বউ শাশুড়ির সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত ২০২৪

 বউ শাশুড়ির সম্পর্ক

বউ শাশুড়ির সম্পর্ক

বিয়ের তৃতীয় দিনের মাথায় আমাকে আমার শাশুড়ি মা ডেকে বলেছিলেন,"শোনো বউমা,তোমাকে এই বাড়িতে আমার ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছি মানে এই না যে তুমি তোমার বাবার বাড়ির আদর থেকে বঞ্চিত থাকবে।হয়তো আমি তোমার আপন মা নই তবে আমি তোমার দ্বিতীয় মা।আমি চাই তুমি পড়াশোনা করো।নিজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে চাকরি করে নিজের পায়ে দাড়াও।আমার ছেলের উপরেও যেনো তোমাকে নির্ভরশীল হতে না হয়।"


শাশুড়ির মুখে এহেন কথা শুনে আমি অবাক।আমি অহনা এবার বিবিএ কমপ্লিট করেছি।বাবা বড়লোক বাড়ির সুদর্শন পুত্র দেখে আমাকে বিয়ে দিয়ে দিলেন।শাশুড়ির মুখে এসব শুনে আমি অবাক হলেও খুশি হই।যাক আমি তাহলে এবার এমবিএ পড়ার সুযোগ পাবো।


বিয়ের পর দুই মাস শশুর বাড়িতে ছিলাম।তারপর স্বামীর সাথে করে ঢাকা শহরে আসতে হয়।দুইমাস শাশুড়ি যেনো আমার দ্বিতীয় মা হয়ে উঠেছেন।এত ভালোবাসা এত যত্ন করে খাওয়ানো আমার খুব ভালো লাগতো।বিয়ের সময়ও আমি এতটা কান্না করিনি যতটা কান্না আমি শশুরবাড়ি থেকে ঢাকা যাওয়ার সময় করেছি।আমার মা বাবাও অবাক হয়েছিলেন।ঢাকায় আসার পর আমার স্বামী অনিক আমাকে এমবিএ ভর্তি করিয়ে দেন।কিন্তু সংসারের কাজ ও পড়াশোনা যেনো আমার উপর চাপ সৃষ্টি করেছে।ঘরের রান্না বান্না এদিক থেকে ওদিক হয়ে যেত মাঝেমাঝে।একদিন অনিক আমাকে এর জন্য অনেক বকা দেয়।


না পেরে শাশুড়ি মাকে কল দিয়ে বলি,"মা আমি পড়াশোনা করতে চাই না।মন দিয়ে সংসার করতে চাই।"


শাশুড়ি মা আমার কথার বিপরীতে কিছুই বলেন না।এর ঠিক দুইদিন পর দেখি আমার শাশুড়ি মা ঢাকায় হাজির।আমাকে বলে,"শোনো বউমা জীবনের মূল্য তো বোঝ না।আমি নারী আমি জানি জীবন কত কঠিন।একটু শক্ত হও।কেউ কিছু বললে তাতে দুর্বল হয়ে নিজের ক্যারিয়ার নষ্ট করা বোকামি।আমিও কারো বউ ছিলাম।তাই আমি বুঝি তুমি এখন কিসের উপর দিয়ে যাচ্ছো।তুমি পড়াশোনা করবে আমি আছি এখানে।তোমার এই মা তোমাকে পড়াশোনা থেকে বঞ্চিত রাখবে না।"


আমার শাশুড়ি মায়ের দিকে তাকিয়ে আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।সাথে সাথে জড়িয়ে ধরি আমার দ্বিতীয় মাকে।


আস্তে আস্তে আমার পড়াশোনা শেষ হলো।বিয়ের ছয় মাস পরেই শশুর বাড়ির সবাই বলেছে,"বউমা এবার একটি বাচ্চা নেও।"


কিন্তু আমার শাশুড়ি মায়ের একটাই কথা,"বেচে থাকলে বাচ্চা আল্লাহর রহমত সে হবে।কিন্তু নিজের পায়ের নিচের খুঁটি শক্ত থাকলে শেষ বয়সে সুখী নারী হতে পারবে।"


শাশুড়ির শক্ত শক্ত কথার মানে আমি বুঝতাম না।কিন্তু তার এই ভালোবাসায় আমাকে তার প্রতি আলাদা মায়া সৃষ্টি করে দিয়েছে।আমি আর আমার শাশুড়ি সারাদিন গল্প করে একসাথে কাজ করতাম।সময় আমাদের কখন চলে যেতো কিছুই বুঝতে পারতাম না।


এমবিএ শেষ করার পর আমি কনসিভ করি।এর কারণে আমার আর চাকরির জন্য ব্যাবস্থা নেওয়া হয় না।আমার বর আমার কাছে আসা বন্ধ করে দেয়।কিছুটা মনঃক্ষুন্ন করে থাকতেন।বিষয়টি আমার কাছে খারাপ লাগলো।তার সন্তান আমার গর্ভে কিন্তু সে এখন আমার যত্ন না করে আমার থেকে দূরে থাকেন।কিন্তু আমার শাশুড়ি মা আমাকে অনেক সেবাযত্ন করতেন। এমনও হয়েছে আমার আট মাসের সময় ভারী কাজ করতে পারবো না বলে তিনি আমার নোংরা জামা কাপড় ধুয়ে দিয়েছেন।আমি ইতস্তত বোধ করতাম।কিন্তু শাশুড়ি মা আমাকে বলতেন,"মেয়ের বিপদে মা তার ঢাল হবে না তো কে হবে?"এবারও আমি জড়িয়ে ধরি আমার শাশুড়ি মাকে।


আমার প্রথম কন্যা সন্তান হলো।শাশুড়ি মা তার নাতিকে নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়েন।আমাকে কাজ করতে হতো।বরের জিনিস পত্র গুছিয়ে দেওয়া রান্না বান্না বাচ্চার ফিডিং করিয়ে নিজের প্রতি যত্ন নেওয়া যেনো উঠেই গেলো।শাশুড়ি মা আস্তে আস্তে অসুস্থ হয়ে পড়েছে।তাই তাকেও আমি কাজ করতে দিতাম না।এক সময় আমার বর আমাকে বলে,"তুমি না পারো ঘর সামলাতে না পারো বাচ্চা সামলাতে আর না পারো ঠিকমতো রান্না এখন তো দেখতেও কুৎসিত হয়েছো।"


বরের মুখে এহেন কথা শুনে আমি প্রতিবাদ করিনি।কিন্তু আমার শাশুড়ি মা বলে ওঠে,"বউমা তোমাকে আমি প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় উঠিয়েছি।আজ আমি তোমাকে বলছি চলে যাও এই বাসা থেকে।"


শাশুড়ি মায়ের এই কথা শুনে আমি অবাক।তারপরও কিছু বলিনি।শাশুড়ি মা আবারও বলেন,"সত্যিই তো এমন বউমা দিয়ে কি হবে যে আমার ছেলেকে সুখী রাখতে পারে না।তুমি চলে যাও আর আমার নাতিকে রেখে যাও।"


আমি কিছু বলতে যাবো শাশুড়ি মায়ের চোখ রাঙানি দেখে বলিনি।ভালোবেসে ফেলেছি আমার এই দ্বিতীয় মাকে।কিন্তু হঠাৎ এমন কিছু বলবে বুঝিনি।বরকে দেখলাম খুব খুশি হয়েছে শাশুড়ি মা আমাকে বকা দিয়েছে তাই।আমিও অভিমান করে বেরিয়ে এলাম সেদিন। বাসে বসে চোখ দিয়ে পানি ফেলছি এমন সময় আমার ফোনে এসএমএস এর শব্দ পেলাম।ফোন হাতে নিয়ে দেখি শাশুড়ির ভয়েস ম্যাসেজ।ভয়েস অন করতে শুনতে পাই,"বরের দুর্দিন গেলে বুঝতে পারবে জীবনে বউ কি জিনিস।মুখ বুঝে সবকিছু যখন সহ্য করেছো তখন মুখ বুঝেই তোমার প্রয়োজনীয়তা তাকে বুঝিয়ে দেও।আপাতত মায়ের ভালোবাসা ভোগ করতে থাকো।সন্তান নিয়ে ঘর সামলানোর দায়িত্ব তোমার বর পালন করুক।তবেই না বুঝবে সংসার কি জিনিস! বিবেক ফিরলে যখন সম্মানের সাথে তোমাকে নিয়ে আসবে তখনই এসো এই সংসারে।তার আগে এসোনা মা।আমি চাইনা জীবনে যে অশান্তি আমি ভোগ করেছি এগুলো এখন আমার বউমা ভোগ করুক।অবহেলিত সংসারে আমার দিন ফুরিয়ে এসেছে প্রায় তাই যাওয়ার আগে আমার মত এক নারীকে সুখী সংসারী হতে দেখতে চাই।"


শাশুড়ি মায়ের ভয়েস শুনে আমার কলিজা এবার ঠান্ডা হলো।নিরবে প্রতিবাদ করানো শিখিয়ে দিলো আমার শাশুড়ি মা।


বাড়িতে এসেছি আজ এক সপ্তাহ হলো।হঠাৎ একদিন আমার মা আমাকে বললেন,"মেয়েদেরকে একটু মানিয়ে নিতে হয় মা। বরেরা তো বাইরে কাজকর্ম করতে করতে ক্লান্ত হয়।ওদের উপর কত চাপ পরে।জামাইকে মাফ করে চলে যা। তোর একটি সন্তানও তো আছে।মেয়েদের এত জেদ ভালো না।"


আমি তাকিয়ে আছি মায়ের দিকে।তফাৎ খুঁজতে লাগলাম নারীজাতির ভিন্ন রূপের দিকে।এই মা বিয়ের আগে আমাকে নিজের হাতে খাইয়ে দিয়েছে।এই মা আমার সন্তান হওয়ার সময়ও আমার শাশুড়ি মায়ের সাথে মিলে অনেক কিছু করেছে।মা আমাকে অনেক ভালোবাসে আমি এটা মানি।কিন্তু সমাজের ভয়তে এই মা আমাকে অবহেলার সংসারে ফিরে যেতে বলছে।পুরুষদের মূল্য আমার মায়ের কাছেও যেনো অধিকতর।বিয়ের পর নারীদের মূল্য নিম্নস্তরে।


ঠিক অষ্টম দিনে আমাদের বাড়িতে হাজির হয় আমার স্বামী অনিক।ওর কোলে আছে আমাদের মেয়ে।অনিক আমার কোলে আমাদের মেয়েকে দিয়ে বলে,"এই একটি সপ্তাহ সংসার সামলাতে যেয়ে অনেক হিমশিম খেয়েছি আমি।বাচ্চা সামলানো রান্না বান্না করা ঘর গোছানো এসব করে যেনো আমার মাজার হার আরো বেশি ক্ষয় হতে লাগলো।এক সপ্তাহে যদি আমার এই হাল হয় তোমাকে তো কাজগুলো প্রতিদিন করতে হয়।তোমার দিকটা না ভেবে আমি অনেক কথা শুনিয়েছি।আমাকে ক্ষমা করে দিও।"


এতদিন আমার বরের ভিতর আমার শ্বশুরের আবির্ভাব দেখেছি এখন যেনো আমার শাশুড়ির আবির্ভাব দেখলাম। বরের বিবেক ফিরেছে এখন।


বর ও মেয়েকে নিয়ে ঢাকা ফিরে যাবো এমন সময় পিছন ফিরে মাকে বললাম,"তুমি বলেছিলে না মেয়েদের এত জেদ ভালো না।তুমি এক মা হয়ে আমাকে ঠেলতে চেয়েছো ওই অবহেলার সংসারে। আর আমার আরেক মা চেয়েছে আমি যেনো অবহেলার সংসার না করি,বরং এমন সংসার পাই যেখানে বরের দেওয়া ভালোবাসা ও সম্মান দুটোই যেনো থাকে।"


মা আমার কষ্ট পেয়েছে মনে মনে কিন্তু আমার শাশুড়ি মায়ের মত মহান মনের মানুষের জন্য মন ভরে দোয়া করলেন।হাজার হোক আমার মাও নরম মনের মানুষ।মেয়ে তার শাশুড়ি মায়ের মাঝে নিজের মাকে পেয়েছে।এটাই তো চায় আমাদের মায়েরা।


সেদিনের পর থেকে অনিক আর আমাকে অবহেলা করেনি।অনিকের কোনো কাজে একটু ঝামেলা হলে ও ভালোভাবে আমাকে বলে দেয় আমি ঠিক করে দেই।রান্নার সময় মেয়ে কান্না করলে অনিক নিজে কোলে নিয়ে আদর করে।আমার রান্নায় জাতে কোনো ঝামেলা না হয়।আমার শাশুড়ি মা এই সময় প্যারালাইজড হয়ে যান।তার সেবাযত্ন আমিই করি।শাশুড়ি মা কান্না করতে করতে বলে,"আমি এই জীবনে যত অবহেলা পেয়েছি আজ যেনো বউমার দ্বারা উশুল করে নিচ্ছি।"


আমি শুয়ে থাকা শাশুড়ি মাকে জড়িয়ে ধরি।তার কষ্ট চোখে না দেখলেও বুঝতে পারি মানুষটি কতকিছু সহ্য করেছে জীবনে।ছেলেও যে তার বাবার মতই হয়েছিলো।আত্মীয়দের থেকেও তো শুনেছি আমার শ্বশুরের কৃতকর্ম।


দেখতে দেখতে কেটে গেলো তিনটি বছর।আজ আমার আরেকটি মেয়ের জন্ম হলো।কিন্তু আজ আমার শাশুড়ি মা বেচে নেই।তিনি মারা গেছেন আজ একটি বছর হয়ে গেছে।প্রথম মেয়ের জন্মের সময় শাশুড়ি মাকে যেভাবে পেয়েছি আজ দ্বিতীয় মেয়ের জন্মের সময় তার অভাব বোধ  করছি।মনে মনে এখনও বলি,"ভালোবাসি মা আপনাকে।খুব বেশি ভালোবাসি আমার দ্বিতীয় মাকে।"


-অনুগল্প

-ভালোবাসি আমার ২য় মা

ইশরাত জাহান


বিঃদ্রঃ একটি আপুর বাস্তব জীবন থেকে নেওয়া।উনি আমাকে যখন ঘটনাটি বলেছিলেন উনি নিজে কেঁদে দিয়েছিলেন।


এমন আরও গল্প পড়ুন।