গল্পঃনিল_নয়না | রহস্যময়ী নারী

 রহস্যময় গল্প

রহস্যময় গল্প

পাত্রী দেখতে এসেছি একরকম জোর করেই।কেননা, আমার মায়ের আসার কোনো ইচ্ছাই ছিল না।তার কারন,যেই মেয়েকে দেখতে এসেছি তার নাম গ্লেমা।ঘটকের মুখে গ্লেমা নাম শুনেই আমার মা হকচকিয়ে উঠেছেন।এ আবার কেমন বিচ্ছিরি নাম।অমন নামের মেয়ে দেখতে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।তবুও,আমি জোরাজুরি করে নিয়ে এসেছি। পাত্রপক্ষকে যতটা খাতির যত্ন করা উচিত তার বিন্দু পরিমাণও গ্লেমার পরিবার করলো না।শুকনো ধরনের হাসি দিয়ে বসিয়ে রাখলো প্রায় আধাঘণ্টা।এরপর বাড়ির ১জন কাজের লোক চা নিয়ে এলো।সেই চাও আবার ঠান্ডা।মা আমার দিকে এমন ভাবে তাকাচ্ছিল যেন আমাকে চোখের মধ্যে ঢুকিয়েই ফেলবে।আমারও খানিকটা রাগ হলো।পাত্র হিসেবে কি আমি এতোটাই নগন্য?

যাইহোক, অনেক অপেক্ষার পর গ্লেমার দেখা মিললো।গাঢ় নীল ১ টা শাড়ি পরে সে আমাদের সামনে এসে বসলো।তার চুলে বেলী ফুলের গাঁজরা।আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।একটা মানুষ এতোটাও সুন্দর হতে পারে! বিশেষ করে ওর চোখ।গাঢ় নীল রঙের। বাঙালিদের চোখ কি অমন হয়?

আমরা চলে আসার সময় ওর বাবা গেইট পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। আন্তরিকভাবে বললেন, দুঃখিত।আসলে আজ বাসায় মেয়েটার মা ছিল না।তাই, আপনাদের আপ্যায়ন করতে পারলাম না ভালো মতো।

আমি বললাম,আরে ঠিকাছে।

বাড়ি ফিরে মা আমার উপর তুমুল চেঁচামেচি করলেন কারন,আমি গ্লেমাকে বিয়ে করার কথা বলেছি তাই।

বড় আপা জিজ্ঞেস করলো,মেয়ে দেখতে কেমন?

আমি বললাম, অপরূপা,নীল-নয়না।

আমার কথা কেড়ে নিয়ে মা বললো,হ্যাঁ, বিড়ালের মত চোখ।দেখলে ভয়ে বুক কাঁপ দেয়।আর মরা লাশের মতো সাদা।সাদা শাড়ি পরলে মানুষ ভাববে কাফন পেঁচানো লাশ।ভদ্রতা-সভ্যতাও নেই।কোনো সালাম-টালাম না দিয়ে ঘরে ঢুকে ধুপ করে বসে পরলো।কি মেয়ে ছিঃ ছিঃ।

মায়ের কথায় আমি খানিকটা আহত হলাম।

মা অন্য মেয়ে দেখার তোরজোর শুরু করলো। কিন্তু, আমি বেঁকে বসলাম।গ্লেমাকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবো না।

একমাস পরে আমার ফ্লাইট। মায়ের ইচ্ছা বিদেশে একেবারে বউ নিয়েই যেন যাই । যাইহোক, অনেক চড়াই-উৎরাই পার করে মা'কে রাজি করালাম।

সেই সিদ্ধান্ত যখন গ্লেমার বাবাকে জানালাম, তিনি অবাক হয়ে বললেন,সত্যিই তুমি আমার মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছো?

আমি বললাম,না হলে বলছি কেন....

তিনি আরো অবাক হলেন। বললেন,তাহলে আগামী কালই বিয়ে হয়ে যাক ।কি বলো?

আমি অবাক হয়ে বললাম,এতো দ্রুত?আমি তো এখনো গ্লেমার সাথে আলাদা করে কথাও বললাম না।

তিনি বললেন,শুভ কাজে দেরি করতে নেই।আর বিয়ের পর তো সারা জীবন পরেই রইলো কথা বলার জন্য।

অবশেষে, ঘরোয়া ভাবেই আমাদের বিয়ে হলো।

সবই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু, বিয়ের পর যখন সবাই বললো, এবার বর-বউ এর কয়েকটা সুন্দর ছবি তোলার পালা।তখন গ্লেমা ঘোর আপত্তি করতে লাগলো,সে ছবি তুলবে না। অনেক জোরাজুরি করেও কাজ হলো না।বরং,সে কান্না করে দিল,সে কিছুতেই ছবি তুলবে না।এতে উপস্থিত সবাই খানিকটা বিরক্ত হলো।আমারও অবাক লাগলো,ছবি তুলতে না চাওয়ার কারণ কি?

বিয়ের ২ দিন পর ঘটলো, আরেক অদ্ভুত ঘটনা।

মা আমাকে নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে বললেন,শাহীন তোর বউ তো মানুষ না।

মায়ের কথায় আমি বিরক্তির চূড়ান্ত হলাম। বললাম,তবে কি এলিয়েন?

মা মুখ ফ্যাকাশে করে বললেন,ও ১ টা মরা মানুষ।

এবার আমি হেসে ফেললাম।

আমাকে হাসতে দেখে মা আরো ফ্যাকাশে হয়ে গেলেন। বললেন,তোর বউয়ের গ্রামের বাড়ির মেয়ে হলো অমির মা।(অমির মা পাশের বাসার আন্টির বাড়িতে কাজ করে)

আমি বললাম,তাতে কি?

মা বললো,তোর বউয়ের যখন ১২-১৩ বছর বয়স তখন নাকি সে শ্বাসকষ্ট হয়ে মারা গেছিলো।

আমি বললাম,মারা গেলে সে আমার সাথে থাকছে কিভাবে?

অমির মা নামক মহিলার ভাষ্যমতে,গ্লেমা মারা গিয়েছিল।এটা নিশ্চিত হয়ে সবাই যখন কবর -টবর খুড়ে ফেলেছে।এমনকি খাটিয়ার মধ্যে তাকে শোয়ানো হয়েছে তখন সে চিৎকার করে উঠেছিল।

এমন গাঁজাখুরি গল্প শুনে আমি হাই তুললাম।

অমির মা জোর দিয়ে বললো,ওদের গ্রামে গিয়ে অন্যদের জিজ্ঞেস করতে।গ্লেমা নাকি ২য় বার বেঁচে ওঠার পর আকস্মিক ভাবে বদলে গেছে। চুপচাপ হয়ে গেছে। চোখের রংও নাকি বদলেছে।

আমি এসব কিছুই পাত্তা না দিয়ে ফ্লাইটের জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগলাম।

চলে আসার দিনও মা কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন,এই মেয়ের গা,হাত পা এতো ঠান্ডা কেন মরা মানুষের মতো...তুই ওর থেকে সাবধানে থাকিস।

আমি হেসে মাকে জড়িয়ে ধরে ফেললাম।কি উদ্ভট দুশ্চিন্তার কারণ।

অবশ্য,এটা সত্যি গ্লেমার শরীরের তাপমাত্রা অনেক কম।

তাই বলে তো আর সে মরা মানুষ না।

আমাদের ২ জনের নিউ জার্সিতে খুব সুন্দর ১টা সংসার হলো।গ্লেমাকে আমি ডাকতাম নীলাঞ্জনা। শুধু তার নীল চোখের জন্য নয় বরং সে সবসময় শুধু নীল রঙের ড্রেসই পরতো।

খুব গোছানো মেয়ে ছিল সে। চুপচাপ,ধীর-স্থির।

ভীষণ ভীষণ ভালোবাসতাম আমি ওকে।

তবে আস্তে আস্তে ওর মধ্যে থাকা কিছু অদ্ভুত অদ্ভুত ব্যাপার আমার চোখে পরলো। সেগুলো একাধারে যেমন অদ্ভুত তেমন ভয়ানকও।

যেমন, একদিন রাতে গ্লেমা আর আমি শুয়ে আছি।বাইরে হঠাৎ ঝড় বইতে শুরু করলো। আমি শুয়ে শুয়ে বই পড়ছি।তো,গ্লেমাকে বললাম,জানালাটা বন্ধ করে দাও ,ঝড় আসছে।

আমার হঠাৎ খেয়াল হলো,গ্লেমা জানালাটা বন্ধ করেছে কিন্তু সে ওঠেই নি।

মানে জানালা খাট থেকে খানিকটা দূরে।খাটে বসে নাগাল পাওয়া যায় না। কথা পেইজ 

কিন্তু,গ্লেমা খাট থেকেই জানালা বন্ধ করেছে।

অবশ্য ,এইটা গ্লেমা স্বিকার করলো না।সে বললো,সে খাট থেকে নেমেছে। কিন্তু,বই পড়ার নেশায় আমি খেয়াল করি নি।কে জানে হয়তো তাই।

আরেক টা অদ্ভুত ব্যাপার খেয়াল করলাম,গ্লেমা আমার মা বা অন্য কারো সাথে অডিও কলে কথা বলে।মা যখন ভিডিও কলে আমার সাথে কথা বলে,গ্লেমা তখন ধারে কাছেও থাকে না।

১ দিন আমি বসে বসে এয়ারফোনে গান শুনছি ।আর গ্লেমা আমার ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়ে ফুলদানি পরিষ্কার করছে। তখন,আম্মু ভিডিও কলে আসলো।

কিন্তু,গ্লেমা ব্যাপারটা বুঝে নি বিধায় নড়লো না ওখানে থেকে।

মা,আমাকে জিজ্ঞেস করল,কি লে তোর বউ কই?

আমি বললাম, পিছনেই তো।

মা বললো,কই তোর পিছনে তো কেউ নেই।

আমি ঘুরে তাকিয়ে দেখি গ্লেমা আছে। কিন্তু, ততক্ষণে ও বুঝতে পারল ভিডিও কলে কথা বলছি।

ও দ্রুত সরে গেল।

আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। আসলেই কি ওর মধ্যে প্যারানরমাল কিছু আছে?

আরেক দিন কিচেনে রান্না করতে গিয়ে ওর হাত কেটে গেছে।ও তড়িঘরি করে একটা সাদা রুমাল দিয়ে হাত বাঁধলো।আমি কিচেনে এসে বললাম,আসো এন্টিসেপটিক লাগিয়ে দিই।

আমার কথা শুনে ও ভয়ে এতো টুকু হয়ে গেল।

যেনো আমি খুব ভয়াবহ কিছু বলেছি।

হঠাৎ,ওর হাতের দিকে তাকিয়ে দেখি রুমাল টার বেশ খানিকটা অংশ নীল রঙের হয়ে গেছে।

ও তাড়াতাড়ি হাতটা ওড়নার নিচে লুকিয়ে ফেলল।

আমি অবাক হলাম,কাটা হাতের রক্তে রুমাল লাল হওয়ার কথা, কিন্তু নীল রং এলো কোত্থেকে?

.

.

.

গল্পঃনিল_নয়না

পর্ব:-০১


গল্পঃনিল_নয়না 

পর্ব:-০২


আমি এক প্রকার কনফার্ম হয়েই গেলাম যে গ্লেমার মধ্যে প্যারানরমাল ব্যাপার আছে।তাই, একদিন সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম এ ব্যাপারে। কিন্তু,গ্লেমা অস্বীকার করলো।তার মতে, আমি অকারণেই তাকে নিয়ে সন্দেহ করছি।

আমি গ্লেমাকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার গ্রামের লোক নাকি তোমাকে ১ বার মৃত ভেবে দাফন করে ফেলেছিল?

আমার কথা শুনে,গ্লেমা অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে রইলো।আমি বললাম, তুমি ভিডিও কলে কেন কথা বলতে চাও না?আর তোমার রক্তের রং কি গ্লেমা?

আমার প্রশ্ন শেষ হওয়ার পর,গ্লেমা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।বললো,১ জন এডুকেটেড পার্সন হয়েও তুমি এতো বোকার মতো কথা কিভাবে বলছো? মানুষের রক্তের রং কি আলাদা হয়?আর ভিডিও কলে কথা বলতে আমার আনইজি লাগে।

আর রইলো বাকি দাফনের ব্যাপারটা।তখন আমি অনেক ছোট ছিলাম। আমার মনে নেই কি হয়েছিল।মনে হয় সেন্সলেস হয়েছিলাম।লোকজন ভেবেছে মারা গেছি।

আমি গ্লেমার কথা মেনে নিতে পারলাম না।তার কি করে এতো বড় ঘটনা মনে থাকবে না? তবে, সত্যি বলতে গ্লেমাকে অবিশ্বাস করতেও আমার মন চাইতো না।ভালোবাসি তো তাই!

তবে আমার কপাল খারাপ। অবিশ্বাস করতে না চাইলেও করতে হতো।

একদিন অফিস থেকে বাসায় ফিরছি।তো, সাধারণত বাসার কাছাকাছি আসলে মানুষজন তাদের বাসার দিকে তাকায় এটাই স্বাভাবিক।আমিও আমার বারান্দার দিকে তাকালাম। দেখলাম গ্লেমা ফুলের টব গুলোতে কি যেন করছে।

ও সম্ভবত আমাকে লক্ষ্য করে নি। যাইহোক,এরপর দরজায় নক করলাম কিন্তু ও দরজা খুললো না।প্রায় পনেরো মিনিট টানা নক করার পর দরজা খুলে বললো,সে নাকি ঘুমাচ্ছিল।

আমি অবাক হয়ে গেলাম।তাকে তো আমি আসার সময়ই বারান্দায় দেখলাম।

কি লুকায় ও আমার থেকে?আরো ১টা ব্যাপার খেয়াল করলাম রাত যতই হোক,আমি ওকে ডাকলেই ও সাড়া দেয়।আগে পাত্তা দিই নি। কিন্তু, ইদানীং, আমি ইচ্ছা করেই রাতের বিভিন্ন সময় ওকে খুব আস্তে ডাকি, 'গ্লেমা'...ও সাথে সাথেই বলে ওঠে, হুম কি? আমি বুঝলাম,ও রাতে আসলে ঘুমায়ই না।

বেশ কিছুদিন ধরে এমন করে আমি একদিন সকালে গ্লেমাকে ডিরেক্টলি বললাম,১টা মানুষ কি রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে বাঁচতে পারে বলো?

গ্লেমা হকচকিত হয়ে আমার দিকে তাকায়।বলে,আমি কদিন ধরে অসুস্থ।তাই, ঘুম আসেনা রাত্রে। তুমি অফিসে চলে গেলে আমি বাসায় ঘুমাই।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি অসুস্থ?কই,আমাকে তো কিছু বললে না।চলো ডাক্তারের কাছে যাই।

আমার কথা শুনে গ্লেমার চেহারায় ভয়ের ছাপ ফুটে উঠলো।

সে বললো,সে ঠিক আছে।ডাক্তার লাগবে না।

কিন্তু, আমি নাছোড়বান্দা।ডাক্তারের কাছে তো আমি নিয়ে যাবোই।আমি এর আগেও খেয়াল করেছি ,ও ডাক্তার , হসপিটাল এসব ইগনোর করে চলার চেষ্টা করে।

আমি ভাবলাম, হাসপাতালে অবশ্যই ব্লাড টেস্ট করাবে।আসলেই কি ওর রক্তের রঙ...............সেটা তখন আমি জানবো।

আমারও তো জানার রাইট আছে তার মধ্যে কি প্রবলেম রয়েছে।

গ্লেমা পথ না পেয়ে, কান্নাকাটি শুরু করলো সে কিছুতেই ডাক্তার দেখাবে না।

এর মধ্যে,১ দিন মা ফোন করে কান্নাকাটি করে বলল , আমি যেনো দেশে ফিরে আসি।গ্লেমার সাথে যেন না থাকি।

মা নাকি নিজেই গ্লেমাদের গ্রামের বাড়ি গিয়ে জেনে এসেছে গ্লেমা ১ বার মারা গিয়েছিল।সব লোক তাই বলেছে। কথা পেইজে নেক্স পাবেন

এই ব্যাপারে গ্লেমার বাবার বক্তব্য হলো,এসব মিথ্যা। গ্রামের লোকজন এর সাথে তার শত্রুতা আছে বিধায় তারা বাড়িয়ে বাড়িয়ে মিথ্যা বলে।

গ্লেমাকে আবার ফোর্স করলাম এ ব্যাপারে।গ্লেমা আগের মতোই কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো,তার কিছুই মনে নেই তখনকার কথা।

যাইহোক, অনেক জোরাজুরির পর আমি ওকে নিয়ে হাসপাতালে গেলাম।ব্লাড টেস্ট করানো হলো,আরো কিছু টেস্টও করলো ডাক্তার।আমি তখন মনে মনে অনুতপ্ত হলাম।কত বোকা আমি, ভাবতাম ওর রক্তের রঙ নীল।ছি: এই যুগে এসেও কি চিন্তা ধারা আমার।

ডাক্তার আমাকে আর গ্লেমাকে পৃথিবীর সেরা সুখের সংবাদ টা দিলেন।হ্যাঁ, আমরা বাবা-মা হতে চলেছি।

খুশিতে আমার চোখে পানি চলে আসলো। কিন্তু,গ্লেমা কেমন ভয় পাচ্ছিলো।ডাক্তার বললেন,প্রথম বার মা হওয়ার ক্ষেত্রে ভয়টাই স্বাভাবিক।আমি গ্লেমাকে বুঝালাম।

বাসায় ফিরার পথে গাড়িতে গ্লেমা আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পরলো।কি নিষ্পাপ আর মায়াবীই না লাগছিল ওকে!

কি আছে ওর মধ্যে যা কিনা অদ্ভুত?আমি বোকার মত কত কি ভেবেছি। ও একটু ইন্ট্রোভার্ট তাই হয়তো ছবি,ভিডিও,কোলাহল এসব থেকে দূরে থাকে।এমন তো নয় যে সে কখনো ছবি তোলেনি। বিদেশে আসার সময় তো তুলেছেই। তবুও খালি আমি কতকি ভাবি।

আমি আমার মা, ভাই-বোন দের বুঝালাম ওর মধ্যে আসলেই ভয়ের কিছু নেই।আর খুশির খবরটাও দিলাম সবাইকে।

সবাই ভীষণ খুশি হলো।মা তো আগের কথা নিমেষেই ভুলে গেলো।বললো, তারাতাড়ি ওকে দেশে নিয়ে আয়।এসময় অনেক যত্নের প্রয়োজন।তুই পুরুষ মানুষ,পারবি না।

আমি গ্লেমার ভালোই যত্ন আত্তি করছিলাম।১ দিন রাতে গ্লেমা বললো, আমার ২টা কথা রাখবা তুমি প্লিজ?

আমি বললাম, অবশ্যই।কি কথা?

সে বললো,ওয়ারড্রবের উপরে কুরআন শরীফ আছে।ছুঁয়ে বলো , তুমি রাখবে।

এবার আমি খানিকটা বিচলিত হলাম।কি কথা জানতে চাইলাম।সে বললো,আগে কুরআন শরীফ ছোঁও‌।

অবশেষে,তাই করতে হলো।

গ্লেমা বললো, বাচ্চা হবে এই কারনে তুমি আমাকে দেশে নিয়ে যাবে না।আর,আমাকে হাসপাতালে যাওয়ার কথাও বলবে না। আমার বেবি বাসায়ই হবে।

ওর কথা শুনে আমি হতাশ হলাম। বললাম,প্রথম বাচ্চা।আমরা কিছুই বুঝিনা। বড়দের সাহায্য লাগবে না?ডাক্তার লাগবে না?

সে দৃঢ় ভাবে বললো,না।

অনেক বুঝিয়েও লাভ হলো না।

সে খাওয়া বন্ধ করে দেয়।দেশে কিংবা হাসপাতাল যাওয়ার কথা বললে।

অবশেষে, আমি আর কি করবো, ছুটি নিয়ে বাসায় ওর খেয়াল রাখি।আর ডেলিভারির আগে আগে একজন নার্সও রাখলাম বাসায়।নার্স থাকায় আমি অফিসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।গ্লেমা বললো,এই কদিন আর অফিস যেও না। অফিস তো সারা জীবন ই যেতে পারবে। কিন্তু, আমার সাথে তো আর সারা জীবন থাকতে পারবে না।

ওর কথা শুনে আমি অবাক হই।কি বলে না বলে।বুঝাই , তোমার কিছু হবেনা। বাচ্চা হওয়ার সময় সব মেয়েরাই এসব ভাবে।

গ্লেমা তাও আমাকে অফিস যেতে দিলো না।সারা দিন আমার গা ঘেষে বসে থাকে।এই শরীর নিয়েও আমার জন্য এটা-ওটা রান্না করে।আর উদ্ভট উদ্ভট কথা বলে।

অবশেষে,যেদিন আমাদের বেবি হবে সেদিন গ্লেমা অদ্ভুত আচরণ করতে থাকলো।সে ঘরে দরজা দিয়ে বসে রইলো।নার্সটাকেও ঘরে ঢুকতে দিল না। আমি রেগে গেলাম খুব। নরমাল ডেলিভারিতেও অভিজ্ঞ দের সাহায্য লাগে।ও কি ভাবছে?ও একাই নিজের ভেলিভারি নিজে করবে।এও কি সম্ভব?আমি দরজা ভাঙতে উদ্যত হলাম।ভেতর থেকে গ্লেমা কাতর স্বরে বলল,প্লিজ,আল্লাহর দোহাই লাগে এমন করো না।এমন কান্ড দেখে নার্স বেচারিও হতভম্ব।

একপর্যায়ে,শত টেনশনের মধ্যে হঠাৎ, বাচ্চার কান্নার শব্দ ভেসে আসলো।আমি গ্লেমাকে ডাকলাম ও সাড়া দিলো না।দ্রুত দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে দেখি,ও সেন্সলেস হয়ে আছে।

আমি নার্সের কাছে বাচ্চা রেখে ওকে নিয়ে গাড়িতে উঠলাম। হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।ও তখন খানিকটা চোখ মেললো।সেই সময়ও ,একই কথা বললো,আমাকে হাসপাতালে নিও না প্লিজ।

তুমি কিছু জেনে যাও আমি চাই না।তাহলে হয়তো তুমি আর আমাকে ভালোবাসবে না।এতো শাস্তি দিও না।আমাকে শান্তিতে মরতে দাও প্লিজ।

আমি গাড়ি থামিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। বললাম, তোমার কিছু হবেনা।আমি তো আছি।

ও বললো,আমি হাসপাতালে যেতে চাইনা। তুমি ঠিকই ভাবতে, আমি অন্যদের মতো নই।তবে , আমি যেমনি হই না কেন, আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। 

এর কিছু ক্ষন পরই,ও মারা গেলো।আমিও যে ওকে অনেক ভালোবাসি সেটা আর বলা হলোনা।


গল্পঃনিল_নয়না 

পর্ব:-০৩


গ্লেমা মারা গেছে ১০ বছর হয়েছে।এই ১০ টা বছর আমি ওকে কি পরিমান মিস করেছি তা শুধু আল্লাহ জানেন। শুধু আমাদের মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে বেঁচে থাকা।আমার আর গ্লেমার মেয়ে।অরু।যদিও আমি বাবা হয়েও ওকে আমার কাছে রাখতে পারিনি।গ্লেমা মারা যাওয়ার পর অরুকে নিয়ে যেদিন দেশে আসলাম সেদিন আমার পরিবার অরুকে দেখে ভয় পেয়ে গেলো।বললো,এ এমন কেন?এতো কালো,বাজে দেখতে।তুই কত সুন্দর দেখতে,তোর বউও তো ফর্সা-ই ছিলো।তাহলে এই মেয়ে এমন দেখতে হইছে কেন?

প্রতিবেশী এক আপুকে বলতে শুনেছিলাম, আমার মেয়েকে দেখে সে এতোই ভয় পেয়েছে যে তার নাকি রাত এ ঘুম হবেনা।

ওদের কথা শুনে আমি এত্তো কষ্ট পেয়েছিলাম!

অরু সুন্দর না ঠিকই কিন্তু আমার চোখে তো মনে হয় আমার মেয়ে সবচেয়ে সুন্দর।

আমি কাজ কর্মে বাইরে থাকতাম , জানতামও না অরুর ঠিকমতো খেয়াল রাখা হচ্ছে কিনা। একদিন অফিসে আমি, হঠাৎই ছোট বোন ফোন করে বললো, ভাইয়া তাড়াতাড়ি বাসায় আসো। ভয়ানক বিপদ হয়েছে।

আমি দেরী না করে বাসায় ফিরলাম।এসে দেখি অনেক মানুষজনের ভীড় বাসার সামনে।মায়ের মুখে শুনলাম,অরু নাকি আমাদের পাশের বাসার এক আপুর চোখে কলম ঢুকিয়ে 

দিয়েছে।এখন উনাকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়া হয়েছে।উনি নাকি অরুকে কোলে নিতে চেয়েছিলো।

আমি মনে মনে হাসলাম।উনি তো আমার মেয়েকে পছন্দই করেন না। ভূতের মতো দেখতে বলে খোঁটা দেয়। আবার কোলে কেন নিতে চেয়েছিল?

আমি অরু যেই রুমে সেই রুমে গেলাম। সেখানে আমার বোন বসে আছে। আমাকে দেখে বোন বললো,দেখছো ভাইয়া,এই টুকু মেয়ে কি ডাকাত....

আমি অরুর দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললাম,সাবাস! বাঘের বাচ্চা।

তখন মাত্র ছয়মাস বয়সী অরু খিলখিল করে হেসে উঠলো।যেন সে আমার মনের কথা বুঝতে পেরেছে।

এই ঘটনার পর আরেক রটনা। আমার মেয়ের কাছে নাকি রাত্রে জ্বিন আসে আর তা নাকি আমার বোন নিজের চোখে দেখেছে।আমি বোনকে ধমকালাম। কিন্তু, তখন আমার ভাই উল্টা আমার সাথে ঝগড়া লাগলো।সে নতুন বিয়ে করেছে সবে।তার বউও নাকি আমার মেয়েকে দেখে ভয় পায়।কদিন পর তার বাচ্চা-কাচ্চা হবে।অরুর দ্বারা যদি তাদের কোনো ক্ষতি হয়।

সবাই মেনেই নিয়েছে অরুর মধ্যে খারাপ কিছু আছে।

সবার সাথে যুদ্ধে হেরে গিয়ে আমি অরুকে আমার শ্বশুরের বাসায় রেখে এলাম।আমিও প্রতিদিন ই অরুর সাথে দেখা করতে যাই।ওর এখন ১০ বছর বয়স। ভীষণ বুদ্ধিমতী হয়েছে মেয়েটা।তবে,সবার থেকে একটু আলাদা।একা একা থাকতেই পছন্দ করে।তবে আমার সাথে খুব গল্প করে।আর সারাক্ষন ছবি আঁকে।এতো সুন্দর ১ টা বাচ্চা কিভাবে আঁকে আমি বুঝিনা।

একদিন দেখি বাগানে বসে বসে একা একাই কথা বলছে।আমি জিজ্ঞেস করলাম,কার সাথে কথা বলছো মা?

সে হেসে বলল,মা'র সাথে।

ওর কথা শুনে আমার বুকটা মায়ায় ভরে গেলো।আহা বেচারা!একা একা কথা বলেই নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছে।

আমি ওর মাথায় হাত রেখে বললাম, তোমার মা যদি থাকতো তাহলে তোমাকে অনেক ভালোবাসতো। তোমার সাথে কত গল্প করতো।

অরু বললো, হুম,এখনো করে।

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।

সে বললো, তুমি বিশ্বাস করো না আমার কথা?

দাঁড়াও আমি তোমাকে প্রমাণ দিই।

আমি অবাক হয়ে বললাম,কি প্রমাণ মা?

সে বললো,আমি মাকে দেখে দেখে তার ১টা ছবি এঁকেছি। হুবুহু সেইম হয় নি ,আমি ছোট তো তাই।তবে,দেখে বুঝা যায় এটা মা।

ওর কথা শুনে আমি অবাক হলাম।সত্যিই কি ও এঁকেছে?ও তো ওর মাকে কোনদিন দেখেনি।ছবিতেও নয়।তাহলে ছবি আঁকলো কি করে?তবে কি সত্যি ও গ্লেমাকে দেখে?

আচ্ছা এমনটা হওয়া কি অস্বাভাবিক?কত প্যারানরমাল ঘটনাই তো পৃথিবীতে ঘটে।ভাবতে ভাবতে আমার হার্টবিট বেড়ে গেলো।

ততক্ষণে আমার মেয়ে ঘর থেকে তার আর্টের খাতা নিয়ে এসেছে।আমি তার আঁকা নারী অবয়বটার দিকে তাকিয়ে রইলাম।কালো রঙের ১টা মেয়ে।চোখ গুলো কেমন অদ্ভুত ভয়ঙ্কর। আমি বেশি ক্ষন তাকাতে পারলাম না।

বললাম,মা এটা কি এঁকেছো তুমি? তোমার মা এমন দেখতে ছিল না।ও অনেক সুন্দর ছিল।

আমার কথা শুনে অরু হাসলো,যেন আমি ভুল বলছি।

ওর খাতায় দেখলাম এই মহিলার আরো অনেক ছবি আঁকা।তবে অদ্ভুত ব্যাপার হলো,সব ছবিতেই ও নীল শাড়ি এঁকেছে। আচ্ছা, আমি কি ওকে বলেছিলাম যে ওর মা নীল পছন্দ করতো। বলেছিলাম হয়তো।

আমার মা আমার জন্য মেয়ে দেখছেন।আগেও দেখেছেন। যদিও আমি মানা করেছি তবুও।অরুও ইদানীং তার দাদীর মতো আমাকে খালি ফোর্স করছে একটা নতুন মা এনে দেয়ার জন্য। যদিও তাকে এসব তার দাদীই শিখিয়েছে।আসলে মা তো তাই আমাকে সুখী দেখতে চায়।ভাবে ২য় বার বিয়ে করলে আমি খুব সুখী হবো। কথা পেইজ

অবশেষে,২ মায়ের আবদারের কাছে হার মেনে গেলাম সেই মেয়ের সাথে দেখা করতে।যাওয়ার সময় আমার অরুর স্কুল পরে।তাই, ভাবলাম অরুকেও স্কুল থেকে নিয়ে যাই আমার সাথে।যেই ভাবা সেই কাজ।

আমাকে আর অরুকে দেখে পাত্রী খানিকটা ভড়কে গেলো।

আমি বললাম,আসলে আমি তো আর একা নই। আমার সাথে বিয়ে হলে আপনাকে ইন্সট্যান্ট মা হতে হবে।তাই, মেয়েকে নিয়ে আসলাম।

আগেই বলেছি অরু অন্য বাচ্চাদের মতো নয়।সে একটু বেশি ই বুঝের।আমরা কথা বলছি দেখে সে হেঁটে দূরে সরে গেল।

অরু কে মনে হয় পাত্রীর বিশেষ পছন্দ হয়নি।সে কেমন ভ্রূ কুঁচকে অরুর দিকে দেখছিলো।

তার এই চাহনিতে আমি ভীষণ কষ্ট পেলাম। বললাম, আমার মা দেখতে সুন্দর না হলে কি হবে ওর অনেক গুণ।

সেই মেয়ে আমার কথা শুনে শুকনো ধরনের হাসি দিল।

সেই হাসি দেখে আমার গা জ্বলে গেল।মন চাইলো এক্ষুনি বলি, আপনার মতো থার্ডক্লাস মেয়ে কে আমি মরে গেলেও বিয়ে করবো না। কিন্তু,নিজেকে আটকালাম।মেয়েটা তো আর সরাসরি কিছু বলেনি তাইনা।

ফিরার পথে গাড়িতে অরু বললো,আন্টিটা অনেক সুন্দর ছিল তাই না বাবা?

আমি বললাম,হু বলছে তোমাকে। শাকচুন্নীর মতো লাগছিল।আর চয়েস কি খারাপ,কি ক্যাটকেটে রঙের ড্রেস পরে এসেছে দেখছো?

হঠাৎ অরু মুখ টিপে হেসে বলল, কেন তুমি কি আশা করেছিলে নীল রঙের পরবে?

আমি অরুর দিকে তাকিয়ে রইলাম।ও মাঝে মাঝে আমাকে অবাক করে দেয়।

অরু খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললো,বাবা ১ টা গল্প শুনাও।

আমি বললাম,আজকে তুই শোনা।আমি তো রোজই শোনাই।

সে বললো, আমার গল্প তোমার ভাল্লাগবে না।

আমি বললাম,লাগবে খুব।বল।

অরু বলতে শুরু করল,জানো বাবা আমার ক্লাসমেট রা আমাকে নিগ্রো ডাকে।আমার গায়ের রং নিগ্রো দের মতো কালো, ঠোঁট মোটা, চোখ ছোট আবার চুলও কোঁকড়ানো তো তাই।এতে কিন্তু আমার নিজের জন্য খারাপ লাগে না।বরং ওদের জন্য খারাপ লাগে।ওরা কত বোকা,বাহিরটা দেখেই মানুষ কে সুন্দর-অসুন্দর বলে সংজ্ঞায়িত করে ফেলে।এই বোকামি দেখে খারাপ লাগে। মোটকথা, আমাকে আল্লাহ খুশি হয়ে যেভাবে বানিয়েছে আমি সেভাবেই খুশী। কিন্তু,১ টা মেয়ে ছিল জানো আমারই মতো সমাজের চোখে অসুন্দর।সে এর জন্য অনেক কষ্ট পেতো।অবশ্য তারও দোষ নেই।তার গ্রামের লোকেরা তাকে নিয়ে নানান কথা বলতো।ছোট থেকেই সে শুনছো তাকে কেউ বিয়ে করবে না। বাবা-মায়ের বোঝা।এসব শুনতে শুনতে সে কিশোরী বয়সেই একবার সুইসাইড এর চেষ্টা করে।তারপর,

অরু দীর্ঘ শ্বাস ফেললো।বললো,ক্লান্ত লাগছে। অন্য কখনো বলবো।

আমি বললাম,কি সব গল্প যে তুই বলিস।মিনিংলেস। সৌন্দর্য শুধু অভ্যন্তরীন হয়।বাহ্যিক সৌন্দর্যের কোন দাম নেই।১ দিন তো চামড়া ঝুলে যাবেই।

অরু হঠাৎ তার ব্যাগ থেকে তার আর্টের খাতা টা বের করলো।একটা ছবি দেখালো আমায়।ও গ্লেমার ছবি এঁকেছে।একদম হুবুহু গ্লেমা।দুধে আলতা গায়ের রং। নীল চোখ। আমার বুকটা ধ্বক করে উঠলো। কতদিন পর দেখলাম আমার নীলাঞ্জনা কে। কিন্তু,অরু তো ওকে দেখে নি।তবে কিভাবে আঁকলো? সেই প্রশ্ন করার আগেই অরু বললো,বাবা তুমি মাকে অনেক ভালোবাসো তাই না?

আমি বললাম,হ্যাঁ , অনেক।

অরু তার আঁকা ছবিটা দেখিয়ে বললো,এমন সুন্দর দেখতে বলে ভালোবাসো?যদি এমন না হতো,১ বার এর আগে যে এঁকেছিলাম ১ টা ছবি ওরকম যদি দেখতে হতো তবে ভালোবাসতে?


গল্পঃনিল_নয়না 

পর্ব:-০৪ এবং শেষ। 


অরুও ওর মায়ের মতোই হয়েছে।যাকে কাছ থেকে দেখেও  

বুঝা যায় না। শুধু এতোটুকুই বুঝা যায় ওর মধ্যে এমন কিছু আছে যা অন্যদের মধ্যে নেই।আমার খুব কৌতুহল হয়।কি ব্যাপার গ্লেমা আমার থেকে লুকাতো?আর অরুও কি কিছু লুকায়?

আমি এক ছুটির দিনে অরুর মাথায় হাত রেখে বললাম,মা তুই অনেক ব্রিলিয়ান্ট।তুই আমার থেকেও বেশি জানিস।

অরু হেসে বললো,কি যে বাবা তুমি বলো না....

আমি বললাম, অরু, আমি তো তোর বাবা।আমাকে কি সবকিছু শেয়ার করা যায় না?

অরু খানিকক্ষণ গম্ভীর হয়ে থেকে বললো,বেশ কি জানতে চাও বলো।আমি যদি তোমার প্রশ্নের উত্তর জেনে থাকি তাহলে অবশ্যই বলবো।

আমি বললাম, আমার মনে হয় তোর মায়ের মধ্যে প্যারানরমাল কিছু ছিল।

অরু হেসে বললো,কেনো তোমার এমন মনে হয়?

আমি সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললাম, আচ্ছা কোনো মানুষের রক্ত কি নীল রঙের হতে পারে?

অরু এবার শব্দ করে হেসে উঠলো।বললো,বাবা আমার বয়স মাত্র দশ। তুমি আমাকে এতো সিরিয়াসলি জিজ্ঞেস করছো মনে হচ্ছে আমি যেনো মহাপন্ডিত।

আমি অরুর দিকে আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।

ও আমার করুন দৃষ্টি দেখে বললো, মানুষের রক্তে আয়রন থাকার কারণে রক্ত লাল হয়। এখন কারো রক্তে যদি আয়রনের পরিবর্তে কপার থাকে তাহলে তার রক্ত নীল হবে।

আমি বললাম,তোর মায়ের শরীরে কি কপার ছিল?

অরু বললো,আমি সেসব কিভাবে জানবো?আমি তো যাস্ট বইয়ে পড়েছি তাই বললাম।আর মানুষের শরীরে কি কপার থাকা সম্ভব?কপার থাকলে তো মানুষ আর মানুষ থাকবে না বিষমানব হয়ে যাবে। স্বাভাবিকের বাইরে কোনো কিছু থাকা মানেই বিষাক্ততা।

আমি বললাম,তুই আমাকে বলবি না তাইনা অরু?আমি ১০ টা বছর ধরে বুঝতে চাইছি কিন্তু তুই আমাকে বুঝতে দিবি না ?

আমার আর অরুর কথার মধ্যে হঠাৎ আমার মা কল করলো।

মা জানালো,যেই পাত্রীকে দেখে এসেছিলাম আমি আর অরু মিলে তারা রাজি হয়েছে।

আমি বললাম,রাজি হলেই বা কি আমি তো রাজি হইনি।

মা আমাকে বারবার বুঝাতে লাগলো।

আমিই বা কিভাবে মা'কে বুঝাই সম্পর্কে জড়ানো আর সেটা কনটিনিউ করা তো এক না।

আমার সাথে না পেরে মা অরুর সরণাপন্ন হলো।

অরু এবার আমাকে পুরোদমে রাজি করানোর চেষ্টা করতে লাগলো।

সে বললো,কেন তুমি রাজি হচ্ছো না?আমার জন্য?আমি কি সারাজীবন তোমার সাথে থাকবো? তোমার ভাই , বোন সবার সংসার আছে। তোমার নেই। তোমার যখন বয়স বাড়বে তখন তোমাকে কে দেখবে? তোমার তো বাঁচার কোনো অবলম্বনই নাই।

আমি বললাম,তুই আছিস।তুই দেখবি ফিউচারে আমাকে। কথা পেইজ

অরু বললো, আমি কিভাবে দেখবো?আমি তো থাকবো না বেশিদিন।

আমার বুক কেঁপে উঠলো।কি বলে এই মেয়ে এইসব?

মনে পরে গেল,গ্লেমাও এরকম বলতো।

আমি জিজ্ঞেস করলাম,তুই থাকবি না মানে কি?কেন এমন বলিস তোরা মা-মেয়ে?আমাকে পেইন দিয়ে কি লাভ?বল....

অরু বললো,বাবা তুমি জানতে চাও তো,কি অস্বাভাবিক ব্যাপার মায়ের মধ্যে ছিল , আবার আমার মধ্যেও আছে তাই না?

আমি বললাম,হ্যাঁ।

অরু বললো,তবে কথা দাও তুমি দাদির কথা শুনবে।

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।

অরু বললো,তোমাকে কথা দিতেই হবে।

আমি রাজি হলাম।

অরু বললো, আমি যখন ছোট ছিলাম তখন কেউ আমাকে যত্ন করতো না।যতটা আমার মনে পরে। তুমি অফিসে থাকতে আর।সবাই আমাকে দূরে সরিয়ে রাখতো। তখন আমি দেখতাম কেউ ১ জন আমাকে রোজ সঙ্গ দেয়।আমাকে হাসায়। আমার সাথে খেলে।ধীরে ধীরে বুঝলাম,তাকে শুধু আমিই দেখি।তার পরনে থাকতো নীল শাড়ি।সে বিশেষ সুন্দর ছিল না। কিন্তু, হঠাৎ হঠাৎ সে বদলে যেতো। চেহারা পাল্টে যেতো।আমি কিছু ই বুঝতাম না।তবে এখন আর আমি তাকে দেখিনা।

নানা তোমাকে জানায়নি। কিন্তু,আমাকে সাইক্রিয়ারটিস্ট দেখিয়েছেন।সাইক্রিয়ারটিস্টের মতে আমি স্কিজোফ্রেনিয়ার প্রাথমিক স্তরে আছি।তাই,এসব উদ্ভট জিনিস কল্পনা করি। তিনি আমাকে ওষুধ দিয়েছেন।আর আমি ঠিক হয়ে গেছি। কাহিনী শেষ।

আমি বললাম,তুই তোর মা'র ছবি হুবুহু এঁকেছিস কিভাবে?

ও বললো,মায়ের পাসপোর্টের ছবি দেখে আইডিয়া করে এঁকেছি।

আমি বললাম,তাহলে প্রথমে কার ছবি এঁকে বলেছিলি এটা তোর মা?

অরু হেসে উঠলো।বললো,আরে বাবা ঐটা আমার কল্পনাবন্ধু।যাকে আমি ছোট বেলায় দেখতাম। তার ছবি আঁকছি। আমার মনে হয়েছিল আমার মাও বুঝি এমন ই হবে।

আমি জানি অরু আমাকে মিথ্যা বলছে। তবুও জিজ্ঞেস করলাম,তোর মা অন্যরকম ছিল কেন?

অরু বললো, আমি তোমাকে ১ টা বাস্তব কাহিনী বলি শোনো।এটা আমাদের মিস ক্লাসে বলেছেন।আরো অনেক অনেক বছর আগে আমেরিকার ফার্গো শহরে ১ কুৎসিত তরুণী ছিল।সে সবসময় প্রার্থনা করতো যেন সে সুন্দরী হয়ে যায়। একদিন সত্যি সত্যি সে ঘুম থেকে উঠে দেখলো সে চেঞ্জ হয়ে গেছে। অনেক সুন্দর হয়ে গেছে। কিন্তু, তার পরিবার মানতে পারলো না এটা সে। তখন তো আর প্লাস্টিক সার্জারি ও ছিলনা। কিন্তু, অনেক পুরানো কথা, সিক্রেট বলে টলে সে পরিবার কে কনভিন্স করতে পারলো। যদিও পাড়া প্রতিবেশী রা মানেনি ব্যাপারটা। কিন্তু,মেয়েটা দারুন খুশি হলো। কিন্তু,আস্তে আস্তে সে অনুভব করলো,তার মধ্যে চেহারা ছাড়াও আরো অনেক পরিবর্তন চলে এসেছে। আধ্যাত্মিক ক্ষমতা যাকে বলে। আবার সে যখন খুব বেশি ব্যাথা পায় তখন তার আগের চেহারায় ফিরে যায়।

আমি অরুকে বললাম,তোর বানানো কাহিনী অফ করতো।

অরু হেসে বললো,বাবা আমার কি মনে হয় জানো মাও বেশি যন্ত্রনা পেলে আগের রূপে ফিরে যেতো।তাই,মনে হয় আমি হওয়ার সময় দরজা বন্ধ করে রেখেছিল।যাতে তুমি তার আসল রূপ না দেখো। তার হয়তো ধারণা ছিল,তাকে ওভাবে দেখলে তুমি আর তাকে ভালোবাসবে না।প্রতারক ভাববে।

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,কি আসল রূপ,নকল রূপ বলছিস?কিছুই তো বুঝতে পারছি না।আর আসল রূপ,নকল রূপ এসব তোর মায়ের মধ্যে আসবেই বা কেন?

অরু বললো,মনে হয় মা এমন কিছুর সাহায্য নিয়েছিল সুন্দর হতে।

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, কিসের সাহায্য?

অরু বললো,বাবা বর্তমানে মানুষ চাঁদে পা রেখেছে এই যুগে প্যারানরমাল ব্যাপার কেউ বিশ্বাস করেনা। তাদের কাছে হাস্যকর লাগে। কিন্তু, তবুও সত্যি এটাই যে প্রকৃতি রহস্য পছন্দ করে।তাই, হাজার হাজার প্যারানরমাল ঘটনা চারপাশে। ওগুলো আমরা বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করি। কিন্তু, আসলেই কি পুরোপুরি ব্যাখ্যা করতে পারি?

আমি বললাম,এসব কথা ছাড়।আমি বিশ্বাস করবো তুই যা বলবি।বল তোর মা কিসের সাহায্য নিয়েছিল যে সে বদলে গেল?

অরু বললো,আমি যদি বলি নাল কাঁকড়ার,তবে বিশ্বাস করবে?

আমি অবাক হয়ে বললাম,কিহ?

অরু বললো, হুম।আমাকে মা বলেছে সে যখন তেরো বছর বয়সী তখন সে রাগ করে নাল কাঁকড়ার বিষাক্ত অংশ টা খেয়ে ফেলেছিল।এরপর শ্বাসকষ্ট উঠে সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিল। লোক জন দেখলো সে মারা গেছে। কিন্তু,আসলে তা নয়।এর পরবর্তী সময়ে হঠাৎ করে সে আস্তে আস্তে অন্যরকম হয়ে যেতে লাগলো।আর জানো বাবা,এই প্রাণীর রক্তও নীল। 

আমি অরুর কথা শুনে না রেগে পারলাম না। বললাম,তো?তাতে কি? মানুষ তো কাঁকড়া খায়ই। আর তোমার মা এই কাঁকড়া কই পেলো?

সে বললো,সেটা তো তাকে তার মা বলেনি।

আমি নিজেই পরবর্তী সময়ে,অরুকে ডাক্তার দেখালাম।

ডাক্তার বললো,এসবই বিক্ষিপ্ত মনের চিন্তা ভাবনা। কল্পনায় সে তার মাকে ভেবেছে।

আমিও ডাক্তারের কথাই মেনে নিলাম।

পরবর্তী তে সবার কথায় বিয়েটাও করতে হলো।যার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে সে আসলে ততোটাও খারাপ নয়।

অরু কে যথেষ্ট ভালো বাসে। যদিও অরু আমাদের সাথে থাকেনা। অরুকে আমি এখনো যথেষ্ট সময় দেই।সব মিলিয়ে আমরা ভালো আছি।

পরিশিষ্ট:-অরুর বাবার মতো অরুও মানতে চায় সে যে ছোট বেলায় তার মাকে দেখতো সেই সবটাই তার সাবকনসিয়াস মাইন্ডের কল্পনা। কিন্তু,এটা সে ভাবতে পারে না।কারন,সে দেখেছে তার রক্তের রঙ ও ইদানিং নীলচে হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু,কেন? তার মা অস্বাভাবিক ছিল তাই কিছুটা অস্বাভাবিক সন্তান জন্ম দিয়েছে। কিন্তু,প্রকৃতিতে অস্বাভাবিক রা বেশি দিন টিকে থাকতে পারে না। কারন, প্রকৃতি স্বাভাবিক নিয়মে চলে।

তাই,অরু বুঝতে পারে অরু বেশিদিন বাঁচতে পারবে না।তাইতো,অরু চাইতো তার বাবা সুখী হোক। নতুন জীবন শুরু করুক।কোনো অস্বাভাবিকতার মায়ায় আটকে না থাকুক।


    সমাপ্ত


পর্বের আরও অনেক গল্প পড়ুন।