বউ শাশুড়ির ঝগড়া
খাবার টেবিলে সদ্য বিবাহিত দেবর আর তার বৌ কে যখন খাবার বেড়ে দিবো, ঠিক তখনই শাশুড়ী মা প্রায় তেড়ে আসলেন!!
-করছো টা কি!!! নতুন বিয়া করা পোলা আমার, বিয়ার দিনই তোমার শখ কইরা খাওয়ানোর কাম নাই! নিজের মতো আমার ছোট পোলার বউটা রে ও বাঁজা বানাইবা না কি? শখ আহ্লাদ অন্য জায়গায় গিয়া দেখাও।
নতুন বৌ আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো!
আমি হাসি হাসি মুখ করে, রান্নাঘরে চলে আসলাম! অপমানে, কষ্টে এখন আর চোখের কোনায় জল আসেনা। কেমন জানি পাথরের মতো লাগে সবকিছু।
ঠিক একটু আগে ঘর ভর্তি মানুষের সামনে যে এতো বড় একটা ব্যাপার ঘটে গেলো! এটা মনে হয় শুধু আমার কাছেই বড় লেগেছে! সবাই ও ঘরে দিব্যি হাসছে৷ কারোর কিছু যায় আসেই নি!
------------------------
৬ বছর আগে, এই বাড়িতে আমি বউ হয়ে আসি, সবার কতো উল্লাস, আনন্দ! বাড়ির বড় ছেলের বৌ আমি! শাশুড়ী মা আমায় মাটিতে রাখেন না পিঁপড়ে খাবে, মাথায় রাখেন না উঁকুনে খাবে!!! এরকম আদরে পেয়ে আমি এ বাড়িতে বউ হয়ে আসি।
সেদিন রাতে আমার স্বামী রাকিব সাহেব, আমাকে খুব স্পষ্ট ভাষায় বলে দিলেন, দেখো এ বাসায় কখনো মায়ের অনুমতি ব্যতীত একটা কাজ করার চেষ্টাও করবেনা। মা যা বলবে, সেটাই মেনে নিবে। কোনও জিজ্ঞাসা করা যাবেনা। শুধু এটুকুই চাওয়া তোমার কাছে।
বাপ মা মরা মেয়ে আমি, এতো আদর স্নেহ যে শাশুড়ী করেন, উনার কথা, উনি না চাইলেও আমি শুনবো। একজন মা পেয়েছি এটাই আমার অনেক বড় পাওয়া।
প্রথম প্রথম সবকিছুই বেশ ভালো যাচ্ছিলো! বছর তিনেক পর যখন সবাই বার বার বলছিলেন সন্তান নেবার কথা, তখন আমরা দুজনেই বেশ চেষ্টা করছিলাম সন্তান নেয়ার। কোনও ভাবেই আমি কনসিভ করতে পারছিলাম না। শুরুর দিকে সবাই বেশ সান্তনা দিলেও, শাশুড়ী মা একটু একটু করে রোজ কথা শোনাতে লাগলেন। আমার স্বামী সবকিছুই দেখতেন, কোনও দিন ও এসব নিয়ে টু শব্দ অব্দি করেন নি!
ডাক্তার দেখানো, পরীক্ষা নিরীক্ষা করানো, কিছুই বাদ দিলাম না। আমার সকল রিপোর্ট নরমাল আসলো! কোনও সমস্যা নেই!
কিন্তু কোনও ভাবেই আমার স্বামী কোনও টেস্ট করাতে রাজি হলেন না।
একরাতে, শাশুড়ী মা, খাবার টেবিলে খুব দূঃখ করে বলেই বসলেন,
-যেই মেয়ের কম বয়সে মা-বাপ মইরা গেসে, সেই মেয়ে আর আমার বংশে বাত্তি জ্বালাইবো কি! কুফা এক মাইয়া!
রাগে, কষ্টে সামলাতে না পেরে সে রাতে, বলে বসেছিলাম,
- আপনার ছেলেকেও টেস্ট করাতে বলেন, আম্মা। আমার তো সবই ঠিক আছে, ওর ও তো কোনও সমস্যা থাকতে পারে!
সে রাতে আমার বলতে হয়তো দেরী হয়েছিলো, কিন্তু টেবিল ভর্তি সকলের সামনে রাকিবের চড় মারতে দেরী হয়নি!
ধীরে ধীরে রাকিবের সাথে আমার একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়। দায়সারা শারীরিক সম্পর্ক ছাড়া আমাদের আর কিছুই অবশিষ্ট ছিলোনা!
সকলের রান্না করা, বাড়ির সমস্ত কিছু টিপটপ করে রাখা, শাশুড়ী মায়ের গালি খাওয়া, ননদের টিপ্পনী খাওয়া, দেবরের অনর্থক চেঁচানো, রাত শেষে রাকিবের মর্জিমাফিক ইচ্ছেপূরণ! ঘরভর্তি এতো মানুষের বাড়িতে আমি কোনঠাসা হয়ে পড়ে থাকলাম!
আমিও যে একজন মানুষ, এ ব্যাপার টাই যেনো হারিয়ে গেলো!
--------------------------------
বিয়ের সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার পর, একদিন রাকিব আমাকে বললো,
- তোমার সাথে কথা ছিলো,মহুয়া৷
- বলোনা! আমি তোমার কথা শোনার জন্য কতো আগ্রহ নিয়ে থাকি, জানো তুমি?
বলে, ওকে যেই একটু জড়িয়ে ধরতে গেছি, ওমনি আমাকে ঝামটা মেরে সরিয়ে বললো,
- জানিনা, কিভাবে নিবে, কিংবা কোথায় যেয়ে উঠবে, আসলে আমি তোমার সাথে আর সংসার করতে চাচ্ছিনা! আগামী মাসে আমি বিয়ে করবো!!
নিজের কানকে কোনওভাবে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না। অসহায়ের মতো ওর দিকে তাকিয়ে শুধু বললাম,
- সত্যি আমায় ছেড়ে দিতে পারবে তুমি?
কোনও কথা না বলে, রুম থেকে বের হতে হতে বললো, সব গুছিয়ে রেখো, কাল তোমার মামার বাসায় তোমাকে দিয়ে আসবো!
শাশুড়ী মায়ের পায়ের কাছে পড়ে ডুকরে কান্না করতে করতে বললাম,
- আম্মা বলেন না, আপনার ছেলেকে আমায় না ছাড়তে! ও আম্মা! আমি ক্যামনে থাকবো ওরে ছাড়া!
- দেখো, তোমার কান্দন বাড়ির বাইরে গিয়া কাইন্দো, আমার পোলার এদ্দিনে সুমতি অইছে, তোমারে খাওইয়া আর কতো খাওন নষ্ট করুম আমরা!! ঢংয়ের কান্দন এনে কাইন্দা লাভ নাই।
-------------------------
৭ বছর পরের কথা, আমার ছেলে সুহান কে নিয়ে আমি আর আবীর হাসপাতালে গেছি, টিকা দিতে। ওহ, আবীর আমার দ্বিতীয় স্বামী। সুহান আমাদের ছেলে।
হাসপাতাল গেটের বাইরে এসে দাঁড়াতেই দেখি, আমার প্রাক্তন স্বামী রাকিব সি এন জি খুঁজছেন। তার পাশে হুইল চেয়ারে বসা আমার প্রাক্তন শাশুড়ী, আর রোগা পাতলা এক মেয়ে। মেয়েটি আমার প্রাক্তন স্বামীর বর্তমান স্ত্রী বোধহয়।
আমি আবীর কে নিয়ে একটু এগিয়ে যেয়ে আমার প্রাক্তন শাশুড়ীর দিকে তাকিয়ে বললাম,
-চিনতে পেরেছেন কি না জানিনা! আপনাকে এখন কি বলে সম্বোধন করবো সেটাও আমার জানা নেই৷ এই যে সুহান ও আমার ছেলে, তিন বছর বয়স,আর ও আবীর, আমার স্বামী। আপনাকে দেখে কথা বলার আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিলোনা, শুধু এটুকু বলি, আমি বাঁজা নই! আপনাদের ধন্যবাদ, সেদিন বের করে না দিলে, আজ আমি সুহান এর মা হতে পারতাম না!
আমার প্রাক্তন শাশুড়ী কান্নায় ভেঙে পরলেন, আমার হাত ধরে বললেন,
- মাফ কইরা দেও মা আমারে!! আমার ভুল হইছিলো!! আমার পোলার ঘরে এখনও কোনও সন্তান হয় নাই! তোমারে আমি ভুল বুঝছিলাম মা!
হাত ছাড়িয়ে নিয়ে উনাকে বললাম,
- কিছু ভুলের মাফ হয় না! ভালো থাকবেন আপনারা।
আমার প্রাক্তন স্বামীর বর্তমান স্ত্রী, মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আমার বেশ মায়া লাগলো!
আহারে মেয়েটা!! আহারে!
-ছোটগল্প
-হায় জীবন