তোমাকে না পাওয়ার যন্ত্রনা
প্রায় ঘন্টা খানেক পর উনার লা'শ এনে আমার সামনে রাখা হলো। সবাই আমাকে ভীষণ শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছে, কারন যিনি মারা গেছেন তিনি আমার স্বামী। আমার স্বামী আশফাক রহমান।
প্রায় বছর ত্রিশেক আগে আমার আব্বার পছন্দের ছেলে আশফাক রহমান এর সাথে আমার বিয়ে হয়।তখন আমার বয়স ছিলো ১৮ আর উনার প্রায় ৩০ ছুঁই ছুঁই। ওইটুকুন বয়সে আমার আগে কখনো প্রেম কিংবা ভালোবাসা এরকম কিছু আসেনি। টানটান উত্তেজনা আর বাঁধভাঙ্গা খুশীতেই বিয়ের পিঁড়িতে বসি। যখন বিয়ের আসরে আয়নায় উনার মুখ প্রথম দেখি, মনে হচ্ছিলো কেউ একজন বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটাচ্ছে। তাহলে ইনিই আমার বর! যার সাথে আমি সারাজীবন থাকবো।
নতুন নতুন স্বামীর সাথে শহরে এলাম। কি আশ্চর্য আনন্দে আমার বিয়ের পরবর্তী দিনগুলো কাটতে লাগলো। আমার প্রতি সবসময় সে কি ভীষণ যত্ন তার। কি ভীষন সুন্দর সময় সে সব। শাশুড়ী আর স্বামী নিয়ে ছিমছাম ছোট্ট সংসার আমার।
প্রায় বছর খানেক পর আমি নিজের ভেতর নতুন অস্তিত্ব টের পাই। বিপত্তির সৃষ্টি সেই তখন থেকে। ধীরে ধীরে তিনি দেরীতে বাড়ি ফেরা শুরু করলেন। আমার প্রতি উনার যত্ন, কাটানো সময় সব কেমন যেন ফিকে হয়ে যেতে লাগলো। ঠিক একবছর আগের মানুষ আর এখনকার মানুষটা কে মেলাতে আমার ভীষণ কষ্ট হতো তখন। যতো তার কাছাকাছি যেতে চাইতাম,ততো তিনি দূরে চলে যেতেন।
ধীরে ধীরে ডেলিভারির ডেট আগাতে থাকে আর শরীরে নানান রকম পরিবর্তন আসতে শুরু করে, বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। একদিন এর জন্য ও সেসব সময়ে আমি আমার স্বামীকে কাছে পাইনি। ঢাল হয়ে আমার পাশে ছিলেন আমার শাশুড়ী।
ঠিক ঠিক যখন আর ১০ দিন বাকি আমার ডেলিভারির, সেদিন রাতে আমার স্বামী বাড়ি ফেরেন রাত দুটোয়। হয়তোবা অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও তিনি ফ্রেশ হয়ে, খেয়ে পাশ ফিরে শুয়ে থাকতেন। আমিও হয়তো বা উনাকে আর কিছুই বলতাম না।
কিন্তু হঠাৎ আমার চোখ যায় তার গলার ঠিক ডান পাশটায়! কেমন যেনো একটা লালচে দাগ! যেটা অন্যকিছুর ইঙ্গিত দেয়!
-আপনি অফিসের পর কোথায় ছিলেন? এতো রাত অব্দি??
- আমার কাজ ছিলো।
- কি কাজ ছিলো? আমি কি জানতে পারি?
- আমাকে অযথা এতো প্রশ্ন করবেনা। তুমি তোমার মতো থাকো, যা চাচ্ছো পাচ্ছো তো!
- আমার কিচ্ছু চাইনা, শুধু আপনাকে আমার পাশে চাই৷ দোহাই লাগে আমার পাশে থাকেন।
- এই রাতদুপুরে তোমার আজাইরা প্যাঁচাল আমার ভালো লাগছেনা।
- কোথায় ছিলেন? কার সাথে ছিলেন আপনি?
কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিনি আমাকে ঠাস করে চড় দিয়ে বললেন,
-যা আছো, যেভাবে আছো, থাকো। আমার সাথে ভবিষ্যতে কোনও দিনও আর এই স্বরে কথা বলবেনা।
রাতের নিস্তব্ধতায় কেউ টের ও পেলোনা কিছুক্ষন আগে কি বয়ে গেছে আমার মনের মধ্য দিয়ে।
একবার সিদ্ধান্ত নেই বের হয়ে চলে যাবো বাপের বাড়ি। কিন্তু আমার গরীব আব্বার এতগুলো ছেলে-মেয়ের মাঝে আরো একজন বিবাহিত মেয়েকে টানার মতো কোন অবস্থা ছিলোনা। সে বাড়িতে বিয়ের পর, ৭ দিনের বেশী থাকলেই মনে হতো বোঝা হয়ে গেছি ওদের কাছে।
অনাগত সন্তানের কথা চিন্তা করে থেকে গেলাম আমার স্বামী আশফাক রহমানের বাড়িতে। ছেলে নিপুনের জন্ম হলো, বছর তিনেক পর আমার মেয়ে মোহনার জন্ম হলো। শাশুড়ী মা ইন্তেকাল করলেন৷ এতো ভালো শাশুড়ী কে হারিয়ে আমার কেমন যেনো অসহায় লাগতো, একমাত্র তিনিই ছিলেন যে সবসময় আমাকে স্নেহ দিয়ে আগলে রাখতেন। কিন্তু নিজের ছেলের উপর টুঁ শব্দটি তিনি করতেন না। তাই কখনো নিজের ঐটুকু চাপা কষ্ট তাকে বলে কোনও লাভ হয়নি।
তিনি আমার দুই সন্তান এর খুব ভালো পিতা, তাদের যতো প্রয়োজন, তাদের পড়াশোনা, তাদের সুন্দর জীবন যাপন করার জন্য যা কিছু প্রয়োজন সবকিছু তিনি বেশ সুনিপুণ ভাবে করেছেন। উনার অফিসে উনি খুব ভালো কর্মী, বস ছিলেন। ভীষন ভালো কাজ করতেন। সবাই খুব পছন্দ করতো।
শুধু আমার সাথেই তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ ভীন্ন এক মানুষ। আমার স্বামীর সাথে ততদিনে আমার দায়সারা এক সম্পর্ক। শুধু চালডাল এর হিসেব, আর উনার ইচ্ছেমতো শারিরীক সম্পর্ক। এর বাইরে ভালোবাসা কিংবা মানসিক কোনও টান বলতে কিছু আর অবশিষ্ট রইলো না।
তার যতো বঞ্চনা, যতো কটু কথা যতো রাগ, তার ইচ্ছেমতো কিছু না হলে সবকিছু ছিলো ঘরবন্দী। এমনকি আমার ছেলেমেয়ে দুটোও কখনো টের পায়নি, শোয়ার ঘরের ভেতর তাদের বাবা ঠিক কতোটা পাল্টে যায়।
আত্মীয় স্বজনরা, বন্ধু বান্ধব সবাই ভাবতো আমরা ভীষণ সুখী দম্পতি! কিন্তু আমি জানতাম আমাদের মধ্যে আদতে কোনও দাম্পত্য নেই।
গত একবছর যাবৎ তার টুকটাক কোনও না কোনও অসুখ লেগে থাকতো। এতো বয়স হওয়ার পরও মানুষ টা বদলে যায়নি। খাবার ভালো না হলে, মন মতো কিছু না হলে রুমে ডেকে যাচ্ছে তাই ব্যবহার করতেন তিনি। এই ত্রিশ বছরেও কোনও কৃতজ্ঞতা নেই উনার আমার প্রতি।
কিন্তু আমি ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ উনার প্রতি। ত্রিশ বছর আমি উনার রোজগারে খেয়েছি, উনার দেয়া কাপড় পরেছি। উনার বানানো বাড়িতে থেকেছি। শুধু কোথায় যেনো সুতার টান ছিঁড়ে গেছিলো।
আজ সকালে প্রকৃতির নিয়মেই আমার স্বামী মারা যান। বাড়ি ভর্তি লোক। সবাই কান্নাকাটি করছে। ছেলে মেয়ে দুটোকে কোনও ভাবেই আটকে রাখা যাচ্ছে না। মুহূর্তে মুহূর্তে বাবার গায়ে আছড়ে পড়ছে। আমার অনেকেই শক্ত করে ধরে রেখেছে, কিন্তু আমার চোখে কোনও পানি নেই। আমার সত্যি বিন্দুমাত্র কষ্ট হচ্ছেনা। উনার মৃত্যু আমার মনে সত্যি কোনও প্রভাব ফেলেনি।
আশফাক রহমান বেশ ভালো বাবা ছিলেন, বেশ ভালো সন্তান ছিলেন, বেশ ভালো কর্মকর্তা ছিলেন। হয়তো বেশ ভালো মামা, চাচা সব ছিলেন।
কিন্তু আমার স্বামী আশফাক রহমান শুধু নামেই আমার স্বামী ছিলেন। উনার সাথে আমার কোনও আত্মিক বন্ধন ছিলোনা।
-ছোটগল্প
তিনি আমার স্বামী ছিলেন