ভালোবাসার গল্প
বিয়ের তিনদিনের দিন নিতু জানতে পারল জিয়ানের পূর্বে একটা বিয়ে হয়েছিল এবং সে ডি-ভো-র্সি। এই সত্যিটা যখন জানল তখন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না সে। নিতু বুঝতেই পারছে না, তার সাথেই কেন এমনটা হবে? তার সবচেয়ে বেশি রাগ হচ্ছিল নিজের পরিবারের ওপর। তারা কী খোঁজ-খবর নেয়নি? ভালো ছেলে পেল, আর ওমনি বিয়ের তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে। এই মুহূর্তে রাগ হচ্ছে নাকি কষ্ট হচ্ছে বুঝতে পারছে না সে। শুধু অপেক্ষা করছে জিয়ানের ফিরে আসার।
ঘণ্টাখানেক পর জিয়ান বাড়িতে আসে। এই সময়টুকু নিতু দরজা বন্ধ করে ঘরে ছিল। শ্বশুর, শাশুড়ি, ননোদ কারও সাথেই কোনো কথা বলেনি। দরজা খুলে জিয়ানের হাতে বেলী ফুলের মালাটা দেখতে পেল। সে প্রতিদিনই বাইরে থেকে আসার সময় নিতুর জন্য ফুল, চকোলেট নিয়ে আসবে। গতকালও নিতু তার হাতে প্রিয় ফুল দেখে একই সাথে আনন্দিত এবং লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠেছিল। তবে আজ তার মাঝে রাগ ব্যতীত আর কিছুই নেই। জিয়ান নিতুকে জড়িয়ে ধরতে যাবে ঠিক সেই মুহূর্তে নিতু দু'পা পিছিয়ে গেল। রাগে ফুঁসে উঠে বলল,
"একদম আমার সামনে আসবেন না বলে দিলাম। মি'থ্যা'বা'দী, প্র'তা'র'ক!"
জিয়ান অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। নিতু কথা বলতে গিয়ে খেয়াল করল কান্নায় কণ্ঠস্বর রোধ হয়ে রয়েছে তার। জিয়ান বুঝতে পারেনি এমনভাবে বলল,
''এসব কী বলছ?''
''কী বলছি? বুঝতে পারছেন না তাই না?''
বলেই নিতু বালিশের নিচ থেকে ডি-ভো-র্স পেপার আর কিছু ছবি জিয়ানের দিকে ছুঁড়ে মেরে বলল,
''এগুলো বোধ হয় লুকিয়ে রাখতে ভুলে গেছিলেন আপনি। আপনারা প্রত্যেকে আমায় ঠকিয়েছেন।''
জিয়ান চমকে যায় এসব দেখে। এগুলো নিতুর কাছে এলো কী করে? তবে সে কিছু বলতে পারল না। অপরাধীর মতো মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল। নিতু আলমারি থেকে কাপড়-চোপড় বের করে লাগেজে ভরতে শুরু করেছে। প্র'তা'র'কের সাথে সংসার করার তো কোনো মানেই হয় না। এই পর্যায়ে জিয়ান নিতুর হাত ধরে বলে,
''কাপড় লাগেজে ভরছ কেন? কোথায় যাবে তুমি?''
নিতু এক ঝটকায় হাত সরিয়ে দিল। কান্না করতে করতেই বলল,
''চলে যাচ্ছি এই বাড়ি থেকে। আপনার সাথে সংসার করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।''
''আমার কথা শোনো।''
''কোনো কথাই আমি শুনব না। আগে শোনানোর কথা মনে হয়নি? কেন ঠকালেন আমায়? কেন লুকিয়েছেন আগের বিয়ের কথা?''
"তুমি আগে শান্ত হও। আমি তোমাকে সব বলছি।"
"আপনি আর একটা কথাও বলবেন না আমার সাথে।"
চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে বাড়ির লোকজন ওদের রুমে চলে এসেছে। নিতু তখনও কাপড় গোছাচ্ছিল। জিয়ানের বাবা জুবায়ের রহমান তখন জানতে চাইলেন,
"কী হয়েছে? কাঁদছ কেন মা?"
কিছু কড়া কথা বলতে গিয়েও নিতু বলতে পারল না। দমে গেল। কান্না গলায় দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। অসহায় লাগছিল তার নিজেকে। ওর থেকে জবাব না পেয়ে তিনি জিয়ানকে জিজ্ঞেস করলেন,
"কী হয়েছে রে? বউ মা কাঁদছে কেন?"
জিয়ান মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। নিতু ততক্ষণে লাগেজ নিয়ে বের হয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়। পথ রোধ করে দাঁড়ায় জিয়ান। মিনতি করে বলে,
"প্লিজ নিতু! এভাবে চলে যেও না।"
"খবরদার! আমার সামনে কোনো নাটক করবেন না। পথ থেকে সরে দাঁড়ান।"
"কী হয়েছে মা বলো না?" নরম গলায় শুধালেন আফরোজা বেগম।
নিতু কাঁদতে কাঁদতে বলে,
"এভাবে আমায় না ঠকালেও পারতেন আপনারা।"
নিতুকে আর কেউই আটকে রাখতে পারল না। সে কাঁদতে কাঁদতে চলে যায় বাড়ি থেকে। জুবায়ের রহমান ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন,
"সব জেনে গেছে না? তোকে আগেই বলেছিলাম,লুকাস না কিছু। এখন হলো তো?"
ছেলেকে গালমন্দ করে সবাই চলে যায়। এখন শুধু জিয়ানের ভাবি মিনা দাঁড়িয়ে আছে। সে বিদ্রুপ করে বলে,
"এজন্যই বলে অতি বাড় বেড়ো না, ঝড়ে পড়ে যাবে!"
"তুমিই ডিভোর্স পেপার আর ছবিগুলো আলমারিতে রেখেছ তাই না ভাবি?" চোখ-মুখ শক্ত করে বলল জিয়ান।
মিনা তাচ্ছিল্যর স্বরে বলে,
"বুঝতে কি তোমার আপত্তি আছে?"
"কেন করলে তুমি এমনটা?"
"ওমা! জানো না বুঝি? আমার বোনের জীবনটা ন'র'ক বানিয়ে দিয়ে তুমি হাসি-খুশি থাকবে তা কী করে হতে দেই আমি?"
"তোমার বোনের ন'র'ক জীবনের জন্য তো আর আমি দায়ী নই। সে আমাকে ছেড়ে গেছিল; আমি না।"
"ভুল বুঝতে পেরে তো ফিরেও আসতে চেয়েছিল। কী হতো একটা সুযোগ দিলে? সে যাই হোক, প্রথম বিয়ের খবরটা নিতুর থেকে লুকিয়ে ভালোই করেছ। নয়তো নিতুকে কী করে আর সরাতাম?"
"কাজটা তুমি ভালো করোনি ভাবি।"
মিনা হাসে। হাসতে হাসতে বলে,
"তুমিও আমার বোনের জীবনটা নষ্ট করে ভালো করোনি।"
মিনা চলে যাওয়ার পর জিয়ান বিছানায় বসে পড়ে। তার মাথা কাজ করছে না। কী করবে সে এখন? বিয়ের কথা লুকিয়ে যে চরম অন্যায় আর বোকামি করে ফেলেছে জিয়ান এটা এখন হারে হারে টের পাচ্ছে। সে ব্যস্ত হয়ে নিতুকে ফোন করে। ফোন বন্ধ। কোথায় গেল নিতু? বাপের বাড়ি? তাই-ই হবে। জিয়ানও তৎক্ষণাৎ ও বাড়িতে যাওয়ার জন্য বের হয়ে যায়।
নিতুদের বাড়ি গিয়ে দেখল নিতু এই বাসায় আসেনি। নিতুর মা মমতা বেগম জিজ্ঞেস করলেন,
"কিছু হয়েছে?"
জিয়ান মিথ্যে বলল,
"না, মা। নিতু বলেছিল শপিং-এ যাবে। আসার সময় এই বাসায় আসবে। তাই দেখতে আসলাম।"
"ওহ। আচ্ছা বাবা বসো তুমি।"
"না, মা। বসব না। নিতু মনে হয় মার্কেটে আছে। আমি যাই।"
জিয়ান বাইরে এসে হাঁপাচ্ছে। ভয়ে তার হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। কোথায় চলে গেল নিতু? সে তার পরিচিত নিতুর কয়েকজন বন্ধু, বান্ধবীকে ফোন করল। তবে আশানুরূপ কোনো তথ্য কারও থেকেই পায়নি। নিতু এদের কারও বাসায় তো যায়-ই নি এমনকি রিসেন্টলি কোনো যোগাযোগও করেনি। বেস্ট ফ্রেন্ডও জানে না কিছু। এবার সে চারদিকে শূন্য দেখছে। পৃথিবী দুলছে তার।
সে পথে পথে হেঁটে নিতুকে খুঁজছে। এভাবে কি একটা মানুষকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব? এর আগে ফোন নাম্বার খোলা থাকলেও, এখন ফোন সুইচড অফ বলছে। দুশ্চিন্তায় তার প্রাণ ওষ্ঠাগত। ক্লান্ত হয়ে সে পথে এক সাইডে বসে পড়ে। সারা শরীর ঘেমে একাকার। তখনই তার ফোনে আননোন নাম্বার থেকে কল আসে। ফোন রিসিভ করার পর ওপাশ থেকে একটা মেয়েলি স্বর ভেসে আসে,
"এখনও সময় আছে জিয়ান। আমি এখনও তোমার অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছি। প্লিজ! আমার কাছে ফিরে এসো।"
কণ্ঠটি জিয়ান চেনে। তার এক্স ওয়াইফ মাহিরা।
গল্প: তোমার দ্বিধায় বাঁচি
মুন্নি আক্তার প্রিয়া
পর্ব:০১
তোমার দ্বিধায় বাঁচি
পর্ব: ২+৩
মুন্নি আক্তার প্রিয়া
"সামনে থাকলে থা-প্প-ড় দিয়ে গাল লাল করে ফেলতাম তোমার।"
ঝাঁঝাল কণ্ঠে বলল জিয়ান। বিরক্তিতে নাক-মুখ কুঁচকে ফেলেছে সে। বিতৃষ্ণায় মুখ তেতো হয়ে আছে। মাহিরা কিন্তু দমল না। সে খিলখিল করে হেসে বলল,
"রাগ করেছ?"
"তোমার সমস্যা কী? কেন বিরক্ত করছ আমায়?"
"বিরক্ত করছি নাকি? আগে তো খুব পাগল ছিলে আমার কণ্ঠ শোনার জন্য। আর এখন বিরক্ত লাগে?"
"হ্যাঁ, লাগে। কারণ আগের সময় আর আগের জিয়ান কোনোটাই এখন আর নেই। সব নতুন।"
মাহিরা শ্লেষেরসুরে বলল,
"ঠিকই বলেছ। সবই নতুন। বউও নতুন। তাই পুরাতন আমিকে আর ভালো লাগে না।"
"তোমাকে কেন ভালো লাগবে আমার? তুমি আমার কে হও? কেউ না।"
"আমি তোমার কেউ হই না?"
"না।"
"এত তাড়াতাড়ি সব ভালোবাসা ফিকে হয়ে গেল?"
"তাড়াতাড়ি? তিনটা বছর পার হয়ে গেছে মাহিরা। তিনটা বছর কিন্তু কম সময় নয়। এখন যখন আমি অন্য কারও সাথে ভালো আছি তখন কেন এমন করছ? কেন বারবার আমার সুখ কেড়ে নিতে চাইছ বলো?"
"তোমার জীবন থেকে চলে গিয়ে সুখ কেড়ে নিয়েছিলাম। এজন্য আমি দোষী। আমি তো চেয়েছিলাম দ্বিতীয়বারও তুমি আমার সাথেই সুখী হও।"
"যাতে করে আবার চলে গিয়ে সুখ কেড়ে নিতে পারো?"
"না জিয়ান! আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবাসি।"
"হাহ্! তার নমুনা তো দেখতেই পাচ্ছি।" তাচ্ছিল্য করে বলল জিয়ান।
মাহিরা বলল,
"দেখো জিয়ান তুমি হয়তো আমায় ভুল বুঝতেছ। আমার ওপর রেগে আছো। কিন্তু আমি কী করব? তোমাকে আমি অন্য কারও সাথে সহ্য করতে পারছি না। আর পারবও না।"
"তোমার কথা বলা শেষ? মাথা ধরে আছে আমার। নিতুকে খুঁজে পাচ্ছি না। দুশ্চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছি। তার ওপর তোমার এসব ন্যাকামো আমি একদম নিতে পারছি না। তুমি দয়া করে আমাকে কল দিও না প্লিজ!"
"জিয়ান, আমার কথাটা..."
কথা সম্পূর্ণ করতে দিল না জিয়ান। তার পূর্বেই কল কেটে দিল। ভীষণ অসহায়বোধ করছে সে। নিতুর কষ্টে তার বুকে প্রবল ঝড় শুরু হয়েছে। কোথায় আছে নিতু?
.
.
বিধ্বস্ত অবস্থায় বাড়িতে এসেছে নিতু। তার পরনের শাড়ি অগোছালো, চুল এলোমেলো। শুকনো মুখ। হাতে লাগেজ। মেয়ের এমন অবস্থা দেখে মমতা বেগম আঁৎকে উঠলেন। ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
"নিতু! তোর এই অবস্থা কেন? কী হয়েছে?"
নিতু কোনো প্রত্যুত্তর করল না। সরাসরি নিজের রুমে চলে গেল। মমতা বেগমও সঙ্গে গেলেন। তিনি উদ্বেগপূর্ণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেই যাচ্ছেন,
"কথা বলছিস না কেন? জিয়ানের সাথে কি ঝগড়া হয়েছে?"
রাগ, জেদ, ক্ষোভ, অভিমান সব আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে নিতুর। বাবা-মায়ের ভুলের জন্য আজ তাকে পস্তাতে হচ্ছে। প্রচণ্ড অভিমানে এসব কথা বাবা-মা কাউকেই তার বলতে ইচ্ছে করছে না। সে ঠিক করেছে বলবেও না। সময় থাকতে যখন খোঁজ-খবর নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি, এখন আর জেনেই বা কী করবে? কোনো প্রয়োজন নেই তাদের জানার। সে শীতলকণ্ঠে শুধু বলল,
"কিছু হয়নি। আমায় একটু একা থাকতে দাও।"
"একা থাকবি মানে কী? হয়েছে কী সেটা তো আমায় বল।"
"বলব। আমি তো আর কোথাও চলে যাচ্ছি না। আছি তো এখানে! আগে ফ্রেশ হই? একটু রেস্ট নিই? তারপর বলি? তাছাড়া আহামরিও কিছু ঘটেনি।"
"সত্যি তো?"
"হ্যাঁ?"
"ঐ বাড়িতে সব ঠিকঠাক?"
"হুম।"
"ওহ। তাহলে জিয়ানের সাথেই ঝগড়া করে এসেছিস। বিয়ে হয়েছে আজ চারদিন হলো। এর মধ্যেই ঝগড়া বাঁধিয়ে দিয়েছিস?"
নিতু কোনো উত্তর দিল না। ওয়াশরুমে চলে গেল। মমতা বেগম দরজায় ধাক্কা দিয়ে বললেন,
"নিতু, ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং রুমে আসিস। আমি তোর নাস্তা দিচ্ছি।"
নিতু এবারও কোনো উত্তর দিল না। গতকাল সে জিয়ানদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে ফেসবুকে পরিচিত এক ক্লোজ বান্ধবী সম্পার বাড়িতে উঠেছিল। জিয়ানের আগের বিয়ের ব্যাপারে সম্পাকে কিছু জানায়নি। সামান্য কথা কা'টা'কা'টি হয়েছে বলেই জানিয়েছিল। ফোন বন্ধ করে সারা রাত ভেবেছে সে কী করবে। কী করা উচিত। ভোর রাতের দিকে সে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভয়াবহ রকমের কঠিন সিদ্ধান্ত। হোক ভুল! ভুল, ঠিকের হিসাব করার মতো মানসিকতা এখন তার নেই। সে উ'ন্মা'দ হয়ে গেছে। জিয়ানের প্র'তা'রণা কিছুতেই মানতে পারছে না। সে তো সত্যিই মানুষটাকে ভালোবাসতে শুরু করেছিল। তাহলে কেন ঠকাল এভাবে?
চাপা স্বভাবের অভিমানী নিতু এতটুকু বুঝেছিল তার সিদ্ধান্ত এখানে বাস্তবায়ন করতে গেলে সম্পাসহ তার বাকি রুমমেটরা ফেঁসে যাবে। তার জন্য অন্যদের ক্ষতি হোক এটা সে চায় না। তাই সকাল হতেই নিজের বাড়িতে চলে এসেছে। যা করার সে এখানেই করবে। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে সে ব্যাগ সে ধা'রা'ল দুটো ব্লে'ড বের করে। এগুলো সে আসার সময় কিনে নিয়ে এসেছে। ব্লে'ড দুটো নিয়ে সে ফ্লোরে বসে পড়ল। খাটের সঙ্গে হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। রুমের ভেতর তখন পিনপতন নিরবতা। তাই ফ্যানের ভনভন শব্দও কানে লাগছে খুব। সে আর কিছুই ভাবার সময় নিল না। দুটো ব্লে'ড একত্রে করে বাঁ হাতের র'গে'র ওপর ক্রমাগতভাবে আঁ-চ-ড় দেওয়া শুরু করে। ক্ষ-ত-স্থা-ন থেকে গলগল করে র'ক্ত বের হচ্ছে। র'ক্তে তার হাত, ব্লেড, পরনে বাসন্তী রঙের শাড়িটি ভিজে জপজপে হয়ে গেছে। চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসছে তার। ধীরে ধীরে শরীর হালকা হতে শুরু করে। চেতনা হারিয়ে শরীরের সমস্ত ভার ছেড়ে দেয়। কাৎ হয়ে পড়ে থাকে র'ক্তে ভেসে যাওয়া সাদা টাইলসের ওপর।
__________
সারাটা রাত ছটফট করেছে জিয়ান। কোথায় না খুঁজেছে? কিন্তু কোত্থাও নিতুর কোনো খবর পায়নি। চোখের পাতায় ঘুমও নেই এক ফোঁটা। সারা রাত কেটেছে তার সিগারেট খেতে খেতে। কিন্তু ঘুম আসেনি একটুও। সকালে একটু তন্দ্রাভাব আসলেও ঘুমটা গাঢ় হয়নি। বারবার স্বপ্নে সে নিতুকে দেখছিল। আর সত্যি ভেবে ঘুমটাও ভেঙে যাচ্ছিল। সে ঘড়ির দিকে তাকাল। সকাল ৮:১০ মিনিট। প্রচণ্ড তৃষ্ণা পেয়েছে। পিপাসা মেটানোর জন্য পানি প্রয়োজন। কিন্তু এ ঘরে পানি নেই। ডাইনিং রুমে যেতে হবে। সে শোয়া থেকে উঠে বসে তখন তার ফোনটা বেজে ওঠে। নিতুর বাবা নূর-আমিন আহমেদ ফোন করেছেন। তিনি হঠাৎ এত সকালে কল দিচ্ছেন! তাহলে কি ঐ বাসায়ও জেনে গেছে নিতু যে নেই? দোনামোনা হয়ে ভয়ে ভয়ে ফোন রিসিভ করল জিয়ান। ওপাশ থেকে অনেকের একসাথে কান্নার শব্দ ভেসে আসে। ভয়ে তটস্থ হয়ে যায় জিয়ান। তার বুক কাঁপছে।
নূর-আমিন আহমেদ ক্রন্দনরত স্বরে বললেন,
"নিতু সু-ই-সা-ই-ড করার চেষ্টা করেছে জিয়ান। হাত কে-টে-ছে। ব্লি'ডিং হয়েছে অনেক। আমরা ওকে নিয়ে এখন হাসপাতালে যাচ্ছি। তুমি তাড়াতাড়ি তানহা হাসপাতালে চলে আসো।"
জিয়ান বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। তার কণ্ঠ কথা বলার শক্তি হারিয়েছে। এমন কোনো খবর শোনার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। নূর-আমিন আহমেদ কল কেটে দিয়েছেন। তৎক্ষণাৎ জিয়ান গায়ে শার্ট জড়িয়ে বেরিয়ে পড়ে। তার দু'চোখে বেয়ে পানি পড়ছে। ছেলে হয়েও সে কান্না আটকে রাখতে পারছে না। নিতুর এখন কী অবস্থা? ওর যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে জিয়ান নিজেকে কী করে ক্ষমা করবে। একটা মিথ্যা কি এভাবে নিতুকে তার জীবন থেকে কেড়ে নেবে?
পর্ব_৩
জিয়ান যতক্ষণে হাসপাতালে পৌঁছাল ততক্ষণে নূর-আমিন আহমেদ এবং বড়ো মেয়ে মিতুর স্বামী শোভন হন্যে হয়ে র-ক্তের সন্ধান করছিলেন।
ফোনে কারও সাথে র-ক্তের জন্যই কথা বলছিলেন নূর-আমিন আহমেদ। জিয়ান এগিয়ে গিয়ে ভয়ার্ত কণ্ঠে শুধাল,
"বাবা, নিতু কোথায়?"
কান থেকে ফোন নামিয়ে রাখলেন তিনি। ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললেন,
"তিন ব্যাগ ও নেগেটিভ র-ক্ত লাগবে জিয়ান। ইমার্জেন্সি!"
জিয়ান আর কথা না বাড়িয়ে সঙ্গে সঙ্গে ওর কাছের দুই বন্ধুকে ফোন করল যাদের র-ক্তে-র গ্রুপ ও নেগেটিভ। ফোন পেয়ে ওরা তৎক্ষণাৎ ছুটে আসে। এখনও আরও এক ব্যাগ র'ক্ত প্রয়োজন। হাসপাতালের এমডি এসে জানাল, তাদের হাসপাতালের একজন ওয়ার্ড বয় রক্ত দিয়েছে। হাফ ছেড়ে বাঁচল নিতুর পরিবার।
নিতুর মা শাড়ির আঁচলে মুখ গুঁজে কাঁদছেন। মিতু তাকে কোনোভাবেই শান্ত করতে পারছে না। শোভন আছে শ্বশুরের সাথে। জিয়ানের মনের ভেতর ভয় এবং আশঙ্কা। এখনও কেউ কিছু জিজ্ঞেস করেনি। কিন্তু যখন জানতে চাইবে নিতুর সাথে তার কী হয়েছিল? কেন নিতু এমন একটা ডিসিশন নিয়েছে। তখন সে কী উত্তর দেবে?
জিয়ান আগে বাড়িতে ফোন করে ঘটনাটি জানাল। এরপর গিয়ে দূরে প্যাসেজ ওয়েতে একা বসল। মাথার ভেতর যন্ত্রণা হচ্ছে খুব। নিজের ভুলের জন্য নিতুকে এখন কষ্ট পেতে হচ্ছে। সে দু'হাতে মুখ ঢেকে ঝুঁকে বসে। নিতুকে পাওয়ার জন্য এই কথা লুকানো ছাড়া তার কাছে আর কোনো রাস্তাও ছিল না তখন।
তিন মাস আগের কথা। বন্ধু আসিফের বোনের বার্থডে পার্টিতে গিয়েছিল জিয়ান। সেখানেই নিতুকে সে প্রথম দেখেছিল। লাল রঙের সুন্দর একটা গাউন পরেছিল নিতু। জিয়ানের সবচেয়ে অপছন্দের রঙ ছিল লাল। কিন্তু সেদিন যেন সে লাল রঙেই মুগ্ধ হয়েছিল। তার বারংবার মনে হয়েছিল লাল রঙ ছাড়া নিতুকে ঠিক মানাত না। হাস্যোজ্জ্বল নিতুর প্রেমে সেদিনই সে ডুবেছিল। খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পারল নিতু বাবা-মায়ের ভীষণ বাধ্য মেয়ে। কোনো সম্পর্কে না থাকলেও তার পেছনে অনেক ছেলের লাইন রয়েছে। যাদের কেউ কেউ জিয়ানের থেকেও বেটার। সে ভয়ে ছিল। নিতু কি তার ভালোবাসার প্রস্তাব গ্রহণ করবে? সম্ভাবনা ছিল খুবই ক্ষীণ। অন্যদিকে তার ছিল অ-ভি-শ-প্ত এক অধ্যায়। যেই অধ্যায়ের নাম মাহিরা!
"জিয়ান!"
ডাক শুনে অতীতের ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে জিয়ান। ঝাপসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে ওর বাবা-মা এসেছে।
"বেয়াই-বেয়াইন কোথায়?" জিজ্ঞেস করলেন জুবায়ের রহমান।
জিয়ান নির্লিপ্ত গলায় বলল,
"দুই তলায়।"
"তুই এখানে একা বসে আছিস কেন?"
"তোমরা যাও। আমি আসছি।"
নিতুর সাথে নূর-আমিন আহমেদের কথা হয় দুই ঘণ্টা পর। সে এখন কিছুটা সুস্থ আছে। বাইরে জিয়ান ও নিতুর শ্বশুর, শাশুড়ি দাঁড়িয়ে আছে। দুই পরিবারের কেউই এখনও মুখোমুখি কোনো কথা বলেনি। নূর-আমিন আহমেদ আগে নিতুর থেকে সবটা শুনতে চান। তিনি বসে আছেন এখন মেয়ের শিয়রে।
"মা রে, কেন তুই এই কাজটা করতে গেলি বল তো?" বিমর্ষ হয়ে সুধালেন তিনি।
নিতু অভিমানি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
"ঠিকই তো করেছিলাম। কেন আমায় হাসপাতালে এনেছ?"
"কী হয়েছে আমায় খুলে বল মা।"
"কিছু বলার নেই তো। আমি বোঝা হয়ে গেছিলাম তোমাদের কাছে তাই না? এটা তো আমাকে বললেই পারতে। আমি চলে যেতাম অন্য কোথাও।" থেমে থেমে কথাগুলো বলল নিতু।
"এসব তুই কী বলছিস মা? তুই আমাদের কাছে বোঝা হয়ে গেছিলি? তোকে কি আমরা কম ভালোবাসি?"
"হ্যাঁ,হ্যাঁ বোঝাই হয়ে গেছিলাম। তাই তো আপদ দূর করতে খোঁজ-খবর না নিয়েই বিয়ে দিয়ে আমায় দূর করেছ।"
"জিয়ানের সাথে কিছু হয়েছে মা? আমায় বল না!"
"আব্বু তুমি যাও প্লিজ! আমার কথা বলতে ভালো লাগছে না। আর হ্যাঁ, ঐ মানুষটা যেন আমার সামনে না আসে।"
মিতু ইশারায় তাকে বাইরে চলে যেতে বলে। নূর-আমিন আহমেদ তবুও কিয়ৎক্ষণ বসে থেকে বাইরে চলে গেলেন। মিতু পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
"জিয়ানের সাথে কী নিয়ে ঝগড়া হয়েছে আমায় বলা যাবে?"
নিতু এ কথার কোনো উত্তর না দিয়ে বলল,
"আমি বাসায় যাব কবে?"
"কাল।"
বাইরে চেঁচামেচির শব্দ শুনে মিতু দৌঁড়ে বাইরে গেল। নূর-আমিন আহমেদ রেগেমেগে বারবার জিয়ানের দিকে তেড়ে যাচ্ছে। শোভন তাকে আটকে রেখেছে। সম্মুখেই মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে জিয়ান। নূর-আমিন আহমেদ ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন,
"এত বড়ো প্র'তা'র'ণা কেন করলেন আপনারা আমাদের সাথে? বিয়ের ব্যাপারটা কেন আগে জানাননি? তাহলে আজ আমার মেয়ের এই করুণ দশা দেখতে হতো না।"
জুবায়ের রহমান মাথা নত করেই বললেন,
"জিয়ানের সাথে সায় দেওয়া আমাদের উচিত হয়নি ভাই। কিন্তু এখন তো কিছু করার নেই..."
"কেন কিছু করার থাকবে না? নিতু যদি না চায় তাহলে এই সংসার করবে না।"
মমতা বেগম স্বামীকে থামিয়ে বললেন,
"আহা! থামো তো। সংসার ভাঙা কি মুখের কথা? এটা হাসপাতাল। এখানে এসব নিয়ে ঝামেলা কোরো না। নিতুকে নিয়ে আগে বাসায় যাই। তারপর একসাথে বসে এসব নিয়ে কথা বলার বলা যাবে।"
শোভন এবং মিতুও তাতে সায় দিল। জিয়ান মিতুর হাত ধরে অনুরোধ করে বলল,
"নিতুর সাথে একটু কথা বলব আপা!"
"নিতু তোমার সাথে কথা বলবে না।"
"আপা প্লিজ! বেশি সময় নেব না।"
জিয়ানের আকুতি-মিনতি শুনে রাজি হলো মিতু। কেবিনে প্রবেশ করতেই নিতু প্রচণ্ড রেগে যায়।
"আমি বলেছিলাম, উনাকে আমার সামনে না আনতে! কেন এনেছিস তাও?"
মিতু শান্তকণ্ঠে বলল,
"ও কী বলে শোন একটু। মাথাটা ঠাণ্ডা কর।"
"আমার কারও কোনো কথা শোনা লাগবে না। তার সংসার আমি করব না।"
নিতুর রাগ কমছে না দেখে জিয়ান কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। উত্তেজিত নিতু কী থেকে কী করে ফেলবে তার কোনো ঠিক নেই।
রাতে শোভন, জিয়ান আর মমতা বেগম হাসপাতালে রয়ে গেলেন। সারা রাত জেগে থাকায় তন্দ্রা ভাব চলে আসে মমতা বেগমের। তিনি নিতুর পাশের বেডে শুয়ে পড়েন। শোভন ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে বলে,
"চলো চা খেয়ে আসি।"
জিয়ান বলল,
"আপনি যান ভাইয়া। আমি এখানেই থাকি।"
অগত্যা শোভন একাই চলে গেল। চা খেয়ে যখন ফিরে এলো জিয়ান সেখানে নেই। সে কেবিনে একবার উঁকি দিয়ে চমকে গেল। নিতুও নেই! শাশুড়িকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল সে। জিজ্ঞেস করল,
"মা, নিতু কোথায়?"
ভয়ে আঁৎকে উঠলেন মমতা বেগম। জিজ্ঞেস করলেন,
"নিতু কোথায় মানে? এখানেই তো ছিল!"
দুজনে মিলে বাইরে বেরিয়ে আসে। শোভন রিসিপশনে গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই একজন রিসিপসনিষ্ট বলল,
"স্যার, একটু আগেই তো তার হাজবেন্ড হাসপাতালের সব বিল পে করে তাকে নিয়ে গেল। আপনারা জানেন না?"
শোভন হা হয়ে যায় এই কথা শুনে। পকেট থেকে ফোন বের করে শ্বশুরকে ফোন করার জন্য। তখনই সে জিয়ানের ম্যাসেজ দেখতে পায়।
"ভাইয়া নিতুকে আমি নিয়ে গেলাম। কোথায় যাচ্ছি সেসব এখন বলব না। কিন্তু নিতুকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না। আর একবার ও বাড়িতে চলে গেলে আমার কাছে আসবেও না। তাই এভাবে কাউকে কিছু না বলেই নিয়ে যেতে হলো। আপনারা কেউ চিন্তা করবেন না। আমি ওর খেয়াল রাখব।"
গল্প: তোমার দ্বিধায় বাঁচি
পর্ব_৪+৫
মুন্নি আক্তার প্রিয়া
সকালে সূর্যের মিঠে আলো চোখে-মুখে পড়ায় ঘুম ভেঙে গেল নিতুর। সে চোখ-মুখ কুঁচকে উঠে বসল। ঝাপসা দৃষ্টিতে চারদিকে চোখ বু্লিয়ে বোঝার চেষ্টা করল এই মুহূর্তে সে কোথায় আছে। এটা তো হাসপাতাল নয়। পরিপাটি করে গোছানো রুম। জানালার কাচ খোলা। মৃদু বাতাসের তোড়ে জানালার শুভ্র রঙা পর্দাটি বিরতিহীন নড়ছে। বাবা-মা কি তাকে বাড়িতে নিয়ে এসেছে? কিন্তু এটা তো তার বাড়ি নয়। তার রুমও নয়। তবে?
সে খুব সাবধানে বিছানা থেকে নেমে জানালার কাছে গেল। বাইরে চোখ রাখতেই দূর-দূরান্তে শুধু গাছপালা এবং অদূরে কিছু বাসা দেখা যাচ্ছে। তবে সে যেখানেই এখন থাকুক না কেন, এই বাড়িটা তার পরিচিতি নয়। এমনকি এই জায়গাটিও নয়। দরজা খোলার শব্দ পেয়ে সে পেছনে ফিরে তাকাল। জিয়ানকে দেখেই তার মাথা ফের গরম হয়ে যায়। দিশেহারা হয়ে পড়ে সে। ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলে,
"আপনি!"
জিয়ান কী বলবে বুঝতে পারছে না। নিতুর চোখের দিকে তাকানোর সাহসও তার নেই। তবুও সে সংকোচের সহিত অপরাধীর ন্যায় নিতুর চোখের দিকে তাকাল। সেই চোখে রয়েছে জিয়ানের জন্য ঘৃণা এবং সীমাহীন রাগ। সে গোপনে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,
"মাথা গরম কোরো না। শান্ত হয়ে বসো। খাবার খেয়ে ওষুধ খেতে হবে।"
"শান্ত হয়ে বসব মানে কী? আপনি আমাকে কোথায় নিয়ে এসেছেন?"
জিয়ান বাইরে থেকে আনা খাবার প্লেটে ঢালতে ঢালতে বলল,
"অনেক দূরে।"
নিতু সামনে এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করল,
"অনেক দূরে কোথায়? এই জায়গার নাম কী?"
"তুমি চিনবে না। নাস্তা করো।"
প্লেট সজোরে দূরে ছুঁড়ে মারল নিতু। রাগে কাঁপছে সে। জিয়ান শূন্য দৃষ্টিতে কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে অন্য প্লেটে নিজের জন্য আনা খাবার ঢালল। নিতু এবারও খাবার ফেলে দেওয়ার জন্য উদ্যত হতেই জিয়ান নিতুর হাত আলতো করে চেপে ধরল। শান্তকণ্ঠে বলল,
"খাবার এভাবে নষ্ট করা ঠিক নয় নিতু।"
"আপনি যে আমার জীবনটা নষ্ট করে দিলেন তার বেলায়?"
"তুমি এভাবে কেন বলছ? আগের বিয়ের কথা তোমার থেকে লুকিয়ে আমি ভুল করেছি। চরম অন্যায় করেছি এটা আমি মানছি। তাই বলে তোমার জীবন নষ্ট তো করিনি। আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবাসি নিতু।"
"ভালোবাসা? কোনটাকে ভালোবাসা বলছেন আপনি? যাকে মিথ্যে বলে, ঠকিয়ে বিয়ে করেছেন তাকে আবার ভালোবাসেন বলেও দাবি করছেন?"
"এই সত্যটা লুকাতে আমি বাধ্য হয়েছিলাম।"
"কে বাধ্য করেছিল আপনাকে?"
"তোমার প্রতি তৈরি হওয়া আমার ভালোবাসা। তুমি যদি জানতে আমি আগে বিয়ে করেছিলাম একটা, তাহলে কি আমায় বিয়ে করতে তুমি? তোমার বাবা-মা কেন এত ভালো ভালো অপশন রেখে তোমায় আমার হাতে তুলে দিত?"
"এজন্য আপনি আমায় ঠকাবেন? মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে যেই সম্পর্ক শুরু হয় সেই সম্পর্ক কখনও টিকে থাকতে পারে না। আমি আপনার সঙ্গে সংসার করব না। ডিভোর্স চাই আমার।"
জিয়ান আকুল হয়ে নিতুর হাত ধরল। তার দু'চোখ ছলছল করছে। সে বিষণ্ণ হয়ে বলল,
"যা ইচ্ছে করো নিতু। আমায় বকো, মারো যা ইচ্ছে হয়। তবুও প্লিজ আমায় ছেড়ে যাওয়ার কথা বলো না। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না।"
"আর আপনার সঙ্গে আমি থাকতে পারব না। আমাকে বাড়িতে দিয়ে আসেন।"
"তুমি আমাকে ক্ষমা না করলে কোথাও যাওয়া হবে না।"
নিতু পরিহাস করে বলল,
"আপনি আর ক্ষমা? হাহ্! কতদিন এভাবে আমাকে আপনার কাছে আটকে রাখবেন আপনি? একদিন, দু'দিন, এক মাস, এক বছর? যেদিন আমি সুযোগ পাব সেদিনই আমি চলে যাব। আপনার মতো প্রতারকের সাথে আমি কোনোমতেই সংসার করব না।"
কথার আঘাতে জর্জিত হয়েও জিয়ান কিছু বলতে পারল না। কী-ই বা বলবে সে? কী-ই বা বলার আছে? সে যা করেছে তার তুলনায় হয়তো এসব কথা কিছুই নয়। সে নিতুর জায়গায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে নিতুর কষ্ট, মনোভাব বোঝার চেষ্টা করছে। কিন্তু কেউ একটাবার তার জায়গায় দাঁড়িয়ে তাকে বোঝার চেষ্টা করছে না। কেউ বুঝতেই চাইছে না কতটা ভালো সে নিতুকে বাসে। জিয়ান পাশের রুমে গিয়ে বসে রইল।
নিতু ফ্লোরে বসে কাঁদছে। সে এসব কিছুই মানতে পারছে না। বাবা-মায়ের পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করে ভালোবাসতে শুরু করেছিল। শুরুটাই তাকে দং'শ'ন করতে শুরু করে দিয়েছে, সমাপ্তি তাহলে কেমন হবে? কতক্ষণ সে এভাবে কেঁদেছে সে জানে না। একটা সময় সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। শরীরে এতটুকুও শক্তি নেই বলে মনে হচ্ছে। খুব খিদেও পেয়েছে। ক্ষুধার যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে সে খাবার খেয়ে নেয়। মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে হলে তাকে শারীরিকভাবেও সুস্থ থাকতে হবে ভেবে সে ওষুধগুলোও খেয়ে নিল। এখান থেকে কী করে বের হওয়া যায় সেই চিন্তায় সে অস্থির হয়ে পড়েছে।
শুয়ে থাকতে থাকতে তন্দ্রাভাব চলে এসেছিল নিতুর। সেই সময়ে সে অনুভব করল কেউ কাঁদছে। সে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল ফ্লোরে বসে নিতুর হাত ধরে অঝোরে কাঁদছে জিয়ান। নিতু উঠে বসতে চাইল। বাধা দিল জিয়ান। ক্রন্দনরতস্বরে বলল,
"উঠো না। শুয়ে থাকো।"
কাঠের পুতুলের ন্যায় চুপ করে শুয়ে রইল নিতু। জিয়ান নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বলল,
"আমার প্রাক্তন ওয়াইফের নাম মাহিরা। ভাবির ছোটো বোন। ভাইয়া-ভাবির বিয়েটা ছিল অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ। ওদের বিয়ের মাধ্যমেই মাহিরাকে আমি চিনি। সম্পর্কে বেয়াইন লাগত তাই হাসি-ঠাট্টা করতাম। ও বাসায় আসত প্রায়ই। একেক সময় একেক রকমভাবে মনের ভাব বোঝানোর চেষ্টা করত। প্রথম প্রথম আমি এসব আমলে নিতাম না। একদিন সরাসরি বলে দিল ও আমাকে ভালোবাসে। আমি সেদিন খুব একটা অবাক হইনি। কারণ ওর ভাবসাব, চোখের ভাষায় আমি আগেই বুঝেছিলাম যে ও আমাকে পছন্দ করে কিংবা ভালোবাসে। সত্যি বলতে ওকেও আমার ভালো লাগত। কিন্তু বিয়ে করার মতো ভাবনা কিংবা রিলেশন করব এসব আমি কখনও ভাবিনি। সেদিন ওর ভালোবাসার কথারও কোনো জবাব দিতে পারিনি। ও ধরে নিয়েছিল, উত্তর নেগেটিভ। তাই ভীষণ কান্নাকাটি করেছিল। আমাদের বাসায় আসা বন্ধ করে দিয়েছিল। আমার ফোন ধরত না, ম্যাসেজের রিপ্লাই করত না। পরে তখন আমি ওর একাকীত্ব অনুভব করতে শুরু করি। প্রচণ্ড মিস করতাম। একটা সময়ে ফিল করলাম, হ্যাঁ ওকে আমিও ভালোবাসি। ওকে আমার চাই। কিন্তু কীভাবে ওকে এটা বলব বুঝতে পারছিলাম না। আমার দোনামোনার মাঝেই ভাবি তার বাবা-মাকে নিয়ে সরাসরি আমার বাবা-মায়ের সাথে আমার এবং মাহিরার বিয়ে নিয়ে কথা বলতে বসল। আমি বিস্মিত হওয়ার সাথে সাথে খুশিও হয়েছিলাম। মাহিরাকে বাবা-মায়েরও ভীষণ পছন্দ ছিল। তাই তারা আপত্তি করেনি। আমাকে মতামত জানাতে বললে আমিও হ্যাঁ বলে দেই। আমাদের যখন বিয়ে হয় মাহিরা তখন ইন্টার প্রথম বর্ষের ছাত্রী। বিয়েটা হলো একদম ঘরোয়াভাবে। একদম ঘরোয়াভাবে মানে দুই পরিবার আর আমার খুব কাছের দুই বন্ধু ছাড়া আর কেউ জানত না। এমনকি পাড়া-প্রতিবেশীরাও নয়। কথা ছিল, মাহিরার ইন্টার কমপ্লিট হলেই অনুষ্ঠান করে বিয়ে হবে আর তখনই সবাইকে জানানো হবে। বিয়ের পর সময়টা যাচ্ছিল স্বপ্নের মতো। আমি নিজেই তখন ওর চেয়ে বেশি পাগল হয়ে গেছিলাম। সারাক্ষণ ওর কথা ভাবতাম। ওর সাথে কথা বলার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুণতাম। এমনভাবে ওর মাঝে বিলীন হয়ে গেছিলাম যে তখন আমি মাহিরা ছাড়া আর কিচ্ছু বুঝতাম না। ও সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার পর সব এলোমেলো হতে শুরু করে। অন্য ছেলের সাথে সম্পর্ক জড়ায়। কল ওয়েটিং পেতাম। ভীষণ ব্যস্ততা দেখাত। সম্পর্কের কথা জানার পর ওকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে সরাসরি আমায় বলে দিয়েছিল, ওর নাকি এখন আর আমাকে ভালো লাগে না। আমার সাথে সংসার করবে না। কত হাতে-পায়ে ধরে কেঁদেছি তবুও ওর মন গলাতে পারিনি। দুই পরিবারের কেউই ওকে ওর সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারেনি। কেউ থাকতে না চাইলে তো আর জোর করে তাকে রাখা যায় না। তাই ওর ইচ্ছেতেই ডিভোর্স হয়ে গেল আমাদের। আমি হয়ে গেলাম ছন্নছাড়া। কী করি, না করি নিজেরই কাজের কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। মা কান্নাকাটি করত ভীষণ। মাস ছয়েক যাওয়ার পর ভাবলাম নিজেকে আবারও গুছিয়ে নেওয়া প্রয়োজন এবং আর কোনো নারীকে জীবনে ঠাই দেবো না। আমার এই সিদ্ধান্তে আমি ততদিন পর্যন্তই স্থির থাকতে পেরেছিলাম, যতদিন আমি তোমায় দেখিনি। তোমায় চিনতাম না। আসিফের বাসায় লাল ড্রেস পরা তোমাকে দেখে আমার কী যে হয়ে গেল আমি বুঝতেই পারিনি! নতুন করে ভালোবাসা জন্মাতে শুরু করল মনে। অনেকবার চেষ্টা করেছি তোমাকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার কিন্তু পারিনি। তোমার সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিয়ে বুঝলাম, তুমি রিলেশনে কখনও রাজি হবে না। সত্যি বলতে রিলেশনে আমিও আগ্রহী ছিলাম না। বিয়ে নিয়ে আরও বেশি ভয়ে ছিলাম যে, সব জানলে তোমার বাবা-মা তোমাকে আমার কাছে বিয়ে দেবে নাকি। তুমিই রাজি হবে কিনা সব নিয়ে আমি ভীষণ ভয়ে ছিলাম। আর তাই বাধ্য হয়েই আগের বিয়ের কথাটা লুকিয়েছিলাম।"
একসঙ্গে এতগুলো কথা বলে থামল জিয়ান। কয়েক সেকেন্ড পর মৌনতা কাটিয়ে নিতু কঠিনস্বরে বলল,
"প্রতারকের কোনো ক্ষমা হয় না। আপনার সাথে যা-ই হয়ে যাক না কেন, আপনি মিথ্যে দিয়ে আমার সাথে সম্পর্ক শুরু করে একদম ঠিক করেননি। যতটা মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন, তারচেয়েও অধিক তাড়াতাড়ি মন থেকে উঠে যাচ্ছেন। আপনাকে আমি সহ্য করতে পারছি না।"
পর্ব_৫
ভারি বর্ষণের মাঝেও খরার মতো সময় কাটছিল নিতুর। বাবা-মায়ের সঙ্গে তার কথা হয়েছে। নতুন বাসায় আসার তিনদিনের দিনই জিয়ান তাদেরকে নিয়ে এসেছিল। হাতে-পায়ে ধরে অনেক অনুনয়-বিনয় করেছে। নিতুকে ভিক্ষা চেয়েছে। জিয়ানের ওপর তারা ক্ষুব্ধ থাকলেও সেটা ছিল সাময়িক। একটা মেয়ের জীবনে বিয়ে নামক শব্দ জুড়ে গেলে কি ছেড়ে যাওয়া এতটাই সহজ? অন্তত বাঙালি মেয়ের জীবনে তো নয়। এজন্যই হয়তো রাগ-জেদকে প্রশ্রয় না দিয়ে বাবা-মা, বোন, দুলাভাই সকলেই নিতুকে সবটা মেনে নিতে বলেছে। সংসারে ঝামেলা হয়ই। ঝামেলা হয় সেটা নিতুও জানে। তাই বলে প্রতারণা? মা, বোন যখন মাথায় হাত বুলিয়ে বোঝাচ্ছিল নিতু কিচ্ছুটি বলেনি। চুপচাপ সবার কথা শুনে গেছে। কী-ই বা বলবে সে? তার আগেও কিছু বলার ছিল না আর এখনও নেই। তবে মনে মনে ঠিকই সে ভেবে নিয়েছে আজ হলেও সে জিয়ানকে ছেড়ে চলে যাবে, কাল হলেও যাবে। এজন্য সে কাউকেই কিছু বলার প্রয়োজন মনে করেনি। কিছুদিন বাদে শ্বশুর-শাশুড়ীও এসেছিল। তারাও তাদের ভুলের জন্য অনুতপ্ত। কিন্তু নিতু যেন স্তব্ধ, জড়বস্তু পুতুলের মতো। যার মাঝে কোনো রাগ, ক্ষোভ, প্রাণ কিছুই নেই।
ভাবির জন্য জিয়ান নিতুকে নিয়ে আলাদা থাকছে। এতে বাবা-মায়েরও সায় রয়েছে। কারণ তারা কেউই চায় না মিনার জন্য আবার ওদের মাঝে কোনো ঝামেলা হোক। মাহিরাও আজকাল ও বাড়িতে আসছে। নিতু নিশ্চয়ই এসব ভালোভাবে নেবে না। মনের ওপর ফের বাজে প্রভাব পড়বে। জিয়ান কোনোমতেই নিতুকে হারাতে চায় না। তাই সে নিতুকে নিয়ে আলাদা থাকাটাই শ্রেয় মনে করছে।
নিতু বসে আছে বারান্দার ফ্লোরে। রান্নাঘর থেকে শব্দ এলো। কিছু পড়ে গেছে হয়তো। জিয়ান অফিস থেকে এসেই রান্না করতে চলে গেছে। শুধু আজ নয়; এক মাস ধরেই এই নিয়ম চলে আসছে। চাইলেই কাজের খালা রাখা যায়। তবে জিয়ান চাইছে সে নিজেই নিতুর জন্য রান্না-বান্না করবে। সব রকম কেয়ার করবে। অতি আদরে বেড়ে ওঠা নিতু রান্নাবান্নার 'র'-ও জানে না। কখনও তাকে রান্নাঘরের গণ্ডিও পেড়োতে হয়নি। হেঁশেল সর্বদা মা এবং কাজের মেয়ে সামলাত। নিতুর ভীষণ ইচ্ছে ছিল বিয়ের পর সে তার শাশুড়ির থেকে রান্না শিখবে। শখ, ইচ্ছে তো আরও কতকিছুই ছিল। এখন যেন সব মরিচিকা।
জিয়ান হন্তদন্ত হয়ে রান্নাঘর থেকে ঘরে এলো। ওয়ারড্রব, ড্রেসিংটেবিলের সবগুলো ড্রয়ারে ব্যস্ত হয়ে কিছু খুঁজছে। ঘুটুরমুটুর শব্দ শুনে নিতু বারান্দা থেকে ঘরে চলে এলো। ওকে দেখামাত্রই জিয়ান জিজ্ঞেস করল,
"বার্না মলমটা দেখেছ?"
নিতু জিয়ানের হাতের দিকে তাকাল। ডান হাতে আঙুলের কাছের অনেকখানি জায়গা লালচে হয়ে আছে। সে কোনো প্রশ্ন না করেই নিশ্চুপ থেকে মলমটি খুঁজে হাতে দিল। তৎক্ষণাৎ আবার কী যেন ভেবে নিজেই জিয়ানের হাতে মলম লাগিয়ে দিল। এই ঘটনায় যেন জিয়ানের সমস্ত কষ্ট ধুয়ে পানি হয়ে গেছে। ভাতের গরম মাড় হাতে পড়ায় যতটা যন্ত্রণা হচ্ছিল, এখন তার চেয়েও অধিক বেশি আনন্দ অনুভব হচ্ছে। সে মনে মনে ভাবছে,
"ভাগ্যিস ভাতের মাড় পড়েছিল!"
মলম লাগানো শেষে নিতু ভারী কণ্ঠে বলল,
"রান্না শেষ?"
জিয়ান বলল,
"উঁহু! তরকারি বাকি আছে।"
নিতু কয়েক সেকেন্ড নিষ্পলক তাকিয়ে রইল। তার আজ নিজের ওপর ভীষণ রাগ হচ্ছে। কেন যে আগে সে রান্নাটা শিখল না! নিতুর রাগ-জেদ যত বেশি মনটাও ঠিক ততটাই নরম। জিয়ানের প্রতি তার ক্ষোভ থাকা সত্ত্বেও এখন ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। সে নিরবতা কাটিয়ে বলল,
"রান্না করতে হবে না। দোকান থেকে কিছু এনে দিন।"
"কিন্তু তুমি তো বাইরের খাবার পছন্দ করো না।"
"একদিন খেলে কিছু হবে না।"
"আমি রান্না করতে পারব নিতু। তুমি বিশ্রাম নাও।"
নিতু বিস্ময়ে হা হয়ে তাকিয়ে রইল। সারাদিন কাজ করে এসেছে সে। আর বিশ্রাম নিতে বলছে নিতুকে! জিয়ান রান্নাঘরে চলে গেছে। কিছুক্ষণ বাদে নিতুও রান্নাঘরে গেল। থমথমে মুখে বলল,
"আপনি আমাকে গাইড করুন। আমি রান্না করছি।"
জিয়ান সঙ্গে সঙ্গে বলল,
"না, না। একদম না। বাবা-মায়ের কাছে যখন ছিলে তখন রান্নাঘরের আশেপাশেও যাওনি। আর এখন আমি তোমাকে দিয়ে রান্না করাব? অসম্ভব! তুমি রুমে যাও।"
"এত আহ্লাদ করতে হবে না। বিয়ের আগের আর পরের জীবন কি এক?"
"তুমি আগেও যেমন ছিলে, এখনও তেমনই থাকবে। এমনিতেই আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। আর কোনো কষ্ট দিতে চাই না।"
নিতু জেদ ধরে বলল,
"ঠিক আছে। আজ তাহলে আমি খাবও না।"
জিয়ান দমে গেল। নিতুর রাগ সম্পর্কে সে অবগত। তাই নিজের অপারগতা মেনে নিয়ে বলল,
"রাগ কোরো না। আমি বলে দিচ্ছি। তবে তরকারিটা বসিয়েই তুমি ঘরে চলে যাবে। বাকিটা আমি সামলে নিতে পারব। ঠিকাছে?"
নিতু প্রত্যুত্তর করল না। জিয়ান যেভাবে যেভাবে বলে দিল নিতুও ঠিক সেভাবেই তরকারি বসিয়ে ঢেকে দিল। জীবনে প্রথমবারের মতো সে রান্না করছে। কিছুটা ভীতি ও কিছুটা আনন্দ কাজ করছে তার মাঝে। নিতুর হাসি হাসি মুখ দেখে সাহস সঞ্চয় করল জিয়ান। আলগোছে পেছন থেকে বাম হাত দিয়ে নিতুকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে থুঁতনি রাখল। হাসি বন্ধ হয়ে গেলেও নিতু সরল না। কিছু বললও না। জিয়ানের সঙ্গে তার মনে মনে ঝগড়া চললেও সে জিয়ানকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেনি। যখন কাছে চেয়েছে নিতু রাজি হয়েছে। বারণ করেনি। তবে সে যে মন থেকে সায় দেয়নি এটাও জিয়ান বুঝতে পারত।
জিয়ান ক্ষীণস্বরে বলল,
"আমার ওপর কি এখনও রাগ আছে তোমার?"
"গরম লাগছে। ঘরে যাব।"
জিয়ান ছেড়ে দিল নিতুকে। ছোটোখাটো এই মুহূর্তগুলোতে নিতু সবসময়ই তাকে এড়িয়ে চলে। ওপর থেকে স্বাভাবিক ব্যবহার করছে মনে হলেও ভেতর থেকে একদমই নিস্তব্ধ হয়ে গেছিল নিতু।
কয়েকদিন যাবৎ নিতুর মুড সুইং বেশি হচ্ছে। খেতে ভালো লাগলে না। মাথা ঝিমঝিম করে। বমি বমি লাগে। কয়েকদিন স্বাভাবিক অসুস্থতা মনে হলেও এখন ভয়টা মনে চেপে বসেছে। গত মাসে পিরিয়ড হয়নি। এই মাসেও মিসিং। ভয়, সংশয় থেকেই জিয়ানকে বলেছিল প্রেগন্যান্সী কিট আনতে। জিয়ান রাতে বাড়ি ফেরার পথে নিয়ে এসেছিল। রাতে খেয়ে-দেয়ে নিতু অপেক্ষা করছে সকাল হওয়ার। রাতে দুশ্চিন্তায় ঠিকমতো তার ঘুমও হয়নি। সারা রাত প্রায় জেগেই ছিল। ভোর পাঁচটার দিকে উঠে সে ওয়াশরুমে গিয়ে প্রেগন্যান্সী কিট দিয়ে টেস্ট করে। রেজাল্ট দেখে তার চোখ ছানাবড়া। বুক কেঁপে ওঠে। কিছুক্ষণ থম মেরে কিটের দিকে তাকিয়ে থাকে। পরক্ষণেই অগ্নিমূর্তি ধারণ করে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে জিয়ানকে চিৎকার করে ডাকতে শুরু করে। জিয়ান ধড়ফড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে বসে। চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করে,
"কী হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে?"
নিতু কিট ছুঁড়ে ফেলল বিছানার ওপর। জিয়ান হাতে তুলে নিয়ে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকে। রেজাল্ট পজেটিভ দেখে খুশিতে ঝলমল করে ওঠে তার মুখ। আনন্দে আত্মহারা হয়ে কিছু বলার পূর্বেই নিতু চিৎকার করে বলে,
"কেন করলি এই কাজ! কেন বেবি দিলি। বেবি নিব বলছিলাম?"
জিয়ান নিতুকে শান্ত করতে বলল,
"আমার কথা শোনো নিতু..."
"কীসের কথা শুনব? তুই ইচ্ছে করে করেছিস এটা যেন আমি তোকে ছেড়ে যেতে না পারি তাই না?"
রাগে ঘরের জিনিসপত্র ভাঙচুর করতে শুরু করে নিতু। অবস্থা বেগতিক দেখে জিয়ান উঠে গিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। প্রথমে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ধস্তাধস্তি করলেও পরে নিতু চুপ হয়ে যায়।
তোমার_দ্বিধায়_বাঁচি
পর্ব_৬ (অন্তিম পর্ব)
মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
জিয়ান-নিতুর ছোট্ট ফ্ল্যাটটির আনাচে-কানাচে আনন্দ ও খুশির ছোঁয়া। খবর পেয়ে দু'জনের পরিবারই ছুটে এসেছে। মিষ্টিতে ভরে গেছে ঘর। নিতু স্তব্ধ, নিশ্চুপ। মা হওয়া নিয়ে তো এক সময় তার মাঝেও অনেক স্বপ্ন ছিল। তাহলে এখন সে কেন খুশি হতে পারছে না? জিয়ানের একটা ভুলের জন্য? একটা ভুল কি মনের মাঝে এতটাই দাগ কাটতে পারে?
সবাই একসঙ্গে বসে আছে। নিতুর মা মমতা বেগম বললেন,
"জিয়ান, নিতুকে তাহলে আমাদের বাসায় নিয়ে যাই এখন? তুমি তো সারাদিন অফিসে থাকো। ওর দেখভাল করার জন্য তো কাউকে প্রয়োজন।"
জিয়ান সঙ্গে সঙ্গে বলল,
"না, মা। নিতু আমার কাছেই থাকবে। আমি ওর দেখাশোনা করার জন্য আলাদা লোক রাখব।"
নিতু এই প্রসঙ্গে কিছুই বলল না। সে এখানেই থাকুক কিংবা বাপের বাড়িতেই থাকুক না কেন তা নিয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। নিতুর বাবা-মা এতটুকু বুঝতে পেরেছে এতদিনে, জিয়ান তাদের মেয়েটাকে ঠিক কতটা ভালোবাসে! সত্যি বলতে এত তাড়াতাড়ি বাচ্চা নেওয়ার প্ল্যান দুই পরিবারেরই ছিল। বাচ্চা হলে হয়তো নিতু আর এমন থাকবে না। তার মন পালটে যাবে। আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে যাবে। জিয়ান খুব করে চায়, তার নিতু আগের মতো হয়ে যাক। তাই তো এভাবে বাচ্চা নেওয়া। কেউ আর নিতুকে নিয়ে যাওয়ার জন্য জোর করল না। মাঝে মাঝে তারা এসে কয়েকদিন করে থেকে যাবে। নিতুর মা যাওয়ার পূর্বে মেয়ের হাতে চুমু খেলেন। তার চোখে অশ্রু। আনন্দের অশ্রু। তার সেই ছোটো মেয়েটা কত বড়ো হয়ে গেছে! তার চোখের দৃশ্যপটে এখনও ভাসছে এইতো কিছুদিন আগেও মেয়েটা তার আঁচল ধরে ঘুরত। সারাক্ষণ মা, মা ডেকে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলত। আর সেই মেয়েটাই এখন মা হবে। তাই আনন্দে, খুশিতে চোখে পানি এসে পড়েছে। তিনি নিতুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
"এবার একটু স্বাভাবিক হ মা। আগের মতো হাসি-খুশি থাক। অতীত ভুলে যা। জিয়ান তো আর তোকে ছেড়ে যায়নি। দুনিয়ার সমস্তকিছু একদিকে আর অন্যদিকে তুই। কেন জেদ করে শুধু শুধু ছেলেটাকে কষ্ট দিচ্ছিস আর নিজেও কষ্ট পাচ্ছিস? জীবনটা ভীষণ ছোট্ট রে মা। এক জীবনে যদি রাগ-অভিমান করেই সময় নষ্ট করে ফেলিস তাহলে ভালো আর থাকবি কবে? নিজের ভালো থাকাটা নিজেরই তৈরি করে নিতে হয়। অন্য কেউ তোর ভালো থাকা তৈরি করতে পারবে না। আমার কথাগুলো একটু শুনিস মা। নিজের যত্ন নিস। খাওয়া-দাওয়া করিস ঠিকমতো। এখন আর তুই কিন্তু একা না। তোর মাঝে আরেকটা প্রাণ বেড়ে উঠছে ধীরে ধীরে। নিজের জন্য না হলেও ওর জন্য তোকে ভালো থাকতে হবে।"
নিতু মায়ের সবগুলো কথা চুপচাপ শুনে গেছে শুধু। সবাই চলে যাওয়ার পর আবার বাড়ি ফাঁকা হয়ে গেছে। দু'দিনের ভেতরেই জিয়ান ১৯/২০ বছরের একটা মেয়ে ঠিক করে। জিয়ান অফিস থেকে না আসা অব্দি শুধু মেয়েটা নিতুর সঙ্গে সঙ্গে থাকবে এবং খেয়াল রাখবে। আরেকজন কাজের খালা ঠিক করে যিনি তিনবেলা এসে শুধু বাড়ির কাজ করে যাবে।
নিতুর মাঝে আরেকটা প্রাণ আছে এটা সে মন থেকে অনুভব করতে পারে না। হয়তো এমনিতেও এই অনুভূতি হতো না, যদি না প্রেগন্যান্সীর সিনড্রোম তার মাঝে দেখা যেত। বাচ্চা পেটে আসার পর থেকেই তার অস্বস্তি শুরু হয়। কিছুই খেতে পারে না। সারাক্ষণ মুখ তিতকুটে হয়ে থাকে। পেটে কিছুই থাকে না তবুও সারাক্ষণ বমি, বমি একটা ভাব থাকে। মাথা কেমন ঝিমঝিম করে। তেঁতুল ছাড়া আর কিছুই তার ভালো লাগে না। যেকোনো খাবারের গন্ধই তার বিরক্ত লাগে। বিশেষ করে মাছের গন্ধ সে একেবারেই সহ্য করতে পারে না। এজন্য জিয়ান বাড়িতে মাছ আনা বন্ধ করে দিয়েছে। সে নিজেও নিতুর জন্য মাছ খায় না। নিতু যখন একা একা থাকে তখন আনমনে সে পেটের ওপর হাত রাখে। বোঝার চেষ্টা করে, এখানেই বুঝি আছে সেই ছোট্ট প্রাণ? কিন্তু মা হওয়া যে সহজ বিষয় নয়। এই যে এত এত অসহ্য যন্ত্রণা তাকে সহ্য করতে হচ্ছে এগুলো তো সে আগে কখনও অনুভব করেনি। তবে এখন জিয়ানের কেয়ার করার পরিমাণ আরও বেড়ে গেছে। এক কথায় বলতে গেলে, নিতুকে সে চোখে হারায়। দুই একদিন পরপরই বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ী, বোন-দুলাভাই এসে নিতুকে দেখে যায়। আসার সময় একগাদা করে খাবার নিয়ে আসে। এত খাবার দেখে গা গুলিয়ে ওঠে নিতুর।
নিতু যে মা হচ্ছে, তার মাঝেও যে আরেকটা প্রাণ আছে এটা সে সত্যিকার অর্থে মন থেকে অনুভব করে একদিন মাঝরাতে। হঠাৎ করেই সে পেটে আঘাত পায়। ঘুমের ঘোরে তখন বুঝতে না পারলেও ঘুম ভাঙার পরে বুঝতে পারল, তার সেই ছোট্ট প্রাণ পেটে কি-ক দিচ্ছে। সে ব্যথা পাচ্ছে তবুও অদ্ভুত আনন্দ হচ্ছে তার মাঝে। সে তার বড়ো পেটটির ওপর হাত রাখল। এইতো আবারও কি-ক দিল! নিতু উঠে বসতে চাইল। কিন্তু একা উঠতে, বসতে, শুতে তার এখন অনেক সমস্যা হয়। সে জিয়ানকে ডেকে তুলল। জিয়ান কিছুটা ভয় পেয়ে বলল,
"কী হয়েছে? কিছু লাগবে?"
নিতু ক্ষীণস্বরে বলল,
"আমি বসব।"
জিয়ান নিতুকে ধরে বালিশের সঙ্গে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিল। নিতুর এক হাত ধরে বলল,
"খারাপ লাগছে?"
নিতু কিছু বলল না। জিয়ানের হাতটা নিজের পেটের ওপর রাখল। জিয়ান আনন্দ চিৎকার করে বলল,
"বাবু কি-ক দিচ্ছে!"
নিচু ছলছল নয়নে উপর-নিচ মাথা ঝাঁকাল। নীল রঙের ডিম লাইটের মৃদু আলোতে নিতুর হাসি, ছলছল করা নয়ন সবই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল জিয়ান। সে নিতুর পেটে আলতো করে চুমু খেয়ে নিতুকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরল। এভাবে কতটা সময় পার হয়েছে কেউই জানে না। নিতুর সকল অভিমান, গ্লানি, কষ্ট মনে হচ্ছে আজ নেই হয়ে গেছে। নতুন প্রাণের অস্তিস্ত তাকেও নতুন একটা জীবন উপহার দিয়েছে। জিয়ানের বুকে মাথা রেখেই নিতু বলল,
"বাচ্চা হওয়ার সময় তো অনেক মেয়েরা মা-রা যায়। যদি আমি মা-রা যাই আপনি কী করবেন?"
জিয়ানের বুক কেঁপে ওঠে। সে শক্ত করে জড়িয়ে ধরার বাঁধন। মৃদু ধমকেরসুরে বলে,
"একদম আজেবাজে কথা বলবে না নিতু। এসব কথা আমার একদম ভালো লাগে না।"
"এগুলো তো সত্যি কথা। আপনিই বলেন, এমনটা কি হয় না?"
"হলে হয়। কিন্তু আমার নিতুর সাথে এমনটা কখনও হবে না। আমার আল্লাহ্ এত নিষ্ঠুর না।"
নিতুর গলা ধরে আসছে। এর আগে তো কখনও তার এমনটা অনুভব হয়নি। মা-রা যাওয়ার কথা তাহলে আজই কেন মনে এলো? এই সুন্দর মুহূর্তেই কেন? হারানোর ব্যথায় বুক ভারী হয়ে যাচ্ছে। সত্যিই যদি সে ম-রে যায় তখন তাহলে জিয়ানের কী হবে? সে কি তার অনাগত বাবুটাকে দেখেও ম-র-তে পারবে না? সে তো জিয়ানের থেকে হারিয়ে যেতে চায় না এভাবে।
নিতু কণ্ঠস্বর শক্ত করে বলল,
"যদি ডাক্তার বলে, বাচ্চা আর মায়ের মধ্যে যেকোনো একজনকে বাঁচানো যাবে তাহলে আপনি কাকে বাঁচাবেন তখন? খবরদার! ভুলেও কিন্তু আমাকে বাঁচানোর কথা বলবেন না। আমি তো অনেকটা সময় পৃথিবীতে থেকেছি। পৃথিবীর আলো দেখেছি। কিন্তু আমাদের বেবি তো দেখেনি। কথা দিন, এমন সিচুয়েশন এলে আপনি ওকেই এই পৃথিবী দেখার সুযোগ করে দেবেন?"
জিয়ান এবার কেঁদে ফেলে। নিতুর মুখ চেপে ধরে বলে,
"চুপ! এসব কথা একদম বলবে না। এমন কিছুই হবে না। আমি কাউকেই হারাতে চাই না। হারাতে পারবও না। আমার তোমাকেও লাগবে আর আমাদের বেবিকেও। কত স্বপ্ন আছে আমাদের। আমরা তিনজনে একসাথে সেই স্বপ্ন পূরণ করব।"
"স্বপ্ন আমারও আছে। কিন্তু..."
জিয়ান নিতুকে থামিয়ে দিতে নিতুর ঠোঁটে গভীর চুম্বন দিল। আর কোনো কিন্তু সে মাঝে আনতে চায় না। নিতু তার। সর্বদা নিতুকে তার কাছেই থাকতে হবে।
_______
সকালে জিয়ান ঘুম থেকে উঠে রেডি হয়ে নিল। অফিসে যাওয়ার পূর্বে নিতুকেও উঠিয়ে ফ্রেশ করিয়ে অল্পকিছু খাবার খাইয়ে দিল। এর মাঝেই নিতুর দেখাশোনা করা মেয়েটি চলে আসে। ওর নাম শাপলা। যেমন মিষ্টি দেখতে তেমনই ওর যত্ন নেওয়ার ক্ষমতা। জিয়ান বাসায় আসার আগ অব্দি নিতুর সময়টা শাপলার সাথে বেশ ভালোভাবেই কেটে যায়।
"শাপলা, নিতুর কিন্তু ভালোভাবে খেয়াল রাখবে। ও খেতে চায় না জানোই তো। জোর করে হলেও খাওয়াবে। আর যেকোনো প্রয়োজনে যখন দরকার হবে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে কল করবে। মনে থাকবে?"
শাপলার উদ্দেশ্যে বলল জিয়ান। শাপলা মাথা দুলিয়ে বলল,
"হ ভাইজান, মনে থাকব। আমার আর কী মনে থাকব, আপনে তো একটু পরপর নিজেই ফোন কইরা আপার খোঁজখবর নেন।"
জিয়ান নিতুর দিকে তাকিয়ে কিছুটা লজ্জা পেল। সে শাপলাকে বলল,
"রান্নাঘর থেকে ওকে দুধটা এনে দাও।"
শাপলা রান্নাঘরে চলে গেল। নিতু বলল,
"একটু আগেই না দুধ খেলাম?"
জিয়ান নিতুর কাছে এগিয়ে বসল। দু'হাত ধরে বলল,
"হ্যাঁ। ওর সামনে তো আর বউকে চুমু খাওয়া যাবে না। একটা চুমু খাই?"
নিতু হেসে ফেলে। দৃষ্টি নামিয়ে বলে,
"আজ যে খুব অনুমতি নেওয়া হচ্ছে? এতদিন কি আপনি চুমু খাননি? প্রতিদিনই তো অফিসে যাওয়ার আগে ঘুমের মধ্যে চুমু খেয়ে যেতেন।"
জিয়ান অবাক হয়ে শুধায়,
"তুমি জানলে কীভাবে? তুমি তাহলে তখন জেগেই থাকতে?"
"উঁহু! জেগে যেতাম আপনার স্পর্শে।"
জিয়ান হাসে। প্রশান্তির হাসি। নিতুর কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দিয়ে সে জড়িয়ে ধরে। শাপলার আসার পায়ের শব্দ শুনে ছেড়ে দেয়। গালে আলতো করে হাত বুলিয়ে বলে,
"নিজের খেয়াল রেখো জান। আসছি।"
"সাবধানে যাবেন।"
জিয়ান অফিসে চলে যায়। শাপলা দুধের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলে,
"আপা,নেন।"
"রেখে দাও। পরে খাব।"
"পরে ক্যান? ভাইজান কইছে, এখনই খাওয়াইতে। আপনে এখনই খাইবেন।"
"তোমার ভাইয়া একটু আগেই খাইয়ে গেছে। এখন আর পেটে জায়গা নেই।"
"অল্প হইলেও খাইতে হইব। ভাইজান আমারে দায়িত্ব দিয়া গেছে না?"
নিতু বুঝল, শাপলা নাছোড়বান্দা। তাই সে কয়েক ঢোক খেয়ে টেবিলের ওপর গ্লাসটি রেখে দিল। শাপলাকে ধরে সে খাট থেকে নিচে নামে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের উঁচু পেটের ওপর হাত রেখে আনমনেই মুচকি হাসে। পেটে হাত বুলিয়ে বলে,
"বলো তো শাপলা, আমাদের ছেলে হবে নাকি মেয়ে?"
শাপলা মাথা চুলকে ভাবুক হয়ে বলল,
"উমম! মেয়ে। আপনাগো পরীর লাহান একটা মাইয়া হইব।"
"কেন বলো তো? ছেলে হবে না কেন? তোমার ভাইয়াও বলে মেয়ে হবে।"
"জানি না তো। আমার মন কইল তাই কইলাম। আপা, এহন তো আলতা না কী জানি করে। আপনে করেন নাই? তাইলেই তো জানতে পারতেন, পোলা হইব নাকি মাইয়া।"
নিতু হেসে বলল,
"আলট্রা সনোগ্রাফি। এখনও করিনি। তোমার ভাইয়া অনেকবার বলেছে। রাজি হইনি।"
"ক্যান?"
"সে তো অনেক কারণ। পরে অবশ্য ভেবেছিলাম, সারপ্রাইজ থাকুক। বাবু হওয়ার পরই জানা যাবে। কিন্তু এখন বাবা-মা, আব্বু-আম্মু সবাই জোর করছে। বাবু কেমন আছে সেটাও তো জানতে হবে। তাই এই শুক্রবার যাব বলেছি।"
"ভালো হইব। তাইলে জানা যাইব।"
নিতু হঠাৎ পেটে হাত রেখে আর্তনাদ ওরে ওঠে। শাপলা ভয় পেয়ে যায়। উঠে গিয়ে নিতুকে ধরে বিছানায় বসিয়ে জিজ্ঞেস করে,
"আপা কী হইছে? ভাইয়ারে ফোন দিমু?"
নিতু শাপলার হাত চেপে ধরে মৃদুস্বরে বলল,
"আহা! ব্যস্ত হচ্ছো কেন? কিছু হয়নি আমার।"
"তাইলে আপনে এমন করতাছেন ক্যান?"
"পেটের ভেতর বাবু কি-ক দিচ্ছে।"
"কী দিতাছে?"
"লা-থি দিচ্ছে। এবার বুঝেছ?"
শাপলা হেসে বলে,
"ওহ। এবার বুঝছি। আমি একটু দেহি?"
নিতু হেসে বলে,
"দেখো।"
শাপলা নিতুর পেটের ওপর হাত রাখল। বাবু কি-ক দেওয়ার পর সে আনন্দে উচ্ছ্বাসিত হয়ে বলল,
"হ, হ! এইতো বাবু লা-থি দিতাছে। এহন মনে হইতাছে আপা, পোলা বাবু হইব।"
একটু থেমে সে নিতুর পেটে হাত বুলিয়ে বলল,
"এইযে দুষ্টু, মায়রে এমনে লা-থি দিতাছো ক্যান? মায় কষ্ট পায় না? শান্ত হও। শান্ত হও। চুপ করে শুয়ে থাকো।"
নিতু শাপলার কথার ধরণ শুনে খিলখিল করে হাসতে থাকে।
.
.
নিতুর এখন নয় মাস চলছে। তার চলাফেরায় বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। অবশ্য এতে খুব একটা কষ্ট তাকে করতে হয় না। মমতা বেগম এবং আফরোজা বেগম দেখাশোনা করার জন্য এক মাস যাবৎ এই বাড়িতেই আছেন। যত্নের কোনো ত্রুটি রাখেনি এই দুই মা। রোজ রোজ দুই বেয়াইন গল্প জুড়ে দেয় তাদের নাতিনকে নিয়ে। রাজপুত্র আসবে বাড়িতে। কতশত নাম ভেবে রেখেছে সবাই। কিন্তু এখনো কোনো নাম ফাইনাল করা হয়নি।
জিয়ান অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিল। নিতু খাটের ওপর হেলান দিয়ে বসে আছে। তার দৃষ্টি জিয়ানের দিকে। জিয়ান আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে জিজ্ঞেস করল,
"কিছু বলবে?"
নিতু মুখ গোমড়া করে বলল,
"এখনো তো আমাদের ছেলের কোনো নাম রাখা হলো না।"
জিয়ান হেসে বলল,
"রাখব তো। সবাই কত কত নাম রাখছে। একটা না একটা সিলেক্ট তো করা হবেই।"
"সেটা কবে?"
"উমম! যেদিন আমাদের বাবু দুনিয়াতে আসবে। সেদিন ওর মুখ দেখার পর যেই নামটা আমার প্রথম মনে আসবে সেই নামটাই রাখব।"
"বাবুকে কি সবার আগে আপনি কোলে নেবেন?"
"জানিনা। সবার আগে আমি তোমাকে দেখব। তুমি সুস্থ আছো কিনা সেটা জানা বেশি জরুরী আমার।"
"যদি দেখেন আমি মা-রা গেছি?"
জিয়ানের মুখের রঙ পাল্টে যায়। সে চোখ-মুখ শক্ত করে বলে,
"তোমার এসব কথা আমার ভালো লাগে না নিতু। আর কতবার বলব তোমায় এ কথা? কেন এভাবে আমাকে কষ্ট দাও তুমি?"
নিতু চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। এরপর বলল,
"আচ্ছা সরি। আর বলব না। একটু কাছে আসেন।"
জিয়ান কাছে এসে বসল। নিতুর চুলের মাঝে হাত বুলিয়ে বলল,
"আমি তোমায় হারাতে পারব না। কেন বোঝো না তুমি?"
নিতু এবার আর কিছু বলল না। নিঃশব্দে মাথা রাখল জিয়ানের বুকে। মিনিট পাঁচেক পর জিয়ান ঘড়ি দেখল। অফিসে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। সে বলল,
"নিতু, আজকে অফিসে না যাই?"
নিতু মাথা তুলে বলল,
"কেন?"
"তোমাকে এভাবে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না।"
"ইশ! ঢং।"
জিয়ান হেসে নিতুর কপালে চুমু খেয়ে বলল,
"আচ্ছা যাচ্ছি আমি। নিজের খেয়াল রেখো। আল্লাহ্ হাফেজ।"
জিয়ান অফিসে যাওয়ার পর নিতু মা, শাশুড়ি এবং শাপলার সাথে বসে গল্প করছিল। আচার খাওয়ার সময় নিতুর লেবার পেইন উঠে। তৎক্ষণাৎ নিতুকে হাসপাতালে আনা হয়। প্রচন্ড ব্যথায় সে চিৎকার করে কাঁদছিল এবং বারবার জিয়ানকে দেখার জন্য আর্তনাদ করছিল। আফরোজা বেগম নিতুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
"একটু সহ্য করো মা! জিয়ানকে ফোন করেছে তোমার বাবা। ও এখনই আসছে।"
নিতুর নরমালে ফুটফুটে একটা সুন্দর ছেলে বাবু হয়েছে। ঠিক যেন রাজপুত্র। ডাক্তার এবং নার্স বাইরে এসে দেখলেন কারও মুখে কোনো হাসি নেই। সবার চোখে পানি। ডাক্তার বিস্মিত হয়ে বললেন,
"আপনারা সবাই কাঁদছেন কেন? পেশেন্ট এবং বেবি দুজনই সুস্থ আছে।"
পাশ থেকে তখন অন্য একটি নার্স এসে ডাক্তারের উদ্দেশ্যে মলিনকণ্ঠে বললেন,
"স্যার, পেশেন্টের হাজবেন্ড হাসপাতালে আসার সময় রোড এ-ক্সি-ডে-ন্টে মা-রা গেছেন। এই হাসপাতালেই তাকে আনা হয়েছে।"
ডাক্তার এবং বাকি নার্স কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তাদের কথা বলার মতো কোনো ভাষা নেই। ভাগ্য কি এতটাই নির্দয় হতে পারে? সদ্য নবজাতক শিশু, যে অল্প কিছুক্ষণ আগেই দুনিয়ার আলো দেখল, তার বাবা আর এই দুনিয়ায় নেই! স্ত্রী হয়তো স্বামীর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে। যখন জানবে তার সবচেয়ে কাছের মানুষটাই আর নেই তখন কী হবে তার?
বড্ড অভিমান নিয়ে নিতু বেডে শুয়ে আছে। এই পর্যন্ত কেউ তাকে দেখতে ভেতরে এলো না। সবাই বাবুকে পেয়ে তাকে ভুলে গেছে। সবার কথা বাদ। জিয়ান! সে কী করে এমনটা করতে পারল? সকালে কী বলেছিল সব ভুলে গেছে এখন? কিন্তু মন যেন বলছিল অন্যকিছু। কোথাও একটা গড়মিল হচ্ছে। কিন্তু সেটা কী? প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার পূর্বেই নার্স বাবুকে এনে নিতুর কোলে দিয়ে বলল,
"ম্যাম, আপনার ছেলে। কী সুন্দর হয়েছে দেখতে!"
নিতু ছেলেকে কোলে নিয়ে জাগতিক সকল দুঃখ-ই যেন ভুলে গেল। কী আদুরে মুখ! ঠিক যেন জিয়ানের মতোই হয়েছে। নিতু অজস্র চুমু খেল। বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে নার্সকে শুধাল,
"আমার কি কেউ নেই এখানে?"
"সবাই আছে ম্যাম। উনারা কিছু ফর্মালিটি নিয়ে ব্যস্ত আছেন তো। তাই আপনার কাছে আসতে পারেনি।"
"আর আমার হাজবেন্ড? সেও ব্যস্ত?"
নার্স ইতস্তত করে বলল,
"সে সম্ভবত এখনো আসেনি। সবাই আসবে। এখন আপনাকে বিশ্রাম নিতে হবে। বাবুকে আমার কাছে দিন।"
নার্সটি অন্য এক নার্সকে ইশারা করল। সে এসে নিতুকে ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। আপাতত আর কোনো সমাধান নেই তাদের কাছে। এমতাবস্থায় জিয়ানের মৃ-ত্যু-র খবর জানানো ঝুঁকিপূর্ণ। শুধু আফসোস এবং কষ্ট এতটুকুই, যেই মানুষটা জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসতো সেই মানুষটাকে শেষবারের মতোও দেখতে পাবে না এই হতভাগী নারী। সময়, জীবন এবং নিয়তি যখন নিষ্ঠুর হয় তখন বুঝি শেষটাও দেখিয়ে দেয়। কী নির্মম এই সত্য!
পরিশিষ্টঃ জিয়ানের মৃ-ত্যু-র খবর পেয়েছে নিতু একদিন পর। জিয়ানকে কবর দেওয়া হয়েছে বাড়িতেই। নিতুর অবস্থা পাগলপ্রায়। সে কবরের ওপর মাথা রেখে চিৎকার করে কাঁদছে। আর্তনাদ করে বলছে,
"বারবার কেন ঠকান আমায়? প্রথমবার ক্ষমা করলেও এবার আর আপনাকে আমি ক্ষমা করব না। তিনজনের একসঙ্গে বাঁচার কথা ছিল, একসাথে স্বপ্ন পূরণ করার কথা ছিল? তাহলে কেন চলে গেলেন আমাদের একা করে? কী করে থাকব আমি আপনাকে ছাড়া? আপনার মতো করে আমাকে আর কে ভালোবাসবে? আপনি তো আমায় জীবন্ত লা-শ বানিয়ে গেলেন। জীবন্ত লা-শ! আমি যে বেঁচে থেকেও বেঁচে নেই। খুব তো রাগ করতেন আমি ম-রা-র কথা বললে। আর এখন আপনি কী করে পারলেন আমায় এভাবে ছেড়ে যেতে? আমি তো হাজারবার বলেও যাইনি। আর আপনি একবারও না বলে চলে গেলেন এভাবে আমাকে নিঃস্ব করে। বাবুকে প্রথম কোলে নিয়ে নাম দেওয়ার কথা ছিল না? কই আপনি তো কোনো নাম দিলেন না। আপনি কোনো কথাই রাখেননি। আপনি মিথ্যাবাদী, মিথ্যাবাদী!"
নিতুর গলা ভেঙে গেছে কাঁদতে কাঁদতে। তার চারপাশে বসে রয়েছে সবাই। সবার মাঝে থেকেও সে একা। কেউই তাকে মানাতে পারছে না। সরাতে পারছে না এখান থেকে। কবরের ওপর মাথা রেখে নিতু ফুঁপিয়ে বলে,
"আপনাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি জানেন? কখনো বলা হয়নি। বলার সুযোগটাও দিলেন না আমায়। আপনাকে ছাড়া এমন দ্বিধা নিয়ে আমি বাঁচব কী করে বলতে পারেন?"
(সমাপ্ত)