ভালবাসার মানুষকে না পাওয়ার কষ্ট | ভালোবাসা কষ্টের গল্প

 তোমাকে না পাওয়ার যন্ত্রনা

তোমাকে না পাওয়ার যন্ত্রনা

আকস্মাৎ পুকুরের পশ্চিম দিকের কলা পাতার ছাউনি বাধা ঘাঁটে রফিক প্রবেশ করতেই স্নানরত অর্ধউলঙ্গ সিমাকে দেখে চোখ ফিরিয়ে নিলো।এদিকে সিমা তাঁর প্রিয় মানুষটিকে এই মুহূর্তে দেখে অনেকটা তাড়াহুড়োর সহিত নিজের শরীরে ভেজা কাপড়খানি জড়িয়ে নিয়েই কিছুটা রাগমাখা স্বরে বলে উঠলো,


– " রফিক ভাই, আপনি এইখানে এই ভরা দুপুরে কী জন্য আইছেন?আপনি কী জানেন না এই বেলায় মাইয়া মাইনসে গোসল করে? "


সিমার কথা শুনে রফিক কিছুটা ইতঃস্তত ভঙ্গিতে বলে উঠলো,

– " এই ঘাঁটেতো সচরাচর কোনো মহিলা গোসল করতে আহেনা তাই একটু পা টা ধুইতে আইছিলাম। আচ্ছা তুই গোসল কর আমি যাই। "


এই বলেই দ্রুত পায়ে প্রস্থান করলো রফিক।আর এদিকে লজ্জায় জুবুথুবু হয়ে অর্ধেক গোসল সেরেই উঠে পরলো সিমা।সে ভাবছে,

– " ইশ!রফিক ভাই আমারে এই অবস্থায় দেইখা ফালাইলো?দোষটাতো আমারই এভাবে সবকিছু খুলেটুলে গোসল করা কী ঠিক হইছে?এহন আমি রফিক ভাইয়ের সামনে যামু কেমনে? তাঁর সামনে না গেলেতো আমার রাইতে ঘুম হইবোনা। "


এই ভেবেই বাড়ির পথে রওয়ানা দিলো সিমা কিছুটা অর্ধভেজা অবস্থাতেই।সিমার আপনজন বলতে ওর নানি ব্যতীত চারকুলে আর কেউ নেই।সিমার যখন চার বছর বয়স তখন ওদের গ্রামে কলেরা অনেকটা টর্নেডোর মতো আঘাত হেনেছিলো।যার ফলস্বরূপ সিমার বাবা মা সহ গ্রামের প্রায় অর্ধেক মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিলো সেই প্রাণঘাতী কলেরা।বুড়ো থেকে বাচ্চা কেউই রেহাই পায়নি সেই মহামারীতে কিন্তু সিমাকে প্রভু কোনো এক অজানা কারণে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। 


যখন সিমার মা মৃত্যুশয্যায় ছিলেন তখন সে সিমাকে সিমার নানির কাছে তুলে দিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বলেছিলেন।সিমার নানিরও সিমার মা ব্যতীত আর কোনো আপনজন ছিলো না তাই তিনি তাঁর একমাত্র নাতিকে নিয়ে এই শেরপাড়ায় আশ্রয় নিয়েছিলেন।যদিও তাঁরা যেই ভিটেমাটিতে থাকে এটা তাঁদের নয় বরং এলাকার মেম্বার তাঁদের অসহায়ত্ব দেখে এই জমিটুকু থাকার জন্য দিয়েছিলেন।


সিমার রূপ লাবণ্যে এলাকার যেকোনো মেয়েই হার মানবে।ওর মতো এমন দুধে আলতা গায়ের রং আশেপাশের দুই চার গ্রামে আছে কিনা সন্দেহ! সিমার এহেন সৌন্দর্য্যের মহীমায় ওর বারো বছর থেকেই এলাকার বহু পুরুষ সিমার নানির কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসতো। কিন্তু সিমার নানি আদিমকালের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও তিনি মনের মধ্যে একটি কথা গেঁথে রেখেছিলেন যে আঠারো বছরের আগে সিমাকে তিনি বিয়ে দিবেন না। কারণ তিনি গঞ্জের এক শিক্ষিত মানুষের থেকে শুনেছিলেন আঠারো বছরের আগে বিয়ে দেওয়া ঠিক না এতে করে মেয়েদের অনেক সমস্যা হয়।


ইদানিং সিমা রফিকের দেখা একদমই পাচ্ছে না অথচ আগে প্রতিদিনই কোনো না কোনো এক অজুহাতে রফিক সিমাদের বাড়িতে আসতো। সিমাও জানে যে রফিক ভাইও তাকে মনে মনে ভালোবাসে কিন্তু কেউই কাউকে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেনা।সিমার ধারণা ভালোবাসার কথা পোলা মানুষের আগে বলা উচিৎ, মাইয়া মানুষের আগে বলা মানায়না।এসব ভাবতে ভাবতেই সে রওয়ানা দেয় রফিকের বাড়ির উদ্দেশ্যে। কারণ এই কদিনে সে রফিকের দেখা না পেয়ে অনেকটা পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিলো, তাঁর পুরো অন্তর জুড়ে শুধু রফিকেরই বসবাস।


রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে সিমা হঠাৎই পথিমধ্যে মেম্বারের ছেলে কুদ্দুসের সাথে দেখা হয় তাঁর। সিমা নিজের মুখখানি কাপড় দিয়ে ঢেকে যেই তাঁর সামনে থেকে প্রস্থান করতে যাবে তখনি কুদ্দুস সিমাকে ডাক দিলো।কুদ্দুসের বয়স চল্লিশের কাছাকাছি এমনকি সে দুটো বিয়েও করেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো দুই বউই বিয়ের এক বছরের মাথায় কোনো এক অজানা রোগে মারা যায়।গ্রামের কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষগুলোর ধারণা কুদ্দুস যেই মেয়েকেই বিয়ে করে তাকেই জ্বীনে আছর করে এবং এক বছরের মাথায় তাকে সেই জ্বীন মেরে ফেলে। তাই কুদ্দুসের বহুত সম্পত্তি আর অর্থকড়ি থাকা সত্ত্বেও গ্রামের কেউই তাঁর নিকট মেয়ে বিলি করতে চায় না। সিমা কিছুটা বিরক্তির স্বরেই কুদ্দুসকে বলে উঠলো,


– " কী কইবেন কন? আপনেরতো আক্কেল জ্ঞান একটুও নাই, রাস্তার মধ্যে এইভাবে মাইয়া মানুষেরে দাঁড় করাইয়া কথা বলা কী ঠিক? "


সিমার কথায় কুদ্দুস কিছুটা থতমত খেয়ে বললো,

– ' না মানে! আসলে তোমারে একটা কথা কইতে চাইছিলাম। "


– " কী কইবেন জানিতো! আপনি আমারে বিয়া করতে চান তাইতো? আচ্ছা আপনার বয়সটার দিকে তাকাইছেন একবার? এই বুড়া বয়সে কেমনে আমার মতো একটা বাচ্চা মাইয়ার উপরে নজর পড়লো আপনের? আর তাছাড়া আপনার সাথে বিয়া বইসা কী আমি মরমু নাকি? আপনার বউতো একটাও বাঁইচা নাই, আমারেও কী তাগো মতো মারতে চান? আমি জানি যে নানিরে ভুলাইয়া আপনি আমারে জোর কইরা বিয়া করতে পারবেন তবে একটা কথা শুইনা রাখেন আপনের সাথে যেদিন আমার বিয়া হইবো তাঁর আগের দিনই আমি গলায় দড়ি দিমু। "


এই বলেই হুড়মুড় করে চলে গেলো সিমা।আর এদিকে কুদ্দুস সিমার মুখে এতোগুলো কড়া কথা শুনে এই মধ্যবয়সেও কোনো এক অজানা অন্তর ব্যাথায় দুফোঁটা অশ্রু বিসর্জন দিলো। কুদ্দুসের মনে একদমই কলুষিতা নেই বরং সে তাঁর বাবার মতোই একজন সাদাসিধা মানুষ।সে তাঁর পূর্বের দুই স্ত্রীকেও প্রচন্ড ভালোবাসতো কিন্তু প্রভু তাঁর সেই ভালোবাসাকে পূর্ণ স্থায়িত্ব দেয়নি।সে জানে সিমাকে পাওয়ার কোনো যোগ্যতাই তাঁর নেই তবুও কোনো এক মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে সে প্রতিনিয়তই সিমাকে অন্তর থেকে নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে দেখতে চায়।


সিমা মনের মধ্যে বেশ রাগ চেপেই উপস্থিত হয় রফিকের বাড়িতে।রফিককে উঠোনে বসে থাকতে দেখে সহসাই তাঁর রাগামিশ্রিত মনটি মুহূর্তেই লজ্জা আর আনন্দে ছেঁয়ে যায়।সে ধীরপায়ে রফিকের সামনে এসেই অনেকটা নিচুস্বরে তাকে ডাক দিতেই রফিক পিছনে ফিরে তাকায়। সিমাকে স্বয়ং তাঁর বাড়িতে উপস্থিত হতে দেখে রফিকও কিছুটা অবাক হয় কেননা সে সহজে তাঁর বাড়িতে পা দেয়না। তবুও নিজের সন্দেহ দূর করতে রফিক সিমাকে জিজ্ঞেস করে,


– " কী হইলো হঠাৎ আমার বাড়িতে আইলি যে? নানির কিছু হইছে? "


– " না না রফিক ভাই! মানে আপনেতো আমাগো বাড়িতে আসেন না অনেকদিন তাই দেখতে আইছিলাম আপনার কিছু হইছে কীনা? "


সিমার কথা শুনে রফিক কিছুটা দায়সাড়া ভাব নিয়ে বললো,

– " তোগো বাড়িতে আমার কী কাজ যে আমার প্রত্যেকদিন যাইতে হইবো? "


রফিকের কথাটা যেন সিমার মনে অনেকটা তীরবিদ্ধ হবার মতো আঘাত করলো। নিজের চোখের জলকে কোনোভাবে একটু আড়াল করে কিছুটা কম্পিত স্বরে সিমা বলে উঠলো,


– " হুম আসলেইতো কোনো কাম নাই। না মানে নানির কী যেন একটা লাগতো তাই আপনি গঞ্জে যাইবেন কবে সেইটাই জানতে আইছিলাম। "


সিমার কথা শেষ না হতেই রফিকের ফুফাতো বোন ময়না একটি বাটি নিয়ে তাঁদের সামনে উপস্থিত হয়েই বলে,


– " রফিক ভাই! তোমার জন্য তরকারি আনছিলাম, আমি কিন্তু নিজে রান্না করছি। "


রফিক অনেকটা হাসিমুখে ময়নার হাত থেকে বাটিটা গ্রহণ করে কিন্তু সিমার এসব দৃশ্য একদমই সহ্য হয়না। সিমার কেনো যেনো মনে হচ্ছিলো তাঁর হৃদয় থেকে রফিকের অস্তিত্ব কেউ কেঁড়ে নিয়ে যাচ্ছে। ময়না খুব ভালো করেই জানে যে সিমা রফিককে ভালোবাসে তাই এই সুযোগটা সে কাজে লাগিয়েই রফিকের কিছুটা কাছাকাছি এসে তাকে আহ্লাদি স্বরে বলে উঠে,


– " রফিক ভাই, তুমি না বলছিলা আমারে গঞ্জে সিনেমা দেখতে নিয়া যাইবা? "


ময়নার এমন ব্যবহারে রফিকও কিছুটা হকচকিয়ে উঠে এবং পরক্ষণেই বলে উঠে,

– " কবে কইছিলাম তোরে? "

– " সে কী এতো তাড়াতাড়ি ভুইলা গেলা? "


সিমা এসব দৃশ্য আর সহ্য করতে পারেনা বরং হুড়মুড় করে দ্রুত পায়ে ত্যাগ করে রফিকের বাড়ি। ময়না আর রফিক দুজনেই বুঝতে পারে সিমার এরকম দ্রুত পায়ে প্রস্থান করার বিষয়টা। ময়না মনে মনে কিছুটা শয়তানি হাসি দিয়ে বলে,

– " তোর মতো ভিখারীনী যতই সুন্দরী থাক না কেন রফিক ভাই আমারি হইবো। "

.

পরদিন রফিক উপস্থিত হয় সিমাদের বাড়ি। সিমার নানিকে ডাক দিতেই সিমা ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে। রফিক সিমার চন্দ্রমাখা মুখখানিতে কিছুটা রক্তিম আভা দেখতে পেয়ে তাঁর বুঝতে বাকি থাকেনা যে গতকালের ঘটনার জন্য সিমা বেশ কষ্ট পেয়েছে এবং সারারাতই কেঁদেছে। তবুও রফিক ওসব কিছু না বলে তাকে জিজ্ঞেস করে,

– " নানি কই? তাঁর নাকি কী লাগবো? গঞ্জে যামু একটু পর। "


সিমা তাঁর কথার জবাব না দিয়ে ধীরপায়ে রফিকের সামনে আসতে থাকে। আস্তে আস্তে যতই সিমা সামনে এগোচ্ছে ততোই রফিকের হৃৎস্পন্দনের গতি বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সহসাই তাঁর মুখোমন্ডলে ঘামের আস্তরণ জেগে উঠছে। এক কব্জি পরিমাণ সামনে এসেই সিমা স্থির হয় আর রফিকের মনের মধ্য তখনো ধুকধুকানি বেড়েই চলছে। সত্যি বলতে সিমাকে রফিক এতোটা কাছে থেকে কখনোই দেখেনি। কী সুন্দর চাঁদের মতো চেহারা সিমার, কতটা নিখুঁত ভাবে প্রভু তাকে সৃষ্টি করেছে এসব ভাবতে ভাবতেই সিমার কথায় সে বাস্তবে ফিরে।


– " রফিক ভাই! তুমি বুঝোনা আমি তোমারে কতোটা ভালোবাসি? তুমি বুঝোনা তোমার সাথে অন্য কোনো নারীরে দেখলে আমার সহ্য হয়না? তুমি কেন বুঝোনা বলোতো? "


রফিক কোনো জবাব দিতে পারেনা।কারণ সেওতো তাকে খুব ভালোবাসে কিন্তু পরিবারের বিরুদ্ধে সে কোনোদিনই যেতে পারবে না। কারণ রফিকের বাবার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী মৃত্যুর আগমুহূর্তে সে তাঁর বাবার হাত ধরে কথা দিয়েছিলো পিতৃহীন ময়নাকে সে বিয়ে করবে। কিন্তু এখন কী চাইলেই তাঁর মৃত বাবার ইচ্ছাকে বলি দিয়ে সে সিমাকে বিয়ে করতে পারবে? রফিক সিমাকে তাঁর প্রশ্নের জবাব না দিয়েই দ্রুত পায়ে সে চলে যায়। রফিকের এহেন কান্ডে সিমা নিজের আঁচলখানি দিয়ে মুখটা চেপে ধরে কান্না করে দেয়। তাঁর হৃদয়টা এখন বায়ুমন্ডলহীন এক নিকষ কালো অন্ধকারে ছেঁয়ে গেছে।

.

এদিকে ময়না রফিকের মায়ের কাছে উল্টাপাল্টা বলে তাঁর আর রফিকের বিয়েটা খুব দ্রুতই এগিয়ে নেয়। বাড়িতে এসে যখন রফিক এসব ঘটনা শুনে তখন স্বভাবতই তাঁর রাগের মাত্রাটা বহুগুণ বেড়ে যায় তবুও সে ময়নাকে কিছু বলার সাহস পায়না। কারণ পরিবারের অমতে সে কোনোকালেই যেতে পারবেনা আর তাছাড়া ময়নাকে তাঁর কোনো না কোনো এক সময় বিয়ে করতেই হবে।


সিমার কানে যখন খবর আসে যে দুইদিন পর রফিকের সাথে ময়নার বিয়ে তখন তাঁর হৃদয় ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। প্রথমে সে ভেবেছিলো ভরা মানুষের সামনে সে রফিকের নিকট সেদিনকার প্রশ্নের জবাব চাইবে পরক্ষণেই তাঁর মন শক্ত হয়ে ওঠে এবং সে ভাবে,


– " রফিক ভাইতো আমারে কোনোকালেই ভালোবাসে নাই। ভালোবাসলে কী আর সে ময়নারে বিয়া করতো? তাইলে আমি কেন তাঁর পিছে পইরা থাকমু? "


এসব ভেবে সিমা তাঁর মনকে সান্ত্বনা দিলেও মনঃকষ্টের জোয়াড়ে সেই সান্ত্বনার বাধ ভেঙ্গে যায় তাঁর।

.

.

সাতদিন চলে গেছে...

রফিক ময়নাকে ইতঃপূর্বে বিয়ে করে ফুলশয্যাও সম্পন্ন করে ফেলেছে কিন্তু সিমার হৃদয়ের ভাঙ্গন যেন এখনো জোড়া লাগেনি।আজ হঠাৎই সিমা তাঁর বৃদ্ধা নানিকে বেশ কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করেও কোনো সাড়াশব্দ পেলোনা। কাছে যেয়ে সে তাঁর নানির শরীর স্পর্শ করতেই স্থির হয় যায়।তখনি এক চিৎকার দিয়ে সিমা তাঁর নানিকে জড়িয়ে ধরে।পরপর এরকম বড় বড় দুটি কষ্ট সহ্য করতে না পেরে সহসাই সে অজ্ঞান হয়ে যায়।


চোখ খুলতেই সিমা নিজের মাথা আবিষ্কার করে কারো কোলের ভিতর। তাঁর বিষয়টা বুঝতে কিছু সময় লাগলেও পরক্ষণেই দুনিয়ায় তাঁর একমাত্র আপনজন নানিকে হারিয়ে সে হেঁচকি তুলে কেঁদে উঠে। ইতঃমধ্যে তাঁর নানির দাফন কাফনের জন্য সবাই তৈরি হয়েছে। তাঁর ধারণা নেই সে কতক্ষণ অজ্ঞান ছিলো তবে সে বুঝতে পারলো তাঁর চিৎকার শুনেই হয়তো পাশের বাড়ির কেউ এসেছিলো। হঠাৎই সে দরজার কাছে রফিককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সহসাই তাঁর থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়। রফিক বিষয়টা বুঝতে পেরে দরজার আড়াল থেকে প্রস্থান করে।


সিমার নানির দাফন কাফন ইতঃমধ্যে শেষ হয়েছে। আস্তে আস্তে সকল পাড়া প্রতিবেশীই তাকে ব্যর্থ সান্ত্বনা দিয়ে নিজ নিজ গৃহে চলে যায়।এমনকি রফিকও চলে যায় সিমাকে দেখা না দিয়েই কারণ সে জানে সিমার সামনে তাঁর মুখ দেখানোর কোনো অবস্থাই তাঁর নিকট উপস্থিত নেই।শুধু থেকে যায় কুদ্দুস আর তাঁর এক চাকর।কুদ্দুস সিমাকে এই একলা ঘরে রেখে যেতে চায়না কারণ চারিপাশের নরপশুরা সবসময়েই ওত পেতে থাকে সিমার প্রতি।


সিমা কিছুটা শক্ত হতেই কুদ্দুস তাকে বলে উঠে,

– ” তুমি আমার বাড়িতে চলো। সমস্যা নাই আমি তোমারে বিয়া করার জন্য নিতে চাইতাছি না বরং এইখানে একলা থাকাটা তোমার জন্য নিরাপদ না। "


সিমা বেশ আক্রোশ কন্ঠেই কুদ্দুসকে বলে উঠলো,

– " না দরকার নাই। আমারে নিয়া আপনের ভাবতে হইবোনা। আপনের কাম আপনে চইলা যান। "


সিমার মুখে এমন কথা শুনে স্বভাবতই কুদ্দুস বেশ কষ্ট পায় তবুও প্রতিউত্তরে কিছু বলতে পারে না বরং সে তাঁর চাকরকে নিয়ে সিমার ঘর থেকে উঠে যায়। যখন কুদ্দুস দরজার সামনে আসে তখনি সিমা তাকে ডাক দেয়।


– " শোনেন। "


কুদ্দুস যেন সিমার এই ডাকটা শোনারই অপেক্ষায় ছিলো এতক্ষণ। পরক্ষণেই সে পিছনে ঘুরে বলে,


– " কিছু বলবা? " 

– " আপনি কী আমারে আপনার আগের দুই বউয়ের থেকেও বেশি ভালোবাসতে পারবেন? "


কুদ্দুসের কথাটা বুঝতে কিছু সময় লাগলেও পরক্ষণেই তাঁর মনের ভিতর খুশির এক অনন্য উত্তেজনা উঁকি দেয়। এরপরই তাঁর মনটা ভয়ে পরিপূর্ণ হয়ে উঠে এবং সে বলে,


– " কিন্তু আমারতো বউ মইরা যায় তুমি কী তবুও আমারে বিয়া করতে চাও? "


– " মইরাতো গেছি অনেক আগেই এখন আমি নিজেরে এক ভালোবাসার কাঙ্গালের হাতে সোপর্দ করতে চাই। এখন মরলেও আমার দুঃখ নাই। "


কুদ্দুস সিমার কথা বুঝতে পারেনা তবে তাঁর চোখ থেকে আনন্দে দুফোঁটা অশ্রু নিজের অজান্তেই বের হয়ে যায়। সে সিমার ধবল সাদা হাতটি বেশ আত্মবিশ্বাসের সহিত ধরে রওয়ানা দেয় এক নতুন জীবনের আশায়।

.

.

.

একটি দুটি বছর করে কেঁটে যায় চল্লিশটি বছর কিন্তু সিমা কুদ্দুসের আগের বউদের মতো পটল তুলেনা বরং সে সম্মান এবং মাথা উঁচু করে সেই বুড়ো বয়সী কুদ্দুসের সাথে এতোটি বছর পার করেছে।এখন আর সিমার মনে রফিকের অস্তিত্ব বিরাজ করেনা বরং তাঁর পুরো অন্তর মহলেই সেই চল্লিশ বছর বয়স্ক কুদ্দুসের প্রতি এক আকুল মায়া আর ভালোবাসা বিরাজ করে। আর এটাই ছিলো কুদ্দুসের প্রতি সিমার পবিত্র এবং প্রকৃত ভালোবাসার শক্তিস্বরূপ এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যেই ভালোবাসার কাছে হার মানবে রফিকের প্রতি সেই ব্যর্থ ভালোবাসা।হোক না ভালোবাসার জয় সমস্যা কি?এটাইতো আমাদের কাম্য ছিলো।

.

(সমাপ্ত)

.

ছোটগল্পঃ প্রকৃত ভালোবাসা

কলমেঃ Misk Al Maruf

----------------------------------------


এমন ভালোবাসার কষ্টের গল্প পড়ুন।