গল্পঃ_নিয়তি | অবহেলা স্ট্যাটাস | অবহেলার কষ্টের স্ট্যাটাস

 অবহেলার কষ্টের গল্প

অবহেলার কষ্টের গল্প

আজ আমার বিয়ে। বিয়ে সবার জীবনের একটা কাঙ্খিত দিন, আনন্দের দিন। অথচ আমি লজ্জা পাচ্ছি। আটচল্লিশ বছর বয়সে বিয়ে হলে, অবশ্য সবাই আমার মতোই আনন্দ না পেয়ে লজ্জাই পেতো। বিয়ে করে মানুষ জৈবিক চাহিদা মেটানোর জন্য, বংশ বৃদ্ধি করার জন্য, সংসার করার জন্য, ভালোবাসার জন্য। অথচ যার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে তার কোনো জৈবিক চাহিদা আছে কি-না জানি না, তবে আমার নেই।


গত বছর নভেম্বার মাস থেকে আমার মেন্সট্রুয়েশান বন্ধ। বয়স হয়েছে, শরীরে রক্ত শূণ্যতা দেখা দিয়েছে। প্রাকৃতিগতভাবেই বয়স হলে একটা নির্দিষ্ট সময় পর নারীদের সন্তান ধারন ক্ষমতা শেষ হয়ে যায়। আমার মেন্সট্রুয়েশান বন্ধ হয়ে যাওয়া সন্তান ধারন ক্ষমতা শেষ হয়ে যাওয়ার লক্ষন কি-না জানি না।  অবশ্য জানার প্রয়োজনও হয়নি। স্বামী ছাড়া আমি সন্তান পাবো কোথায়?


আমি ফুলশয্যার ঘরে বসে অপেক্ষা করছি আমার স্বামীর জন্য। যার সাথে আজ সন্ধ্যায় আমার বিয়ে হয়েছে। আচ্ছা! আমি যতটা অধির আগ্রহে ভদ্রলোকের জন্য অপেক্ষা করছি। তিনি নিশ্চয়ই ততটা আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। অবশ্য তার আগ্রহের কোনো কারণই নেই। আমি হচ্ছি তার দ্বিতীয় বউ। তিনি ষাট বছরের একজন বিপত্নীক।


বছর পাঁচেক আগে ভদ্রলোকের স্ত্রী রোড এক্সিডেন্টে মারা যান। বৃদ্ধ বয়সে তিনি আর বিয়ের চিন্তা করেননি। অথচ ছেলেরা দেশের বাইরে থাকে, সেজন্য অসুস্থ বাবাকে কোনো কাজের লোকের কাছে রেখে যেতে চায়নি। বাধ্য হয়ে বিয়ে নামক স্বীকৃতি দিয়ে তারা তার বাবার জন্য একজন পার্মানেন্ট কাজের লোক এনেছে।


যাকে বিয়ের সময় শর্ত দেয়া হয়েছে সে কোনদিন মা হতে পারবে না। বয়স ৪৮ হলেও আমি হচ্ছি কুমারী। মাতৃত্বের আক্ঙ্খা একজন নারী হিসাবে আমার রয়েছে। আমাকে বিয়ে করাবে তারা একটাই শর্তে আমি কখনো মা হওয়ার চেষ্টা যেন না করি। আমি কষ্ট পেয়েছি, এমন কঠিন শর্তে ঠুকরে কেঁদেছি। তখন অবশ্য ছোটবোন মনে করিয়ে দিয়েছে,


– "বুবু তোর তো মেন্সট্রুয়েশান বন্ধ। এমনি তেই তোর আর মা হওয়ার বয়স নেই। শর্ত দিয়ে ভালোই করেছে।  তুই রাজি হয়ে যায়।"


অামার অবশ্য রাজি না হয়েও কোনো উপায় ছিল না। আর কত কাল ছোট ভাই, ছোট বোনের সংসারে তাদের দয়ায়, অনুগ্রহে বেঁচে থাকব। তাদেরও সংসার আছে বউ -বাচ্চা আছে। আমাকে নিয়ে তাদের ছোট হতে হয়। কেউ আসলে পরিচয় দিতে পারে না।


নিজের বোন বলতে লজ্জা পায়, কাজের লোক বললে বিবেকে বাধে। আমি সব বুঝতে পারি, আমার অপমানে, অসম্মানে মরে যেতে ইচ্ছে করে। অথচ এই মধ্য বয়সে কেউ আমাকে বিয়ে করবে সেটাও আশা করিনি। হঠাৎ করে বিয়ের প্রস্তাব আশায় আমার মরুময় জীবনে যেন এক পশলা সুখের বৃষ্টি এসে ঝরে পড়েছে।


আমার চেয়েও বেশি উৎসাহী আমার ভাই- বোন। আপদ বিদেয় হবে ভেবে তারা শান্তিই পেয়েছে। তারা অবশ্য যেনতেন বিয়ে দেয়নি। ভদ্রলোকের ঢাকায় তিনটে বাড়ি, নিজস্ব গাড়ি, ব্যাংকে মোটা অংকের ফিক্সড ডিপোজিট আছে। দুই ছেলেই দেশের বাইরে প্রতিষ্ঠিত। দেশের সবকিছু বলতে গেলে আমিই ভোগ করব। এমন নির্ভেজাল সুখের জীবন তো আমার জন্য স্বর্গতুল্য।


নিশ্চয়ই প্রশ্ন জাগছে মনে এত বছরেও কেন আমার বিয়ে হয়নি। বিয়ে হয়নি বলব না। বিয়ে একসময় আমি ইচ্ছে করেই করিনি। পরে আমাকে দেয়া হয়নি। এর পরে আর কেউ করতে চায়নি। না না আমি মোটেও অসুন্দর নই বা অযোগ্য নই। এখন অবশ্য সুন্দরের চিটেফোটাও অবশিষ্ট নেই, আমি যৌবন কালের কথা বলছি। যখন চারদিক থেকে সমানে বিয়ের প্রস্তাব আসতো। বিয়ের কনে হিসাবে সবার কেবল আমাকেই পছন্দ হতো। আমি অসম্মতি জানালে অনেকেই বলতো,


– "ঠিক আছে তুমি এখন বিয়ে না করলে, তোমার মতো একজন মেয়ে হলেও আমার ভাইয়ের জন্য দেখে দিও।"


তার মানে আমার মতো মেয়ে চাই সবার বিয়ে করার জন্য। একটা সময় আমার মতো, আমার মতো নয় সব মেয়েরই বিয়ে হয়ে গেছে শুধু আমি ছাড়া।


আমার বিয়ের বয়সে হঠাৎ করে বাবা মারা যাওয়াও পুরো পরিবারের দায়িত্ব আমার কাঁধে এসে পড়েছে। তখন আমার বয়স আর কতই বা হবে! বড় জোর আঠারো কী বিশ! সবে মাত্র কলেজের গণ্ডিটা পার করেছি। স্কুল শিক্ষক বাবার স্বপ্ন ছিল আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর। আমিও শিক্ষকতা করবো বাবার মতো, তবে স্কুলে নয় কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু বিধি বাম।


বাবার মৃত্যুর পর আমাকে বাধ্য হয়ে নিজ জেলা শহরে ডিগ্রিতে এডমিশান নিতে হয়েছিল। আত্মীয় -স্বজন কেউ মেনে নিতে পারেনি আমার উপজেলা শহরের ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হওয়ার ব্যাপারটা। যে মেয়ে এসএসসি আর এইচএসসিতে স্টার মার্কস পেয়েছে, সে পড়বে ডিগ্রিতে! স্বয়ং মা কেঁদে বুক ভাসিয়েছেন। মেয়েকে নিয়ে ছোটবেলা থেকে দেখা স্বপ্ন হঠাৎ করে শুকনো পাতার মতো মরমর করে ভেঙে যাওয়ায়।


অথচ আমি ছিলাম চুপচাপ। কারণ বাবার মৃত্যুর পর পুরো পরিবারের একমাত্র অভিভাবক তখন আমি একা। আমরা চার ভাই-বোন। সবার বড় বুবু। সে বুদ্ধি প্রতিবন্ধি। এক জীবনে তার বিয়ে শাদির আর আশা নেই। কে নেবে ওর দায়িত্ব। যে মেয়ে নিজের ভালো বুঝে না। বুদ্ধি নেই, বিবেক নেই, শুধু ক্ষুদা আছে। খেতে বসলে পাতিলে কি আছে না আছে ওসব তার দেখার বিষয় না, তার বড় মাছের টুকরো চাই, প্রতিবেলায় মাংস চাই। খাওয়া একটু কম হলেই শুরু হয় তার উৎপাত। এতদিন বাবা -মা সহ্য করেছেন। পরে আমাকে আর মাকে সহ্য করতে হয়েছে। 


আমি মেজো। বাবার মৃত্যুর কয়েকমাস আগে এইচএসসি পাশ করেছি। তার পর ছোট একভাই, একবোন। ভাইয়ের নাম মাসুদ। তখন এসএসসি পড়তো জিলা স্কুলে। বাবার স্বপ্ন ছিল ওকে ডাক্তারি পড়ানোর। সেজন্যই ছোটবেলা থেকে ওকে জেলা শহরের হোস্টেলে রেখে পড়িয়েছে। প্রতিমাসে খরচ হিসাবে দিতে হয় তিনহাজার টাকা। সেও বাবার স্বপ্ন পুরণের পথে হাঁটছিল। অষ্টম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে। এসএসসিতে স্টার মার্কস পেলে নটরডেম কলেজে পড়তে চায়। ছোটবোন তখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ত। সেও ছাত্রী হিসাবে ভালো ছিল। যে এখন দুই সন্তানের জননী। আমার বিয়েটা তার বাসায় থেকেই দিয়েছে।


-গল্পঃ_নিয়তি

-পর্বঃ_০১

-কামরুন_নাহার_মিশু

--------


-গল্পঃ_নিয়তি

-পর্বঃ_০২

-কামরুন_নাহার_মিশু

--------

গ্রামের বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বাবার, বাচ্চাদের লেখাপড়া আর সংসারের সিংহভাগ খরচ আসত টিউশনি থেকে। বাবার একটা কোচিং সেন্টার ছিল, যেখানে প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণির সব ছাত্র ছাত্রীদের গনিত পড়াতেন। যে যা পারত দিতো, কারো সুনির্দিষ্ট কোনো বেতন ছিল না। বেশিরভাগ ছাত্রই সেই সুযোগ নিত।


পরিবার থেকে টাকা নিলেও বাবার বেতন দিত না। তারপরও সেই কোচিং সেন্টারের আয় দিয়ে আমাদের চার ভাই -বোনের লেখাপড়া এবং সংসার বেশ ভালোই চলছিল। হঠাৎ বাবার মৃত্যর সাথে সাথে কোচিং সেন্টারটাও বন্ধ হয়ে গেলো। সাথে সংসারের চাকা ও ভাই বোনদের লেখাপড়া। বাধ্য হয়ে আমাকে সংসারের হাল ধরতে, ভাই-বোনদের স্বপ্ন পুরনের সারথি হতে বাবার কোচিং সেন্টারের দায়িত্ব নিতে হয়েছে। 


বাবার মৃত্যর পর অনেকগুলো ভালো পরিবার থেকে আমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল। যারা করতে পারবে না, বা যাদেরকে কখনো পাত্র হিসাবে যোগ্য মনে হয়নি আমার জন্য বাবার কাছে একসময়। এখন তারাই করুনা করে বিয়ে করে কন্যাদায়গ্রস্ত পরিবারকে উদ্ধার করতে চেয়েছিল। গ্রামের একটা মেয়ে উপযুক্ত হলে নানান মানুষ নানান মন্তব্য করে। আমিও সে মন্তব্যর উর্ধ্বে ছিলাম না। আমাকে নিয়ে মন্তব্য করার আরেকটা কারণ হচ্ছে আমি অভিভাবকহীন এতিম।


সেই মুহূর্তে মা নিরব হয়ে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কান্না করছিলেন। একদিকে মেয়ের জীবন, অন্যদিকে শূণ্য ভাসমান পুরো সংসার। যদিও ছোট ভাইটা বলেছে, 


– "সংসার একার আপুর নয়, প্রয়োজনে আমিও হাল ধরব।"


আমি রাজি হইনি, আমার মনে হয়েছে আমার ছোট ভাই-বোনদের লেখাপড়া করিয়ে বাবার স্বপ্ন পুরণ করা আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য। ভাইকে সংসারের হাল ধরতে বলব, যে এখনো এসএসসি পাশটা পর্যন্ত করেনি, অথচ নিজে বিয়ে করে সংসার করবো! প্রতিবন্ধি বোনকে মায়ের কাঁধে ফেলে রাখবো! এসবের কোনটাই আমার শিক্ষক পিতার আদর্শ নয়।


সবই আগের মতো চলছিল, বাবার স্কুলের চাকরিটাও আমার হলো, সাথে ছিল কোচিং সেন্টার। আমি ভাই-বোন মা কাউকে কষ্ট পেতে দেইনি। পুরো সংসারের দায়িত্ব বাবার মতো করে পালন করতে লাগলাম।


আর স্বপ্ন দেখতে লাগলাম, আকাশ পড়াশোনা শেষ করে একদিন বড় চাকরি করবে। আমি লাল বেনারসি শাড়ি পরে তার ঘোমটাটানা মিষ্টি বউ হবো। আকাশ হচ্ছে বাবার এক ছাত্র। আমার দু'বছরের সিনিয়ার। পৃথিবীতে তার মা ছাড়া আপন বলতে কেউ ছিল না। ছোটবেলায় রোড এক্সিডেন্টে বাবাকে হারিয়ে মাকে নিয়ে নানার বাড়িতে উঠেছিল। তার নানাদের পুরো বংশে প্রাইমারির গন্ডি ফেরনো একজন মানুষ ছিল না। একদিন ওর মা ছেলেকে নাম দস্তখত শেখানোর জন্য বাবার কোচিং সেন্টারে এনে ভর্তি করে দিয়েছিলেন।


আকাশের মেধা এত ভালো ছিল, যে তাকে একটা পড়া দুই, তিনবারের বেশি কখনোই বলতে হতো না। আমার বাবা চায়নি এমন মেধাবী একটা ছেলের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাক। তাই বাবা ওর মাকে বুঝিয়ে ওকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে। সাথে ওর মস্তিস্কে লেখাপড়ার গুরুত্বের বীজ বপন করে দিয়েছে। এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি, সে নিজের চেস্টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হয়েছে।


আকাশ লেখাপড়ার ব্যাপারে বিভিন্ন পরামর্শের জন্য নিয়মিত ববার কাছে আসা যাওয়ার ফলে আমাদের মাঝে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হয়ে গেছে ছোটবেলা থেকেই। এই সম্পর্কটা একদিন বন্ধুত্বের চেয়ে বড় কিছু হবে আমার পরিবার এবং আমি কোনোদিনই ভাবিনি। একদিন আকাশের মা এসে বাবাকে অনুরোধ করলেন বাবা যেন কখনো আকাশকে তাঁর স্নেহ থেকে বঞ্চিত না করেন। তিনি আমাকে তার পুত্রবধূ হিসাবে দেখতে চান। বাবা সেদিন কোনো দ্বিমত করেননি, আবার কথাও দেননি। এরপর থেকে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কটা দুইপক্ষের সম্মতিতেই আর কয়েক কদম এগিয়ে গেছে।


এটাকে ঠিক প্রেম বলা যাবে না। আবার বন্ধুত্বও নয়। একটা নির্ভরতার জায়গা তৈরি করে নিয়েছিল সে নিজের অজান্তে। আমরা কখনো কারো হাত পর্যন্ত ধরিনি। যেদিন বাবা মারা গেলেন। সেদিন আর সবার মতো আমি তার বুকে আঁছড়ে পড়ে কান্না করেছি। গভীর নির্ভরতায় আর উষ্ণতায় আমি বারবার কেঁপে উঠেছি। এরপর থেকে লক্ষ করেছি আকাশ আমার কাছ থেকে বিশেষ কিছু একটা চাইতো। 


তখন সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তার বাড়ি আসার পরিমান আগের চাইতে বেড়ে গেলো। তখন চারদিক থেকে আমার বিয়ে নিয়ে মাতামাতি চলছিল। সে বিশেষ কিছু চাইত আমার কাছে, অথচ আমার বিয়ের অালোচনায় তাকে কখনো বিচলিত মনে হয়নি। ব্যাপারটা এমন তুমি যারই বউ হও আমার আপত্তি নেই। শুধু একবার হলেও নিবিড়ভাবে আমার কাছে আসো।


আমি কৌশলে এড়িয়ে যেতাম। আমার দিক থেকে আশানুরুপ সাড়া না পেয়ে, হঠাৎ করে আকাশ বদলে যেতে লাগল।


বাবার মৃত্যু, আমার স্থানীয় ডিগ্রী করেজে ভর্তি হওয়ায়, পুরো পরিবারের দায়িত্ব আমার কাঁধে এসে পড়ায়। আকাশ তার স্বপ্ন পরিবর্তন করলো। আমাকে নিয়ে সে আর বিয়ে করার স্বপ্ন দেখেনি। সে একসময় ভেবেছিল আমিও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব। আমারও সুন্দর একটা ক্যারিয়ার হবে। কিন্তু সেটা না হওয়ায়, শহরে গিয়ে রঙিন চশমা চোখে লাগিয়ে তার কাছে আমাকে বড্ড সাদা কালো আর ফানসে মনে হয়েছিল।


আস্তে আস্তে সে পরিবর্তন হতে লাগল, স্বভাবে, চরিত্রে, আচরণে। পরিবর্তনটা এত ধীরে ছিল যে প্রথম প্রথম আমি বা আমার পরিবার বুঝতেই পারিনি।


আকাশের চাকরি হওয়ায় একদিন মা ডেকে তাকে বললো,


– "মেঘলা আমার কাছে থাকলেও, আমি চাই তোমাদের বিয়েটা হয়ে যাক। কয়েক বছরে তুমি সব গুছিয়ে ওকে নিয়ে যেতে পারবে।"


অথচ সে সরাসরি মায়ের মুখের উপর আমাকে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানাল। এত তাড়াতাড়ি সে বিয়ের কথা ভাবছে না। আমাকে সে বন্ধুর মতো মনে করত, বউ হিসাবে কখনো ভাবেনি।


সেদিনই আমার কাছে পুরো পৃথিবীটা মিথ্যা হয়ে গেলো। আমার আর কোনো সম্পর্কের উপর বিশ্বাস ছিল না। মনে মনে পরিকল্পনা করেছি, বাকি জীবন ভাই- বোন আর মাকে নিয়েই কাটিয়ে দেব।


সব কিছুই স্বাভাবিক আর আগের মতোই চলছিল। শুধু ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে আমি আর আমার মন। ভাই মাস্টার্সে পড়ছে। বোনও অনার্সে পড়ে। আমি ভেবে রেখেছি। ভাইয়ের একটা চাকরি হয়ে গেলে হয়তো সংসারের ঘানিটা কিছুটা হালকা হবে আমার।


কিন্তু না হঠাৎ করে তিনদিনের জ্বরে অসুস্থ বুবুটা মারা যায়। বাবার মৃত্যুতে আমি যেমন নির্লিপ্ত ছিলাম, বুবুর মৃত্যুতে ছিলাম তেমনই নিশ্চুপ। আমার মা, স্বামী হারিয়ে, সন্তান হারিয়ে, জীবন্ত লাশ আমাকে নিয়ে টেনশান করতে করতে বুবুর মৃত্যুর পর সে যে বিছানায় পড়ল, তাকে আর স্বাভাবিক জীবন দিতে পারিনি।


আলহামদুলিল্লাহ ছোট ভাই- বোন লেখাপড়ার খরচের জন্যই কেবল আমার উপর নির্ভর করেছিল। বিয়ের ঝামেলায় আর আমাকে জড়ায়নি। তারা নিজেদের পছন্দেই নিজেরা বিয়ে করে নিয়েছে। এতে আমি অবশ্য খুব খুশি হয়েছে। সারা জীবন দায়িত্ব নিতে নিতে আমার আর বেশি দায়িত্ব কর্তব্য ভালো লাগছিল না। আমার বোকা মা নিজের সন্তানের বিয়ের মতো আনন্দের সংবাদ শুনে কেন জানি খুশি হতে পারেননি। উল্টো শোকের মাতম করে বাড়িসুদ্ধ মাথায় তুলেছে।


.


এত শোক মা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। হঠাৎ করে আমাকে সংসার থেকে সম্পর্ণ বিচ্ছিন্ন করে পরপারে পাড়ি জমালেন। ভাই-বোন কিন্তু আমাকে ফেলে দেয়নি, তাদের সংসারে দায়িত্বও আমার কাঁধে তুলে দিয়েছিল। ছোট বাচ্চা, চাকরি সব তারা একা সামলাতে পারছিল না। বিপত্তি বাধালো ভাইয়ের বউ।


সে আর আমাকে সহ্য করতে পারছিল না। ফুলশয্যার বিছানায় বসে শহুরে উচ্চশিক্ষিত মেয়েটার প্রতি মনে মনে কৃতজ্ঞতাবোধ কাজ করছে। সে না চাইলে তো এক জীবনেও আমার গায়ে লাল বেনারসি শাড়ি উঠত না।


.


অপেক্ষায় করতে করতে আমার যখন তন্দ্রার মতো এসেছিল, তখন প্রায় গভীর রাত। আশরাফ সাহেব দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলেন। খট করে দরজার সিটকিনির শব্দে ভয়ে, লজ্জায়, আমার বুকের ভেতর বন্ধি হয়ে থাকা এতদিন মৃত প্রায় মনটা যেন লাফাতে লাগল।


কোনো অজানা সুখের প্রতিক্ষায়, আমার সারা দেহ মন তখন উৎসুক হয়ে আছে। ড্রিমলাইটের আলো অাধারিতে আমার মনে হয়েছিল, ত্রিশোর্ধ কোনো যুবক এসে আমার পাশে বসেছে, যে মুহূর্তে হরণ করে নেবে, আমার সমস্ত অস্তিত্ব। কোনো শক্তি দিয়ে, কোনো যুক্তি দিয়ে তাকে বাধা মানাতে পারব না।


কিন্তু না আমার সব কল্পনাকে মিথ্যা প্রমাণীত করে দিয়ে তিনি বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।


-গল্পঃ_নিয়তি

-পর্বঃ_০৩ (শেষ)

-কামরুন_নাহার_মিশু

--------

অপেক্ষায় করতে করতে আমার যখন তন্দ্রার মতো এসেছিল, তখন প্রায় গভীর রাত। আশরাফ সাহেব দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলেন। খট করে দরজার সিটকিনির শব্দে ভয়ে, লজ্জায়, আমার বুকের ভেতর বন্ধি হয়ে থাকা এতদিন মৃত প্রায় মনটা যেন লাফাতে লাগল।


কোনো অজানা সুখের প্রতিক্ষায়, আমার সারা দেহ মন তখন উৎসুক হয়ে আছে। ড্রিমলাইটের আলো অাধারিতে আমার মনে হয়েছিল, ত্রিশোর্ধ কোনো যুবক এসে আমার পাশে বসেছে, যে মুহূর্তে হরণ করে নেবে, আমার সমস্ত অস্তিত্ব। কোনো শক্তি দিয়ে, কোনো যুক্তি দিয়ে তাকে বাধা মানাতে পারব না।


কিন্তু না আমার সব কল্পনাকে মিথ্যা প্রমাণীত করে দিয়ে তিনি বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তার গন্তব্য সামনের সোফা। তিনি ছোট ছোট কদম দিয়ে সামনে এগিয়ে গেলেন। আমি সামনে এগিয়ে যাওয়া পদজোড়ার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম। আমার বুকের ভিতরে তখনো ঝড় বয়ে যাচ্ছে। এটা কিন্তু সুখের ঝড় নয় ভয় আর আতঙ্কের। কী করতে যাচ্ছেন ভদ্রলোক!


আশরাফ সাহেব হেলান দিয়ে সোফায় বসলেন। আমি উদগ্রিব হয় অপেক্ষা করছি তার কণ্ঠ শোনার জন্য। কয়েক হাত সামনে বসে থাকা লোকটা আমার স্বামী। আমার জীবন মরনের সঙ্গী। আমার হেরে যাওয়া, ডুবে যাওয়া, তলিয়ে যাওয়া জীবনের একটা অবলম্বন।


হঠাৎ করে আমার আকাশের কথা খুব মনে পড়ছে। প্রায় বিশ বছর তার সাথে কোনো দেখা দেখা-সাক্ষাৎ নেই। একবার শুনেছি বিয়ে করেছ। বউয়ের সাথে বনিবনা না হওয়ায় এখন সেফারেশানে আছে। আচ্ছা আমার সামনে এভাবে আকাশ বসে থাকলে কি আমি নিশ্চুপ হয়ে খাটেই বসে থাকতাম। না-কি এগিয়ে গিয়ে তার পাশে বসতাম। আমার বুকের তলানি থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসল। আমি চাই না, কোনোভাবেই চাই না, কষ্ট দেয়া নষ্ট অতীত মনে করতে। তারপরও কেন যেন থেকে থেকে মনে পড়ে যায়। আমাকে বিষণ্ন করে তুলে সবসময়।


হঠাৎ নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে আশরাফ সাহেব বললেন,

- "আসলে আপনাকে একটা কথা না বললেই নয়, আপনি নিশ্চয় আমার সম্পর্কে সবকিছু জেনেই বিয়েতে রাজি হয়েছেন।"


আমি চুপ করে আছি, এই মুহূর্তে আমার কী বলা উচিত বুঝতে পারছি না। আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে তিনি বলতে লাগলেন।


- "সত্যি কথা বলতে কী! এই বয়সে আমার আর বিয়ে করার মোটেও ইচ্ছে ছিল না। আপনি শুনেছেন আমার স্ত্রী গত হয়েছেন প্রায় পাঁচ বছর। তিনি আসলে আমার স্ত্রী ছিলেন না।"


আমি এমন কথা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। পুরো কথাটা আমার কানের মাঝে ধাক্কার মতো লাগল। অস্পষ্ট স্বরে আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো,


- "কী!"


- "জি, আপনি ঠিকই শুনেছেন। বাচ্চাদের স্বর্গীয় মায়ের সাথে আমার সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়েছে আজ প্রায় চৌদ্দ বছর। আমাদের আলাদা হওয়ার ৯ বছর পর তিনি পরলোক গমন করেছেন। অথচ এই বিষয়টা আত্মীয়- স্বজন,বন্ধু-বান্ধব কেউই জানতে পারেনি। কারণ আমরা একই বাড়িতে থাকতাম। শুধু আমার বাচ্চারা জানত।"


এমন অদ্ভুত রহস্যজনক গল্প শুনে আমি রীতিমতো হা হয়ে গেলাম। আমি নড়েচড়ে বসলাম।


- "আজ সারারাত আপনার সাথে গল্প করবো। পুরো বাসায় কেউ নেই। চলুন বারান্দায়। আমি বসার ব্যবস্থা করে রেখেছি।"


আমি বাধ্যগত মেয়ের মতো তার কথা শুনেই খাট থেকে নেমে তাকে অনুসরন করলাম।


আমরা বারান্দায় গিয়ে একটু দূরত্ব নিয়ে পাশাপাশি চেয়ারে বসলাম। বসার স্থানের আয়োজন দেখে বুঝাই যাচ্ছে, এসবই ছিল পূর্ব পরিকল্পনা। আর ভদ্রলোক ভীষণ সৌখিন।


- "জানেন আমি স্বামী হিসাবে মোটেও ভালো ছিলাম না। আমি অফিসে সেরা অফিসার, বন্ধু মহলে সেরা বন্ধু, বাচ্চাদের সৎ বাবা, ভাড়াটিয়াদের সেরা বাড়িওয়ালা। একমাত্র স্ত্রীর কাছেই অামি অথর্ব আর অপদার্থ ছিলাম।"


ভদ্রলোকের এভাবে রহস্য করে কথা বলা ভালো লাগছে না আমার। ইচ্ছে করছে একনিমিষে পুরো রহস্যের উন্মোচন করে ফেলি। আমি বাইরে বড় রাস্তায় দৃষ্টি দিলাম। একজোড়া কুকুর উর্ধশ্বাসে দৌঁড়ে পালাচ্ছে।


ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। আমার দৃষ্টি বরাবর তাকিয়ে বললেন,


- "আমি ভীষণ ভাবে দুঃখিত। আপনাকে একটা স্বার্থক রাত উপহার দিতে পারছি না।"


আমি গলা খাকারি দিয়ে ভদ্রলোকের চোখের দিকে তাকালাম। এই প্রথম আকাশ ছাড়াও অন্য কোনো পুরুষের দিকে তাকিয়ে আমি ভালোবাসা অনুভব করছি। ভদ্রলোকের চোখের কোণা ভিজে আছে। আলো অাঁধারিতেও আমার চোখ এড়িয়ে যায়নি ব্যাপারটা। ইচ্ছে করছিল, আলতো করে চোখটা মুছে দেই। কিন্তু না এখনো সেই সময় আসেনি। চব্বিশঘণ্টা আগেও তো এই লোকটা আমার সম্পূর্ণ অচেনা ছিল।


সৃষ্টকর্তা প্রদত্ত বিবাহিত সম্পর্কের কী আদিম শক্তি। কী সহজে সম্পূর্ন অচেনা একজন মানুষ আপন হয়ে যায়।


- "আমি যে নিজেকে পরিবর্তন করতে চাইনি সেটা কিন্তু নয়। কিন্তু কোনোভাবেই নিজের দোষ খুঁজে পাইনি। একটা সময় আমার কনফিডেন্ট লেভেল একদম তলানিতে পৌঁছে গেছে। আমি বিশ্বাস করতে শুরু করেছি। আমি হয়তো সত্যি স্বামী হিসাবে, মানুষ হিসাবে একদমই ভালো নই।"


আমি আবারও অস্পষ্ট স্বরে বললাম,

- "তারপর!"


- "আপনি বোর হচ্ছেন না তো!"


- "একদমই না।"


আশরাফ সাহেব হাসলেন। কোনো মানুষের হাসির শব্দ এত সুরেলা হয় সত্যি আমার জানা ছিল না। আমার বুকের ভেতর আবার টিবটিব করতে শুরু করলো।


- "দোষ যে আমার একেবারেই ছিল না, তা কিন্তু নয়। বিয়ের ২০ বছর পর দুই বাচ্চার মা হওয়ার পর যদি একজন মানুষ হঠাৎ অভিযোগ করেন, বিছানায় আমার পারফরমেন্স সন্তোষজনক নয়। এটা আমার জন্য কতটা অসম্মানের আপনাকে বলে বোঝাতে পারব না।"


হঠাৎ করে আমার উৎসাহে ভাটা পড়ে গেলো। যদিও বিছানায় একজন পুরুষ কেমন আমি জানি না। জানার সেই সৌভাগ্য আমার হয়নি। কিন্তু আমি তো অসুস্থ নই। আমার সব ইন্দ্রিয় তো সচল আছে, হয়তো এতদিন নির্জিব ছিল।


ভদ্রলোক আমার মনোভাব বুঝতে পেরেছেন,

- "না না আপনি একদমই ভয় পাবেন না। এটা ছিল তার অভিযোগ। যে অভিযোগ আনলে একজন পুরুষকে সহজে ঘায়েল করা যায়। আমি মোটেও সে রকম নই। তাহলে নিশ্চয়ই আপনার মতো কুমারীকে বিয়ে করতাম না।"


আমার মন খারাপ কিন্তু তখনো কাটেনি।


- "আমি কিন্তু আপনাকে পুরো বিষয়টা ক্লিয়ার করবো। বিষয়টা ছেলেদের কানে পর্যন্ত পৌঁছাল। নিত্য অশান্তি সংসারে। আমার সত্যি সে সময় ম'রে যেতে ইচ্ছে করেছিল। ছেলেরা বাবা-মায়ের মধ্যে এমন অশান্তি মেনে নিতে পারেনি। তাই তাদের উপস্থিতিতে আমরা আলাদা হয়ে গেলাম।"


- "তারপর!"


- "তারপর সে তার মতো করে চলতে লাগল। তার বন্ধু-বান্ধব, পার্টি, রাত করে বাড়ি ফেরা সবই পুরোদমে চলছিল। পরপুরুষ হয়ে আমার আর বাধা দেয়ার অধিকার রইল না।"


এবার আমার কাছে বিষয়টা পরিষ্কার হয়েছে। মন খারাপও আস্তে আস্তে কমে গেছে।


- "বাচ্চাদের মায়ের মৃত্যুও কিন্তু পার্টি থেকে ড্রিংক করে রাতে ফেরার পথে রোড এক্সিডেন্টে হয়েছিল।"


পাশের মসজিদে তখন ফজরের অজানের সুর শোনা যাচ্ছে। আমি উঠে দাঁড়ালাম।


- "একটু বসুন। আর একটু কথা আছে। এতকথা বলার শুধু একটাই কারণ। আপনি এখন আপাতত আমার থেকে স্ত্রীর অধিকার চাইবেন না। নারীদের উপর আমার বিশ্বাস উঠে গেছে। একসাথে চলতে চলতে যদি কখনো বিশ্বাস অর্জন করতে পারেন, তখন না হয়....।"


আমি মৃদু হেসে মাথা নিচু করে চলে গেলাম। এত বকবক শোনার সময় আমার হাতে নেই। আজ আমার কত কাজ স্বামীর জন্য নাস্তা বানাতে হবে। বাবার বাড়ি থেকে লোকজন আসবে তাদের আপ্যায়ন করতে হবে। আমার বাড়ির সব কাজের দায়িত্ব যে সব আমারই।


.


আমি ওয়াশরুমে শাওয়ার ছেড়ে গোসল করছি। নিজের অস্পর্শ শরীরের দিকে তাকিয়ে আমি হাসলাম। এই পৃথিবীর কোনো কিছুই আমি সহজে পাইনি। আশরাফ সাহেবকেও আমি সহজে পেতে চাই না। একদিন সত্যি আমি তাকে জয় করবো। সেদিন আর বারান্দায় নয়, তার প্রসস্ত বুকে মাথা রেখে আমি সারারাত এভাবেই জেগে ভালোবাসার গল্প করবো।


(সমাপ্ত)... (নিয়তি)


পর্বের আরও গল্প পড়ুন।