খারাপ শাশুড়িকে উচিত শিক্ষা দিল | বউ শাশুড়ির ঝগড়া

 বউ শাশুড়ি

বউ শাশুড়ি

-'গরম ভাত করোনি কেন বউ মা?' 

শ্বাশুড়ির গম্ভীর কণ্ঠ নায়লাকে নাড়িয়ে তুলল ভেতরে ভেতরে। উপর থেকে যতটা সম্ভব স্থির থাকার চেষ্টা করল সে। তারপর বিনয়ের সঙ্গে জবাব দিলো,

-'আম্মা, আগামীকাল করে দিবো পাক্কা। আজকে চোখটা লেগে এসেছিল..'

বলে ঘাড়টা যথাসম্ভব নিচু করে নিলো নায়লা। শ্বাশুড়ির চোখে চোখ রেখে কথা বলাটা চরম বেয়াদবির পর্যায়ে পড়ে নাকি। একদিন বলেছিল, এরপর সেই বেয়াদবির তকমা গায়ে লাগার পর আর কখনো সাহস করেনি। কী দরকার শুধু শুধু ঝামেলা বাড়িয়ে? শ্বাশুড়ি মা বুড়ো মানুষ, এত কষ্ট করে সংসারটাকে গড়ে তুলেছে- নায়লার অবশ্যই উচিত এডজাস্ট করা। সে এডজাস্ট না করলে কে করবে আর? 

কল্পনা বেগম বিনিময়ে কিছু না বলে ঘরের দিকে রওনা হলেন। নায়লার বুক কেঁপে উঠল। শ্যামল এক্ষুনি ঘর থেকে বের হবে। মা'কে খাবার টেবিলে দেখতে না পেয়ে নিশ্চয়ই ডাকতে যাবে। তারপর যখন রসিয়ে রসিয়ে দু-আলাপ শুনবে বউয়ের নামে,ওমনি তেতে আসবে নায়লাকে মারতে। এর আগে কতবার গায়ে হাত তুলেছে! ইয়ত্তা নেই...


নায়লার বিয়ের বয়স আট মাস। অথচ তার অভিজ্ঞতা যেন আটটি বছর পার করে গেছে! পারিবারিক ভাবে শ্যামলের সঙ্গে বাঁধা পড়বার কিছুদিন পর থেকেই নায়লা বুঝতে শিখে গিয়েছিল, সংসারে 'কম্প্রোমাইজ' এবং 'এডজাস্টমেন্ট' শব্দ দু'টি কেবল তার জন্য তোলা। এমনকি নায়লার মা মমতাও বারবার মেয়ের কানে ঢুকিয়ে দিয়েছেন এই কথাটি। যাই হয়ে যাক না কেন, সবসময় চোখে-কানে-ঠোঁটে খিল এঁটে থাকাটাই মেয়েদের কর্তব্য। বলা চলে, মূক ও বধিরের শত্রু হয় না। তাই শিক্ষিত নায়লাকেও নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে শিক্ষার জাল থেকে। ক্রমশ ডুবে চলেছে অন্ধকারের মাঝে। নিকষ কালো আকাশের মাঝে চাঁদ তো নেই, তবে মাঝে মাঝে যে তারা দেখতে পাওয়া যায়,তাই যেন ওর শেষ ভরসা। ওর তারার ন্যায় সুখগুলো মাঝে মাঝে আসে, তারপর আবার ডুব মারে। কোথায় যে হারিয়ে যায়,নায়লা ঠিক জানে না।


ফজরের আযান পড়ছে। আজকে প্রথম রমজান। বাবার বাড়িতে থাকাকালীন মা সবসময় ডেকে তুলতেন আদুরে মুখটাকে। ঘুম ঘুম চোখে যখন ডায়নিং টেবিলে গিয়ে বসত নায়লা,বাবা তখন সহাস্যে প্লেটের ভাত মেয়ের সঙ্গে শেয়ারে লেগে পড়তেন। টুকটুক করে বাবার হাতে খেয়ে,কোনোরকমে নামাযটুকু আদায় করে আবার ঘুমের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাতো নায়লা। এইতো কিছুদিন আগের কথা, অথচ নায়লার মনে হয়, কতবছর হয়ে গেল- বাবার হাতে খাওয়া হয় না! সংসারের বোঝা কাঁধে বইয়ে গিয়ে কাঁধটাই ভেঙে পড়েছে, অথচ মাথা তুলে সে দিব্যি হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে! সব গুছিয়ে রাত বারোটায় শুতে গিয়ে স্ত্রী'র কর্তব্য পালন করতে করতে কখন যে ঘড়ির কাটা একটা ছুঁয়েছে,নায়লা টের পায়নি। শ্যামল ঘুমিয়ে পড়ার পর কোনোরকমে গোসলটা সেড়ে বিছানায় গা এলাতেই দু'চোখ বন্ধ হয়ে আসে আপনা আপনি। যখন চোখ খোলে তখন ঘড়ির কাটা সাড়ে তিনটা ক্রস করেছে। ভাত গরম করার সময় টুকু নেই। হুড়ুমদুড়ুম করে তরকারি গরম করে শ্বাশুড়ির পাতে দিয়েছিল সে। তাও মন পেল না! শ্যামলের কাছে একগাদা নালিশ দিয়ে,বিচার দিয়ে,রসিয়ে রসিয়ে একটু ফোঁপানি শেষে শ্বাশুড়ি এসে ঠিকই গিলে গেছেন, নায়লার খাওয়াটা শুধু বন্ধ হয়ে গেছে। কোনোরকমে তিন চার লোকমা গলায় ঠুসে পানি দিয়ে গিলে নিয়েছে সে। তরকারি নিয়ে আসার বাহানা করে উঠে গেছে রান্নাঘরে। কেউ দেখে ফেলার আগেই চোখ জ্বালা করা অশ্রুটাকে টেনেটুনে বাইরে ফেলে দিয়েছে নায়লা। মুখে টেপ দিয়ে আঁটকেছে কৃত্রিম হাসি। নইলে আবার শ্বাশুড়ি বলবেন,

-'একটু কিছু বলা যায় না, গাল ফোলায়! ঢং যত..'


লাইট জ্বলে উঠতেই নায়লার কপালের উপর থেকে হাত সরিয়ে উঠে বসল। শ্যামল এসেছে নামায পড়ে। ভোরের আলো এখনো ফোঁটেনি বাইরে। আবহাওয়া বেশ শীতল। কিন্তু নায়লার মন ছুঁতে ব্যর্থ তা। নায়লার বুকটা কাঁপছে দুরুদুরু করে। শ্যামলের ভাবভঙ্গি ভালো ঠেকছে না। 

হুকের সঙ্গে পাঞ্জাবিটা আঁটকে দিয়ে বাতি নিভিয়ে নায়লার পাশের জায়গাটা দখল করল শ্যামল। কয়েক সেকেন্ডের ভয়ংকর নিরবতা। নায়লা ধীর ভাবে বিছানায় শুলো। তারপর আরও কয়েকটা সেকেন্ড, শোনা গেল গাঁকগাঁক করে চেঁচানো কণ্ঠস্বর, শ্যামল চাপা চিৎকারে বলছে,

-'তোমার সাহস কী করে হয় আম্মা'কে ঠান্ডা ভাত খাওয়ানোর? কী দরকার ছিল ঘুমানোর? একেবারে সেহেরির পর ঘুমানো যেতো না?'

নায়লা কেঁপে উঠল ভয়ে। মনে মনে প্রার্থনা ছুঁটছে, 'গায়ে যেন হাত না পড়ে খোদা, দেখো তুমি।'

ঠোঁট নাড়িয়ে বলার চেষ্টা করল,

-'আ..মার শরীরটা ভালো লাগছিল না। সারাদিন ঘরের কাজ..'

শ্যামল পূর্বের ন্যায় চিৎকার করে উঠল,

-'যেই না কাজ ঘরের! রোজ রোজ বাহানা দেবে না আমায়! তোমার মতো আরও মেয়েরা আছে,সবাই-ই করে। তুমি একা তো নও! আজকের মতো ছেড়ে দিচ্ছি। মা'কে যদি আর একদিনও ঠান্ডা ভাত খাওয়াও, গরম পাতিলের ভেতর তোমার মাথাটা ঠুসে ধরব আমি। মনে রেখো।'

চোখের কোল বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল নিরবে। অন্ধকারের মাঝে শ্যামলের নজরে এলো না তা। নায়লা ঠোঁট খুলে কিছু একটা বলতে গিয়ে চেপে গেল। কী দরকার আছে ঝামেলা বাড়ানোর? এবারও এডজাস্টটা না হয়, ও-ই করুক! 


***


মিনির ন'টার সময় কলেজ থাকে। সে ফ্রেশ হয়ে, ব্যাগ গুছিয়ে বাইরে এসে দেখল, টেবিলে কোনো নাশতা দেওয়া হয়নি এখনো। মিনির পরনে সাদা কলেজ ড্রেস, চিপা করে বানানো পায়জামা- চুলগুলো উঁচু করে ঝুঁটি পাঁকানো। চোখের উপরে মোটা আইলাইনার টানা, আখিপল্লবে মাশকারার ছোঁয়া। হাতে জ্বলজ্বল করছে সদ্য লাগানো গাঢ় নীল নেইল পলিশ। সিনেমাতে যেভাবে নায়িকারা কলেজে যায়, এ যেন তারই বাস্তব চিত্র! হালকা গোলাপি লিপগ্লস লাগানো ঠোঁটজোড়া ভেঙে একটা বিরক্তিকর আওয়াজ অস্ফুটে বেরিয়ে এলো। নায়লার উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে তার। সে কী জানে না, এই সময়টা ওর কলেজ যাওয়ার? খালি পেটে বাসা থেকে বেরোনো যায় নাকি? আর একদম রোজা টোজা রাখতে পারে না ও। রোজা রাখলে কলেজ করবে কী করে? টিকটক ভিডিও বানাবে কেমন করে সেজেগুজে? আর ফিরতি পথে সদ্য হওয়া বয়ফ্রেন্ডের ঠোঁটে চুমুই বা খাবে কী করে? এসব যে রোজার চেয়েও অনেক দামী মিনির কাছে! রোজা তো রাখে বুড়োরা। তাদের কাজকাম নেই, মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এসেছে। তাই নামায পড়ে,রোজা রেখে নিজেদের গুনাহ গুলোর প্রায়শ্চিত্ত করে একটু,এইতো! মিনির কুবুদ্ধিতে আঁটসাঁট মস্তিষ্কখানায় এইটুকুই ইসলামের সংজ্ঞা! তার এখন যৌবনের বয়স। এ বয়সটা মজার, নিষিদ্ধ কাজের সুখের- আর মিনিও তাই করছে। একদম হেলায় ফেলায় সময়টাকে হারাচ্ছে না ও। 


বড় ভাইয়ের ঘরে সবসময় নক করে ঢোকা উচিত। তাতে সে বিবাহিত হোক অথবা অবিবাহিত,যদিও এই কমনসেন্স মিনির নেই। সে ঠাস করে দরজা খুলতেই ঘুমন্ত নায়লার শুভ্র মুখখানা ভেসে উঠল। দাঁতে দাঁত চেপে কিছু একটা বিড়বিড় করল মিনি। তারপর হন্যে পায়ে বেরিয়ে এলো। ফজরের নামায পড়েই শুয়েছে নায়লা। সারাদিনের কাজের ব্যস্ততার মাঝে, রোজা রেখে, ক্লান্ত শরীরটাকে একটু আরাম দিচ্ছিলো সে। কিন্তু সহ্য হলো না সেটা কারো। একটু পরই রুমে ঢুকলেন কল্পনা বেগম। মিনি তাকে ডেকে এনেছে,ননদের নাশতা না বানিয়ে দিয়ে বাড়ির বউ ঘুমাচ্ছে- এ যেন দণ্ডনীয় অপরাধ! এর কী কোনো ক্ষমা আছে? 


ঘুমের মধ্যেই নায়লা নিজের শরীরটাকে অনেক হালকা অনুভব করতে লাগল হুট করেই। কয়েক সেকেন্ডের মাঝে চুলের গোড়ায় একটা তীক্ষ্ণ ব্যথা ছড়িয়ে পড়তে লাগল ক্রমশ। নায়লার মস্তিষ্ক জানান দিলো, সামথিং ইজ রং! চোখজোড়া আপনা আপনি খুলে গেল, এবং মুহূর্তেই তাজ্জব বনে গেল সে। কল্পনা বেগম চুলের মুঠি ধরে টেনে তুলেছেন ও'কে। ও চোখ খোলাতে সে যেন জিতে গেল। তারপর লম্বা গলায় ধরল গীত, যার আদ্যোপান্ত একটাই কথা- কীভাবে ননদ কে না খাইয়ে বিদায় করে? কুম্ভকর্ণের মতো পড়ে পড়ে ঘুমায়? বাড়ির বউয়ের এমন আচরণ মানায় না। বাড়ির বউয়েরা হয় মেশিন, তাদেরকে দশ হাত দিয়ে দশদিক একই সময়ে সামলাতে হয়। সামলাতে না জানলেই সে অলক্ষী, যৌক্তিক কথা বললে বেয়াদব, বাবা-মা আদব শেখায় নাই- সহ নানান ধরনের সামাজিক ট্যাগ পেয়ে বসে। 


নায়লা হতবাক হয়ে চেয়ে রইলো। নিজে রোজা রেখে,ঘর সামলিয়ে ঢেমরি ননদের জন্য সকালের নাশতা বানাতে হবে?নায়লার হুট করেই মেজাজ নষ্ট হলো। সে গটগট পায়ে বিছানায় আধশোয়া হয়ে মাত্রই ঘুম থেকে জাগা শ্যামলকে বলল,

-'আমিও তো ফজরের পর শুয়েছি শ্যামল। তোমার ঘুম দরকার, মায়ের ঘুম দরকার, তাহলে কী আমার ঘুম দরকার হয় না? আমি কী এই বাসার কাজের বুয়া? যদি কাজের বুয়া হই, তাহলে বিয়ে করেছো কেন? শরীরের চাহিদা ন্যায় ভাবে আদায়ের জন্য?'

সপাটে গালে এসে চ'ড় পড়ল। নায়লা ছিঁটকে সরে যায় পেছনে। 

-'কী বললি তুই.. শা'লী.. কী বললি তুই?' 

রাগে হি হি করে কাঁপতে থাকা শ্যামল কোমর থেকে টেনে বেল্ট খুলে নেয়। এরপর পি'টি'য়ে যায় মনের আঁশ মিটিয়ে। সেই সঙ্গে কল্পনা বেগম ও মিনির মনেরও আঁশ মেটে।

'খালি পেটে ক্লাস করব কেমনে?' বলে মুখ গোমড়া,ঠোঁট ভেঙে মন খারাপের ভাব দেখিয়ে মায়ের থেকে একশো টাকার দুটি নোট নিয়ে বেরিয়ে পড়ে মিনি। আজ আর কলেজ গিয়ে লাভ নেই। নাঈম কে নিয়ে কোথাও বেরিয়ে আসা যায়। ও, বলা হয়নি, নাঈম মিনির সেই সদ্য হওয়া বয়ফ্রেন্ড!


গল্প- শ্বাশুড়ি মা

পর্ব- ১

লেখনীতে- অলিন্দ্রিয়া রুহি


শ্বাশুড়ি_মা

পর্বঃ২ (শেষ পর্ব)

অলিন্দ্রিয়া_রুহি


-'হ্যালো মা।' নায়লার ভাঙা ভাঙা কণ্ঠস্বর, ওপাশ থেকে মায়ের গলা খানিকটা রুক্ষ শোনালো,

-'তুই ফের ঝগড়া করেছিস জামাইয়ের সাথে? হ্যাঁ রে নায়লা,তোকে কী আদবকায়দা কম শিখিয়েছি বল? তবুও বারবার আমাদের অপমান না করে তোর হচ্ছিল না?' 

নায়লা স্থির কণ্ঠে জানতে চাইলো,

-'কে বলেছে তোমাকে? শ্যামল?'

-'তোর শ্বাশুড়ি। মাত্রই কথা হলো। মেয়েকে কোন কেতাব পড়িয়ে বড় করেছি,জানতে চাইলেন। নায়লা,তোকেও বলি মা,একটু মানিয়ে গুছিয়ে চললে কী হয়? সংসার তো তুই একা করিস না! কত মেয়ে সংসার করে যাচ্ছে। বিয়ের একটি বছর হতে পারল না,এখনই এই অবস্থা! মানসম্মান কিছু অন্তত রাখ আমাদের..'

মা হাঁকিয়ে গেলেন। নায়লা চুপটি করে সব শুনল। তারপর একসময় একটি কথার প্রত্যুত্তরে বিড়বিড়িয়ে জবাব দিলো,

-'অনেক মেয়েরা সংসার করে, কারণ তারা 'লোকে কী বলবে' এই কথাকে ভয় পায়। আমি ভয় পেতাম না,তোমরা পাইয়েছো। তোমাদের সম্মানের কথা ভেবে আমি নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়েছি, অথচ সেই আমিই ভালো না!!'

মা চিল্লালেন,

-'কী বিড়বিড় করিস? যা বলার খুলে বল।'

নায়লা যেন কৌতুক শুনেছে,এমনই করে হেসে বলল,

-'কী খুলে বলব মা? সবখানেতে আমারই তো দোষ।'

-'মা রে তোর ভালোর জন্য বলি। পুরুষ মানুষ মাথা গরম হয় সবসময়। এটাই ইহজাগতিক নিয়ম। সবাই মেনে চলে, তুইও চল। যত তাড়াতাড়ি এসব মেনে নিতে পারবি,তোর জন্যেই ভালো হবে। সংসারের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দে মা। তবেই না সুখ পাবি? একদিন বুঝবি এই সংসার কী জিনিস।'

-'আমার আর কিচ্ছু বোঝার নেই মা। আমি বেশ ভালো বুঝে গেছি।'

মা বকলেন আরও একবার,

-'কথা শুনিস না যে এইজন্যে ভাল লাগে না। বিয়ে হচ্ছে না হচ্ছে না করেও শেষমেশ এত কষ্টে বিয়ে দিলাম। গায়ের রংটা একবার দেখ নিজের..! এরপরও যদি সংসার করতে না পারিস.. নিজের কপাল নিজে পুড়াইস না। এখনো সময় আছে। যেভাবে শ্বাশুড়ি, জামাই বাবাজী বলে,ওভাবেই চল। রাখছি।'

টুট টুট জাতীয় শব্দে বোঝা গেল ফোন কেটে গেছে। তবুও অনেকক্ষণ ফোন কানে চেপেই বসে রইলো নায়লা। ওর কানে এখনো বাজছে একটি কথা, 'গায়ের রংটা একবার দেখ নিজের' - নিজের মা! যে মা দশ মাস দশ দিন পেটে রেখে, ৫৪ টি হাড্ডি ভাঙার সমান যন্ত্রণা সহ্য করে, নাড়ি ছিঁড়ে যাকে জন্ম দেয়, সেই তাকেই কথা শোনায় গায়ের রঙ নিয়ে? আচ্ছা,নায়লা কী নিজেই নিজের গায়ের রঙ কী হবে তা সেট করে পৃথিবীতে এসেছিল? নাকি বিধাতা ভালোবেসে দিয়েছেন? এই চরম সত্য টুকু কেন অনেকেই বুঝতে চায় না,মানতে চায় না? নায়লার চোখ ফেটে কিছু জল বেরিয়ে এলো। বাম হাত দিয়ে মুছতে গিয়ে টনটনে ব্যথা অনুভব করল। সকাল বেলায় শ্যামল ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার সময় বিছানার কোণায় খুব শক্ত আঘাত পেয়েছে। হাতটার মাঝখান ফুলে উঠেছে ইতিমধ্যেই, নীলচে ভাব- ব্যথাটা অসহনীয় হয়ে উঠছে। ঠোঁট টিপে যন্ত্রণা সংবরণ করার চেষ্টা করল সে। তারপর ধীরস্থির ভাবে উঠে দাঁড়াল। বিকেল হতে চলেছে। আজ প্রথম ইফতারি। আয়োজনে ত্রুটি থাকলে হয়তো রাতেও ভাতের জায়গায় একগাদা মা'র জুটবে কপালে! 

এই গল্প শুধু নায়লার নয়, ওর মতোই আরও অনেক নায়লার- যারা শারীরিক ভাবে বেঁচে গেলেও মানসিক ভাবে বিন্দুমাত্র শান্তি পায় কীনা সন্দেহ! যারা নিজেদের শখ,আহ্লাদ,ইচ্ছে- সব মাটিতে কবর দিয়ে নিজেদের করে তুলেছে মানুষ প্রায় রোবট। যারা প্রতিনিয়ত হেরে যাচ্ছে নিজেদের কাছেই। যারা বাঁচতে হয় বলেই বাঁচে!


***


কোমর জড়িয়ে মিনিকে আরও কাছে টেনে বসালো নাঈম। মিনি জড়সড় ভয়ে, পাবলিক প্লেসে এতটা খোলামেলা ভাবে বসাটা কতটুকু সমীচীন কে জানে! কলেজ যায়নি আজ, সেই সময়টুকুতে নাঈমের কথা মতো চলে এসেছে এলাকার ধারের এই পার্কে। মিনি চেয়েছিল ভালো কোনো রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসতে,একটু ভালো জায়গায় ঘুরে বেড়াতে,কিন্তু এখান থেকে উঠতে পারলে তো! গাছের আড়ালে।টেনে নিয়ে মিনিকে চেপেচুপে এখন আবার এই বেঞ্চে এসে বসেছে নাঈম। কিছুতেই উঠছে না এখান থেকে। মিনি কয়েকবার ইনিয়েবিনিয়ে বলেছে, 

-'চলো না,কোনো রেস্টুরেন্টে যাই নাঈম।'

নাঈম প্রত্যুত্তরে জ্ঞানী ভাব নিয়ে বলেছে,

-'আসল প্রেম তো দশ টাকার বাদামে হয় মিনি। রেস্টুরেন্টের চাকচিক্যতে ভালোবাসার রঙ গুলো ফিঁকে।'

শুনে মিনির আবেগী মন ভিজে গেছে। আহারে, ছেলেটা কত কাব্যিক! কত সহজ-সরল! এরকম একজনকে নিজের জীবনে পেয়ে মিনির হঠাৎ খুব গর্ব অনুভব হচ্ছে। 


পার্কটা শুধু প্রেমিক-প্রেমিকাদের অংশ নয়, রোজ অনেকেই হাটতে আসে এখানে। কেউ কেউ বড় রাস্তা ঘুরে বাজারে যাওয়ার বদলে পার্কের শর্টকাট ব্যবহার করে। সেরকম ভাবে আলতাফ হোসেনও পার্ক দিয়ে বাজারে যাচ্ছিলেন। যেতে যেতে একটা বেঞ্চের দিকে চোখ আঁটলো উনার। মিনি না? বয়স্ক চোখজোড়া জুম করে দেখল, আসলেই তো মিনি! ছিঃ! ছিঃ! একটা ছেলে এভাবে কাঁধের উপর হাত জড়িয়ে বসে আছে? মিনিকে বসিয়ে রেখেছে উরুর উপর? নিজের এলাকার পার্কে এতটা নোংরা ভাবে বসতে মিনির গায়ে বাঁধলো না? আলতাফ হোসেন দ্রুত পায়ে বাড়ির পথ ধরলেন। আপাতত বাজার করার চেয়েও এই খবর ছড়িয়ে দেওয়া যেন অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। নাঈমের সাথে কথার ছলে থাকা মিনি ঘূনাক্ষরেও টের পেল না, আলতাফ হোসেন যাওয়ার আগে ক'টি ছবিও তুলে নিয়ে গেছেন।


***


-'কী গো মিনির মা, আজকাল দেখি দেখাই যায় না।'

বলতে বলতে সোফার উপর নিজের মোটাসোটা শরীরের ভার ছেড়ে দিলেন আলতাফ হোসেনের স্ত্রী ময়না বেগম। কল্পনা বেগম পাশের সিটটা নিজের দখলে নিতে নিতে মুখ বাঁকালেন,

-'আমার কী আর ঘুরার কপাল আছেরে বইন। ঘরের কাজ করতে করতেই তো...'

-'সে কী! আপনার ছেলের বউ তাইলে করে কী? সে কী কিছু করে না?'

চোখ কপালে তুললেন ময়না বেগম। প্রত্যুত্তরে কল্পনা বেগমের নাসিকাপথ বেয়ে বেরিয়ে আসে মেকী দীর্ঘশ্বাস, যেন এই বাড়িতে তার চেয়ে অবহেলিত বস্তু আর কিছু নেই। নিখুঁত অভিনয়- দূর থেকে চেয়ে দেখল নায়লা। জবাব দেওয়ার জন্য শক্তি তো দূরে থাক, ভাষাই নেই। সে দ্রুত হাতে পেয়াজু নাড়াচাড়া করতে লাগল। গরম তেলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ জ্বালা করতে লাগল। এতটা দুর্বল কবে হলো সে! কথায় কথায় কান্না আসে শুধু। 


-'কিন্তু যখনই আপনাদের বাসায় আসি, আপনাকে বসাই তো দেখি আপা। আর আপনার ছেলের বউকে রান্নাঘরে।' 

ফিচেল হাসিতে ময়না বেগমের ঠোঁট মাতোয়ারা। তিনি খুব ভালো করে জানেন, কল্পনা বেগম কত কাজ করেন ঘরে! ময়না বেগমের কথার প্রত্যুত্তরে কল্পনা বেগমের চোখ বড় বড়,গোল গোল,কী উত্তর করবেন ভেবে না পেয়ে দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টালেন।

-'আরে,রাখেন তো ওর কথা। আপনার ছেলেমেয়ে সব ভালো?'

-'হুম,ভালো ভালো।' বলতে বলতে চাপা হাসিতে ভেঙে পড়েন তিনি। ওদিকে রান্নাঘর থেকে এই দৃশ্য দেখে ছলছল চোখের নায়লাও গুটিগুটি হাসিতে ফুঁটে উঠে। চোখের কোল বেয়ে বেরিয়ে আসা জল চট করে মুছে নিয়ে কাজে মনোনিবেশ করে। শ্বাশুড়ি মা'য়ের মুখের উপর জুতোর বারিটা ঠিক ভাবে পড়েছে একদম। এটাই উচিত! 


-'তা আপনার ছেলেমেয়ে কই সব? ওরা ভালো?'

প্রশ্ন করেন ময়না বেগম, তার চোখমুখ এখন সিরিয়াস খানিকটা। আসল কথা পাড়বেন শীঘ্রই।

-'ছেলে তো অফিসে, আর মিনি কলেজ গেছে। কলেজ থেকে কোচিং শেষে একেবারে বাসায় আসবে।' 

একটু বিরতি টেনে কল্পনা বেগম ফের শুরু করলেন,

-'আমার এই মেয়েটা এত পড়ালেখা পাগল! কী বলব আর। মানুষের ছেলেমেয়ে নাকি পড়তেই চায় না, আর আমার মেয়েটাকে আমি টেবিল থেকে উঠাতে পারি না। সারাদিন মুখ গোঁজ করে থাকে বইয়ের মধ্যে। রাতেও দেড়ি করে শোয়। পড়ে নাকি। দোয়া করবেন,ভালো একটা রেজাল্ট করে আমাদের সবার মুখ উজ্জ্বল করতে পারে যেন।'

ময়না বেগমের ঠোঁটে আবারও চাপা হাসি, দূর থেকে নায়লা দুরুদুরু বুক নিয়ে তাকিয়ে- মিনি যে কত পড়ে তা নায়লার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না। বইয়ের ভাঁজে সবসময় ফোন চালায়,রাতের বেলা পুনপুন করে কথা বলে কার সাথে যেন- সবই শোনে,দেখে,বোঝে নায়লা। বলে না কিছু। কী দরকার অহেতুক অশান্তি করার? এই বাড়িতে অশান্তি মানেই নায়লার উপর দিয়ে ঝড় বয়ে যাওয়া। 

-'দোয়া তো সবসময়ই করি আপা। কিন্তু এতটাও সহজ-সরল হইয়েন না। মেয়ে যা বলে তাই শুনে বিশ্বাস কইরেন না। একটু চোখ,কান খুলে মেয়ে কই কই যায়,সেটাও খেয়াল রাইখেন।'

ঝটকা খেল যেন কল্পনা বেগম, ভ্রু কুঁচকে বললেন,

-'মানে?'

-'এই যে মানে..'

বলে ফোনের গ্যালারি থেকে কিছু ছবি তুলে ধরলেন সামনে। কল্পনা বেগমের মনে হলো, মাটি ফাঁক হয়ে তাকে সহ নিয়ে ঢুকে গেলে অনেক ভালো হতো। এতবড় অসম্মান! জড়সড় মুখের কল্পনা বেগমকে দূর থেকে দেখে নায়লার মন বাগানে আজ অনেকদিন পর প্রজাপতির উড়াউড়ি। কারো অসম্মান দেখে নয় বরং সবসময় মেয়েকে নিয়ে বানিয়ে বানিয়ে এটাসেটা বলায় যে আজ মুরগীর বিষ্ঠা পড়েছে,তাই দেখে এই প্রশান্তি। নায়লা না দেখেও বুঝল, মিনিকে নিয়েই কিছু একটা ঝামেলা হয়েছে। হোক, তাতে ওর কিছু যায় আসে না। 

-'এলাকার পার্কেই এই অবস্থা, তাহলে দূরে কোথাও গিয়ে কী করে কে জানে! রুমে গেছে কীনা- তা নিয়েও প্রশ্ন জাগে আপা। আপনার মেয়ে, কিন্তু আমিও তো ওকে মেয়ের চোখেই দেখি,বলেন? তাই যখন এসব দেখলাম, সহ্য হলো না, ছুটে এলাম আপনার কাছে। আপনাকে দেখানোর জন্য। লাগাম টানুন আপা। এই কথা কেউ জানে না কিন্তু জানতে কতক্ষণ বলেন?' 

বলে ফিচেল হাসলো মহিলা, ইতিমধ্যেই ৫-৬ জনকে জানিয়ে তবে এসেছে এখানে। ফ্ল্যাটে একটা ছি,ছি পড়ে গেছে। কল্পনা বেগমের মাথা ঘুরে উঠল। ঘর থেকে বাহিরে বেরোলেই যে সবার প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে হবে!- রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে উঠে উনার। আজ আসুক মিনি। না, মিনি আসা অবধি অপেক্ষা করবেন না উনি। এখনও নিশ্চয়ই ওই পার্কে আছে। ওখানেই যাবেন তিনি এবং হাতেনাতে ধরে নিয়ে আসবেন দুটোকে। কল্পনা বেগম একটি কথাও না বলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। ময়না বেগম হাসেন, তারপর উঠে আসেন রান্নাঘরে। 

নায়লা তাকে দেখে জড়সড় হয়ে যায়। মহিলাটি ভালো না খারাপ, বোঝার উপায় নেই। সবসময় সবার পেছনে কাঠি খোঁচেন, কিন্তু নায়লার সঙ্গে আজ পর্যন্ত এমন কিছু করেননি। নায়লা সালাম জানিয়ে নিজের কাজ করতে থাকে। ময়না বেগম কয়েক মিনিট নিরবে তা দেখে জিজ্ঞেস করলেন,

-'তুমি কোন ক্লাস পর্যন্ত পড়ছো মা?'

নায়লা বিনয়ের সঙ্গে বলল,

-'জি, অনার্স শেষ করেছি।'

-'আমার বড় মেয়েটাও অনার্স শেষ করছে। একটা ভালো জায়গায় চাকরি করে। মাসে সতেরো হাজার টাকা বেতন। ওর একার জন্য সঠিক, তাই না?'

-'সতেরো হাজার টাকা? হুম, আপুর একার জন্য একদম পারফেক্ট। সতেরো হাজার টাকায় অনেক কিছু করা যায়। একা চলা কোনো ব্যাপার না এই টাকায়।'

-'তাহলে তুমি কেন করছো কেন? কেন ম'রছো এই বাসায় থেকে?'

আচমকা এরকম প্রশ্নে নায়লা হকচকিয়ে উঠে। তবে কী ময়না বেগম ওর সংসার ভাঙার বুদ্ধি দিতে এসেছে? খানিকটা শক্ত চোয়ালে নায়লা তাকাল,ঠোঁটে জবাব নেই। ময়না বেগম আশ্বস্তের হাসি হেসে বললেন,

-'তোমার সংসার ভাঙার কোনো ইচ্ছা নাই মা। কিন্তু একটা জীবনকে এভাবে বিনা কারণে ধুকে ধুকে ম'রতে দেখলে কার না খারাপ লাগে।'

নায়লা এবারেও নির্বাক, তার কাছে আসলে কোনো জবাব নেই।

ময়না বেগম বলে চলেছেন,

-'যুগ পাল্টেছে। একটা সময় ছিল, যখন শ্বশুর বাড়ির অত্যাচার মেনে নিয়ে মেয়েরা ঠোঁট টিপে থাকতো। মাটি কামড়ে থাকতো। তখন তো এত শিক্ষা ব্যবস্থা চালু ছিল না। আর না মেয়েদের জন্য চাকরির অহরহ সুযোগ ছিল। বলতে গেলে,সেই সময়ে অত সাহসই ছিল না কারো। কিন্তু এখন আছে। এখন চাইলেই মেয়েরা সারাজীবন একলা কাটিয়ে দিতে পারে। জীবনে চলতে গেলে পুরুষের উপর নির্ভরশীল হয়ে নয়, নিজের সব দায়িত্ব নিজেই বহন করতে পারে। তুমিও পারবে মা। একবার চেষ্টা করে দেখো। সাংসারিক জীবন নিয়ে তোমার চেয়ে আমার জ্ঞান বেশি। সেই জ্ঞান থেকে বলছি, যদি ভেবে থাকো, নিজেকে স্যাক্রিফাইস করবে এদের জন্যে তবে ভুল ভাবছো। জীবনে কিছু স্যাক্রিফাইস করতে হলে নিজের জন্য করা উচিত। অন্যের জন্য নয়। আর...মানুষ স্যাক্রিফাইস করে মানুষের জন্য, অমানুষের জন্য নয়। তুমি যতই করো, দিনশেষে তুমিই নির্যাতিত, নিপীড়িত হবে।'


নায়লার চোখ বেয়ে অঝোরে পানি পড়ছে। এই কথাগুলো যে সে ভেবে দেখেনি তা না, কিন্তু ভয় হয়। এখান থেকে বেরিয়ে কোথায় যাবে সে? নিজের বাড়িতে? ওখানে তো আরেক অশান্তি- সেই কথাই বা কী করে বোঝাবে নায়লা? 

নায়লাকে কথা বলতে না দেখে ময়না বেগম ওর কাঁধে হাত রেখে নরম গলায় বললেন,

-'কেঁদো না। শ্বাশুড়ির পাশে মা নামটা তখনই যুক্ত করবে যখন সে প্রকৃত মা হয়ে উঠতে পারবে। যদি না পারে তাহলে তাকে 'মা' ডেকে 'মা' ডাকটার অমর্যাদা করো না। 'মা' অনেক মূল্যবান একটি শব্দ। দশ মাস দশ দিন গর্ভে রেখে, যুদ্ধ করে জন্ম দেওয়ার পরও আরও অনেক পরিশ্রম, ধৈর্য্য ধরতে হয় সন্তানের মুখ থেকে বহুল আকাঙ্ক্ষিত 'মা' ডাকটি শোনার জন্য। আর এসব ছেলের মা-রা সেটা এক নিমিষেই শুনতে পারে তো তাই আর এটার মর্মার্থ বোঝে না। তাই শ্বাশুড়ি শ্বাশুড়ি, আর মা মা... অমানুষ শ্বাশুড়ি কে মা ডেকে 'মা' ডাকটিরই সম্মানহানি করো না।'


নায়লা চোখের জল মুছে নিলো চট করে। ডায়নিং রুমে ধুপধাপ শব্দ। মিনিকে জুতো দিয়ে পেটাতে পেটাতে ঘরে ঢুকছেন কল্পনা বেগম। ছোট খাটো একটা জটলা পাকিয়ে গেছে। ময়না বেগম দ্রুত সেদিকে এগিয়ে গেলেন। চুলো নিভিয়ে নায়লা তড়িঘড়ি হাতে ফোন করল শ্যামলকে। শ্যামল ফোন ধরেই ঝাঁঝিয়ে উঠল তারস্বরে,

-'কী সমস্যা? বাসায় শান্তি নাই, এখন অফিসেও শান্তি পাবো না? বারবার ফোন দিচ্ছো কেন?'

অন্যসময় হলে মনে আঘাত নিয়ে সরি বলতো নায়লা, এবার বলল না। পক্ষান্তরে শীতল গলায় পাল্টা প্রশ্ন করল,

-'আমি তো একবারই ফোন দিলাম, বারবার দেইনি শ্যামল।'

-'কেন দিবে? একটু পর ইফতারি, আমি আসতাম তো। তখন বলা যেতো না? এখন কত ব্যস্ত জানো? তোমার কোনো আইডিয়া আছে সারাদিন কত কাজ থাকে আমার? টিপিক্যাল হাউজওয়াইফ কোথাকার!!'

-'একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার জন্য ফোন দিছি শ্যামল।'

পূর্বের ন্যায় শীতল স্বর, যেন শ্যামলের ধমকাধমকি কানেই যায়নি নায়লার।

-'কী গুরুত্বপূর্ণ কথা? জলদি বলো।'

গাঁকগাঁক করে চেঁচায় শ্যামল, নায়লা ঠান্ডা গলায় বলল,

-'আমি এখন, এই মুহূর্তে এখান থেকে বেরিয়ে সোজা থানায় যাবো। প্রথম আসামী তুমি, দ্বিতীয় আসামী তোমার মা, তৃতীয় আসামী তোমার ছোট বোন, আর সর্বশেষ আসামী আমার মা'কে করে একটা মামলা ঠুকে দিবো। তারপর তোমার কাছে ডিভোর্স লেটারটা পাঠিয়ে দিলে চুপচাপ সই করে দিও। ভুলেও আর কোনোদিন আমার সামনে আসার চেষ্টা করো না। তোমার সাথে এখন,এই মুহূর্তে- আমি সব সম্পর্ক শেষ করলাম।'

-'নায়লা, আর ইউ অলরাইট?'

শ্যামল চমকে গেছে। নায়লা এসব কী বলছে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না সে। নায়লা ফিসফিসিয়ে বলল,

-'ছিলাম না, তবে এখন থেকে আমি অলরাইট। আমি নায়লা, না কারো সন্তান, না কারো স্ত্রী। আমি শুধু আমার একার,আমার নিজের। যারা আমার মূল্য দিতে জানে না,তাদেরকে বিন্দুমাত্র পরোয়া করি না আমি।'

ফোন কেটে দিলো নায়লা। শ্যামল ফোন ব্যাক করল, নায়লা ধরল না। সাইলেন্ট মুড করে উঠে দাঁড়াতেই ঘরে কল্পনা বেগম প্রবেশ করলেন। খেঁকিয়ে বললেন,

-'তুমি এখানে কেন? ইফতারির আর কতসময় আছে?'

নায়লার মাথা গরম হলো না। এ যেন নায়লা নয়, অন্য নায়লা। যে কথায় কথায় কষ্ট পায় না,কাঁদে না। যে নিজেকে ভালো রাখতে জানে, কাউকে পরোয়া করে না। 

-'আমি আর একটি কাজও করতে পারবো না মিসেস শ্বাশুড়ি...উঁহু, মা বলে ডাকবো না। আপনি আমার মা নন, মায়ের কোনো ক্যাটাগরিতেই পড়েন না। আপনি একটা নিকৃষ্ট মনের নিচু মহিলা। আপনার গায়ে শত শত ফোঁড়া উঠুক..'

নায়লার কিড়মিড়ানি দেখে হতবিহ্বল বনে গেলেন কল্পনা বেগম। পরমুহূর্তেই এগিয়ে এলেন মা'রার জন্য। একটা হাত তুলেছেন, ওমনি নায়লা সেই হাত সজোরে চেপে ধরে নখ দাবিয়ে দিলো। কল্পনা বেগম ব্যথায় ছটফট করে উঠলেন।

-'তোকে আমি জেলের ভাত খাওয়াবো বুড়ি। অনেক ছাড় দিয়েছি, আর না। আমাকে মানুষ মনে করিস না,না? যা নিজে গিয়ে কাজ করে দেখ কেমন লাগে। আর তোর ওই দামড়িটাকেও কাজকাম কিছু শেখা। বসে বসে খেতে খেতে আজকে তোদের সম্মান খাইয়ে,কবে জানি তোদেরকেই খেয়ে বসে। তোর ছেলেকে বলে দিস,আমার পেছনে যেন কখনো না আসে। আসলে এর ফল অনেক খারাপ হবে। আমি নায়লা, আমি হার না মানা নায়লা। এতদিন তোদের জন্য স্যাক্রিফাইস করেছি, আজকে নিজের জন্য ভয়ডর সব স্যাক্রিফাইস করে দিলাম। যা হবার হবে, তোদের এই বাড়িতে আর একমুহূর্তও নয়।'

নায়লা এক কাপড়ে বেরিয়ে গেল। কল্পনা বেগম ঝিম ধরা শরীরে বিছানার এক কোণে বসে রইলেন। এসব তার সাথে কী হচ্ছে! তিনি কল্পনাও করতে পারছেন না। ময়না বেগম দূর থেকে দেখে আবার হাসলেন। যাক, বাঁচুক মেয়েটা এবার- ওর জন্য রঙিন ভবিষ্যৎ অপেক্ষায়....


পরিশিষ্ঠঃ শ্যামলেরই না, কল্পনা বেগমেরও ৬ মাসের জেল হয়েছে। হাজতের শক্ত বিছানায় শুয়ে এই প্রথম উনি নিজের ভুলগুলো বুঝতে পারলেন। সেই সঙ্গে ছটফটিয়ে উঠল উনার মন, নায়লাকে কোথায় পাবে? ওর কাছে যে ক্ষমা চাওয়াটা খুব দরকার! ময়না বেগমের মেয়ে-ই নায়লার জন্য একটা ভালো অফিসে কর্মের সুযোগ করে দিয়েছে। অফিসের কাছাকাছি একটা মেস ভাড়া নিয়েছে নায়লা। প্রতিদিন দশটা টু পাঁচটার অফিস করতে একটুও ক্লান্ত লাগে না তার। বরং একদিন অফিসে না গেলেই ভালো লাগে না। ওখানে সদ্য হওয়া কলিগ কাম বন্ধু গুলো এত ভালো! নায়লাকে মাথায় করে রাখে যেন। নায়লার অতীত নিয়ে কেউ খোঁটা দেয় না বরং সবাই অনুপ্রাণিত ওর গল্প শুনে। নায়লার মা প্রতিদিন নিয়ম করে ফোন করেন, কিন্তু নায়লা ফোন তোলে না। একেক সময় নাম্বার টাকে ব্লকলিস্টে ফেলে রাখে। যারা ও'কেই বুঝল না,তাদের সাথে কীসের সম্পর্ক আবার? বাবা-মা বলেই যা ইচ্ছে তাই করবে আর সন্তান হিসেবে চুপচাপ মেনে চলতে হবে? জন্ম দিয়েছে বলেই কী জীবন টা কিনে নিয়েছে তারা? সবার আগে আমরা মানুষ। আমাদের সবচেয়ে বড় পরিচয় এটা। কারো সন্তান,কারো মেয়ে,কারো বউ হওয়ার আগে আমরা মানুষ, আমাদের নিজেদের জীবন আছে,আমাদের শখ,আহ্লাদ হয়,ইচ্ছে জাগে- ভালোলাগা,মন্দলাগা থাকতে পারে- আমরা রোবট নই, আমাদেরও একটি সুন্দর জীবন যাপন করার অধিকার রয়েছে। জীবন যখন একটাই, এই একটাতেই সব শখ-আহ্লাদ মিটিয়ে যেতে হবে। এই সুন্দর পৃথিবীতে যতটুকু অধিকার পুরুষদের, সম পরিমাণ অধিকার আমাদেরও। পুরুষরা যদি সপ্তাহে একদিন করে ছুটি পায়, তাহলে আমরা কেন পাবো না? পুরুষরা যদি ইফতারির পর ক্লান্ত হয়ে যেতে পারে তবে আমরা কেন পারব না? মনে রাখতে হবে, ওদের শরীরে হিমোগ্লোবিন থাকলে আমাদের শরীরেও তাই আছে। বিধাতা এক্সট্রা কিছু তো দেননি! 


(সমাপ্ত)


এমন আরও বউ শাশুড়ির গল্প পড়ুন।