স্বামীর প্রতি স্ত্রীর অবহেলার গল্প | অবহেলার কষ্টের স্ট্যাটাস

 স্ত্রীর প্রতি স্বামীর অবহেলা

স্ত্রীর প্রতি স্বামীর অবহেলা

আমাদের তিন বোনের মধ্যে সবচেয়ে কপাল খারাপ বেনুর।অথচ সবচেয়ে সুন্দরীও সে আর পড়াশোনাও তার বেশি। ছোট বেলায় আদর করে আব্বা বলতেন,'বড় দুই মাইয়ারে লইয়া আমার যতো চিন্তা।এরার চেহারা সুরতও কম আবার মাথার ঘিলুও বিরাট ঢিলা।চিন্তা নাই আমার বেনু আম্মারে লইয়া।তার রূপ মেধা দুইটাই আছে মাশাআল্লাহ!'

আব্বার কথায় ফলেছিলো অবশ্য। আমার আর এনার বিয়ের আগেই বেনুর জন্য বিয়ের আলাপ আসতে শুরু করলো অহরহ। আব্বা এইসব সামলাতে বড় হিমশিম খাচ্ছিলেন। তিনি বললেন,'ঘরে বড় দুই শেয়ান মাইয়া রাইখা ছোডো মাইয়ার বিয়া আমি দিবো না। আগে বড় দুইজনের বিয়ার মামলা শেষ হউক পরে ছোডো মাইয়ার বিয়ার কথা ভাবা যাইবো।'

কিন্তু শেষপর্যন্ত এমন এক ঘরের আলাপ এসে বসলো বেনুর জন্য তখন আর আব্বা গা ধরে বসে থাকতে পারলেন না। আমাদের দু' বোনকে ঘরে রেখেই বেনুর বিয়ে দিয়ে দিলেন। আহা!কী রূপ তার বরের।আর ধন-দৌলতের কথা বলে কী আর শেষ করা যায়!

ছেলের রূপ কিংবা দৌলত যেমন তেমন তার মনও বিশাল।বেনু বাড়িতে নাইওর এসে বললো,'আপা, তোদের বোন জামাই তো আমার কাছে না বলে থুথুও পর্যন্ত ফেলতে যায় না!'

শুনে আমাদের খুব হিংসে হতো। আমরাও মনে মনে এমন একটা বরই কামনা করতাম। অবশ্য পরের বছর পালা করে আমাদের দু 'বোনের বিয়ে হলো। আমাদের দু 'বোনের বরদের অত দৌলত কিংবা চেহারা সুরত নাই ঠিক, কিন্তু মন আছে বলতে হবে। তবে অতটাও নয় যে আমার কথায় থুথু ফেলবে আবার নিষেধ করলে গিলে ফেলবে। কিন্তু বর যে ভালো পেয়েছি এটা মোটামুটি নিশ্চিত হতে পেরেছিলাম। কিন্তু বছর পেরুলেই বেনুর হলো উল্টোদশা। ওই যে তার খুব ভালো বর যে কিনা তার কথা ছাড়া থুথু পর্যন্ত ফেলে না সেই বর এখন তার কাছে কোনোকিছু জিজ্ঞেস না করেই রাতভর ফোনে অন‍্য মেয়েদের সঙ্গে কথা বলে। মেসেঞ্জারে কী সব নোংরা নোংরা ছবি দেওয়া-নেওয়া করে তার প্রেমিকাদের সাথে।দূরে কোথাও গিয়ে ওইসব মেয়েদের সাথে গোপন কিছুও করে আসে।এর কোন প্রতিবাদ করতে গেলেই বেনুর উপর ধাপুস ধুপুস মা*র। বেচারির চেহারা যা মন্দ হয়েছে এখন! সারাদিন এসব নিয়ে টেনশন করে।এক বছর আগের এতো ভালো মানুষটা হঠাৎ এমন বদলে গেল কেন? নাকি আগে থেকেই এমন ছিল?বেনু তার শাশুড়ি মাকে জিজ্ঞেস করে।এই মানুষটা সত‍্যিই মাটির।জগতে শাশুড়ি কিংবা পুত্রবধূর নাম শুনলেই মানুষের কেমন শরীর কেঁপে উঠে। মানুষ ভাবে, বাঙালি শাশুড়ি আর পুত্রবধূ এই দুই রাম- রাবণ। পুত্রবধূর বাপের বাড়িতে রাবণ শাশুড়ি আর শাশুড়ির বাড়িতে পুত্রবধূ।এ বহু পুরনো দিনের নিয়ম। কিন্তু বেনুর এই এক ভাগ‍্য। শাশুড়ি তার মাটির। কিন্তু চোখ দুটো নেই তার। সাধারণত এমন বয়সে মানুষের চোখের পাওয়ার একেবারে নিভে যায় না। কিন্তু বেনুর শাশুড়ির নিভে গেল। তিনি চোখে কিছুই দেখতে পান না।

বেনুর শাশুড়ি বললেন,'মাগো,কী বলবাম বলো? আমার পোলা যে এমন খা*রাপ আমি আগে জানতাম না গো মা।আল্লার কসম লাগে গো বউমা। আমার দুই চোউখ নাই। আমি মিছা বললে আমার জবানও বন্ধ হইবো। আমার ছেলে যে এমন খা*রাপ তা যদি আগে জানতাম তাইলে তোমারে বিয়ে করিয়ে আইনা এই বিপদে ফেলতাম না গো মা। আমিও তো নারী। আমি কী তোমার কষ্ট বুঝি না মা।নারী হয়ে আরেক নারীর ক্ষতি আমি কেমনে করতাম বলো!'

বেনু তার শাশুড়ির কথা শুনে একটু স্বস্তি পায়।ভাবে আজ না হোক কাল তার স্বামী আলোর পথে ফিরবেই। একদিন সত্যি সত্যি তার সুদিন ফিরে আসবে। আমি আর এনা কতবার বলেছি,'বেনু, এখনও সময় আছে ওই অসভ‍্যটার হাল ছেড়ে দে। সময় থাকতে নতুন পথ ধরা ভালো।'

কিন্তু বেনু আমাদের কথায় অতটা গা করলো না মনে হলো।সে বললো,'আপা,যার কপালে খাটতি আছে তা না খাইটা তার মুক্তি নাই। অন্ধকারের পর আলো আসে এটা মানস তোরা?'

বেনুর এমন কথায় আর কী বলবো আমরা? বরং মনে মনে ওর জন্য দুঃখ করে আব্বার কাছে গিয়ে বলি। আব্বা শোনে কপাল ভাঁজ করে খানিক সময় কী যেন ভাবেন। তারপর বলেন,'সব আল্লাহ পাকের ইচ্ছা গো মা। বেনুর কপালে এই দুঃখ আগে থাইকাই ঠিক করা। নাইলে অত বাছ বিচার কইরা বিয়া দেওনের পরেও তার হালত এমন হইবো কেন?

তোমরা চিন্তা কইরো না মা। একদিন দেখবা আমার বেনু মাই- ই সব থাইকা সুখি হইবো।'

বেনু যে সুখি হবে এটাই যেন আব্বার কাছে চিরন্তন সত্য এবং এর উপর তার প্রগাঢ় বিশ্বাস।আমরা দুই বোন অনেক চেষ্টা কসরত করেও বেনু কিংবা আব্বাকে টলাতে পারলাম না। তাদের আল্লাহর উপর অগাধ বিশ্বাস। সেই বিশ্বাসে শরীক হলাম আমরাও। ভাবলাম,দেখি কী হয়। আল্লাহ তো সবকিছুই পারেন। বেনুকেও নিশ্চয় তিনি সারা জীবন কষ্টের ভেতর রাখবেন না। আল্লাহ তো পরম ন‍্যায়বিচারকও।

এরপর সময় আরো যতটা ঘনালো বেনুর দুঃখের সীমা ততোটাই ছাড়িয়ে গেলো। বছরের একটি দিনও বেনুর সাথে তার স্বামী ভালো আচরণ করতো না।ওর শাশুড়ির যতোটুকু শাসন ক্ষমতা ছিল ততটুকু তিনি করে দেখেছেন তাতে ছেলের সামান‍্যতম পরিবর্তনও হলো না।

ও যখন আমাদের কাছে এসব কিছু শুনাতো তখন ইচ্ছে হতো পুলিশের কাছে যাই।দেশে তো নারী নি*র্যাতনের মামলা অনেক শক্ত হয়।কেস টেস টুকে দিয়ে আসি।কিন্তু বেনুর জন্য মোটেও পারলাম না।বেনু বলে,'মামলা করে কী আর মানুষের মন জয় করা যায় রে আপা? মানুষ যদি তার বিবেক খাটাইয়া ঘরে না ফিরে তাইলে তারে জোর জবরদস্তি করে ফিরাইয়া কোন লাভ আছে?সংসারে ভালোবাসা না থাকলে শরীর দিয়া কী করে মানুষ?তারচে আমি অপেক্ষা করি আপা। অপেক্ষা মানুষরে অনেক কিছু দেয়। অনেক অনেক কিছু।'

এর মাঝে হঠাৎ করে খবর পেলাম বেনুর বাচ্চা হবে।খবরটা শুনে এবার একটু শান্তি লাগলো। ভাবলাম, এখন যদি ঘোড়ার দড়িতে টান পড়ে।

'

বেনুর কন‍্যা সন্তান হয়েছে। সেই কন‍্যার চেহারার আদল হুবহু তার বাপের। বেনুর শাশুড়ি অন‍্য কাউকেই তার নাতনীকে কোলে তুলতে দিলেন না।নাতিনের কাছে কাউকেই ঘেঁষতে দিলেন না। সবাইকে সাবধান করে দিলেন। বললেন,' আমার নাতিনের কাছে এখন কেউ ঘেঁষবা না।'

কারোর কোলে না দিয়ে কাউকে নাতিনের কাছে ঘেঁষতে না দিয়ে তিনি সরাসরি কন‍্যার বাপের কোলে তুলে দিলেন সদ‍্য জন্ম নেয়া কন‍্যাকে। দিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন,'বাপধন,বহুত খা*রাবি করছো জীবনে। নিজের ঘরে বউ থুইয়া পর মাইয়াগোর লগে কু*কাজ করে বেড়াইছো।বউ প্রতিবাদ করলে তার উপরে অ*ত‍্যাচার করছো। অ*নাচার করছো। আমি কিছু বললেও গা করোনাই বাপধন। কিন্তুক এহন তুমি এইসব করতে পারবা নাকি পারবা না তা তোমার বিবেক খাটাইয়া চিন্তা করো। তোমার ঘরে যে মাইয়া জন্ম নিছে সেই মাইয়াও একদিন বড় হইবো।তার বিয়া শাদী হইবো। বিয়ার পরে যদি তোমার মাইয়ার জামাই তোমার মাইয়ারে ঘরে রাইখা বাইরের মাইয়াগোর লগে খা*রাপ সম্বন্ধ রাখে তখন তোমার কেমন লাগবো বাপধন? তুমি যদি সেই বিষয় মাইনা নিতে পারো তাইলে আমার কোন কথা নাই।যেমনে তুমি চলতাছো তেমনেই চলো।'

নিজের মেয়েকে কোলে নিয়ে মার এমন কথা শোনার পর বেনুর স্বামী জড়জড় করে কেঁদে ফেললো। তারপর তার মার পায়ে পড়ে বললো,'আম্মা,আমি অপরাধী গো আম্মা। শয়তানের ফন্দিতে পইড়া বহুত খা*রাপ কাজ করছি।আমি অ*পরাধী।আমারে তুমি মাফ দেও!'

বেনুর শাশুড়ি ভেজা গলায় বললেন,'যার সাথে অপরাধ করছো তার কাছে মাফ চাও।সে মাফ দিলে আমিও মাফ দিলাম।'

বেনুর স্বামী সঙ্গে সঙ্গে বেনুর কাছে গিয়ে তার একটা হাত ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।বেনু বড় আবেগতাড়িত হয়ে বললো,'আরে কী করেন আপনি,কী করেন এইসব!'

বেনুর স্বামী কান্না ভেজা গলায় বললো,'আমারে মাফ দেও বেনু। আমি অপরাধী।জীবনে আর এইসব করবো না। আমার সদ‍্য জন্ম নেওয়া মেয়ের কসম করে বলতেছি।'

বেনু আর তখন কী বলবে?সে তো দীর্ঘদিন ধরে এই এমন একটি দিনের জন‍্যই অপেক্ষা করে আসছে।সে তার দু' চোখের জল গন্ডাদেশ বেয়ে ফেলতে ফেলতে বললো,'আমি আপনার কোন অ*পরাধ মনে রাখিনি স্বামী। আপনি যে আমার কাছে ফিরে আসছেন এইটাই আমার শান্তি। আমার পরম পাওয়া। আমি আপনারে মাফ করে দিছি, আল্লাও যেন আপনারে মাফ করে দেন।'

বেনুর স্বামী বললো,'আমীন।'

'

বেনুর স্বামী নতুন জীবনে ফিরে আসা এবং সন্তানের আগমনের আনন্দে তাদের বাড়িতে মহা উৎসবের আয়োজন করেছে।যেই সেই উৎসব না। বিশাল উৎসব। সেই উৎসবে সকল আত্মীয়-স্বজনদের দাওয়াত করা হয়েছে। আমরাও সবাই মিলে দলবেঁধে এসেছি তাদের বাড়িতে বেড়াতে। বেনুর স্বামী বেনুর জন্য একটা সোনার চেইন গড়িয়ে আনিয়েছে। সেই চেইন তার গলায় সূর্যের মতো ঝিকমিক করছে।চেইনের মতো তার মুখশ্রীও উজ্জ্বল হয়েছে। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে তার এখন সুখ। সুখী মানুষের চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। চেহারায় চিকচিক করে সুখ।দুঃখী মানুষের চেহারাও চেনা যায়। বেনুর গায়ে সুখ চিকচিক করছে।তার মুখের দিকে তাকিয়ে শান্তি লাগছে।

সেদিন উৎসব শেষে আব্বা আমাদের বোনদের ডেকে এক ঘরে নিয়ে গিয়ে বললেন,'মায়েরা আমার,দেখছো তোমরা , আল্লার কলমই যে সবচাইতে বড় কলম? আসলে আমরা মানুষেরা যত চিন্তা ফিকির করি না কেন, আল্লাহ যতক্ষণ ইচ্ছা না করবেন ততক্ষণ যার কপালে কষ্ট আছে সেই কষ্ট তার ভোগ করতেই হইবো। কিন্তুক আরেক কথাও সত্য।যার কষ্ট যত বেশি তার সুখও তত বেশি।'

আব্বার কথাগুলো শুনে সেদিন মনে হলো ঠিকই তো।যে আল্লাহর উপর ভরসা রাখে তাকে তিনি কখনো ঠকান না।ঠকানো মানুষ জাতীর স্বভাব, আল্লাহর না।

'

-ভরসা

 -অনন্য_শফিক


মন ছুঁয়ে যাওয়া অসাধারন গল্প।