গল্পঃহেথায়_সেথায়_সর্বত্রই_রিক্ত | অবহেলার কষ্টের গল্প

 অবহেলার ভালবাসার গল্প

অবহেলার ভালবাসার গল্প

---ডিভোর্সের ১৭দিন পর রাত সোয়া ৪'টার সময় আমার প্রাক্তন স্বামী ফোন করেছিল। তখন আমি ওরই ছবি বুকে জড়িয়ে ৭মাসের সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে কাঁদছিলাম।এতো রাতে হঠাৎ তার ফোন কল পেয়ে আমি চমকে উঠলাম। ফোনে তখনও সেই প্রিয় নামটাতেই তার নাম্বার সেভ করা ছিল।মন না চাইলেও ইতস্ততঃ করে কেনো যেন কল রিসিভ করলাম।সঙ্গে সঙ্গেই ওপাশ থেকে সে আর্ত কাতর স্বরে বলল,


--- আমি তোমাকে ডিভোর্স দিতে চাইনি অনিন্দিতা।গোপন ফন্দি ও মমতাশূন্য পরিস্থিতি আমাকে বাধ্য করেছে। আমার সন্তান ও তোমাকে নিয়ে খুব সুন্দর ভাবে আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম। শেষ শ্বাস অবধি যেতে চেয়েছিলাম।কিন্তু বিধাতা হয়তো এমনটা চায়নি।


ভাঙা গলায় বললাম,

--- এতো রাতে ফোন করে এসব তুমি কী বলছো ইমতিয়াজ? তোমার কোনো কথাই আমার বোধগম্য হচ্ছে না। তুমি আমাকে কেনো ফোন করেছো? কী বলতে চাইছো? আর কখনো আমাকে ফোন করবে না। তোমার সাথে সব সম্পর্কই আমার শেষ হয়ে গেছে। 


--- আমি জানি, তুমি এখনো আমাদের ডিভোর্সটা মানতে পারছো না। এমনকি এতো রাতে আমারই ছবি বুকে জড়িয়ে তুমি কাঁদছো।কিছু সত্য তোমাকে মেনে নিতে হবে আর কিছু সত্য তোমাকেই খুঁজে বের করতে হবে। আজ তোমাকে অনেক কিছুই বলার ছিল আমার।কিন্তু সে পর্যন্ত আয়ুষ্কাল আমার হাতে নেই। অলরেডি আমার শরীরে কাঁপুনি শুরু হয়ে গেছে অনিন্দিতা।আমার ভেতরটা ঝল'সে যাচ্ছে। শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিয়ো। তোমাকে দেওয়া কোনো কথা, প্রতিশ্রুতিই আমি রাখতে পারলাম না। যদি কাল শীতের সকালে তুমি শুনতে পাও, আমার লা'শ খাটিয়ায় উঠেছে। দয়াকরে তুমি কাফন জড়ানো লা'শটা দেখতে এখানে, কখনো এসো না। শেষ বেলা তোমাকে একটু না দেখার মানসিক আর্তি আমার রয়ে গেল।


তারপর ওপাশ থেকে আর কোনো আওয়াজ আসেনি। কলও কাটেনি। এভাবে আধাঘন্টা গেল। পরে আমিই ফোনটা কেটে দিই। সেদিন রাতে আমি আর চোখের পাতা বন্ধ করিনি। বাকি রাতটাও অশ্রুতে নয়ন ভিজিয়ে পার হয়েছিল আমার। পরেরদিন সকালে বাড়িতে পুলিশ আসে। তাদের কাছ থেকেই জানতে পারলাম, ইমতিয়াজ মা'রা গেছে। সকালে নিজের রুমেই নাকি ওর লা'শ পাওয়া গেছে। যা শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। বুকের ভেতর ছ্যাঁৎ করে উঠলো। চোখ থেকে পানি বের হয়ে গেল। মুখ চেপে কোনোরূপ কান্না আটকে রেখেছিলাম।


অতঃপর নিজেকে যথাসম্ভব নৈসর্গিক করে বললাম,

--- সে কী করে মা'রা গেছে? 


পুলিশ অফিসার প্লাবন সাথে সাথে জবাব দিলো,

--- দেখে তো মনে হলো বিষ খেয়েছে। পোস্ট মর্টেমের জন্য লা'শ পাঠানো হয়েছে। পোস্ট মর্টেম হওয়ার পর রিপোর্ট বের হলেই সব খুঁটিনাটি জানা যাবে। শেষ আপনার সাথেই ইমতিয়াজ ইসলামের কথা হয়। যদিওবা অত রাতে। তা ডিভোর্সের ১৭ দিন পর আপনাদের মাঝে ঠিক কী নিয়ে কথা হয়েছিল? তাছাড়া আরও বিভিন্ন বিষয় জানার জন্যই আমাদের এখানে আসা।


প্রত্যুত্তরে সব কিছু বললাম। এরপরও তারা আমায় বিভিন্ন ভাবে জেরা করে। নিঃসংকোচ ভাবে সব প্রশ্নের জবাব দিলাম। তারপর ওনার চলে যায়। সাথে সাথে আমি আমার রুমে চলে এসে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে বো'বা কান্নায় ভেঙে পড়ি। এরপর প্রায়ই একসপ্তাহ পর জানতে পারলাম, পোস্ট মর্টেমের পর ইমতিয়াজের লা'শ আজ তার বাড়িতে আনা হয়েছে। 


দুপুর ১২'টার সময় বাবাকে বললাম, 

--- জোহরের নামাজের পর ইমতিয়াজকে কবর দেওয়া হবে। আমি ওকে শেষবারের জন্য একবার দেখতে চাই। 


বাবা এতে নারাজ হলো। সঙ্গে সঙ্গে রাগান্বিত গলায় বলে উঠলো,

--- তুই ওখানে কিছুতেই যাবি না অনিন্দিতা। ওর সাথে তোর আর কোনো সম্পর্ক নেই। যা ছিল সব শেষ হয়ে গেছে। কোন অধিকারে যাবি তুই?


কিছু না বলে চুপচাপ নিজের রুমে চলে আসি। আলমারি থেকে কালো রঙের একটা বোরকা বের করলাম। অজান্তেই কয়েক ফোটা চোখ থেকে পানি বের গেল। বিবাহবার্ষিকীতে ইমতিয়াজের দেওয়া উপহার ছিল এটা। খুব পছন্দের বোরকা। অতঃপর কাজের মেয়েটাকে ডেকে বললাম, 


--- আমি বের হচ্ছি। আমার ছেলে (অমিত) এখন ঘুমাচ্ছে। আমি না ফেরা পর্যন্ত ওকে দেখে রেখো আর ঘুম ভেঙে গেলে সামলে নিয়ো। বিলম্ব করবো না। অতি শীঘ্র চলে আসবো।


বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে বাবা জিজ্ঞেস করেছিল, 

--- কোথায় যাচ্ছি। কিছু বলিনি। চুপচাপ বেরিয়ে আসছিলাম। কিছু আঁচ করতে পেরে বাবা আটকানোর চেষ্টা করে কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। রাস্তায় কোনো যানজট না থাকলে সর্বোচ্চ ৩০'মিনিট সময় লাগবে ইমতিয়াজদের বাড়ি যেতে। ঠিক ৩০'মিনিটই সময় লাগলো। একতলা বিশিষ্ট বাড়ি। ঢেরদিন পর এ বাড়িতে পা রাখলাম। শহরা অঞ্চলে এ বাড়িটা করার জন্য ইমতিয়াজকে কত যে কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। ওর জীবন সংগ্রামের কোনো কথাই আমার অজানা নয়। কতশত মানুষের ভিড়। থাকবেই তো।লা'শের ক্ষানিকটা দূরেই ছেলে হারানো মায়ের আর্তনাদ। যা আমার বুকের ভেতরের পীড়া, যাতনাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছিল। আমি বেশিক্ষণ সেখানে থাকিনি। থাকতেও পারিনি। শেষবার ওর ফ্যাকাসে যাওয়া মুখটা দেখেই চলে এসেছিলাম।


বাড়িতে আসা মাত্রই সবার ক্রোধ, আক্রোশের সম্মুখে পড়তে হয়।সবার মুখে একই প্রশ্ন, কাউকে কিছু না বলে আমি কোথায় গিয়েছিলাম। ভাবী-তো বলেই ফেলে, বেহায়া মেয়ে। লাজ শরমহীন। নিশ্চয় বোরকা পরে ও প্রাক্তন স্বামীর লা'শ দেখতে গেছিলো।


আমি কারো কোনোরূপ প্রশ্নের জবাব দেয়নি। সোজাসাপ্টা নিজের রুমে চলে আসি। কাজের মেয়েটার কোলে অমিত কাঁদছিল তখন। অমিতকে কোলে নিয়ে কাজের মেয়েটাকে যেতে বললাম। মায়ের কোলে আসতেই অমিতের কান্না মুহূর্তেই থেমে যায়। 


আমার তখনও সবকিছু স্বপ্নের মতো লাগছিল। মনে হচ্ছিল এখনো আমি গভীর ঘুমেই আছি। একটু পরেই আমার ঘুম ভেঙে যাবে আর আমি চোখ মেলে দেখবো, ইমতিয়াজের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছি। সে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে।


পারিবারিক ভাবেই আমাদের বিয়ে হয়। যদিও শুরুতে ইমতিয়াজের সাথে আমার ঠিক মতো মনোমালিন্য হচ্ছিল না। কিন্তু যবে থেকে আমি ওকে বুঝতে শিখি, উপলব্ধি করতে পারি তখন থেকেই ওর সবকিছুর মায়ায় পড়ে যাই আমি। ওকে আমি ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি। আমাদের একে অপরের প্রতি ভালোবাসা, প্রত্যয় এবং সংসার সবকিছুই খুব ভালো ভাবে চলছিল। যখন আমার কোল আলো করে আমাদের সন্তান পৃথিবীতে ভূমিষ্ট হলো, তার কিছুটা দিন পরই আমি ইমতিয়াজের মধ্যে অস্বাভাবিক পরিবর্তন লক্ষ্য করি। ওর আচার-আচরণ সবকিছুই পাল্টে যেতে থাকে।  শান্তশিষ্ট স্বভাবের ইমতিয়াজকে আমি দিনের দিন রাগান্বিত, খিটখিটে মেজাজের হতে দেখি। 


তারপর হঠাৎই একদিন হুট করে অফিস থেকে এসে, সে আমায় ডিভোর্সের কথা জানালো। ভেবেছিলাম মজা করে বলেছে তাই একদমই অবাক হয়নি কিন্তু আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেছিলাম তখন, যখন ইমতিয়াজ আমার গায়ে হাত তুলে। এতো বছরের সংসার জীবনে ইমতিয়াজ কখনো আমার গায়ে হাত উঠায়নি। সেদিনই প্রথম ছিল।


ডিভোর্স চলাকালীন আমি আমার বাবার বাড়িতেই ছিলাম। ডিভোর্সটা আটকানোর কতই না চেষ্টা করেছিলাম। সব চেষ্টাই বৃথা যায়। এমনকি ইমতিয়াজের মা-ও ওর বিপক্ষে ছিল। উনিও কখনো চাননি আমাদের ডিভোর্স হোক। ছেলেকে কত বুঝালেন, কত চেষ্টা করলেন তবুও কোনো লাভ হয়নি। আমি এখনো সঠিক কোনো কারণ খুঁজে পেলাম না ও- আমাকে কেনো ডিভোর্স দিলো। যতবার জিজ্ঞেস করেছি, কেনো ডিভোর্স দিচ্ছো, ততবারই কোনো জবাব পাইনি। অন্য কোনো মেয়ের সাথেও ওর কোনোরূপ সম্পর্ক ছিল না। পরিশেষে, আমার সাথে সে থাকতে চায়না, মানিয়ে নিতে পারছে না এবং আরও বিভিন্ন অজুহাত, অযুক্তিকর কথাবার্তা দাঁড় করিয়ে আমাদের ডিভোর্স হয়।


রেস্টুরেন্টের ডানদিকের জানালার পাশের টেবিলে বসে উপরোক্ত কথা গুলো বলেই এবার থামলো অনিন্দিতা। টেবিলের অপরপ্রান্তে লাচ্ছি খেতে ব্যস্ত এহসানুল সরকার।এতোক্ষণ যাবৎ এতো গুলো গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার পরেও এহসানুল সরকারকে স্বাভাবিক ভাবে লাচ্ছি খেতে দেখে অনিন্দিতা বেশ অবাক হলো। পরক্ষণেই আবার বলে উঠলো,


--- আপনি আমার বলা সব কথা শুনেছেন তো?


মৃদু স্বরে এহসানুল সরকার জবাব দিলো,


--- হ্যাঁ।

--- আপনাকে দেখে তো মনেই হচ্ছে না আমার, আপনি এতোক্ষণ যাবৎ আমার বলা সব কথাই মনযোগ সহকারে শুনেছেন।

--- প্রথমে সবাই এমনই মনে করে। আপনি কী আরও কিছু বলবেন?

--- হ্যাঁ।

--- বলুন?


--- পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট থেকে পুলিশ বলেছে, ইমতিয়াজের মৃত্যু বি'ষক্রিয়ায় হয়েছে। বি'ষ খেয়েছে তেরো ঘন্টা আগে মৃত্যু হয় শেষ রাতের দিকে। বিষটাই নাকি এমন। আমাদের দেশ সহ পাশের অনেক দেশেও সচরাচর পাওয়া যায় না। বিভিন্ন মানসিক চাপে ভুগছিল বিধায় ইমতিয়াজ বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল বলে তিনমাস পর কেসটা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু আমার বিশ্বাস ইমতিয়াজ আর যাইহোক আ'ত্মহত্যা করতে পারে না। তাছাড়া হুট করে ইমতিয়াজের পাল্টে যাওয়া, আমাদের ডিভোর্স, তারপর শেষ রাতে ইমতিয়াজের ফোন করা, এরপর অস্বাভাবিক মৃত্যু। এ সব কিছুর পিছনে নিশ্চয়ই কোনো বড় কারণ রয়েছে, আমার মনে হয়। আর কী সেই কারণ তা আপনাকে খুঁজে বের করতে হবে। 


জানেন, শান্তিতে ঘুমাতেও পারিনা আমি। শেষ ফোন কলে ইমতিয়াজের বলা সেই কথাগুলো শুধু আমার কানে ভাসে। রোজ রাতে ঘুম ভেঙে যায়। চিৎকার করেও কাঁদতে পারিনা। মুখ চেপে বোবাকান্না করতে হয়। আমার দূরের বান্ধবী শান্তা। অর্থাৎ আপনার চাচাতো ভাইয়ের স্ত্রী। ওর মাধ্যমেই আপনার সাথে আজ দেখা করার সুযোগ পেলাম। এর আগে আপনার নামই শুধু শুনেছি। আপনাকে কখনো দেখা হয়নি। আমি আশা করছি আমাকে আপনি সাহায্য করবেন।


--- ডিভোর্সের পরেও প্রাক্তন স্বামীর প্রতি এতো ভালোবাসা! প্রথম দেখলাম। আমি আপনাকে সাহায্য করবো। বিষয়টার শেষ পর্যন্ত ঘেঁটে দেখবো। তবে আমার কিছু শর্ত আছে। 


--- কী শর্ত? 


--- আপনি আমার সাথে দেখা করেছেন। আমার সাথে কথা বলেছেন।আমি আপনাকে সাহায্য করবো।বিষয়টা ঘেঁটে দেখবো বলেছি।এ সব যেন আর কেউ না জানে। কাউকে জানাবেন না। কোনো কিছু বলবেন না। আপনার পরিবার, আত্মীয়স্বজন, কাছের কেউ, কাউকে না।


--- নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। আমিও এমন কিছুই বলতে চেয়েছিলাম।


--- আপনি এখন যেতে পারেন। আর যাওয়ার সময় যদি এমন মনে হয় কেউ আপনার পিছু নিচ্ছে, পিছুপিছু আসছে বা কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে তাহলে  কিছু বলবেন না।পাত্তা দিবেন না।চুপচাপ চলে যাবেন। আজ শনিবার। ঠিক  সাত দিন পর শনিবার, একই টাইমে, একই রেস্টুরেন্টে, ডানদিকের এই একই টেবিলের একই সিটে বসে আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করবো।


আরকিছু বলল না অনিন্দিতা। উঠে দাঁড়ালো। আসি বলে চলে যেতে লাগলো। এহসানুল সরকার ওয়েটারকে ডেকে আরেকটা লাচ্ছি দিতে বললো। সঙ্গে সঙ্গে ওয়েটার লাচ্ছি দিয়ে গেলো। পূর্বের ন্যায়ে এহসানুল সরকার আবার লাচ্ছি খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তবে এবার তার মুখে গম্ভীর একটা ভাব দেখা গেল। 


বাড়িতে আসার পরপরই অনিন্দিতা আগে তার ছেলেকে কোলে নিয়ে আদর করতে লাগলো। কিছু সময় পর অনিন্দিতার রুমে তার মা-বাবা, ভাইয়া-ভাবি সবাই আসলো। সবাইকে একত্রে রুমে দেখে অনিন্দিতা একটু অবাক হলো। কর্কশ গলায় অনিন্দিতার ভাই বলে উঠলো, 


--- তুই দিনদিন এতো নিচে কী করে নামছিস অনিন্দিতা? তোর গয়না লাগতো, তোর ভাবীকে বলতি। নির্দ্বিধায় দিয়ে দিতো। চুরি করার কী দরকার ছিল? টাকার প্রয়োজন হয়েছিল, বাবাকে বা আমাকে বলতি, তোর ভাবীর গয়না বেচার কী দরকার ছিল?


আচমকা নিজের ভাইয়ের মুখ থেকে এমন কথা শোনা মাত্রই আঁতকে উঠলো অনিন্দিতা। অবাক আশ্চর্যের শেষ সীমানায় পৌঁছে অনিন্দিতা সাথে সাথে জবাব দিলো,


--- ছিঃ। এসব তুমি কি বলছো, ভাইয়া? আমি কেনো ভাবীর গয়না চুরি করতে যাবো? নিশ্চয়ই তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। 


--- মাথা খারাপ হয়নি। ঠিকই আছে। আমি কি করে বলবো কেনো তুই গয়না চুরি করতে গেছিস! কেনো এমন করেছিস সেটাই তো জানতে চাইছি।


--- কি প্রমাণ আছে? কেনো মিথ্যা বলছো ভাইয়া? কেনো মিথ্যা দোষারোপ দিচ্ছো? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। এসব হচ্ছেটা কি? আর বাবা-মা তোমরাই বা কিছু বলছো না কেনো?


--- তোর কী মনে হয়, প্রমাণ ছাড়া শুধু শুধু তোকে আমি একটা মিথ্যা অপবাদ দিয়ে দিবো? গতকাল থেকে তোর ভাবীর একটা গয়না পাওয়া যাচ্ছিল না। আজ তোর রুমে গয়না বিক্রি করার জুয়েলার্সের একটা কাগজ পাওয়া যায়। কিছুটা সন্দেহ বশে সেই জুয়েলার্সের দোকানে খোঁজ নিয়েই জানতে পারি, তুই তাদের কাছে একটা গয়না বিক্রি করেছিস আর সেই গয়নাটাই হলো তোর ভাবীর। বাবা-মা'ও কিছু বলবে না। কারণ সব প্রমাণই তোর বিপক্ষে। 


পাশ থেকে অনিন্দিতার ভাবী বলে উঠলো, 

--- তোমার বোনকে এটাও জিজ্ঞাসা করো, সেই টাকা দিয়ে কী কী করছে। আর কিছু দিন পরপর বাচ্চাকে কাজের মেয়েটার কাছে রেখে কই যায়। কার সাথে দেখা করতে যায়। যতবার জিজ্ঞাসা করা হয় ততবারই কোনো জবাব দেয়না। চুপ করে থাকে। এড়িয়ে যায়। আজ যেন ও- কোনো কিছু থেকে রেহাই না পায়।


অনিন্দিতা বলল, 

--- আমি জানিনা। কিচ্ছু জানিনা। আমি গয়না চুরি করিনি। মিথ্যা। সব মিথ্যা। 


অনিন্দিতার ভাই প্রত্যুত্তরে বলল,

--- দেখো বাবা-মা তোমাদের অদূরে মেয়ে। এখনো অস্বীকার করে যাচ্ছে। কোনো অনুশোচনা নেই। তোমরা আর চুপ থেকো না। তোমরা তো সবই জানো?


নিরব মনোভাব ভেঙে অনিন্দিতার বাবা অনিন্দিতাকে উদ্দেশ্য করে এবার বলে উঠলো,

--- কোলে যদি নানা ভাই না থাকতো, তাহলে এতোক্ষণে তোকে ঠাটিয়ে দু'টো চ*ড় দিতাম। যখন থেকে এ বাড়িতে তুই পা রেখেছিস, তখন থেকেই একটা না একটা অশান্তি লেগেই আছে।সবশেষে তুই যে এতোটাও নিচে নামতে পারিস তা আমি আসা করিনি। কিছু বলবো না। কিছু জিজ্ঞাসা করবো না। কেনো গয়না চুরি করেছিস জানতেও চাইবো না। সেই টাকা দিয়ে কী করেছিস তার কৈফিয়তও চাইবো না। শুধু একটা কথা বলবো, যত দ্রুত সম্ভব এ বাড়ি ছেড়ে তুই যেখানে খুশি সেখানে চলে যা। 


কথাগুলো বলেই অনিন্দিতার বাবা রেগে হনহন করে চলে গেল। অনিন্দিতাকে কিছু বলার সুযোগও দিলেন না তিনি। মা'কে কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলো না। অনিন্দিতার মা-ও অনিন্দিতার থেকে মুখ ঘুড়িয়ে চলে যায়। শেষে অনিন্দিতার ভাই-ভাবিও আর কিছু না বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে অনিন্দিতার দিকে তার ভাবী কেমন যেন এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায়। মাথায় হাত দিয়ে অনিন্দিতা বিছানায় বসে পড়ে। এদিকে অমিতও কান্না জুড়ে দিয়েছে। অমিতকে কোনোমতে সামলে নিলো অনিন্দিতা।


হুট করে কি থেকে কী হয়ে গেল কিছুই বুঝতে পারছে না অনিন্দিতা। অনিন্দিতার জীবনে আজ পর্যন্ত অস্বাভাবিক যা কিছু ঘটেছে সবকিছুই হুট করে। হুট করে কোনো কিছুই এখন পর্যন্ত অনিন্দিতা মেনে নিতে পারেনি।সে-তো এমন কিছুই করেনি তাহলে কি করে তার রুমে গয়না বিক্রি করার কাগজটা পাওয়া গেল? মাথা ঝিমঝিম করছে অনিন্দিতার। কিছুই ভেবে পাচ্ছে না সে।


পদে পদে একেক জনের একেক রকম কথা শুনে আজ চারদিন কেটে গেল অনিন্দিতার। রাত ২'টার দিকে অনিন্দিতার ফোন বেজে ওঠে। এহসানুল সরকার ফোন করেছে। সাথে সাথে ফোন রিসিভ করে অনিন্দিতা বললো, 


--- কী ব্যাপার! আপনি এতো রাতে কেনো ফোন করলেন? কিছু কী জানতে পেরেছেন?


তীক্ষ্ণ গলায় এহসানুল সরকার বললো,

--- আপনি আমার কাছে অনেক কিছুই লুকিয়েছেন। যেটা উচিত হয়নি। আপনার যে আগে বয়ফ্রেন্ড ছিল সেটা কেনো জানান নি? এমনকি বিয়ের পরেও আপনি ওর সাথে ৫বার দেখা করেছিলেন।


চমকে ওঠে অনিন্দিতা। আমতাআমতা করে কিছু বলতে যাবে তার আগেই এহসানুল সরকার আবার বলে উঠলো, 


--- আপনার সেই বয়ফ্রেন্ড কিছুক্ষণ আগে খু'ন হয়েছে। তার সারা ডায়েরি জুড়ে শুধু চারটা কথাই লেখা ছিল, অনিন্দিতা ঠক, অনিন্দিতা প্রতারক। অনিন্দিতা আমাকে ঠকাইছে। অনিন্দিতা আমার সাথে প্রতারণা করছে। তাছাড়া আপনি আরও একটা অনেক বড় ভুল করেছেন, আমাদের মধ্যকার কথাবার্তা পাঁচকান করে দিয়ে। যেটা আমি ঘুণাক্ষরেও চাইনি। এখন শুধু একের পর এক মৃ*ত্যু, লা*শ, নৃশংসতাই দেখতে পারবেন। 


কথাগুলো বলার পর সঙ্গে সঙ্গে ফোন কেটে দিলো এহসানুল সরকার। সাথে সাথে অনিন্দিতা বেশ কয়েকবার এহসানুল সরকারকে ফোন করেছিল কিন্তু রিসিভ করেনি। অনিন্দিতার কপাল ঘামছে। হাত-পা কাঁপছে। কিছু ভাবতে পারছে না। ভাবতেও চাইছে না। ৫'মিনিট পর এহসানুল সরকার নিজে থেকেই আবার অনিন্দিতাকে কল করে দ্রুত গলায় বললো,


--- আপনার বাবা কোথায় এখন? দেখুন তো উনি রুমে আছেন কি-না। ওনার প্রাণ সংশয়ে আছে। ওনাকে এলার্ট করেন। ওনার বেঁচে থাকাটা অনেক জরুরী। ফাস্ট!


উত্তেজিত হয়ে অনিন্দিতা বললো,


--- এসব আপনি কী বলছেন? আমি কিছু বুঝতে পারছি না।

--- এখন কিছু বলার বা বোঝানোর সময় নেই। আপনি শীঘ্রই যান।


অনিন্দিতা আর কিছু না বলে দ্রুত বাবার রুমে গেল। ওয়াশরুম, বেলকনি রুমের কোথাও বাবা নেই। মা'কে ডাক দিয়ে জানতে চাইলে, তিনিও কিছু বলতে পারলেন না। ইতিমধ্যে বাসার সবাই জেগে গেছে। বাসার ভেতর কোথা-ও বাবা নেই। বয়স্ক মানুষ। এতো রাতে বাবা কোথায় গেল? সবার মনে এখন একই প্রশ্ন। বাসার মেইন দরজা খোলা। বাইরে একবারও খোঁজা হয়নি। দেখা হয়নি। সবাই দ্রুত গতিতে বাইরে গেল। অনিন্দিতা চিৎকার করে উঠলো। বাসার বাইরের গেটের বাম পাশে বাবা মাটিতে পড়ে আছে। দৌড়ে গিয়ে বাবার শরীর স্পর্শ করলো অনিন্দিতা। মুহূর্তেই আঁতকে উঠলো সে। বাবার সারা শরীর ঠান্ডা হয়ে আছে। 


 

গল্পঃহেথায়_সেথায়_সর্বত্রই_রিক্ত_ (সেরু ভাই সিরিজ) 

সূচনা পর্ব [ ০১ ]

লেখাঃ মোঃ শাহরিয়ার


গল্পঃহেথায়_সেথায়_সর্বত্রই_রিক্ত_ (সেরু ভাই সিরিজ) 

পর্ব [ ০২ ]

লেখাঃ মোঃ শাহরিয়ার


বাসার বাইরের গেটের বাম পাশে বাবা মাটিতে পড়ে আছে। দৌড়ে গিয়ে বাবার শরীর স্পর্শ করলো অনিন্দিতা। মুহূর্তেই আঁতকে উঠলো সে। বাবার সারা শরীর ঠান্ডা হয়ে আছে। নির্বাক হয়ে বসে পড়লো অনিন্দিতা। মুখের ভাষা যেন হারিয়ে যাচ্ছে তার। কিছুই বলছে না। অনিন্দিতার পরে এবার তার ভাই বাবার শরীর স্পর্শ করলো। সাথে সাথে সেও চমকে উঠলো। নিশ্বাস চলছে কি-না চেক করতেই অনিন্দিতার ভাইয়ের যেন সারা শরীর শিউরে ওঠে। 


পাশ থেকে অনিন্দিতার মা উত্তেজিত হয়ে বললো,

--- তোর বাবার কী হয়ছে রে! সারা শরীর এমন ঠান্ডা হয়ে আছে কেনো? জলদিই তোর বাবাকে তোল, হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। এখন এতো কিছু ভাবার সময় নাই। তোরা ভাই-বোন এমন চুপ হয়ে আছিস কেনো?


কাঁপা কাঁপা স্বরে অনিন্দিতার ভাই বলে উঠলো,

---- তার কোনো প্রয়োজন নেই। বাবা আর নেই। বাবার শ্বাস চলছে না। সারা শরীর এমনি এমনি ঠান্ডা হয়ে ওঠেনি।


--- কি বাজে কথা বলছিস! চ*ড় খাবি কিন্তু। 


অনিন্দিতার ভাই এবার চোখে জল এনে বললো,

--- না মা, বাজে কথা বলছি না। বাবা আর সত্যিই নেই। 


সঙ্গে সঙ্গে অনিন্দিতার ভাইয়ের গালে ঠাশ করে একটা চ*ড় দিয়ে অনিন্দিতার মা বললেন,

--- তুই কী ডাক্তার হইছিস, যে বলে দিচ্ছিস তোর বাবা আর বেঁচে নেই?


অনিন্দিতার মা আর কিছু বলতে পারলো না। মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি সেন্সলেস হয়ে যান। সবাই একত্রে ধরাধরি করে অনিন্দিতার মা'কে রুমে নিয়ে আসে। অনিন্দিতার ভাবীকে সেখানে রেখে তারা দু'জন আবার বাসার বাইরে বাবার লাশের পাশে এসে দাঁড়ালো। অনিন্দিতার ভাই পুলিশকে ফোন করে দ্রুত আসতে বলেছে। থানা অতটাও দূরে নয়। আসতে বেশ একটা সময় লাগবে না বোধ হয়।


অনিন্দিতার মনে এই মুহূর্তে আতঙ্ক বিরাজ করছে। বাবার লাশের পাশে মুখ চেপে কাঁদছে সে। এবারের হুট করে ঘটা বিষয়টাও সে আরও মানতে পারছে না। কোথা থেকে কী হলো, কি হচ্ছে, পরবর্তীতে কী হবে কোনোকিছুই বুঝতে পারছে না অনিন্দিতা। আচমকা অনিন্দিতার ভাই বলে উঠলো, 


--- আমার মাথাতে কিছু ঢুকছে না। বাবা এতো রাতে বাসার বাইরে কি করছে? কেনো এলো? নিশ্চয়ই এটা খু'ন। বাবাকে কেউ খু'ন করেছে। কিন্তু কেনো খু'ন করা হলো! তারা কে? এর পিছনে কারা জড়িত বা কে আছে? যাই ভাবিনা কেনো, ফলাফল শূন্যই। তুই-ই এতো রাতে আমাদের সবার ঘুম ভাঙিয়েছিস। বাবা ঘরে নেই তোর মাধ্যমেই জানা। আচ্ছা অনিন্দিতা, তুই কি আগে থেকে কিছু জানতিস? আমার-তো এখন সব বিষয়েই তোর ওপর সন্দেহ হয়। বাবার মৃত্যুর পেছনে তোর কোনো হাত নেই তো?


শেষ পর্যন্ত নিজের ভাইয়ের মুখে এমন কথাও যে অনিন্দিতাকে শুনতে হবে তা সে কস্মিনকালেও আশা করেনি। ছলছল চোখে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে অনিন্দিতা বললো,


--- আমি বাবার খু'ন....ছিঃ!আমি মাথায়ও আনতে পারছি না।তুমি এসব কি শুরু করছো ভাইয়া? চারদিন আগে গয়না নিয়ে একটা মিথ্যে দোষারোপ আমার উপর চাপিয়ে দিলে আর আজ বাবার মৃত্যুর দোষও! কেনো এমন করছো?


প্রত্যুত্তরের আগেই গেটের বাইরে পুলিশের গাড়ি এসে ব্রেক করলো।কিছু বলতে গিয়েও কেনো যেন বললো না অনিন্দিতার ভাই। গাড়ি থেকে দ্রুত কয়েকজন পুলিশ নেমে এলো। সাথে থানার ওসিও আছে। ইশারায় বাবার লা'শ দেখিয়ে দিলো অনিন্দিতার ভাই। বাবার লা'শ যেমন ছিল, তমনই আছে। কোনো নড়াচড়া করা হয়নি। যদি কোনো প্রমাণ নষ্ট হয়ে যায় তাই। কয়েকজন আশেপাশে কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছে আর ক'জন লা'শটাকে ভালো করে দেখছেন। আশেপাশে তেমন কিছু পাওয়া গেল না। তবে লা'শের নিচে একটা খাম পাওয়া গেল। কালো রঙের খাম। যেটা লা'শের নিচে চাপা পড়ে ছিল। খামটা এখনো খোলা হয়নি।ভেতরে কি আছে সেটাও কারো জানা নেই। খাম হাতে নিয়ে থানার ওসি অনিন্দিতার ভাইকে জিজ্ঞাসা করলো,


--- গলায় দাগ! শরীরের আর কোথাও কোনোরূপ চিহ্ন নেই। মনে তো হচ্ছে শ্বাসরুদ্ধ ভাবে খু'ন করা হয়েছে। তবে এতো রাতে আপনার বাবা এখানে কী করছিলেন? কিছু কী জানেন?


--- আমি ও আমার স্ত্রী ঘুমাচ্ছিলাম। এতো রাতে মা ও বোনের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে আমাদের দু'জনেরই ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো। পরে জানতে পারলাম, বাবা বাসায় নেই। সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেও বাবাকে কোথাও পাওয়া গেল না। এদিকে বাসার মেইন দরজাটাও খোলা ছিল। বাইরে একবারও খোঁজা হয়নি। বাইরে আসা মাত্রই গেটের পাশে বাবাকে সবাই এভাবে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখি।


--- কাউকে সন্দেহ হয়? 

--- হ্যাঁ হয়। অবশ্যই সেটা আমার বোনকে। আমি আমার বোন অনিন্দিতাকে সন্দেহ করি। ওকে আপনারা নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেন। 


ভাইয়ের মুখে এমন কথা শুনে অনিন্দিতার চোখ দু'টো বড়বড় হয়ে গেল।কিছু বলতে যাবেই মাত্র তার আগেই কেউ একজন ভেতরে প্রবেশ করতে করতে গম্ভীর গলায় বলে উঠলো, 


--- জিজ্ঞাসাবাদ তো আপনাকে করা উচিত।


গলার স্বরটা এহসানুল সরকারের। এহসানুল সরকারকে দেখে অনিন্দিতা একটু সংকোচ মুক্ত হলো।এই মুহূর্তে বাহির থেকে অপরিচিত কারো উপস্থিতি দেখে থানার ওসি নিজেই আগে প্রশ্ন করে বসলেন।


- কে আপনি? 


একটা কার্ড বের করে দেখানোর পর এহসানুল সরকার বললেন,

--- আমি এহসানুল। এহসানুল সরকার। গোয়েন্দা শাখার একজন পুলিশ অফিসার। চোখে না দেখলেও নাম বোধ হয় শুনেছেন।


অনেকটা অবাক হয়ে থানার ওসি গলার কন্ঠ স্বর নরম করে বললো,

--- আপনি! শুনবো না কেনো, অবশ্যই আপনার নাম শুনেছি আমি। কিন্তু আপনি এমুহূর্তে এখানে কী করছেন?


--- এতোকিছু বলতে চাইছি না। অনিন্দিতার বাবার প্রাণ সংশয় রয়েছে। সেটা আমিই এতো রাতে ফোন করে ওকে জানিয়েছি। তা উনি কি বেঁচে আছেন?


--- না।

--- লা'শের আশেপাশে কোনো কিছু পাওয়া গেছে?


হাতে থাকা কালো রঙের খামটা এগিয়ে দিয়ে থানার ওসি বললো,


--- এই খাম ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায়নি। 


দ্রুতই ওসির হাত থেকে এহসানুল সরকার খামটা নিলো। পূর্বপরিচিত খাম। খামটা খুলেই তিনি একটা চিঠি বের করলেন। যে চিঠিতে লেখা ছিলো,


--- পাপের পরিমাণ সর্বোচ্চ সীমানায় পৌঁছে গিয়েছিল। জীবনের শেষ পাপটা আজ করার কথা ছিল। যারপর সব ছেড়ে-ছুড়ে মহান হতে চেয়েছিলো কিন্তু তার আগেই ওপরে তার সব পাপের হিসেব দিতে চলে গেল।


চিঠিটা সবার একটু শোনার মতো করেই পড়ে ছিলেন এহসানুল সরকার। যার পরপরই খামসহ চিঠিটা মুষ্টিবদ্ধ করে ছুড়ে ফেলে দিয়ে তিনি বললেন,


--- এই চিঠি দিয়ে কিছু হবে না। কিছু পাওয়াও যাবে না। 


আতঙ্কিত গলায় থানার ওসি বললো,

--- এটা কি সেই সেরু ভাইয়ের খাম!


এহসানুল সরকার গম্ভীর গলায় জবাব দিলো,

- হ্যাঁ। আপনি লা'শটাকে মর্গে পাঠানোর ব্যবস্থা করুন। এই খু'নের পেছনে শুধু একজনেরই হাত আছে, সেটা হলো সেরু ভাই।


এতোক্ষণ যাবৎ নিশ্চুপ থাকলেও এবার চুপ থাকলো না অনিন্দিতা। চোখের জল মুছে, অসহায় দৃষ্টিতে এহসানুল সরকারের দিকে তাকিয়ে বললো,


--- সেরু ভাই কে? সে আমার বাবাকে কেনো খু'ন করলো? আমার বাবার কী এমন দোষ ছিল? এসব কি! একের পর এক আমি আর কিছু নিতে পারছি না।


সাথে সাথে অনিন্দিতার ভাইও এহসানুল সরকারের উদ্দেশ্য বলে উঠলো, 

--- আমিও জানতে চাইছি।


খানিকটা মুচকি হেসেই অনিন্দিতার ভাইয়ের কথার জবাবে এহসানুল সরকার বললো,


--- কেনো আপনি কী কিছুই জানেন না? এতো সাধু সাজছেন কেনো? আজ তো আপনারও, আপনার বাবাকে খুন করার কথা! কত সূক্ষ্ম প্লানিং করে রাখা।আপনার কথাতেই তো আপনার বাবা এতো রাতে বাসার বাইরে বের হয়েছিল। আপনার তো খুশি হওয়া উচিত আপনার কাজটা অন্য কেউ করে দিয়েছে। মাঝখানে আমি পড়ে গেলাম, অপ্রীতিকর অবস্থায়। আপনার বাবা তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর একমাত্র ছেলে ইমন অর্থাৎ অনিন্দিতার এক্স বয়ফ্রেন্ডকে কেনো খু'ন করালো সেটা ওনার নিজের মুখ থেকে জানা হলো না।


অনিন্দিতার ভাই চমকে উঠলো। মুখে আর কোনো কথা ফুটছে না। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পা দুটো তার একটু একটু কাঁপছে। এতো কিছু হবে মোটেও আশা করেনি সে। হতভম্ব হয়ে অনিন্দিতা এহসানুল সরকারকে বললো,


--- আপনি ভুল বলছেন। আমি কিছু বিশ্বাস করতে পারছি না। আমার মাথা চক্কর দিয়ে উঠছে। আমি জাস্ট আর কিছু নিতে পারছি না।আমার বাবাকে সেরু ভাই নামক লোকটা কেনো খু'ন করলো সেটাই তো এখন পর্যন্ত জানতে পারলাম না। এরপর আপনি বলছেন, ভাইয়ারও আজ বাবাকে খু'ন করার কথা ছিল কিন্তু কেনো? আর সবশেষে বললেন, ইমনের মৃত্যুর পিছনেও আমার বাবা জড়িত! কি এসব! কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।


এহসানুল সরকার প্রত্যুত্তরে বললো,


--- সেরু ভাই হলো একজন খুনি।জেল থেকে পালিয়ে যাওয়া একজন আসামি। যার গল্প শুরু হয় প্রায়ই দু'বছর আগে। নিখুঁত ভাবে খু*ন, কালো রঙের খাম দিয়ে কাউকে সতর্ক করা, কারো খু*ন হওয়ার কারণ লেখা, সুন্দর হ্যান্ড রাইটিং, বুদ্ধি, বিচক্ষণতা সবকিছুই দুর্দান্ত। এমনকি ওর ফাঁসির রায়ও বের হয়ে গেছিলো। ফাঁসির দিন আমি ওখানে উপস্থিত ছিলাম না। সেটাই আমার জীবনে এই পর্যন্ত করা সবচেয়ে বড় একটা ভুল। ওই দিন ওর ফাঁসিটা হয়নি। সবকিছু যেন নাটকীয় ছিল। আগে থেকে করা সাজানো-গোছানো পূর্বপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র, মহাচক্রান্ত ছিল। সে অনেক কাহিনি। আমার আগের কেসটাতেও ও আচমকা এসে এভাবেই হস্তক্ষেপ করেছিল। দেখা পেয়েছিলাম প্রায় দু'বছর পর। শেষে দিনাজপুর থেকে গ্রেফতারও হয়েছিল কিন্তু সেই পূর্বের ন্যায়েই যেন জেল থেকে বের হয়ে যায়। আজ পর্যন্ত ওর হাতে খু*ন হওয়া কেউই নিরপরাধ ছিল না। তাদের প্রত্যেকেই কোনো না কোনো অন্যায়, অনাচার, অপরাধ করেছিল বা সেই সবের সাথে যুক্ত ছিল। ও কখন কোথায় কিভাবে কার সাথে জড়িয়ে পরবে সেটা কেউ জানে না। সে নিজেও বোধ হয় জানে না। আপনার বাবার কিছু অবৈধ ব্যবসা আছে। যেই ব্যবসা শুরু করেছিলেন একজনের প্রাণ কেড়ে। শেষও একজনের প্রাণ কেড়েই করতে চাইছিলেন। কিন্তু হলো না। তাছাড়া বিভিন্ন খারাপ চক্রের সাথে জড়িত তো আছেনই।


অনিন্দিতা বললো,


--- আমি কিছু মানতে পারছি না। সহ্যও করতে পারছি না। আমার বাবা কিসের অবৈধ ব্যবসা করতো? সেই ব্যবস্যা কাকে খুন করে শুরু করেছিল আর কাকেই বা খুন করে শেষ করতে চাইছিল?


--- কিছু সত্য মেনে নিতে হবে আর কিছু জিনিস না চাইলেও সহ্য করতে হবে। আপনার বাবার অবৈধ ব্যবসার কোনো অভাব নেই। তবে উনি কাকে খু*ন করে শুরু করেছিল আর কাকেই বা খু*ন করে শেষ করতে চেয়েছিল সেটা আমার অজানা। তাছাড়া আপনার বাবা কেনো আপনার এক্স বয়ফ্রেন্ড ইমনকে খু*ন করিয়েছে সেটাও আমার অজনা। তবে আরেকটা কথা জেনে নিতে পারেন, আজ থেকে অনেক বছর আগে আপনার মামার গুম হওয়ার বিষয়ে। গুম হওয়ার ৮দিন পর তার লাশ পাওয়া যায়। তাকে খু*ন করা হয়। সেটাতো জানেনই। কিন্তু সেই খু*নের পিছনে কে আছে তা আজও আপনারা কেউ জানেন না। আপনার মামার খু*ন হওয়ার একটাই কারণ ছিল, ওনার দোষ ছিল, উনি আপনার বাবাকে পরনারীর সাথে অন্তরঙ্গ মুহূর্তে দেখে ফেলে ছিলেন। আশা করছি বুঝতে পারছেন, আপনার বাবা এতোটাও ভালো মানুষ ছিলেন না।


অনিন্দিতা স্তব্ধ হয়ে গেল। কিছু বলার মতো মুখে কোনো শব্দই তৈরি হচ্ছে না এখন। তবুও আমতা-আমতা করে কোনো মতে বলে ফেললো,

--- আর ভাইয়া কেনো তাহলে বাবাকে খু'ন করতে চাইলো?


--- জানিনা।এটা সহ আরও অনেক বিষয়ই এখনো ক্লিয়ার হয়নি।তবে শীঘ্রই সবকিছু ঝাপসা থেকে পরিষ্কার হবে। আপনার ভাই আর ভাবীকে জিজ্ঞাসা করলেই সব জানা যাবে। আপনার ভাইতো এখন মুখে কুলু এঁটেছে। চুপ করে আছে। কিছুই বলছে না। অবশ্য এখন আর কিছু বলবেনও না বোধ হয়। ওসি সাহেব একে গাড়িতে তুলুন । সাথে ওনার স্ত্রী'কেও থানায় নিয়ে গিয়ে যেমনই হোক কথা বের করুন।


ঠিক সেই মুহূর্তে অনিন্দিতার ভাবী বাসার ভেতর থেকে বাইরে আসতে আসতে বললেন,

--- গাড়িতে তুলুন মানে? আমরা কেনো থানায় যাবো?


এহসানুল সরকার গম্ভীর ভাবে জবাব দিলো, 

--- সেটা থানায় গেলেই বুঝবেন৷ আপনাদেরকে থানায় কেনো নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেটাও আপনারা ভালোই জানেন। এতো অভিনয়ের কোনো দরকার নেই। দুপুর ১২টা পর্যন্ত আপনাদের স্বামী-স্ত্রীকে কোনো রকম টর্চার করা হবেনা। সে পর্যন্ত সময় দেওয়া হলো, সবকিছু স্বীকার করে নেওয়ার।


কথাগুলো বলার পরপরই থামলো এহসানুল সরকার। একটু নিরব ভূমিকা পালন করে কি যেন ভাবতে লাগলেন তিনি।অনিন্দিতার ভাবীকে আর কিছু বলতে দিলো না কনস্টেবল। ওসির নির্দেশে তাদের উভয়কেই গাড়িতে তোলা হলো। যার একটু পরই অনিন্দিতার বাবার লা'শ মর্গে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। এহসানুল সরকার এখনো নিরব। নিরব হয়ে কি ভাবছে কে জানে। অনিন্দিতা তো কথাবলারই উৎস খুঁজে পাচ্ছে না। কোনোকিছুর হিসেবও মিলাতে পারছে না। অতঃপর এহসানুল সরকার বলে উঠলো, 


--- আচ্ছা, এতো কিছু হয়ে গেল আপনার মা'কে তো দেখতে পেলাম না। আমার তো খেয়ালই ছিল না। 


অনিন্দিতা সাথে সাথে জবাব দিলো, 

--- মা সেন্সলেস হয়ে গেছিল। ধরাধরি করে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।


এহসানুল সরকার আর কিছু না বলে কাকে যেন কল করে ৫'মিনিট কথা বলে। তারপর অনিন্দিতাকে উদ্দেশ্য করে আবার বললো,


--- রাত ৪টা বেজে ৮মিনিট। সকাল হতেই বা আর কতক্ষণ। আমি দুপুর ১২টার পরে আপনাদের বাসায় আসবো। বাকি সব কথা তখন হবে। আপনি নিজেকে একটু শান্ত করে এখন বাসার ভেতর চলে যান। আপনার মায়ের কাছে যান। তাছাড়া আপনার ছেলেও তো রুমে একা!


অনিন্দিতা আর কিছু বলল না। তার কিছু বলতেও ইচ্ছে করছে না। চোখের জল মুছে বাসার ভেতরে চলে গেল। এহসানুল সরকারও, সকল সকাল থানায় আসবে ওসিকে কথাটা বলেই তাড়াহুড়ো করে নিজ গাড়ি করে চলে গেল।


দুপুর ২'টা বাজতে আর দু'মিনিট বাকি। 

এহসানুল সরকার মাত্রই অনিন্দিতাদের বাড়ি এসে পৌঁছিল। অনিন্দিতার মায়ের করুণ অবস্থা। অনিন্দিতার থেকে সবকিছু শুনেছেন তিনি। কোনো কিছু মেনে নিতে পারছেন না। মানতে কষ্ট হচ্ছে। যে কষ্ট অনেক তীব্র। এহসানুল সরকার সান্ত্বনা প্রকাশ করে অনিন্দিতার মা'কে উদ্দেশ্য করে বলে,


--- আপনার ছেলে ও তার স্ত্রী সবকিছু স্বীকার করে নিয়েছে। তারা জানিয়েছে, সম্পত্তির লোভে এমন কিছু করার চিন্তাভাবনা করেছিল। অনিন্দিতাকে তার অংশ থেকে বঞ্চিত করাই তাদের মূল লক্ষ ছিল। তাই প্রথমে গয়না চুরি ও বিক্রি করার মিথ্যা অভিযোগ লাগিয়ে অনিন্দিতাকে সবার সামনে চোর ও ছোট করার চেষ্টা করলো। তারপর বিভিন্ন ভাবে বাবার কান ভাঙাতে লাগলো কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হচ্ছিল না দেখে শেষ-মেষ কিছুটা স্ত্রীর প্ররোচনায় নিজ বাবাকে হ'ত্যার পরিকল্পনা করে। কোনোমতে ওনাকে বাসার বাইরে নিয়ে আসে। এরপর প্লান অনুযায়ী ওনাকে বাসার সামনে থেকে তিন জনের একটা গ্রুপের কিডন্যাপ করার কথা ছিল। তারপর ভয়ভীতি দেখিয়ে সবকিছু লিখে নেওয়ার পর খু'ন। 


এখন আসছি মেইন পয়েন্টে, 

অনিন্দিতার বাবা তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর ছেলে ইমন অর্থাৎ অনিন্দিতার এক্স বয়ফ্রেন্ডকে খু*ন করার জন্য যাদেরকে কন্ট্রাক্ট দিয়েছিল, তাদেরকেই অনিন্দিতার ভাইও নিজের বাবাকে কিডন্যাপ করার পর সম্পত্তির একটা কাগজে সাইন করিয়ে খু*ন করার কন্ট্রাক্ট করেছিলো। 


কুখ্যাত কন্ট্রাক্ট কিলার। মাত্র তিন জনের একটা গ্রুপ। এমন কোনো কাজ নেই যে তারা করে না। তাদের সাথে দেখা করার কোনো সুযোগ নেই। একে অপরের মুখোমুখির তো প্রশ্নই আসে না। এক কথায় তারাও আপনাকে কখনো দেখবে না, দেখতে চাইবেও না, আপনিও তাদের কখনো দেখতে পারবেন না। এমনই ভাবে তাদের কাজকর্ম চলে আসছিল। যেহেতু দু'টো কন্ট্রাক্ট একই দিনে ছিল। তাই একই দিনেই তারা দু'টো কাজ একসাথে শেষ করতে চেয়েছিল। ইমনকে খু*ন করার পরই অনিন্দিতার বাবাকে কিডন্যাপ করার কথাছিল তাদের। কিন্তু দূরভাগ্যবশত তারা আমার কবলে পরে যায়। নিজ বাড়িতেই ইমনকে খু*ন করার পর চলে যাওয়ার সময় ধরা পড়ে। অনিন্দিতার বয়ফ্রেন্ড আছে জেনে অতো রাতেই আমি ইমনদের বাড়ি গিয়েছিলাম কিছু জিজ্ঞাসা করার জন্যে। অনিন্দিতা যদি আগে থেকে আমাকে জানাতো তার আগে একজন বয়ফ্রেন্ড ছিল। তাহলে আমাকে নির্ঘুমে রাত-বিরেতে এতোটাও ছুটাছুটিও বোধ হয় করতে হতো না। অনেক আগেই অনেক কিছু জেনে যেতাম।


গতকাল রাত ২টার সময় অনিন্দিতাকে ফোন করে ইমনের ব্যাপারে বেশ কিছু কথা বলার পর সাথে সাথে কল কেটে দিয়েছিলাম। সবকিছুর পরেও কেনো যেন আমি সংকোচ মুক্ত না হতে পেরে ৫মিনিট পর আবার কল করে অনিন্দিতাকে বলেছিলাম, তার বাবার প্রাণ সংশয়ে আছে। দু'জনের মধ্যে একজন অন্তত বেঁচে থাকলে, না জানা অনেক প্রশ্নের উত্তর পেতাম। অনেক রহস্যের সমাধান পেতাম।


এতক্ষণ যাবৎ চুপচাপ এহসানুল সরকারের কথাগুলো শুনছিল অনিন্দিতা ও তার মা। 

অনিন্দিতা বললো,


--- আমি ওর মতো একজন বেইমান, প্রতারকের কথা আপনাকে জানাতে চাইনি। তাই বারবার বলতে চেয়েও সেদিন বলতে পারিনি। ও একজন ঠক। ভালোবাসার নামে আমাকে ঠকিয়েছে।


--- ইমনের সারা ডায়েরি জুড়েও এমনই কিছু লেখা ছিল। লেখাটা তার নিজের হাতের লেখাই। কে কাকে ঠকিয়েছে সেটা আমি এখন জানি না। জানতেও তেমন একটা সময় লাগবে না। আমি আপনাকে সেদিন রেস্টুরেন্টে বারবার বলেছিলাম, আমাদের মধ্যকার কথাবার্তা যেন আর কেউ না জানে কিন্তু আমি শিওর আপনিই সেগুলো পাঁচকান করেছেন।


--- আমি শুধু আমার পরিবারের সবাইকে জানিয়ে ছিলাম। সবাই অনেক বাজে কথা, কটুকথা শোনাচ্ছিল তাই সহ্য করতে না পেরে রাগের বশে বলে দিয়েছিলাম।


--- ভুল করেছেন। আপনার পরিবার থেকেই সেটা আরও পাঁচকান হয়েছে। তাৎক্ষণিক তার কান অবধিও চলে যায়। যেটা আমি ঘুণাক্ষরেও চাইনি। জানিনা সেরু ভাই এরপর কোথায় কখন কী কী করবে। মাসের পর মাস তারপর বছর ওর পিছে হায়নার মতো পড়ে আছি। ওকে গ্রেফতার করার আরও একটা সুযোগ পাওয়া গেল। এখন আসছি ইমতিয়াজের ব্যাপারটায়। ইমতিয়াজের কেসটা তিন মাস পর এমনি এমনি বন্ধ হয়ে যায়নি। যথেষ্ট টাকা খাইয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যার পিছনে আছে আপনার এক্স বয়ফ্রেন্ড ইমন। তাছাড়া ইমতিয়াজ মা*রা যাওয়ার ১৩ঘন্টা আগে নিজের মায়ের হাতে বানানো ঠান্ডা শরবত খেয়েছিল। শরবতেই ওই বি'ষটা মেশানো ছিল।


এহসানুল সরকারকে আর কিছু বলতে না দিয়ে অনিন্দিতা সঙ্গে সঙ্গে বললো,


--- তারমানে ইমতিয়াজের মা-ই ইমতিয়াজকে.......!

--- না।

--- তাহলে?


--- আপনার বাবার অবৈধ কিছু ব্যবসার মধ্যে একটা হলো, ফার্মেসি। যতসব অবৈধ ওষুধের কারসাজি। সেই ফার্মেসিতেই ইমতিয়াজের মৃত্যু যে বিষের জন্য হয়েছে তার একটা সিসি পাওয়া গেছে।


--- তারমানে আপনি বলতে চাইছেন ইমতিয়াজের মৃত্যুর পিছনে আমার বাবা আছে?


--- এখনো সঠিক জানিনা। তবে এটা শিওর ভাবে বলছি, আপনার আর ইমতিয়াজের ডিভোর্সই হয়নি। আপনারা আইন অনুযায়ী এখনো স্বামী-স্ত্রী।

গল্পঃ হেথায়_সেথায়_সর্বত্রই_রিক্ত_ (সেরু ভাই সিরিজ) 

পর্ব [ ০৩ ] সমাপ্ত

লেখাঃ মোঃ শাহরিয়ার


- এখনো সঠিক জানিনা। তবে এটা আমি শিওর ভাবে বলছি, আপনার আর ইমতিয়াজের ডিভোর্সই হয়নি। আপনারা আইন অনুযায়ী এখনো স্বামী-স্ত্রী।


চমকে উঠলো অনিন্দিতা। সঙ্গে সঙ্গে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। এমন কিছু শোনার জন্য একদমই অপ্রস্তুত ছিল সে। বাক্যহীন হয়ে জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে এহসানুল সরকারের দিকে তাকিয়ে আছে অনিন্দিতা।পাশ থেকে অনিন্দিতার মা ভেঙে যাওয়া গলায় বলে উঠলো,


- এটা কী করে সম্ভব! আমাদের সবার সামনেই সাইন হলো, ডিভোর্স হলো, সব কিছু। 


এহসানুল সরকার গলায় গম্ভীরতা এনে বললো,

- ডিভোর্স পেপারটাই যদি আসল না হয়ে সবকিছু আগে থেকে সুন্দর ভাবে পূর্বপরিকল্পনা করা থাকে তাহলে ডিভোর্সটা হয় কী করে?


অনিন্দিতা প্রতুত্তরে বললো,

- প্লিজ সবকিছু বুঝিয়ে বলুন। সত্যি বলছি, আমার মাথায় আর কিছু ঢুকতে চাইছে না। একের পর এক ট্র্যাজেডি মেনে নিতে দুষ্কর হয়ে উঠছে।


এহসানুল সরকার বললো, 

- চেয়ারম্যান সহ আরও অনেকেই এর সাথে জড়িত। ডিভোর্সের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত, সমস্ত কাগজ, সবকিছু মিথ্যা। পরিকল্পিত সুন্দর একটা প্লানিং ছিল। আর এই প্লানিং স্বয়ং ইমতিয়াজই করেছিল।


অনিন্দিতা আবারও চমকে উঠে বললো,

- কি বলছেন এসব! কিন্তু কেনো? কিসের জন্য এই প্লানিং? এসব করার কারণটা ঠিক কী?


- যেটুকু জেনেছি সেটুকুই আপাতত জানালাম। এর বেশি কিছু না। এখন আমাকে ইমনের ব্যাপারে কিছু কথা বলুন, ইমন আপনাকে কিভাবে ঠকালো? ওর সাথে আপনার রিলেশন কেনো ভাঙলো?


অনিন্দিতা বললো,

- ওর নাম শুনলেও আমার সারা গা ঘিনঘিন করে ওঠে।ইমনকে আমি ঘৃণা করি। অনেক ঘৃণা করি। আমার ভালোবাসা নিয়ে খেলেছে, আমার আবেগ, অনুভূতি সবকিছু নিয়ে খেলা করেছে। আমার সাথে রিলেশন চলাকালীনই ইমনের আরও একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিল। যাকে ইমন গোপনে বিয়ে করে। তার ওপর মেয়েটা ছিল প্রেগন্যান্ট।মেয়েটা প্রেগন্যান্ট হওয়ার পরেই ইমন ওকে বিয়ে করেছিল। এটা নিয়ে পরে অনেক ঝামেলাও হয়। এই সূত্র ধরেই ইমনের বাবার সাথে আমার বাবার বন্ধুত্বটাও নষ্ট হয়ে যায়। 


এহসানুল সরকার বললো,

- আপনার ভাই-ভাবীও এমনই কিছু বলেছিল। তারপরও আপনার নিজের মুখ থেকে একবার জানতে ইচ্ছা করলো। তাই জিজ্ঞাসা করা।


অনিন্দিতার মা এতোক্ষণ যেন নিরব ভূমিকা পালন করছিলেন। চুপচাপ কপালে হাত দিয়ে কথাগুলো শুনছিলেন। নিরব মনোভাব ভেঙে তিনি বলে উঠলেন,

- আমার মেয়ে যা বলেছে সব সত্য। ওই ছেলেটার চরিত্র ভালো ছিল না। অনিন্দিতার সঙ্গে বিয়ের কথাবার্তা চলাকালীন সময় ওর কুকর্ম ফাঁস হয়।


এহসানুল সরকার কিছু বললেন না। গম্ভীর হয়ে কি যেন ভাবতে লাগলেন। অনিন্দিতার মা খানিকটা সময় চুপ থেকে সঙ্গে সঙ্গে আবার বলে উঠলেন,

- আচ্ছা, অনিন্দিতার বাবার যে অবৈধ ব্যবসা ছিল তা কী আমার ছেলে বা তার বউ জানতো?


অনিন্দিতার মায়ের কথার প্রত্যুত্তরে এহসানুল সরকার বললো,

- না। তারা সম্পত্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। লোভ বড়ই মারাত্মক একটা জিনিস। তাছাড়া এখন অনিন্দিতার বাবা ও তার ভাইয়ের রুম সার্চ করা অনেক প্রয়োজন। আমাকে তাদের রুম গুলো দেখিয়ে দিন।


অনিন্দিতা বললো,

- আপনি আমার সাথে চলুন। আমি রুম গুলো দেখিয়ে দিচ্ছি।


এহসানুল সরকার অনিন্দিতার পিছু পিছু গেল। সর্ব প্রথম অনিন্দিতার ভাইয়ের রুমটা ভালো করে চেক করলেন। সেখানে সন্দেহজনক কিছু পাওয়া গেল না। এরপর অনিন্দিতার বাবার রুমে এলেন। সারা রুমের জিনিসপত্র এদিক-ওদিক করার পর এখানেও তেমন কিছু পেলেন না। শেষমেষ একপ্রকার হতাশ হয়েই রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় কী মনে করে যেন তিনি একবার অনিন্দিতার বাবার বালিশের কভারের ভেতর চেক করেন। যেখানে কালো রঙের একটা খাম পাওয়া যায়। অযথা সময় নষ্ট না করে দ্রুত খাম খুলে চিঠিটা বের করার পর মনেমনে পড়তে শুরু করলেন। 


চিঠিটায় লেখা ছিলো,


কিছু কিছু মানুষকে জানিয়ে আর কিছু মানুষকে না জানতে দিয়ে উপরে জবাবদিহিতার জন্য পাঠাতে আমার ভিষণ ভালো লাগে। আপনার পাপের হিসেব করা হচ্ছে। লিষ্ট করা হচ্ছে। জানিয়ে রাখলাম। যদি আপনি কখনো গুম হয়ে যান বা খু*ন হন তাহলে এর পেছনে এ যাবৎ আপনার করা সমস্ত কুকর্ম গুলোই একমাত্র দায়ী থাকবে। 

#সেরু__ভাই


পাশ থেকে অনিন্দিতা বলে উঠলো,

- এটা কি সেই খাম? চিঠিতে কী লেখা আছে? 


এহসানুল সরকার প্রত্যুত্তরে বলল,

- হ্যাঁ, এটা সেই খাম। নিচে ছোট করে একটা তারিখও লেখা আছে। খামটা ১'মাস আগের।চিঠিটা পড়ে আমি যা বুঝতে পারলাম, অনেক আগে থেকে আপনার বাবা সেরু ভাইয়ের টার্গেটে ছিল। 


- এই জন্যই বোধ হয় ১'মাস আগে বাবাকে অনেক ভয়ভীতিতে এবং চিন্তিত দেখাচ্ছিল।


পূর্বের ন্যায়ে চিঠিটা বাজ করে কালো রঙের খামের ভেতর রেখে এহসানুল সরকার বললো,


- আজ তাহলে আমি আসি। যেতে হবে আমায়।যেকোনো প্রয়োজনে আমি আবার আসবো। এখনো অনেক কিছুর সমাধান হয়নি। খোঁজাখুঁজি করতে হবে। সবকিছুর জট খুলতে হবে। তন্মধ্যে, 

১. আপনার বাবা কাকে খু*ন করে অবৈধ ব্যবসা শুরু করে আর কাকেই বা খু*ন করে সবকিছু শেষ করতে চাইছিলেন।

২. ইমনকে আপনার বাবা কেনো খু*ন করালো।

৩. ইমন কেনো টাকা খাইয়ে ইমতিয়াজের কেসটা বন্ধ করে দিয়েছিল।

৪. সবশেষে ইমতিয়াজের মৃত্যুর আসল রহস্য কী। আর সে কেনোইবা ডিভোর্সের একটা সুন্দর নাটক সাজালো। আরও অনেক কিছু। 


কথাগুলো বলার পর এহসানুল সরকার একমুহূর্তও আর দাঁড়ালো না। সোজাসাপটা অনিন্দিতাদের বাসা থেকে বের হয়ে আসলো। এখনো অনেক রহস্যের সমাধান খোঁজার বাকি। 


আজ ২৭'দিন চলে গেল। এখনো এহসানুল সরকার বাকি চারটা রহস্যের কোনো সমাধান খুঁজে পেলেন না। এখানে সেই স্থানে সকল বিষয়েই তিনি শূন্য ছাড়া আর কিছুই পাননি। কেটে গেল আরও বেশ ক'টা দিন। প্রায় পাগল বেশে যেন এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন তিনি। অতঃপর ১মাস ১৭ দিন পর সবকিছুর উত্তর খুঁজে পেলেন। সব রহস্যের সমাধান পেলেন। নির্ঘুমে রাত-বিরেতে এখানে-সেখানে ছুটাছুটি সহ কোনো কিছুই যেন ওনার বৃথা যায়নি। এই মুহূর্তে অনিন্দিতাদের বাসায় সিঙ্গেল একটা সোফায় বসে আছে এহসানুল সরকার। সামনেই তিন সিটের সোফায় সবকিছু জানার অধীর আগ্রহে অনিন্দিতা এবং তার মা বসে আছেন। ৫'মিনিট হলো, উনি এখানে এসেছে। 


নিরবতা ভেঙে এহসানুল সরকার বলল,

- অনিন্দিতার বাবা তার অবৈধ ব্যবসা অনন্দিতার মামাকে খু*ন করেই শুরু করেছিলেন। বহু বছরের অবৈধ ব্যবসা। অনিন্দতার বাবার পরনারীর সাথে অ*ন্ত*র*ঙ্গ মূহুর্ত চোখে দেখাসহ অবৈধ কিছু ব্যবসা শুরু করার কথাবার্তাও তিনি জানতেন। সবকিছু ফাঁস ও শেষ হওয়ার ভয়ে অনিন্দিতার মামাকে গুম করার পর খু*ন করানো হয়। 


শেষটা অনিন্দিতার মা অর্থাৎ আপনাকে দিয়ে করতে চাইছিলেন। ওনার মৃ*ত্যু*র ৩'দিন আগে উনি মাঝ রাতে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে নিজের অনেক গোপনীয় কথাবার্তা কারো সাথে ফোনে বলছিলেন।সে মূহুর্তে পেছন থেকে আপনি ওনার কাঁধ স্পর্শ করেন। ঘুম ভাঙার পর ওনাকে দেখতে না পেয়েই তখন ব্যালকনিতে গিয়েছিলেন। সেদিন অনিন্দিতার বাবা সুন্দর ভাবে সবকিছু ম্যানেজ করে নিলেও পরে আপনার অল্পকিছু কার্যকলাপে ওনার মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। ওনার মনে হচ্ছিল, সেদিন রাতে আপনি সবকিছুই জানতে পেরে গেছেন। সব জেনে আপনি অভিনয় করে যাচ্ছেন। অথচ আপনি কিছুই জানতেন না। এ বয়সে জেলে যেতে চাননি। গেলেও নিশ্চিত ফাঁসি।এই সামন্য সন্দেহ বশে তিনি সেদিন আপনারও খু*নে*র ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন।


অনিন্দিতা বলল, 

- তাহলে ইমনকে বাবা কেনো কন্ট্রাক্ট কিলার দ্বারা খু*ন করালো?


এহসানুল সরকার অনিন্দিতার প্রশ্নের জবাবে বলল,

- ইমনকে খু*ন করার একটাই কারণ ছিল, ইমন জানতো আপনার বাবা ফার্মেসির নামে অবৈধ সব কারসাজি করে।এমনকি এটা নিয়ে আপনার বাবাকে ইমন ব্লাকমেল পর্যন্ত করছিল। সবশেষে ওই দিন'ই অনিন্দিতার বাবার সবকিছুর ইতি টানার কথা ছিল কিন্তু সাথে ওনার ইতিও যে হবে, সেটা উনি বোধ হয় কল্পনাও করেননি।


অনিন্দিতার মা বলল,

- অনিন্দিতার বাবার সম্পর্কে আমি আর কিচ্ছু শুনতে চাইনা। ঘৃণা জন্মে গেছে। তুমি ইমতিয়াজের ব্যাপারটা একটু ক্লিয়ার করে বলো।


এহসানুল সরকার বলল, 

- ফেঁসে যাওয়ার ভয়ে ইমতিয়াজের কেসটা টাকা খাইয়ে ইমন জোরপূর্বক কোনো ভাবে বন্ধ করিয়ে ছিল। অবশ্য ইমনকে দিয়ে এটা একপ্রকার করানোই হয়।


ইমতিয়াজ, যে অফিসে চাকরি করতো, সেই অফিসের বস একজন মেয়ে। তবে বিধবা। ৩বছর আগে ওনার স্বামী মা*রা যায়। পরে আর বিয়ে করেনি। শুরু থেকেই ইমতিয়াজের উপর ওনার নজর ভালো ছিলনা। সুদর্শন পুরুষ হওয়ায় ইমতিয়াজের প্রতি উনি প্রথমেই একটু আকৃষ্ট হয়েছিলেন।এরপর ধীরে ধীরে আরও আকৃষ্ট হতে থাকেন। একসময় ইমতিয়াজকে ভালোবেসে ফেলে। যদিও এটাকে ভালোবাসা বলা যায় কি-না জানি না। ইমতিয়াজ বিবাহিত। ইমতিয়াজের স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা। কিছুদিন পর বাচ্চা হবে। সবকিছু জানা সত্যেও ইমতিয়াজকে বেশ কয়েকবার বিয়ের প্রস্তাবসহ অনেক কুপ্রস্তাবও দিয়েছিল।


তবে ইমতিয়াজ মানুষ ভালো ছিল। কিছুটা সরল মনের। নিজ স্ত্রীর প্রতি ছিল তার অফুরন্ত ভালোবাসা। রাবেয়া চৌধুরীর কোনো প্রস্তাবেই সে রাজি হয়নি। একদিন অফিস ছুটি হওয়ার পরেও, বিভিন্ন কাজের অজুহাত দিয়ে ইমতিয়াজকে আটকে রাখা হয়। সেদিন-ই মনে মনে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো- সে। কিন্তু আর হলো না। 


সেদিন ছল করে ইমতিয়াজকে নেশা জাতীয় কিছু খাওয়ানো হয়। যারপর নিজের সাথে অ*ন্ত*র*ঙ্গ ভিডিও ও কিছু ছবি ফোনে ধারণ করে পরবর্তীতে ইমতিয়াজকে ব্ল্যাকমেল করা হয়। তাই মন চাইলেও আর চাকরিটা ছাড়তে পারলো না ইমতিয়াজ। কিন্তু তারপরেও রাবেয়া চৌধুরীর সম্পূর্ণ হাতের মুঠোয় যেন কিছুতেই আসছিল না ইমতিয়াজ। ইমতিয়াজকে নিজের করে পাওয়ার প্রবল লালসায় শেষমেষ শীর্ষ এক কন্ট্রাক্ট কিলার দ্বারা অনিন্দিতা এবং তার সন্তান উভয়কেই খু*ন করার ভয় ও হুমকি-ধমকিটা রাবেয়া চৌধুরীর অনেক কাজে লেগে যায়। ধীরে ধীরে ইমতিয়াজ সবদিক থেকে অদৃশ্য শিকলে বাঁধা পড়ে যায়। রাবেয়া চৌধুরীর সম্পূর্ণ হাতের মুঠোয় চলে আসে। রাবেয়া চৌধুরীর কথা অনুযায়ী, সেদিন অফিস থেকে হুট করে ফিরে ইমতিয়াজ তোমাকে ডিভোর্সের কথা জানালো। তাছাড়া ইমতিয়াজের হাতে তখন কোনো অপশন ছিল না। পরিস্থিতি বুঝে চাইলেও পুলিশ বা কারো সাহায্য নিতে পারেনি। কাউকে বলতেও পারেনি। সবদিক থেকে ইমতিয়াজ নিরুপায় ছিল। ডিভোর্সটা না হওয়া পর্যন্ত দৃষ্টিবন্দী ছিল। কিন্তু তাই বলে ইমতিয়াজ এতো সহজেও হার স্বীকার করে নেয়নি।তাইতো সেও অনেক ভেবেচিন্তে ডিভোর্স নিয়ে একটা পরিকল্পনা করলো। প্রতিটি ধাপে ধাপে একাই প্লানিং সাজালো। সবকিছু ঠিক ছিল। 


১৭ তারিখ,

আজ থেকে ৩'বছর আগে পরপুরুষে আকৃষ্ট হয়ে নিজের স্বামীকে খু*ন করা সহ রাবেয়া চৌধুরীর বিরুদ্ধে আরও অনেক প্রমাণই, ইমতিয়াজের হাতে আসলো। তার প্লানিং অনুযায়ী পরের দিন ১৮ তারিখ রাবেয়া চৌধুরীর সবকিছু ফাঁস করার কথা ছিল কিন্তু কিছু অসাবধানতা ও ভুলের জন্য ইমতিয়াজের সমস্ত প্লানিং সম্পর্কে রাবেয়া চৌধুরী জেনে গিয়েছিল। যা ইমতিয়াজ ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি।


এহসানুল সরকার এইবার একটু থেমে অনিন্দিতাকে উদ্দেশ্য করে আবার বলে উঠলো,

- ১৭ তারিখ অর্থাৎ সেদিনই কাজের মেয়েটার সাহায্যে ইমতিয়াজের ঠান্ডা শরবতে সেই বিষটা মেশানো হয়।যার ১৩ঘন্টা পর ইমতিয়াজের মৃ*ত্যু হয়। মৃ*ত্যু*র পূর্বে আপনার সাথে কথা বলার আগে রাবেয়া চৌধুরীর সঙ্গে ইমতিয়াজের কথা হয়েছিল। অবশ্য রাবেয়া চৌধুরীর ফোন কলেই অতো রাতে ইমতিয়াজের ঘুম ভেঙে ছিল। তার সাথে কথা বলার দু'মিনিট পরেই বিষের প্রতিক্রিয়াটা তৎক্ষণাৎ শুরু হয়।


রুমের দরজা বাহির থেকে বন্ধ করা ছিল। অন্যদিকে ইমতিয়াজের মা ছিল গভীর নিদ্রায়। কাজের মেয়েটা আড়ালে পানির সাথে ঘুমের ঔষুধ মিশিয়ে দিয়েছিল। ইমতিয়াজের মায়ের, ইমতিয়াজ ছাড়া পৃথিবীতে আপন বলতে আর কেউই ছিল না। সেদিন ছেলের হাজারো চিৎকার চেঁচামেচি ও যন্ত্রনার আর্তনাদেও ওনার ঘুম ভাঙলো না। সল্প সময়ের মধ্যেই দুর্দন্ত পরিকল্পনা করেছিল রাবেয়া চৌধুরী। তবে ইমতিয়াজকে খু*ন করার বিষয়ে বারংবার ভেবেছিলেন, তিনি। 


অনিন্দিতা নিজেকে বহু কষ্টে সামলে নিয়ে বলল,

- তাহলে ইমনের এখানে কী ভূমিকা ছিল?


এহসানুল সরকার বলল, 

- ইমনের ভূমিকাও কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্টেপে আছে। কারণ বেকার ইমনকে অফিসের সবচেয়ে বড় পজিশনে চাকরি দেওয়ার প্রবল স্পৃহা দেখিয়েই আপনার বাবার ফার্মেসি থেকে প্রথমে ওই বিষটা আনিয়ে ছিল। তারপর ইমতিয়াজদের বাসার কাজের মেয়েটাকে মোটা অংকের টাকা দিয়ে কাজটা করানো সহ সবকিছুই ইমনকে দিয়ে করিয়েছে। শুরুতে ইমন নাকচ করে দিলেও পরমূহুর্তে ঠিকই রাজি হয়ে গিয়েছিল। শেষে রাবেয়া চৌধুরীর কথাতেই তার কাছ থেকে মোটা অংকের যথেষ্ট পরিমাণ টাকা নিয়ে পুলিশকে ঘুষ দিয়ে ইমতিয়াজের কেসটা কোনো একটা অজুহাত দাঁড় করিয়ে বন্ধ করালো। বলতে গেলে ইমন প্রায়ই সবকিছুই জানতো। তাছাড়া ইমতিয়াজের করা ডিভোর্সের ওই প্লানিংয়ের সাথে যারা যারা জড়িত ছিল, তাদের প্রত্যেককে অনেক আগেই টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেই সাথে রাবেয়া চৌধুরীর বিরূদ্ধে ইমতিয়াজের জমা করা সমস্ত প্রমাণও কত আগেই ভেনিস হয়ে যায়।


সবকিছু শোনার পর অনিন্দিতা কি বলবে ভাষা খুঁজে পাচ্ছিল না। অনিন্দিতার মা-তো অনেক আগে থেকেই ভাষা হারিয়ে চুপ করে আছেন। এভাবেই কিছুক্ষণ পিনপিনে নিরবতা চললো। হঠাৎ অনিন্দিতা বলল,

- ইমতিয়াজের বাসার কাজের মেয়েটা এখন কোথায়? সবকিছুর জন্য যে মহিলা দায়ী, সেও এখন কোথায়? তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তো?


এহসানুল সরকার গম্ভীর ভাবে উত্তর দিলো,

- কাজের মেয়েটাকে গ্রাফতার করা হয়েছে। একটুর জন্য তার প্রাণটা বাঁচলো বলে। কিন্তু রাবেয়া চৌধুরীকে গ্রেফতার করতে পারিনি। সে মা*রা গেছে। আমি পৌঁছানোর আগেই সেরু ভাই সেখানে পৌঁছে গেছিল। 


- ভালোই হয়েছে। ওর মতো নিকৃষ্ট মহিলার মরাই উচিত। আমার সবকিছু শেষ করে দিয়েছে। 


খানিকক্ষণ চুপ থেকে এহসানুল সরকার বলল,

- আর একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। ইমনের সারা ডায়েরি জুড়ে, 

অনিন্দিতা ঠক, অনিন্দিতা প্রতারক। অনিন্দিতা আমাকে ঠকাইছে। অনিন্দিতা আমার সাথে প্রতারণা করছে।

এই লিখাগুলোর বিষয়ে। এই কথা গুলো রাবেয়া চৌধুরীর কথাতেই ইমন তার সারা ডায়েরিতে লিখেছিল। জানি না কেনো। 


অনিন্দিতার মা চোখের জল মুছে এবার বলে উঠলো,

- তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। আমার মেয়েকে তুমি সাহায্য না করলে এতোকিছু কখনোই জানতে পারতাম না। সেই সাথে এতো সত্যও কখনো সামনে আসতো না। কখনোই বোধ হয় প্রকাশ হতো না।


চোখে টলমল করতে থাকা জল মুছে অনিন্দিতা বলল,

- আপনাকে কিছু বলার ভাষা আমার নেই। সবশেষে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। 


অতঃপর আরও কিছুক্ষণ তাদের সাথে ভালো মন্দ অনেক কথা বলার পর এহসানুল সরকার অনিন্দিতাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

- তাহলে আমি আসি। ইমতিয়াজের মা'কেও সবকিছু জানাতে হবে। তারপর আমাকে আমার বাড়িতে ফিরতে হবে। ভালো থাকবেন আপনারা।


★★★★

৮ দিন পর।

সকাল ১০টায় রেস্টুরেন্টের ডান দিকের একটা সিটে বসে লাচ্ছি খাচ্ছিল এহসানুল সরকার। লাচ্ছি তার ভিষণ পছন্দের।সেই মুহূর্তে তার ফোন বেজে উঠলো। অপরিচিত নাম্বার। ফোন রিসিভ করে বললেন,

- কে?


ওপাশ থেকে কেউ গম্ভীর কন্ঠে বলল,

- আমি।


- সেরু ভাই! 


- চিনে গেছেন?


- তুমি আমার আশা-পাশে থাকলেও আমি বুঝতে পারি। অনুভব করতে পারি।


- প্রথমেই বলছি, ট্র্যাকিং করার কোনো চেষ্টা করবেন না। কোনো লাভ হবে না।


- তুমিকি এতোটাই বো*কা এমন কোনো কাজ করবে কী? সেটা আমি জানি। কেনো ফোন করেছো, এটা বলো?


- আপনি একটা ভুল ধারণা মনের মধ্যে পোষণ করে আছেন। যেটা ভাঙার জন্যই ফোন করা।


- কিসের ভুল ধারণা? 


- আপনি মনে করেন, আপনি যেসব কেসের সাথে জড়ান। আমিও সেসবেই জড়িয়ে পড়ি। কথাটা ভুল। আমি কখন, কোথায় কিভাবে কার সাথে জড়াবো সেটা কেউ জানে না। কেউ জানবেও না। মাঝেমধ্যে অনেক কিছু কাকতালীয় হয়ে যায়। তবে আপনার সাথে চোর পুলিশের খেলা খেলতে আমার একটু বেশিই ভালো লাগে। অন্যরকম লাগে। জানি না সেটা কেনো।


এহসানুল সরকার মৃদু স্বরে বলল,

- মাঝে মাঝে তোমার জন্য আমার অনেক কষ্ট হয়। তোমার নিদারুণ ভাগ্যকে খুব দোষ দিতে ইচ্ছে হয়। জন্মানোর পর যদি তুমি বাচ্চা চুরির চক্রে না পড়তে, তাহলে নিশ্চিত আজ তুমি আমার পাশে থাকতে। আমার নিঃসঙ্গতার সঙ্গী হতে পারতে। আজ থেকে প্রায়ই দু'বছর আগে যদি তোমার ফাঁসি হয়ে যেতো, তাহলে আমি বোধ হয় কখনো জানতেও পারতাম না। সেই তুমি কি-না আমার আপন রক্তের ভাই! এ কথা আমি বা তুমি ছাড়া আর কেউ জানে না। জানবেও না কখনো। কাউকে জানতেও দিবো না। ভেবোনা নরম করে কথা বলেছি দেখে, আমি তোমাকে ছাড় দিবো। কখনোই না। দু'বার রক্ষা পেয়েছো। দু'বছর আগে তোমার ফাঁসির মহা চক্রান্তের পিছনে যারা জড়িত ছিল, তারা সবাই সেদিন ধরা পড়েনি। আসল দু'জন কালপ্রিট গ্রেফতার হয়নি। তারাই আবার তোমাকে ২য়'বার জেল থেকে পালাতে সাহায্য করেছিল। ভেবোনা বারবার তুমি এভাবে পালাতে পারবে। বারবার তোমার বিষয়টা ধামাচাপায় পড়ে যাবে। এখনো জানিনা সেই কালপ্রিট দু'জন কে? জানতেও বোধ হয় বেশি সময় লাগবে না। নিজের কোনো শেষ ইচ্ছে থাকলে সেটা পূরণ করে নিতে পারো। কারণ এইবার গ্রেফতার হলে তুমি আর পালাতে পারবে না। খুব শীগ্রই তুমি হোঁচট খেয়ে পড়তে চলেছো। যা তোমার অন্ত নিশ্চিত করবে। তোমার সেই পড়ে যাওয়ার অপেক্ষায় রইলাম। যারপর আমি নিজ ইচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দিবো। মা'কে নিয়ে দেশ ছেড়ে বিদেশ চলে যাবো।


ফোনের ওপাশ থেকে প্রত্যুত্তরে সেরু ভাই কর্কশ গলায় বলল,

- লাভ নেই। আপনি আমাকে কখনো ধরতে পারবেন না। আপনার চাকরি চলে যাবে। ততদিনে বুড়ো হয়ে যাবেন।আপনি অবসরে চলে যাবেন। আপনার সবকিছু থেমে যাবে। কিন্তু আমি বুড়ো হলেও আমার কোনো অবসর নেই। আমার কোনো কাজকর্ম থামবে না। কখনোই না। আপনার গল্পে হয়তো আমি চোর আপনি পুলিশ কিন্তু আমার সব গল্পে আমি ছাড়া বাকি সবাই চোর। সেরু ভাইয়ের গল্প, সেরু ভাইয়ের কাহিনি, কখনো শেষ হওয়ার নয়।

 


(সমাপ্ত) 


পর্বের আরও গল্প পড়ুন।