গল্প:হঠাৎ_ঝড়ো_হাওয়া | রহস্যময়ী নারী

 রহস্যময় গল্প

রহস্যময় গল্প

মেসেজের টুং শব্দে ঘুম ভাঙলো। একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে। কেউ একজন লিখেছে, ‘আজকে সন্ধ্যায় বৃষ্টি হবে সাথে ঝড়ো হাওয়া। সাবধানে থাকবেন।’


আজব! কে দিবে এমন মেসেজ। পরিচিত হয়তো কেউ মজা করছে। কল দিলাম সেই নাম্বারে। ফোন বন্ধ। অবাক হলাম। মেসেজ দিয়ে আবার ফোন বন্ধ করে রেখেছে।


.


সন্ধ্যার দিকে হঠাৎ দমকা হাওয়া বওয়া শুরু করলো। আমি মাত্র বাহিরে বের হয়েছি তখন তখনই এই ঝড়। বাতাসের ঝাপটা একটু কমতেই বৃষ্টি শুরু হলো। সে কি তেজ! বৃষ্টির ভাব দেখে মনে হচ্ছে আজকে ঢাকা শহরকে ভাসিয়ে ফেলবে।


হালকা ভিজে, হালকা নিজেকে বৃষ্টির পানি থেকে বাঁচিয়ে বাসায় আসলাম। মা কফি দিয়ে গেল। গরম কফি নিয়ে অন্ধকার বারান্দায় বসে আছি। বৃষ্টির তেজ এতোক্ষণে একটু কমেছে। ঠান্ডা বাতাস আসছে হু হু করে বাহির থেকে। ভালই লাগছে। মনের ভেতরটা প্রশান্তিতে ভরে যাচ্ছে। রাত আটটার মত বাজে। আগামীকাল ভার্সিটিতে পরিক্ষা আছে একটা। পড়তে বসতে হবে।


মোবাইলটা হাতে নিলাম।সাথে সাথেই মনে পরলো ওই মেসেজের কথা। আজব! এরপর আর কিছুই বললো না।

বৃষ্টি হবে, ঝড় বইবে এ কথা আমাকে কেন জানালো?


টুং করে মোবাইলে মেসেজ আসলো।সেই নাম্বার থেকে আবার এসেছে। লিখেছে,

– 'ঝড়ো বাতাসে আমাকে অনুভব করেছিলেন? আমি কিন্তু আপনাকে ঠিকই স্পর্শ করে গেছি।'


মেসেজটা দেখে কিছুই বুঝলাম না। কিছু বোঝা বা না বোঝার আগে ফোন দেয়া উচিৎ। কিন্তু অবাক করার মত ব্যাপার এবারও ওই পাশ থেকে শব্দ আসলো, ‘আপনি যেই নাম্বারে কল দিয়েছেন তা এই মুহুর্তে বন্ধ আছে। অনুগ্রহ করে…….’


কে দিবে এমন মেসেজ। কোন বন্ধু হয়তো মজা করছে।থাক এই বিষয় নিয়ে চিন্তা করার কোন কারন দেখছি না। আপাতত পড়াশোনায় মনোযোগ দেয়া উচিৎ।


.


রাতের দিকে আরেকবার বৃষ্টি হয়ে গেল। ঠান্ডা ঠান্ডা একটা ভাব চারদিকে। অন্ধকার ঘড়ে শুয়ে আছি। ঘুম আসছে না।সকালে উঠতে হবে, পরিক্ষা।


হঠাৎ ওই নাম্বার থেকে আবার মেসেজ আসলো,


– 'আপনি ইচ্ছা করলেই নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারেন। আপনাদের পরিক্ষা কাল হচ্ছে না।'


কি ব্যাপার? কে উনি? মনের ভেতরটা জানি কেমন করে উঠলো। একটু পর আমি নিজের অজান্তেই আবিষ্কার করলাম এই উড়ো মেসেজের প্রতি আমার হালকা ভরসা জন্মে গেছে। কারন আমি বিশ্বাস করে ফেলেছি আসলে কাল পরিক্ষা হবে না।


.


ঘুম থেকে উঠলাম ছ'টায়। সকাল আটটার দিকে পরিক্ষা আরেকটু আগে পৌছে যেতে হবে। সকালে উঠে নোটিফিকেশন চেক করা আমার একটি অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে। নোটিফিকেশন চেক করতেই দেখলাম আজকের পরিক্ষা ক্যান্সেল করা হয়েছে। আনন্দে লাফাতে মন চাচ্ছে। একে তো ভাল করে পড়া হয় নি তাছাড়া এতো সকালে উঠতে কারই বা মন চায়?


মেসেজের কথাটা মনে পরলো। কিভাবে জানলো আজকে পরিক্ষা হবে না? যাইহোক আগে ঘুম পরে কথা।


.


পরিক্ষা ক্যান্সেল হলেও ক্লাস আছে। দশটার দিকে উঠে ফ্রেশ হয়ে ভার্সিটির জন্য রউনা দিলাম। ভার্সিটির বাস এখন আর পাবো না। যেতে হবে লোকালে।


অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে বাসের জন্য। বাস আজকে কম মনে হচ্ছে। এই সময় সামনে একটা প্রিমিও কার থামলো। গাড়ির কাচটা নেমে যেতেই দেখলাম একটি খুবই অপরুপ মেয়ে। মেয়েটা এদিক তাকিয়ে, 'এক্সকিউজ মি' বললো।


মনে হয় আমাকেই বলেছে। আশাপাশে অনেক মানুষ থাকলেও কেউ নেই মনে হচ্ছে।


আমি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললাম,

- "জ্বি, আমাকে বলছেন?"


- "আসলে একটা বিপদে পরেছি যদি একটু হেল্প করতেন খুব ভালো লাগতো।"


এতো সুন্দর একটা গাড়ি থাকলে মানুষ আবার বিপদেও পরে।


- "কি বিপদ?"


মেয়েটা একটু গলায় ঠেকে একটু দ্রুততার সাথে বললো,


- "আসলে আমি একটা ঠিকানা খুঁজে পাচ্ছি না। যদি একটু হেল্প করতেন।"


মনে মনে বললাম, ‘ওহ এই ব্যাপার।’


মেয়েটার হাতে একটা কাগজ ছিল। আমার কাছে বাড়িয়ে দিল। ঠিকানাটা দেখলাম আমাদের পাশের বাড়ি আমি খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলাম। মেয়েটা আমাকে অনেকবার ধন্যবাদ দিয়ে চলে গেল। তাকে বলি নাই এই ঠিকানায় যেই বাড়ি তার পাশেই আমাদের বাসা। 


.


আকাশের অবস্থা ভালো ঠেকছে না। কালো হয়ে যাচ্ছে।রাস্তার বালুগুলো বাতাসের উষ্কানিতে আন্দোলন শুরু করে দিয়েছে। যে যেভাবে পারছে মুখচোখ ঢাকছে। এমন সময় কাঙ্ক্ষিত বাস পেলাম আর উঠে বসলাম। বাসে উঠার কিছুসময়ের মাঝেই বৃষ্টি নেমে গেল।


বাসের জানালা সব বন্ধ। নাহলে পানি ঢুকে পরবে ভেতরে।

আমি বসতে পারলেও অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। এইটুকু বাসে কত মানুষ। বাসের জানালা সব বন্ধ, তাতে এতো মানুষ, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।


হঠাৎ মেসেজের শব্দ। কেন জানি মনে হচ্ছে সে মেসেজ দিয়েছে। আমার ধারনাই ঠিক। সেই অপরিচিত নাম্বার৷ লিখেছে,


– 'একটু বাসের জানালাটা খুলে দিন। দম বন্ধ হয়ে যাবে তো বৃষ্টির ফোটা গায়ে পরলে তেমন তো কোন সমস্যা নেই।'


যেহেতু একবারে শেষে জানালার কাছে বসেছি, তাই বাসের জানালা খুললে শুধু আমিই ভিজবো। অল্প করে জানালাটা খুললাম। জানালাটা খোলার সাথে সাথেই বৃষ্টির পানি, ঠান্ডা বাতাস আর অসম্ভব সুন্দর এক সুগন্ধ আমার নাক-চোখ-মুখ স্পর্শ করে গেল। এইরকম সুন্দর গন্ধ আমি কোথাও পাই নাই। মনটা ভরে গেল। পুরো রাস্তায় একটু একটু বৃষ্টির পানিতে ভিজতে লাগলাম।


.


ভার্সিটিতে পৌছাতেই একটি বাজে সংবাদ শুনতে হলো।আমাদের আগের সেমিস্টারের শিক্ষক, হামিদ খান, আজকে সকালে ইন্তেকাল করেছে। এখন সব ক্লাস বন্ধ। 


বন্ধু রাফি এসে বললো,

- "স্যারের সাথে যাবি?"


- "হুম.. যাওয়া যায়। তুই?"


- "যাওয়ার ইচ্ছে ছিল, মামা। কিন্তু এখন আর যাবো না।"


- "কেনো? ফখরুলরা তো যাচ্ছে।"


- "এই জন্যই যাবো না।"


রাফি আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। ও না গেলে আমারও যাবার প্রশ্ন ওঠে না।


- "আমিও যাবো না তাইলে। চল চা খাই।"


টিএসসিতে এসে দুইজন দু কাপ চা নিলাম। রাফি স্যারের জীবন বৃত্তান্ত নিয়ে একটা লেকচার মারছে। কিন্তু আমার মনোযোগ সেদিকে নেই। আমি ভাবছি সেই মেসেজের কথা। রাফিকে কথাটা বলা ঠিক হবে কিনা? যদি কেউ মজা করে তাহলে আমি লজ্জিত হবো। কিন্তু এইভাবে মজা নেয়া সম্ভব? রাফির লেকচার থামিয়ে দিলাম।


- "রাফি, তুই কি আমার সাথে মজা কর‍তেসিস কোন?"


- "কি মজা?"


রাফিকে অবাক লাগলো। নাহ, ও এ কাজ করবে না। 


রাফিকে সব খুলে বললাম। মেসেজগুলো দেখালাম।ওই নাম্বারে ফোন দিলাম ফোন বন্ধ। রাফি আমার কথাগুলো শুনে অনেকক্ষণ চুপ করে রইলো।


এরপর বললো,

- "আমার মনে হয় কেউ মজা নিচ্ছে ।"


- "আমারও তাই মনে হলো। কিন্তু কিছু জিনিস তো আসলে বিভ্রান্তিতে ফেলিয়ে দেয়ার মত।"


রাফি চুপ।তারপর ওর মাথার লম্বা চুলে একটা নাড়া দিয়ে একটা ভয়ানক কথা বললো,


- "দেখ হেমন্ত, কেউ যদি মজাও করে, তার মানে এই দাঁড়াচ্ছে সেই লোক বা নারী তোকে ফলো করছে। সে হয়তো আশেপাশেই আছে অথবা নাই।"


রাফির কথা শুনে কেমন জানি ভয় ভয় লাগলো। চারপাশে একটু তাকালাম। এতোক্ষণ চারপাশ যেমন স্বাভাবিক লাগছিল এখন আর লাগছে না। মনে হচ্ছে প্রত্যেকটা মানুষ রহস্যে ঘেড়া।


ঠিক এই সময়ে একটা মেসেজ এলো। রাফির দিকে ভয় ভয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম, 


- "ওই নাম্বার থেকে।"


রাফি আগ্রহ নিয়ে বললো,

- "কি লিখেছে দেখ।"


আমরা দুইজন একই সাথে দেখলাম। লিখেছে,

- "কারো সম্পর্কে বলার জন্য আমার তাকে ফলো করতে হয় না। আমি আপনার আশাপাশে কি দুরেও নেই। আমাকে নাগালের মাঝে পাওয়া যায় না।"


আমি রাফির দিকে তাকালাম। ওকে একটু কেমন জানি দেখাচ্ছে। ভয় পেয়েছে নাকি?


আমরা এতো আস্তে কথা বলছিলাম যে দুইজন বাদে অন্যকারো শোনা অসম্ভব। আর রাফিও একটা বারের জন্য ফোন হাতে নেয় নি। মানে কি দাঁড়াচ্ছে? কেউ একজন আমার সব কাজ দূর থেকে দেখতে পারছে। 


.


বাসায় আসলাম সন্ধ্যার দিকে। মাথাটা কেমন জানি ব্যাথা করছে। সব কিছু অসহ্য লাগছে। কি একটা কথা! আমি যা করছি কেউ একজন তা প্রত্যক্ষ করছে। মানে আমি বাথরুমে গেলেও সে দেখছে। এমন সময় মেসেজ আসলো। এখন মেসেজ আসলেই ভয় লাগে।


– "আসলে উপরওয়ালা বাদে কেউই পারে না আরেকজনের সব কাজে, মনে দৃষ্টি দিতে। মানুষ যেটা পারে অনুমান করতে পারে। অনুমান শক্তি মাঝে মাঝে কারো খুবই শক্তিশালী হয়। বন্ধুর সাথে একটা মানুষ কি কথা বলবে, এরপর বন্ধু কি উত্তর দিতে পারে সবই অনুমানে বলা যায়।"


এবার কিছুক্ষণ অবাক হয়ে রইলাম। অনুমান শক্তি কারো এতো ভাল হয়? মনের কথাও বলে দেয়া যায়?


আসলেই যেই মেসেজগুলো আমাকে এই পর্যন্ত দিয়েছে সবই অনুমান করে বলা যায়। পরিক্ষা ক্যান্সেল হতে পারে, বৃষ্টিতে বাসের সব জানালা বন্ধ থাকে এগুলো অনুমান করে আসলেই বলা যায়। তবুও মনে একটা খটকা তো লেগেই আছে।


মেসেজ দিয়েই ফোন কেন অফ করে দেয়? কে এই অপরিচিত নাম্বারের মালিক। পুলিশ ফাইল করবো নাকি আরেকটু দেখবো?


হঠাৎ মা রুমে দেখলো। আমাকে দেখে বললো,

- "কি ব্যাপার? তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন?"


কথাটা বলেই মাথায় হাত দিতে দেখলো জ্বর আসছে কি না? আমি যতটা সম্ভব নিজেকে শান্ত রেখে বললাম,


- "কিছু হয় নি। এমনেই জার্নি করে এসেছি তাই একটু টায়ার্ড লাগছে।"


মাথার ভেতর যে এতোবড় একটা চিন্তা বুঝতে দেয়া যাবে না।


- "আচ্ছা,দেখিস অসুখ বাধাইস না।"


আমি একটু হাসলাম। বললাম,

- "আচ্ছা এখন যাও। একটু রেস্ট নেই।"


মা যাওয়ার পর দরজাটা একটু চাপিয়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পরলাম। কেমন জানি লাগছে। ঘুম আসছে কিন্তু ঘুমাতে পারছি না। একে তো একটা উটকো ঝামেলায় ব্যাপক চিন্তা হচ্ছে তার মধ্যে আবার পাশের বাড়ির ছাদে জোরে গান বাজাচ্ছে। খুব সম্ভবত বিয়ে বা গায়ে হলুদ। ঘুম যেহেতু আসছে না একটু ছাদ থেকে ঘুরে আসি।


.


পাশের বাড়ির ছাদে ব্যাপক গান-বাজনা হচ্ছে। গায়ে হলুদ। আকাশে মেঘ মেঘ, যেকোন সময় বৃষ্টিতে গায়ে হলুদ পন্ডু হয়ে যেতে পারে।


এমন সময় একটা ডাক এলো,

- "এই যে, এক্সকিউজ মি।"


গায়ে হলুদ যেই ছাদে সেই ছাদ থেকে ডাকছে। তাকাতেই দেখলাম সেই মেয়ে। যে সকালে আমার কাছে ঠিকানা জিজ্ঞেস করেছিল। অনুষ্ঠানের জন্য হলুদ শাড়ি পরেছে মেয়েটা। এতো অপরুপ সুন্দর মেয়ে আমি আগে কখনও দেখে নি। আমাকে ডেকেই চলছে....


(চলবে)...


গল্পঃ_হঠাৎ_ঝড়ো_হাওয়া

পর্বঃ_০১

লেখাঃ_হেমন্ত হাসান

-------------------------------------

-গল্পঃ_হঠাৎ_ঝড়ো_হাওয়া

-পর্বঃ_০২

-লেখাঃ হেমন্ত হাসান

-------------------------------------

পাশের বাড়ির ছাদে ব্যাপক গান-বাজনা হচ্ছে।গায়ে হলুদ।আকাশে মেঘ মেঘ, যেকোন সময় বৃষ্টিতে গায়ে হলুদ পন্ডু হয়ে যেতে পারে। এমন সময় একটা ডাক এলো,"এই যে এক্সকিউজ মি।"


গায়ে হলুদ যেই ছাদে সেই ছাদ থেকে ডাকছে।তাকাতেই দেখলাম সেই মেয়ে।যে সকালে আমার কাছে ঠিকানা জিজ্ঞেস করেছিল।অনুষ্ঠানের জন্য হলুদ শাড়ি পরেছে মেয়েটা।এতো অপরুপ সুন্দর মেয়ে আমি আগে কখনও দেখে নি।আমাকে ডেকেই চলছে।


০২.

আমি হাত নেড়ে মেয়েটাকে স্বাগত জানালাম।হাসি হাসি মুখ নিয়ে কি যেন বলছে।বোঝা যাচ্ছে না।হাত দুটো মুখের সামনে গোল করে এনে জোরে জোরে বলছে।তাও বোঝা যাচ্ছে না।আমি ইশারায় বুঝিয়ে দিলাম উচ্চস্বরে গান বাজছে তাই বুঝতে পারছি না। 

মেয়েটা হাতের ইশারায় একটু অপেক্ষা করতে বললো।আমি দাঁড়িয়ে আছি আর ভাবছি মেয়েটা আমাকে মনে রাখলো কিভাবে?


ভাবতে ভাবতে মেয়েটা এসে পরেছে।এরপর ইশারায় আমার ফোন বের করতে বললো আর বুঝিয়ে দিলো একটা নাম্বার লিখতে।এই ব্যাপারটা আমার সাথে কখনও হয় নি।ইশারায় কারো নাম্বার নেয়া। প্রথমে মেয়েটা ডান হাত গোল করে শুন্য বুঝালো। এরপর হাতের আঙুল দিয়ে বাকী নাম্বারগুলো বোঝালো। আমার খুব ভালো লাগলো।মুখের ভাষা ব্যাবহার না করেও কত সহজে দূর থেকে যোগাযোগ করা যায়।


মেয়েটা আমাকে ফোন দিতে বলে ছাদের ভেতর দিকে চলে গেল। আমি ফোন দিলাম সাথে সাথেই।

ফোন রিসিভ করলো।গান-বাজনার শব্দ একটু কম লাগছে হয়তো বাসায় ঢুকেছে মেয়েটা। 


আমিই কথা প্রথমে বললাম,

- "হ্যালো, আমি পাশের ছাদের ছেলেটা।"


ও পাশ থেকে মেয়েটার হাসির শব্দ শোনা গেল।কি সুন্দর হাসি।ভেতরটা নাড়া দিয়ে যায়।


মেয়েটা বললো,

- "আমি পাশের ছাদের মেয়েটা।"


বলেই আবার একটু হাসলো।

- "আমার নাম, হেমন্ত।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি।অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগে।"


- "আমি সূচনা। পড়ি ময়মনসিংহ মেডিকেলে।"


- "বাহ, ডাক্তার। এই জন্যে মুখটা মনে রাখতে পেরেছেন আমার।"


- "নাহ, আসলে এই জন্যে না।আপনার কপালে একটা তিল আছে।আমার খুব কাছের একটা বান্ধবীর মাথায় ও তিল আছে। আর আপনার মুখটা কেমন জানি বিষন্ন লাগছিল।বিষন্ন মুখের মানুষ সহজে আমি ভুলতে পারি না।"


আমি একটু হাসলাম।বাকি কথা শোনার জন্য চুপ করে আছি।


মেয়েটা বলে চলেছে,

- "এই জন্যে আপনার মুখটা ভুলি নি।আচ্ছা,আপনি আমাকে কিভাবে মনে রেখেছেন।"


এখন আমি যদি বলি আপনি সুন্দর তাই, ব্যাপারটা বাজে দেখায়।তবে আরেকটা কারন অবশ্যই আছে।সেটা বলা যায়।


বললাম,

- "আপনি যেই ঠিকানা জিজ্ঞেস করেছিলেন সেই ঠিকানাটা আমার পাশের বাসার ছিল, তাই মনে আছে। আর একটা কারন আছে সেটা পরে বলবো।"


মেয়েটা আবার হাসলো।কি মনে করে হাসলো কে জানে?এরপর বলল,


- "আচ্ছা পরেই বইলেন। তবে আপনাকে সবসময় এমন লাগে কেন?মনে হয় রাজ্যের চিন্তা মাথায়।"


- "আপনি আমাকে দেখলেনই মাত্র দুইবার।এতেই কিভাবে বলেন সবসময় চিন্তিত থাকি?আচ্ছা, একটু সমস্যায় আছি তাই।ব্যাপার না।"


- "আচ্ছা, এখন রাখি পরে কথা হবে। উপর থেকে ডাকছে।নাচতে হবে।আপনারা আসলেন না কেন, হলুদে?"


- "মা, আর ছোট দুই ভাই-বোন গেছে।শরীর খারাপ নাহলে আসতাম।"


- "আচ্ছা পারলে আসবেন। আমি একটু পর নাচবো।"


আমি হাসলাম। হেসে হেসে বললাম, 

- "আচ্ছা আসবো। এখন রাখি।খোদা হাফেজ।"


- "আল্লাহ হাফেজ।"


.


ফোনটা রাখার পর একটু হালকা হালকা লাগছে। এতক্ষণ যে একটা চাপা টেনশন ছিল একটু কমে এসেছে মেয়েটার সাথে কথা বলার পর।জানি না এই চিন্তাহীন কতক্ষণ থাকতে পারবো। আরেকটু ভাল লাগলে মেয়েটার নাচ দেখে আসবো।মায়াবী মেয়েদের নাচ মিস করা পাপ। সাথে গায়ে হলুদে দেয়া বিরিয়ানিও পাওয়া যাবে।গন্ধ আসছে সুস্বাদু বিরিয়ানির।পেটে থাকা সুপ্ত ক্ষুধাটা বিরিয়ানির কথা মনে করতেই নাড়া দিয়ে উঠছে।


.


মেসেজের চিন্তাটা একটু মাথা থেকে নেমেছে এখন সেখানে মেয়েটার চিন্তা।নীচে নেমে দেখলাম মা এখনও যায় নাই। ছোট-ভাই বোন গেছে। নীল একটা পাঞ্জাবি ছিল।গত ঈদে কিনেছিলাম।সেটা তাড়াতাড়ি পরে নিলাম।


রুম থেকে বের হতেই মা বলল,

- "কিরে কোথায় যাস?"


- "চলো তোমার সাথে হলুদে যাবো।"


- "আমি তো যাবো না।"


- "কেন যাবা না কেন?রেহান আর সুস্মিতা কই?"


- "ওরা তো ওদের বন্ধুর জন্মদিনে গেছে।"


নিরাশ হলাম।মনে হয় গায়ে হলুদে আমাদের আমন্ত্রণ জানায় নি।লজ্জা লাগছে।এভাবে হুটহাট পাঞ্জাবি পরে ফেললাম।তীব্র মাথা ব্যাথাটাও এক পাশে এসে পরেছে।সূচনা,পাশের ছাদের সেই মেয়ে, ওর নাচ দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। কি করা যায়?


হঠাৎ ফোনে টুং করে শব্দ হলো।বুকের ভেতরটা নাড়া দিয়ে ওঠে এই শব্দে।আস্তে আস্তে তাকাচ্ছি।চিন্তাটা একটু কমেছিল আবার যদি মেসেজ দেয়। 

নাহ, ওই নাম্বার না।মেসেজ দিয়েছে সূচনা।পাঁচ মিনিটের মধ্যে নাচ শুরু করবে।পারলে তাড়াতাড়ি সেখানে যেতে বলছে।


আম্মাকে বললাম, আমাদের কি হলুদে দাওয়াত দেয় নি। আম্মা না বললো।বিয়েতে দিয়েছে।হলুদে বেশি মানুষ তারা জানায় নি। পাশের বাসার সাদিককে ফোন দিলাম।ওর সাথে একই স্কুল আর কলেজে পড়েছি।সম্পর্ক অনেক ভালো।


- "কিরে সাদিক। কি অবস্থা।"


- "এইতো ভাই, খোঁজ খবর নেস না।"


- "বন্ধু, তোদের ছাদে যে যাইতে হয় একটু।"


- "আজকে তো অনুষ্ঠান হচ্ছে।"


- "এই জন্যেই তো যাবো। একটা কাজ আছে, বন্ধু।সাহায্য কর।"


- "ভাইয়া পেকে গেছো। কাকে পছন্দ হয়েছে।"


- "আরে ভাই এমন কিছু না। নীচে নামি তুই আয়।"


.


নীচে নামতেই দেখলাম সাদিক হাজির। ও সাদা রং এর একটা পাঞ্জাবি পরেছে। আমাকে দেখেই মুচকি হাসা শুরু করলো।সাদিকের সাথে আরও দুটি ছেলে ছিল, চিনি না। সাদিক দুই ছেলের দিকে তাকিয়ে আমাকে দেখিয়ে বলল,


- "আমার বন্ধু, হেমন্ত।"


এরপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

- "উনারা হচ্ছেন কনের কাজিন।চট্টগ্রামে থাকে।আমার সাথে ভাল সম্পর্ক হয়ে গেছে।"


আমি হাত মেলালাম। সাদিক এরপর একটা মিথ্যা কথা বলল,


- "কত করে বললাম হেমন্ত হলুদে আয়। তিনি আসবেন না।এখন কই যাচ্ছে?"


বুঝলাম উপরে নেয়ার ধান্ধা করছে।আমি বললাম,


- "এই তো সামনে। কাজ নেই। কেমন জানি বোরিং লাগছে।"


ব্যাস বলতেই কাজ হয়ে গেল। দুই ছেলের মধ্যে একজন বললো,


- "ভাই,আমাদের সাথে আসেন।খুব মজা হবে।"


চট্টগ্রামের লোক তো কেমন যেন নাকা নাকা সুর।


আমি বললাম,

- "নাহ, শুধু শুধু ঝামেলা।"


আরে চলেন বলে একজন আমাকে হাত ধরে টান দিল।আমি আর না করতে পারি? এতো করে যখন বলছে।


.


উপরে ওঠার সাথেই সাথেই আমার চোখ সূচনাকে খুঁজে  বেড়াচ্ছে।একটু খুঁজতেই পেয়ে গেলাম।হলুদের স্টেজের পেছনে আরও কিছু মেয়ের সাথে রেডি হচ্ছে।নাচার জন্য অন্যরকম একটা ড্রেস পরেছে।ড্রেসটার নাম জানি না।একটু লজ্জা লজ্জা লাগছে।আমার সাথে কখনও এমন হয় নি।একটা মেয়েকে দেখার জন্য আমি এতো কিছু করে এলাম।

শুধু আমি বললে হবে না।মেয়েটা মেসেজ না দিলে হয়তো আসতাম না।


.


এক পায়ে দু পায়ে একটু সামনে গিয়ে চেয়ারে বসলাম।একবারে সামনে না আবার একবারে পেছনেও না। সূচনা স্টেজের সামনে এসে একবার চেয়ারে বসা লোকদের দিকে চোখ ঘুরালো।সূচনার দৃষ্টি আমার দিকে পরতেই ওর চেহারায় একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম।এতো মানুষের সামনে হয়তো হাত তুলে অভিবাদন জানাতে পারছে না।শুধু মুখ টিপে একটু হাসলো আর চোখ দুটো আস্তে করে বন্ধ করে আমাকে স্বাগত জানালো।


.


রবীন্দ্রনাথের পাঁচটা গান রিমিক্স করে সূচনা এবং তার দল নাচলো।সূচনার নাচ দেখার সময় আমি আসলে হারিয়ে গিয়েছিলাম।সেই সময়ের বর্ননা ভাষায় দেয়া সম্ভব না।শুধু আমার মনে হচ্ছিল এর থেকে সুন্দর রাত,অনুষ্ঠান আমি আর হয়তো পাবো না।কোনদিনও না, কোথাও না।


.


অনুষ্ঠান থেকে এসে গা এলিয়ে দিয়ে একটু শুয়েছি। তখনই টুং শব্দ।সেই অপরিচিত নাম্বার।অস্বস্তিটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। এবার একটু বড় মেসেজ মনে হচ্ছে।লিখেছে,


– "মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আনে ভালোবাসা। মানুষ যখন কারো প্রতি তীব্র প্রেমে পরে তখন সব কিছু তার কাছে সহজ হয়ে যায়।প্রথম দেখায় যদি কারো প্রতি অনেকটা দূর্বল হয়ে যায় তাহলে সেই দূর্বলতা ভয়ানক রূপ নিতে পারে।কিছু দিনের সম্পর্ক অনেকসময় হাজার দিনের কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।"


এইবার এই মেসেজের কিছুই বুঝলাম না। প্রত্যেকবারই আমার কোন সাম্প্রতিক বিষয় নিয়েই মেসেজ এসেছে।এবার ভালোবাসা নিয়ে কেন এলো? সূচনা? ওর প্রতি কি আমি দূর্বল? নাহ এতো তাড়াতাড়ি কিভাবে? আর অপরিচিত নাম্বারের মালিক,সে বলে সব অনুমান করে কথা বলে। এইসব কিভাবে অনুমান করে? নাহ আমাকে কেউ ফলো করছে।সারাক্ষণ আমার আশাপাশেই আছে কেউ একজন। আমি তাকে দেখছি না কিন্তু সে আমাকে দেখছে।আমার প্রতিটা মুহুর্ত খুব কাছ থেকে দেখছে।


ঘুম যা আসছিল, আবার চলে গেছে। এই ভাবে আর হয় না। কিছু একটা বিহিত করতে হবে।আগামীকাল থানায় যাবো।কে এই লোক? কিন্তু থানায় কি বলবো?এই মেসেজগুলো তো একটাও আক্রমনাত্মক না।তাছাড়া সহজ হিসেব, বিরক্ত লাগলে তারা আমাকে নাম্বার ব্লক করতে বলবে।আমার সব কিছু একজন দেখছে এটা কোনমতেই তাড়া বিশ্বাস করবে না। আচ্ছা নাম্বারটা ব্লক দিয়ে দেই।


টুং…


আবার মেসেজ এসেছে।

– " আমাকে কি ব্লক দিয়ে আসলে থামানো যাবে?"


ভয় পাবো নাকি অবাক হবো বুঝতে পারছি না।ভয় পাওয়ার আর অবাক হওয়ার বাধ ভেঙে যাচ্ছে।

ফোন দিবো? দিলেই বা কি?দেখা যাবে ফোন বন্ধ।তাও আরেকবার ফোন দিয়ে দেখি। সমস্যার সামনাসামনি দাঁড়ানো প্রয়োজন। 


ফোন দিলাম। এক..  দুই...  তিন.. সেকেন্ড 

রিং হচ্ছে।গলাটা শুকিয়ে গেল এক অজানা ভয়ে।বুকের ভেতরটা উত্তেজনায় ফেটে যাচ্ছে।বুকের ঢিপঢিপ শব্দ মনে হয় বাহিরে এসে পরবে।


গল্পঃ_হঠাৎ_ঝড়ো_হাওয়া

পর্বঃ_০৩ (সমাপ্ত)

লেখাঃ_হেমন্ত হাসান

-------------------------------------

ফোন দিলাম। এক.. দুই... তিন.. সেকেন্ড 

রিং হচ্ছে।গলাটা শুকিয়ে গেল এক অজানা ভয়ে।বুকের ভেতরটা উত্তেজনায় ফেটে যাচ্ছে।বুকের ঢিপঢিপ শব্দ মনে হয় বাহিরে এসে পরবে।


০৩.


রিং বেজেই চলছে।কেউ রিসিভ করলো না।আবার দেয়া উচিৎ। এবারো রিং হচ্ছে।ভেতরটা উত্তেজনায় ফেটে যাওয়ার উপক্রম। 


ফোন রিসিভ করলো কেউ একজন।প্রথমে ওপাশ পুরো নিরিবিলি মনে হলেও কয়েক সেকেন্ড পর বোঝা গেল, কি রকম একটা শব্দ যেন হচ্ছে।অনেক দূর থেকে কোন শব্দ আসছে,ফুস ফুস করে একটা শব্দ।


অনেক সাহস করে বললাম,

- "হ্যালো, কে আপনি?"


কোন উত্তর পেলাম না।আবারও বললাম,

- "কথা বলছেন না কেনো?কে আপনি?আমাকে কেন এভাবে মেসেজ দিচ্ছেন।"


এবারও চুপ।আগে যে একটা ফুস ফুস শব্দ হচ্ছিলো সেটাও এখন বন্ধ।পুরো নিশ্চুপ সব।কেন জানি আমিও ধীর হয়ে গেলাম।ও পাশের নিরবতা দেখে মনে হচ্ছে, শব্দ করা যাবে না।


হঠাৎ ও পাশ থেকে অন্যরকম একটা শব্দ আসলো।প্রচন্ড ঝড়ের মাঝে পরলে এমন শব্দ হয়। বাতাসের শব্দ শু..শু…..শু…


একবার মনে হচ্ছে ঝড়ের শব্দ, আরেকবার মনে হচ্ছে কোন দ্রুত কিছুতে কেউ যাচ্ছে সেই দ্রুততার ফলে বাতাসের একটা ধাক্কা, সেই থেকে যে শব্দ হয়, সেটা আসছে।


হঠাৎ আবার শব্দটা বন্ধ হয়ে গেল।এরপর কিছুক্ষণ সব চুপ।আমিও চুপ। এরপর একটা হাসির শব্দ। কয়েক সেকেন্ডের হাসি। তারপর ফোন কেটে দিলো।

সাথে সাথে আবার ফোন দিলাম। নাহ, ফোন বন্ধ।

হাসিটা ঠিক পুরুষের নাকি নারীর বুঝতে পারলাম না।হাসির ধরনটা জানি কেমন?কোন অনুভূতিতে মানুষ এমন করে হাসে ঠিক ধরতে পারলাম না।

ভয় কেটে গেছে।এখন সেখানে জায়গা করে নিয়েছে বিষ্ময় হওয়া।


.


মাথাটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।কোন বাজে কিছুর সাথে কি আমি জরিয়ে পরলাম।এই নাম্বার ব্লক করতে চাইলাম, তখনই মেসেজ।


সূচনার প্রতি একটু ভালোলাগা কাজ করেছে তখনই মেসেজ।নাহ,কেউ একজন কিভাবে পারে?আমি কি চিন্তা করছি হয়তো আমার সামনে থেকে কেউ অনুমান করতে পারবে কিন্তু এভাবে কিভাবে পারে?

সব কিছু গুলিয়ে যাচ্ছে।


টুং... 


আবার মেসেজ এলো।সূচনার মেসেজ, সেই উটকো মেসেজ না।


- "ফোন দেয়া যাবে?"


এখন সূচনার সাথে কথা বললে হয়তো একটু ভালো লাগবে। তাই আমিই ফোন দিলাম।


সূচনা ফোন ধরলো।

- "কই নাচের পর তো আপনাকে আর দেখলাম না।"


- "ছিলাম তো আরও কিছুক্ষণ। এরপর চলে এসেছি।"


- "ভালো লেগেছে আপনার?"


- "কি?নাচ?"


- "হুম..?"


- "অনেক ভালো লেগেছে, এরকম নাচ আমি আগে কখনও দেখি নি।"


- "কই, এটা তো কমন নাচ। প্রায় সব জায়গাতেই দেয়।"


- "আসলে আমি নাচই দেখি নি বেশি।"


কথাটা বলে একটু হাসলাম।সূচনাও হাসলো।সূচনার হাসি শব্দ বুকে খুব জোরে আঘাত করে।কেন করে জানি না।


.


আরও কিছুক্ষণ এলোমেলো কথা বলে ফোন রাখলাম।একটা মেয়ের সাথে কত কম পরিচয়। কিন্তু কত তাড়াতাড়ি ঘনিষ্ঠ হয়ে গেলাম।মনে হচ্ছে অনেকদিন ধরে চিনি আমি সূচনাকে।গান গাইতে মন চাচ্ছে। ‘এই বৃষ্টি ভেজা রাতে তুমি নেই বলে,সময় আমার একা কাটে না।’ গানটা বাজিয়ে দিলাম।ঠিক করেছি আগামীকাল সকালে নাম্বার চেঞ্জ করবো।এই সিম ই আর ব্যাবহার করবো না।একেবারে মাথা ব্যথায় এবার মাথাই কেটে ফেলবো।


সূচনাকে আবার ফোন দিতে মন চাচ্ছে।তবে অনুমতি ছাড়া এভাবে ফোন দিতেও ইচ্ছে করছে না।মেসেজ দিতেও ভাল লাগছে না।মেসেজের প্রতি একটা ভয় একটা বিরক্তি ভাব কাজ করে।মনে মনে ভাবলাম থাক আগামীকাল সকালে কথা বলবো সূচনার সাথে।তখন ফেসবুক আইডিও চেয়ে নিবো।এই যুগে এসে মেসেজে কথা বলতে কে চায়?


.


রাত বারোটার মত বাজে।গায়ে হলুদের গান-বাজনা এখন বন্ধ হয়েছে।যদিও এখনকার হলুদ অনুষ্ঠান রাত তিনটা চারটার আগে শেষই হয় না।

মেসেজের চিন্তায় ঘুম আসতে চায় না।আবার আরেকটা সূক্ষ্ণ চিন্তা,সূচনার কথা মাথায় ঘুরছে।চোখ বন্ধ করলেই সূচনার নাচের দৃশ্যগুলো চোখের সামনে ভেসে আসছে।

.


বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছি।আগে যখন এভাবে ঘুম আসতো না তখন জানালার পর্দা সরিয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকতাম।আমার বিছানার পাশেই জানালা।খুব সুন্দর আকাশ দেখা যায় বিছানা থেকেই। কিন্তু আজকে আকাশে মেঘ।চাঁদ দেখা যাচ্ছে না।ঠান্ডা বাতাস আসছে জানালা দিয়ে।


.


হঠাৎ মোবাইলটা কেঁপে উঠলো।আবার মেসেজ।সেই অপরিচিত রহস্য ঘেরা নাম্বার থেকে।


– " মানুষ আনন্দে, দুঃখে আর দুশ্চিন্তায় ঘুমাতে পারে না।চেষ্টা করাও বৃথা। "


একটা জিনিস খেয়াল করছি।গতকাল থেকে প্রায় সব মেসেজগুলোই আমার মনের কনফিউজড বিষয়গুলোর উপর আসছে।অদ্ভুত! কেউ আমার মন পড়ছে।কোথা থেকে পড়ছে, কে পড়ছে কিছু জানি না।


এই রহস্য ঘেরা নাম্বারের মালিক কে জানি না।তবে যেই হোক এটা নিশ্চিত খুবই অদ্ভুত এবং অন্যরকম ক্ষমতা সম্পন্ন কেউ। তাহলে আমি যদি নাম্বার চেঞ্জ করি কোন লাভ হবে না।কারন যে আমার মন পড়তে পারছে সে মন থেকে নাম্বার ঠিকই নিতে পারবে।মন না মস্তিষ্ক? যাই হোক।নাম্বার তার কাছে চলেই যাবে।


টুং... মেসেজ!


– "ঠিক। নাম্বার আমি ঠিকই পাবো।"


আর অবাক হবো না।ভয়ও পাবো না।চেষ্টা করি এই অদ্ভুত সত্তার সাথে যোগাযোগ করার।


ফোন দিলাম ,সেই একই ঘটনা।ফোন বন্ধ।উত্তেজনা একটু বৃদ্ধি পেলেও আগের থেকে কম।মানুষ আগুনের পাশে থাকতে থাকতে একটা সময় অনেক উচ্চ তাপও সহনীয় হয়ে যায়।


.


ঝড় হতে পারে।জানালা দিয়ে বাতাস আসছে। পর্দাগুলো বাতাসে এলোপাথাড়ি উড়ো উড়ি করছে।বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে কিছুক্ষণ পর পর। ঘুম মনে হয় আর আসবে না। আবার মোবাইলটা কেঁপে উঠলো।সেই অচেনা নাম্বার, 

"ঘুম আসবে না।জীবনে সুন্দর কোন দৃশ্য দেখতে চাইলে ছাদে আসা উচিৎ। আসুন।"

.

ঘুম আসছে না ঠিকই।কিন্তু এখন ছাদে যাওয়া ঠিক হবে?

যদি মেরে ফেলে।তবে ভয়হীন ভাবে থাকা যায়।এটা কোন সাধারণ মানুষ না।কোন চোর বা ডাকাত হওয়ার সম্ভাবনা নেই।প্রতারক হওয়ারও সম্ভাবনা নেই।মানুষ আর যাই করুক আরেকজনের মনের কথায় বার বার উত্তর দিতে পারে না।তাও আবার আমার আশেপাশে না থেকে।

.


আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালাম।টেবিলে রাখা পানিটা এক চুমুকে খেয়ে রওনা দিলাম ছাদের উদ্দেশ্যে। যা হবার হবে।


আমাদের ছাদটা দুই ভাগে বিভক্ত। সিড়ি দিয়ে উঠে ছাদে প্রবেশ করলে এক পার্ট,এরপর একটু সামনে গেলে দুই নম্বর পার্ট দৃশ্যমান হয়।দুই নম্বর পার্টে অনেকগুলো ছোট ছোট ফুলের গাছ লাগানো। 

সিড়ি দিয়ে উঠে প্রবেশ করলাম ছাদে।ঠান্ডা ঠান্ডা একটা বাতাস স্পর্শ করে গেল।ঝড় আসার আগে হঠাৎ পরিবেশটা কেমম ঠান্ডা হয়ে যায় সেরকম অবস্থা।মেঘলা আকাশ হলেও কেন জানি ঘুটঘুটে অন্ধকার না ছাদটা।কোথা থেকে জানি একটা ঝাপসা আলো ছাদ আর আমার উপরে মেঘগুলোকে মৃদু আলোকিত করে রেখেছে।


আমি আস্তে আস্তে ছাদের ভিতরে প্রবেশ করলাম।বাতাসে একটা মিষ্টি গন্ধ।দুই নাম্বার পার্টে চোখ পরতেই দেখলাম সেখানে কেউ একজন দাঁড়িয়ে। হালকা ভয় পেয়ে গেলাম।


আরেকটু সামনে এগোতে দেখলাম,একটা মেয়ে।হালকা নীল শাড়িতে উল্টো দিক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।আমি তার ত্রিশ হাতের মত পেছনে। সে উপর দিকে তাকিয়ে আকাশ দেখছে।অন্ধকার আকাশ।চুলগুলো খোলা।এতো লম্বা চুল আমি আগে দেখেছি কিনা মনে হয় না।


শাড়ির আঁচল আর খোলা চুল একই সাথে বাতাসে এমন ভাবে আলোড়িত হচ্ছে যে, কোন ব্যাক্তির পক্ষেই একে উপেক্ষা করা সম্ভব না।


আমি আসলাম মোবাইল মেসেজে।এই কি সেই সৌন্দর্য? সাথে সাথে মোবাইলটা কেঁপে উঠলো। মোবাইল স্ক্রিনে সেই নাম্বার। মেসেজ এসেছে,


– "নাহ। সৌন্দর্য দেখা বাকী আছে।"

.


ঝড় যেকোন সময় নেমে যাবে।বাতাসের প্রবাহ দ্রুত হচ্ছে।সাথে ওই মেয়ের চুল আর আঁচলের আন্দোলনও। মেয়েটা পেছনে ঘুরছে।এতো রাতে একটা মেয়ে ছাদে।এই প্রশ্নটা আমি করবো নাকি এতো রাতে ছাদে কি করেন এই প্রশ্নটা মেয়েটা করবে ভাবতে ভাবতে মেয়েটা পেছনে ঘুরে দাঁড়ালো। মেয়েটার চেহারা দেখে ভিষণ একটা ধাক্কা খেলাম। সূচনা!!


কিন্তু এই ছাদে কেন?এতো রাতে? এটা কি সূচনাই।সূচনার মতই কিন্তু একটা গুরুগম্ভীর ভাব মুখে, চোখে, হাঁটায়। আস্তে আস্তে আমার দিকে এগিয়ে আসছে।আমি এতোটাই অবাক হয়েছি যে মুখ দিয়ে কিছু বের হচ্ছে না।সে আমার দিকে এগিয়ে আসছে আর বাতাসে তার চুল আর শাড়ির আঁচল উড়ছে।তার পেছনে মেঘ, ঝড়ো বাতাস আর বিদ্যুৎ চমকানো আকাশ।


আমার এক হাত সামনে দাঁড়িয়ে সূচনা।এখন কিছু না বললেই না।


- "সূচনা, আপনি এতো রাতে এখানে?"


সূচনা হাসলো।তার ব্যাক্তিত্বে অনেক পরিবর্তন দেখতে পারছি।আগের মত হাসি না।এই হাসি কেমন যেন, ঘোর লাগিয়ে দেয়।


- "আমি সূচনা না।আমি, আপনাকে মেসেজ দেয়া সেই সত্তা।"


- "তাহলে আপনিই মেসেজগুলো দিচ্ছিলেন?"


- "আমিই দিচ্ছিলাম।"


- "তাহলে আপনি ইচ্ছে করেই আমার কাছে ঠিকানা চেয়েছিলেন আজ সকালে।"


- "আমি সূচনা না।সূচনা এখন ঘুমোচ্ছে।"


.


আমার মাথা ঘুরাচ্ছে।সামনে সূচনা দাঁড়িয়ে।কিন্তু বলছে সে সূচনা না।সূচনা ঘুমোচ্ছে।তাহলে কে আমার সামনে দাঁড়িয়ে।


- "আপনার সামনে যে দাঁড়িয়ে সে অনেক দূরের একজন।মানুষের ধারনার বাহিরে।মানুষ এখনও ওই দূরের কথা চিন্তাও করতে পারে নি।"


- "আপনি কি অন্য জগৎ এর কেউ?সিনিমায় দেখা এলিয়েন। "


- "নাহ।"


- "তাহলে?"


- "মানুষকে বোঝানো যাবে না।মানুষ এ ধারনার বাহিরে। "


ঝড়ো বাতাস বেড়ে যাচ্ছে সাথে ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকানো।মাঝরাতে এভাবে একটা পরিচিত নাকি অপরিচিত মেয়ের সাথে দাঁড়িয়ে আছি।রহস্যময়ী মেয়ে।


- "আমার কাছে কি চান?"


- "আপনার কাছে কিছু চাই না।"


- "তাহলে গতকাল থেকে যে মেসেজগুলো দিলেন?"


সূচনা নাকি অন্যকেউ, একটু হাসলো।এই হাসির কোন অর্থ নেই।মূর্তির চোখে যেমন চঞ্চলতা নেই ঠিক এই হাসিতেও কোন আকর্ষণ নেই।মেয়েটার শাড়ি পরে যাচ্ছে। কিন্তু শাড়ি ঠিক করার কোন লক্ষণ নেই।


মেয়েটা বললো,

- "আসলে কাকতালীয় ভাবে আপনার উপরই পরিক্ষা চালাচ্ছি। আমি আসলে মানুষের মনের উপর পরিক্ষা করছিলাম।আর সাব্জেক্ট হিসেবে আপনাকে নিয়েছি। মন বলি কেনো? মস্তিষ্ক হবে।মন বলতে কিছু নেই।


আমি আপনার মস্তিষ্ক প্রায় পুরোটা পড়েছি।যদিও আমি বলেছিলাম অনুমান করে বলি কথাটা মিথ্যা।একটু স্বস্তিতে রাখতেই আপনাদের মিথ্যা বলা।মানুষের মস্তিষ্ক আসলে খুব বিচিত্র। পুরোটা ধরা যায় না। তবে মস্তিষ্কের একটা জায়গা আছে যার ক্রিয়াকলাপকে আপনারা মনের খেলা বলেন।সেখানে কালকে থেকেই একটা নতুন মুখ জেগে উঠেছে।"


আমি তার কথা কিছুই বুঝছি না।সূচনা নাকি অন্য কেউ বলেই চলেছে।


- "দেখুন আপনার মনে অনেকগুলো মুখ আছে।আপনার বাবা-মা,ভাই-বোন,সবারই আলাদা একটা করে জায়গা সেখানে রাখা আছে।এদের কোন বিকল্প নেই আপনার কাছে। কালকে থেকে সেই জায়গায় আরেকটা মুখ আসছে যার কোন বিকল্প এই পৃথিবীতে নেই।"


একটু একটু তার কথা বুঝতে পেরেছি।


আমি বললাম,"

- 'কে সে?কার মুখ?'


- 'আপনার সামনে যে এতোক্ষণ যে দাঁড়িয়ে।'


- 'কে সূচনা?'


মেয়েটা হাসলো।আবার সেই ঘোর লাগানো হাসি কোন মিষ্টতা নেই। 


মেয়েটা বলল,

- "হুম।"


- "আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না।"


- "একদিন ঠিকই বুঝতে পারবেন।"


.


হঠাৎ দমকা হাওয়া শুরু হলো।বাতাসে তেজ এমন ভাবে বেড়ে চলেছে মনে হচ্ছে আমাকেও উড়িয়ে নিয়ে যাবে।বাতাসে আর মেয়েটা অবহেলায় মেয়েটার শাড়ি এখন পুরো খুলে গেছে।লাল ব্লাউজে এখন এক মানবী দাঁড়িয়ে আমার সামনে।যে সুচনার মতই কিন্তু সূচনা না।তার খোলা চুল শাড়ি খুলে যাওয়ার পর আরও দীর্ঘ মনে হচ্ছে।


ভ্রম নাকি জানি না।তার খোলা চুল তার দেহকে জরিয়ে ধরছে।পুরো দেহ তার চুলে ঢাকা পরে গেছে।সে আস্তে আস্তে আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।ঝড়ের তীব্রতা বেড়েই চলেছে।


মেয়েটা আমার থেকে এখন প্রায় বিশ হাত দূরে এখন।কই এই মেয়ে তো সূচনা না।এখন অন্য কারো মুখ সেখানে। নারী নাকি পুরুষ তাও বোঝা যাচ্ছে না এখন আর।চুলে আবৃত সারা দেহ।মুখটা অস্পষ্ট হয়ে গেছে।


হঠাৎ মেয়েটার থেকে একটা শব্দ ভেসে আসলো

ঠিক পুরুষ নাকি নারীর গলা বোঝা গেল না।


– "তোমার কিছুই মনে থাকবে না।এই মেসেজের কথা, এই রাতের কথা।সূচনা থাকবে তোমার পাশে।ওকে হারিয়ে ফেল না।"


মনে থাকবে না? রাফির তো মনে থাকবে।ও আমাকে জিজ্ঞেস করবে, তখন আমার মনে পরবে।পরক্ষণেই খেলে গেল এসব আমার মাথায়।


আবার শব্দটা ভেসে আসলো,

– "তুমি ফেরার সাথে সাথেই রাফি সব ভুলে গেছে।"


হঠাৎ কোথাও জোরে বজ্রপাত হলো।একটার পর একটা বজ্রপাত। আলোকিত হয়ে যাচ্ছে চারদিক বিদ্যুৎ চমকানোর ফলে।সেই আলোতে দেখতে পেলাম এতোক্ষণ যাকে সূচনা ভেবেছিলাম সে সূচনা নয়।সে নারী নয়, পুরুষ নয়।সে যে কি, বোঝানো যাচ্ছে না।


বৃষ্টিও শুরু হয়ে গেছে।ভিজছি এই মাঝরাতে।বাতাসের প্রবাহ আরও দ্রুত হয়ে গেল।বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় দেখতে পেলাম সে উড়ে যাচ্ছে খুব দ্রুত উপরের দিকে।যেতে যেতে বজ্রপাতের মত জোরে একটা শব্দ এলো, 


– "ভুলে যাবে সব।এই রাত, আমাকে। "


হঠাৎ মাথায় তীব্র যন্ত্রণা শুরু হলো।

আমি জ্ঞান হারচ্ছি,আমি জ্ঞান হারাচ্ছি…


সমাপ্তি….. হঠাৎ_ঝড়ো_হাওয়া


[সমস্ত ঘটনা কাল্পনিক। প্রশংসা এবং সমালোচনা উভয়ই গ্রহনযোগ্য। দোষ- ত্রুটি, ভালোলাগা মন্তব্য করে জানাবেন। ধন্যবাদ, কষ্ট করে পড়ার জন্য।]


পর্বের আরও গল্প পড়ুন।