স্বামী স্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক | স্বামী স্ত্রীর আদর ভালোবাসা

 স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসা

স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসা

তোমাকে যদি এই মুহূর্তে আমি একশোটা চুমু খাই, তোমার ব্যথা কি কমে যাবে, জান? তুমি না বলতে, ব্যথা জায়গায় প্রিয়রা চুমে খেলে ব্যথা সেড়ে যায়!"


প্রিয়তম স্বামীর বুকে মাথা গুঁজে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মায়া বললো, 


"মনের ব্যথা চুমুতে সাড়ে, শরীরের ব্যথা কি করে সাড়াবেন রিহান ভাই? আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, নেতা সাহেব। বড্ড ভয় লাগছে আজ!

মনে হচ্ছে, আজই আমার জীবনের শেষ দিন। আমার শেষ মুহূর্তে আপনি আমার পাশে থাকুন নেতা সাহেব। আপনি কোথাও যাবেন, আমার হাত ধরে বসে থাকবেন। ওরা যদি আমায় নিতে আসে, আপনি আমায় যেতে দিবেন না! আপনি আমায় আপনার কাছে রেখে দিবেন, নেতা সাহেব! আমি আপনার সাথে অনেক গুলো বছর বাঁচতে চাই। আপনাকে এখনো অনেক ভালোবাসা বাকি, নেতা সাহেব! "


সিজারিয়ান অপারেশন থিয়েটারে বসে ডেলিভারি পেইন, অদ্ভুত এক যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে মায়া। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে, ডক্টর, নার্স। এক্ষুণি তার অপারেশন করা হবে।  মাএই মায়া'কে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। এখানে এসেই তার ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় জানান দিচ্ছে, তার আয়ু ফুরিয়ে এসেছে। এরিমধ্যে মায়া বায়না ধরলো, তার স্বামী'কে একবার দেখবে।


খবর পেয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো, নেতা রিহান চৌধুরী। স্ত্রী'র কান্না ভেজা চোখ, তার চিৎকার কলিজায় আ'ঘা'ত করছে যেন! এই নারীটি তার অনেক আদরের! অনেক ভালোবাসা'র! 

দিকবিদিকশুন্য হয়ে স্ত্রী'র হাত খানা ধরে অবুঝের মতো আচরণ করছে শক্তপোক্ত, নেতা রিহান চৌধুরী। এই মুহূর্তে তার বিচার শক্তি, বুদ্ধিমত্তা কাজ করছে না। স্ত্রী তার দুর্বলতা! তার কিছু হলে, এলোমেলো হয়ে যায় রিহান চৌধুরী। 

স্ত্রীর ব্যথাতু মুখখানা স্পর্ষ করে সবার সামনেই অবুঝের মতো, চুমু খাওয়ার আবদার করলো সে। যা শুনে শুষ্ক ঠোঁটে এক চিলতে হাসলো, মায়া। ডক্টর, নার্সরাও মুখ টিপে হাসছিলো। 

সবার নিকট একজন শক্তপোক্ত, কঠিন রাজনৈতিক নেতা রিহান চৌধুরী। এই কঠিন লোকটাও যে কাউকে এতটা ভালোবাসা'সে তা নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস'ই হবে না কারো!


স্বামীর কথা শুনে, ভেতর থেকে কান্নারা দলা পাকিয়ে আসছে। পরমুহূর্তে, মায়া রিহানের সাহায্যে শোয়া থেকে উঠে বসলো। প্রিয়তম স্বামীর বুকে মাথা গুঁজে উপরোক্ত কথা গুলো বললো। যা শুনে ভিতরটা দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে রিহান চৌধুরী'র। তার চোখেও জল। বুকের সাথে মায়া'কে আরো একটু  চেপে ধরে ভেজা কণ্ঠে শুধালো,


"ওমন করে বলে না, জান! কিচ্ছুটি হবে না তোমার। আমি আছি তোমার পাশে, ভয় পেয়ে না জান! কিছু হবে না তোমার, কিছু না। "


মায়া চোখ বন্ধ করলো। রিহান চুমু খেলো স্ত্রীর কপালে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। রোগীর অবস্থা শোচনীয়!  যা দেখে এই অবস্থায়ই দ্রুত রোগীকে অজ্ঞান হওয়ার ইইঞ্জেকশন পুঁষ করা হলো। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই রিহানের বুকে ঢলে পড়লো, মায়া। রিহানের হাতখানা এখনো তার মুঠোবন্দী।

 ভয়ে, দুশ্চিন্তায় ঘামছে, রিহান চৌধুরী। 

 ডক্টর রিহানকে পর্যবেক্ষণ করে বাহিরে যেতে বললো। কিন্তু রিহান বললো,


"আমি এখানেই থাকবো ডক্টর। আমার মায়া'র আবদার আমি রাখবো, তার এই হাত ছাড়বো না। বুঝলেন ডক্টর, আমার বউটা অনেক ভয় পাচ্ছে। এখন তার পাশে আমাকে প্রয়োজন। সে চোখ খোলা না অবধি, আমি এভাবেই থাকবো।"


"কিন্তু, আপনাকে ভীষণ নার্ভাস লাগছে স্যার। আপনি নিজ চোখে বউয়ের শরীরে'র কা'টা'ছেঁ'ড়া সহ্য করতে পারবেন? এখানে কিন্তু কোনো প্রকার সিনক্রিয়েট করা যাবে না, স্যার। এতে রোগীর সমস্যা হবে।"


"চিন্তা করবেন না। আমি নিজেকে সামলে নিবো, ডক্টর। আপনারা নিজেদের কাজ করুন। আর শুনুন? ও যেন ব্যথা না পায়!" 


এদের ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ হলো ডক্টর। সচারাচর এমন নজরকাঁড়া ভালোবাসা চোখে পড়ে না আজকাল। 

ডক্টর আর কথা বাড়ালো না। নিজেদের কাজে মনোযোগী হলো। অপারেশন চলছে, রিহান চৌধুরী প্রিয়তমা স্ত্রী'র একটা হাত ধরে চোখ বন্ধ করে পাশে বসে থাকলো। মনে মনে সৃষ্টিকর্তা'কে ডাকছে। 

.

.

সিজারিয়ান অপারেশন সাকসেস। ঘন্টাখানিক হলো, ছোট্ট একটা প্রাণের আগমন হলো পৃথিবীতে। সকল কাজ শেষ। কিছুক্ষণ হলো, মা ছেলে কে বেডে দেওয়া হলো। মায়া এখনো অজ্ঞান।

রিহান চৌধুরী, ছেলের আগমনে খুশী হলেও বউয়ের টেনশনে অস্হির হয়ে যাচ্ছে। যা দেখে ডক্টর আশ্বাস দিয়ে বললো, 


"রিলাক্স স্যার! কিছুক্ষণ পরই রোগী'র জ্ঞান ফিরবে। "


তবুও স্বস্তি মিলছে না, তার। এক হাতে ছেলেকে অন্য হাতে বউয়ের হাত ধরে, অপেক্ষা করছে রিহান চৌধুরী। এরিমধ্যে, নানি-দাদিরা ছেলেকে তার কাছ থেকে নিয়ে গেলো। ছোট্ট শিশুর আগমনে পুরো চৌধুরী পরিবার বেজায় খুশী। 


কিন্তু, এই খুশী স্হায়ী হলো না! এক ঘন্টা, দু'ঘন্টা করতে করতে একটা দিন পাড় হলো, কিন্তু মায়ার জ্ঞান ফিরছে না। দু'শ্চিন্তায় পড়ে গেলো সকল চৌধুরী পরিবার। রিহান চৌধুরী একেবারে নিশ্চুপ! 

ডক্টররা চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছে,রোগীর অবস্থা করুণ! শ্বাস আঁটকে যাচ্ছে, অক্সিজেন মাস্ক পড়ানো হয়েছে মায়া'কে। এরিমধ্যে ডক্টর পরিক্ষা করে জানতে পারলো, রোগীর ব্রেইনে টিউমার। দীর্ঘদিন ধরে এর বাস। যা এবার সারা মস্তিষ্কে ছড়িয়ে র'ক্ত'ক্ষ'র'ণ হচ্ছে। সৃষ্টিকর্তা জানেন, এই অবস্থায় এই রোগী বাঁচবে কি-না! তবে উনারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। 


এই খবর পেয়ে, পুরো চৌধুরী পরিবারে কান্নার স্রোত বয়ে যাচ্ছে। রিহানের মনে পড়ে যায়, গর্ভকালীন অবস্থায় মায়া প্রায়সই মাথা চেপে ধরতো। জিজ্ঞেস করলে, সবসময় কিছু  খুব সূক্ষ্ম ভাবে এড়িয়ে যেতো। তার মানে মেয়েটা জানতো। হয়তো বাচ্চার কথা ভেবে, তাদের জানায়নি সে খবর। বাচ্চা পেটে আসার সময় প্রায়ই মায়া বলতো,


"নেতা সাহেব! যদি আমার কিছু হয়ে যায়, আপনি আমার বাচ্চাটাকে দেখে রাখবেন। মানুষের মতো মানুষ করবেন। কখনো বুঝতে দিবেন না, ওর মা নেই।"


রিহান তখন রাগ করতো, অভিমান করতো। বলতো,


"এমন কথা আর বলবে না, জান। তোমার কিছু হবে না। "

 

 মেয়েটা তখন অদ্ভুত কণ্ঠে খিলখিল করে হাসতো! বলতো, 


"আমিও বাঁচবো। কিছু হবে না আমার। সত্যিই কিছু হবে না। এমনিতেই মজা করছি, নেতা সাহেব!  স্যরি! আর এমনটা বলবো না। "


পুরোনো কথা মনে পড়তেই, চোখ টলমল করছে রিহান চৌধুরী'র। সে কেন মেয়েটাকে বিশ্বাস করতো! ইশ, যদি তখন জানতো সেসব! আজ হয়তো এই করুণ সময়টা আসতো না।

ততক্ষণাৎ পুরুষটি স্ত্রীর নড়বড়ে হাতটা শক্ত করে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো, 


"বোকাফুল! তুমি বড্ড স্বার্থপর! তুমি বড্ড মিথ্যুক! তুমি আমাকে ঠকালে!"


পরমুহূর্তে উপরের দিকে তাকিয়ে রবের নিকট বললো,


"ইয়া রব! তুমি আমার আয়ুর অর্ধেক তাকে দিয়ে দেও। তবুও তাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেও, খোদা! তুমি তো জানো,  এই মেয়েটাকে আমি অসম্ভব ভালোবাসি! তার কিছু হলে আমি সহ্য করতে পারবো না খোদা.. তার আগে তুমি আমার মৃ'ত্যু উপহার দিও।"

________


শেষ সময় এসে ডক্টর তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করলো। কিন্তু, হায় বাঁচাতে পারলো না মেয়েটাকে। সৃষ্টিকর্তার সিদ্ধান্তের ওপর কারো হাত নেই। 

মেয়েটা দু'দিন আগে যে চোখ বন্ধ করলো,আর চোখ খুললো না। দেখা হলো না, নাড়ি ছেঁড়া পুত্র'কে! দেখলো না, তার জন্য এক পুরুষের হা'হা'কা'র। সকল মায়া ত্যাগ করে, আজ ভোরে মেয়েটা দুনিয়া ছাড়লো।

 লা শ'কে ঘিরে ধরে কাঁদছে সবাই। 

রিহান চৌধুরী এখনো স্ত্রী'র হাত ধরে আছেন। করুণ কণ্ঠে ডাকছে,


"মায়া ও মায়া! জান, উঠো জান! একটা বার চোখ খুলে দেখো মায়া, তোমার নেতা সাহেব তোমায়  ডাকছে।

এই দেখো, তোমার হাত ধরে এখনো বসে আছি আমি। অভিমান করে না জান, সত্যি বলছি এই হাত একটুও ছাড়িনি আমি। এই তোমরা সবাই দেখছো না? ওরে বলো, সত্যি কথা বলো।"


ছেলের এই আকুতি ভরা কন্ঠ স্বর শুনে মায়ার শাশুড়ী ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো, 


"বাবা'রে আর কখনো উঠবে না, আমাদের মায়া। ম'রে গেছে মায়া, ম'রে গেছে।"


"মায়া! ওই বোকাফুল! সত্যিই ম'ই'রা গেছো তুমি! মায়া,এমনটা তো কথা ছিলো না। আমারে ভালোবাসা'র লোভ দেখাইয়া তুমি কেমনে এতো স্বার্থপর হইলা? ও মায়া! আমার কষ্ট হচ্ছে মায়া! উঠো মায়া! আমারে এতো বড় শাস্তি দিও না, খোদা।

ও খোদা! তুমি আমারেও মৃ'ত্যু দেও! খোদা! তারে ছাড়া আমি কেমনে থাকবো একলা ঘরে! আমার যে দ'ম বন্ধ হয়ে আসছে। খোদ!

তুমি যদি তারে নিয়াই যাইবা, তাইলে তুমি তারে আমার কইরা দিছিলা কেন? না!  না! তারে আমি কোথাও যাইতে দিবো না!"


বলতে বলতে লা শ টা বুকের মাঝে চেপে ধরে, রিহান চৌধুরী।ছেলেটার এমন ভালোবাসা দেখে হসপিটালে থাকা সবার চোখে জল। ইশ মেয়েটা কত লাকি! এতো ভালোবাসা দিয়েও আগলে রাখা গেলো না, মেয়েটাকে। মৃত্যুর কাছে মানুষ বড্ড অসহায়। এই মেয়েটাকে ভালোবেসে থমকে গেলো, নেতা রিহান চৌধুরী'র জীবন। এরপর আর সেও কখনো স্বাভাবিক হতে পারেনি। নেতা রিহান চৌধুরী আজ বড্ড উ'ম্ম'দ! স্ত্রী'র শো'কে, নেতা রিহান চৌধুরী এখন একজন মানসিক রোগী। তার দিন রাত পেড়োয়, বোকাফুল'র সাথে কল্পনায়। সে কখনো হাসে, কখনো কাঁদে। কখনো কখনো আকাশের দিকে তাকিয়ে  চিৎকার করে বলে,


"বোকাফুল! তুই বড্ড পা'ষা'ণ! তুই বড্ড স্বার্থপর! তবুও, তোকে আমি ভীষণ ভালোবাসি!"


গল্প:বোকাফুল


(সমাপ্ত) 


মন ছুঁয়ে যাওয়া নতুন নতুন গল্প পড়ুন।