গল্পঃ_রুইতন | ভালোবাসার কষ্টের স্ট্যাটাস ২০২৪

 ভালোবাসার গল্প

ভালোবাসার গল্প

মেয়েটিকে দেখতাম শার্টের দুটো বোতাম খুলে ক্লাসের শেষ বেঞ্চে গিয়ে বসতে। ও বসতেই ক্লাসের ছেলেদের মাঝে একটা গুঞ্জন শুরু হত।


- 'এসেছে। মেম এসেছে।'


সব ছেলে আড়চোখে মেয়েটিকে দেখতে থাকত। যারা কিছুটা সাহসী,পড়াশোনায় একদম মন নাই তারা আগেভাগেই এসে পিছনের সীট দখল করে বসত। আকাঙ্খা একটাই, এখান থেকে মেমকে স্পষ্ট দেখা যায়।  মেম নামটা ওদেরই দেওয়া।মেরিলিন মনরোর প্রথম দুই অক্ষর সাজিয়ে মেম। কাঁধ ছোঁয়া বিচ ব্রাউন কোঁকড়া চুল, গোলাপি আভায় টোল পড়া ফর্সা গাল আর রক্তিম ঠোঁটে ওকে সত্যি মেরিলিন মনরোর মতই লাগত। 


খানিকটা অহংকারী মিশেল উদ্দাম দৃষ্টি, সাজপোশাকে ভীষণ সাহসিকতা আর ডোন্ট কেয়ার ভাবের জন্যে ওকে সত্যি আর সবার মাঝখান থেকে আলাদা করা যেত। রোজই ও আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হত।কোনদিন স্লিভলেস টপ পরে উপস্থিত,কোনোদিন বা স্লিপ স্কার্ট।  একদিন দেখলাম, ভার্সিটির ক্যান্টিনের সামনে দাঁড়িয়ে ধুমিয়ে খাচ্ছে। আমি ওকে দেখতে দেখতে যেতেই ও ইশারায় ডাকলো,


- 'লাগবে?'


- 'না। আমি স্মোক করি না।'


- 'মেয়েটির হাতের সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে দিল।'


- 'আমিও করি না। জাস্ট ঘ্রাণ নেবার জন্যে মাঝে মাঝে ধরাই।'


নেশা করে না অথচ সিগারেটের ঘ্রাণ ভালো লাগে কস্মিনকালেও শুনি নাই৷পাগল নয়ত! মেয়েটা সম্ভবত আরো কিছু বলত দ্রুত পায়ে চলে গেলাম। ওর কেমন লালচে চোখ, টেনে টেনে কথা বলে। আমার পরিচিত কোনো মেয়েই ওর মত নয়। কৌতুহল হচ্ছিল আবার সঙ্কোচও লাগছিল। ও ওর মত থাকুক।


ওর কাছে চলে আসতেই ছেলের দল আমাকে ঘিরে ধরলো,


- 'উর্মি তোকে কি বললো?'


- 'উর্মি! উর্মি কে?'


- 'ওই যে মেম! যারসাথে এতক্ষণ ফিসফিস করছিলি!

কি বললো ও?


- 'তেমন কিছু না।'


.


উর্মি একা থাকত। ক্লাসের অধিকাংশ মেয়েরা স্বভাবতই ওকে পছন্দ করত না।সবাই নিম্নমধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। কোনোরকমে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়াকে বর্তে গেছি।টাকা থাকলে কেউ আজকাল বাংলা বিভাগে পড়তে আসে না। বেসরকারি ভার্সিটিতে অ্যাডমিশন নেয়।


আমাদের ব্যাচের ছেলেরা নিতান্ত অসহায় হয়েই যেন বাংলা পড়ছে। আমার বাংলা পড়তে ভালো লাগে। কেন যেন এক একটা অক্ষরের মাঝে আমি রঙিন আলোবিন্দুর খেলা দেখতে পাই। গোপন খাতার কবিতাগুলো বিন্দু বিন্দু আলো মিলে বর্ণিল তরঙ্গের মত দৃশ্যপটে ধরা পড়ে।


.


এক দুপুরে উর্মির সাথে বারান্দায় ঠোকাঠুকি হতেই উর্মি হাসলো।


- 'তোমার কবিতার খাতা আমি দেখতে পারি?'


- 'কবিতা!আপনি জানলেন কি করে?'


উর্মি হাসলো।


- 'শেষ বেঞ্চে সবাই যখন আড়চোখে আমাকে দেখে তখন তুমি কি লিখ? কবিতা না গান?'


- 'কবিতা!'


- 'কিন্তু আপনি!'


- 'ব্যাচমেট কারো কাছে আপনি শুনতে ভাল্লাগে না।তুমি বলা যায় না।'


- 'যায়।'


- 'আজকে ক্লাস শেষ হলে তুমি আমায় কবিতা শোনাবে। আমি ক্যান্টিনে অপেক্ষা করবো।'


- 'আমার টিউশন আছে।'


- 'বিকালে?'


- 'তিনটা টিউশন করে আমার বাড়ি ফিরতে রাত হয়।'


- 'ওহ। আমারো আজকে শুটিং আছে। ভেবেছিলাম,যাব না।'


- 'তুমি অভিনয় করো?'


- 'উহু! মডেল।তাকিয়ে দেখো, সবাই এমনভাবে আমাদের দেখছে যেন আমি তোমায় গিলে হা করে গিলে ফেলবো।'


উর্মি মিটিমিটি হাসছে। আমিও হেসে ফেললাম। এরপর থেকে আমাদের কথা হত ফোনে,হোয়াটসঅ্যাপে। উর্মি মেসেঞ্জারে তত এক্টিভ নয়। পনেরদিনের মধ্যে আমাদের কথোপকথন তুমি থেকে তুই এ নেমে আসলো।তুমির বিপরীতে তুই শুনি।


- 'কি করিস?'


- 'রেডি হচ্ছি। ক্লাসে যাব।'


- 'আমি আজকে ক্লাস করবো না।'


- 'না করো।'


- 'তোরও করতে হবে না।আমাদের বাসায় আয়।মা-বাবা কেউ বাসায় নাই৷ খালি বাসায় ভাল্লাগছে না।'


- 'তোর মাথা খারাপ! খালি বাড়িতে আমি কেন যাব!'


উর্মি হি হি করে হাসল।


- 'শোন আমাদের বাড়ি কখনও খালি থাকে না। কেউ বাড়িতে না থাকলেও চারজন কাজের লোক আর দুটো জার্মান শেফার্ড থাকে।আয় তুই।'


বিশাল আলিশান বাড়িতে উর্মি থাকে। সাদা রঙের টিশার্ট আর রঙচঙা প্লাজুতে ওকে লাগছিল রুপকথার বন্দী রাজকন্যার মত। ছবির মত সাজানো বসার ঘর আরো কয়েকটা বড় ঘর পেড়িয়ে উর্মি আমায় ওর রুমে নিয়ে এসে দরজা লাগাল।


- 'কি করছিস!'


- 'এটা এই বাসার কালচার। বাবা প্রাইভেট বান্ধবী নিয়ে এসে দরজা৷ লাগায়৷ মা প্রাইভেট সেক্রেটারি নিয়ে দরজা বন্ধ করে। কাজের লোকেরা সব দেখেশুনেও বোবাকালার ভান ধরে থাকে।নয়ত বড়লোকিদের ঠকমা বজায় থাকবে কি করে! আমি অবশ্য এই প্রথম কাউকে ঘরে নিয়ে  দরজা লাগালাম।মজা লাগছে'


কি উত্তর দিব ভেবে পাচ্ছিলাম না।তাকিয়ে তাকিয়ে ওর ঘরের সাজসজ্জা দেখছিলাম।আমাদের আড়াইরুমের বাসাটা ওর রুমের সমান। ওটাকে অবশ্য বাসা না কবুতরের খুপরি বলা চলে। আমরা ছয়জন মানুষ তাতে গাদাগাদি বাস করি। উর্মি বলল,


- 'তোকে একটা সিরিয়াস কথা বলব তাই ডেকে এনেছি।'


- 'কি কথা।'


- 'আমি প্রেগন্যান্ট।বাচ্চাটা খু'ন করতে হবে।'


- 'কিহ?'


- 'সত্যি! আমার সাথে ক্লিনিকে চল। ওয়াশ করবো।'


একটা উনিশ বছরের মেয়ে প্রেগন্যান্ট অথচ ও দাবি করছে ওর সাথে কোনো ছেলের সম্পর্ক নাই এবং গর্ভে সন্তান আসার ব্যাপারটা এত সহজভাবে বর্ণনা করছে যেন ডালভাত খাবার মত কিছু! 


গল্পঃ_রুইতন

প্রথম_পর্ব | ০১

লেখা | হাবিবা সরকার

-------------------------------


গল্পঃ_রুইতন

দ্বিতীয়_পর্ব | ০২

লেখা | হাবিবা সরকার

--------------------------------

একটা উনিশ বছরের মেয়ে প্রেগন্যান্ট অথচ ও দাবি করছে ওর সাথে কোনো ছেলের সম্পর্ক নাই এবং গর্ভে সন্তান আসার ব্যাপারটা এত সহজভাবে বর্ণনা করছে

যেন ডালভাত খাবার মত কিছু! 


কয়েক মুহূর্ত কোনো কথা বলতে পারছিলাম না। 


উর্মি বললো,

- 'কি ভাবছিস?'


জিজ্ঞেস করলাম,

- 'বাচ্চাটা কার?'


- 'তা জেনে তোর কাজ কি!'


- 'তাহলে আমাকে ডেকেছ কেন? যার বাচ্চা তাকে সঙ্গে নিয়ে হসপিটালে যাও।'


- 'যদি জানতাম দারুন একটা ব্যাপার হতো৷ কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে ড্রামাটিক ভঙ্গিতে বলতাম, ‘ওগো তুমি বাবা হতে চলেছ! যত তাড়াতাড়ি পারো আমাকে বিয়ে করে উদ্ধার করো।’ হি হি হি!'


উর্মি হাসতে হাসতে গড়িয়ে পরে।ওর হাসি দেখে রাগ সামলে রাখতে পারলাম না।


- 'ছিহ! তুমি এত নীচ!'


- 'আমি নীচ নয় জঘন্য। তোর কি সমস্যা? তোর মন চাইলে আমার সাথে যাবি নয়তো ভাগ!'


অন্য কোনো ছেলে হলে ওখান থেকেই চম্পট দিত। কিন্তু আমি উর্মিকে এরকম কঠিন পরিস্থিতিতে রেখে চলে যেতে পারলাম না।মেয়েটার সাথে আমার পরিচয় অল্প কিছুদিনের। সম্ভবত অল্প দিনের পরিচয়ে একজন আধচেনা মেয়েকে বিচার করা সম্ভব নয় কিন্তু উর্মি একা।ঠিক যতখানি একা হলে একজন মানুষ আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে অশরীরী ভেবে ভয় পেয়ে যায় ততখানি একা।


আমাদের নিম্নমধ্যবিত্ত সংসারে সন্তানেরা ভাবি বাবা-মা সারাক্ষণ সন্তানের পিছু পিছু টিকটিক করে, ‘এই এত ফোন টিপিস না, এই শাকসবজি না খেলে পুষ্টি পাবি না, এই মাথায় তেল না দিলে চুল পরে যাবে, জ্বালাইয়া জীবন শেষ করেছিস।’ কথাগুলি শুনতে ভালো লাগে না সত্যি কিন্তু কতখানি ভালোবাসা মিশে থাকে আমরা কল্পনা করি না। সেই ছেলেমেয়েরা ভীষণ অভাগা যারা বাবার বকুনি আর মায়ের কড়া শাসন ছাড়াই একটু একটু করে বড় হয়ে যায় আর উর্মি তাদের দলে একজন।


.


আমাকে বিছানায় বসিয়ে রেখে উর্মি তৈরি হয়ে এল। ওর সাজ বলতে কোনোরকমে চুলে পলিটেইন বেঁধে গলায় স্কার্ফ জড়ানো।


ওর বাড়ি থেকে বের হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

- 'উবার ডাকবো?'


- 'উহু! বেবিটা পেটে আসার পর আমার গাড়ির গন্ধে বমি পায়। রিকশা নে।'


.


রিকশায় বসে ওর কনসিভ করার আদিনক্ষত্র সবটা জানলাম।উর্মিরা যাকে বলে কয়েক পুরুষের 'বনেদি বংশ৷' বাবা বিলেত থেকে এমবিএ করে এসে পারিবারিক ব্যবসা সামলান।মা রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী। টিভিতে পরিচিত মুখ, ব্লগ করেও বেশ জনপ্রিয়। উর্মি যে টুকটাক মডেলিংএর সুযোগ পায় তাও মায়ের কল্যাণে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও উর্মিকে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে হয়।


মা চায় মেয়ে মায়ের মতই জনপ্রিয় হোক। বাবার ইচ্ছা ছিল মেয়ে প্রকৌশলী হবে। সবার স্বপ্ন চুরমার করে উর্মি অনেকটা জেদের বশেই বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়েছে। উর্মির আসলে পড়তে ভালো লাগে না। কিছুই ভালো লাগে না। 


ওর বাবা-মা উর্মির জন্মের পর আর কোনো সন্তান নিতে চান নাই যেন উর্মির যত্নে কোনো কার্পণ্য না হয়। সেই যত্ন এতখানিই উর্মির ঘরভর্তি বারবি ডল আর কাবার্ড ভর্তি জামাকাপড়।দুজন কাজের বুয়ার মেয়ের সমস্ত দায়িত্ব দিয়ে মা ছুটতেন বিউটিপার্লারে। টিভির প্রোগাম যদি হয় আধাঘণ্টা তারজন্যে দুই ঘণ্টা ধরে চেহারাখানা দলাইমলাই করা চাই। বাবার তো একটার পর একটা বিদেশে মিটিং থাকত।


অনেক বছর পর উর্মি বুঝতে পারে, বিদেশ মিটিং, কনফারেন্সে শুধু ব্যবসায়িক কাজকর্মই হয় না তারসাথে বাবার সুন্দরী পিএর সাথে আলাদা কাজও থাকে।মা তাতে খুব বেশি বিরক্ত নন। ধনী স্বামীর বদৌলতে নামের সাথে মিসেস চৌধুরী যুক্ত হয়েছে। দামী গাড়ি, রঙবেরঙের কাঞ্জিভরম,জামদানি শাড়ির কালেকশন স্বামীর টুকিটাকি চরিত্রে দোষ ভুলিয়ে দেয়।তিনি নিজেও তো সতীসাবিত্রী নন কিছু রুপের গুণগ্রাহী বন্ধু জোঁকের ন্যায় পিছনে লেগেই থাকে। বন্ধুদের কাছে তিনি মিসেস চৌধুরী নন শিরিন বকুল কি না!


আর ভাইবোন হলে আদরের ভাগ হবে কথাটা ছিল ফাঁকি। তাদের দুজনের নিজেদের জীবন উপভোগ করতে কোনো সন্তানেরই প্রয়োজন ছিল না উর্মি জন্ম নেওয়াটা স্রেফ বংশরক্ষা। বাবা-মায়ের ডির্ভোস নেবারও প্রয়োজন হয় নাই কেননা দুজনের মাঝে বন্ধন থাকলে তো ছিন্ন হবে।


পাশাপাশি আলাদা দুই ঘরে দুজনে স্বর্গ রচনা করে বাস করছে।মধ্যিখানে উর্মি ভালো নেই। বাবা-মায়ের নিরুত্তাপ আর বন্ধুহীন জীবনে বিতৃষ্ণা হয়ে প্রায়ই ছুটে যায় শৈবালের ফ্লাটে। শৈবালের বাবা-মা আরো আধুনিক। তারা ছেলেকে আলাদা বাড়ি তৈরি করে দিয়ে ফ্রী জীবনযাপন করছেন। সেখানে প্রায়ই আফিমের আসর বসে। কিছু পথভ্রষ্ট ছেলেমেয়ে নেশায় চুড়চুড় হয়ে কয়েকঘণ্টার জন্যে এদুনিয়া দেশে হাজার সূর্যের দেশে উড়াল মারে। উর্মিরও হুশ থাকে না। মাঝরাত থেকে সকাল অবধি বিভোর হয়ে ঘুমায়।


তেমনি কোনো রাতে এক হারামি পেটে বাচ্চা দিয়ে ভেগেছে। এ নতুন কিছু নয়। এর আগেও শিমুল আন্টির মেয়ে 'জুন' শৈবালের বাড়ি এসে প্রেগন্যান্ট হয়ে ছিল।কেউ টের পায় নি,উর্মির সাথে ক্লিনিকে গিয়ে খালাস করে এসেছে।


.


যতক্ষণ উর্মি ওর গল্প বললো ততক্ষণ আর আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।সৃষ্টিকর্তা মানুষকে ঠিক কতরকম কষ্ট দিয়ে পরীক্ষা করেন তা একমাত্র তিনিই জানেন। উর্মির সব আছে কিন্তু আপন মানুষ বলতে কেউ নেই।


নামীদামী একটা ক্লিনিকের সামনে সিএনজি থামল। উর্মি এখানে আগেও কয়েকবার এসেছে বোঝা গেল। রিসেপশনিস্টের কাছে উর্মি ফিসফিস করে কিছু বলতেই আয়াকে ডেকে একজন নার্সের রুমে পাঠিয়ে দিল। ক্লিনিকে এধরনের  কেইস অহরহ আসে বোঝা যায়।


নার্স বললো,

- 'পাঁচ মিনিটের ব্যবসা। আপনার সাথে কে বয়ফ্রেন্ড?'


- 'না বন্ধু।'


- 'নার্স,বেবির হার্টবীট এসেছে?'


- 'আল্ট্রা করলে বোঝা যাবে। আপনি তো গর্ভপাত করাবেন এসব ভেবে লাভ কি!'


- 'কতমাসে হার্টবীট আসে?'


- 'সাধারণত আট থেকে দশ সপ্তাহের মাঝেই বোঝা যায়।'


- 'তারমানে এসেছে।'


উর্মি বেড থেকে বসে পরলো।

- 'কোন রুমে আল্ট্রা করায়?'


নার্স কি করবে বুঝতে না পেরে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।


আমি বললাম, 

- 'সিস্টার আপনি যান। আমি ওকে ম্যানেজ করছি।'


নার্স চলে গেলে উর্মির দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলাম,


- 'উর্মি, তুমি কি চাও?'


- 'শিশির, তুই তোর মাকে ভালোবাসিস?'


- 'এটা কেমন প্রশ্ন! হ্যা,খুব ভালোবাসি।'


- 'আমার মা একটা হারামি। তবু ওকে ঘৃনা করতে পারি না।'


- 'উর্মি তুমি একটা পাগল।'


- 'আমাকে কেউ কোনোদিন ভালোবেসে স্পর্শ করে নাই। এই বাচ্চাটা খুব ভালোবেসে আমার পেটে বড় হচ্ছে।'


- 'উমি ওর বাবা কে তুমি জানো না।'


- 'আমার বাপ কে তার ঠিক নাই শালা। মা দশ বেটার সাথে ঢলাঢলি করে। কার সন্তান চৌধুরীর ঘাড়ে 

চাপাইছে আল্লাহ মালুম।'


- 'উর্মি, প্লিজ।'


- 'আমি এসন্তান রাখবো। তারজন্যে বাড়িতে যতখুশি ফাইট করতে হোক করবো।'


.


উর্মিকে কোনোভাবে আমি বোঝাতে পারলাম না। উর্মি আল্ট্রা, ব্লাড টেস্টের রির্পোট নিয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে সিএনজিতে উঠলো।আমি জাস্ট রোবটের মত ওর কাণ্ডকারখানা দেখছিলাম। বাঁধা দিতে পারলাম না। ও সিএনজিতে বসেই আমার মুখে দিকে তাকিয়ে হাসল,


- 'কীরে ক্যাবলাকান্তের মত বসে আছিস কেন? বাসায় আজকে একটা সেই মজা হবে।'


- 'কি হবে?'


- 'প্রেগন্যান্সি পজেটিভ রির্পোট খাবার টেবিলের উপরে রেখে দিবো। মিস্টার অ্যাণ্ড মিসেস চৌধুরী যেই আগে দেখবে শকড্ হয়ে হার্টঅ্যাটাক করবে। হি হি হি। পৃথিবী থেকে একটা জঞ্জাল বিদায় হবে। হি হি হি!'


আমি ভয়ার্ত চোখে ওকে দেখতে থাকলাম।ওর মুখে কেমন একটা পৈশাচিক খেলা করছে। আমার ভয় হচ্ছে। ও কোনো বড় বিপদে পড়তে যাচ্ছে নাতো! 


গল্পঃ_রুইতন

শেষ_পর্ব | ০৩

লেখা | হাবিবা সরকার

--------------------------------

কেন জানি মনে হচ্ছিল উর্মির প্রেগন্যান্সির খবর শুনে ওর বাবা-মা ওর কোনো বড় ক্ষতি করে ফেলতে পারে। পিতৃপরিচয়হীন একটা সন্তান জন্মদানে অভিভাবকরা সার্পোট করবে না এটা খুব স্বাভাবিক। আমাদের সমাজ,ধর্ম, তথাকথিত সামাজিক ব্যবস্থার কাছে বিয়ের আগে একটা মেয়ের বাচ্চা পেটে আসা জঘন্যতম অপরাধ। সেখানে মেয়েটা দোষী হোক বা না হোক মেয়েটাকে পরিণামে ভুগতে হয় যাচ্ছেতাই ভাবে।


.


উর্মির কথা ভেবে রাতে ঘুম হচ্ছিল না। ওর ফোনটাও বন্ধ। অনেকক্ষণ বিছানায় এপাশ ওপাশ করে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। একটা কালো গাড়ি ল্যাম্পপোস্টের সামনে পার্ক করা। সিগারেটের ফুলকির উঠানামা দেখে বুঝলাম একটা মানুষ গাড়ির পিছনে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো। আমি জানি না কেন,অবয়বটা দেখেই বুকের ভেতরটা কেমন খপ করে উঠলো।দ্রুত পাঁচ তলা বেয়ে নামলাম।যা ভেবেছিলাম তাই উর্মি দাঁড়িয়ে।


আমায় দেখে হাসলো,

- 'তোরা এত ঘিঞ্চি এলাকায় থাকিস?কিছুতেই বাড়ি খুঁজে পাচ্ছিলাম না'


- 'তুই এখানে? এত রাতে?'


- 'তোদের বাসায় একটারাত থাকতে দিবি? আমি খুব ক্লান্ত। গাড়িতেই ঘুমিয়ে পরতাম।কিন্তু গাড়ির গন্ধে বমি পায়।'


- 'চল।'


.


উর্মি ধীরে ধীরে সিড়ি বেয়ে উঠতে লাগলো। যেই মেয়েটা লম্ফঝম্প করে সারা ক্যাম্পাসে নেচে বেড়াত ওর পেটে হাত দিয়ে হাঁটি হাঁটি পা করে উঠতে দেখে ভীষণ মায়া হচ্ছিল।


ঠিক সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিলো, নেশাগ্রস্থ,পাগল অথবা বারবণিতা একজন নারী যতবড় পাপকাজে লিপ্ত থাকুক না কেন মা শব্দটা যখন নামের পাশে যুক্ত হয় তখন সে শুধুই মা। মা শব্দটার আগে পিছে কোনো বিশেষণ যোগ করবার প্রয়োজন হয় না।মা মানেই গোটা একটা নীল পৃথিবী। 


.


বাড়িতে মা আছে, বাবা আছে। কানে শুনতে পায় না কিন্তু দাদী বড় সেয়ানা। বাড়িতে কে আসছে কে যাচ্ছে সব হদিস রাখে। উর্মিকে নিয়ে রাত দুটোর সময় ঘরে ঢুকলে গেঞ্জাম হবে জানি কিন্তু উপায় নাই।


চুপিচুপি ওকে ঘরে নিয়ে মিতুর ঘরে শুইয়ে দিলাম।মিতু আমার ছোটবোন,ওর ঘুমালে হুশ থাকে না। সকালে উঠে অপরিচিত মেয়েকে দেখে চেঁচামেচি করবে। করুক, অন্তত রাতটা শান্তিতে কাটাই। এবাড়িতে আমার ঘর বলে কিছু নাই। দিনের বেলা প্রথম ঘরটা বসার ঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয় রাতের বেলা আমি ক্যাম্প খাট টানিয়ে ঘুমাই। এভাবেই চলে যাচ্ছে আর কি!


.


ভোর হল। উর্মি ঘুমিয়েছে কী না জানি না আমি ঘুমাতে পারলাম না। মা ফজর নামাজ পড়ে কোরআন তেলাওয়াত করে। মায়ের গুণগুণ করে পড়া তেলাওয়াত কানে আসছিল। সম্ভবত তেলাওয়াত শুনতে শুনতেই ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম।


ঘুম ভাঙল দাদীর চিৎকারে,

- 'ও আল্লাহ! আল্লাহরে কি হইল! আমার নাতি মেমবউ নিয়া বাড়ি আইছে। ও মিতুর মা, কি সর্বনাশ হইল।'


মিতুর ঘরে সবাই থমথমে মুখে বসে আছে।উর্মি বিছানার মাঝখানে বসে সবার কৌতুহলি দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে চুকচুক হজমি খাচ্ছে।


আমায় দেখে হাসলো,

- 'শিশির দেখ,কেউ বিশ্বাস করছে না যে তুই শুধু আমার বন্ধু। ভাবছে আমি তোর বউ! হি! হি! হি!'


.


প্রায় ঘণ্টা ধরে পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষকে আলাদা আলাদা করে বোঝানোর পর মা আর মিতু কিছুটা বিশ্বাস করলো, উর্মি আমার বন্ধু। বিপদে পরে এখানে কিছুদিন থাকতে এসেছে। দাদী বিশ্বাস করলো না,পান খেতে খেতে উর্মির হাত-পা নাড়িনক্ষত্র বিচার করে বললো,


- 'উর্মি আমার বউ হিসেবে মন্দ হবে না। খালি গায়েগতরে আরেকটু মাংস লাগলে ওকে পরীর বাচ্চা মনে হবে।'


যাই হোক,উর্মি দুদিনের মাঝে আমাদের বাসার সবার মন যুগিয়ে ফেললো। মা রান্না করে ও সিঙ্কে হেলান দিয়ে মায়ের সাথে গুজগুজ করে গল্প করে। 


- 'আন্টি, আমার ছেলে হলে নাম রাখবো উত্তাল।'


- 'ওমা! একেমন কথা! বিয়েই হয় নাই বাচ্চার নাম রাখছো।'


- 'হি! হি! হি!'


দাদীর পান ছেঁচে দিয়ে এক টুকরা পান গাল ফেলে বলে,


- 'উম!দাদী,তুমি জম্পেশ জিনিস খাও। গাজাতেও এত পিনিক নাই!'


- 'গাজা! গাজা খায় কে?'


- 'কেউ না। তুমি পান চিবাও।'


এমনকি আমার ঝগড়াটে স্বভাবের ছোটবোন মিতুও উর্মির সাথে বিছানা ভাগাভাগি করতে আপত্তি করছে না। ও ভার্সিটিতে যাচ্ছে না। রোজ আমি ক্লাস থেকে ফেরার সময় বুক ধুকপুক করতে থাকে।বাবা চিটাগং গেছে। ফিরে উর্মিকে দেখে কি কাণ্ড করবে জানি না।


.


আমাদের জন্যে পাঙ্গাস মাছ রান্না হলে মা উর্মির জন্যে কড়কড়ে করে পাঙ্গাস মাছ ভেজে রাখতো। রাতে আমাদের জন্যে সীম,আলু আর উর্মির জন্যে ডিমভাজি। সাধারণ আয়োজন কিন্তু ও চেটেপুটে খেতো।


বাচ্চাদের মত হাত চাটতে চাটতে বলতো,

- "আন্টি,তোমার হাতের রান্না অসাধারণ।'


আমি উর্মিদের বাড়ির পরিবেশ দেখেছি৷ওদের অট্টালিকার তুলনায় আমাদের ঘর বাবুই পাখির বাসা। সে বাসায় উর্মি পাখির ডানায় ভর করে উড়ে বেড়াচ্ছে। ওর আনন্দ দেখলে বলা যাবে না, উর্মির মা ওর পেটে অবৈধ সন্তান এসেছে শুনে চড় মেরে মেঝেতে ফেলে দিয়েছিল। ওর বাবা তখনি হাউজ ডক্টরকে ফোন করে বাসায় ডেকেছিল। গর্ভের সন্তানটা মেরে ফেলবে। উর্মি কোনোক্রমে পিছনে দরজা দিয়ে পালিয়ে এসে এবাসায় আশ্রয় নিয়েছে।


.


পনের দিন কেটে গেল নির্বিঘ্নে,নিরুত্তাপ। বাবা আসবেন শুক্রবার। টেনশনে রাতে ঘুম হয় না। বাবাকে কি জবাব দিবো!


মা বলেছে,

- 'তোর বাবাকে আমি সামলাবো।মা


য়ের কথা বাবা মেনে নিবে ভরসা কি।


--------

-------------

বৃহস্পতিবার টিউশন থেকে ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম উর্মিকে কোথাও রেখে আসবো। বাবার মুখোমুখি ওকে দাঁড়া করানো যাবে না। কিন্তু বাড়ি এসে দেখি আমাকে সমস্ত দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দিয়ে উর্মি চলে গেছে। ওর বাবা-মা এসে জোর করে ওকে ওদের বাড়ি নিয়ে গেছে।


মা বললো,

- 'উর্মি খুব কাঁদছিলো।বাবা-মায়ের প্রতি ভীষণ অভিমান বুঝি মেয়ের!'


উত্তর দিতে পারলাম না।


.


সারারাত ঝটপট করে কাটানোর পর সকালে উঠলাম উর্মিদের বাসায়। উর্মি নেই। ওর বাবা-মা কেউই বাড়িতে নেই। মেয়েকে নিয়ে ছুটি কাটাতে রাতের ফ্লাইটে সিঙ্গাপুর চলে গেছে। বেড়ানো-টেড়ানো সব ফাঁকি।আমি জানি,উর্মিকে গর্ভপাত করিয়ে ছাড়বে।

'

'

'

'

কেটে গেল একঘেয়ে কয়েকটা মাস। ইতোমধ্যে ইয়ার ফাইনাল চলে গেছে। উর্মি পরীক্ষাতে বসে নাই। ওর নাম্বার সুইচ অফ,ভার্সিটিতে একদিনের জন্যেও ক্লাসে আসে নাই।


আমাদের ক্লাসের ছেলেরা 'মেম' নামের একজন যে ছিল তাকে ভুলেই গেলো। ওদের নতুন ক্রাশ এখন বোটানি ডির্পাটমেন্টের লাল চুলের একটা জুনিয়র মেয়ে। শুধু আমি উর্মিকে ভুলতে পারি নাই। ওকে কখনই কাঁদতে দেখি নাই আমি,ভেঙে পরতে দেখি নাই কিন্তু ওর বাচ্চাটা বাঁচিয়ে রাখার জন্যে যে আকুলতা তা আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। দুঃস্বপ্নে উর্মি আসে ওর ভেজা চোখ, ক্লান্ত মুখ জানিয়ে দেয়, ও ভালো নেই। ওকে সবাই ভালো থাকতে দিচ্ছে না।


.


তারপর ধীরে ধীরে আমি উর্মির কথা ভুলে গেলাম। একজনের সাথে পরিচিত হলে তাকে তো আর ভোলা যায় না স্রেফ স্মৃতির উপর ধূলোর পাহাড় জমে স্মৃতির রঙ রঙিন থেকে ধূসর করে দেয়।


.


পড়াশোনা শেষ করে নিজেকে খানিকটা গুছিয়ে নিয়েছি। একটা বেসরকারি কলেজে অধ্যাপনার সুযোগ পেলাম। বেতন বেশি নয় মধ্যবিত্তের চলে যায় আর কি! মিতুর বিয়ে দিলাম বড় ঘর দেখে।বাবা অসুস্থ। দাদী মারা গেছেন আজ দু'বছর।


.


কয়েক বছরের মধ্যে আমি বড় হয়ে গেলাম। মোটা ফ্রেমের চশমা আর চোখের নীচে কালো বৃত্তের রেখা জানিয়ে দেয় এবার বিয়ে না করলে বুড়ো বয়সে আর মেয়ে পাবো না। মা ইতোমধ্যে তার পছন্দের পুত্রবধূ ঠিক করে ফেলেছেন।


শ্রাবন মাসে বিয়ে। পাত্রীর ছোটবোনের নাম উর্মি। আশ্চর্য, উর্মি নামটা শুনতেই আমার প্রথম যৌবনের সেই বান্ধবীটির কথা মনে পরলো। প্রাণবন্ত, মুখরা একটা মেয়ে। যে ছোট্ট একটা ভুলের কারণে হারিয়ে গেছে বা এখনও কোথাও আছে আমার পোঁড়া চোখের অন্তরালে।


.


যাই হোক, শ্রাবন মাসের শুরুতেই একবার নেত্রকোণা যেতে হল। বিজয়পুর। একেবারে বর্ডার ঘেষা অঞ্চল।টিলায় ঘেষা অপূর্ব এক অঞ্চল। আমার কলিগের মা মা'রা গেছেন। 


বন্ধুকে সান্ত্বনা দিতেই ঢাকা থেকে চৌদ্দ ঘণ্টার সফর করে নেত্রকোণা। অপরচিত এলাকা খোঁজার সহজ মাধ্যম হলো তার আশেপাশের মসজিদ,মন্দির বা কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম বলা। বন্ধু বারবার বলে দিয়েছে, ‘আল-হেরা এতিমখানার এসে আমাকে কল দিবে। আমি এসে নিয়ে যাবো।’


.


রিকশা এতিমখানার সামনে দাঁড়াতেই আমি অবাক হয়ে গেলাম এতিমখানার গেটের দেয়ালে রঙবেরঙের কারুকার্য এঁকে বাচ্চারা হুলস্থুল কাণ্ড করছে। ছোট্ট ছোট্ট শিশু। সাদা পাঞ্জাবি আর সবুজ পাগড়িতে মনে হচ্ছে দেবশিশুরা জান্নাতের বাগান থেকে নেমে এসেছে।


পাঞ্জাবিতে রঙ মেখে রঙ-তুলি হাতে হি হি করে হাসছে। ওদের সাথে একজন কালো বোরকা পরা মহিলাও রঙ দিয়ে ফুল,লতাপাতার ছবি আঁকছে আবার বাচ্চাদের মতই হি হি করে হাসছে।ভদ্রমহিলার কণ্ঠ কেমন পরিচিত মনে হলো। এগিয়ে গেলাম।উর্মি! হ্যা উর্মিই দাঁড়িয়ে।


----


দুজন অনেকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলাম না। তারপর উর্মিই কথা শুরু করলো,


- 'কেমন আছ?'

- 'ভালো।'

- 'তুমি! তুমি এখানে!'

- 'সে লম্বা গল্প।'


উর্মি হাসলো।


বন্ধু বারবার ফোন দিচ্ছে। কিন্তু উর্মির মাঝখানের কিছু বছরের গল্প না শুনে আমি চলে যেতে পারলাম না।ও আমাকে এতিমখানার ভেতরে নিয়ে হুজুরদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। বোঝা গেল,ও এখানে নিয়মিত আসে। বাচ্চাদের ইংরেজি,গণিতের ক্লাসগুলো ওই করায়। সারাদিন বাচ্চাদের সাথে হৈ চৈ করে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরে। এতিমখানার পিছনেই এক রুমের ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকে।


কৌতুহল দমিয়ে রাখতে পারলাম না। প্রশ্ন করলাম,


- 'আমাদের বাড়ি থেকে চলে আসার পর তারপর কি হয়েছিল উর্মি?'


ও কয়েকমুহূর্ত কি যেন ভাবলো। তারপর বলতে লাগলো,


- 'তোমাদের বাসা থেকে বাবা-মা আমাকে নিয়ে আসার পর সোজা সিঙ্গাপুর। কিছুদিন মারধোর, চিৎকার-চেঁচামেটি করার পর হসপিটালে গর্ভপাত করানোর জন্যে নিয়ে যাওয়া হল।


ডাক্তার বললো, ‘দেরি হয়ে গেছে। বাচ্চার ক্ষতি করতে গেলে মায়েরই ক্ষতি হয়ে যাবে।’


তারপরও মা দমে যায় নাই। বাথরুমের মেঝেতে তেল ঢেলে পিচ্ছিল করে রাখত যেন আছাড় খেয়ে বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে যায়। যে দুনিয়াতে আসার সেতো আসবেই। সাড়ে আটমাসে নরমাল ডেলিভারি হলো। ছেলে বাবু। (উর্মি হাসলো) 


আমি ওর নাম রাখলাম 'উত্তাল' , কিছুদিন ভালোই কাটলো। তারপর একদিন বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখি, আমার বাবাটা নাই। ওরা আমার কলিজার টুকরাকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে।'


উর্মি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চুপ হয়ে গেল।আমি বুঝতে পারছিলাম না ঠিক কি বলবো। ও বলতে লাগলো,


- 'তিন বছর পর দেশে ফিরলাম। বাবা আমার বিয়ের জন্য খুব চেষ্টা করতে লাগলেন। পাত্রপক্ষের সাথে আমার দেখা হলেই বিয়ে ভেঙে যায়। পাগল মেয়েকে কে বিয়ে করবে!আমি বলি, ‘আমার সন্তানকে এনে দাও।আমি বিয়েতে রাজি।’ ওরা শুনলো না। শেষে হার মেনে ঠিকানা দিলো, এই এতিমখানায় আমার ছেলে আছে।'


- 'কোথায়? কোথায় তোমার ছেলে?'


উর্মি হাসলো,

- 'এখানে এসে দেখলাম কি জানো,যেই শিশুর দিকে তাকাই তাকেই আমার সন্তান মনে হয়৷ কারো মা নাই,বাবা নাই কারো বাবা-মা কেউ নাই।


রেজিস্ট্রেশন নাম্বার আর জন্মতারিখ মিলিয়ে আমার ছেলে কোনটা খুঁজে বের করা খুব সহজ। কিন্তু ইচ্ছা হল না। এক ছেলেকে খুঁজতে গিয়ে আমি একশ ছেলের মা হয়ে গেলাম। একজনকে বেশি ভালোবাসলে ওরা মন খারাপ করবে না বলো?'


এই প্রশ্নের উত্তর জানা নাই। আরো কিছুক্ষণ কাটিয়ে চলে আসলাম।।বন্ধু এসে গেছে।  


বন্ধু রিকশায় বসে ফিসফিস করে বললো,

- 'এই পাগলি মহিলা তোর পরিচিত?'


- 'পাগলি!'


- 'হুম। ভীষণ বড়লোকের মেয়ে। গাড়িভর্তি খাবার-দাবার এনে বাচ্চাদের মাঝে বিলি করে। সব ছেলেই নাকি ওর সন্তান। কি অদ্ভুত না?'


- 'অদ্ভুত! পৃথিবীটাই অদ্ভুত!'


(সমাপ্ত)...(রুইতন)


পর্বের আরও গল্প পড়ুন।