ভালোবাসার অনুভূতি | নীল ক্যাফের ভালোবাসা

নীল ক্যাফের ভালোবাসা

নীল ক্যাফের ভালোবাসা

 আমার বড়ো আপা ছিল আমাদের ঘরের সবচাইতে চুপচাপ, শান্তিপ্রিয় মেয়ে। দশ কথায় 'রা' ছিল না তার। আমি আপাকে মুখ ফুটে আবদার করে কখনো কিছু চাইতে দেখিনি। প্রচন্ড মুখচোরা স্বভাবের ছিল বলেই তার মনের কথা, আবদার বহিরাগত হতো খুবই কম।


হাতে একটা বই আর একটা ডায়রি নিয়ে বারান্দায় বসে থাকা ছিল তাঁর অন্যতম প্রিয় কাজ। আমরা বাকি দুই ভাই-বোন যেখানে সারা এলাকা দাঁপিয়ে বেড়াতাম, সেখানে আপাকে কেউ ঠিকঠাক চিনতোই না! তাঁর সব কাজ ছিল নিয়ম মাফিক। সকালে কলেজ যেত, দুপুরে এসে গোসল করে খেয়েদেয়ে একটা ঘুম দিত, ঘুম থেকে উঠে এক মগ র'চা আর বই নিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসতো। 


আমার বই পড়া আর লেখালেখির স্বভাবটা মূলত আপার থেকেই পেয়েছি। আমার মনে হতো, আমার আপা পৃথিবীর সবচাইতে পারফেক্ট মানুষ! আমি তার মতো হতে চাইতাম। সে যেই যেই কাজগুলো করতো, আমিও তাই তাই করতে চাইতাম, খুব আপার নেওটা ছিলাম। আর সেকারণেই মূলত আমি আপার সন্তর্পণে করা কাজগুলোও সবচাইতে কাছ থেকে দেখেছি। 


আমি আপাকে খুব বেশি রাগতে দেখিনি কখনো। তবে মুখটা সর্বদা হাসিহাসি হয়ে থাকত। কি সুন্দর করে হাসতো। গালের মধ্যিখানে একটা কালো তিল, তারার মতো জ্বলজ্বল করত। আমার সেই হাসিহাসি মুখের সুন্দরী আপাকে আমি একটা সময় হুটহাট কাঁদতে দেখতাম। ছোট ছিলাম, অত বুঝতাম না।


ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করতাম, 

– "আপা কাঁদো ক্যান?"


আপা কান্না লুকানো হাসি হেসে বলতো,

– "বেশিক্ষণ বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলে আমার চোখে পানি এসে যায়। কাদঁছি না তো। কাঁদবো কেন রে বোকা? আমার কাঁদার কারণ নাই, কেউ নাই, কিচ্ছু নাই!"


আমি ভাবতাম,

– "ইশশ! বই পড়া সত্যিই কত্ত কষ্টের! আম্মু যে ক্যান বোঝে না! আমারও কত্ত কষ্ট লাগে!"


খুব বেশি রাগতে না দেখা আমার সেই আপাকে একদিন আমি খুব রাগতে দেখলাম। সে তার প্রিয় ডাইরি আমার সামনে কুটকুট করে ছিঁড়ল। তার চোখের মায়াময় অশ্রু মুছতে মুছতে বললো,


– "ম্যাঁচটা নিয়ে আয় তো পিহু, দ্রুত।"


আমি কালবিলম্ব না করে ম্যাচ নিয়ে এলাম। আপা সেই ছেড়া কাগজ গুলো আমার সামনে পুড়িয়ে দিয়েছিল, সাথে কিছু চিঠি। যদিও সেসব যে চিঠি ছিল, তখন বুঝিনি, পরে বুঝেছি। ডাইরি, চিঠি আর সেই সাথে স্মৃতি পুড়িয়ে মুক্ত হতে চেয়েছিল কি?


সেদিনের পর থেকে আমার শান্তপ্রিয় আপা আরো বেশি শান্ত হয়ে গেল। জানালার গ্রিল ধরে বসে বসে কি যেন ভাবতো! ডাইরিটা পুড়িয়ে ফেলার পর আর ডাইরিও লিখত না। কেন জানি, ডাইরি লিখার কারনটাই বুঝি ফুরিয়ে গিয়েছিল!


ইন্টারমিডিয়েট শেষে, খুব হঠাৎ করেই আপার বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। বাবা মা সবাই খুশি, আবার দুঃখিও! তাদের আদরের বুঝদার মেয়েটাকে কাছ-ছাড়া করা সময় হয়ে এলো যে!


বিয়ের দিন আপা খুব কাঁদল। আমায় আদর করে বললো, 


– "পিহু, শোন? কক্ষনো কাউকে অযথা ভালোবাসবি না। কারো কথায় গলে যাবি না। সব মোহ, লোক দেখানো। মন দিয়ে পড়াশোনা করবি শুধু। মনে থাকবে?"


আপার অমন কান্না দেখে বললাম,

– "মনে থাকবে আপা, খুব মনে থাকবে। শুধু তোমায় বেশি ভালোবাসি।"


আপা আরো কাঁদল। আমার আপার কান্নাও সুন্দর। দারুন করুন!


আপার কান্না শেষে হাসি হয়ে অবশেষে আসলো কেউ। যেই মানুষটার সাথে বিয়ে হলো, সে ছিল আপার পুরোপুরি বিপরীত স্বভাবের। বিপরীত স্বভাবের হলেও ভাইয়াকে আমার খুব পছন্দ হয়েছিল। আপাকে ঘিরে তার চোখেমুখে দারুন মুগ্ধতা সেই শুরু থেকেই৷ চলাফেরা খুব সাধারণ, সাদামাটা।


তিনি বিয়ের দিন ঘটালো এক মজার ঘটনা। তাঁর জন্য কেনা বিয়ের পাঞ্জাবি তিনি পরলেন না, তাঁর নাকি গরম লাগে। বিয়ে নাকি আড়াম করে করতে হয়। তাই তিনি একটা সাধারন সাদা পাঞ্জাবি পরে এলেন। সাদা শুদ্ধতার প্রতীক। শুদ্ধতম কাজ নাকি শুদ্ধতার সহিত করতে হয়!

ওনার আত্মীয়স্বজনরা লজ্জা লজ্জা হয়ে বলতে লাগলেন, 


– "দেখুন তো, কি একটা অবস্থা! এই ছেলেকে নিয়ে যে কি করি!"


ভাইয়া বললেন,

– "আমায় নিয়ে কিচ্ছু করা লাগবে না। আমার বউকেও রিলেক্স করে দাও। ওকেও বস্তাটস্তা পড়াবা না খবরদার! ছোট্ট মেয়েটা গরমে সিদ্ধটিদ্ধ হয়ে গেলে সর্বনাশ।"


সবাই তো সেখানেই হেসে খুন। তবে আমার আম্মু আব্বু মনে মনে মহাখুশি, মেয়ের প্রতি জামাইয়ের এমন কেয়ারনেস দেখে। তাঁদের মুখচোরা মেয়ের জন্য তো তাঁরা এমন জামাই-ই চায়।


আপার মনে এমনিতেই দুঃখ, তার উপর আবার হতে যাওয়া জামাইটা এমন সব কাজকারবার করছে। সে মুখ বাঁকিয়ে বলে,


– "বেশরম ছেলে মানুষ!"


কিন্তু এই ছেলেতে কাবু না হয়ে উপায় কি আপারও ছিল? এমন নির্মল, স্বচ্ছ যার প্রেম!


তিনি যখন আমাদের বাসায় আসতেন, আমায় মাঝেমধ্যে ডেকে নিয়ে বলতেন,


– "তোমার আপা একটা পরী। তাই না বলো পিহু?"


আমি বলতাম,

– "হ্যাঁ পরী তো৷ কিন্তু কী পরী বলুন তো? লাল, নীল নাকি সাদা?"


ভাইয়া আড়চোখে দূরে থাকা আপাকে এক পলক দেখতো। তারপর টেনেটেনে বলতো,


– "মিষ্টি পরী। তোমার আপা ফুল, ফুল পরী!" 


আমি তখন ম্যাট্রিক দিব বলে রাত-দিন পড়ি৷ নিজের বই সাথে আপার পুরোনো বই। পুরোনো বইগুলো অনেক হেল্পফুল। এমনই একদিন একটা বইয়ে আমি এক বিস্ময়কর চিঠি পেয়েছিলাম। জেনেছিলাম, আপা কাউকে সন্তর্পণে মন দিয়েছিল! তার মিটমিট হাসি আর কান্নার আড়ালে লুকায়িত এক হারিয়ে যাওয়া ছেলে মানুষ ছিল!


ছোট্ট বেলায় দেখা আপার সেই রাগ আর কান্নার অর্থ আমি সেদিন খুঁজে পেয়েছিলাম। কিন্তু আমার কেন যেন মনে হলো, আপার সব খানি ভালোবাসা তার বরটাই ডিজার্ভ করে। কেমন আলতো করে, কোমল করে ছোঁয়া মাখানো ভালোবাসা ওঁর বরটার! অন্যকারো প্রতি একটুখানি টান থাকাও সেখানে নিষেধ। আপার আজও মনে আছে তাঁকে? আমার খুব জানতে ইচ্ছে হলো। 


.


আপা একদিন বাসায় এলো, সাথে এলো তার বরটাও। আপাকে ছাড়া তিনি একা থাকতে পারেন না! ওনার নাকি যন্ত্রণা লাগে, একলা একলা লাগে!


বাসায় এসে আমায় দেখেই বলে উঠলেন,

– "পিহুরানী? শুনলাম তুমি রাত দিন পড়ছো? অত পড়বে না, বুঝলে? বেশি পড়ুয়া মেয়েগুলো রাগী হয়, তোমার আপার মতো। তারপর নিরিহ মানুষদের উপর অকারণ, অযথাই বকাঝকা করে।"


শেষের কথাগুলো বললেন, গলার স্বর একদম নিচে নামিয়ে, যেন আপা শুনতে না পান। আমি হাসলাম। ভাইয়া বললেন,


– "তোমার আপা এত পড়ে পড়ে, আমায় পাগল করে দিল। সে কথা না বলে সারাক্ষণ বই-ফই পড়ে, আর আমি 'তার কথা' 'আমার কথা' মিলিয়ে একা একা বকবক করি, ইন্টারেস্টিং না?"

বলেই উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। 


কী পাগল মানুষ। কী স্বচ্ছ তার প্রেম! তাও আমি আপাকে উপরে রাখতে বললাম,


– "আপাকে পেয়েছেন এটা আপনার ভাগ্য, বুঝলেন? আমার আপা ফার্স্টক্লাস, হু।"


ভাইয়ার মুখটা কি সুন্দর তৃপ্তিময় হয়ে উঠলো।  আপার রুমের দিকে একবার চেয়ে বললো,


– "হ্যাঁ, সত্য! আই এম দ্যা লাকিয়েস্ট ম্যান! জগতের এত সুন্দর ফুলপরীটা আমার! ভীষণ লাকি না হলে কেউ পায়? বলো?"


আমি ভাবলাম, এই মানুষটা আপায় যতটা মুগ্ধ, আপা ততটা মুগ্ধ তো? যেমনটা ছিল তার কিশোরী প্রেমে? 


রাতে সেদিন আপা হন্তদন্ত হয়ে আমার সাথে শুতে এল। নিশ্চিত ঝগড়া-টগড়া করেছে। আমার শান্তিপ্রিয় আপাটা এমন ঝগড়ুটে হয়ে উঠলো কবে, কে জানে! আমি অবাক হয়ে বললাম,


– "অত ভালো বরটা রেখে চলে এলে? তুমি কত নিষ্ঠুর হয়ে যাচ্ছ আপা!"


আপা মিটমিটি হাসলো। বালিশ গোছাতে গোছাতে বললো, 


– "ভালো না ছাই! ফাজিল একটা। এত বড়ো হলো, তাও আমায় রাগায়। তুই ঘুমা, বেটাকে একটা পানিশমেন্ট দেই।" 


আমি আশ্চর্য হই। আপার চোখে মায়া, কথায় মায়া। তাও ভাবখানা এমন যেন একটুও কেয়ার করে না কিচ্ছু!

আপার রুম পাশেই, তার বরটা একা সেখানে। আপা শুতে আসবে তক্ষুনি সেই রুমে কিছু পরার আওয়াজ হলো, গ্লাস হবে বোধহয়। এমন করে পর পর দুই তিনবার কিছু ছুঁড়ে মারলেন।


আপা মেকি রাগ দেখিয়ে বললো, 

– "কত্ত বড়ো সাহস দেখছিস? আমার বাড়ি এসে আমার জিনিস ভাঙচুর করে!"


আমার খিলখিলিয়ে হাসি পায়! হাসি আটকে বলি,

– "তোমরা দুইজন পাগল। যাও তো আপা। বেচারা তোমায় দুই মিনিট না দেখলে পাগল হয়ে যায়। তাঁরে একটু ঘুমাইতে দেও, সাথে আমারেও। প্লিজ যাও৷"


আপা যাওয়ার জন্য প্রস্তুত, তাও ভাব দেখাতে হম্বিতম্বি করলো। কঠিন শাস্তি দেয়ার মতো ভাব নিতে নিতে যেতে লাগলো।


আপা দরজার কাছে যেতেই আমি আচমকাই বলে ফেললাম,


– "মানুষ যা হারায়, আল্লাহ চান তো তার থেকে দুগুন কিছু পায়, বরং আরো উত্তম রূপে ফেরত পায়। তোমার বরটাকে তুমি তাঁর মতো করে ভালোবাসো তো আপা?"


আপা হঠাৎ আনমনা হয়। সেই কিশোরী আপা যেমন করে চাইত, তেমন করে চায়! খুব শিতল হয়ে বলে,


– "না বেসে উপায় কই? আল্লাহ আমায় এমন ভালো মানুষ দিল, ভালো না বেসে পারি? সে কাছে থাকলে আমার দুনিয়া শান্তিময়! মিনিটে মিনিটে রাগায়, ক্ষ্যাপায়, পেছনে লেগে থাকে সর্বদা, তাও দুঃখ টের পাই নি এই এতগুলো বছরে! আমারে ছাড়া সে কিচ্ছু বোঝে না! 


তাঁরে আমি কতখানি ভালোবাসি জানি না। কিন্তু তাঁর মতো ভালো বোধহয় এ জনমে কাউরে বাসি নাই! বাসার বোধহয় সুযোগই পাই নাই। হঠাৎ এসে আমার মন, আমার সব ভালোবাসা নিজের দখলে; কেমন করে যেন নিয়ে নিল, কি আশ্চর্য!"


(সমাপ্ত)...


-ছোটগল্প

-মনের_মানুষ 

-কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া

----


মন ছুঁয়ে যাওয়া গল্প পড়ুন।