অবহেলার কষ্টের গল্প | স্বামীর প্রতি স্ত্রীর অবহেলার গল্প

স্ত্রীর প্রতি স্বামীর অবহেলা

স্ত্রীর প্রতি স্বামীর অবহেলা

 স্বামীর প্রেমিকার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে অপরাজিতা । তার রাগ, দুঃখ কিংবা মান-অপমান কিছুই বোধ হচ্ছে না। এমন একটা মানসিক অবস্থা তৈরি করতে যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করতে হয়েছে। এখন নিজের কাছেই নিজের খুব আশ্চর্য লাগছে। মন ক্ষত বিক্ষত হতে হতে এখন দুঃখ পেতে ভুলে গেছে। নিজের স্বামী অন্য কাউকে ভালোবাসে এই খবর জেনে স্বাভাবিক ভাবেই তার অসম্ভব কষ্ট লেগেছিলো। এখন মনে হচ্ছে সে কোন প্রিয়জনের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে! খুব শান্ত ভঙ্গিতেই কলিং বেলের সুইচের উপর আঙ্গুল চালিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো সে।


সায়রা দরজা খুলে অসম্ভব রুপবতী একজন মহিলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটু হকচকিয়ে গেলো , এমন সৌন্দর্য থেকে সহজে চোখ ফেরানো যায় না। কিন্তু এই সুন্দরী মহিলাকে সে চেনে না, বুয়া এসেছে ভেবে না দেখেই দরজা খুলে দিয়েছে সে। একজন নারীর সৌন্দর্য আরেকজন নারীকে এভাবে বিমোহিত করতে পারে!  এই মহিলাকে না দেখলে সায়রা কখনোই বিশ্বাস করতো না। এত হালকা প্রশাধন, সুতি শাড়ি, হালকা অর্নামেন্টসেও এতটা অপূর্ব লাগছে! তার ধাতস্থ হতে কিছুটা সময় লাগলো।

নিজেকে সামলে জিজ্ঞেস করলো- 

---কাকে চান?

---মিস সায়রাকে।

---আমিই সায়রা। বলুন কি দরকার?

---কোন দরকার নেই শুধু দেখতে এসেছি তোমাকে। তোমাকে তুমি করেই বলছি। আমার থেকে বয়সে অনেক ছোট হবে তুমি, কিছু মনে করলে না তো?

---না। কিছু মনে করবেন না, আমি কিন্তু এখনো আপনাকে চিনতে পারিনি।

---আমি অপরাজিতা। কি চিনতে পেরেছ?

---না এখনো চিনতে পারিনি।

---শাহেদ আমার নামটা ভুল করেও কখনো তোমার সামনে উচ্চারণ করেনি তাহলে!


শাহেদের নামটা শুনেই সায়রার বুকটা ধক্ করে উঠলো।


---এবার নিশ্চয় চিনতে পেরেছ? কি আশ্চর্য দেখ আমাদের মেয়েদের নিজেদের নামটা পর্যন্ত এক সময় মুছে যায় কেউ আর নামে চিনে না। কেউ চিনে স্বামীর নামে, কেউ চিনে সন্তানের নামে, কেউ চিনে নাতি- নাতনির নামে। একটা সুন্দর নাম ছিলো কখনো, সেটা চাপা পরে যায় সম্পর্কের আড়ালে।

আমি কি বাইরে দাঁড়িয়েই কথা বলবো নাকি ভেতরে আসতে বলবে?


কোন কথা না বলে সায়রা দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো। এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলাও ঠিক না , প্রতিবেশীদের কানে কথা গেলে ঝামেলা হতে পারে।


চারদিকে তাকিয়ে অপরাজিতা বললো-

---খুব সুন্দর সাজিয়েছ।

---আপনি এখানে কেন এসেছেন?

---তোমাকে দেখতে।

কয়েকদিন থেকেই ভাবছিলাম আমার হাসবেন্ড যাকে দেখে আমাকে ভুলে গেলো, আমার পনের বছরের সংসার ভুলে গেলো দুই সন্তানকে ভুলে গেলো সে নিশ্চয়ই অনেক স্পেশাল কেউ। তাই তো তোমাকে দেখতে এলাম।

---সব কিছুর জন্য কি আপনি আমাকে দায়ী ভাবছেন? আমি আপনার স্বামীকে কেড়ে নিয়েছি? আপনি আমার বিচার করতে এসেছেন?

---মোটেও না মোটেও না। সত্যটা হলো মানুষকে কেউ কেড়ে নিতে পারে না যদি না সে নিজেকে কেড়ে নিতে দেয়। আমি খুবই কিউরিয়াস ছিলাম তোমাকে দেখার জন্য, সেই জন্যই আসা।

আর বিচারের কথা বলছ-মানুষ মানুষের বিচার করলে তো শাস্তি যথাযথ হয় না, কম হয়ে যায়। বিচার দায়িত্ব দিতে হয় উপরওয়ালার কাছে, যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন।


সায়রা একটু ভয় পেয়ে গেলো।সে নিজের অজান্তেই একটা ঢোক গিলল। 

শাহেদের ছেলে-মেয়ের ছবি সায়রা দেখেছে কিন্তু কখনো স্ত্রীর ছবি দেখায়নি। এত সুন্দর যার স্ত্রী সে কিভাবে তার মতো মেয়ের সাথে জড়িয়েছে? 


---শোন কারো বাহিরগামী, দ্বিগামী হতে কোন কিছুর অভাব লাগে না, কোন কারণও লাগে না যেমন- কেউ অসুন্দর বলে -নাকি  বয়স হয়েছে বলে- নাকি অনস্মার্ট বলে, নাকি বাচ্চা হয় না বলে, নাকি ছেলে নেই বলে? 

আমাকে কোন ক্যাটাগরিতে ফেলবে? এগুলোর কোনটাতেই ফেলতে পারবে না, তাহলে শাহেদ কেন তোমার দুয়ারে আসে? তুমিই কেন ওকে দরজা খুলে দাও? আসলে যে এত সহজে অন্যের হয়ে যায় আমি মনে করি সে কখনো আমার ছিলোই না। বাইরের তাড়নাই তাকে ধাবিত করে বেরিয়েছে চিরকাল, হয়তো শুধুই ছিলো একটা সময়ের অপেক্ষায়!


সায়রা চমকে গেলো অপরাজিতার কথা শুনে, সে মনে মনে এই কথা ভাবছে সেটা সে জানলো কিভাবে?

এত সুন্দর করে কথা বলছে অপরাজিতা , শুনতেই ইচ্ছে করে। সায়রা ভাবলো শাহেদকে কল করে সব কিছু জানানো দরকার তাই উঠে ভেতরে যেতে চাইলে

অপরাজিতা বলল-

---শাহেদকে জানাতে চাইছ? কিন্তু কি লাভ ওকে জানিয়ে? আর আমি কি তোমাকে কিছু করতে এসেছি তাহলে এত ভয় পাচ্ছ কেন? আর যদি কিছু করতেও চাই, শাহেদ এত দূর থেকে এসে তোমাকে বাঁচাতে পারবে?

তুমি দেখি সত্যিই ভয় পেয়েছ!ভয় পেয়ো না আমি তোমাকে কিছুই করবো না।

---বলেছিলেন আমাকে দেখতে এসেছেন, দেখা তো হয়েছে এবার চলে যান।

---কি বল এই সব, কেউ বাসায় আসলে এভাবে তাড়িয়ে দিতে হয়? আমার শ্বশুর বাড়ির আত্মীয় স্বজন কিন্তু অনেক।তারা সব সময় আমার বাসায় আসে তারা যত দিন ইচ্ছে থাকে। তাদেরকে তুমি এভাবে চলে যেতে বলতে পারবে?

---তারা আমার কাছে আসবে কেন?

---কি আশ্চর্য! শাহেদ যেখানে থাকবে তারা তো সেখানেই আসবে। সম্পর্কটা শাহেদকে ঘিরে। আমার সাথে শাহেদের সম্পর্ক না থাকলে আমার কাছে কেন যাবে? তবে আমার শাশুড়ি নাকি কিছুতেই আমাকে ছেড়ে থাকবেন না। তাঁর ছেলের সাথে সম্পর্কও রাখবেন না। দেখো তো এটা কোন কথা হলো?


অপরাজিতার মোবাইল বেজে উঠলে রিসিভ করলো-

---হ্যাঁ মা বল, উকিল সাহেব আসছে?ও আচ্ছা। ডিভোর্স পেপার নিয়ে আসছে? আচ্ছা ঠিক আছে। মা তোমার নাতি-নাতনিদের কি মন খারাপ, ওরা কি বলে? আমিও সেটাই আশা করেছিলাম। শুধু শুধু কেন মন খারাপ করবে আর কার জন্যই বা মন খারাপ করবে? ওদের যখন ইচ্ছা বাবার সাথে দেখা করবে। মা শোন, এর মাঝে তোমার ছেলে বাসায় আসলে তাকে বলো ডিভোর্স পেপারে সাইন করে বাসা থেকে বের হতে। আমি এসে সাইন করবো।

আচ্ছা মা আমি একটু অফিস হয়ে আসবো। কয়েকদিন যাওয়া হয়নি।

হু জানি তো, শক্ত হাতে না ধরলে ব্যবসা লাটে উঠবে।

হু , এখন থেকে আর এমন হবে না, বিজনেসে সম্পূর্ণ মনোযোগ দেবো।

মা, কোন চিন্তা করছি না, জানি তো তুমি আমার পাশে আছ।

আচ্ছা এবার তাহলে রাখি। 


সায়না মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলো কথাগুলো। অপরাজিতা তার শাশুড়ির সাথে কথা বলল এতক্ষণ। তার মানে সব কিছুর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে তারা। 


---তো সায়না তোমার রাস্তা ক্লিয়ার। এবার তোমরা বিয়ে করতে পার।

---আপনার কষ্ট হচ্ছে না। এত দিনের সংসার ভেঙ্গে যাচ্ছে?

---কষ্ট হয়েছিলো প্রথমে এখন হচ্ছে না। তবে একেবারেই যে হচ্ছে না তা নয় , সহ্য করা যাচ্ছে। আসলে যে কোন দুঃখ যখন হঠাৎ সামনে আসে তখন মানুষ বেদিশা হয়ে যায়। মনে করে এই দুঃখ সহ্য করা সম্ভব না কিন্তু এক সময় সেটাও সয়ে যায়। আসলে এই পৃথিবীতে কারো জন্য কিছুই আটকে থাকে না, জীবন চলতেই থাকে নিজস্ব নিয়মে। আর দুঃখ করে কি লাভ? 


---আমি আবারো বলছি এখানে আমার কোন দোষ নেই। শাহেদই আমাকে প্রথমে প্রোপোজ করেছে, আমাকে ভালোবেসেছে। সে যদি আমাকে ভালোবাসে তাহলে আমার দোষ কোথায়?

---একদম ঠিক বলেছ। তুমি ভাত ছিটিয়ে রেখেছ , তোমার হাঁড়িতে ছিটানোর মতো যথেষ্ট ভাত আছে এতে করে যদি কাক আসে কিংবা কাক ঘরে ঢুকে ভাতের হাঁড়িতে মুখ দেয় তাতে তোমার দোষ কোথায়?

---মানে কি?

---তুমি জানতে না শাহেদ ম্যারিড তার দুই বাচ্চা আছে? নাকি ভেবেছিলে এত দিনেও সে বিয়ে করেনি? 

সায়না কিছু বলে না, আসলে বলার মতো কোন কথা খুঁজে পায় না।

---একটা মেয়েকে সৃষ্টিকর্তা অবর্ননীয় গুণাবলী দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। জ্ঞান হবার পর থেকে একটা পুরুষের তাকানো, টাচ করাতেই বুঝতে পারে সব কিছু। অমানুষের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্যই এই ক্ষমতা সৃষ্টি কর্তা প্রদত্ত। একটা মেয়ে প্রশ্রয় না দিলে কখনো একটা পুরুষ এগিয়ে আসার সাহস করতে পারে না। ক্ষেত্রবিশেষে খুব অল্প সংখ্যক মানুষ রুপি হায়েনা থাকে সেটা অন্য প্রসঙ্গ। আমার কথা হচ্ছে শাহেদ তোমাকে পছন্দ করে সেটার জন্য তোমাকেও ঝুলে পড়তে হবে? শাহেদের টাকা, বাড়ি, গাড়ি সব আছে আর কি চাই? কিছু মেয়ে তো এই জন্যই হা করে বসে থাকে কখন এমন একজনকে বাগে আনতে পারবে। এমন মেয়েরা ছলনা, রং ঢং খুব পারে। 

এই দেখ তোমার মতো মেয়েদের কথাই শুধু বলছি। শাহেদের মতো পুরুষ কম বেশি সব জায়গায় আছে কিন্তু মেয়েরা ইচ্ছে করলেই নিজেকে বাঁচিয়ে চলতে পারে যদি ইচ্ছা করে। যদি বেশি বাড়াবাড়ি করে সবাইকে নিয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা ও নিতে পারে শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারে। 

আচ্ছা যাই হোক এই অবস্থায় তোমার কিংবা শাহেদের কারো কানেই ন্যায় অন্যায় ভালো মন্দ কোন যুক্তি ঢুকবে না। এখন তোমরা আছ অন্য জগতে মত্ত হয়ে ।

তবে একটা কথা শোন - যার কাছে এত বছরের সংসার কিছুই না তার কাছে আশা করো না  তোমাকে নিয়েই পরে থাকবে। ওকে তো ভালো ভাবেই চিনি।

দীর্ঘশ্বাস টা খুব সাবধানে গোপন করলো অপরাজিতা।

---আমার এখন যাওয়া উচিত, তোমার অনেক মুল্যবান সময় নষ্ট করলাম।


অপরাজিতার মুখে কোন কষ্টের ছাপ নেই। বরং তাকে যেন এই মুহূর্তে ঝরঝরে লাগছে।


সায়রা বলল-

---আমাকে এত কিছু বললেন, শাহেদকে কিছু বলার সাহস নেই?

---তোমাকে তো কিছুই বললাম না। যদি সত্যিই তোমার সত্যিটা তোমাকে শুনাই, সহ্য করার মতো শক্তি আছে আর শাহেদের কথা বলছো, ওর সাথে সব হিসেব নিকেশ শেষ। ফ্যামিলির সবার সাথেই ওর হিসেব শেষ। এখন ও কিছুই বুঝতে পারছে না , যখন বুঝতে পারবে - সব কিছু থেকেও তার কিছুই নেই মাঝখানে একটা ঘৃণার দেয়াল উঠে গেছে শত চেষ্টা করেও যখন সেটা ভাঙ্গতে পারবে না তখন বুঝবে সর্বোচ্চ শাস্তিটাই তাকে যত্ন করে দেয়া হয়েছে। আর আমি তোমার কোন বিচার করতে আসিনি, শাস্তিও দিতে আসিনি।


সায়রা রাগে কাঁপতে লাগলো।

 কিছুক্ষণ চুপ থেকে সে বলল-

---শাহেদ যদি আবার আপনার কাছে ফেরত যায়?


---একদিন না একদিন তো সে ফিরে আসবেই এটা আমার বিশ্বাস। আসবে সন্তানদের বাবা হয়ে, মায়ের ছেলে হয়ে কিন্তু আমার স্বামী হয়ে ফেরত আসতে পারবেনা কোনদিন ।


লিফটে না উঠে সিঁড়ি দিয়ে নামছে অপরাজিতা। সুখের  সময় খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায় কিন্তু কষ্টের কখনো শেষ হয় না সেটা হয় দীর্ঘ আর অন্ধকার। তার কষ্ট হচ্ছে, খুব কষ্ট হচ্ছে, কষ্টে নীল হয়ে যাচ্ছে অপরাজিতা।


 কারো পায়ের আওয়াজ পেতেই অপরাজিতা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো শাহেদ আসছে। ওর ঠিক পাশে এসেই দাঁড়ালো ছাদের রেলিং ধরে। অপরাজিতা নিজের মনেই কফির মগে চুমুক দিতে লাগলো। যেন ওর পাশে কোন মানুষ নেই এমন মনোভাব নিয়েই সে সামনে তাকিয়ে রইলো। আজকের আকাশটা একটু আগেও অসম্ভব সুন্দর লাগছিলো কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এতটাও সুন্দর না যতটা সে ভেবেছিলো।আসলে অপছন্দের মানুষের জন্য সুন্দরও অসুন্দর হয়ে উঠে।

একটা মানুষের জন্য কারো জীবন থেমে থাকে না কিন্তু অনেকগুলো জীবনকে এলোমেলো করে দিতে একটা মানুষই যথেষ্ট।


 সায়রার বাসা থেকে যেদিন বের হয়ে এসেছিলো মনে পড়ে গেলো সেদিনের কথা-

 সেদিন তার পাগুলো যেন চলতে চাইছিলো না সিঁড়িগুলো কেমন ঝাঁপসা হয়ে যাচ্ছিলো। রেলিং টা শক্ত হাতে ধরে চোখের ভেতরে তৈরি হওয়া অশ্রু কণাগুলোকে এক সঙ্গে জুড়ে জলের ধারা বইতে   দিলো না, শক্ত করে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলো সে। চোখের ভেতরে অশ্রু কণা বাষ্পায়িত করার পন্থা তাকে ভালোভাবেই আয়ত্ব করতে হয়েছে সেদিন থেকে। যদিও চোখের পানির সাথে দুঃখকে গিলে ফেলার কৌশল মেয়েরা জন্মগত ভাবে পেয়ে থাকে।লিফটে উঠলে কারো না কারো সাথে দেখা হতে পারতো এমন অবস্থায় তাকে কেউ দেখলে নানান প্রশ্নের জন্ম হতো এই জন্যই লিফটে উঠেনি সেদিন।কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে পা বাড়িয়েছিলো সামনের দিকে। 

এর পরে আর পেছনে ফিরে তাকায়নি। শাহেদের সাথে কোন ভাবেই যেন দেখা বা যোগাযোগ না হয় সেই ভাবেই চলেছে সে। আজ যখন শাহেদ মা'কে কল করে বলল, সে আসছে তখন ওর মুখোমুখি না হতেই কফির মগ নিয়ে ছাদে চলে এলো।


কিছুটা সময় এমনিতেই কেটে গেলো কোন কথা না বলে, শুধু একটা কাক দূরে বসে কা কা করছে। খুব কর্কস স্বরে ডাকলেও ভালো লাগছে অপরাজিতার। কাক তার সঙ্গী মারা গেলে দ্বিতীয় বার জোড়া বাঁধে না। কখনো সঙ্গীর সাথে প্রতারণাও করে না।  কাকটা কি তার মরে যাওয়া সঙ্গীর জন্য কাঁদছে ?

এক সময় নীরবতা ভেঙে শাহেদ বলল-

---আজ তিন বছর চার দিন পরে তোমার সামনে দাঁড়ালাম । এর আগেও কয়েকবার ভেবেছি কিন্তু সাহস পাইনি।

অপরাজিতার কোন ইচ্ছে নেই কথা বলার তাই চলে যেতে পা বাড়াতেই শাহেদ মিনতি করে উঠলো-

---প্লিজ জয়িতা , আমার কথাগুলো একটু শোন।


অপরাজিতা হেসে খুব শান্ত ভঙ্গিতেই বলল-

---জয়িতা অনেক আগেই মরে গেছে। ঐ নামে ডাকলে কেউ আর জবাব দিবে না।আর সাবধান করে দিচ্ছি আমাকে জয়িতা বলবে না

জয়িতাকে তো তুমিই গলা টিপে মেরে ফেলেছ। 


---আমি ক্ষমা চাই তোমার কাছে।

---কেন? আমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার কি আছে? আর ক্ষমা করে দিলেই বা কি হবে? এত দিনের অপমান, চোখের পানি, সন্তানদের কষ্ট-ক্ষোভ, মায়ের চাপা কান্না সব কিছু কি ধুয়ে মুছে যাবে?


---জানি আমার ভুলের কোন ক্ষমা নেই তবুও মুখ দিয়ে একবার বল ক্ষমা করেছ?

---মুখে বললেই কি মন সায় দিবে আমার? এটা ঠিক তুমি তো আবার মনের কথা বুঝ না । রসিয়ে রসিয়ে, ঢং এ ঢাং এ , কেঁদে কেঁটে যা দেখানো হবে সেটাই তুমি সত্যি বলে ধরে নিবে। হৃদয়ের সাথে তোমার কোন কানেকশন নেই।

---আমি আসলে এটা বুঝাতে চাইনি।

---তুমি কি বুঝাতে চাও না চাও তাতে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। তোমাকে ছাড়া খুব তো চলছিলো আমাদের জীবন , আমরা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম আবার কেন এলে ঝড় উঠাতে?

---আমি শুধু ক্ষমা চাইতে এসেছি।

---ক্ষমা চাওয়ার দরকার নেই। সায়রা আর তোমার জন্য সব সময় শুভ কামনা।

--- সায়রা চলে গেছে আমাকে ছেড়ে, শুভ কামনার দরকার নেই।


অপরাজিতা অবাক হয়ে ব্যঙ্গাত্মকভাবে বলল-

---তাই নাকি? আমরা তো জানতাম তাকে নিয়েই দেশের বাইরে পাড়ি জমিয়েছ,সুখে শান্তিতে আছ! সায়রা ঠুকরে দিয়েছে এই জন্যই এখন এখানে আসার সময় হয়েছে?

---দুই বছর আগেই ও চলে গিয়েছে, এর পরে আমি একাই এখানে সেখানে ঘুরে বেরিয়েছি কিন্তু কোথাও শান্তি পাইনি।

দেশের বাইরে যাওয়ার আগেও এসেছিলাম এখানে।

 সেই আগের মতো বেড রুমে ঢুকে যেতে পারিনি সেদিন, পা আঁটকে গিয়েছিলো এক সময় নিজের রুমে আধিপত্য থাকলেও নিজের জন্য সেটা হারিয়েছি, সেই দিনই বুঝেছি আমি কতটা পরিত্যক্ত এই বাসায়।ড্রয়িংরুমে বসে থাকলাম। মা আমাকে দেখে খুশি হননি। 

আমাকে বললেন" কেন আসছস?আমরা মরে গেছি কিনা সেইটা দেখতে? বৌমা বাসায় নাই আর বাচ্চারা তোর সাথে দেখা করবো না।যেই বাপ সন্তানের কথা চিন্তা করে না, সন্তানরা কেন বাপ বাপ করবো? এই বাসা থাইকা কেউ খালি মুখে যায় না, চা পাঠাইতাসি খেয়ে যা।"

এর পরে মা ভেতরে চলে গেলে আমি কিছু না বলেই বেরিয়ে গিয়েছিলাম। মা আমাকে এতটা ঘৃণা করেন!!

---মায়েরা কখনো সন্তানকে ঘৃণা করতে পারে না। তাঁরা অভিমান করে কিন্তু ঘৃণা করতে পারে না। মা তোমাকে এক মুহুর্তের জন্য ভুলতে পারেননি। কেমন মনমরা হয়ে থাকতেন মাঝে মাঝে বিশেষ করে যখন তোমার পছন্দের খাবার টেবিলে থাকতো। সেই খাবার তাঁর গলা দিয়ে নামতো না। ছেলে শত অন্যায় করলেও  মায়ের মন সন্তানের জন্য কাঁদে।  এই সব দেখেও আমি না দেখার ভান করে থাকতাম। উনি কখনো চাইতেন না কেউ উনাকে সান্ত্বনা দিক। আর কে কাকে সান্ত্বনা দিবে সবাই তো দুঃখ কুয়ার চারপাশেই ঘুরছিলাম।


--- সায়রার সাথে জড়িয়ে গেলেও আস্তে আস্তে আমার ভেতরে অনুতাপ আর হতাশা জেঁকে বসছিলো।সায়রার আসল চেহারা স্পষ্ট হচ্ছিল আমার কাছে। ওদের মতো মেয়েদের নিয়ে সময় কাটানো যায় কিন্তু সংসার করা যায় না। এর জন্য তো আমাদের মতো পুরুষরাই দায়ী। আমাদের মতো পুরুষদের জন্যই তো সায়রাদের উত্থান। সায়রার কাছে আমি শুধুই ছিলাম টাকার মেশিন আর সাময়িক মোহ।

সায়রা বলতে শুরু করেছিলো আমার সাথে জড়িয়ে সে ভুল করেছে। তার জীবন শেষ। আমার মনে হচ্ছিল আমি শুধু ভুল করিনি চরম পাপ করেছি সায়রার সাথে জড়িয়ে। এক সময় উচ্চাভিলাসী সায়রার  আরো টাকা ওয়ালা একজনের সন্ধান পেয়ে তাকেই বিয়ে করেছিলো। কিন্তু সে নিজের জালে নিজেই জড়িয়ে গিয়েছিলো । সে হয়ে উঠেছিলো হাসবেন্ডের ক্লায়েন্ট প্রস্টিটিউট। ওর জীবন  এমন যে - না পারছে মরতে না পারছে সইতে। এর পরের কাহিনী কি আমি আর জানিনা।


---এই সব আমাকে শুনিয়ে লাভ কি? অন্যের কাহিনী শোনার মতো সময় আমার নেই। তোমার পাপের তো হিসাবই নেই। এই দুনিয়াকে আমার জন্য নরক বানিয়ে চলে গেলে।

আমাকে আমিতে টিকিয়ে রাখতে আমাকে কি পরিমাণ যুদ্ধ করতে হয়েছে  সেটা আমিই কেবল জানি। কিছু হায়েনার মুখোশ তখনই উম্মোচিত হয়েছিলো, স্বামী পরিত্যক্তা নারীকে অসহায় ভেবে কৌশলে কলুষিত করতে চেয়েছিলো। আর সবাই ছিলো পরিচিতজন।

---কি? কার এত বড় সাহস?

অপরাজিতা হাসলো। 

---সাহস তো তুমিই দিয়ে গিয়েছিলে।সবার প্রথমে হাত বাড়িয়েছিলো তোমার প্রাণের বন্ধু ইকবাল।

---কি ইকবাল?

---হু ইকবাল।

 অন্ধকারে হাবুডুবু খাওয়া আমাকে দেখে  বন্ধু ইকবাল আমাকে খুব জ্বালাতন করা শুরু করেছিলো।

আমি প্রথমে বুঝিয়ে বলেছিলাম-"আপনাকে সব সময় বড় ভাইয়ের মতো মনে করি,  কোন প্রয়োজন হলে অবশ্যই জানাবো ভাইয়া। আপনাকে বার বার এসে কষ্ট করে খবর নিতে হবে না। আর একটা কথা কি জানেন ভাইয়া শাহেদের সাথে আমার সম্পর্কের ব্যাপারটা অনেকেই জানে। আর এখন সবাই আমাকে নিয়েও এটা ওটা খুঁজে বেড়াবে। কারণ এখন আমি একা। আমাদের সমাজে একটা মেয়ে বা মহিলা একা জীবন কাটাবে এটা মেনে মানতেই পারে না।এই যে ধরেন আপনার সাথে আমার সম্পর্ক আমি আপনি জানি কিন্তু  ভাবি একদিন বলে বসলো- "অপরাজিতার কাছে এত যাওয়ার কি হলো, স্বামী পরিত্যক্তা মেয়ে মানুষ ভালোই চিনি, দেখা যাবে তোমার গলায় ঝুলে পড়ছে, এদের কোন ঠিক আছে?" তখন কি করবেন? আপনার কেমন লাগবে? আমার কানে গেলে আমি তো লজ্জায় মরে যাবো। কথা যে কারো মুখ থেকে বেরিয়ে যেতে পারে, সেই কথা তো আর ফিরিয়ে নেয়া যায় না।"

এই কথা শুনে ইকবাল সেদিন একটু চুপসে গিয়েছিলো। ভেবেছিলাম ঝামেলা চুকেছে। কিন্তু না মোবাইল, মেসেঞ্জার সব কিছুতে রীতিমতো অত্যাচার শুরু করলো। তার বৌকে বলাতে উল্টো আমাকেই দোষারোপ করতে লাগলো"নিজের স্বামীকে নাকি বেঁধে রাখতে পারিনি এখন অন্যের স্বামীকে ভাগিয়ে নিতে চাই।"

দোষ না করেও আমার নিজের চরিত্রের দোষ দিয়েছে মানুষ।

তবে আমি মুখ বুজে সহ্য করিনি চারপাশের হা করা মুখগুলোকে উপযুক্ত শিক্ষা দিয়েই বন্ধ করেছি। একা থাকতে গেলে নিজের চারপাশে কাঁটাযুক্ত বেড়া দিতে হয়।


---আমিও কি অমানুসিক কষ্ট পাচ্ছি সেটা শুধু আমিই জানি। নিচে দেখা হলো আমাদের মেয়ে অপির সাথে কথা বলেনি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সন্তান বাবাকে ঘৃণা করে এর চাইতে কষ্টের কি আছে?

---অপি, অহনের বন্ধুদের মায়েরা কানাঘুষা করতো, অনেকে মুখ বাঁকিয়ে হাসতো সেই সব ওরা খুব বুঝতে পারতো। ওদেরও অনেক মানসিক যন্ত্রণা পেতে হয়েছে।

 একদিন অপি ওর ফুফুর বাসা থেকে এসে  জিনিস এলোমেলো করে ভাঙচুর করে হাত পা ছুড়ে কাঁদতে লাগলো আর বলতে লাগলো" ঐ লোকটাই কেন আমার বাবা হলো, সবাই কত খারাপ খারাপ কথা বলে ছিঃ ছিঃ কি লজ্জা লাগে আর কোনদিন কোথায় যাবো না।"

আমি মেয়েকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে থাকলাম, কতটা সময় জানিনা একসময় ওর হৃদপিন্ডের গতি নরমাল হলো কিন্তু এর পর থেকে আমরা সব আত্মীয় স্বজনের বাসায় যাওয়া বন্ধ করে দিলাম।

আমাদের ছেলে অহন একদিন বলল," কেউ বাবার কথা জিজ্ঞেস করলে আমি বলি বাবা নেই। সত্যি কথা বললে তো নানান প্রশ্ন করে, অনেক সময় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয় তাই এটা বললেই ভালো বাবা নেই। এটা শুনে ভাবে মারা গেছে, আর কোন প্রশ্ন করে না। মা আমাদের জন্য তো এটাই সত্যি তাই না?"

আমি তোমার বিরুদ্ধে, ওদের কখনো সরাসরি কিছু বলিনি, কোন অভিযোগ করিনি ওরা নিজেরাই যা বুঝার বুঝে নিয়েছে। তবে সন্তানও বাবাকে পুরোপুরি ঘৃণা করতে পারে না। ঘৃণা আর ভালোবাসার দোলাচলে দোলে সন্তানের মন।


শাহেদের মনে পড়লো অপির জন্মের প্রথম দিনের কথা। অপরাজিতার কষ্ট হচ্ছিল তবুও মিষ্টি করে হেসে ছিলো, ওর চোখে মুখে স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে ছিলো। মা তার কোলে অপিকে দিলেন , অনভ্যস্ত হাত কাঁপছিলো বুকের সাথে লাগিয়ে রেখে, ওর ছোট্ট হাত ধরে বলেছিলো সে " এই হাত কখনো ছাড়বো না "ছোট্ট মা"।" 

কি আশ্চর্য কি অনায়াসে শাহেদ ছেড়ে দিয়েছিলো এই ছোট্ট হাত। 


---শুধু স্ত্রী মনেপ্রাণে ঘৃণা করে তাই না?

---এটা ঠিক বলেছ।একজন স্ত্রী তার স্বামীকে যেমন উজাড় করে ভালোবাসতে পারে তেমনি উজাড় করে ঘৃণা করতেও পারে। যেমন আমি তোমাকে ঘৃণা করি। 


---আমার পাপের শাস্তি আমি পাচ্ছি। কি করলে তোমরা আমাকে ক্ষমা করবে?

---ক্ষমা করা না করায় কিচ্ছু আসে যায় না। জীবন চলছে জীবনের নিয়মে তোমাকে ছাড়া আমাদের, আমাদের ছাড়া তোমার?

---তোমাদের ছাড়া যে আমার এই জীবন খুব কষ্টের।

---তুমি নিজের সুখের কথা চিন্তা করে আমাদের ছেড়ে দিয়েছিলে। এখন সায়রা তোমাকে ছেড়ে দিয়েছে বলেই বলছ এই জীবন কষ্টের। সায়রার সাথে ভালো থাকলে এখানে কখনো আসতে, ক্ষমা চাইতে?

---ভালো থাকব কি করে? কাউকে কষ্টের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে কখনো সুখী হওয়া যায়? কষ্টের প্রতিটা নিঃশ্বাসের হিসাব তো প্রকৃতি নিজের হাতে নিয়েই ছাড়েন।

জীবনের এই শেষ মুহূর্তে এসে  দাঁড়িয়ে আমার জীবনের হিসাব শুন্য। তোমাদের ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য নই জানি তবুও পারলে ক্ষমা করো। আমার হাতে আর হয়তো বেশি সময় নেই।


অপরাজিতা একটু অবাক হলো এই দাম্ভিক, একরোখা, রগচটা , স্বার্থপর মানুষটার কথা শুনে। এতক্ষণ শাহেদের দিকে একবারও ফিরে তাকাতে ইচ্ছে হয়নি এখন তাকাতেই দেখলো শাহেদের স্বাস্থ্য ভেঙ্গে গেছে বলতে গেলে শুকিয়ে কাঠ। ওর দাঁড়িয়ে থাকতেও যেন কষ্ট হচ্ছে। হঠাৎ বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। এখনো কি ওর জন্য কোন ফিলিংস অবশিষ্ট আছে? অপরাজিতা মনকে বার বার বলল- 'একদম না, একদম না। 


---কেন,কি হয়েছে ?


শাহেদ অপলক তাকিয়ে রইল অপরাজিতার দিকে। হেসে হেসে বলল-

--- জীবনের প্রতি অত্যাচারের ফল ভোগ করছি। মরণব্যাধি শরীরে বাসা বেঁধেছে। এতদিন শরীরের সাথে মনের কষ্টটা জড়িয়ে ছিলো এখন এই মুহূর্ত থেকে আমার মনে কোন কষ্ট নেই জয়িতা। বিশ্বাস কর কোন কষ্ট নেই। তোমার চোখে আমার জন্য এখনো ভালোবাসা দেখতে পাচ্ছি এখন মরেও শান্তি পাবো।


শাহেদের এই শোচনীয় অবস্থা দেখে অপরাজিতার মায়া হচ্ছে, এটা কিছুতেই ভালোবাসা না। সে মনে মনে বললো,' তাকে করুণা করা যায় কিছুতেই ভালোবাসা যায় না, সেই যোগ্যতাই তার নেই।'


(সমাপ্ত)


-নীল_অপরাজিতা

Himu


আমাদের নতুন ওয়েব সাইটে এমন আরও গল্প পড়ুন।