অবহেলার কষ্টের গল্প
এই পাপ আমাকে করতে বলো না,তোমার পায়ে ধরি মা । আমি এটা করতে পারবো না। এটা অন্যায়, এটা পাপ!!
--- একদম চুপ মেরে থাকবি শিখা। পাপ- পূণ্য আমাকে শেখাতে আসবি না।একটা শব্দও যেন না শুনি।শুনলে খুব খারাপ হবে।
দরজা আটকে চলে গেছে শিখার মা।
একটু পরে শিখার ছোট বোন শশী দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো।
--- আপু..
--- শশী...বোন আমাকে বাঁচা।এতো বড় অন্যায় আমি করতে পারবো না।
শশীর চোখেও পানি এসে গেছে শিখার কাকুতি মিনতি দেখে।
আজ শিখার বিয়ে। বিয়ে নিয়ে আর পাঁচ দশটা মানুষের মতো ভাবতে পারছেনা শিখা। ওর চোখে এখন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।শিখা জানে না কি হবে, তবে এটা জানে যা হবে, খুব খারাপ কিছু হবে।
যে ছেলেটার সাথে বিয়ে, তার নাম মাহির।সেও জানে না কি হতে যাচ্ছে। জানে শুধু শিখার বাড়ির কয়েকজন মানুষ।
কনে বদলে গেছে। বিষয়টি অনিচ্ছাকৃত বা বাধ্য হয়ে করা হচ্ছে এমন নয়। এটা সম্পূর্ণ পূর্ব পরিকল্পনা করে হচ্ছে। শিখা নিজেও জানতো না। বিয়ের আগের রাতে জানতে পেরেছে বিয়েটা শিখার!! বিয়েটা ভেঙে দিবে বা ছেলেকে, ছেলের বাড়ির কাউকে জানাবে এই সুযোগও নেই।
শশী শিখাকে ধরে কাঁদছে।
--- আপু, আমি তোমার জন্য কিছু করতে পারবো না। আমাকে ক্ষমা করে দিও।
শিখা নিজেও জানে শশীর কিছু করার নেই। তবুও ভেসে যাওয়ার আগে মানুষ শেষ চেষ্টা করে,
খড়কুটো আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা।
শিখাকে বউ সাজিয়ে একটা ঘরে আটকে গেছে ওর মা।এদিকে বর এসে গেছে। বরযাত্রী অনেক দূর থেকে এসেছে। তাই খুব বেশি মানুষ আসেনি। বরের বাড়ির কেউ শিখার সাথে দেখা করার সুযোগ পায়নি।খুব কৌশলে আটকে দেয়া হয়েছে। কনের সাজ শেষ হয়নি বলে ভেতরে যাবার অনুমতি নেই কারো। বিয়ে পড়ানোর একটু আগে শিখার মা এসে কানে কানে শিখাকে বললেন
--- ঘোমটা খুলবি না, কোনো ঝামেলা না করে কবুল বলবি। না হলে এই দেখ!
বিষের শিশিটা দেখালেন। আমি তোর মা।আমি আবার অনুরোধ করছি কোনো ঝামেলা করবি না, করলে শশী আর আমি দুজনেই বিষ খাবো। এখন তুই জানিস তুই কি করবি।হয় বিয়ে করবি না হয় এটা শশীকে খায়িয়ে আমিও খাবো।
--- মা....!!তুমি আমাকে এতো একটা অন্যায় করতে বললে!! তারচেয়ে জন্মের পরে আমার গলায় বিষ ঢেলে দিতে!!
শিখারর মা মুখশক্ত করে উঠে চলে গেলেন।
.
.
.
বিয়েটা হয়ে গেছে। এছাড়া আর কোনো পথ ছিলো না শিখার।বরযাত্রী কনে নিয়ে বিদায় হলো।এখনো কেউ জানতে পারলো না কনে বদলে গেছে। শিখাকে নিয়ে বরযাত্রী ফিরে যাচ্ছে।
শিখা জলে যাচ্ছে।হা জলেই যাচ্ছে। যে শ্বশুর ঘরে যাচ্ছে সেখানে নিশ্চয়ই তার জন্য কেবল জল আর জলই আছে। ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে ওর । সাথেও কেউ আসেনি।যেন হাত পা বেঁধে জলে ফেলে পুরো পরিবার বেঁচে গেছে! এতো শত ভাবনা আর দুঃচিন্তার করতে করতে শ্বশুর ঘরে পৌঁছে গেলো শিখা। সবাই দৌড়ে এসে বউবরণ করে ঘরে তুললো।। সবাই এলো নতুন বউ দেখতে।
ঘোমটা খুলে বউ মুখ দেখাতে গিয়ে মাহিরের ভাবি ইভা চিৎকার করে উঠলো,
--- এটা কি!!!
--- কি হয়েছে? কি হয়েছে? মাহিরের মা দৌড়ে এলেন।
--- এ মেয়ে তো সেই মেয়ে না!! বউ বদলে গেলো কি করে?!!
বিস্মিত চোখে ইভা জিজ্ঞেস করলো,
--- কি! এতো বড় জোচ্চুরি!
ইভা তোমার শ্বশুরকে ডাকো। কই তুমি? তাড়াতাড়ি এদিকে আসো।মাহিরের মা মাথায় হাত দিয়ে ধপ করে বসে পড়লেন!! আমার ছেলের জীবনটা শেষ করে দিলো!
মাহির, মাহিরের ভাই মাহিন , মাহিরের বাবা সবাই চেঁচামেচি শুনে দৌড়ে এলেন।।
--- কি হয়েছে? এতো চেঁচামেচি কিসের?
--- কি হয়েছে? দেখো... দেখো...
শিখার ঘোমটা টেনে সরিয়ে দেয় মাহিরের মা।
--- একি! এ আবার কে?? এসবের মানে কি?
--- মানে বুঝোনি? তোমার ছেলের কপাল পুড়েছে! বউ বদলে দিয়েছে!. ঠকিয়েছে!!
--- কি!!
--- বাবা,তুমি এক্ষুনি ফোন করো।
মাহিন সারোয়ার সাহেবকে বললো,
--- হা.... ফোন তো দেবোই! সাথে জেলের ভাত খায়িয়ে ছাড়বো। এত বড় ফ্রড!
মাহির চুপচাপ রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে শুনছিলো। এবার সে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।শিখার দিকে ফিরেও দেখলো না।এদিকে শিখার অবস্থা! লজ্জায় অপমানে মাটিতে মিশে যেতে পারলে বেঁচে যেতো!ওর মা ওকে কিসের মধ্যে ফেলে দিলো!!এরচেয়ে মৃত্যু ঢের ভালো ছিলো।
--- এই মেয়ে তোমার নাম কি?
কি হলো কথা বলছো না কেন? সারোয়ার সাহেব ধমকে জিজ্ঞেস করলেন। শিখা ভয়ে চমকে উঠে,কাঁদতে কাঁদতে বলে,
--- শি-শিখা..
--- অহহ! এই আসল শিখা! ফ্রড তো প্রথমেই করেছে এখন বুঝতে পারছি।
সারোয়ার সাহেব শিখার মামাকে ফোন করলেন। প্রচন্ড রাগারাগি করলেন। শিখার মামা অনেক কিছু বুঝাতে চাইলেন, কিন্তু সারোয়ার সাহেব এসব কথা শুনতেই চাইলেন না।বললেন,
--- আপনাদের মেয়েকে এসে নিয়ে যান।
--- বিয়ে হয়ে গেছে। এখন আপনার বাড়ির বউ আপনি কি করবেন সেটা আপনি জানেন।।
এটা বলেই শিখার মামা ফোন রেখে দিলেন।
সারোয়ার সাহেব চিন্তায় পড়ে গেলেন।উনি এলাকার একজন সম্মানিত ব্যক্তি। যা-ই করেন না কেন ভেবে চিন্তে করতে হবে। মান সম্মানের একটা ব্যাপার আছে!!
--- কি হলো? এতো রাত হয়ে গেছে এই মেয়েকে পাঠাবে কখন?
--- একটু একা ছেড়ে দাও আমাকে। তোমার সবাই যাও এখান থেকে। আমি মেয়েটার সাথে কথা বলবো।
--- ওর সঙ্গে কথা বলে কি হবে?!! বিদায় করো এক্ষুনি।
--- আহ! যাও তো।।
সারোয়ার সাহেব অত্যন্ত রাগী মানুষ। সবাই বাঘের মতো ভয় পায় উনাকে। তাই আর কিছু বলার আগেই সবাই রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। সারোয়ার সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,
--- এই মেয়ে, তুমি জানো তুমি কি করেছো?আমার ছেলের জীবন নিয়ে তোমরা খেলেছো।এতো বড় জুচ্চুরি কেন করা হয়েছে আমাকে বলো।শিখা মাথা নিচু করে কেঁদেই চলছে।
--- কি আশ্চর্য! তোমাকে তো কথা বলতে হবে। আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু।তোমার মায়ের নাম্বার দাও।
শিখা কাঁপা কাঁপা হাতে মোবাইল থেকে ওর মায়ের নাম্বার টা বের করে দিলো। শিখার মায়ের সাথে প্রায় একঘন্টা কথা বলেন সারোয়ার সাহেব। তারপর মাহিরকে ডেকে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন। শিখা, মাহির, সারোয়ার সাহেব মুখোমুখি বসে আছে।শিখা মাথা নিচু করে বসে আছে। মাহির অন্য দিকে তাকিয়ে আছে।
--- মাহির।
--- জী বাবা।
--- জন্ম,মৃত্যু আর বিয়ে এই তিনটি জিনিস মানুষের হাতে থাকে না।এটা তুমি বিশ্বাস করো?
--- করি।
--- এই যে মেয়েটা ' শিখা', ওর সাথে তোমার বিয়ে হয়েছে ; এটাও তোমার ভাগ্যে ছিলো।তোমাকে শিখার সামনে কিছু কথা বলি।তোমরা দুই ভাই আর তোমাদের বোন আনিশা আর আনিকা, তোমরা যখন যা চেয়েছো তা-ই তোমাদের দিয়েছি।কোনো দিন কিছু চাইনি তোমাদের কাছে।আজ তোমার কাছে আমার চাওয়া আছে। এটাকে চাওয়া বলো আর অনুরোধই বলো, এটা তোমাকে রাখতে হবে।
--- বাবা,তুমি কি বলতে চাইছো?
--- শিখার সাথেই তোমার সংসার করতে হবে।
--- কিন্তু বাবা...
--- আমি তোমার কাছে কিন্তু আশা করছি না মাহির।
--- এটা ফ্রড করে বিয়ে। আমি কিভাবে..!
--- এতে দোষ থাকলে মেয়েটার পরিবারের।এই মেয়ের দোষ নেই।ওকে বাধ্য করা হয়েছে।
--- বাবা আমি...
--- এই মেয়ে এখানেই থাকবে এটাই আমার শেষ কথা। এখন যাও গিয়ে বিশ্রাম করো।
দীর্ঘ দুই ঘন্টা পরে সারোয়ার সাহেব দরজা খুলে বেড়িয়ে ইভাকে ডেকে বললেন,
--- শিখাকে নিয়ে ওর ঘরে যাও।ওর বিশ্রাম প্রয়োজন।
--- কিন্তু বাবা....
--- আমি তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছি, ইভা।
--- আচ্ছা বাবা।
ইভা মুখ কালো করে শিখাকে বললো,
--- এসো আমার সাথে।।
ইভা শিখাকে নিয়ে চলে গেলো।
.
.
.
--- তুমি এটা কি করলে? এই মেয়ে এখানে থাকবে??!! জুচ্চুরি করে বিয়ে দিয়েছে। এখন এই মেয়ে নিয়ে আমার ছেলে সংসার করবে?
--- আফরোজা, মেয়েটা এখানেই থাকবে। এটা নিয়ে কোনো কথা শুনতে চাই না।
--- কেন বলবো না? আমার ছেলের জীবন নিয়ে কথা! এই মেয়েকে আমার ছেলের পাশে কোন দিকে মানায়?আর দেখো, এই মেয়ে মাহিরের চেয়ে বয়সে বড় হবে।
--- কি শুরু করেছো!! খাবারের ব্যবস্থা করো। অনেক রাত হয়ে গেছে।
সারোয়ার সাহেবের মুখের উপর আর কথা বলার সাহস নেই আফরোজা বেগমের। তাই উনি বিরক্তি নিয়ে চলে গেলেন।
.
.
রাত প্রায় তিনটা বাজে। মাহির রুমে আসলো।কাঁদতে কাঁদতে শিখার চোখ ফুলে গেছে। মাহিরকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলো।মাহির চুপচাপ ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে শুয়ে পড়লো।শিখা কি করবে বুঝতে না পেরে দাঁড়িয়েই রইলো। বেশ কিছুক্ষন পরে মাহির তাকিয়ে দেখে শিখা দাঁড়িয়ে আছে।
--- এই মেয়ে শুনো, বাবার জন্য এবাড়িতে এমনকি এই রুমে থাকার অনুমতি পেয়েছো।কিন্তু তাইলে বলে ভেবো না আমার স্ত্রীর যায়গা পাবে।।দুই দিন আগে আর পরে এই বাড়ি তোমাকে ছাড়তেই হবে। এখন রোবটের মতো দাঁড়িয়ে না থেকে নিচে চাদর পেতে শুয়ে পড়ো।আর ভুলে আমার সামনে পড়বে না।এটা বলেই মাহির বালিশ ছুড়ে দিলো।
শিখা এটার জন্য প্রস্তুত ছিলো বোধহয়। কারণ ওর মধ্যে খুব একটা পরিবর্তন দেখা যায়নি।শুধু চোখ থেকে টপটপ করে কিছু পানি ঝরে পড়ছে।শিখা বালিশ টা নিয়ে ফ্লোরে একটা চাদর পেতে শুয়ে পড়লো।
গল্পঃ__কনে_বদল
পর্ব : ০১
লেখিকাঃ তাসলিমা মুন্নী
গল্পঃ__কনে_বদল
পর্ব : ০২
লেখিকাঃ তাসলিমা মুন্নী
এই মেয়ে! তোমাকে নিষেধ করেছিলাম না আমার সামনে আসতে?
এখনো এই রুমে কি করছো??
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে মাহির শিখাকে রুমে দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে।
- আমি বাহিরে গিয়েছিলাম,কিন্তু আমাকে বললো রুমেই থাকতে। এখান থেকে বের না হতে।
- এই সকাল বেলা উঠেই.... ঠিক আছে বের হতে হবে না। আমিই বের হয়ে যাচ্ছি।
মাহির বের হয়ে যায়।
শিখা বসে বসে কাঁদছে। কি নসীব ওর!
প্রতি পদক্ষেপে এখানে অপমান সহ্য করতে হবে সেটা বেশ বুঝতে পারছে।
কিছু সময় পরে ইভা এসে কিছু খাবার দিয়ে বললো
- তোমার খাবার, খেয়ে নাও।
খাবার টা সামনে দিয়ে ইভা চলে গেলো।
শিখাকে তাদের সাথে খেতেও ডাকেনি।আলাদা করে রুমে খাবার পাঠিয়ে দিয়েছে।
এই খাবার খাওয়াও লজ্জাজনক, কিন্তু খিদে এমন এক জিনিস যেটা দুইদিন পেটে দানাপানি না পড়লে বোঝা যায়।
শিখার পেটেও দুদিন ধরে কিছু পড়েনি।খাবার টা পেয়ে মান অপমান উপেক্ষা করে শিখা খাবার টা মুখে দিলো।
একটু পরেই শুনতে পেলো
- কোনো অনুষ্ঠান হবে না। সব বাতিল করো।মাহির বলে গেছে ও এসবে থাকতে পারবে না। থাকবে কি করে?? আমার ছেলের পাশে একে নিয়ে দাঁড়াবে? ছেলেটা আমার না খেয়ে বেরিয়ে গেলো!!...
ওর বাবার ভীমরতি হয়েছে... এই মেয়েকে এখনো বাড়িতে রেখেছে। আমার ছেলের জীবন থেকে সুখ চলে গেছে।
মাহিরের মায়ের কথাগুলো শিখা রুমে থেকেই স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে।
খাবারটা আর শেষ করা হলো না।
মনে মনে ভাবছে উনারই বা কি দোষ?! মাহির উনার ছেলে। মাহির সুদর্শন যুবক। ফর্সা সুন্দর গায়ের রঙ,দেখতে হাজারে একজন!!
তার পাশে শ্যাম বর্নের শিখা বড্ড বেমানান।
তার উপর অযত্নে অবহেলায় শিখার কপালের বলি রেখা গাণিতিক হারে জানান দিচ্ছে শ্রীহীনতার!
মোট কথা মাহিরের পাশে শিখা কুৎসিত!!
এমন ছেলের জন্য কোন মা শিখার মতো বউ চাইবে???
ও আল্লাহ!....... কি অপরাধে আমাকে এমন শাস্তি দিচ্ছো!! আত্নহত্যা করা যদি মহাপাপ না হতো, তাহলে এই জীবন রাখতাম না। কিন্তু ইহকাল চলে যাক... আমার পরকালের সহায় থেকো প্রভু....
আমাকে সহ্য করার ক্ষমতা দাও.... না হলে মৃত্যু দিয়ে আমাকে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দাও...
শিখা মনে মনে প্রার্থনা করে।
দুপুরবেলায় ইভা এসে শিখাকে নিয়ে মাহিরের মায়ের রুমে যায়।
- মা শিখাকে নিয়ে এসেছি।
- ভেতরে এসো।
ভেতরে এসে শিখা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
- এখানে বসো।
খাটের কিনারায় বসতে ইশারা করলেন।
- মা আমি যাই?
- আচ্ছা যাও।
ইভা চলে গেলো।
- তুমি এখন এ বাড়ির বউ। তোমার শ্বশুর যখন বলেছেন তখন তুমি এখানেই থাকবে। কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে। তুমি কি সেটা মানতে পারবে?
- কি শর্ত মা?
- তুমি তোমার বাবার বাড়িতে কখনো যেতে পারবে না! হয় এখানেই থাকবে আর বাবার বাড়িতে গেলে একেবারেই চলে যাবে।
শিখার চোখ টলটল করছে।
- ঠিক আছে মা।আপনি যেমনটা বলবেন সেটাই করবো।
- আচ্ছা ঠিক আছে। এখন যাও সারাক্ষণ রুমে বসে থাকতে হবে না।ইভার সাথে বাড়ির সবকিছু দেখেশুনে নাও।
ইভা...ইভা...
- জি মা?
- শিখাকে নিয়ে সব কিছু দেখিয়ে বুঝিয়ে দাও।
- আচ্ছা মা।
- মাহির ফিরেছে?
- না মা।ফোনও ধরছে না।
- আচ্ছা ওকে নিয়ে যাও।
আফরোজা বেগম ভেতরে ভেতরে খুব নরম মনের মানুষ। শিখার উপর উনার রাগ আছে, তারচেয়েও বেশি রাগ ওর পরিবারের উপর।
শিখাকে মানতেও পারছেন না, কিন্তু সারোয়ার সাহেবের সাথে কথা বলার পরে এটাও বুঝলেন শিখাকে ফেলতেও পারবেন না।
অনেক রাতে মাহির বাড়ি ফিরে। শিখা অপেক্ষা করছিলো কখন মাহির ফিরবে।
মাহির রুমে ঢুকে নিজের মতো সব কিছু করে যাচ্ছে কিন্তু রুমে যে আরেকটি প্রাণীর অস্বস্তি আছে সেদিকে ভ্রুক্ষেপও করছে না।
- আপনি এতো রাত করলেন যে?
মাহির কোনো উত্তর দিলো না।
শিখা কিছুক্ষন পর শিখা আবার বললো
- দেখুন, এটা আপনার বাড়ি,আপনার রুম।আমার জন্য আপনি কেন নিজের রুম ছেড়ে দিয়েছেন?
বেশ বিরক্তি নিয়ে মাহির বললো
- তোমার জন্য রুম ছেড়ে দিয়েছি? কে তুমি? আর নিজেকে এতো ইম্পোর্টেন্ট ভাবছো কেন, যে তোমার জন্য আমি রুম ছেড়ে দিবো??
শিখাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো মাহির।
- আমি কিছু দিন পরেই চলে যাবো। এই কয়েকদিন একটু ঝামেলা সহ্য করতে হবে আপনাকে।
- যাক! তুমি যে একটা ঝামেলা সেটা কমপক্ষে বুঝতে পেরেছো!! আমি ধন্য!!!
মাহির বিছানায় শুয়ে আলো নিভিয়ে দিলো।
শিখা অন্ধকারেই কোনো রকমের বালিশ টা নিয়ে নিচে বিছানা পেতে নিলো।
শ্বশুর বাড়িতে আসার পরে শিখা নিজের ফোন একেবারে বন্ধ করে রেখে দিয়েছে, যাতে করে ওর সাথে কেউ বাড়ি থেকে যোগাযোগ করতে পারে না।
বিয়ের প্রায় এক সপ্তাহ হয়ে গেছে। শিখা মোটামুটি মানিয়ে নিতে পেরেছে। এবাড়ির মানুষগুলো ভালো। শিখা যেমন টা ভেবেছিলো তারা তেমন নয়।এতো কিছুর পরেও তারা শিখার সাথে কেউ খারাপ ব্যবহার করেনি। শুধু মাহির মেনে নিতে পারেনি। সারোয়ার সাহেব হঠাৎ শিখাকে উনার রুমে ডেকে পাঠালেন।
- বাবা, আমাকে ডেকেছেন?
- তোমার মায়ের সাথে কথা বলেছো?
- জি না।
- তোমার ফোন অফ করে রেখেছো।উনি আমাকে ফোন করেছেন। মায়ের সাথে কথা বলে নিও।
শিখা কিছু না বলে দাঁড়িয়ে রইলো।
- আমি ওই বাড়িতে আর যাবো না।
- আচ্ছা সে পরে দেখা যাবে। তার আগে তোমার মায়ের সাথে কথা বলো।
শুনো শিখা, কোনো মা ই সন্তানের অমঙ্গল চায় না।তোমার মা এটা কেন করেছে সেটা তুমি নিজেও জানো।তারপরও কেন মায়ের উপর অভিমান করে থাকবে?
- আচ্ছা বাবা,আমি কথা বলে নিবো।
- ঠিক আছে। যাও।
শিখা জানে না, তা নয়।ও জানে কেন ওর মা এমন করেছে। আর মা তো কিছু করেনি!
শুধু চাচাদের কথা মতো কাজ করেছে... করতে বাধ্য হয়েছে!!
তবুও শিখার অভিযোগ নেই কারো উপর। কেবল নিজেকেই দোষারোপ করে!!
শিখা এখানে সংসারের সব কাজে ইভাকে,শ্বাশুড়িকে সাহায্য করে। ওর ব্যবহারে, কাজে সবাই সন্তুষ্ট। হয়তো সেই রূপ নেই শিখার।কিন্তু সবার মন জয় করে নিয়েছে নিজের ব্যবহারে।
মাহিরের সব কাজ শিখা নিজের হাতেই করে। তবে সেটা মাহিরের আড়ালে। মাহির যেন সামনে দেখলেই সহ্য করতে পারে না শিখাকে।
এতো দিন ধরে ফ্লোরে শুয়ে শিখার সর্দি জ্বর বেঁধে গেছে।
ইভা ওকে কিচেনে কাজ করতে দেয় না,তবুও জোর করেই শিখা কাজ করে।
ইভা বলে
- তোমাকে এতো করে বলি তবুও শুনো না।এই অবস্থায় কাজ না করলে হয় না? বড় একটা অসুখ বাঁধিয়ে ছাড়বে!
- এতো টুকু করতে দাও, ভাবি।সারাদিন বসে থেকে থেকে আর ভালো লাগে না।এই সময় টুকু তোমাদের সাথে কাজ করতে ভালো লাগে আমার। আর একা বসে থাকতে ভালো লাগে না।।
- বুঝেছি।কিন্তু অসুস্থ অবস্থায় কাজ করলে আরও অসুখ বাড়বে শিখা।
- বাড়বে না ভাবি।আমার অভ্যাস আছে।
ইভা শিখার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো, তবে কিছু বললো না।
মাহির বিয়ের জন্য অফিস থেকে ছুটি নিয়েছিলো। ছুটি শেষ হয়ে গেছে। এখন থেকে অফিস করছে। ফিরতে ফিরতে সেই সন্ধ্যা।ইদানীং মাহির কিছুটা নমনীয় হয়ে গেছে শিখার প্রতি। আগের মতো উঠতে বসতে বিরক্তি প্রকাশ করে না। তবে খুব ভালো ব্যবহার ও করে না।
মনে হয় শিখা ওদের পরিবারের একজন সদস্য, সবার সাথে ভালো সম্পর্ক শুধু মাহিরের সাথে কোনো লেনাদেনা নেই।
রাতে শুধু রুমে এসে চুপচাপ শুয়ে পড়ে। দুটি মানুষ একটা রুমে। তবুও কেউ কারো সাথে কথা বলে না।
চলবে...
গল্পঃ__কনে_বদল
পর্ব : ০৩
লেখিকাঃ তাসলিমা মুন্নী
(৩)
গভীর রাতে গোঙানির শব্দে মাহিরের ঘুম ভাঙে।প্রথমে ঘুমের ঘোরে বুঝতে পারেনি কিসের শব্দ। ঘুম একটু কাটতেই বুঝতে পারলো শব্দটা নিচে থেকে আসছে।
মাহির উঠে বসলো।
লাইট অন করার পর দেখলো শিখা কাঁপছে।
গায়ে কাঁপুনি দেয়ার মতো শীত নেই, তবুও মেয়েটা কাঁপছে!
মাহির ভাবলো হয়তো জ্বর এসেছে। কাছে গিয়ে দেখবে কি দেখবে না....
অনেক ভেবে শেষ পর্যন্ত গিয়ে কপালে হাত রেখে দেখে অনেক জ্বর মেয়েটার গায়ে। এ অবস্থায় নিচে শুয়ে থাকা ঠিক হবে না। কিন্তু...
এইযে শুনছো?.... এই মেয়ে..
আস্তে করে ধাক্কা দিলো।কিন্তু শিখা কোনো সাড়া দিলো না।
মাহির শিখাকে মেনে নিতে পারেনি ঠিক। কিন্তু এভাবে জ্বরের মধ্যে একটা মানুষকে নিচে ফেলার রাখার মতো অমানুষ নয়।।
শিখাকে নিয়ে বিছানায় শুয়িয়ে দিলো।
পরদিন সকালে মাহির ইভাকে গিয়ে বললো
- ভাবি,শিখার অনেক জ্বর। তুমি ওকে খায়িয়ে দিও।
- ওর গায়ে তো জ্বর ছিলোই।এখন মনে হয় আরও বেড়ে গেছে।
- হুম।
মাহির চলে গেলো।
মাহির ঔষধের প্যাকেটটা এনে শিখার সামনে দিয়ে বললো
- এখানে ঔষধ আছে। খেয়ে নিও।
মাহিরের এই সামান্য কথায় শিখা অনেক খুশি হলো। এতটুকু চিন্তা করেছে ওর জন্য এটাই তো অনেক!!
কিছু দিনের মধ্যে শিখা সুস্থ হয়ে উঠলো।
সারোয়ার সাহেব বলার পরেও শিখা ওর মাকে ফোন করেনি।হঠাৎ কি মনে করে ওর মাকে ফোন করলো।
- হ্যালো... মা।
- শিখা!! তুই কেমন আছিস? এতো দিন হয়ে গেছে একটা ফোন করিসনি! তুই ভালো আছিস তো মা?
- এতো কিছু জেনে কি করবে?
তোমার কাঁধের বোঝা নেমে গেছে! এটাতেই খুশি থাকো না।
- এভাবে বলছিস কেন? তুই তো জানিস..
- জানি বলেই তো বললাম। তোমার ঘরে বয়স্ক একটা মেয়ে ছিলো, তার বিয়ে দিতে পারছিলেনা। ঠকিয়ে হোক আর যেভাবেই হোক বিয়ে দিয়ে ঘাড় থেকে নামিয়েছ।আপদ বিদায় হয়েছে। আর তো চিন্তার কিছু নেই!!
- মা রে... তুই আমার দুঃখ টা বুঝলি না?
কাঁদতে কাঁদতে শিখার মা বললো।
- রোজ রোজ তোর এত অপমান আমি আর কত সহ্য করতাম??
- আর তো সহ্য করতে হবে না
শুনো মা, আমাকে আর ফোন দিও না। এখানে সবাই খুব ভালো মানুষ। এতো কিছুর পরেও তোমার মেয়েকে বাড়িতে যায়গা দিয়েছে। কিন্তু তোমাদের উনারা সহ্য করতে পারেন না। তোমাদের সাথে যোগাযোগ রাখি সেটা উনাদের পছন্দ না।
- ঠিক আছে। তুই যদি ভালো থাকিস তাহলে যোগাযোগ করবো না। তবুও আমার মেয়েটা একটু সুখ পাক।
- শশীকে বলে দিও আমি ভালো আছি।
- কথা বলবি শশীর সাথে? নে কথা বল।
- না বলবো না। যোগাযোগ যেন না করো সেটা জানাতে ফোন করেছি।আর আমার শ্বশুরকেও ফোন দিবে না।
রাখলাম।
বলেই ফোন রেখে দিলো শিখা।
মাকে এতো কড়া ভাষায় কথা বলে, এতো খারাপ ব্যবহার করেও শিখার ভাবলেশহীন। যেন কিছুই হয়নি!!
শিখা বয়সে মাহিরের থেকে দুই-তিন বছরের বড়। তার উপর মাহিরের পাশে বড্ড বেমানান। শিখার সেই রূপ নেই যা দিয়ে স্বামীর মন ভুলাবে! সাধারণের থেকে সাধারণ চেহারার মাঝে যেন বয়সের ছাপটা স্পষ্ট বোঝা যায়।
মাহির কোনো ভাবেই এটা মেনে নিতে পারছেনা।
শিখার ব্যবহারে মন নরম হলেও শিখার মুখের দিকে তাকালে যেন মাহিরের মন বিষিয়ে যায়।
শিখা মাহিরের গলার কাঁটা হয়ে গেছে। সেই কাঁটা না গিলতে পারছে না বের করতে পারছে।
ওর জীবন বিষিয়ে গেছে। শিখাকে নিজের স্ত্রী বলে কারো সামনে পরিচয় দিতেও লজ্জাবোধ করে।
মাহিরের বিয়ের পরে যখন ওর বোনদের শ্বশুর বাড়ি থেকে লোক আসবে শুনলো,মাহির রীতিমতো পালিয়ে থাকলো। কারণ ওর পক্ষে শিখাকে বউ বলে পরিচয় দেয়া সম্ভব না।
দুনিয়া সুন্দরের পূজারী। সুন্দর চেহারার আড়ালে কুৎসিত, বিকৃত মন থাকলেও সুন্দরের দোহাই দিয়ে পাড় পেয়ে যায়!
আর কুৎসিত একটা চেহারার আড়ালে সুন্দর একটা মন থাকলেও সেটা অযত্নে, অবহেলায়, অপমানে রোজ রোজ নরকের যন্ত্রণা সহ্য করে।
মাহির আর শিখার বিয়ে হয়েছে অনেক দিন হয়ে গেছে। মাহিরের বাবা জোর করে শিখাকে এই বাড়িতে রাখলেও মাহির যে মেনে নিতে পারেনি সেটা উনি জানেন।
তিনি একদিন ইভাকে বললেন
- মাহির বোধহয় বিয়েটা এখনো মেনে নিতে পারেনি।।
- আসলে বাবা... মাহিরের পক্ষে কি এতো তাড়াতাড়ি মেনে নেয়া সম্ভব? ওর যায়গা থেকে চিন্তা করে দেখুন।আমরা তো মেনে নিয়েছি। মাহিরও ঠিক মেনে নিবে।আরও কিছু দিন সময় দিন।
আপনি চিন্তা করবেনা না।
- হুমম।
একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মাহিরের বাবা।
মাহিরের অফিসের একটা ট্রেনিং এর জন্য ৩ মাস ঢাকায় থাকতে হবে। এটা জেনে মাহির অনেক খুশি হলো। কিছু দিন সে এই বাড়ির বাইরে থেকে মুক্ত নিঃশ্বাস নিতে পারবে।
এই খবর বাড়িতে জানার পরেও সারোয়ার সাহেব মনে মনে বুদ্ধি করলেন, এই সুযোগ। মাহির আর শিখা নিজেদের মতো কিছু দিন থাকুক এই বাড়ির বাইরে। এতে হয়তো মাহিরের মন গলবে। তিনি মাহিরকে বললেন
- যাচ্ছো যে থাকবে কোথায়? অফিসের কোনো ব্যবস্থা আছে?
- হা বাবা।উনারা সব ব্যবস্থা করে দিবেন।
- হুম। ওখানেই থাকতে হবে এমন বাধ্যবাধকতা আছে নাকি?
- না,তা নেই।অনেকেই বাইরে থাকবে। যার ইচ্ছে সেখানে থাকবে।
- তাহলে তো ভালো ই হয়েছে। তুমি তিন মাসের জন্য একটা বাসা ভাড়া করে নাও।
- বাসা ভাড়া করে কি করবো? আমি তো সেখানেই থাকতে পারবো।
- না পারবে না। কারণ শিখাও যাবে তোমার সাথে।
-বাবা.. আমি তো বেড়াতে যাচ্ছি না।
- সেটা জানি। কিন্তু বাসা থেকে গিয়ে ট্রেনিং করতে পারবে না এমন তো কোনো কথা নেই।
খোঁজ নিয়ে আগে বাসার ব্যবস্থা করো।
তাছাড়া কি খাবে না খাবে তার ঠিক নেই।শিখা তোমার সাথেই যাবে।
- আচ্ছা, ঠিক আছে।
মাহির মুখকালো করে বেরিয়ে ওর মার কাছে গিয়ে বলে
- মা....
বাবা কি শুরু করেছেন এসব? সব কিছু কি জোর করে চাপিয়ে দিতে চান আমার উপর?
সারোয়ার সাহেব মাহিরের পিছনে দাঁড়িয়ে কথা শুনছেন সেটা মাহির বুঝতে পারেনি।
- তোমার উপর চাপিয়ে দিতে চাইছিনা। যাতে তুমি মানিয়ে নিতে পারো সেই চেষ্টা করছি।।
মাহির পিছনে ফিরে ওর বাবাকে দেখে মাথা নিচু করে ফেললো।
- বসো মাহির। আজ তোমাকে একটা গল্প বলি।
একটা ছেলে ছিলো। সে পড়াশোনায় খুব ভালো। অনেক আগ্রহ ছিলো পড়ার। স্কুলের স্যার মেডাম বলতেন, " ছেলে টা অনেক মেধাবী,জীবনে অনেক বড় হবে। "
কিন্তু ছেলে টা এতো গরীব ছিলো যে পড়াশোনা চালিয়ে যাবার তৌফিক ছিলো না।
অনেক কষ্টে দশম শ্রেণি অবধি পড়ার পরে ছেলেটার পড়া বন্ধ হয়ে যাবে প্রায়,এমন অবস্থা। কারণ সামনে মেট্রিক পরীক্ষা।কিন্তু ফরম পূরণ করার জন্য অনেকগুলো টাকার প্রয়োজন। ছেলেটার বাবা দিন মজুরের কাজ করতো।
এতো গুলো টাকা জোগাড় করা তার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। অনেক যায়গায় হাত পাতলো । কিন্তু খুব সামান্য কিছু টাকা ধার পেলো। কারণ দিন মুজুরকে কেউ সহজে ধার দেয় না, দিলেও খুব সামান্য।
ফরম পূরণ করার শেষ দিন ছেলেটা বসে বসে কাঁদছে। কারণ তার পরীক্ষা আর দেয়া হবে না। কষ্টে তার বুক ফেঁটে যাচ্ছিলো।
তখন ছেলেটার এলাকার এক বড় ভাই আসলো। সে শহরের কলেজে পড়তো। অনেক ভালো সম্পর্ক ছিলো তার সাথে। বয়সে দুই-তিন বছরের বড় হলেও বন্ধুর মতো। সেই ছেলেটা ছুটিতে বাড়িতে এসেছিলো। তাদের আবার অবস্থা অনেক ভালো ছিলো।
সে ছেলেটাকে কাঁদতে দেখে জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে? ছেলেটা সব বলার পরে বললো
- আয় আমার সাথে।
তারপর নিজে ঘর থেকে টাকা নিয়ে স্কুলে গিয়ে ছেলেটা সব টাকা পরিশোধ করে দিলো। ছেলে টা পরীক্ষা দিলো। সবাই যেমন ভালো ভেবেছিলো, তারচেয়েও অনেক ভালো রেজাল্ট করলো । পত্রিকায় ছবি ছাঁপালো।
তারপর শহরের কলেজে সেই ভাই তাকে ভর্তি করিয়ে দিলেন। তারপর আর পিছনে তাকাতে হয়নি।নিজের পড়াশোনার খরচ ছেলেটা নিজেই টিউশনি করে জোগাড় করে।।
পড়াশোনা শেষ করে অনেক বড় একটা চাকরি করে।
কিন্তু সেই যে দুই হাজার টাকা ছেলেটার প্রয়োজন ছিলো, সেটা না পেলে ছেলেটা হয়তো দিন মুজুরের কাজই করতো।
সেই দুই হাজার টাকা জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। সেই জন্যই আজ এই বাড়ি! এতো আরাম আয়েশ! তোমাদের সব চাহিদা অনুযায়ী পেয়েছো। লেখাপড়া করে ভালো চাকরি করছো।সম্মানের জীবন কাটাচ্ছো।
সেই দুই হাজার টাকা যদি না থাকতো তবে আজ তোমরা সারোয়ার সাহেবের ছেলের পরিচয় না, কামলা সারোয়ারের পুত পরিচয়ে বাঁচতা!!
(৪)
সেই দুই হাজার টাকা যদি না থাকতো তবে আজ তোমরা সারোয়ার সাহেবের ছেলের পরিচয় না, কামলা সারোয়ারের পুত পরিচয়ে বাঁচতা!!
বুঝতেই পারছো সেই ছেলেটা তোমার বাব!!আর সেই টাকাটা কে দিয়ে ছিলো জানো? শিখার বাবা।
মাহিরের চোখ ভিজে গেছে।
এখন যদি মনে করো সেই টাকা শোধ করার জন্য তোমাকে ব্যবহার করছি বা তোমার উপর চাপিয়ে দিচ্ছি তবে ভুল করছো।
বাবারে... কিছু ঋণের শোধ হয় না।
কোনো কিছুর বিনিময়ে সেই দুই হাজার টাকার মূল্য পরিশোধ সম্ভব হবে না।
শিখাকে যখন বিয়ে করাতে চেয়েছিলাম তখন শিখার বাবার পরিচয় জেনেই গিয়েছিলাম। কিন্তু তারা যে শিখার বদলে অন্য মেয়েকে দেখিয়েছে সেটা তো জানতাম না।
ওর মায়ের সাথে কথা বলার পরে বিষয় টা পরিষ্কার হয়ে গেছে আমার কাছে। শিখার বাবা মারা যাবার পরে ওর চাচাদের অত্যাচারে ওদের জীবন বিষিয়ে গেছে। আর শিখার বিয়ের এসব সব ওর চাচাদের প্ল্যান অনুযায়ী হয়েছিলো।
কেন করেছিলো সে সব পরে জেনে যাবে।
মানুষের ভিতর দেখার চেষ্টা করো।তাহলেই মনে শান্তি পাবে।
এখন যাও আমি একটু বিশ্রাম নিবো।
মাহির খুব হতাশ হয়ে চলে গেলো।
কয়েকদিনের মধ্যেই মাহির নতুন বাসা নিলো। শিখা সাথে করে নতুন বাসায় উঠলো।
শিখা নিজের হাতে এই নতুন সংসার সাজালো।
মাহির এখন স্বাভাবিক ব্যবহারই করে শিখার সাথে।
একদিন ইভা ফোন দিলো মাহিরকে।ইভা শিখার কথা জিজ্ঞেস করতেই মাহির বললো
- শিখা ভালোই আছে।
- তোমাদের মধ্যে কি সব ঠিক হয়েছে?
- ভাবি, আমি অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু কিছুতেই মানতে পারছিনা।
- ও কিন্তু অনেক ভালো একটা মেয়ে।তোমার কতটা খেয়াল রাখে সেটা বোধহয় তুমি নিজেও বুঝতে পারো না।
- জানি। কিন্তু.... বাদ দাও ভাবি।
- হুম। ওকে একটু বুঝতে চেষ্টা করো।তাহলে তোমার জন্য অনেক সহজ হয়ে যাবে।
ভালো থেকো।রাখছি।
মাহির সত্যিই চাইছে মানিয়ে নিতে। কিন্তু শিখা সামনে আসলেই ওর মেজাজ বিগড়ে যায়। খারাপ ব্যবহার না করলেও স্ত্রী বলে ভাবতে পারছেনা।
সেই সকালে বেরিয়ে যায় মাহির।রাত আট টার পরে ফিরে। শিখা সারাদিন বাসায় একাই থাকে। মাহির এসে খাবার খেয়ে কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে আবার কাজ করে কিছু। শিখার সাথে প্রয়োজনের বাইরে কথা বলার মতো সময় যেমন নেই, তেমনি মাহির নিজেও সময় খুঁজে না কথা বলার জন্য।
শুক্রবার দিনটা অর্ধেক ঘুমিয়েই কাটিয়ে দেয়।
এক শুক্রবার রাতে শিখা যখন সব কাজ সেরে রুমে আসলো, তখন মাহির কি মনে করে শিখাকে জিজ্ঞেস করে ফেললো
- তোমার বাসায় কে কে আছে?
এতো দিন এসব জানার প্রয়োজন বোধ করেনি।
- অনেক মানুষ আছে। মা আছে,আমার বোন শশী আছে। বড় চাচা, বড় চাচীমা,উনার এক ছেলে, দুই মেয়ে, ছোট চাচা-চাচি,উনাদের দুই ছেলে মেয়ে।
- বাহবা! এতো দেখছি বিরাট পরিবার।
- হা।সবাই একসাথেই থাকে।
- তোমার চাচারা নাকি অনেক... তোমার বাবা তো শুনেছি ভালো জব করতেন।
চাইলে তো তোমরা আলাদা থাকতে পারতে।
- এটাই নাকি আমাদের পরিবারের রেওয়াজ; যাই কিছু হয়ে যাক,কেউ আলাদা থাকতে পারবে না। আমার দাদু উনার সম্পত্তির যে উইল করে গেছেন, তাতে আছে কেউ একজন যদি আলাদা হয়ে যায় তবে শুধু সে বঞ্চিত হবে না,বাকি সবাইও বঞ্চিত হবে। কারণ সব তাহলে একটা ট্রাষ্টে চলে যাবে।
এই ভয়ে কেউ আলাদা হয়নি।আমাদের ও আলাদা হতে দেয়নি।
বাবা মারা যাবার পর পেনশনের একটা টাকাও মায়ের হাতে রাখতে পারেননি।সব চাচারা নিয়ে গেছেন।
- হুম। বুঝেছি।
সবকিছুর পিছনে তোমার চাচারা! বুঝলাম, কিন্তু এই বিয়ে নিয়ে এতো নাটকের কারণ তো বুঝলাম না।
শিখা মৃদু হেসে বললো
- আমি যে দেখতে ভালো নই।
তাই সবার বোঝা হয়ে গিয়েছিলাম।
বাবা মারা যাবার তিন বছরের মাথায়, ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর যখন ভর্তি হতে চেয়েছি,চাচারা পড়া বন্ধ করে দিলেন। মেয়েদের এতো পড়ার নাকি দরকার নেই।
অনেক চেষ্টা করেও আর পড়তে পারিনি।
মা চেয়েছিলেন বিয়ে দিয়ে দিতে।কিন্তু বড় চাচী প্রথম বাধা দিলেন। বললেন এতো তাড়াহুড়ো করার কিছু নেই।
আসলে মা আর আমি সংসারে সব কাজ করতাম। প্রায়ই মা অসুস্থ হয়ে পড়তেন, তখন আমি আর শশী মিলে রান্না করা,কাপড় কাচা,ঝাড় দেয়া.... সব করতাম।
বিনে পয়সার চাকর কেউ এতো সহজে ছাড়ে!!
আমাদের পড়া বন্ধ হলেও অন্যরা সবাই ঠিকই পড়াশোনা করেছে।। কিন্তু উনার মেয়ের বিয়ে ভেঙে গেছে, কারণ মানুষের মুখে শুনেছে বাড়ির বড় মেয়ের এখনো বিয়ে দেয়নি। এজন্য অনেকেই উনাদের বদনাম করেছে।
পরপর কয়েকটি বিয়ে ভাঙার পরে চাচির টনক নড়ে। এবার আমাকে বিদায় করতে উঠে পড়ে লাগেন।
কিন্তু আমি তো সুন্দর নই, তার উপর বয়স ত্রিশের কোটা ছুঁয়েছে! এই মেয়েকে দেখতে এসে কেউ পছন্দ করবে??
বারবার চেষ্টা করেও যখন দেখলো কেউ আমাকে পছন্দ করছে না, তখন তারা আরও মরিয়া হয়ে গেলেন।
উঠতে বসতে অনেক অপমান করতেন তারপর গায়েও হাত তুলেছে। কারণ আমার অপরাধ হলো -আমার বিয়ে হচ্ছে না। কেউ পছন্দ করছে না।
তারপরে আমার মামাতো বোন দোলন কে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসলো। শুনলাম ওকে দেখতে আসবে এখানে। ওকে পছন্দ করলো।বিয়ে ঠিক হলো।।
বিয়ের আগের রাতে জানলাম বিয়েটা আমার। বুঝলাম আমার বদলে দোলকে দেখিয়েছে।এটা কত বড় অন্যায়! লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছিলো।
অনেক চেষ্টা করেছি, অনেক বুঝিয়েছি।কিন্ত শেষ পর্যন্ত মা বললেন, বিয়ে না করলে উনি বিষ খাবেন। বিষের শিশি হাতে নিয়ে বসে ছিলেন। তখন আমার আর কিছু করার ছিলো না।
আমার মা অনেক অসহায়। রোজ রোজ উনাদের কাছে আমার জন্য অপমান সহ্য করতে করতে উনি আর পারছিলেন না। আমাকে অই নরক থেকে বাঁচাতে অন্যায় জেনেও মা এটা করেছে।
মায়ের উপর অভিযোগ নেই।অভিমান আছে।
আর কিছু না পারলে তিন মা মেয়ে তো এক সাথে মরতে পারতাম!!
শিখার কথা শুনে মাহিরের চোখ কখন ভিজে গেছে টের পায়নি।
গল্পঃ__কনে_বদল
পর্ব : ০৪
লেখিকাঃ তাসলিমা মুন্নী
(৫)
মায়ের উপর অভিযোগ নেই।অভিমান আছে।
আর কিছু না পারলে তিন মা মেয়ে তো এক সাথে মরতে পারতাম!!
শিখার কথা শুনে মাহিরের চোখ কখন ভিজে গেছে টের পায়নি।
বুকের ভেতর চিনচিন করে উঠলো। কত রঙের দুঃখ আছে মানুষের মনে!!
শিখাকে বলার মতো কিছু খুঁজে পেলো না মাহির। শুধু বললো
- ঘুমিয়ে পড়ো।
শিখা ঠিকই ঘুমিয়ে পড়লো, কিন্তু মাহিরের চোখে ঘুম আসেনি।
মাহির শিখার দুঃখের গল্প শুনে শিখার প্রতি কিছুটা নমনীয় হতে চাইলো।কিন্তু পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি মাহিরের মন ঠিক উল্টিয়ে দেয়।
মাহির ঢাকায় এসেছে বউ নিয়ে, এই কথা শোনার পরে মাহিরের এক সাইফ তার বউ নিয়ে আসে মাহিরের বাসায়।
শিখাকে দেখে একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করা মাহিরের চোখ এড়ায়নি।
শিখা অনেক আপ্যায়ন করলো মাহিরের বন্ধু আর বন্ধু-পত্নীকে।
শিখা কিচেনে ব্যস্ত ছিলো। মাহিরও একটু বাহিরে গিয়েছিলো।সাইফ আর সাইফের বউ বেলকনিতে বসে ছিলো।
মাহির ওদের ডাকতে এসে শুনলো সাইফের বউ বলছে
- তুমি দেখো বয়সে অনেক বড় হবে। মাহির ভাইয়ের পাশে একদম মানায়নি। গায়ের রঙ ও ময়লা!
- এটাকে ময়লা বলে না,শ্যামলা বলে।
- অই একই কথা। কেমন যেন!
- খুবই ভদ্র আর অমায়িক। হয়তো এতো সুন্দরী নয়।
- পেহলে দর্শনদারী, ফের গুণ বিচারি!! তোমার কি মনে হয় মাহির ভাই ওর সাথে সুখী হবে? উনার মতো হ্যান্ডসাম ছেলের পাশে একে দেখলে মানুষ বড় বোন ছাড়া কিচ্ছু ভাববে না।
উনি কিভাবে মানিয়ে নিয়েছেন আল্লাহ ই জানেন!!
- হুমম।।
এসব শুনে মাহিরের মেজাজ আরও খারাপ হয়ে গেছে।
কিন্তু ওদেরকে কিছু তো বলা যায় না। আর তারা সত্যি কথাই তো বলেছে। ভুল কিছু বলেনি।
ওরা সেদিন বিদায় নিলেও মাহিরের মনে আরও বিষাদ দিয়ে গেলো।
শিখার প্রতি যতটুকু দুর্বলতা তৈরি হচ্ছিলো সেটাও এখন অসহ্য মনে হতে লাগলো। আগে টুকটাক কথা বললেও এখন সেটাও বলে না।
সারাদিন একা বাসায় শিখার দম বন্ধ হয়ে আসে।মাহির রাতে ফিরে সকালে চলে যায়।শিখার দিকে খেয়াল দেবার প্রয়োজন বোধ করেনি।
এই বন্ধ অবস্থায় থেকে থেকে যেন শিখার প্রাণ হাঁসফাঁস করছে একটু মুক্ত নিঃশ্বাস নিতে।মফস্বলের মেয়ে শিখা।এই বন্দী দশায় ওর শরীরের অবনতি হচ্ছে কেবল।
না খেতে পারছে,না শান্তি পাচ্ছে। অসুস্থ বোধ করছে।কিন্তু কাকে বলবে?
মাহিরের সময় কই ওর দিকে ফিরে দেখার!!
দিন দিন শিখা কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে।
ও কিছু খেতে পারছে না। সারাদিন কিছু খায় কিনা মাহির কখনো জিজ্ঞেস করেও দেখেনি।
রাতে মাহিরের সাথে খেতে বসলেও মাহির খেতে খেতে ফোন ঘাটে।
খাবার শেষ করে উঠে চলে যায়।
শিখা যে কিছুই খেতে পারছেনা সেদিকে ও খেয়াল করেনি।
এরমধ্যে হঠাৎ একদিন শিখা ঘুমিয়ে আছে,মাহির শিখার দিকে খেয়াল করে দেখে মেয়েটা অনেক শুকিয়ে গেছে।
মাহির ভাবলো হয়তো এখানে মানিয়ে নিতে পারছেনা।
পরদিন সকালে মাহির শিখাকে জিজ্ঞেস করলো
- তুমি কি অসুস্থ?
- না তো।আমি ঠিক আছি।
- কিন্তু তোমাকে দেখে অসুস্থ মনে হচ্ছে। অনেক শুকিয়ে গেছো।
- কিছু হয়নি। এখানে কেমন বন্দী বন্দী মনে হয়। ভালো লাগছে না আমার।
- হুম। আর তো দেড় মাস।দেখতে দেখতে চলে যাবে।
তোমার কিছু প্রয়োজন হলে আমাকে বলো।
- আচ্ছা বলবো।
দুদিন পরে মাহির খেয়াল করে শিখাকে খুব অসুস্থ লাগছে।চোখে মুখে অস্বাভাবিক কিছু একটা বুঝতে পারছে।মাহির আরও খেয়াল করলো শিখা কিছুই খেতে পারছেন না।
- তুমি যে বললে অসুস্থ না! আমি তো দেখছি তুমি সুস্থ না।কিছু ই তো খাওনি।
কি হয়েছে তোমার? তোমার চোখে কেমন ফুলে গেছে!
- আমাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিবেন? আমার এখানে একদম ভালো লাগছে না।
- আচ্ছা সে দেখা যাবে।আগে তোমার ডাক্তার দেখাতে হবে।
দুদিনের মধ্যে মাহিরের সুযোগ হয়নি ডাক্তার দেখানোর।
সেই রাতে শিখার অনেক জ্বর উঠে। মাহির সারারাত জেগে জলপট্টি দেয় মাথায়।
শিখা এক রাতে যেন বিছানার সাথে মিশে গেছে! ঔষধ এনে খাওয়ানোর পরে জ্বর কমলেও শিখা যেন শরীরে কোনো শক্তিই পাচ্ছে না।
মাহির আর দেরি না করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো।
অনেক ঔষধপত্র নিয়ে তারা ফিরলো।
চার- পাঁচ দিন পরে মাহির ইভাকে ফোন করে বললো
- ভাবি, তুমি একটু ভাইয়া বা বাবাকে নিয়ে একটু ঢাকায় আসো।
- কেন মাহির? কি হয়েছে? কোনো সমস্যা?
- শিখা খুব অসুস্থ। ওকে একা রেখে আমি যেতে হয়।
কিভাবে কি করবো বুঝতে পারছি না।
একা রেখে যাবো ভরসা পাচ্ছিনা।তোমরা আজই আসো।
- কি হয়েছে শিখার?
- জানি না ভাবি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমরা আসো।
- ঠিক আছে তুমি চিন্তা করো না। আজই আসবো।
মাহিরের ভাবি আর বাবা এসে ঢাকা পৌছালো।
তারা এসে শিখাকে দেখে চমকে উঠলো।শিখা ঘুমে।উনারা আসবেন সেটাও শিখা জানে না।
- একি হাল হয়েছে মেয়েটার! একদম চেনাই যাচ্ছে না।
তুমি ওর দিকে খেয়াল রাখোনি? কি অবস্থা হয়েছে ওর! নিশ্চয়ই খাওয়া দাওয়া একদম করেনি।
- ভাবি, আমি সারাদিন বাসায় থাকলে তো! সকালে বের হই সেই রাত হয়ে যায় ফিরতে ফিরতে। আগেই বাবাকে বলে ছিলাম। বাবা তো বুঝেনি।
একা সারাদিন কি করে সেসব তো আমি খেয়াল রাখতে পারিনা।
আর এমনিতেই আমি প্রেশারের মধ্যে থাকি।
- যাই বলো ভাই,তোমার খেয়াল তো ছিলো না সেটা আমি জানি। তার সাথে অবহেলায় ছিলো।
মেয়েটা ভেতরে ভেতরে কেবল কষ্ট পেয়েছে। নিজের দিকে একটু ও খেয়াল করেনি।
মাহির, ইভা কথা বললেও সারোয়ার সাহেব গম্ভীর ভাবে বসে রইলেন।
(৬)
- মাহির, তুমি আজকে একটু তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা করো। আমি নিজে গিয়ে কথা বলবো ডাক্তারের সাথে।আমার বন্ধু, অনেক বড় ডাক্তার। কথা হয়েছে ওর সাথে। সেখানেই যাবো।
- ঠিক আছে, বাবা।
শিখাকে নিয়ে সারোয়ার সাহেব, মাহির ডাক্তারের কাছে গেলো। সবকিছু দেখে ডাক্তার শিখাকে ইমার্জেন্সি হসপিটালাইজড করলো।
পনেরো দিন ধরে শিখা হাসপাতালে ভর্তি। শিখার শ্বশুর, ইভা আছে শিখার সাথে। মাহির প্রতিদিন সকালে একবার দেখে যায়, আবার রাতে ফেরার সময় শিখাকে দেখে যায়।
বন্দি শিখা আরও বেশি বন্দী হয়ে গেছে। চার দেয়ালের বদ্ধ ঘরে ছটফট করছে। এখানে দম আরও বন্ধ হয়ে আসছে।
- ভাবি!
ইভা শিখার শিয়রে বসে আছে। একটু ঝুঁকে জিজ্ঞেস করলো
- কিছু বলবে?
- এখানে আর কতদিন থাকতে হবে?
- এইতো, আর কিছু দিন। তুমি সুস্থ হয়ে যাও তাড়াতাড়ি।
- আমি বোধ হয় আর বাঁচবো না,তাই না?
শিখা ইভার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো।
- ছিঃ শিখা! ওসব বাজে কথা একদম বলবে না। তুমি খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে।
- আমার কি হয়েছে, ভাবি?
- এইযে খাওয়া দাওয়া করোনি,নিজের খেয়াল রাখোনি! এইজন্যই অসুখ করেছে।
- আমাকে এখান থেকে নিচে চলো।বাড়িতে নিয়ে চলো। দেখবে আমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবো।
- আচ্ছা নিয়ে যাবো। এখন কথা না বলে চুপ করে ঘুমাতে চেষ্টা করো।আমি তোমার পাশেই আছি।
- আমার জন্য কত কষ্ট করছো তুমি।
- আমি তোমার বোন না?
- হা,তুমি আমার বোন।
- তো বোনের জন্য এইটুকু করবো না? আচ্ছা আমার অসুখ হলে বুঝি তুমি আমার জন্য করবে না!! বুঝেছি।
কপট অভিমানের সুরে বললো ইভা।
শিখা ইভার একটা হাত ধরে
- তুমি আমার বোন।সত্যিকারের বোন।
বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
আমার মা কি জানে আমি এখানে?
- না।তোমার মা অসুস্থ ছিলেন। তাই উনাকে কিছু বলতে বাবা নিষেধ করেছেন। উনি আরেকটু সুস্থ হয়ে উঠুক তখন বাবা নিজেই বলবেন।
- কি হয়েছে মায়ের?
- তেমন কিছু না। আগের অসুখই, সাথে জ্বর ছিলো। কিন্তু তোমার মা টেনশন করে আরও অসুস্থ হয়ে পড়বেন আবার এখানেও চলে আসতে চাইবেন। তাই বাবা বলেনি কিছু।
- ভালো করেছেন।
সারোয়ার সাহেবকে শিখা অনেক অনুরোধ করলো তাকে এখান থেকে নিচে যেতে।
শিখা কেমন অস্থির হয়ে গেছে এখান থেকে বের হবার জন্য।।
রাতে মাহির একটু দেরি করে আসলো। কারন শুক্রবার সারাদিন সে শিখার কাছেই থাকে। তাই বৃহস্পতিবার একটু দেরি করেই আসে।
শিখা ঘুমিয়ে আছে। মাহির শিখার পাশে এসে বসলো। ঘুমন্ত শিখার মুখের দিকে তাকিয়ে ভেতর টা হু হু করে উঠলো।
নিজের অজান্তেই মাহির শিখার একটা হাত টেনে নিজের হাতের মুঠোয় নিলো। এই প্রথম মাহির শিখার হাত স্পর্শ করলো। তাও আবার যখন শিখা হাসপাতালের বিছানায়!!
শিখার ঘুম ভেঙে গেছে। ঘুম ভাঙার পরে দেখলো মাহির ওর হাত ধরে বসে আছে।
শিখার চোখ ছলছল করছে।
- আমাকে এখান থেকে নিয়ে যান না!!
- নিয়ে যাবো।আরেকটু সুস্থ হয়ে যাও।তারপর।
- এখানে থাকলে আমি সুস্থ হবো না। দম আটকে মরে যাবো।।
- আচ্ছা নিয়ে যাবো।ডাক্তারের সাথে কথা বলে নিয়ে যাবো, চিন্তা করো না।
- আপনি অনেক ভাগ্যবান মনে হয়।
- কিভাবে?
- শুনেছি ভাগ্যবানের বউ মরে। আপনিও ভাগ্যবান হয়ে যাবেন। অবশ্য বউ আর হতে পারলাম কই!
- কেন এইসব কথা বলছো? তোমার কিচ্ছু হবে না। আর এই কথাটা দ্বিতীয় বার যেন তোমার মুখে না শুনি।
- আমি খুব অপয়া! যেখানে যাই সবার উপর ঝামেলা হয়ে যাই।আপনার জীবনটা আমার জন্য কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে।
- হা এলোমেলো হয়ে গেছে। এবার তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে এলোমেলো জীবন গোছানো দায়িত্ব নিতে হবে তোমার।
শিখা মৃদু হেসে চোখ বন্ধ করলো। মুখে কিছুই বললো না।
মাহির শিখার মাথায় হাত রাখে। শিখা অনুভব করে মাহিরের স্পর্শ। মনে হয় স্বপ্নের মতো। কিন্তু চোখ খুলতে ইচ্ছে করছে না শিখার।পাছে স্বপ্ন ভেঙে যায়!!
শুধু টপটপ করে দুই ফোটা পানি চোখ থেকে দু'দিকে গড়িয়ে পড়লো।
মাহির অনেক সময় শিখার পাশে বসে থাকলো।কেন জানি উঠতে ইচ্ছে করছে না মাহিরের।
শিখা কিছুতেই হাসপাতালে থাকতে চাইছে না। সবাইকে অনেক অনুরোধ করলো তাকে বাড়িতে নিয়ে যেতে। কিন্তু যখন দেখলো কেউ নিয়ে যাচ্ছেই না,তখন জিদ ধরে বসলো।
কিছুতেই ঔষধ মুখে তুলছে না।এখান থেকে না নিয়ে গেলে ঔষধ খাবে না বলে জিদ ধরে আছে।
- বাবা, শিখাকে কিছুই খাওয়ানো যাচ্ছে না।জিদ ধরে আছে বাড়িতে যাবার জন্য। অস্থির হয়ে গেছে মেয়ে টা।।
- হুম।
গম্ভীরমুখে বললেন সারোয়ার সাহেব।
- দেখি ডাক্তারের সাথে কথা বলে কি বলে।মাহির আসুক।
তখনই মাহির আসলো। ইভা মাহিরকে দেখে
- অইতো মাহির এসে গেছে।
- বাবা, ডাক্তারের সাথে কথা বলেছি।কালকেই রিলিজ দিয়ে দিবে।
- রিলিজ দিলেই তো হবে না। বাড়িতে নিয়ে কি এই চিকিৎসা করা যাবে।
- কিছু করার নেই বাবা,এখানে রাখলে অবস্থার অবনতি ছাড়া উন্নতি হবে না
তাছাড়া শিখা এখানে থাকতেই চাইছে না। ওকে এভাবে কষ্ট দিয়ে কি লাভ?
- এটা ঠিক ই। আচ্ছা যাবার ব্যবস্থা করো।
- আচ্ছা ,আমি এম্বুল্যান্স ঠিক করে রাখবো।
- তুমি কি যাবে আমাদের সাথে?
- না বাবা, আমার আরও আট দশ দিন লাগবে। শেষ হলেই যেতে হবে। এছাড়া যাবার উপায় নেই।
- ঠিক আছে।
পরদিন শিখাকে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হলেন সারোয়ার সাহেব আর ইভা। এম্বুল্যান্সের পিছনের গ্লাস গলিয়ে এই শহরের বড় বড় অট্টালিকার ফাঁকে একটু আকাশ উঁকি দিচ্ছে। শিখা চোখ খুলে সেই আকাশ দেখছে।
যখন শহর থেকে বেরিয়ে এলো তখন আকাশ আরও স্পষ্ট দেখতে পেলো।
এই আকাশ দেখে যেন শিখার মনে একটা স্বস্থি এলো। এই শহরকে বিদায় জানিয়ে শিখা চললো বাড়ির পথে।
মনে হচ্ছে শিখার জন্যেও সেই পথ যেন অধীর আগ্রহে চেয়ে আছে।
অবশেষে শিখা বাড়ি পৌছালো।
আজ পাঁচ দিন হলো শিখা চলে গেছে বাড়িতে। মাহির ঢাকায় থেকে গেলো।
কিন্তু কিছুতেই মনে শান্তি পাচ্ছে না। শিখা যখন হাসপাতালে ছিলো দিনে দুবার দেখা করতে গেছে।
কিন্তু এখন পুরো বাসা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।এই বাসার প্রতিটি জিনিসের শিখার ছোঁয়া আছে। প্রতিটি জিনিস নিজের হাতে সাজিয়েছিলো।
মানুষ নিজের অজান্তেই কারো অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। সেই মানুষটাকে যতই অবহেলা করা হোক, তার উপর যতই বিরক্তি আসুক,ঘৃণা করুক , তার অনুপস্থিতিতে তার অভাবটা অনুভব হয়।
বাড়িতে একটা বিড়াল পুষলেও তার উপর মায়া পড়ে যায়। আর শিখা তো জলজ্যান্ত একটা মানুষ!!
শিখা নিজের হাতে বিছানা গুছিয়ে রাখতো,মাহিরের জামা-কাপড় ধুয়ে রাখতো।খুব ভোরে উঠে মাহিরের জন্য নাস্তা তৈরি করতো, অফিসে যাবার আগে কাপড় আয়রন করে দিতো।।
কিন্তু এই কদিনে পুরো বাসা দেখে মনে হচ্ছে -এটা একটা গোডাউন! এখানে সেখানে সব কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠার পরে টেবিলে নাস্তা তৈরি করা থাকে না।
অফিস থেকে ফেরার পরে কেউ একগ্লাস ঠান্ডা পানি এগিয়ে দেয় না।
মাহির শিখার অভাব খুব অনুভব করছে। একটা মানুষের চেহারা তার ভেতরের সব সৌন্দর্যকে ম্লান করে দিতে পারে না।
সুন্দরকে চিনতে হয়,জানতে হয়!!
শিখার অবর্তমানে মাহির এটা ভালো ভাবেই উপলব্ধি করতে পারছে।
গল্পঃ__কনে_বদল
পর্ব : ০৫
লেখিকাঃ তাসলিমা মুন্নী
(৭)
একটা মানুষের চেহারা তার ভেতরের সব সৌন্দর্যকে ম্লান করে দিতে পারে না।
সুন্দরকে চিনতে হয়,জানতে হয়!!
শিখার অবর্তমানে মাহির এটা ভালো ভাবেই উপলব্ধি করতে পারছে।
কিছু উপলব্ধি বড্ড অসময়ে হয়!!
মাহির উপলব্ধি করতে পারছে সে শিখায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
মনের দ্বিধা-দ্বন্ধে এতো দিন মাহির ভেতরে ভেতরে জ্বলে যাচ্ছিলো।
আর কয়েকটা দিন তারপর মাহির ও ফিরে যাবে।
মাহিরের সব কাজ শেষ করে ফিরে আসে।
শিখা মাহিরকে দেখে খুব খুশি হলো।
কিন্তু শিখার অবস্থা দেএ মাহির কষ্ট পেলো।
- কেমন আছো, শিখা?
- আপনি এসেছেন?
- হা।আমি চলে এসেছি। এখন কেমন আছো তুমি?
- আমি ভালো আছি।
শিখা উঠে বসার চেষ্টা করে।
- এই, উঠতে হবে না। শুয়ে থাকো তুমি।
- আমি ঠিক আছি।উঠতে পারবো।
- জানি উঠতে পারবে, কিন্তু উঠার প্রয়োজন নেই।।
মাহির জানে শিখা নিজে বিছানা থেকে উঠতে পারে না, কিন্তু ওকে দেখে উঠার চেষ্টা করছে।
- কিছু খেয়েছো?
- হুম।
এমন সময় ইভা রুমে প্রবেশ করে।
- মাহির,কথা পরে হবে। তুমি আগে ফ্রেশ হয়ে নাও।মা খাবার রেডি করছেন।
মাহির ফ্রেশ হবার জন্য চলে গেলো।
ইভা বিছানার কাছে গিয়ে শিখাকে তুলে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিয়ে এলোমেলো চুল বেঁধে দিলো।
তারপর ঔষধ খাওয়াতে চায়।
- আর ভালো লাগে না। আর ঔষধ দিও না ভাবি।
- কোনো কথা না, চুপচাপ খেয়ে নাও।
- এতো গুলো খেতে কষ্ট হয়।আমি খাবো না।
- দেখো বাচ্চাদের মতো জেদ করে।
ঔষধ না খেলে হবে নাকি?
মাহির এসে দেখলো ইভা ঔষধ খাওয়াতে চেষ্টা করছে কিন্তু শিখা কিছুতেই খেতে চাচ্ছে না।
- ভাবি,আমার কাছে দাও।
মাহির ইভার কাছ থেকে ঔষধ নিয়ে নেয়।
- ঠিক আছে, তুমি খায়িয়ে দাও।আমি আসছি।
ইভা চলে গেলো।
- হা করো।
- খেতে পারবো না। কেন জোর করছেন?
- আমি বলেছি,তাই খেতে হবে।
শিখা আর কথা না বাড়িয়ে আস্তে আস্তে ঔষধ খেয়ে নিলো।
বাড়িতে আসার পরে মাহির যত সময় থাকে শিখার অনেক খেয়াল রাখে।
রাতে মাহির শিখার পাশে বসে আছে।
শিখা চোখ বন্ধ করে আছে। মাহির ভাবলো শিখা ঘুমে। তাই একটা বই নিয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে পড়ছিলো।
শিখা একটু মাহিরের দিকে ফিরে বললো
- আমার মা আর শশীকে একটা খবর দিবেন?
- ঘুমাওনি তুমি? আমি ভাবলাম ঘুমিয়ে পড়েছো।
- মাকে অনেক দেখতে ইচ্ছে করছে। কতদিন দেখিনা মার মুখ।
- আচ্ছা কালই বাবাকে বলবো। তুমি এখন ঘুমাও।
- হুমম। ঘুমাবো।
পরদিন সকালে মাহির সারোয়ার সাহেবকে বললো
- বাবা, শিখার মাকে এখন একটা খবর দেয়া দরকার।
- হা।উনাকে খবর দিয়েছি গতকাল।উনি আজকেই আসবেন।
- তাহলে তো ভালো ই হয়েছে।
- তুমি কি আজ কোথাও বের হবে?
- না বাবা , আজ কোথায় যাবো না।
শিখা অসুস্থ শুনে শিখার মা, শশী,শিখার মামা ছুটে আসেন।
বিয়ে নিয়ে যত কান্ড! তারপর উনারা কখনো এমুখো হতেন কিনা সন্দেহ!
কিন্তু এমন একটা খবর জানার পরে কোনো মা না এসে পারেন না।
- শিখা!
শিখার মা ওর কাছে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন!.
- আপু..
- মা.. শশী! তোমরা এসেছো!
- একি অবস্থা হয়েছে তোর!!
আমাকে কেউ একটা বার বললো না আমার মেয়েটার এই অবস্থা!!
মাগো তোর একি হাল হয়েছে!!
শিখার মা কাঁদতে কাঁদতে অস্থির হয়ে গেছেন।
আফরোজা বেগম আর ইভা উনাদের সান্ত্বনা দিচ্ছে। আফরোজা বেগমে উনাকে নিজের রুমে নিয়ে গেলেন আর ইভা শশীকে।
শিখার মা কেঁদেই চলছে।
আফরোজা বেগম শিখার মাকে বললেন
- আপা! শিখা যে পরিস্থিতিতে এই বাড়িতে এসেছিলো তাতে আমার পক্ষে মেনে নেয়া কঠিন ছিলো তবুও মেনে নিয়েছি।
শিখা আমার ছেলের বউ। ওকে এই অবস্থায় দেখে আমরা কেউ ভালো নেই।
আপনি তো সব শুনেছেন।এখন যদি ওর সামনে এভাবে কান্নাকাটি করেন, তবে মেয়েটার মনের জোর হারিয়ে ফেলবে।ওর সামনে আমরা কিছুই আলোচনা করি না।
- বোন!!... অনেক দয়া আপনাদের। এতো কিছুর পরেও মেয়েটাকে ঠাঁই দিয়েছেন। কিন্তু এই অবস্থায় মেয়েটাকে দেখে কিভাবে শান্ত থাকবো বলুন??
- জানি আপা।কিন্তু তবুও শিখার জন্য নিজেকে সামলে নিন।
শিখার মা ওর পাশে গিয়ে বসে মাথায় হাত রাখলো।
- মা...
- কেমন আছিস রে মা?
- তুমি আমার উপর রাগ করে আছো?
- না মা।রাগ করে থাকবো কেন? একটু রাগ করিনি।
- কত খারাপ ব্যবহার করেছি।
- তুই সুস্থ হয়ে উঠ।দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে।
- মা,.... আমাকে নিয়ে যাবে?
- হা মা। নিয়ে যাবো।তুই যাবিনা আমার সাথে?
শিখা কিছু সময় চুপ থেকে বললো
- আবার একদিন এসে আমাকে নিয়ে যেও।আজকে যাবো না তোমার সাথে। আরেকটু সুস্থ হয়ে যাই।তুমি এসে নিয়ে যেও।
-আচ্ছা মা।
সারোয়ার সাহেব, আফরোজা বেগম আর শিখার মা একসাথে বসে কথা বলছেন।
- ভাই, মেয়েটাকে আমি সাথে নিয়ে যেতে চাই।আপনারা আপত্তি করবেন না।
- ভাবি,বুঝতে পারছি।কিন্তু এই অবস্থায় ওকে নিয়ে গিয়ে আপনি কতটা কি করতে পারবেন জানি না।
আমার মনে হয় এখানে থাকাটাই ভালো হবে।
- শিখা এখন যেতে চাচ্ছে না, কিছু দিন পরে নাকি যাবে। আমি সপ্তাহ খানেক পরে নিয়ে যাবো।
- সে পরে দেখা যাবে।
আপনারা আজকে কোথাও যাচ্ছেন না।দুটো দিন থেকে যাবেন।
- ভাই, কিভাবে...
- হা আপা।দুটো দিন থেকে গেলে শিখার ভালো লাগবে। আপনি আর আপত্তি করবেন না।
সারোয়ার সাহেব আর আফরোজা বেগমের অনুরোধে শিখার মা দুদিন থেকে গেলেন শিখার কাছে।
উনার তো ইচ্ছে করে সারাক্ষণ মেয়ের পাশে থাকতে। কিন্তু মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে এভাবে থাকা! তার উপর বিয়ের বিষয়টা উনার ভালো করেই মনে আছে।
সেই মরমে উনি মরে যাচ্ছেন। তবুও মেয়ের জন্য লাজ লজ্জা, সম্মানের কথা ভুলে তিনি ছুটে এসেছেন।
বসন্ত এসে গেছে । গাছে গাছে নতুন পাতায় আর ফুলের মেলা বসেছে।
শিমুল, পলাশ,কৃষ্ণচূড়ায় ছেয়ে গেছে প্রকৃতি।
মাহিরদের বাসার পাশে বড় বড় কয়েকটি শিমুল গাছ আছে। মাহিরের বেলকনিতে থেকে স্পষ্ট দেখা যায় গাছে যেন আগুন লেগেছে!
শিখা শুয়ে শুয়ে জানালার ফাঁকে একটু একটু দেখে সেই আগুন।
- বসন্ত এসেছে! শিমুল ফুল অনেক সুন্দর।।
- তোমার ভালো লাগে?
- অনেক।
- দেখবে?
- অই যে দেখা যায়।
- আরও দেখাবো।আসো।
মাহির শিখাকে ধরে নিয়ে ব্যালকনিতে বসিয়ে দেয়।
- এবার দেখো তো কেমন?
শিমুল বনে আগুন লেগেছে, পুড়ছে কারো মন!
আর কারো মনে শিখা দাউদাউ করে জ্বলছে!!
শিখা দুচোখ ভরে দেখছে।আহ! এতো সুন্দর কেন সবকিছু!!
চোখে জল এসে যায়।
- এতো সুন্দর বসন্ত আগে কখনো দেখিনি।
মাহির কিছু বলে না, শুধু শুনে যাচ্ছে শিখার কথা।
(৮)
শিখার গাল বেয়ে দুফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। কালের যাত্রার ধ্বনি শিখা শুনতে পাও??
শিখা হয়তো শুনতে পাচ্ছে।।
লুকোচুরি লুকোচুরি.... সব কিছুতে কেমন একটা লুকোচুরি খেলা....!!
সবাই তার সাথে লুকোচুরি খেলায় মেতেছে!!
শিখাও বাদ যাবে কেন? শিখাও এ খেলায় যুক্ত হয়ে গেছে। এমন ভাবেই থাকে যেন সে কিছুই জানে না!
কিন্তু শিখা সবটা জানে।কিন্তু কাউকে বুঝতে দেয় না, যে ও সবকিছু জানে।
কি অদ্ভুত লুকোচুরি!
বেলকনিতে বসেই গোধূলির রঙ গায়ে মাখলো শিখা। শিখা একা নয়,মাহিরও।
জ্বলজ্বল করা সূর্যটা ধীরে ধীরে, নিভু নিভু হয়ে পশ্চিমে ডুবে গেছে, তার সাথে সাথে আধারে ডুবে গেছে সব।
শিখা জানে এই সূর্যটা যেমন নিভু নিভু হয়ে অস্ত গেছে, তেমনি সেও অসীমের পথে যাচ্ছে।
সূর্য অস্ত গেলেও উদয় হয়ে ঝলমলে রোদে হাসবে, কিন্তু শিখার জীবন প্রদীপ নিভে গেলে আর উদয় হবে না।
মানুষের সময় যখন ফুরিয়ে যায় তখন বাঁচার আকুতি আরও তীব্র হতে থাকে। সবকিছু মনে হয় এতো সুন্দর কেন! এতো মায়া কেন!
তবুও কিছু মানুষ মায়া কাটাতে চায়।
শিখার কাছে গোপন করলেও শিখা জেনে গেছে তার লিউকেমিয়া। নিজের অজান্তেই এই রোগ ধীরে ধীরে শেষ করে দিয়েছে তাকে,কখনো গুরুত্ব দেয়নি। অসুস্থ বোধ করলেও কাউকে বলেনি,দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে গেছে, যার শেষ পরিনতি এই!!
একেবারে লাস্ট স্টেজে আসার পরে ডাক্তার দেখানোর হয়েছে।কিন্তু এখন আর কিছুই করার ছিলো না। তবুও হাসপাতালে ভর্তি ছিলো।
কিন্তু বাড়িতে আসার জন্য ছটফট করায় ডাক্তার ওকে ছেড়ে দিলো।ডাক্তাররাও মানুষ। দুঃখ, কষ্টের অনুভূতি তাদেরও আছে।
শিখার জন্য কিছু করতে পারবে না, শুধু ধরে বেঁধে কিছু মেডিসিন দিতে পারবেন! এটা ভালো করেই জানেন মেডিসিন দিয়েও কিছু হবার নয়।তারচেয়ে যে ক'টা দিন আছে, সেদিনগুলো মেয়েটার পরিবারের সাথে কাটানোই ভালো। এই ভেবেই ওকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
তারা শিখাকে কিছুই জানায়নি। কিন্তু শিখা জেনে গেছে।
হাসপাতাল থেকে রিলিজ নিভে শুনে ইভা আপত্তি করছিলো।
সারোয়ার সাহেব, ইভা আর মাহির কথা বলছিলো নিচুস্বরে।শিখা ঘুমে ছিলো। কিন্তু যখন ঘুম ভেঙে গেছে তখন শুনতে পারলো ওকে নিয়েই আলোচনা।
কোনো সাড়া না দিয়ে ঘুমের মতো পড়ে রইলো, কারণ শিখা জানতে চেয়েছিলো ওর কি হয়েছে।
- বাড়ি নিয়ে যাওয়া কি ঠিক হবে? এখানে তো ট্রিটমেন্ট ভালো চলছে। নিয়ে গেলে যদি আরও সমস্যা হয়??
- লাভ তো তেমন কিছুই হবে না, শুধু শুধু মেয়েটা বন্দী থেকে কষ্ট পেয়ে যাবে।
- কিছুই কি করার নেই বাবা? ডাক্তার কি আশার কোনো কথা বলেনি?
- না গো মা। লিউকেমিয়া একেবারে লাস্ট স্টেজে ডাক্তারের আর কিছু করার নেই।কেমো দিলেও এর ধকল সহ্য করার মতো ক্ষমতা নেই ওর শরীরে। একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউ কিছু করতে পারবে না।
- বাবা, শিখাকে বাড়ি নিয়ে যাবো। এখানে ওর কষ্ট হচ্ছে। সারাজীবন কষ্ট পেয়ে গেছে। শেষ ক'টা দিন এভাবে আজাব না দিয়ে ওর ইচ্ছের দাম দেয়া উচিত।
- হা। সেটাই ভালো হবে। সবার সামনে থাকলে মনে কিছুটা শান্তি পাবে।
- তাহলে সেটাই করো ভাই,মেয়েটার এই অবস্থা আর চোখে দেখা যাচ্ছে না।
শিখা সব কথা শুনেছে। ব্লাড ক্যান্সারে শেষ পর্যন্ত শিখা নিভে যাবে এটা জেনে গেছে।
সন্ধ্যা নামায় মাহির শিখাকে রুমে নিয়ে শুয়িয়ে দেয়।
কেমন মায়া পড়ে গেছে মেয়েটার উপর।
- আমার জন্য এতো কষ্ট করছেন কেন?
- কি কষ্ট করলাম?
- এইযে আমার এতো সেবা-যত্ন করছেন!
- তুমি অসুস্থ তাই।
- হুম।
- আমি আমাদের বাড়িতে যেতে চাই...
..
মাকে বলেছি...... উনি আসবেন আমাকে নিতে।
- বাড়িতে যাবে মানে কি?? এই অবস্থায় যাওয়া অসম্ভব। কোথাও যেতে পারবে না। এখানেই থাকবে।
শিখা মৃদু হাসে।
- যেতে পারবো। আমাদের বাড়িতে যেতে খুব ইচ্ছে করছে।
- তুমি জানোনা ওখানে পরিস্থিতি? সেখানে তোমাকে কিছুতেই যেতে দিবো না।
- যাইহোক,ওটা আমার বাড়ি। জন্মের পর থেকে ওখানেই থেকেছি।এখন কেন জানি মন খুব টানছে সেখানে যেতে। আপনি না করবেন না।
- দেখো শিখা,আমি এই অবস্থায় তোমাকে পাঠাতে পারবো না। তুমি এখানেই থাকবে আমার কাছে।
তোমার মা বোন চাইলেও ঠিক মতো তোমার দেখাশোনা করতে পারবে না।
- ওসব নিয়ে চিন্তা করবেনা না। কিছু দিনেরই তো ব্যাপার!
- কিছু দিনের ব্যাপার মানে?
মাহির চমকে উঠে।
- কিছু দিন পরে তো চলে আসবো।
- হুম।
- আমাকে যেতে দিবেন না? বেশি কিছু চাইনি আপনার কাছে।
- তুমি বুঝতে পারছো না!
- আমি বুঝতে পারছি। আপনি না করবেন না।
আমাকে যেতে দিন।
মাহির গম্ভীর হয়ে গেলো।শিখাকে সে যেতে দিতে চায়না।মাহির চায় শিখা ওর সামনেই থাকুক।
কেন চায় সে নিজেও জানে না। হয়তো মেয়েটার উপর মায়া পড়ে গেছে, তাই।সেখানে গেলে শিখা শান্তি পাবেনা,সেবাযত্ন ও পাবেনা ঠিকঠাক। এসব ভেবেও মাহির ওকে যেতে দিতে চাচ্ছে না।
আর শিখা?
শিখা মনে মনে ভাবছে - আমার জন্য মাহিরের জীবন এলোমেলো হয়ে গেছে। মাহিরের জীবনে এক অভিশাপের নাম - ' শিখা'। মরেই তো যাবো।কেন অর উপর বোঝা হয়ে থাকবো??
সব দায় থেকে মরার আগেই মুক্তি দিয়ে যাই।
এতো যত্ন, এতো কেয়ার! এসব দেখলে বাঁচার ইচ্ছে হবে।
তারচেয়ে আমি চলে যাবো। সবাই এখানে কত কষ্ট করছে আমার জন্য!.
এইসব কথা ভেবেই শিখা যাবার জন্য পাগল হয়ে গেছে।
ওদের উপর আর বোঝা হয়ে থাকতে চাইছে না শিখা।
মাহির অনেক ভেবে বললো -
আমাকে একটু ভাবতে দাও।
গল্পঃ__কনে_বদল
পর্ব : ০৬ (সমাপ্ত)
লেখিকাঃ তাসলিমা মুন্নী
(৯)
মাহির অনেক ভেবে বলল
- আমাকে একটু ভাবতে দাও।
মাহির অনেক ভাবলো শিখাকে যেতে দিবে কিনা।কিন্ত কিছু সিদ্ধান্ত নিতে পারছেনা।
ওর ইচ্ছে করছে না যেতে দিতে। এদিকে শিখা যাবার জন্য উতলা হয়ে আছে।
শেষ পর্যন্ত মাহির ওর বাবাকে বললো
- বাবা, শিখা ওর মায়ের কাছে থাকতে চাইছে।
- বেশতো,কাউকে পাঠিয়ে ওর মাকে নিয়ে আসো।
- না বাবা,ও ওবাড়িতে থাকতে চাইছে!
- তা কিভাবে সম্ভব? তুমি জানো না সেখানে কি হালে ছিলো?
- জানি বাবা।
- তবে এ কথা বলছো কি করে? তুমি ওকে মেনে নিতে পারোনি ভালো কথা, তাই বলে ওখানে অবহেলায় ছেড়ে দিবে?
- তুমি বুঝতে পারছো না বাবা,আমি যেতে দিতে চাচ্ছি না।
কিন্তু শিখা যাবার জন্য পাগল হয়ে গেছে। আমি বুঝতে পারছি না কি করবো।
- হুমম।
আমিও বুঝতে পারছি না কি করা উচিত!
এখানে যে সেবাযত্ন পাবে সেগুলো পাবে কিনা জানি না। কিন্তু তারচেয়ে বড় কথা হলো এই সময় যদি ওর মনে টানে তবে যেতে দেয়াই দরকার। আফসোস রেখে....
- ঠিক আছে বাবা, আমি ওকে আবারও বুঝাতে চেষ্টা করবো যদি মানে তো ভালো আর না মানলে...
আফরোজা বেগমে যখন শুনলেন শিখা ওর বাড়িতে যেতে চাচ্ছে, তখন শিখার কাছে গেলেন। ওর কাছে গিয়ে বসে মাথায় হাত রেখে
- তোমার এখানে অসুবিধা হচ্ছে মা?
- না মা।আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।আপনারা এতো দেখাশোনা করেন, অসুবিধা হবার সুযোগ ই দিচ্ছেন কই?!
- তাহলে বাড়ি যেতে চাচ্ছো কেন?
- মা, কেন জানি মন খুব চাইছে একটা বার যেতে। কিছু দিন থেকেই চলে আসবো।
- সুস্থ হও আগে,তারপর যাবে।
- কিছু দিনের জন্যই তো।আপনি বাবাকে একটু বলেন না মা!
খুব যেতে ইচ্ছে করছে!
- আচ্ছা দেখি, তোমার বাবা কি বলেন!
মাহির শিখাকে আবারও অনেক বুঝালো। কিন্তু শিখা যাবেই বলে ঠিক করেছে। তাই মাহির শেষ পর্যন্ত রাজি হয় শিখাকে যেতে দিতে।
শিখার মা, মামা এসেছে ওকে নিতে।
মাহির শিখার কাছে এসে বললো
- সত্যিই চলে যাচ্ছো?
- হা।
আপনি দেখতে যাবেন আমাকে?
- নাহ!
- কেন?
- দেখতে যাবো কেন?
আমি যাবো নিয়ে আসার জন্য।
- তাই বুঝি?
শিখা হাসে।
- হা তাই।
একটা হাতে শিখার গাল ছুঁয়ে
- ভালো থেকো আর নিজের খেয়াল রেখো।আমি খুব তাড়াতাড়ি আসবো তোমাকে আনার জন্য।
শিখার অজান্তেই চোখ ভিজে গেছে।
মাহিরের সেই হাতেই হাত রেখে বললো
- আপনিও অনেক ভালো থাকবেন। জামাকাপড় এগুলো এলোমেলো করে রাখবেন না।
নিজের খেয়াল রাখবেন।
শিখা অশ্রুসিক্ত চোখে বিদায় নিলো সবার কাছ থেকে।
একদিন অজানা একটা ভয় নিয়ে বউ সেজে এবাড়িতে এসেছিলো। আজ এবাড়ি ছেড়ে যাচ্ছে। আর কখনো ফেরা হবে না এবাড়িতে।কখনো এবাড়ির বেলকনিতে বসে শিমুলে আগুন ধরা বিকেল দেখা হবে না।
এ বাড়ি ছেড়ে শিখা চলে যাচ্ছে।
কি আজব! জটিল যায়গা এ দুনিয়া! মানুষ যখন বাঁচতে চায় না, তখন মৃত্যু ধরা দেয় না!
আর যখন বাঁচার আকাঙ্ক্ষা তীব্র হতে থাকে, বাঁচতে ইচ্ছে করে তখন চারদিক থেকে অন্ধকার হয়ে ঘনিয়ে আসে মৃত্যুর কালো ছায়া।।
শিখার এখন মাঝে মাঝে বাঁচতে ইচ্ছে করে। পাছে এই ইচ্ছেটা তীব্র হয়ে যায়! সেই ভয়ে রীতিমতো পালিয়ে যাচ্ছে এখান থেকে।
তীব্র হলেও কোনো লাভ নেই জানে,মিছেমিছি মায়া বাড়বে।
ওর প্রতি মাহিরের ভালোবাসা নেই।যা আছে সেটা কেবলই সহানুভূতি।
এতো দিন একসাথে থাকা একটা মানুষ ধীরে ধীরে মৃত্যুর মুখে চলে যাচ্ছে, সেটা,দেখে যেকোনো মানুষের দয়া হবে, খারাপ লাগবে।
মাহিরের ও এমনই হয়েছে।
বড়জোর একটা মায়ায় পড়ে যাবে!!
কিন্তু কি হবে এই মায়ায় জড়িয়ে??
একা যেমন এসেছিলো, সেই একাই চলে যাচ্ছে। না হয় ভালোবাসা নামক অদৃশ্য অনুভূতি টা শিখার জীবনে আসলো না। শিখার জীবনের গল্প না হয় এখানেই থেমে যাবে।
কি ক্ষতি হবে তাতে?
সূর্য পূর্ব দিক বাদ দিয়ে পশ্চিমে উদয় হবে না। ঘড়ির কাঁটা উল্টো দিকে ঘুরবে না।কিছুই থেমে থাকবে না।
সব নিয়মমাফিক চলবে। হয়তো কিছু মানুষের দুঃখ হবে, কষ্ট হবে।
কিন্তু সেটা সাময়িক।
কারণ সময় এমন এক ঔষধ যা ধীরে ধীরে সব কিছু সহজ করে দেয়, ভুলিয়ে দেয়।
শিখার না থাকার দুঃখ ও একটা সময় ভুলে যাবে সবাই।
(১০)
সময় এমন এক ঔষধ যা ধীরে ধীরে সব সহজ করে দেয়, ভুলিয়ে দেয়। শিখার না থাকার দুঃখও একটা সময় ভুলে যাবে সবাই।
অনিবার্য পরিণতি কঠিন, কিন্তু সেটাই সময়ের সাথে স্বাভাবিক হয়ে যায়। সন্তানের মৃত্যু হলেও মা-বাবা বুকে পাথর চেপে বেঁচে থাকেন। পিতামাতার মৃত্যুর শোক সহ্য করে সন্তান ও বেঁচে থাকে!
দুনিয়া টা কঠিন।
এতোটাই কঠিন যে একটা সময় চোখের জলও শুকিয়ে যায়।এতো আপনজনের মৃত্যুর বর্ননা অনায়াসে করা যায়!!
শিখাও জানে একদিন এমনই হবে।
অবশেষে মাহিরের বাড়ি থেকে শিখা বিদায় নিলো এই কঠিন সত্যি টা মেনে। একটা তাসের ঘর অথবা খেলাঘর বেঁধে ছিলো শিখা,তার শেষ হয়তো এভাবেই হবার ছিলো।
শিখা ফিরে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ওর ভেতরটা ভেঙেচুরে যাচ্ছে। বুকের মধ্যে কি একটা ভার চেপে আছে যেন। কি যেন ফেলে যাচ্ছে এখানে, অথচ ওর ফেলে যাবার মতো কিছু ছিলো না।
এ বাড়ির মানুষদের প্রতি শিখার অনেক মায়া পড়ে গেছে। এজন্যই হয়তো যাবার সময় কিছুটা খারাপ লাগছে।
শিখা বাড়িতে এসেছে প্রায় একমাস। এর মধ্যে রুম থেকে বেরিয়ে বাইরে যাওয়া হয়না।দু-একদিন শশী আর শিখার মা ওকে বারান্দায় নিয়ে এসেছিলো। বারান্দায় বসে খোলা আকাশ দেখে মনের গভীর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।
শিখার শ্বশুর -শ্বাশুড়ি এসেছিলো ওকে নিয়ে যেতে।
কিন্তু শিখা অসুস্থতার অযুহাতে যায়নি।তারপর আরেকদিন শিখার শ্বশুর, শ্বাশুড়ি, ইভা,মাহিন সবাই এসে দেখে গেছে।
উনারা অনেক চেয়েছিলেন শিখাকে বাড়ি নিয়ে যেতে, কিন্তু শিখাকে নিয়ে যাবার মতো অবস্থা ছিলো না।
মাহিরও এসেছিলো দু-তিনবার। এসে চুপচাপ শিখার পাশে বসে ছিলো। শিখা ঘুম থেকে জাগার পরে দেখে মাহির বসে আছে!
- আপনি এসেছেন?!!
- কেমন আছো তুমি??
- ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
- আমিও ভালো আছি।
- অনেক শুকিয়ে গেছেন আপনি!
- তাই?
- হুম
এরকম টুকটাক কথা চলে দুজনের মধ্যে।
মাহির অনেক সময় থেকে তারপর চলে যায়।যখনই আসে সাথে করে শিখার ঔষধপত্র যাবতীয় সবকিছু নিয়ে আসে।কত কিছু নিয়ে আসে শিখার জন্য, কত ধরনের ফলমূল; কিন্তু শিখা তো....
বাড়িতে মাহিরের একদন্ড মন টিকছে না।ভেতরে কেমন আনচান আনচান করে। এক অদ্ভুত শূন্যতা ঘিরে থাকে।।
শিখার অভাব দিন দিন তীব্র অনুভব করছে।কিন্তু এতো দূর! প্রতিদিন যাওয়া সম্ভব হয় না।
তার উপর অফিস তো আছেই। মাহিরের ইচ্ছে করে শিখার কাছে যেতে।একদিন হুট করেই চলে আসে।
তারপর সেই টুকটাক কথোপকথন চলে দুজনের মধ্যে।
শিখা খুব একটা কথা বলতে পারে না। তাই মাহির বেশি কিছু বলে না,কারণ তাতে শিখা কথা বলার চেষ্টা করে। কথা বলতে খুব কষ্ট হয় শিখার।
চোখ বন্ধ হয়ে আসে।মনে হয় ঘুম ওর চোখে,তারপরও তাকিয়ে থাকার চেষ্টা করে। কারণ মাহির সামনে বসে আছে!
মাহির বুঝতে পেরে বলে
- ঘুমাও।আমি তোমার পাশে বসে আছি। আস্তে করে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
শরীরের ধকল সইতে না পেরে ঘুমিয়ে পড়ে শিখা।
সকালের সূর্যের আলো চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙে যায় শিখার।
চোখ খুলতে পারছে না। কিন্তু মাহির জানালা খুলে দিয়েছে।
- আর ঘুমাতে হবে না। এখন উঠে পড়ো।
কত বেলা হয়ে গেছে!
- আমি কিভাবে উঠবো? নিজে নিজে বসতে পারি নাকি?
- কে বলেছে পারো না? তুমি কি এখন আগের মতো অসুস্থ নাকি? ! তুমি তো অনেক সুস্থ হয়ে গেছো। চেষ্টা করে দেখো,নিজেই উঠে বসতে পারবে।
শিখা মাহিরের কথা শুনে হাত-পা নাড়াচাড়া করে দেখছে।
আসলেই তো! আগের থেকে শরীর কেমন ফুরফুরে লাগছে।
- কই? উঠে বসো এবার।
শিখা উঠে বসার চেষ্টা করছে, প্রথম দুবার একটু উঠেও বসতে পারেনি। তৃতীয় বার উঠে বসে গেছে।
- কি আশ্চর্য! আমি নিজে নিজেই বসতে পারছি?
- বলেছিলাম না ঠিক পারবে।
- কিন্তু... কিভাবে সম্ভব?
- মনের জোর থাকলে আর ভালোবাসা থাকলে সব সম্ভব।
এবার তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও।নাস্তা করতে হবে।
- আজ সকাল এতো সুন্দর কেন?
- ওমা! সেটাও জানো না?
- না! আপনি জানেন?
- হুম, জানি তো।
- কেন?
- আজ আমরা নতুন করে জীবন শুরু করবো তাই!
- নতুন করে জীবন শুরু মানে? আমি কিছু বুঝতে পারছি না!
- মানে হচ্ছে তুমি আজকে আমার সাথে বাড়ি ফিরে যাচ্ছো।বুঝতে পেরেছো?
- আমি? কিন্তু...
- কিন্তু কি?
- আমি যে অসুস্থ! আমার যে খুব বেশি সময় নেই।
- কে বলেছে? ওসব ভুল ছিলো, ডাক্তারের ভুল ছিলো। তোমার অন্য একটা অসুখ ছিলো। এখন তুমি অনেক সুস্থ হয়ে গেছো। আরও তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে।
- কি বলছেন এসব!?
সত্যিই আমি??..
শিখা উত্তেজনায় বিছানা থেকে নেমে মাহিরের কাছে পায়ে ছুটে গিয়েই ওর হাত ধরলো।
- আমি বাঁচবো! আমি বাঁচতে পারবো? আমার কিছু হয়নি!
- হা।তুমি বাঁচবে। তোমাকে যে বাঁচতে হবে শিখা। আমার জন্য!
- আপনার জন্য??
- হা।আমার জীবন টা এলোমেলো করে দিয়েছিলে,এখন সেটা কে গুছাবে শুনি?
- আমি গুছাবো!
- হা।তুমি।।
সব কিছু স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে।আমি বিশ্বাস করতে পারছিনা...
আমি সুস্থ হয়ে গেছি...!! আমি বাঁচবো...!!
আমার কিছু হয়নি...!!
- শিখা.... এই শিখা.... তুমি কাঁদছো কেন?
-কই!! আমি কাঁদছিনা তো.... আজ আমার অনেক খুশি। খুশিতে চোখে পানি চলে এসেছে।
- আচ্ছা... তুমি তৈরি হয়ে নাও.. আমি এক্ষুনি আসছি। এসে তোমাকে নিয়ে যাবো।
- কোথায় যাচ্ছো তুমি??
মাহির রুম থেকে বেরিয়ে গেছে। শিখা পিছন থেকে জিজ্ঞেস করছে
- কোথায় যাচ্ছো? মাহির? আমাকে নিয়ে যাবেনা?
আমাকে নিয়ে যাবে কখন?
.
.
.
মাহির যত দূরে যাচ্ছে শিখা তত জোরে ডাকছে কিন্তু মাহির যেন বধির হয়ে গেছে। কিছু শুনতে পাচ্ছে না। এতো চিৎকার করে শিখা ডাকছে কিন্তু এসব কিছু মাহিরের কান পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছেনা!
- আমি তৈরি হয়ে থাকবো... তুমি কখন আসবে মাহির...? কখন আসবে?
ধীরে ধীরে শিখার কণ্ঠস্বর নিচু হয়ে আসছে।শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে!!
- আপু? আপু? তোমার বেশি খারাপ লাগছে?
শিখাপু? ও আপু.... তুমি এমন করছো কেন?
শিখা তাকিয়ে দেখে শশী ওর পাশে বসে কাঁদছে!
- মাহির কই?
- আপু? তোমার এখন কেমন লাগছে?
- মাহির আসেনি?
- মাহির ভাইয়া আজকেই আসবে। তুমি একটু ঘুমাও আপু।
শিখার মা তাড়াহুড়ো করে রুমে আসে।
- মা , আপু কি জানি সব বলে! এখন চোখ খুলে মাহির ভাইকে খুঁজছে।
- আল্লাহ... আল্লাহ তুমি সহায় হও...আমার মেয়েটাকে উদ্ধার করো। ছেলেটা কালকেই ভালো দেখে গেলো!
- মা, আপুর অবস্থা কি বেশি খারাপ?
- কাল থেকে কিছু বুঝতে পারছি না। ও বাড়ির তারা আজকেই আসবে,রাস্তায় আছে। আমার মাথা কাজ করছে না আর!
কখনো অচেতন হয়ে পড়ে,কখনো জ্ঞান ফিরে।
তখন ভর দুপুর। শিখা শশীকে জিজ্ঞেস করলো
- শশী?
- আপু...
- মা কই? আমার পাশে একটু বসতে বল।
- আমি এক্ষুনি বলছি...
মা..মা... তুমি আপুর পাশে বসো।
- মাহির আসেনি? আসবে না আর?
- আসবে আপু... একটু পরেই...আসবে
আরও আধাঘন্টা কেটে গেছে। শিখা আবার জিজ্ঞেস করলো
- মাহির এসেছে?
মা আমাকে একটু পানি দাও...
পানি খাবো।
শিখার মা চামচে করে পানি দেয় দুচামচ পানি খায় শিখা...
তৃতীয় চামচ আর মুখে তুলতে পারেনি।
শিখার চোখে সেই অস্তমিত সূর্যটার দৃশ্য ।
ধীরে ধীরে নিভে যাচ্ছে...
শিখাও... নিভে গেলো ধীরে,.... কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে!!
সব মায়াজাল ছিন্ন করে শিখার আলো নিভে গিয়ে গাঢ় অন্ধকার নেমে এলো!!
- সমাপ্ত -