো না , অধিকাংশ পরিবারেই দেখবে দাদা , নানা , শ্বশুর বা বাবা আগে দুনিয়া থেকে বিদায় নেন বা মৃত্যু বরন করেন । আর মহিলারা বুড়ি থুত্থুড়ি হয়েও মরে না । যখের ধনের মতো জানটাকে আগলে রাখে যত্ত কিছু রোগবালাই হোক না কেন , কোন না কোনভাবে মৃত্যুর চোখে ধুলো দিয়ে পার পেয়ে যায় তারা ।
- তার মানে মোটামুটি সব পরিবারেই দেখা যায় বাড়ির পুরুষ ব্যক্তিটি আগে মারা যায় । বলল
রিদা ।
- রিদা হয়ত ঠিকই বলেছো । তবে একটা কথা কি জানো রিদা এদেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যায় , স্ত্রী' র তুলনায় স্বামীর বয়স বেশি । তো স্বাভাবিক নিয়মে যার বয়স যত বেশি অর্থাৎ যে যত আগে দুনিয়াতে এসেছে সে তো ততো দ্রুত বৃদ্ধ বয়সে উপনীত
হবে । সুতরাং তার মৃত্যুটা আগে হওয়াই তো স্বাভাবিক তাই নয় কি । আমার নানাজান যখন চলে গেলেন তখন ওনার বয়স ছিল সত্তুর বছর আর নানীজানের পঞ্চান্ন । নানীজান চলে গেলেন পঁয়ষট্টিতে পা রাখার আগেই তবুও সবাই বলবে মেয়ে মানুষের কই মাছের প্রাণ ।
- হুমম্ , এমনটা তো ভেবে দেখিনি ভাবি ।
রশ্মির ছোট ননদ রিদা । ভালো ছাত্রী । ভিষণ সুন্দর গানের গলা । ওর কলেজের বার্ষিক অনুষ্ঠানে একজন বড়মাপের শিল্পী এলেন প্রধান অতিথি
হয়ে । রশ্নির গান শুনে তিনি এতটাই মুগ্ধ হলেন যে সেই অনুষ্ঠান থেকে ফিরে যেয়েই তিনি একটি টিভি চ্যানেলে সুপারিশ করে রিদার একক সঙ্গীতানুষ্ঠানের ব্যাবস্থা করে দিলেন । সেই গানের অনুষ্ঠানটি সম্প্রচারের পর রাতারাতি রিদা জনপ্রিয় শিল্পীদের কাতারে নিজের ঠাঁই করে নিল । ঠিক সেই সময়ই রিদার জন্য ভালো ভালো বিয়ের প্রস্তাব আসতে লাগল । রিদাও ছেলে পক্ষ থেকে আসা অতিথিদের মাঝে গান পরিবেশন করত । এভাবেই তারই এক মুগ্ধ শ্রোতার সাথে রিদার বিয়ে ঠিক হয়ে গেল । রিদার গানের প্রেমে পড়েছিল যে ভদ্রলোকটি । রিদার সাথে বিয়ের তিনমাস পর তিনি ঘোষণা দিলেন রিদার গান গাওয়া ছেড়ে দিতে
হবে । সংসার অথবা সঙ্গীত এ দুটোর মধ্যে যে কোন একটাকে বেঁছে নিতে হবে রিদাকে । রিদা রশ্নির সাথে পরামর্শ করল । রশ্মি নারীবাদির মতো সঙ্গীতের পক্ষে মত দিলো । এতে রিদার সাথে ডিভোর্স হয়ে গেল সেই ভদ্রলোকের ।
লোকমুখে রিদা এবং তার পরিবারের সবাই জানতে পেরেছে ঐ ভদ্রলোক দ্বিতীয় বিয়ে করে ভিষণ সুখে আছেন । আর রিদা আজও একা । সংসার ভাঙার জন্য সবাই দোষ দেয় রিদাকে । আর রিদা দোষ দেয় তার ভাবি রশ্মিকে । এখন নারীবিদ্বেষীরা দোষ দিবে নারী স্বাধীনতার । সংসার টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব কি কেবল নারীর ?
এই রশ্নির বড় বোন নিকিতা একদিন শ্বশুরবাড়ির লোকদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে এক বোতল ডেটল খেয়ে নিল আত্মহত্যা করবে বলে । কিন্তুু সে মরল না কারণ ঐ যে কই মাছের প্রাণ ।
রশ্মির ও এখন মেয়েদেরকে কই মাছের প্রাণ মনে হয় । কারণ একটা মেয়ে যখন মা হয় তার শরীরের ভেতর থেকে আরেকটা প্রাণ বেরিয়ে
আসে । নারী যেই প্রানটাকে ধারণ করে রাখে সেই প্রাণটা রক্তচোষার মতো মায়ের শরীর থেকে পুষ্টি শুষে শুষে বড় হয় । বাচ্চার জন্মের পরে মা সন্তানের প্রতি অধিক যত্নবান হতে যেয়ে নিজের প্রতি চরম অবহেলা করলেও সে না মরে ধুঁকে ধুঁকে বাঁচে । এই যে বেঁচে থাকাটা । কই মাছের প্রাণ বলেই তা সম্ভব ।
রশ্মি যখন চাকরি করত নিজের জ্ন্য খুব সুন্দর করে গুছিয়ে টিফিন নিত । ছোট্ট ফ্লাক্সে চা নিত । তাই দেখে তার এক সহকর্মী মিসেস সেন বললেন ,
- রশ্নি চৌধুরী নিজের জন্য এতটা আয়োজন কেন ? আমি তো শুধু বরের আর বাচ্চাদের টিফিন গোছাতেই নিজের খাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলি । সবার দৃষ্টিতে রশ্মি তখন অপরাধি স্বার্থপর । কিন্তুু একটুও লজ্জা না পেয়ে রশ্নি বলেছিল ,
নারী তুমি মানুষ হবে কবে ?
নারী তুমি নিজেকে ভালোবাসবে কবে ?
নিজেকেই যদি হীন ভাবো তবে ,
কি করে বল অন্যের কাছে সম্মান তুমি পাবে ?
হারিয়ে না ফেলে নিজের অস্তিত্ব ,
পুরুষকে দেখাও তোমার মহাত্ব ।
তুমি মা , তোমার রয়েছে প্রাণ প্রাচুর্য ,
মনের জোরে অটল থাকো , যত্ন করো রুপ মাধুর্য ।
আসলে নারীর মানুষ না হয়ে নারী হয়ে ওঠার পেছনে আমরা নারীরা নিজরাই দায়ী ।
রাহেলা বানুর পড়াশোনার পেছনে প্রথম বাঁধা ছিল তার শাশুড়ি খোদেজা বেগম । খোদেজা বেগম তার গুণধর ছেলে মকবুলকে ডেকে বললেন ,
- মাইয়া মানুষ এত পড়াশুনা শিখা কি লাভ ? পরে আর তোরে মানবো না দেখিস । কথাটা মকবুলের পছন্দ হলো ।
এভাবেই যুগে যুগে মকবুলদের পছন্দ অপছন্দের বলি হয়ে আসছে রাহেলা বানুর মতো মেয়েরা ।
(সমাপ্ত )
-কই_মাছের_প্রান
রেজওয়ানা_ফেরদৌস।