জীবন সংসার | সংসার জীবনের কষ্ট | সংসারে অশান্তি

সংসার কাকে বলে

সংসার কাকে বলে

আমার বিয়ের সময় শ্বশুর বাড়ি থেকে নয় ভরি স্বর্ণের গহনা দিয়েছিলো আমাকে।যা বিয়ের পর প্রথম সাতদিনই গায়ে জড়ানো হয়েছিলো আমার। তারপর থেকে তা কখনোই গায়ে জড়ানোর সুযোগ হয়নি।এমনকি বড় কোনো অনুষ্ঠানে গেলেও না।একটা এয়ারিং হারিয়ে ফেলার অপরাধে এভাবে শূন্য হাতে, শূন্য গলায় সব খানে যেতে হতো আমাকে।নেহায়েত স্বামীর অমঙ্গল হবে এই কুসংস্কার মানতেন বলে নাকে ও কানে অতি সামান্য স্বর্ণের রিং পড়তে দিতেন তিনি।হাতের জন্য বরাদ্দ থাকতো সিটি গোল্ডের চুরি।আর বাকি সব গহনা শাশুড়ী মা নিজের কাছে গচ্ছিত রাখতেন।সবগুলো তাদের পয়সায় কেনা বলে অধিকারও দেখাতে পারতাম না কখনো।এটা নিয়ে কখনো মুখ ফুটে কিছু বলিনি আমি।গরিব ঘরের মেয়ে বলেই হয়তো বলা হয়ে ওঠেনি।ওই গহনা গুলো পড়ার সাধ আমার থাকলেও সাধ্য যে ছিলো না।


যেকোনো বিয়ে বা অনুষ্ঠানে গেলে আমার বয়সী থেকে শুরু করে মাঝবয়সীদের গায়ে ভারী গহনা দেখে ভীষন সাধ জাগতো পড়তে।তাই একদিন আমার স্বামীকে ইচ্ছে জানিয়ে বলেছিলাম,


"আমায় গহনা পড়লে কেমন লাগবে দেখতে ইচ্ছে করে না তোমার?আমার না খুব গহনা পড়ে তোমার সামনে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে। "


জবাবে সে ভাবলেশহীন কণ্ঠে বলেছিলো,


"তোমাকে এমনিতেই অনেক সুন্দর লাগে।গহনা কারো চেহারা বদলাতে পারে না।"


তার এমন জবাবের মূল কারণ তখনও বুঝতাম না আমি।তাই মনটা ভারী করেছিলাম।গহনা চেহারা না বদলালো আমার মনের মেঘ তো বদলাতে পারবে।এই যে এখানে সেখানে এমন ভাবে যাওয়া নিয়ে কতজনে কত কথা শোনায় আমাকে।এসব তো শুনতে হবে না।এসব ভেবে মন ক্ষুন্ন করেছিলাম আমি।সে হয়তো এটা অনুভব করেছিলো।তাই তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলেছিলো,


"বেকার ছেলের বউদের গহনা পড়ার সাধ থাকতে নেই শ্রেয়া।যদি কখনো তোমার স্বামী গড়িয়ে দিতে পারে তবেই গহনা পড়ো।অন্যথায় তোমার স্বামীকেই নিজের গহনা ভেবো।"


কথাগুলো বলে মাঝ রাতেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো সে।আর আমি তার মনের বেদনা বুঝে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম।সেদিনের পর আর কখনো মুখ ফুটে গহনার কথা বলিনি আমি।বিয়ে বা অন্য কোনো অনুষ্ঠানে খুব একটা যাইওনি।তাদের ওসব কথা শুনে যদি মন বিষিয়ে যায় সেই ভয়ে তাদের সঙ্গ এড়িয়ে চলেছি সারাক্ষণ।


এভাবে কেটে গেলো প্রায় দশটি বছর।এর মাঝে আমার শ্বশুর গত হলো।শাশুড়ীর গায়ের সব গহনা খুলে নেওয়া হলো।একজনের মৃ'ত্যুতে মানুষটা কেমন ভেঙে গেলো।কয়েকদিনের শোকে দুঃখে তার বয়স বেড়ে আশির কোটায় গিয়েছে মনে হলো।তিনি নিজের কোনো যত্ন নিতেন না। ঠিক ঠাক খাওয়া দাওয়াও করতেন না।এই সব দেখে আমিই তার সেবা যত্ন শুরু করি।তার খাওয়ানো থেকে শুরু করে তার পোশাকাদি আমিই ধুয়ে দেই।তার মাথা আঁচরে পরিপাটি করে দেই।এভাবে ধীরে ধীরে দিন পেরুলো।তার শোকও কে'টে কমে গেলো।তিনি এখন পানের বাটা নিয়ে বারান্দায় বসে সারাদিন পান চিবান ও একা একা গল্প করেন।মাঝে মধ্যে দুই একজনের সঙ্গ পেলে আলাপ জমিয়ে তোলেন বেশ।আমার আদর যত্নের প্রশংসা করেন।আমি কাজের ব্যস্ততার ফাঁকে এসব চেয়ে চেয়ে দেখি।এক সময় এই তিনিই আমার প্রতিটা কাজে ভুল ধরতেন।কাজ পারি না এসব নিয়ে  সমালোচনা করতেন অন্যদের কাছে।আজ তার মাঝেই কত বদল।


আমার শাশুড়ি মায়ের মাঝে কতটা বদল হয়েছে তা কয়েকদিন পর আমি আরও টের পেলাম।দুপুর বেলায় ক্লান্ত শরীরে ঘরে শুয়ে আছি আমি।হঠাৎ দেখি আমার শাশুড়ী হাতে একটা বাক্স হাতে নিয়ে আমার ঘরে এলেন।ভিতরে প্রবেশ করে বললেন,


"এই নেও মা।তোমার সব গয়না বুইঝা নেও।ওসব গয়না খুইলা হাতে ও কানে এই গয়না গুলা পড়ো।এগুলা হলো তোমার বিয়্যার গয়না।এসব পড়ায় মজা আছে।এসব গয়না তুলে রাইখা কি হইবো কও।এমনি এমনি যাকাত দিয়া,লাভ আছে?"


মায়ের কথা শুনে অবাক না হয়ে পারলাম না আমি।যেই গহনা নিজের কাছে ছিনিয়ে নেওয়ার সময় কত কটু কথা শোনালেন, এমনকি গহনা হারিয়ে ফেলেছি বলে একবেলার খাবারও বন্ধ করলেন সেই তিনিই আমাকে গহনা ফেরত দিতে এসেছেন?


আমি বিষ্ময় আড়াল করতে না পেরে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে।আমাকে এভাবে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে বিব্রত বোধ করলেন তিনি।কিছুটা লজ্জাও পেলেন মনে হলো।হয়তো তিনি ভাবছেন আমার বউ কালের জীবনটা তিনি কেমন করে নষ্ট করেছিলেন।আমার শখ ইচ্ছে কি করে মাটি করে দিয়েছিলেন।যেই সময়ে গহনা পড়ে সেজেগুজে ঘোরার কথা ছিলো তখনই এসবের হক থেকে তিনি আমাকে বঞ্চিত করেছিলেন।আজ এই বয়সে এসে স্বামী হারানোর পর নিজ শরীরে গহনার কোনো ছিটেফোঁটাও নেই তার।আর এই সময়েই তিনি আমাকে এসব ফেরত দিচ্ছেন বলে বিব্রত হচ্ছিলেন হয়তো।আমি তার দিকে তাকিয়ে এসবই আঁচ করলাম।তারপর তার হাতের দিকে তাকালাম।বাক্সের ভিতরে ভরি ভরি স্বর্ণ পড়ে আছে।যা অনাগ্রহ হয়ে দেখে নিলাম।


আমার এই গহনার প্রতি আর কোনো মোহ অবশিষ্ট নেই।কোনো মেয়ের এই বয়সে এসে সংসারে জড়িয়ে যাওয়ার পর গহনা পড়ে ঘুরে বেড়াতে মন চায় না।কিন্তু তবুও ওনার এগিয়ে দেওয়া বাক্স থেকে কানের গহনা,বালা এসব বের করে গায়ে জড়িয়ে নিলাম।উনি উৎফুল্ল হয়ে গলায় হাড়ও পড়তে বললেন।আমি পড়লাম।আমি চাইলেই আজ কথার জালে আটকে ফেলতে পারতাম ওনাকে।আমি যখন চেয়েছি তখন দেয়নি বলে এখন এসব ফিরিয়েও দিতে পারতাম।এখন আমার নিজেরই অল্প কিছু গহনা গড়ানো হয়েছে।তাই এসবে কোনো আগ্রহ নেই আমার।কিন্তু এসবের কিছুই করলাম না আমি।মুখ ফুটে কিছু বললামও না।কেনো যেনো তার মন ভাঙতে মন চাইলো না।তাই তার মন রাখার গল্প রচিত করলাম।তিনি একসময় ভুল করে আজ অনুতপ্ত হয়েছেন।আর অনুতপ্ত মানুষকে ফিরিয়ে দিয়ে প্রতিশোধ নেওয়ার মাঝে কোনো সার্থকতা দেখলাম না।কারণ কষ্ট দিয়ে প্রতিশোধ সবাই নিতে পারে।কিন্তু ক্ষমা করে আগলেও কেও নিতে পারে না।অথচ অনুতপ্ত মানুষদের আগলে নেওয়ার মাঝেই থাকে আসল সার্থতকতা।


-সমাপ্ত -অনুগল্প

গল্প-গহনা

স্বামীর সংসার

দুই ভ্রুর ঠিক মাঝখানে ব্রন উঠেছে। ব্রনটাকে ঢাকতে কালো টিপ পরলাম। নীরু আপা আয়নায় আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললো,


-- 'তুই কোন ব্যাটার সাথে ঢলাঢলি শুরু করছিস বল তো?? দিন দিন এত সুন্দর হচ্ছিস।'


- 'ছি!! নীরু আপা। ঢলাঢলি কি শব্দ!'


- 'হইছে আর ঢং করিস না। যা করার বুঝে শুনে করিস, পুরুষ মানুষ হচ্ছে দু'মুখো সাপ। ওরা........ '


- 'নীরু আপা, আমার স্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছে। গেলাম আমি।'


ব্যাগটা নিয়ে এক ঝটকায় বেরিয়ে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। নীরু আপা দুই টাইম ডির্ভোসী। তার কাছে পুরুষ মানেই স্বার্থপর, বেহায়া, বেশরম ইত্যাদি।


.


ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরছি। দেখি ললিতাদি হেঁটে হেঁটে ফিরছে। আমি তাকে রিকশাতে ডাকতে গিয়েও ডাকলাম না।


ললিতাদির স্বামী প্যারালাইস হয়ে বাড়িতে বসে আছেন ৮ বছর। তিন কন্যা আর সংসারেরর খরচ চালাতে দিনে অফিসের পাশাপাশি রাতে টিউশন করান। তিনি কখনই রিকশায় উঠেন না। কেউ ডাকলেও উঠেন না। এতটাই আত্মসম্মানবোধ।

'

'

'

'

'

পাঠক, এবার আমার কথা বলা যাক। আমি মিলি। এখানকার স্থানীয় হাইস্কুলে শিক্ষকতা করি। গার্লস হোস্টেলে থাকি। নীরু আপা আর ললিতাদি হচ্ছে আমার রুমমেট। দিন শেষে তিনজন ক্লান্ত হয়ে একই ঘরে ফিরি।


ভিন্ন বয়সী তিনজন নারী নিজেদের গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ি। প্রতি রাতে ঘুমানোর সময় নীরু আপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,


- 'মিলি, তুমিই বেশ আছো। বিয়ে হয় নি তাই কোনো পিছুটান নেই।'


ললিতাদি ও নীরু আপার কথায় মাথা নাড়েন। মুখে বলেন,


- 'হ্যা। আমাকে দেখো, স্বামী, সন্তান থাকতে ও আমি ঘরছাড়া। এর চেয়ে বিয়ে না হলেও ভালো ছিল।'


আমি তাদের কথায় হাসতে হাসতে বলি, 

- 'এজন্যই তো আমি চিরকুমারী থাকবো। টেনশন ফ্রি জীবন।'


এরপর ওরা ঘুমিয়ে যায়। আমি কিছুক্ষণ বিছানায় এপাশ ওপাশ করে ঘুমাতে না পেরে উঠে বসি।


.


মাঝরাতে এসে বেলকনিতে দাঁড়াই। আনমনে নিজের কথা ভাবি। এক সময় খুব গল্পের বই পড়তাম। কিশোরী বয়সে জানতে পারলাম, আমি নারী হয়ে জন্মালেও আমার মা হবার ক্ষমতা নেই। তারপর থেকে বই পড়া ছেড়ে দিয়েছি। আর কোনো গল্পের নায়িকা হবো না আমি।


অর্নাসের পর তবু মা বিয়ে দেবার জন্য চেষ্টা করলো। কেউ হয়ত দু'সন্তান রেখে অন্য পৃথিবীতে চলে গেছে। তার স্থানটা আমাকে নিতে হবে। আমি রাজি হই নি। চাই নি কারো সাজানো সংসারে অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি হতে।


স্কুলের এ চাকরী টা পাবার পর পরিবার পরিচিত জন ছেড়ে এক প্রকার পালিয়ে আসি। এখানে আমার অক্ষমতাটা কেউ জানে না। নিজের অক্ষমতাকে ঢাকতে আমি সুখে থাকার ভান করি। আর দিন শেষে সবাই বলে,

- 'বাহ মিলি!! তুমি তো বেশ সুখী।' 🙂


-অণুগল্প || -তিন_নারী

-লেখা || -হাবিবা_সরকার_হিলা


মেয়েদের জীবনের কষ্টের গল্প পড়ুন।