ভালোবাসার অনুভূতি | ভালোবাসার কষ্টের স্ট্যাটাস

 ভালোবাসার গল্প

ভালোবাসার গল্প

আমার বড় মেয়ে তিতলি অটিস্টিক। তিতলি আমাদের দুই দিকের পরিবারের সবচেয়ে বড় সন্তান। ও পৃথিবীতে আসার আগেই ওকে নিয়ে দুই পরিবারের সবার কত স্বপ্ন। কী নাম রাখা হবে সেটা নিয়ে রীতিমত ঠাণ্ডা যুদ্ধ নানি আর দাদির মাঝে।


সেই যুদ্ধ মেটাতে জাহিদ ঘোষণা দিল, আমাদের বাচ্চা, নামও আমরা ঠিক করব। মেয়ে হবে জানতাম, সেটা নিয়ে জাহিদ ভীষণ উত্তেজিত!


‘বুঝলে, আমার মেয়ে ভীষণ চঞ্চল হবে।’ জাহিদ একা একাই কত কিছু বলত। আমার পেটে কান ঠেকিয়ে বলতো, ‘দেখছ না, তোমার পেটেই কেমন ছটফট করছে।’ আমি শুনতাম আর হাসতাম। ওর সেই না দেখা চঞ্চল মেয়ের নাম ঠিক করে রেখেছিল 'তিতলি।' তিতলি শব্দের অর্থ, 'প্রজাপতি।'


.


সোনার চামচ দিয়ে নাতনির মুখ দেখেছিলেন আমার শাশুড়ি। নানা- নানি, দাদা- দাদি, চাচা, ফুপুদের আদরে তিতলিকে বিছানায় শোয়ানোর সুযোগও দিনের বেলা পাওয়া যেত না। সবার আদরে কোলে কোলেই বড় হচ্ছিল সে। যেই দেখতে আসত বলতো, ‘কী ফুটফুটে বাচ্চা, আর কী ভীষণ শান্ত।’


ছোটবেলায় মেয়ে আমার খুব কম কান্নাকাটি করত। সময় মত খেত, বেশি রাত জাগত না। আমাকে একটুও জ্বালায় নি সে। এমন লক্ষ্মী বাচ্চা আসলেই খুব কম দেখা যায়। সবার চোখের মণি সে। দিনগুলো কী সুন্দর কাটছিল। যেই বয়সে বাচ্চারা হাসে, সে হেসেছে তার কিছু পরে। বাচ্চাদের হাসি প্রথম দিকে এমনিতেই অর্থবোধক থাকে না। তারা হাসে অকারণে। আমরাও সেই অকারণ হাসি দেখে উচ্ছ্বসিত হতাম। শব্দ করত অর্থহীন। সেই সব শব্দ আমার আর জাহিদের কাছে গানের চেয়েও মধুর লাগত।


দেড় দুই বছর বয়স পর্যন্ত তেমন কোন অর্থপূর্ণ শব্দ সে বলে নি। বাবা অথবা মা ও না। কিন্তু সেটা নিয়ে আমাদের কারও কোন দুশ্চিন্তা হয় নি। তাছাড়া ওর জন্মের বছর দেড়েক পরে আমার মা মারা গেলেন, মায়ের মৃত্যুতে আমি বেশ ভেঙ্গে পড়েছিলাম। শাশুড়ি মা মাঝে মাঝে আমার সাথে এই প্রসঙ্গ তুলতে গেলে আমার মুখ ভার হয়ে যেত। 


‘সব বাচ্চা কি এক রকম হয় মা? একেক বাচ্চা একেক বয়সে হাঁটে, একেক বাচ্চা একেক বয়সে কথা বলে। তাছাড়া ও তো শব্দ করে, বোবা হলে তো শব্দ করত না।’


উনি কি একটা বলতে যেয়েও বলতেন না। দুই পার হয়ে যখন তিন চলছে, তখন একদিন জাহিদ বললো,


- 'আচ্ছা, তিতলিকে ডাকলে বা ওর পাশে জোরে শব্দ হলে ও তাকায় না কেন?'


বাবা এই কথাটা বলতে পারলেও, আমার মায়ের মন কোনভাবেই কোন কিছু মেনে নিতে চাইছিল না। এদিকে আর বছর খানেক পরে তো স্কুল ও শুরু করতে হবে। তখন তো কথা শিখতেই হবে। চিন্তা আমারও ততদিনে কিছুটা শুরু হয়েছে। জাহিদের দিকে খুব করুন চোখে তাকিয়ে বললাম,


- 'কী বলতে চাইছ?'


আমার দিকে তাকিয়ে ও আমার মন খারাপটা টের পেল। তারপর আমার হাতটা হাতে নিয়ে বললো,


- 'ওকে একটা কানের ডাক্তার দেখাই চল।'


জাহিদের কথায় রাজি হলেও আমি জানতাম, ওর কান ঠিকই আছে। নাহলে ও শব্দ করত না। পরের দিন অফিস থেকে আগে বেড়িয়ে আমরা ওকে নিয়ে গেলাম একজন বিশেষজ্ঞর কাছে।


তিনি সব দেখে বললেন,

- 'আমি তো কোন অসুবিধা দেখছি না।'


ডাক্তারের কাছ থেকে ফেরার পথে জাহিদকে ভীষণ বকা দিলাম, ‘খামাখা ভয় দেখিয়ে দাও। আমার মেয়ে ঠিকই আছে।’


কারও কাছে কিছু স্বীকার না করলেও সারাক্ষণই একটা অস্বস্তি হত, এতো সময় লাগছে কেন কথা বলতে? অনেকে বললো, 'কোন কোন বাচ্চার বেশ দেরি হয়।' কেউ কেউ বললো, 'সারাদিন চাকরি করো। কাজের মেয়ে আর বুড়ো শাশুড়ি হয়তো ওর সাথে কথাই বলে না।' এসব কথায় তীব্র অপরাধ বোধে মন ছেয়ে যেত। শেষ পর্যন্ত নিজের সব অস্বস্তিকে চাপা দিয়ে চুপি চুপি একজন শিশু মনরোগ বিশেষজ্ঞর কাছে নিয়ে গেলাম।


- 'আপনার বাচ্চা একজন স্পেশাল চাইল্ড, যাদেরকে বলে অটিস্টিক। ও শারীরিক ভাবে সুস্থ। কিন্তু মানসিক ম্যাচুরিটি কম। অর্থাৎ বয়সের সাথে শরীর বাড়লেও ওর মন থেকে যেতে পারে অনেকটা শিশুর মত।'


- 'তার মানে কি ও কথা বলতে পারবে না? স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবে না?'


আমি হয়তো আর্তনাদই করছিলাম। এসি চেম্বারে বসেও কুল কুল করে ঘামছিলাম আমি। আমার হাত শক্ত করে ধরে ছিল জাহিদ। আর আমাদের পাশে বসে অদ্ভুত শব্দ  করছিল তিতলি।


.


সেদিন থেকে শুরু হল আমার অন্যরকম জীবন, বলা যায় জীবনের সাথে যুদ্ধ। কথা বলছে না, শুরু হল খোঁজ খবর, অনেক খুঁজে পাওয়া গেল স্পিচ থেরাপির সন্ধান। সপ্তাহে তিন দিন অফিস কামাই দিয়ে ওকে যেতাম ওখানে। অফিস থেকে বের হতাম যখন আগে আগে, নিজেকে চোরের মত মনে হত। প্রথম প্রথম সবাই সহানুভূতি দেখালেও, মাস তিনেক পরে বস একদিন ডেকে বললেন,


- 'এভাবে তো আর চলছে না রুমানা। এবার যে তোমার একটা সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তোমার যদি আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ হত, তাহলে ও একটা কথা ছিল। তোমাকে চাকরি থেকে বিদায় দিতে আমারও খুব খারাপ লাগবে।'


মাথা নিচু করে বললাম,

- 'আমি বুঝতে পেরেছি স্যার।'


লজ্জায় চোখ তুলতে পারছিলাম না, সেই চোখ দিয়ে ফোটা ফোটা জল ঝরছিল আমার হাতের উপরে। এতদিনের চাকরিটা ছেড়ে দিতে কি যে খারাপ লাগছিল। কাজে আমার অনেক সুনাম ছিল। চাকরিটা ছিল আমার অস্তিত্বের একটা অংশ।


পাস করার পর থেকে কখনোই ঘরে বসে থাকি নি। কিন্তু দিন গুলো ঠিকই চলে যায়। তিতলিকে থেরাপিতে নিয়ে যাওয়া, ওর খাওয়া, গোসল, বাথরুম সব দেখা শোনা আর সেই সাথে বিভিন্নভাবে চেষ্টা ওকে কিছুটা স্বাভাবিক করে তুলতে। ওর ভেতরে জীবন জাগাতে আমি নিজেই ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম। একে তো এতো বড় ধাক্কা সামলে নেওয়া, চাকরি ছাড়তে বাধ্য হওয়া, তার উপরে কেউ যখন বাঁকা কথা শোনাত বা করুণা দেখাত তখন অসহ্য লাগতো।


ধীরে ধীরে আত্মীয়, স্বজন, বন্ধু বান্ধবের সাথেও যোগাযোগ কমিয়ে দিলাম। সারাদিন মন মরা হয়ে থাকতাম। শুধু মেয়েটা যখন অকারণে হাসত হা হা করে বা মাঝে মাঝে আমাকে জড়িয়ে ধরত তখন খুব ভাল লাগতো। ওকে বুকে জড়িয়ে আমি আমার কষ্ট ভুলতাম। হোক অটিস্টিক, কিন্তু আমারই তো সন্তান।


.


এক বছরের সাধনায় তিতলি কিছু কিছু শব্দ বলতে শিখল। যেদিন প্রথম 'মা' ডেকেছিল, আমার ইচ্ছে করছিল সারা পৃথিবীকে জানিয়ে দেই চিৎকার করে। জাহিদকে অফিস থেকে ফোন দিয়ে আগে আগে আনিয়েছি। ইদানীং ওর সাথেও আমার প্রয়োজনের বাইরে কথা হয় খুব কম। ও অনেক চেষ্টা করেছে। আমারই কিছু ইচ্ছে করত না। একটা অপরাধ বোধও কাজ করত। মনে হত, এই যে তিতলি বাবা ডাকছে না, দাদি ডাকছে না, অন্য দশটা বাচ্চার মত বাড়িতে প্রজাপতির মত ঘুরে বেড়াচ্ছে না, বিনা কারণে চিৎকার করে সারা বাড়ির সবাইকে অস্থির করছে, এই সব কিছুর জন্য দায়ী আমি, ও যে আমারই অংশ।


এই নীরবে দুরে সরে যাওয়া আমি সেদিন জাহিদকে ফোন দিয়ে খুশিতে ফেটে পড়েছিলাম,


- 'তিতলি আজ আমাকে মা ডেকেছে, আমার তিতলি কথা বলতে পেরেছে, তুমি এখুনি বাড়ি আস।'


জাহিদ ভীষণ অবাক হয়েছিল আর তার চেয়েও বেশি খুশি। ও যখন বাড়িতে আসল তিতলি তখন সারা বারান্দা দৌড়াচ্ছে আর ময়না পাখির মত বলছে,


– 'মা মামা মা মামা ....... '


ওকে কোলে নিতে গিয়েও থমকে যায় জাহিদ, ততদিনে আমরা জেনে গেছি তিতলিকে যখন তখন বিরক্ত করা  যাবে না, তাহলেই সর্বনাশ। তিতলির বদলে আমাকেই পাঁজকোলা তুলে নিল ও। আমি ও বাধা দেই নি। নিচু হয়ে জাহিদ যখন চুমু খেল, আমার শরীর অবশ হয়ে আসছিল।  কতদিন নিজের দিকে ফিরেও তাকাই নি, আর জাহিদের দিকেও।


.


সে রাতে আমাদের অনেক ভালোবাসা হল। বাধ ভাঙ্গা জোয়ারের মত আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল জাহিদ। আমাদের মেয়েটার মুখে ছোট্ট দুটো শব্দ আমাদের দুটি প্রাণে যেন একটু খানি আশার আলো জ্বালিয়ে দিল। জাহিদের বুকে মাথা রেখে বলেছিলাম,


- 'আমি দুঃখিত, তোমাকে অনেক দিন দুরে সরিয়ে রেখেছি।'


আমার মাথার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলেছিল,

- 'তোমার দুঃখ কি আর আমার চেয়ে আলাদা?'


মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে এক সময় আঙ্গুল গুলো থেমে গেল। আমাকে আরও কাছে টেনে নিয়ে বললো,


- 'রুমু, এক কাজ করলে কেমন হয়, আরেকটা বেবি নেই চল, একটা সুস্থ বাচ্চা আসলে বাড়ির পরিবেশটা পাল্টে যাবে।'


'সুস্থ' শব্দটা বড় কানে বাজল আমার। তবে কি আমার তিতলি অসুস্থ। বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত ঝট করে সোজা হয়ে বসলাম আমি। আমার চোখে রাজ্যের অবিশ্বাস,


- 'কী  বলছ তুমি? যদি আরেকটা বাচ্চা ও অটিস্টিক হয়?' 


- 'তুমি না চাইলে তো আর কিছু হবে না।'


আমাকে শান্ত করে জাহিদ। অনেক দিন পরে একটা শান্তির ঘুমে গড়িয়ে পড়ি আমি। বিধাতা তখন হাসছে, সে রাতেই আমার মাঝে বীজ বুনে দিয়েছিলেন আরেকটি অনাগত সন্তানের, আমার অজান্তেই।


.


এতদিন যুদ্ধটা ছিল আমার জীবনের সাথে। এখন শুরু হল নিজের সাথে যুদ্ধ। কারও কারও এক্সিডেন্ট হয় শুনেছি, এরকম এক্সিডেন্ট যে আমাদেরও হবে, কখনো ভাবিনি। প্রথম মাতৃত্বের সুসংবাদে যেমন আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম, এবারের ঘটনাটা টের পেয়ে ঠিক ততখানি মুচড়ে পড়লাম। একটা অটিস্টিক বাচ্চার পরে অন্য আরেকটা বাচ্চা কেমন হবে সে আশঙ্কা কিছুতেই মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছিলাম না।


জাহিদ খুব চাইছে আমরা বাচ্চাটা রেখে দেই, কিন্তু জানি ও আমাকে কোন কিছুতেই খুব জোর করবে না। কাজ নিয়ে প্রচণ্ড ব্যস্ত থাকতে হয় ওকে, তাই বাচ্চা পালার দায়িত্বটা আমাকেই নিতে হয়। আমার মানসিক অবস্থাটা ও জানে। কিন্তু আরেকজন জোর করছেন আকারে ইঙ্গিতে, তিনি আমার শাশুড়ি মা। একদিন আড়াল থেকে ছেলেকে বলছে শুনলাম,


- 'এটা আল্লাহর তরফ থেকে তোদের জন্য নেয়ামত। আল্লাহ মুখ তুলে তাকিয়েছেন, এতদিনে। ছেলে না হোক, অন্তত একটা সুস্থ মেয়ে বাচ্চা হলেও হোক, তোদের তো নাহলে আর কেউ থাকবে না। তাছাড়া তিতলিকেই বা দেখবে কে?'


এই শেষের কথাটা আমাকে ভাবিয়ে তুললো। দুদিন পরে হাসপাতালে যাব ভাবছিলাম। সারারাত ভাবলাম। দুচোখের পাতা এক করতে পারি না। একবার তিতলির মুখটা ভাসে চোখে, আর তার পরেই এক অনাগত শিশুর কচি মুখ।


নাহ, শেষ পর্যন্ত আর পারলাম না, মা হয়ে এতো কঠিন হতে। বাচ্চাটাকে রেখে দিলাম। এবারের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। কোন আনন্দ নেই, আছে শুধু দুরু দুরু বুকে প্রতীক্ষা। আল্লাহকে যে কত ডেকেছি। আরেক ভয় ছিল তিতলিকে নিয়ে। ও এমনিতে বেশ শান্ত। কিন্তু মাঝে মাঝে খেপলে অস্থির হয়ে যায়, এলো পাথারি হাত পা ছোড়ে। আমি ছাড়া কেউ ওকে তখন শান্ত করতে পারে না। যদি কখনো কোন কারণে আমি আঘাত পাই, পেটের বাবুটাকে সেই ভয়ে অনেক সাবধানে রাখি।


রাতে আমার আর তিতলির মাঝে বালিশ দিয়ে ঘুমাই। মাঝে মাঝে ভয়ে ঘুমও হয় না।


প্রতীক্ষার পালা এক সময় ফুরাল। এবারেও মেয়ে হল আমার। মেয়ের মুখ দেখে...


(চলবে)...


গল্পঃ_আমার_মেয়ে

পর্বঃ_০১

তামান্না_ইসলাম

------------


গল্পঃ_আমার_মেয়ে

পর্বঃ_০২+০৩ (শেষ)

তামান্না_ইসলাম

------------

প্রতীক্ষার পালা এক সময় ফুরাল। এবারেও মেয়ে হল আমার। মেয়ের মুখ দেখে এতো মায়া টলমল করে বুকে, কিন্তু ভয়ে খুশি হতে পারি না। তিতলি ছোট বোনকে দেখে কিছু বুঝল কিনা জানি না। প্রথমে কোন ভাবান্তর নেই।


বাড়িতে যাওয়ার পর কিছু একটা বুঝতে পেরেছে মনে হয়। কখনো খুব আদর করতে চায়, টিপে, চেপে অস্থির। তখন আবার বুঝিয়ে সুঝিয়ে থামিয়ে রাখাও কঠিন। একদিন আরেকটু হলে শ্বাস নালির উপরে চাপ পড়ে গিয়েছিল। কী প্রচণ্ড ভয়টাই পেয়েছিলাম। আবার মাঝে মাঝে ফিরেও তাকায় না। নতুন বাচ্চার চেয়ে তিতলিকেই আমার বেশি সময় দিতে হয়, ও তো আসলে এখনো আরেকটা শিশুই। সব চেয়ে কষ্ট হয় বাথরুম নিয়ে, অনেক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছই ওকে ট্রেনিং দিতে।


.


এতদিন বাসায় নিয়মিত কোন সহকারী পাই নি। তিতলির কারণেই কিছু দিন পর পর লোক পালায়। এইবার ভাবলাম, আর পারছি না, এ ব্যাপারে আরও সিরিয়াস হতে হবে। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে, বেশ কিছু সংস্থার সাথে কথা বলে, অনেক গুলো ইন্টারভিউ নিয়ে শেষ পর্যন্ত একটা মেয়েকে মনে ধরল।


শিক্ষিত মেয়েরা অচেনা বাসায় আসতে ভয় পায়। ছেলে শিক্ষক বা সাহায্যকারী পাওয়া যায়, কিন্তু মেয়ের জন্য ছেলে রাখতে সাহস হয় না। যা শুনি আজকাল চারিদিকে। আমার আর জাহিদের মেয়েটাকে বেশ ভাল লেগেছে। সবচেয়ে বড় কথা, তিতলি সুমনাকে বেশ পছন্দ করেছে মনে হল। অন্তত ট্রায়ালের প্রথম এক সপ্তাহ তেমন কোন ঝামেলা করে নাই। আমি এতদিন পর আমাদের ছোট মেয়ে আশার দিকে একটু মনোযোগ দিতে পারলাম।


আশা হয়েছে তিতলির উল্টো, খেতে চায় না একদম। ঘুম ও খুব অল্প। আমি সুযোগ পেলেই ওর মুখের দিকে, চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি, বুঝতে চেষ্টা করি ওর চাহনি। প্রথম কয়েক মাস আমি তিতলিকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় জাহিদ আর আমার শাশুড়ি মা ওর অনেক দেখা শোনা করেছে ওদের মত করে । একারণে নিজেকে একটু অপরাধীও লাগে। সেটা পুষিয়ে দেওয়ার জন্যই আরও যেন বেশি চেষ্টা করতাম আমি।


একদিন রাত দুটোয় ওকে কোলে নিয়ে বোতলে করে দুধ খাওয়াচ্ছি আমি আর ঘুমে ঢুলছি, হঠাৎ সে মিষ্টি করে ভুবন ভুলানো এক হাসি দিল। তিতলি আর জাহিদ তখন গভীর ঘুমে। ঘুমন্ত জাহিদকে ঘুম থেকে টেনে তুললাম আমি। আশা তখনও হেসেই চলছে, মনে হচ্ছিল স্বর্গ থেকে এক ছোট্ট পরী নেমে এসেছে আমাদের ঘরে। আমি জাহিদের বুকে মাথা রেখে খুশিতে কেঁদে ফেলি।


ধীরে ধীরে দেখা গেল, তিতলিকেও সে চিনতে শুরু করেছে। বড় বোনকে দেখলেও হাসি দেয়। আত্মীয় স্বজনের সাথে যোগাযোগ আমি কমিয়ে দিলেও তারা আমাকে ছাড়ে না। প্রতিবেশীরাও। আশাকে দেখতে এসেও অনেকে অনেক কথা শুনিয়ে গেল উপদেশ দেওয়ার ছলে। তিতলিকে দেখলে এমনভাবে তাকায় যে আমার গা জ্বলে যায়, যেন পাগল দেখছে। সবার সব কথা সহ্য করে আমি আমার দুই মানিককে বুকে চেপে খালি আল্লাহর কাছে কাঁদি।


সুমনা আসার পর তিতলির বেশ কিছুটা উন্নতি হয়েছে। বাথরুমটা এখন নিজেই করতে পারে, আগে মাঝে মাঝে এক্সিডেন্ট হত। খেতেও পারে নিজের হাতে। বেশ কিছু নতুন শব্দ শিখেছে। ছবি আঁকার চেষ্টা করে। কিছুক্ষণ পর পর এসে আশাকে দেখে যায়। একটা জিনিস আজকাল বেশ বোঝা যায় সেটা হল আশার জন্য ওর মনে ভীষণ মায়া। আশা কোন কারণে কাঁদতে থাকলে মাঝে মাঝে ছুটে আসে।


আশা যেদিন প্রথম 'বাবাহ' বললো, আমি আমার নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। ওকে কোলে নিয়ে আমি তিতলিকে ছবি আঁকতে সাহায্য করছিলাম। হঠাৎ 'বাবাহ' শুনে আমি চমকে তাকাই। জাহিদ অফিসের কাজ করছিল। ছুটে যেয়ে ওকে খবরটা দিলাম। ও মনে হল বিশ্বাস করতে পারছিল না। কিন্তু তার পর থেকেই আশা বাক বাকুম করে 'বাবাহ' ডাকতে থাকে, এরপর আরও কত শব্দ। আমাদের বাসাটা কচি মুখের বুলিতে মুখরিত হয়ে উঠে।


.


সুমনা পড়া লেখা শুরু করবে আবার। শুরু হল তিতলির জন্য স্কুল খোঁজা। অনেক খুঁজে খুঁজে বাসা থেকে বেশ দুরে একটা স্কুল পাওয়া গেল। দিনে চার ঘণ্টা। ভীষণ টেনশনে ছিলাম। বাড়ির বাইরে অচেনা পরিবেশে কেমন থাকে। ওর যদি কিছু খারাপ লাগে ও তো বলতে পারবে না। খিদে পেলে, বাথরুম লাগলে, এগুলো তো আমি আর সুমনা বুঝতাম। এখন কী হবে? যদি খুব বেশি অস্থির করে, আঁচড়ে টাচরে দেয়? কেউ থামাতে না পারে? এই প্রথম মনে হল, আমার_মেয়ে'টা কত অসহায়। আবার ওকে তো অন্তত কিছুটা হলেও নিজের কাজ করা, চলা শিখতে হবে।


দিনের পর দিন বুঝিয়েছি। প্রথম দিন নামিয়ে আসার সময় বেশ চিৎকার করছিল, আমি একরকম পালিয়ে এসেছি। পুরো চার ঘণ্টা স্কুলের সামনে বসে ছিলাম। ওদিকে বাড়িতে আশাকে রেখে এসেছি বুয়ার কাছে। শাশুড়ি মা যদিও আছেন, তবুও ভীষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। সময় মত ডায়াপার বদলাবে তো। যদি বেশি কান্না কাটি করে।


এভাবে টানা এক সপ্তাহ যাওয়ার পর পরিস্থিতির একটু উন্নতি হয়েছে। একজন টিচারকে ওর কিছুটা পছন্দ হয়েছে, শিখা মিস। তার সাথেই আঠার মত লেগে থাকছে। স্কুলে কতটুকু কী শিখছে জানি না, তবে ছবি আঁকতে বেশ পছন্দ করছে এটা বুঝি। কম্পিউটারেও কি যেন সব করে। খেলার মাঠে খেলতে নিয়ে যায়। অন্য বাচ্চাদের সাথে বন্ধুত্ব না হোক, মারামারি তো করছে না। এটুকুতেই আমি ভীষণ খুশি।


আশার বয়স তিন হওয়া পর্যন্ত আমি বাসাতেই ছিলাম। এই মেয়ে দুরন্ত। বোন স্কুল থেকে আসলে ছুটে চলে যাবে দরজার কাছে। ওর ঘাড়ে পিঠে উঠে বসে থাকবে। ওর নিজের খাওয়া জোর করে তিতলির মুখে ঢুকিয়ে দিতে চায়। তিতলি যেন ওর একটা খেলনা।


ঘরে থেকে থেকে আমি হাঁপিয়ে উঠেছিলাম প্রচণ্ড। সামাজিক কোন জীবন নেই। জাহিদ অনেক দিন ধরেই বলছে কাজে ফিরতে। আমার সাহস হচ্ছিল না। অবশেষে আশা যখন স্কুল শুরু করল, আমিও একটা পার্ট টাইম কাজে ঢুকে গেলাম। তিতলির স্কুলের পাশেই আরেকটা বাচ্চাদের স্কুলে। যেন ওকে আনা, নেওয়া আমিই করতে পারি।


প্রথম দিন বাসা থেকে বেড়িয়ে খুব নার্ভাস লাগছিল। পারবো তো? কাজটা কী ঠিক করলাম? বাচ্চা দুটোর কোন অসুবিধা হবে না ত? তবে একথা ঠিক, অনেক অনেক দিন পরে মনে হচ্ছিল, আমারও একটা স্বাভাবিক জীবন আছে। পাশে বসে আছে তিতলি, যার দৃষ্টিটা ঠিক স্বাভাবিক নয়, আমারই আত্মজা। কিন্তু, তবুও, জীবন থেমে থাকবে না। আমিও তো একটা মানুষ।


পর্বঃ_০৩

-------------

প্রথম প্রথম বেশ হাবুডুবু খাচ্ছিলাম। নতুন চাকরি, পড়ানোর অভিজ্ঞতা আগে ছিল না। তবে একটা জিনিস খেয়াল করলাম, তিতলিকে দেখা শোনা করে করে বাচ্চাদের ব্যাপারে আমার ধৈর্য অনেক বেড়েছে আর ওদের মন মানসিকতাও বুঝতে পারছি সহজে। চাকরির পরেও তো এক দণ্ড বসা নেই। 


তিতলিকে সাথে নিয়েই কাজ থেকে বাড়ি ফিরতাম। আমরা বাড়িতে ফিরতে ফিরতেই জাহিদ আশাকেও স্কুল থেকে তুলে নামিয়ে দিয়ে যেত। দুপুরের খাওয়াটা আগের রাতেই রান্না করে রাখতাম। কারণ বাড়ি ফেরার পর থেকে এই দুই বাচ্চাকে নিয়ে প্রচণ্ড ব্যস্ত থাকতাম।


তিতলি যেদিন শান্ত থাকত, তবুও রক্ষা। কিন্তু কোন কোন দিন ভীষণ জেদ করত, গোসল করবে না, খাবে না। কখনো কখনো চিৎকার করে ঘুমন্ত আশাকে জাগিয়ে দিত। ওকে হয়তো অনেক কষ্ট করে আমি মাত্র ঘুম পারিয়েছি। কখনো বা আমাকে পুরোটা সময় ওকেই দিতে হত, আশাকে বুয়া বা শাশুড়ি মায়ের কাছে রেখে। সমস্যা হয়ে যেত ডাক্তারর কাছে যাওয়া, দোকান পাটে যাওয়া এসব নিয়ে।


আমি আর জাহিদ দুজনে একসাথে তো এসব কাজে যেতেই পারতাম না, অথচ এক বাচ্চার অসুখ হলে বা দোকানে যেতে হলে দুজনকেই ছুটি নিতে হত। একজনের কাছে এক বাচ্চা, আরেকজন অন্য বাচ্চা নিয়ে কাজ সারতে হত। যদিও বাইরে নিয়ে গেলে মানুষ জন তিতলির কাজে বিরক্ত হত, কিন্তু বাইরে গেলে ও খুশি হত মনে হত। তাই মাঝে মাঝে ওকে সময় পেলে এমনি গাড়িতে করে ঘুরাতাম। ওই সময়টাই আমার একমাত্র বিশ্রাম। গাড়িতে বসে ও শান্ত ভাবে বাইরে দেখত। আশাও আমার কোলে কিছুক্ষণ থেকে ঘুমিয়ে পড়ত। শুধু জ্যামে অনেকক্ষণ আটকে থাকলে অস্থির করত।



প্রথম ধাক্কাটা সামলে উঠার পর এই ব্যস্ত জীবনে আমরা সবাই মোটামুটি অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। রুটিন জীবন বরং তিতলির জন্য ভালো মনে হল। আগে মাঝে মাঝে রাতে ঘুমাতে চাইত না। এখন ক্লান্ত থাকে সময় মত ঘুমিয়ে যায়। প্রতিদিন একই কাজের একই সময়ে পুনরাবৃত্তি করতে করতে দৈনন্দিন কিছু কাজ ও এখন নিজে করতে পারে। সকালের দাঁত ব্রাশ করা বা জামা, জুতো দিয়ে রাখলে পরা এসব। স্কুলের টিচাররা ওর ছবি আঁকার প্রতিভাটাকেই বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। সাথে একটু একটু করে পড়তে, সংখ্যা গননা এসব ও শেখাচ্ছে। আমাদের বুকে একটু একটু করে আশা জাগে।


তবে সামাজিক জীবন থেকে আমরা তখনও অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। তিতলি কিন্তু অন্য বাচ্চাদের আঘাত করে এমন নয়। কিন্তু তারপরেও ওর সাথে কেউ খেলতে বা মিশতে চায় না। বাচ্চাদের চেয়ে তাদের বাবা মায়ের ভয় বেশি। আর ও চিৎকার করলে তো কথাই নেই। এমন ভয় পায় বা বিরক্ত হয়। অনেকে অনেক সময় মুখের উপরে অনেক কিছু বলে দেয়। সেগুলো সহ্য করা কঠিন হয়ে যায়। বাইরে খুব একটা যাওয়া হয় না বলে কিনা জানি না, ওদের দুবোনের ভীষণ ভাব। ভাবটা বলা যায় খানিকটা এক তরফা। আশা তিতলির জন্য পাগল। 


আমার বড় মেয়েটাকে আল্লাহ অসহায় করে পাঠিয়েছেন বলেই হয়তো ছোটটা বয়সের তুলনায় অনেক বুদ্ধি রাখে। পাঁচ ছয় বছর বয়স হতে হতেই সে শিখে গেছে বোনকে অনেক খেয়াল রাখতে হয়। অনেক কিছুতে সাহায্য করতে হয়। কোন কোন খাবার তিতলি খেতে চায় না, সেটাও সে জানে। তিতলিকে যে বেশি সময় দিতে হয়, সেটা নিয় মন খারাপ করে না, বায়নাও কম। তবুও বাচ্চা মানুষ। ওর ও পড়ালেখা আছে, খেলতে মন চায়। তিতলি ওর খুব ভাল খেলার সাথী। কখনো ওকে আশা ঘোড়া বানায়। কখনো প্রিন্সেস।


ছুটির দিনের দুপুর বেলায় দুই মেয়েকে পাশে নিয়ে আমি ওদেরকে গল্প পড়ে শুনাই, আশা হাজারটা প্রশ্ন করে, আর তিতলি কখনো একদম অপ্রাসঙ্গিক কিছু একটা বলে বসে।


শাশুড়ি মা আজকাল মাঝে মাঝে নতুন চিন্তা মাথায় ঢুকায়, মেয়ে বড় হলে কী হবে। ওর শরীর নিয়ে কিছু ওকে বুঝানো তো সম্ভব না। আমি এগুলো বেশি একটা ভবতে চাই না। এখনো তো মাত্র দশ পেরিয়ে এগার। আমি না ভাবলে কী হবে, পৃথিবী আমাকে ঠিকই ভাবাবে।


সেদিন ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া ভাশুরের ছেলে এসেছে বাড়িতে। দুপুর বেলা, আমাদের ও তখনও খাওয়া হয় নি। তাই খেয়ে যেতে বললাম। ওকে ড্রইং রুমে বসিয়ে আমি গেছি রান্না ঘরে। হঠাৎ তিতলির ঘর থেকে চিৎকার। রান্না ঘর থেকে ওর রুমটা বেশ দুরে। এসে কিছুই বুঝলাম না, খালি ওকে গোঙ্গাতে দেখলাম। ভীষণ রেগে লাল হয়ে আছে। অনেক কষ্টে থামিয়ে ড্রইং রুমে আসতেই জয়, আমার ভাশুরের ছেলে উঠে দাঁড়াল,


- 'আমার যেতে হবে চাচি এক বন্ধুর বাসায়।'


আমাকে তেমন কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ও এক রকম পালিয়ে চলে গেল, ওর মুখে বেশ কয়েকটা আঁচড়ের দাগ। আমার হাত পা হিম হয়ে গেল। সামনের দিনের কথা ভেবে আমি চোখে মুখে অন্ধকার দেখি।


দেখতে দেখতে মেয়েটা বেশ বড় সর হয়ে গেছে। আজকাল রাস্তা ঘাটে ছেলেরা কেমন করে যেন তাকায়। ওকে ফ্রক ছাড়িয়েছি অনেক আগেই, জামা কাপড় ঠিক মত সামলাতে পারে না বলে। কিন্তু ওড়নার ঝামেলাও তো পারবে না। মাথায় আবার নতুন চিন্তা। ঢোলা ঢালা সালওয়ার কামিজ ধরনের কাপড় খুঁজে বের করি হন্যে হয়ে। সেগুলো পরে ওকে আরও অদ্ভুত লাগে। আর আমার মন খারাপ হয়। সারা জীবনে কখনো লম্বা চুলও রাখতে দেই নি।


আর তারপর একদিন ঠিকই চলে এল সেই দিন, যার ভয়ে আমি কাঁটা হয়ে ছিলাম। স্কুল থেকে ফোন এল, ফোনটা ধরতে ধরতেই আমার মন বলছিল একটা কোন খারাপ খবর। খারপই বা বলি কী করে, এটাই তো প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম। তিতলির পিরিয়ড শুরু হয়েছে। সেদিন নিজেকে আমার এতো অসহায় লাগছিল। বাসায় নিয়ে এসে পরিষ্কার পরিচ্ছন করে দিলাম। ও খুব কাঁদছিল, মনে হয় ব্যথাও করছিল। নিজের কথা মনে হল। আমিও জানতাম না। তাই অনেক ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু আস্তে আস্তে যখন বুঝানো হল সবারই এটা হয়, কদিন পরে ঠিক হবে, তখন একটু একটু করে ভয় কেটেছে। এই মেয়েকে আমি কিভাবে কী বুঝাব? আর না বুঝালে তো ওর ভয় কাটবে না। জন্ম থেকে যেগুলো হয়, সেগুলোতে ও অভ্যস্ত, কিন্তু এটা তো সেরকম না।


আমার এই আশংকাটা সত্য হল। ওকে এটা ঠিক মত বোঝানো গেল না। আর ওর সাথে আমাকেও ছুটি নিয়ে বসে থাকতে হল প্রথম কদিন ওকে, ওর কাপড় চোপর সব ঠিক রাখতে, সামলে রাখতে। নতুন চিন্তা মাথায় যোগ হল, এভাবে আমি চাকরি করব কিভাবে?


কিন্তু আমার এই মোটামুটি বন্দি জীবনে চাকরিটাই একমাত্র খোলা জানালা। সে জানালা আমি বন্ধ হতে দেব না কিছুতেই। বেশ কয়েক বছর ধরে চাকরি করছি। সিনিয়র বলে বেতনও বেড়েছে। পয়সার মায়া ত্যাগ করে আবারো লোক খোঁজা শুরু করলাম। মাসের ওই কয়দিন বাড়িতে ওর সাথে থেকে ওর দেখা শোনা করবে এমন লোক। প্রায় অসম্ভব কাজ মনে হচ্ছিল। ও এখন বড় হয়েছে, কিছুতেই বাইরের কারও সাথে সহজ হতে পারছিল না, তাও এমন একটি ব্যাপারে।


শেষে উপায় না দেখে ওকে একটা মেয়ের সাথে স্কুলে নিয়ে আমার টিচার্স রুমে বসিয়ে রাখতাম। মনে হচ্ছিল আমার যুদ্ধ আর শেষ হবে না। বছর খানেক লেগেছে ওর অভ্যস্ত হতে।


সময়ের গতিতে শরীরে সব পরিবর্তনই আসছে, এগুলোকে তো আর আটকে রাখা যাবে না। ওকে স্কুলে নামাতে বা তুলতে গেলে মাঝে মাঝে দেখি, ওদের ক্লাসের ছেলেগুলো বড় হয়ে গিয়েছে, গোঁফের রেখা। মাঝে মাঝেই দেখা যায় সবার সামনে মাকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে চুমু খাচ্ছে অনবরত, আর বেচারি মা বিব্রত, থামাতে চাইছে। এই মায়ের কষ্ট কে বুঝবে?


এর মধ্যে একটা বিরাট ঘটনা ঘটেছে। ওর আঁকা একটা ছবি জাতীয় পর্যায়ে প্রথম পুরস্কার পেয়েছে। সেই ছবির পুরস্কার আনতে গিয়ে আমি খুশিতে হাপুস নয়নে কেঁদেছি। আমাকে কাঁদতে দেখে ও আমার চোখের পানি মুছে দিয়েছে, আর আমার এই কাণ্ড দেখে আশা হেসেই অস্থির। একবার বাবাকে জিজ্ঞেসও করলো,


- 'মা কী পাগল হয়ে গেছে? খুশিতে কেউ কাঁদে?'


আশা তো জানে না যে একজন নামকরা পাবলিশার্স তিতলির জন্য চুক্তি সই করেছে আমাদের সাথে, তার কোম্পানির সব ক্যালেন্ডার, পত্রিকা, বইয়ের কাভার এগুলোর ছবি এঁকে দেবে তিতলি। এক বছরের চুক্তি হয়েছে, কাজ পছন্দ হলে এই চুক্তি বাড়ানো হবে। আমার ব্যাগে তখন পাবলিশার্সের দেওয়া অগ্রিম বিশ হাজার টাকার একটা চেক। 


আমার স্পেশাল বাচ্চার প্রথম ইনকাম। এই টাকা গুলো আমি রেখে দেব। ওকে একটা আর্ট গ্যালারি করে দেব। ও মনের মত ছবি আঁকবে, গ্যালারিটা দেখাশোনা করতে আশা সাহায্য করবে। একদিন নাম করা শিল্পী হবে তিতলি। এতো সুখ কী আমার ভাগ্যে আছে? ভাবতে ভাবতে আমার চোখে জল আসে। আশা আছে বলেই তো আমরা বেঁচে থাকি, আশাই আমাদের বাঁচিয়ে রাখে, জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যায়...


(সমাপ্ত)...


পর্বের আরও গল্প পড়ুন।