অবহেলার কষ্টের স্ট্যাটাস | খুব কাছের মানুষের অবহেলা

অবহেলার কষ্টের গল্প

অবহেলার কষ্টের গল্প

 -- "বউমা, তোমার গলার চেনটা দাওনি আমায়।"


শাশুড়ীর কথায় তার পানে অসহায় চোখে চায় সুনয়না। রিদম আর সুনয়নার বিয়ে হয়েছে আজ ছয়মাস হলো। বিয়ের রাতেই সমস্ত গয়না শাশুড়ী মায়ের হাতে তুলে দিয়েছিলো সুনয়না। চেনটা তার মায়ের দেওয়া। সুনয়নার ভিষণ প্রিয়। তাই দেওয়া হয়নি। আজ শাশুড়ী চেয়ে বসলেন। রিদম এই বাড়ির বড় সন্তান। বয়স পয়ত্রিশ পেরিয়েছে। তিনবোন, দু ভাই তারা। রাশেদ সাহেব, রিদমের বাবা শয্যাশায়ী। বাইশ বছর বয়স থেকেই পরিবারের সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলো রিদম। ভাইকে ডাক্তারী পাশ করানো, দু বোনের বিয়ে দেওয়া সবই করেছে। কিন্তু নিজের দিকে খেয়াল করা তার হয়ে উঠেনি। বয়স ত্রিশ পেরোলেও কেউ তার বিয়ে নিয়ে মাথাই ঘামায়নি। কত রাত একাকিত্বে কাটিয়েছে। একটা সঙ্গীর জন্য ছটফট করেছে। লজ্জায় মুখ ফুটে মাকে বলতে পারেনি। হয়তো মা বুঝেছেনও ছেলের অস্থিরতা। কিছু বলেন নি তিনি। তিনমেয়ের বিয়ে বাকি, ছোট ছেলেটা ডাক্তারি পড়ছে। স্বামী শয্যাশায়ী। এমন অবস্থায় রিদমের বিয়ে দিলে তাদের পরিবারের কি হবে? মনে ভয়ও ছিলো মা অন্তপ্রাণ ছেলে যদি আবার বউ পাগল হয়ে যায়! মায়ের আঁচল ছেড়ে যদি বউয়ের আঁচল ধরে? সংসার চালাবে কে? দিন গিয়ে মাস, মাস গিয়ে বছর। সবার জন্য খাটতে খাটতে অবশেষে উনিশের সুনয়নাকে বড়ই মনে ধরেছিলো রিদমের। ব্যবসার কাজে পদ্মার পাড়ে এক গ্রামে গিয়েছিলো। সেখানেই কোঁকড়া চুলের শ্যামবতীকে সুবিস্তীর্ণ এক মাঠে গালে হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখে মনের ভিতর অস্থিরতা অনুভব করে রিদম। বহু রাগ, জেদ দেখিয়ে বিয়ে করে তার শ্যামবতীকে। মায়ের কথা ছিলো এখনো তো ছোট ছেলের বিয়ে বাকি, ছোট মেয়েটার বিয়ে বাকি। জীবনে প্রথমবারই মায়ের কথা অমান্য করে রিদম। সুনয়নার প্রতি এক অদ্ভুত রাগ রিদমের মা আম্বিয়ার। বিয়ের রাতে সব গহনা নিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। গলার চেনটাও উনার সহ্য হয়নি। তাই চেয়ে বসলেন। সরল মনের সুনয়না স্বামী আজ্ঞা পালনে নিজের মায়ের শেষ চিহ্নটাও তুলে দিলো শাশুড়ির হাতে। সারাদিনের হাড় ভাঙা খাটুনি শেষে খাটের উপর মন খারাপ করে বসে আছে সুনয়না। রিদম পাশে বসে ব্যবসায়িক কাজ করছে।


-- "সুনয়না"

-- "জ্বি"

-- "তোমার কি মন খারাপ?"

-- "কই নাতো।"


সুনয়নাকে একটানে বুকের উপর নিয়ে আসে রিদম। আলতো করে এলোমেলো চুলগুলো গুঁজে দেয় কানের পাশে। 

-- "মন খারাপ কেন? বাড়ির কথা মনে পড়ছে?"

-- "তেমন কিছু না।"


বলেই স্বামীর বুকে মাথা দিয়ে ফুঁপিয়ে উঠে সুনয়না। বুকটা ছেৎ করে উঠলো রিদমের। সুনয়নার ভেজা আঁখিতে চুমু এঁকে দেয় সে। শুষে নেয় অশ্রু। 


-- "কি হয়েছে বলো আমাকে?"


সুনয়না কিছুই বলেনা রিদমের বুকে মাথা রেখে চুপটি করে বসে থাকে।


-- "তোমার গলা খালি কেন? মা কি চেন নিয়ে নিয়েছে সুনয়না?"


এবারেও সুনয়না নিশ্চুপ। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রিদম। পরদিন সন্ধ্যে নামার আগেই সুনয়নার গলায় নতুন চেন, কানে নতুন দুল। হাতে মোটা বালার ঝলক দেখা যায়। রিদম কিনে পড়িয়ে দিয়েছে। তা নিয়েও মায়ের সাথে তর্ক করতে হয়েছে। ছোটো ছেলের বিয়ে হয়েছে এক ডাক্তার মেয়ের সাথে। তাদের কদর বাড়িতে অনেক। দুবছর পেরোলেও সন্তান জন্ম দিতে পারেনি সুনয়না তা নিয়েও কত খোঁটা। ননদগুলো তো ওৎ পেতে থাকে। মেঝো ননদ থাকেন পাশের ফ্ল্যাটেই। প্রতিদিন এসে একটা না একটা সুনয়নার খুঁত না ধরলে তার আবার মন ভরেনা। সুনয়নার স্বামীর পয়সায় সংসার চলে অথচ তার কত বঞ্চনা। কেবল ভরসার জায়গা একজনই। সুনয়নার রিদম সাহেব। মা, বোনের উপর কথা না বললেও লোকটা তাকে ভিষণ ভালোবাসে সুনয়না জানে। ছোট ছেলের বউয়ের ছেলে হয়েছে। তবে সুনয়নাকে ধরতে দেওয়া হয়না। যেদিন শাশুড়ি মা মুখের উপর বললো, 


-- "বন্ধ্যা মেয়ে মানুষের বাচ্চা ধরতে হয়না।" সেদিন রিদমের বুকে মাথা রেখে খুব কেঁদেছিলো সুনয়না। 


সুনয়নার একটা মেয়ে হয়েছে। এবারেও মেয়ে নিয়ে কথা শুনতে হয়েছে তাকে। পরপর আবারও মেয়ে হয়েছে তার। বাড়িতে বিল্ডিংটা তুলেছে রিদম। নিজের টাকা দিয়ে। কত পরিশ্রম করতে হয়েছে তাকে! সম্পত্তি ছিলো মায়ের নামে। বাবা মারা যাওয়ার পর আজ হুট করেই শুনে বাড়িটা ছোট ছেলেকে লিখে দিয়েছেন তিনি। অবাক হয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলো রিদম। মা বলে দিয়েছেন,


--  "ছোটোর দুই ছেলে। তাদের ভবিষ্যত আছে। তোর মেয়েদের তো বিয়ে দিলে পরের বাড়ি চলে যাবে।"


রাগে, কষ্টে সুনয়নাকে নিয়ে বাড়ি ছেড়েছে রিদম৷ সুনয়না যেন একটা মুক্ত জীবন পেলো। জমজ ছেলে হয়েছে তাদের। কি সুন্দর সংসার। রিদম অবশ্য মাঝে মাঝে বলে, 


-- "যাদের জন্য জীবনটা শেষ করলাম তারা আমাকে ধোঁকা দিলো সুনয়না। বড় সন্তানদের কি বাবা-মায়েরা একটুও বুঝতে পারেনা? সব আদর কেন ছোট সন্তানের বেলায়? মা ওদের সবাইকে ভালোবেসেছে সুনয়না। কেবল আমায় ভালোবাসেনি।"


স্বামীর বুকে মাথা রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুনয়না। 


(সমাপ্ত) 


ছোটগল্প - বড়_সন্তান


মন ছুঁয়ে যাওয়া গল্প পড়ুন।