গল্পঃ পাস_ওয়ার্ড | অবহেলার কষ্টের গল্প

 কষ্টের ভালোবাসার গল্প

কষ্টের ভালোবাসার গল্প

আমার স্বামী আমাকে সত্যিই ভালোবাসে কি-না জানতে খুব ইচ্ছে করে। তাই ফেসবুকে একটা ফেইক আইডি ওপেন করে, আমার স্বামীকে রিকোয়েস্ট পাঠালাম। খুব ইচ্ছে তার ভালোবাসা পরীক্ষা নিবো। আগে অবশ্য এইসব ইচ্ছে মাথায় আসেনি। কিন্তু তানিয়া কাছ থেকে যখন জানতে পারলাম ও-র কাছে ও-র বরের ফেসবুক আইডির পাসওয়ার্ড আছে। সে তানিয়ার থেকে কিছুই লুকিয়ে রাখে না তখন তানিয়ার সুখ দেখে খুশি হলেও, নিজের জন্য অনেক খারাপ লাগছিল। নাজিমের মোবাইলটাও আমি কখনো ছুঁয়ে দেখতে পারি না। ফেসবুক আইডি তো অনেক দূরের ব্যাপার। খুব ইচ্ছে হলো ভালোবাসার পরীক্ষা নেওয়ার। নাজিমকে পরীক্ষা করবো বলে একটা ফেইক আইডি খুললাম। তারপর নাজিমকে রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে ফোনটা রেখে দিলাম। আমি এই পরীক্ষায় হারবো না জিতবো কিছুই বলতে পারছি না। মনের ভিতর নানান প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। আমি খুব করে চাই যেন আমি এই পরীক্ষায় হেরে যায়। নাজিমকে আমি অনেক ভালোবাসি। কিন্তু আমি সত্যিটা জানতে চাই। কয়েকদিন আগে আমি আমার কলেজ জীবনের বান্ধবী তানিয়ার সাথে দেখা করতে গেছিলাম। সেদিন,


--" দোস্ত জানিস আমার বর আমাকে খুব ভালোবাসে। ও-র দুইটা ফেসবুক আইডির পাসওয়ার্ডই আমার কাছে আছে। আমাদের ভিতর কোনো লুকোচুরি নেই। ও নিজে থেকেই আমার ফোনে লগইন করে দিয়েছে। স্বামী স্ত্রী ভিতর লুকোচুরি রাখতে নেই।


তানিয়ার কথায় আমার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। নাজিমের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে প্রায় দুইবছর। এর ভিতর কখনোই নাজিম ওর ফোনের লক পর্যন্ত আমাকে জানতে দেয়নি। আমি অবশ্য কখনো নাজিমের কাছে এসব ব্যাপারে জানতে চাইনি। প্রয়োজন হলে ও-র ফোন থেকে কথা বলতাম শুধু। কথা বলা শেষ হলে নাজিম নিজের মোবাইল নিয়ে যেতো। নাজিমকে আমি সন্দেহ করি এমনটা না তবুও কেন যেন মনটা খারাপ হয়ে গেলো। 


আমাকে চুপ থাকতে দেখে তানিয়া আবারও বলে উঠলো, " কি হলো তোর? মুখ কালো করে বসে আছিস কেন? " 


তানিয়ার কথায় আমি হাসতে চেষ্টা করলাম, ঠোঁটের কোণে মিথ্যা হাসি ঝুলিয়ে বললাম, " কিছু না রে। এমনই ভালো লাগছে না কিছু।"


--" আচ্ছা মিতা তুই বিবাহিত জীবনে সুখী তো?


--" হ্যা রে আমি অনেক সুখী। নাজিম খুব ভালো। আমার অনেক খেয়াল রাখে।"


--" ফাহাদও আমার অনেক খেয়াল রাখে। আচ্ছা নাজিমের ফেসবুক আইডির পাসওয়ার্ড জানিস তুই?"


তানিয়ার এমন প্রশ্ন শুনে আমি কিছুটা বিব্রতবোধ করতে লাগলাম। সত্যি বলতে নাজিমের ফেসবুক আইডির পাসওয়ার্ড আমি জানি না। এমনকি আমি কখনো নাজিমের ফোনটাও হাতে ধরি না৷ বিয়ের কয়েকদিন পর নাজিম আমাকে একটা মোবাইল কিনে দিয়েছিলো। সেই থেকে আমি আমার ফোনই ব্যবহার করি। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে তানিয়া বলে উঠলো, " বুঝতে পেরেছি, তোর বরের ফেসবুক আইডির পাসওয়ার্ড তুই জানিস না। আজকালকার ছেলে ফেসবুকে হয়তো নানান মেয়ের সাথে কথা বলে সেগুলো তোর থেকে লুকিয়ে রাখতেই তোকে পাসওয়ার্ড দেয় না। "


তানিয়ার এই সামান্য কথাগুলোই আমার মনকে বিষিয়ে দিতে সক্ষম হলো। মনের ভিতর হাজারও সন্দেহ জেগে উঠলো। কেন নাজিম আমাকে ও-র মোবাইল ধরতে দেয় না। তানিয়ার বর তো তানিয়ার থেকে কিছু লুকিয়ে রাখে না। তাহলে কি নাজিমের অন্য কোনো মেয়ের সাথে সম্পর্ক আছে? না এসব আমি কি ভাবছি! আমি নাজিমকে পাগলের মতো ভালোবাসি, নাজিমও আমাকে অনেক ভালবাসে, আমার অনেক খেয়াল রাখে, আমাদের সম্পর্কের মাঝে তৃতীয় কেউ থাকতে পারে না। 


আমি চুপচাপ বসে আছি দেখে তানিয়া বললো, " একটা কাজ করতে পারিস মিতা। একটা ফেইক আইডি খুলে তোর বরকে পরীক্ষা করে দেখতে পারিস। সরাসরি পাসওয়ার্ড চাইলে হয়তো সর্তক হয়ে যেতে পারে। "


তানিয়ার বুদ্ধিটা আমার বেশ পছন্দ হলো। নাজিম কখনো আমার মোবাইল চেক করে না। ফেইক আইডি চালালেও বুঝতে পারবে না। 


--" আচ্ছা তানিয়া তুইও তোর বরকে পরীক্ষা করে দেখতে পারিস। যদিও তোর বরের আইডি তোর কাছে আছে তবুও একবার না হয় হেরে গিয়ে সুখ পেলি।"


তানিয়া আমার কথায় হো হো করে হেসে উঠলো। তারপর চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললো, " কি যে বলিস না মিতা! ফাহাদের আইডি তো আমার কাছে। '


আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই ফাহাদ চিৎকার করতে করতে ঘরে ঢুকলো। ঘরে আসার পর তানিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললো, " তুমি কবে ঠিক হবে বলো তো? আজ একটা মেয়েকে আমি ফেসবুকে এড করেছিলাম তুমি তাকে ব্লক দিয়েছো কেন? "


তানিয়া স্বাভাবিক ভাবে বললো, " আমি চাই না তুমি কোনো মেয়ের সাথে কথা বলো। ঘরে বউ থাকতে অন্য মেয়ে কেন তোমার ফেসবুক ফ্রেন্ড থাকবে?"


--" তানিয়া নিজের মনটাকে একটু বড় করো। ওই মেয়েটা আমাদের নতুন এমডি। উনার থেকে আমার কিছু কাজ বুঝে নেওয়ার ছিলো তাই ফেসবুকে এড হয়েছি এতে দোষের কি আছে?"


তানিয়া আর কিছু না বলে আমার দিকে ইশারা করলো। ফাহাদও আমাকে দেখে শান্ত গলায় বললো, " আরে মিতা তুমি! তোমার পাগলী বান্ধবীকে দেখো কোনো মেয়ের সাথেই আমাকে দেখতে পারে না। শুধু সন্দেহ করে। তা তুমি কখন এলে?"


আমি মুচকি হেসে জবাবে বললাম, " এইতো বেশ কিছুসময় হয়েছে। তোমাদের ভিতর অনেক ভালোবাসা। সারাজীবন একসাথে থেকো তোমরা। "


ফাহাদ আমার কথায় কোনো জবাব দিলো না। শুধু মুচকি হাসলো। সেদিনের মতো ঘোরাঘুরি করে বাড়িতে চলে আসলাম। কিন্তু নাজিমকে পরীক্ষা করার ব্যাপারটা আমার মাথায় থেকে গেলো। সেদিন রাতে খাওয়ার পর নাজিমকে বললাম, " আচ্ছা নাজিম তোমার ফেসবুক আইডিটা আমাকে দেবে? "


নাজিম বিরক্ত চোখে আমার দিকে তাকালো। তারপর একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললো, " কেন আমার আইডি তোমার দরকার কি জন্য?  তোমার তো আইডি আছে। তুমি নিজের আইডি চালাও"


নাজিমর কথায় আমার ঠিক কতোটা কষ্ট হয়েছিলো বলে বোঝাতে পারবো না। মনে হচ্ছিল কেউ আমার বুকের উপর পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে। কথা বলতেও পারছিলাম না। বারবার গলা ধরে আসছিলো। সেদিন কোনো রকম নাজিমের চোখ ফাঁকি দিয়ে রান্নাঘরে চলে গেছিলাম। যার কাছে আমার থেকে তার ফেসবুক আইডি বড় তাকে নিজের কষ্ট দেখানোর কোনো মানে হয় না। রান্নাঘরের দরজা আটকে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিলো কিন্তু কেন জানি কাঁদতে পারছিলাম না। হয়তো অধিক শোকে পাথার হয়ে গিয়েছিলাম। কোনো কথা বলতে পারছিলাম না। 


এরপর থেকে নাজিমের কাছাকাছি খুব একটা যেতাম না আমি। কথা বলাও কমিয়ে দিয়েছিলাম। একদিন নাজিম আমাকে ডেকে প্রশ্ন করলো, " মিতা কি হয়েছে তোমার? কয়েকদিন ধরে দেখছি কেমন চুপচাপ হয়ে গিয়েছো। কোনো বিষয় নিয়ে মন খারাপ নাকি কোনো দুশ্চিন্তায় আছো?"


ইচ্ছে করছিলো ও-র  চোখের দিকে তাকিয়ে বলি যে, " ফেসবুক আইডি দিলে আপনার সব প্রেমিকার খবর পেয়ে যাবো তাই আমাকে ফেসবুক আইডি দিতে পারলেন না এইতো!"


কিন্তু এখন এমনটা বললে চলবে না। আমি নিজে আগে পরীক্ষা করে নিবো। হাতে প্রমাণ না নিয়ে কোনো কিছু বললে হিতে বিপরীত হতে  পারে। আমি মুচকি হেসে বললাম, " আজকাল শরীরটা অনেক খারাপ থাকে তাই কিছু ভালো লাগে না।"


আমার শরীর খারাপের কথা শুনে নাজিম ব্যস্ত হয়ে আমার কপালে গলায় হাত দিতে থাকলো। তারপর বললো, " শরীর তো ঠান্ডা আছে। কোথায় কি খারাপ লাগছে বলো? তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে এসো। আমাকে আগে বলবে না তুমি যে শরীর খারাপ!"


নাজিমের অস্থিরতা দেখে আমার মন একরাশ মুগ্ধতায় ভরে গেলো। আমি হয়তো ভুল ভাবছি। নাজিম অন্যকাউকে ভালোবাসলে আমার এতোটা খেয়াল রাখতো না। মনে মনে ভাবলাম আইডিটা ডিলেট করে দিবো নাজিমকে পরীক্ষা করা হয়তো ঠিক হবে না আমার। সেদিন নাজিম জোর করে আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো। ডাক্তার দেখিয়ে বাড়ি ফেরার পথে আমাকে নিয়ে নদীর পাড়ে ঘুরতে গেলো। অনেক সুন্দর সময় কাটালাম নাজিমের সাথে। এতোদিনের বিষন্নতা কেটে উৎফুল্ল হয়ে উঠলাম। সারা বিকাল ঘোরাঘুরি করার পর হোটেলে রাতের খাবার খেয়ে বাড়িতে আসলাম। আজকে আমার মনটা অনেক ভালো আছে। বোরকা হিজাব খুলে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। ফ্রেশ হয়ে ঘরে আসার পর নাজিম আামকে বললো, " মিতা তুমি কিছু সময় বিশ্রাম নেও। আমি একটু বাইরে থেকে আসি। "


খুব বলতে ইচ্ছে করলো, " না তুমি কোথাও যেও না। আমার কাছে থাকবে এখন। " কিন্তু কথাগুলো মুখে বলা হলো না। মনের মাঝেই রয়ে গেলো। মন খারাপ করে বললাম, " সাবধানে চলাচল করবেন। "


নাজিম মুচকি হেসে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। আমি মোবাইলটা হাতে নিয়ে ফেসবুক ওপেন করলাম। কিন্তু যা দেখলাম তাতে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। নাজিম আমার ফেক আইডির রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করেছে। সেই সাথে এসএমএস দিয়ে জানতে চেয়েছে আমি কে! 


আমার তখন কেমন লাগছিলো বলে বোঝাতে পারবো না। একদিনও হলো না এর আগেই রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করে এসএমএসও দেওয়া হয়েছে। এসএমএস দেওয়ার সময়টা দেখলাম কয়েক মিনিট আগে। তার মানে ঘর থেকে এসব কারণে বেরিয়েছে। চোখের পানিগুলো মুছে রিপ্লে দিলাম, তারপর মোবাইলটা বালিশের নিচে রেখে শুয়ে রইলাম। পরবর্তী রিপ্লে দেখার জন্য! 


গল্পঃ-পাস_ওয়ার্ড 

পর্বঃ ০১

কলমেঃ ফারহানা_কবীর_মানাল


পাস_ওয়ার্ড (পর্ব : ০২ | সমাপ্ত) 

ফারহানা_কবীর_মানাল 


সেদিন রাতে নাজিম আর কোনো এসএমএস দিলো না। সারারাত আমি একটুও ঘুমাতে পারিনি। শুধু ছটপট করেছিলাম আর ভাবছিলাম যে নাজিম কি সত্যি আমাকে ভুলে গিয়ে অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্ক করবে। এতোদিনে ভালোবাসা বিশ্বাস সবকিছু কি নষ্ট হয়ে যাবে!

চোখের পানিতে বালিশ ভিজে যাচ্ছে, নাজিম আমার পাশেই শুয়ে আছে। হয়তো ঘুমিয়ে আছে না হলে আমার চোখের পানিতে তার কিছু যায় আসে না। এমন নানান সব চিন্তার মাঝে কেউ আমার ধাড়ে হাত রাখলো। স্পর্শটা বড্ড পরিচিত, 


--" কাঁদছো কেন তুমি? খারাপ স্বপ্ন দেখেছো নাকি? দেখি আমার কাছে এসে ঘুমাও। "


নাজিমের কথার কোনো জবাব দিলাম না। চুপচাপ শুয়ে রইলাম। নাজিম আমার বাহু ধরে ওর দিকে ফিরালো তারপর খুব যত্ন করে চোখে মুখে লেপ্টে থাকা পানির কণাগুলো মুছে দিতে দিতে বললো, " কি স্বপ্ন দেখেছো তুমি হুম? আমি মরে গেছি নাকি তোমাকে রেখে চলে গেছি?"


নাজিমের কথায় আমার সারা শরীর কেঁপে উঠলো। নাজিম আমাকে ও-র বাহুর মাঝে আবদ্ধ করে নিলো তারপর মুচকি হেসে বললো, " কি হয়েছে তোমার? কাঁদছো কেন?"


--" আপনি হাসছেন কেন? আমার কান্না দেখে খুব ভালো লাগছে তাই না?"

কান্না জড়িত কন্ঠে কথাগুলো বলে নাজিমের বাহুর বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু তাতে কোনো প্রকার লাভ হলো না। বরং নাজিম আমাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।


--" না তোমার কান্না দেখে হাসছি না। কেউ একজন আমাকে হারানোর ভয় পায় তাই হাসছি। জানো তো প্রেয়সী ভালোবাসার মানুষ যখন তোমার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করবে তখন তুমি হাসতে বাধ্য হবে। তুমি না চাইতেও তোমার ওষ্ঠদ্বয় প্রসারিত হবে। তোমার মলিন মুখে খুশির আভা ছড়িয়ে যাবে। চাইলে তুমি মিলিয়ে নিতে পারো। আমি তোমায় মিথ্যা বলছি না।"


আমি অপলক দৃষ্টিতে নাজিমের দিকে তাকিয়ে আছি। নাজিমকে বড্ড অপরিচিত লাগছে আমার কাছে। হয়তো ও-র কথার সত্যতা বোঝার চেষ্টা করছি বলে। আমি চুপ করে আছি দেখে নাজিম আর কিছু বললো না। আমার কপালে আলতো করে চুমু এঁকে দিয়ে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরলো। আমার কানে ভেসে আসছে নাজিমের হৃদয় স্পন্দন। আমি খুব কাছ থেকে অনুভব করতে পারছি ও-কে। তবুও কেন জানি অনেক দূরত্ব আমাদের। হয়তো আমি নাজিমের থেকে দূরে সরে গিয়েছি নয়তো নাজিম আমার থেকে অনেক অনেক দূরে। এগুলো সব আমার ভাবনা। নাজিম আমাকে বুকে জড়িয়ে শুয়ে আছে। আলতো করে কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কোনো মেয়ের কাছে এর থেকে বেশি সুখের মুহুর্ত বুঝি আর নেই।


নানান কথা ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে গেছি ঠিক মনে নেই। ফজরের আজানের শব্দে ঘুম ভেঙে নিজেকে নাজিমের বাহুর মাঝে আবিষ্কার করলাম। ঘুমন্ত নাজিমকে বড্ড শান্ত লাগছে। চোখ মুখ কিছুটা ফুলে ওঠেছে। সারা মুখে তেল লাগিয়ে আছে এমন দেখাছে। তবুও এই মানুষটাই আমার কাছে বড্ড সুদর্শন। বিবাহিত নারীদের কাছে তার স্বামীই সব থেকে সুন্দর। অন্য কোনো পুরুষ যেন বড্ড বিরক্তিকর। স্বামী থাকার পরও অন্য কারো প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার অধিকার কোনো রমণীর নেই। কোনো পুরুষের স্ত্রী ব্যতিত অন্য কারো প্রতি আকর্ষিত হওয়ার অনুমতি নেই। দুইজন মানুষ যেন দুইজনের মাঝেই সীমাবদ্ধ। হাজারও বেড়াজালে আটকে আছে দুইজন। এ গন্ডির ভিতর তৃতীয় কারো প্রবেশের অনুমতি নেই, তৃতীয় কারো উপস্থিতি সহ্য করার মানসিকতাও হয়তো কোনো নরনারীর নেই। 


--" আমাকে দেখা হলে কি আমরা ওজু করে আসতে পারি? আমি জানি আমি সুন্দর, এতো দেখার কি আছে শুনি?"


নাজিমের কথায় আমার ধ্যান ভাঙলো। দুইজন মিলে ওজু করে নামাজ আদায় করে নিলাম। নামাজ শেষে নাজিম প্রায়ই কুরআন তিলাওয়াত করে। আমি তখন নাজিমের পাশে বসে থাকি। কখনো কখনো সকালে মনোমুগ্ধকর বাতাসে দুইজন হেঁটে বেড়াই। কখনো কখনো আমি রান্না করার সময় নাজিম পাশে বসে তরকারিতে লবন ঠিক আছে কিনা পরীক্ষা করার তীব্র বাসনা প্রকাশ করে। সত্যি বলতো আমরা অনেক খুশি। এতো সুখের মাঝেও আজ কোথাও কিছু খামতি রয়েছে। 


প্রতিদিনের মতো নাজিম অফিসে যাওয়ার পর আমার মোবাইলটা নিয়ে বসলাম। ফেইক আইডি গিয়ে দেখলাম নাজিম এসএমএস দিয়েছে,


--" কি দরকারে এসএমএস দিয়েছেন? "


নাজিমের এসএমএসটা বড্ড খাপছাড়া লাগলো আমার কাছে। তবুও নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করলাম। তারপর এসএমএসের রিপ্লে দিলাম।


--" আপনিই তো কাল নক দিলেন।"


--" আপনি ভুল বলছেন। আপনি আমাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দিয়ে এসএমএস দিয়েছিলেন যে কেমন আছেন। তাই আমি আপনাকে রিপ্লে দিয়েছি। "


--" প্রয়োজন ছাড়া কি আপনাকে এসএমএস দেওয়া যাবে না? এমনটাও তো হতে পারে আমি আপনাকে ভালোবাসি।"


--" আপনি আমাকে ভালোবাসেন কিনা আমি জানি না। এমনকি আমি মনেও করি না এটা জানার কোনো প্রয়োজনীয়তা আমার রয়েছে।"


--" কেন আপনাকে ভালোবাসা কি অপরাধ নাকি?"


--" অনেকটা তেমনই। আমি বিবাহিত। আমার স্ত্রী আমাকে যথেষ্ট ভালোবাসে। আমার স্ত্রী ব্যতিত কোন মেয়ে আমাকে নিয়ে কেমন ধারণা করলো বা কেমন অনুভব করলো তা জানার বিন্দুমাত্র প্রয়োজনীয়তা আমার নেই।"


নাজিমের এসএমএসটা দেখে খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে। আমার বরটা কত ভালো। আমি শুধু শুধুই সন্দেহ করছিলাম। কিন্তু না নাজিমকে আর একটু পরীক্ষা করে দেখতে হবে। এতো সহজে আমি ও-কে ছাড়বো না হি হি। কিছু সময় খুশিতে গড়াগড়ি দিয়ে নাজিমকে আবারও এসএমএস দিলাম। 


--" বউ থাকলেই যে কারো সাথে কথা বলা যাবে এমনটা কোথায় লেখা আছে? আপনার বউয়ের কাছে বুঝি আপনার আইডি পাসওয়ার্ড আছে? বউকে ভয় পান নাকি?"


--" বউ থাকলেই যে কারো সাথে কথা বলা যাবে না এমনটা নয়। তবে আপনি প্রথমেই অন্যভাবে কথা বলা শুরু করেছেন। আর আমার স্ত্রীর মন এতোটা নিচু নয় যে সামান্য আইডি পাসওয়ার্ডও নিজের কাছে রেখে দিবে। আমাদের সম্পর্কটা ভালোবাসায়, বিশ্বাসের, সম্মানের। আমাকে সে বিশ্বাস করে আর আমি তার বিশ্বাসের অমর্যাদা করতে চাই না। প্রয়োজন ব্যতিত কোনো কারণে আমাকে বিরক্ত করবেন না। "


ইসসসস! বউয়ের প্রতি কতো ভালোবাসা উনার। দেখলে একদম মন ভরে যায়। শেষবারের মতো একটু জ্বালানোর ইচ্ছায় একটা সুন্দরী মেয়ের ছবি দিলাম। তারপর লিখলাম,


--" এতো সুন্দর একটা মেয়েকে ফিরিয়ে দিতে আফসোস হচ্ছে না আপনার?"


--" না আফসোস হচ্ছে না। বরং এটা ভেবে ভালো লাগছে যে আমি মানুষ। কোনো পশুর স্বভাব আমার ভিতর নেই, পশুর মতো নানান সঙ্গীর প্রয়োজন নেই আমার। আপনি নিজেকে সুন্দর দাবী করলেও আমার কাছে আমার স্ত্রী পৃথিবীর সব থেকে সুন্দরী রমণী। "


আহা! আমার যে কি ভালো লাগছে বলে বোঝাতে পারবো না। শুধু শুধু আমার বরটাকে আমি সন্দেহ করলাম। সত্যিই তো আমাদের সম্পর্কটা ভারচুয়াল না যে আইডি পাসওয়ার্ড এসব ব্যাপারে সীমাবদ্ধ থাকবে। নাজিম যেমন কখনো ও-র আইডি পাসওয়ার্ড আমাকে দেয়নি। তেমনই কখনো আমার মোবাইল চেক করেনি বা আমার ফেসবুক আইডি চায়নি। কারণ আমাদের সম্পর্কে বিশ্বাস আছে। আমরা একে অপরকে বিশ্বাস করি। ভালোবাসা ছাড়া সম্পর্ক টিকে থাকলেও বিশ্বাস ছাড়া কোনো সম্পর্ক টিকে থাকে না। নাজিমকে আর কিছু বলতে যাবো এমন সময় খেয়াল করলাম নাজিম আমাকে ব্লক করে দিয়েছে। আমি সত্যি অনেক ভাগ্যবতী যে নাজিমের মতো বর পেয়েছি। 

মোবাইলটা বালিশে পাশে রেখে নিজের কাজে চলে গেলাম। আজ নাজিমের পছন্দসই খাবার রান্না করবো। নিজেকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে রাখবো ও-র জন্য। 


সন্ধ্যায় নাজিম বাড়িতে আসলো। ততোসময় আমি সেজেগুজে একদম পরিপাটি হয়ে রয়েছি। নাজিম গজগজ করতে করতে বাড়িতে আসলো। তারপর রাগী গলায় বললো, মিতা আমাকে এক গ্লাস পানি দাও। "


আমি এক গ্লাস লেবুর শরবত নিয়ে ও-র কাছে গেলাম। নাজিম আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। আমি একটু ভাব দেখিয়ে বললাম, " আমি জানি আমি সুন্দরী। এতো দেখার কি আছে?"


নাজিম সোফা থেকে উঠে এসে আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো, " তোমার সাজে অপূর্ণতা রয়ে গেছে।"


কথাটা বলে ও-র পকেট থেকে একগুচ্ছ ঘাসফুল আমার কানে গুঁজে দিলো। ও-র এমন কান্ড দেখে আমার খুব হাসি পাচ্ছে। মানুষ গোলাপ বেলি কত ধরনের ফুল দেয় আর উনি আমাকে ঘাসফুল দিচ্ছে। তবুও কেন জানি খুব ভালো লাগছে। ভালোবাসার উপহার কখনো টাকার মূল্যে আটকে থাকে না। তা সর্বদাই অমূল্য। 


রাতে ঘুমানোর সময় নাজিম আমার মোবাইলটা নিয়ে ও-র আইডি লগইন করে দিতে দিতে বললো, " আমি ছাড়া কোনো ছেলের দিকে তাকাবে না বুঝেছ। তবে কোনো ডাইনি রাক্ষসী আমাকে বিরক্ত করলে ইচ্ছে মতো শিক্ষা দিয়ে দিবে। আজকে মেজাজটাই খারাপ করে দিয়েছে।


নাজিমের কথার কোনো জবাব না দিয়ে আমি ও-কে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলাম। আজ কেন জানি খুব ভালো লাগছে আমার। নাজিম ফোনটা রেখে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো, " কি হলো তোমার?"


আমি মুচকি হেসে বললাম, " আমাদের সম্পর্কে এইসব অবিশ্বাস না-ই বা রইলো। কোনো ডাইনি রাক্ষসী অথবা সুন্দরী রমণী আমার বরকে নিতে আসলে কি আমার বর আমাকে রেখে তার সাথে চলে যাবে নাকি? "


নাজিম দৃঢ় কন্ঠে বললো, " না যাবে না। তুমি বিশ্বাস করতে পারো তোমার বরকে। "


আমি নাজিমের বুকে হাত রেখে বললাম, " আমি বিশ্বাস করি তোমায়! "


সমাপ্ত


পর্বের আরও গল্প পড়ুন।