কঠিন সময়ে কেউ পাশে নেই | চরম বাস্তব কিছু তেতো কথা

 শিক্ষনীয় বাস্তব গল্প

শিক্ষনীয় বাস্তব গল্প

সুমিকে পড়াচ্ছি দু'মাস হলো। দু'মাস পড়ানোর পরেও টিউশনির টাকা হাতে না পেয়ে বললাম,

- ' তোমার আম্মু যদি আমার টাকাটা দেওয়ার চেষ্টা করতো। '


সুমি বিস্ময় নিয়ে সাথে সাথে বললো,

- ' স্যার, প্রতি মাসের এক তারিখেই বাবা বিদেশ থেকে আপনার টিউশনির টাকা, সাথে সংসারের খরচের টাকা পাঠিয়ে দেয়। মা তাহলে এখনো আপনাকে টাকা দেয় নি ? '


আমি চুপ করে রইলাম। সুমির কথা শুনে বলার কিছু বলার মতো ভাষা খুঁজে পেলাম না। 


টিউশনি শেষ করে মেসে ফিরলাম রাত করে। মেসে এসে শুনলাম আজকে রাতে কিছুই রান্না হয় নি। কিছু খেতে চাইলে রাতে হোটেলে খেতে হবে। হাতে কোন টাকা নেই, টিউশনির টাকা দিয়ে মেসের খরচ চালাতে হয়। এর মধ্যে দু'মাস ধরে টিউশনির টাকা না পাওয়ায় চলতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। 


রাতে বাইরে থেকে খেয়ে আসার জন্য জাহিদের কাছ থেকে একশো টাকা ধার চাইলাম। জাহিদ আমার রুমমেট, দু'জনে একই সাথে থাকছি চারটি বছর। এখন ভার্সিটির ফাইনাল ইয়ার চলছে। ফাস্ট ইয়ার থেকেই দু'জনে একই রুমে আছি। একশো টাকা ধার চাওয়ার পর জাহিদ কঠিন গলায় বললো,

- ' পকেটে দশ টাকার একটি নোট ছাড়া কোন টাকা নেই, তোরে একশো টাকা ধার দেবো কিভাবে ? যেই দশ টাকা আছে সেটা দিয়ে আমাকে সিগারেট খেতে হবে। '


জাহিদের কথা শুনে সামান্য লজ্জা পেলাম। মাথা নিচু করে পাশের রুমের শফিক ভাইয়ের কাছ থেকে একশো টাকা ধার চাইতেই আমাকে বললো, 

- ' একশো টাকা তো ভাংতি নেই। তুই একটু অপেক্ষা কর। আমি জাহিদের কাছ থেকে ভাঙ্গিয়ে নিয়ে আসি। '


আমি বললাম,

- ' জাহিদের কাছে মাত্র দশ টাকা আছে, আপনাকে এক হাজার টাকা ভাংতি দিবে কিভাবে ? '


শফিক ভাই শীতল গলায় বললো,

- ' জাহিদের কাছে তোরে ধার দেওয়ার টাকা নেই, কিন্তু ভাংতি দেওয়ার টাকা ঠিকই আছে। '


আমাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। দুই মিনিটের মধ্যেই শফিক ভাই দশটা একশো টাকার নোট নিয়ে ফিরে আসলো। আমার হাতে একশো টাকা দিয়ে বললো,

- ' দেখলি তো, টাকা ধার দেওয়া মানুষের সংখ্যা খুবই কম হলে ও ভাংতি দেওয়া মানুষের সংখ্যা অভাব নেই। '


আমি একশো টাকার নোটটি হাতে নিয়ে চোখ বড় বড় করে নোটটির দিকে নির্বাক ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলাম।


• 


ঘুম থেকে উঠতেই সুমির আম্মু ফোন দিয়ে বললো আজকে যেন তাড়াতাড়ি করে টিউশনিতে চলে আসি। কথা শুনে আমি বললাম,

- ' আজ তো শুক্রবার, আজকে আমার টিউশনিতে যাওয়ার কথা নয়। '


আমার কথা শুনে বললো,

- ' সুমির সামনে সপ্তাহে পরীক্ষা, এখন প্রতিদিনই আসতে হবে। '


- ' ঠিক আছে আসবো। সত্যি কথাটা হলো, পকেটে একটা টাকা ও নেই। দু'মাসের টাকা জমে গেছে, যদি টাকাটা দিতেন ভালো হতো। '


সুমির আম্মু রেগে গিয়ে বললো,

- ' মেয়েটাকে পড়াতে আসবে না সেটা বলো। পকেটে টাকা নেই এটা কেন বলছো ? এমন ছোটলোকি কথা আমার অপছন্দ, এমন ছোটলোকি কথা বললে তোমাকে পড়াতে আসতে হবে না। '


সেদিনের পর থেকে আর কোনদিন সুমিকে পড়াতে যাই নি। পকেটে টাকা না থাকলে কেউ যখন অপমান করে কথা বলে তা সহ্য করে নিতে অনেক সময় লাগে। 


• 


ভার্সিটির পড়াশুনা শেষ হয়ে গেছে। বিসিএসের প্রস্তুতি নিচ্ছি। এর মাঝেই ব্যাংকে চাকুরি হয়েছে। প্রতিদিন অফিসে যেতে হয় বাসে করে। তাই একটু আগেই বের হয়েছি। বাসে উঠতেই পাশের সিটে সুমির আম্মুকে দেখে চমকে গেলাম। আমাকে দেখেই মুখ কালো করে ফেললো। আমি সহজ গলায় বললাম,

- ' আপনার বাসা তো এদিকে নয়, বাসে করে কোথায় যাচ্ছেন ? '


কিছুক্ষণ থেমে থেকে বললো, 

- " সুমির বাবার বিদেশ থেকে আসার পর পরই আমাদের মাঝে ডিভোর্স হয়ে যায়। এখন আমি নিজের বাড়িতে চলে এসেছি। '


আগ্রহ নিয়ে বললাম,

- ' যদি কিছু মনে না করেন জানতে পারি, জানতে পারি ডিভোর্স হয়েছে কেন? '


করুণ গলায় বললো,

- ' বিদেশ থেকে এসে টাকা পয়সার হিসেব চেয়েছিল। আমি হিসেব দিতে পারি নি। তবে এখন হিসেব করে চলি। তবু ও চলতে কষ্ট হয়, খুব কষ্ট। '


বাস অফিসের কাছে চলে এসেছে। আমি চুপচাপ বাস থেকে নেমে গেলাম। বাস থেকে নামতেই শরীরে শীতল স্রোত বয়ে গেলো।


• 


ব্যাংকে কাজ করছি লোন সংক্রান্ত হিসেব নিয়ে। ব্যাংক লোন নেওয়ার জন্য আমার টেবিলে একটা আবেদন পেপার রেখে বললো,

- ' স্যার, পড়াশুনা শেষ করে ব্যবসায়ে নেমেছিলাম। বড় ধরণের লস খেয়ে সবকিছু হারিয়ে ফেলেছি।এখন যদি ব্যাংক লোন পেতাম বড়ই উপকার হতো। '


আবেদন পেপারের কোনায় ছবিটা দেখে পরিচিত মনে হলো। তাকিয়ে দেখি জাহিদ দাঁড়িয়ে আছে।আমি জাহিদকে কঠিন গলায় বললাম,

- ' সম্ভব নয়, মিথ্যাবাদী মানুষের ব্যাংক লোন দেওয়ার অনুমতি দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। '


জাহিদ আমার কথা শুনে বিশ্বাস করতে পারছিল না। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ব্যাংক থেকে বের হয়ে গেলো।


জাহিদ চলে যাওয়ার পর পরই আমার কলিগ নাজমুল চেয়ার থেকে উঠে এসে বললো,

- ' ব্যাংক লোন নিতে আসা ছেলেটা বলেছিল, আপনি নাকি তার পরিচিত। পরিচিত হয়ে ও লোন দেওয়ার অনুমতি দেননি কেন? '


আমি বললাম,

- ' জীবনে চলার পথে এমন সব মানুষের সাথে পরিচয় হয় বলেই কঠিন সময়টা পার করা আরো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তবু ও আমরা ঘুরে দাঁড়াই, সফল হয়ে স্বপ্ন পূর্ণ করি । কিন্তু এমন সব মানুষদের কখনোই ভুলি না। যারা অন্যজনের বিপদ উপলব্ধি করতে না পারে, তাদের ভুলা যে খুব কঠিন। '

.

(সমাপ্ত)


------------------------

ছোটগল্প

জীবনের_সমীকরণ 

--------------------------------------


এমন আরও বাস্তব জীবনের ঘটনা ও গল্প পড়ুন।