গল্প:ডিভোর্স | ডিভোর্স গল্প | ডিভোর্স নারী

 ডিভোর্সের গল্প

ডিভোর্সের গল্প

আজ ডিভোর্স পেপারে সাইন করব,আমার বর শুভর সাথে দেখা হবে কোর্টে।কিছুক্ষণ পর আইনের খাতায় বর নামটি পর হয়ে যাবে। 


সিদ্ধান্তটা শেষ পর্যন্ত নিতেই হলো।


মাঝ রাতে এসে বারান্দায় বসেছি, আঁধারের গায়ে অনিশ্চিত আগামীর হিসেবের ছক কাটতে।কখন যে রাত গড়িয়ে সকাল হলো টের পাইনি।আমার ছেলে বাঁধন বুকের সাথে লেপ্টে আছে, ঘুমুচ্ছে অঘোরে।বিছানায় আমাকে না পেয়ে বারান্দায় এসে বুকে চড়েছে।


আজ সকালটা কেমন ঠিক বুঝতে পারছি না।প্রতিদিনের মতো ভোরের রোদ নরম লাগছে না আবার কঠিনও না।পাখির কিচিরমিচিরে আলাদা কোন ভালো লাগা কাজ করছে না।মানুষ যখন নিজের মধ্যে ডুব দেয় তখন পারিপার্শ্বিকতা তাঁকে ছুঁতে পারে না।এ ডুব বড় কঠিন ডুব।ঠিক যেমন গহীন সমুদ্রে ডুব দেয়া ডুবুরি বুঝতে পারে না বাহিরে কী চলছে।


ভালোবাসার বিয়ে আমাদের।আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয় ছিল সে।শুভর শহরে জন্ম আর সেখানেই তার বেড়ে ওঠা।এক আত্মীয়ার বিয়েতে গ্রামে এসে আমার সাথে পরিচয়। 


চোখাচোখি তারপর ভালো লাগা।ভালোবাসাটা তখনও হয়ে ওঠেনি।তখন আমি ইন্টার প্রথম বর্ষে পড়ছি। শুভ বিবিএর শেষ সেমিস্টারের ছাত্র। 


প্রথম দর্শনে মনে হয়েছিল শুভর মতোন সুদর্শন যুবক আমি আর দেখিনি।বিয়ের অনুষ্ঠানে এসে এক সপ্তাহ ছিল। যাবার সময় ইশারায় বোঝাতে চেয়েছে তার ভালোবাসার কথা,যদিও তার প্রতি দুর্বলতা ছিল তবুও সব বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকলাম।কারণ আমি গ্রামের মেয়ে, বাবা সাধারণ স্কুল মাস্টার।আমাকে এসব মানায় না।আমাকে অনেক দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে নিজ লক্ষ্যে এগুতে হবে।


ইন্টারে আমার ভালো রেজাল্ট হলো। 


ইউনিভার্সিটিতে পড়ার চান্স পেলাম।তাই ঢাকায় আমার নতুন ঠিকানা হলো।শুভর সাথে আমার যোগাযোগ ছিল না কিন্তু সে নিয়মিত আমার খোঁজ খবর রাখত আত্মীয়র মাধ্যমে। আমি ঢাকায় থাকি জানার পর দেখা করল,তার ভালোবাসার কথা আমাকে জানল,আমার জন্য তার প্রতীক্ষা এবং তার প্রতি আমার দুর্বলতার কারণে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনি। একটা সময় মন দেয়া নেয়াটা হয়েই গেল।


আমার পড়াশোনা শেষ হলো,ততদিনে শুভ ভালো একটা চাকরি করে।দুই পরিবারের সম্মতিতে আমাদের বিয়ে হলো যদিও স্কুল মাস্টারের মেয়েকে বিয়ে করানোর জন্য আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ি রাজি ছিলেন না তবুও শুভ অনেক কষ্টে রাজি করাল।


আমার ছেলে বাঁধনকে নিয়ে সুখের সংসার আমাদের। ছেলে হওয়ার পর শুভ নাম রাখল বাঁধন।শুভ বলত স্বামী স্ত্রী হলো নদীর দুই পাড় আর সন্তান দুই পাড়ের মধ্যে সেতু হয়ে বাঁধন সৃষ্টি করে। তাই ছেলের নাম রাখল বাঁধন। 


ঝড় ঝঞ্ঝা হয়তো নদীর দুই পাড় সয়ে যায় কিন্তু নদীতে ভাঙ্গন শুরু হলে পাড়ের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। আমার সংসার নদীতে ভাঙ্গন ধরেছে। ভাঙ্গনে ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে গেছে সব।এখন আর পাড় দেখা যায় না।


৫ বছরের প্রেম তারপর ৭ বছরের সংসার আমাদের।এই ১২ বছরের পথ চলায় সুখের কমতি ছিল না কিছুতেই।শুভ চায়নি বলে সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়েও আমি কোন চাকরি করিনি।দু'জনের ভীষণ বোঝাপড়া ছিল আমাদের।সে আমার কাছে ছিল দেবতারাই মতন আর আমি পুজারিনি হয়ে তার ভক্তি করেছি শুধু।  


আমার ননদ সপরিবারে অস্ট্রেলিয়া থাকেন। 


ননদের বাচ্চা হবে তাই আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ি মেয়ের কাছে গেছেন কিছুদিন থাকবেন বলে।


এদিকে জুনের ৪ তারিখ খবর পেলাম বাবার শরীর খারাপ। শুনে বাবার বাড়িতে গেলাম কয়েক দিন বাবার কাছে থকতে।শুভর অফিসে কাজের চাপ থাকায় সে বাসায় থেকে গেল। জুনের ৭ তারিখ আমার বিবাহ বার্ষিকী ছিল।২দিন থাকার পর বাবার শরীর কিছুটা ভালো দেখে আর থাকতে ইচ্ছে করছিল না।শুভর জন্য খারাপ লাগছিল তাই ৭ তারিখ আমি বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম শুভকে জানালাম না কারণ তাকে বিশাল একটা সারপ্রাইজ দেবো বলে।একদম নতুন বউ সেজে বসে থাকব, অফিস থেকে ফিরে আমাকে দেখে অবাক হয়ে যাবে।বিবাহ বার্ষিকীতে এটাই হবে সেরা উপহার।বাসায় ফিরে ব্যাগে রাখা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে গেলাম।আমার বেড রুমে কারো শব্দ পেয়ে উঁকি দিতেই শুভর সাথে ওর কলিগ রুম্পাকে দেখে কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলাম।আমার পৃথিবীটা আঁধার হয়ে গেল।


এক মুহূর্তে বিশ্বাসের পাহাড় ভেঙে তপ্ত মরুভূমি হয়ে গেল ।কোন কমতি ছিল না আমার মাঝে তবুও কেন অন্যের মাঝে সুখ খুঁজতে গেল? কিসের অভাব ছিল? তাও আবার আমার বিছানায়!


সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। সাজান সংসার হয়ে গেছে তাসের ঘর।এক তুরিতে ভেঙে চুরমার।  


একটান নিষ্পাপ শিশু হতে যাচ্ছে বলির পাঁঠা।  


ছেলেটার জন্য যদি আবার নতুন করে শুরু করি তবে বাকিটা জীবন জ্যন্ত লাশ হয়ে থাকতে হবে। 


ঐ বিছানায় যে দৃশ্য দেখেছি তা আমাকে প্রতি মুহূর্তে রক্তাক্ত করবে,প্রতি মুহূর্তে মরে যাব।এক জীবনে এতো মৃত্যু কিভাবে সইব!


ভীষণ রকমের অস্বস্তি হচ্ছে শুভর মুখোমুখি হতে। 


শুভ যদি সব কিছুর জন্যই ক্ষমা চেয়ে আবার নতুন করে শুরু করতে চায় তবে আমি কি পারব তাঁকে ক্ষমা করতে?আমার বিশ্বাস নিয়ে যে ছিনিমিনি খেলেছে তাঁকে ক্ষমা করা কি উচিৎ হবে?তবুও তার মুখোমুখি হতেই হবে।জীবনের দাবা খেলার শেষ চালটা এখন শুধুই সময়ের প্রতিক্ষায়।


ডিভোর্স 

পর্ব- ০১ ( ৩পর্বে সমাপ্ত হবে)

লেখা- মনোয়ারা স্মৃতি।


ছোট_গল্প।

ডিভোর্স (২য় পর্ব) 

লেখা- মনোয়ারা স্মৃতি।


অনন্যা শুভর সামনে দাঁড়িয়ে আছে যেন এক পাথরের মূর্তির মতো।দেহের অবয়ব সব ঠিকঠাক শুধু প্রাণের স্পন্দনটুকু থেমে গেছে।কিছুটা দূরে শ্বশুর শ্বাশুড়ি দাঁড়ানো। শুভ নিচের দিকে তাঁকিয়ে বলল 


অনন্যা আরেক বার কি ভেবে দেখা যায় না?বাঁধনের কথা ভেবে কি আবার শুরু করা যায় না? 


--- শুভ, বাঁধনের সাথে তো তোমার সম্পর্ক ছিন্ন করতে আসিনি বা কখনো তা বলিওনি।বাঁধন এখনও শিশু, বড় হয়ে গেলেও কখনোই জানবে না তার বাবার কুকির্তীর কথা। কারণ, বাবার প্রতি সন্তানের ভক্তি শ্রদ্ধা নষ্ট হোক সেটা অবশ্যই চাইব না। 


বাঁধনকে অযুহাত না বানালেই ভালো।সন্তানের কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ তার জন্মের পর থেকেই বাবা মায়ের ভাবা উচিৎ। সন্তানের ভালোর কথা শুধু একজন কেন ভাববে?দুজন কেন নয়? 


---অনন্যা ট্রাস্ট মি এটা একটা ভুল ছিল, এক মুহূর্তের ভুলের জন্য সারাটা জীবন নষ্ট করে দেবে। 


---যেটাকে তুমি ভুল বলছ সেটা ঠান্ডা মাথায় প্রতারণা।তোমার জন্য এক মূহুর্তের ভুল আমার জন্য এক জীবনে লাশ হবার কারণ ।আজ যদি আমার ভুল হতো তবে পারতে ক্ষমা করতে?

জানি পারতে না কারণ মেয়েদের ভুলের কোন ক্ষমা হয় না।আর বিশ্বাসের কথা বলছ?

আমার বিছানায় যে অবিশ্বাসের চারা বুনেছ তা দিনে দিনে বিষ বৃক্ষ পরিনত হচ্ছে। 


শুভ বেশ কিছুটা রাগ দেখিয়ে বলল, বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না? 


অনন্যা ভীষন শান্ত গলায় বলল,পৃথিবীতে প্রত্যেকটা মানুষের সুখি হবার অধিকার আছে কিন্তু বাঁধা দেয়ার অধিকার কারো নেই।তোমার সুখে বাঁধা হতে চাই না। মিথ্যে অভিনয় করে হয়তো-বা দায়িত্ব পালন করা যায়, সম্পর্কও টিকিয়ে রাখা যায়, কিন্তু সেই সম্পর্কের সম্মান থাকে না।আর সম্মানহীন সম্পর্কগুলোর পালকের মতো হাল্কা হয়।

সামান্য বাতাস এলেই উড়ে যায়।

কি ভেবেছিলে গাছের গুলোও খাবে,তলার গুলোও কুড়াবে?এতোটা হীনতার পরিচয় দেবে ভাবতেই পারিনি। 


অনন্যা আর একমুহূর্তও দেরি না করে সিগনেচার করার জন্য কলম হাতে নিতেই শ্বাশুড়ি সামনে এসে দাঁড়ল, অনুনয়ের সুরে বলল, 


--বউমা,আমাদেরকে পর করে দেবে?সংসার করতে গেলে ভুল হয় আবার ভুলের সমাধানও হয়।

একটু ভেবে দেখ বউমা। 


অনন্যা শ্বাশুড়ির হাত চেপে ধরে বলল। 


---মা,আপনারা আমার বাবা মা তুল্য।আপনাদের সাথে আমার সম্পর্ক মৃত্যু পর্যন্ত থাকবে,যে কোন প্রয়োজনে আমাকে ডাকবেন, সামনে এসে হাজির হবো।তাছাড়া আপনাদের নাতির শেকড়তো আপনাদের কাছে তা উপড়াবার দুঃসাহস আমার নেই মা।আপনাদের কথা বাঁধনের কথা ভেবে আমি থেকে যেতে পারতাম কিন্তু নিঃশ্বাস নিতে পারতাম না শান্তিতে। প্রতি নিঃশ্বাসে ছলনার বিষ ডুকে যেত হৃদপিণ্ডে। এভাবে বাঁচা যায় না মা তাই চলে যাচ্ছি। আর হ্যা মা, ভুল মানুষের হয় এবং তার ক্ষমা হয়, সমাধান হয়, কিন্তু প্রতারণার কোন ক্ষমা নেই। 


আর দেরি না করে সিগনেচার করে দাঁড়াতেই শুভ সামনে এসে দাঁড়িয়ে রক্তচক্ষু করে বলল,

--তোমার এই অপমানের প্রতিশোধ আমি নেবই।দেখব কিভাবে তুমি শান্তিতে থাকো।তোমার এই দম্ভ আমি চূর্ণ করে ছাড়ব মনে রেখো। 


অনন্যা মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বলল 


--চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলাম।আর যা-ই হোক কোন ঠক,প্রতারক,মিথ্যার সাথে আপোষ নয়।ভালোবাসার প্রতিদানে যে অবিশ্বাস তুমি দিয়েছ তা নিয়ে ভালোই কাটবে এক জীবন। 


আর কথা না বাড়ি অনন্যা হাঁটতে শুরু করল সামনের দিকে। এক অনিশ্চিত জীবনের দিকে ক্রমশই এগিয়ে যাচ্ছে পায়ে পায়ে।বাবার বাসায় গিয়ে ছেলেকে নিয়ে স্টেশনে বসে অপেক্ষা করছে ট্রেনের জন্য। আজ বান্ধবী মৌরীর বাসা যাচ্ছে অনন্যা।কয়েকটা দিন ওখানেই থাকবে।নিজের ভেতর যে তোলপাড় হচ্ছে তা শিথিল করা খুব প্রয়োজন।ছেলেটার দিকে মনোযোগ দিতে পারছেনা কারণ জীবনের ভুল হিসেবগুলো ভীষণ পীড়া দিচ্ছে। ট্রেন উঠে বসেছে মা ছেলে। সকল পরিচিত মুখ,আপন মায়া, অধরা স্বপ্ন সাঁইসাঁই করে সরে যাচ্ছে পেছনে।

জানলা দিয়ে মুখ বের করে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিচ্ছে অনন্যা।কেউ একজন বলে উঠল আরে তুমি অনন্যা না? ঘাড় ফিরিয়ে দেখল ইউনিভারসিটির বন্ধু আবির।

মুচকি হেসে বলল তাইতো মনে হচ্ছে আবির আমিইতো অনন্যা।আবির খুব উৎফুল্লতা নিয়ে বলল তোমার ছেলে তো দারুণ কিউট,এটা বলে বাঁধনে কোলে তুলে নিল।কতদিন পর তোমার সাথে দেখা।কেমন আছ তুমি?

অনন্যা কিছুই বলছে না, চুপ করে আছে দেখে আবির কিছুটা ইতস্ততভাবে বলল, আমি কি তোমাকে বিরক্ত করছি অনন্যা?

অনন্যা বলল, না আবির অবশ্যই তা না।আমি আসলে কেমন আছি বুঝতে পারছি না। জীবনে এমন কিছু মূহুর্ত আসে তখন ভালো থাকা আর মন্দ থাকার তফাতটা উপলব্ধি করা যায় না।তাই বলতে পারছি না কেমন আছি।এটা বলে অনন্যা আবার মুখ ঘুরাল জানলার দিকে,শেষ বিকেলের সূর্যটা ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে সন্ধ্যের বুকে আর এক অজানা গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে জীবন।


ছোট_গল্প (ডিভোর্স)

শেষ_পর্ব(৩)

লেখা- মনোয়ারা স্মৃতি 


মৌরী অনন্যার খুব কাছের বান্ধবী।ছোটবেলা থেকে একসাথে বড় হওয়া। স্কুল, কলেজ একসাথে ছিল।ইউনিভার্সিটি ছিল আলাদা।এক জীবনে অনেক বন্ধু বান্ধব আসে, সব বন্ধুের কাছে সবকিছু শেয়ার করা যায় না। কিছু কিছু বন্ধু আত্মার আত্মীয় হয়,আপনজনের মতো পাশে থাকে সবসময়।মৌরী অনন্যার তেমনই একজন বান্ধবী, যার কাছে নিজের সকল কথা জমা রাখা যায় অনায়াসে। 


আবার কিছু কিছু  কাছের মানুষ একমুহূর্তেই দূরের মানুষ হয়ে যায়।জন্ম জন্মান্তরের দূরত্ব সৃষ্টি হয় এক পলকেই।জীবনের এই রঙ্গমঞ্চে উপস্থাপিত নাটকের গতিপথ সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা থাকে না কারো।শুধুই দেখে যাওয়ার নামই হয়তো জীবন। 


অনন্যা রাতে এসেছে বান্ধবীর বাসায়। সৌজন্য মূলক হায় হ্যালো ছাড়া খুব একটা কথা হয়নি রাতের বেলা।মৌরী ও তার বর হাসান,দুজনেই কলেজে চাকরি করেন তবে আলাদা আলাদা কলেজে।অনন্যা আসবে তাই দুদিনের ছুটি নিয়েছে মৌরী ।হাসান সাহেব খুব ভালো মনের মানুষ।মেয়ে, ছেলে আর শ্বাশুড়ি নিয়ে মৌরীর সুখের সংসার। 

এদিকে সারারাত ঘুমুতে পারেনি অনন্য। বুকের ভেতরে যে ভীষণ তোলপাড়, তা কিছুতেই কমছে না।নিজেকে হাল্কা করার জন্যই বান্ধবীর কাছে আসা।খুব ভোরে উঠেছে আজ ভোরের আলোয় চারদিক আলোকিত। অনন্যা ছাদে এসে দাঁড়িয়ে আছে। গাছে গাছে অনেক ফুল ফুটেছে ছাদে।কিন্তু অনন্যা যেন খেয়ালই করেনি।মানুষের মনের স্বস্তিটুকু ফুরিয়ে  গেলে বাহ্যিক সৌন্দর্য হয়তো চোখে পড়ে না। তবে তা অবশ্যই কিছু মুহূর্তের জন্য।কারণ সমস্যার পাশাপাশি সমাধানও থাকে, শুধু সমাধানের পথটি খুঁজে নিতে হয়।পেছন থেকে মৌরী একটি গন্ধরাজ ফুল অনন্যার খোঁপায় গুঁজে দিয়ে বলল, 

---কি এতো ভাবছিস? 


--- না রে... তেমন কিছুই ভাবছি না।ভেবে আর কি হবে বল, জীবন নদী এ-তো তাড়াতাড়ি বাঁক নেবে স্বপ্নেও ভাবিনি।সামনে শুধুই আঁধার দেখছি।এখন ছেলেকে নিয়ে কিভাবে বাঁচব সেটাই ভাবছি। 


---আঙ্কেল, আন্টি কি ভাবছে তোর বিষয়ে? 


---বাবা মা চাইছেন তাদের সাথে গিয়ে থাকি।তুই তো জানিস ছোট ভাই ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে,বোন কলেজে।বাবা তাদের খরচ মিটিয়ে সংসার চালাতেই হিমসিম খায়।আমি আর তাদের উপর বোঝা হতে চাই না। 

---তা তো অবশ্যই, বাবা মা আমাদের জন্য অনেক করেন, একটা সময় আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হয়ে যায় ওনাদের  জন্য কিছু করা। আর এই সময়ে নিজেই তাদের উপর বোঝা হয়ে থাকাটা খুবই বিব্রতকর একটা ব্যাপার হয়ে  যায়। 


---জানিস মৌরী , একটা বিষয় খুব অবাক লাগল।এত্তো কিছুর পরও শুভ আমাকে হুমকি দিল, আমি কিভাবে ভালো থাকি সে নাকি দেখে নেবে। মানুষ কিভাবে এতোটা বদলে যায়? 


---এতো দুঃখ পাবার কিছু নেই অনন্যা।শুভ বদলে যায়নি, সে তার মতোই আছে।যতদিন তোর সাথে ছিল,মুখোশ পরে ছিল।এখন মুখোশ খুলে গেছে এবং আসল রুপটাও বেরিয়ে এসেছে। আর তোর মনে হচ্ছে শুভ  বদলে গেছে। আর হুমকি দিয়েছে তো?

ওটা কিছু না। কমজোর আর নৈতিকতা বর্জিত মানুষের গলার জোর বেশি থাকে।ওটুকুই ওদের সম্বল।যখন যা খুশি তা বলে দেয়।তোকে একটু ভয়ে রাখার জন্য তার এই গলাবাজি। তুই এখন শুভর সমস্ত কথা সমস্ত চিন্তা মাথা থেকে ডিলিট করে দে চিরতরে। শুধুই নিজের চিন্তা কর। 


---হুম,কিছু একটা করতে হবে,কি করব ভেবে পাচ্ছি না, কোন একটা কাজ জুটিয়ে নিতে পারলে ছেলেকে নিয়ে কোনরকম কেটে যেত। 


---এতো চিন্তার কিছু নেই অনন্যা,আমরা সবসময়ই তোর পাশে আছি। চল নাস্তা করবি। 


মৌরীর সাথে কথা বলে অনেকটা ভালো লাগছে অনন্যা,বুকের ভেতরের পাথরটা সরতে শুরু করেছে।

বিকেলে দু'বান্ধবী বসে গল্প করছে ঠিক তখনই আবীরের কল আসল। জানতে চাইল সব ঠিকঠাক কি-না,বাঁধন কেমন আছে,বান্ধবীর বাসায় কদিন থাকবে ইত্যাদি ইত্যাদি। যতটা সম্ভব অল্প কথায় জবাব দিয়ে অনন্যা ফোন রেখে দিল।মৌরী জানতে চাইল। 

---কার সাথে কথা বললি? 


---তুই চিনবি না, ইউনিভার্সিটির এক বন্ধু। গতকাল আসার সময় হঠাৎ ট্রেনে দেখা অনেকদিন পর।বিয়ের পর কারো সাথেই তেমন আর যোগাযোগ ছিল না এবং আবীরের সাথেও না।কাল শুভকে আমার পাশে না দেখে অনেক কিছু জানতে চাইল।কৌশলে এড়িয়ে গেছি।এসব কথা সবার সাথে শেয়ার কতরে ইচ্ছে করে না।জনিস তো,আমাদের সমাজে স্বামী পরিত্যক্তা স্ত্রী হয় কিন্ত স্ত্রী পরিত্যক্ত স্বামী হয় না।স্বামী ছাড়া মেয়ে মানুষ যেন ভীষণ সহজলভ্য। যে তাকানোর সাহস রাখে না সেও গায়ে পড়ে কথা বলে। 


---তো মিঃ আবীর কি সেই টাইপের মানুষ? 


---আরে না...না...।আবীর তেমন হবে কেন, সেতো আমার বন্ধু, নিঃসন্দেহে ভালো মানুষ। শুধু ব্যক্তিগত কথা বলতে চাইনি বলে কিছু জানাইনি। 


--- ও আচ্ছা বুঝতে পেরেছি,এখানে কোথায় থাকেন এবং কি করেন ভদ্রলোক? 


---আশেপাশে কোথাও থাকে হয়তো, সমাজসেবা অধিদপ্তরে আছেন। ডিটেইলস জানি না। 


--- ও তা-ই। একা থাকেন, না-কি পরিবার নিয়ে? 


---অতশত জানি না আমি,আসলে কাল কোন কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না তাই অনেক কিছু জানা হয়নি।কিছু মনে করেছে কি-না জানি না।পরে আবার কথা হলে জেনে নেব এবং সরি বলব। 


অনন্যা বান্ধবীর বাসায় এসেছে বেশ কয়েকদিন হয়ে গেছে।বাঁধন এ বাসায় খুব আনন্দে আছে মৌরীর বাচ্চাদের সাথে।অনন্যা ভাবছে এবার বাবার বাসায় ফিরতে হবে। তারপর চাকরির জন্য চেষ্টা করতে হব।তাই রাতের বেলা খাবর টেবিলে বসে অনন্যা বলল, 


----অনেকদিন তো থকলাম এবার যেতে চাইছি।আগামীকাল চলে যাব ভাইয়া,আপনাদের সহানুভূতি ও সহর্মিতা আজীবন মনে থাকবে। 


হাসান হাসি দিয়ে বলল,কেন? এখানে কি তোমার খুব অসুবিধা হচ্ছে? 


--না ভাইয়া, অসুবিধা না।ভাবছি বাসায় গিয়ে কিছু একটা করতে হবে জীবন ও জীবিকার জন্য। 


অনন্যার শ্বাশুড়ি বলল,কেন চলে যাবে মা।তোমার কি কোন অসুবিধা হচ্ছে আমাদের সাথে থাকতে?তুমি থাকো আরও কিছু দিন।জানো তো আমার কোন মেয়ে নেই।তোমাকে তো আমার মেয়ের মতোই দেখি মা। 


--না খালাম্মা কোন অসুবিধা হচ্ছে না। আর আপনিতো আমার মায়ের মতোই।অনেকদিন তো থাকলাম,এবার বিদায় দিলেই ভালো হয়। 


হাসান বলল,কি করবে ভেবেছ কিছু? 


---না ভাইয়া কিছু ভাবিনি,আমার তো সার্টিফিকেট ছাড়া আর কোন অভিজ্ঞতা নেই।তাই কি করব বুঝতে পরছি না।ইচ্ছে করলেই কি আর চাকরি পাওয়া যায়? 


----কলেজে চাকরি  করবে?যদি করতে চাও আমার কলেজে গেস্ট টিচার হিসেবে জয়ের করতে পারো।আমাদের কলেজ যেতেতু সরকারি তাই হয়তো স্থায়ী ভাবে চাকরি ব্যবস্থা করতে পারব না তবে পার্টটাইম লেকচারের ব্যবস্থা করে দিতে পারব।আমাদের কলেজে টিচার সংকট আছে তাই এখানে আপাতত শুরু করো যদি আপত্তি না থাকে। 


----হাসান ভাই তা হলে তো ভালই হয়। আমার তো কলেজ নিবন্ধনের সার্টিফিকে আছে কখনো নিয়োগের সার্কুলার আসলে চেষ্টা করা যাবে তবে অনেকদিন ধরে বই-পুস্তকের সাথে যোগাযোগ নেই।আমি কি পারব পড়াতে? 


মৌরী বলল,কেন পরবি না?সাবজেক্টিব পড়াশোনা শুরু কর।পরের দিন যে ক্লাস থাকবে আগেরদিন ভালোভাবে স্টাডি করে নিবি।একটা সময় দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে। নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস রাখ তাহলেই হবে। 


---আমি আসলে চাইছিলাম ঢাকা থেকে দূরে থাকতে মানে পরিচিত মানুষ থেকে দূরে থাকতে। কারণ পরিচিত মানুষ মানেই নানানরকম প্রশ্ন যা আমাকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। 


---অনন্যা তুমি আমাকে বান্ধবী বর না ভেবে  বড়ভাই 

ভাবতে পার, তাহলে তোমার সংকোচ কেটে যাবে।আর যে কোন ধরনের  সমস্যায় এই ভাইটিকে ডেকো,সবসময়ই পাশে পাবে। 


অনন্যা কলেজে জয়েন করেছে বছরখানেক  হলো,আলাদা বাসা নিয়েছে।মৌরীর সহায়তায় পেয়েছে একজন বিশ্বস্ত হেল্পিংহ্যান্ড।যাকে অনন্যা খালা বলে ডাকে আর বাঁধন ডাকে নানু।অনন্যা আরও একটি প্রাইভেট কলেজে গেস্ট টিচার হিসেবে সপ্তাহে দুনিদ লেকচার দেয়।প্রথম প্রথম বেশ সমস্যা হয়েছে তার পর কিছু টিউশনি শুরু করেছে সব মিলিয়ে এখন ভালোই আছে।শ্বশুর শ্বাশুড়ির সাথে কথা হয় প্রায় সময়। 


বারান্দায় বসে আকাশের তারা গুনছে অনন্যা।ছুটে যাওয়া তারাদের জীবনের হিসাব মেলাতে চাইছে।আসলে তারা ছুটে যায় না।নক্ষত্র বা গ্রহ থেকে ছুটে যায় গ্রহানু, শিলা-খণ্ড যা আমাদের চোখে উল্কা হয়ে ধরা দেয়।যাকে আমার ভাবি নক্ষত্রের ছুটে যাওয়া। 

তেমনি জীবনও তারার মতো ছিটকে পড়ে না, নিমিষেই একটা জীবন শেষ হয়ে যায় না।জীবনের কঠিন পরিস্থিতিগুলো উল্কার মতো জ্বলতে জ্বলতে সময়ের পরিক্রমায় হারিয়ে যায়।জীবন ঠিকই তারার মতো জ্বলতে থাকে সহস্র তারা মাঝে।নানান ভাবনায় ডুবে আছে অনন্যা, মোবাইলটা বেজে ওঠল। 


---হ্যালো,মৌরী, কি খবর, ভালো আছিস তো? 


---ভালো আছি,তোর কি খবর? বেশ কিছুদিন হলো কোন খোঁজ খবর নেই।কাল সন্ধ্যায় বাসায় আয়।আড্ডা দেয়া যাবে। 


পরদিন সন্ধ্যায় মৌরীর বাসায় গেল অনন্যা।ড্রয়িং রুমে আবীর বসে আছে।কিছুটা অবাক হয়ে জানতে চাইল,তুমি এখানে? 


---কেন আসতে বারণ?তোমার বাসায় তো যেতে বলো না কখনোই তাই বলে কি অন্য কারো বাসায়ও আসতে পারি না?

---না না তা হবে কেন?মৌরীর বাসায় তুমি,মানে তোমরা তো পূর্ব পরিচিত না তাই হিসাবটা মেলাতে পারছি না।

----ও এই বিষয়,বেশ কিছুদিন আগে তুমি ও মৌরী এক সাথে শপিং করতে গিয়েছিলে না?সেদিনই তো পরিচয় হলো এবং ফোন নাম্বার আদান প্রদান।ভুলে গেলে এতো তাড়াতাড়ি? 

---তা ভুলিনি,তবে এতো অল্প পরিচয়ে বাসায় আসবে বুঝতে পারিনি। 


হাসান রুমে ঢুকতে গিয়ে বলল, অনেক দিন ফোনে কথা হয়েছে তাই অল্প পরিচয়টা বিশাল আকার ধারণ করেছে অনন্যা। মৌরী এসে তাঁদের সাথে যোগ দিল। জমিয়ে আড্ডা হলো কয়েক ঘন্টা তার পর রাতের খাবার খেয়ে আবীর চলে গেল। অনন্যা বেরুবার পথে হাসান ও মৌরী পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বলল অনন্যা,তোমার সাথে কথা আছে, একটু দাঁড়াও। 


---বলুন ভাইয়া, কি কথা বলতে চান। 


---অনন্যা, জীবনটা অনেক বড়,একজীবনে অনেক রকমের সমস্যার সৃষ্টি হয় আবার তার সমাধানও হয়।

আর মানুষ একা থাকতে পারে না।কেউ একজন চাই যে ছায়ার মতো পাশে থাকবে তাই বলছি নতুন করে শুরু করো।

---ভাইয়া, আপনি আসলে কি বলতে চাইছেন?আবার বিয়ে করার কথা?

--- আবীর বলছিল তোমার সাথে সে এক পথে চলতে চায় বাকিটা জীবন, যতদূর বুঝতে পেরেছি আবীর ভালো ছেলে।বিষয়টা ভেবে দেখো।

---না ভাইয়া,তা আর হয় না।আবীর নিঃসন্দেহে ভালো মানুষ কিন্তু আমি আর পারব না কোন নতুন সম্পর্কে জড়াতে। আমি বেশ ভালো আছি।আর আমি তো একা না, আমার ছেলে আছে,তোমরা আছো।এক জীবন কাটিয়ে দেয়ার জন্য এর চেয়ে বেশি কিছু আমি চাই না।আমি ভালো আছি।আমি দেখেছি কত সহযে একটা হৃদয় পুড়ে যায়।আমার ঝলসে যাওয়া হৃদয়টাকে আর পোড়াতে চাই না ভাইয়া। 


মৌরী বলল,তবুও একটু ভেবে দেখিস।এখনই সিদ্ধান্ত জানাতে হবে তা কিন্তু নয়। একটু সময় নে মন কি বলে দেখ। 

---না.. রে.. আমাকে দিয়ে এসব আর হবে না। তাই নতুন করে ভাবারও কিছু নেই।বলেই বাসা থেকে বেরিয়ে গেল অনন্যা।দুই-তিন মিনিটের হাঁটা পথ।বাসায় পৌঁছে বাঁধনকে ঘুম পাড়িয়ে দিল।নিজেও শোয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে এমন সময় মোবাইল বেজে উঠল।মোবাইলে চোখ বুলাতেই আবীরের নাম দেখতে পেল।মোবাইল রিসিভ করতে ইচ্ছে করল না।তাই কেটে দিল।মিনিট দশেক পর আবার আবীরের কল,এবার রিসিভ করল।

---হ্যালো 

---কেমন আছো অনন্যা?

---ভালো আছি,

---তোমাকে সরাসরি বলার সাহস পাইনি তাই হাসান ভাই ও ভাবিকে জানালাম বিষয়টি। শুনলাম তুমি না করে দিয়েছ।পৃথিবীর সব পুরুষ খারাপ না,প্রতারক না।আরেকটা বার বিশ্বাস করে দেখো তুমি ঠকবে না। 


মোবাইলে অপর প্রান্তে ভীষণ নিরবতা, কিছুই বলছে না অনন্যা শুধুই শুনছে। 


----কিছুই বলবে না অনন্যা?এখন যদি বলতে না চাও তবে বলতে হবে না।তোমার যখন ভালো লাগবে তখনই বলো,আমি তোমার সকল সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাব। শুধু বলব একটু ভেবে দেখো... 


একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে,পাতায় জমে থাকা জলের শেষবিন্দুটাও ঝরে পড়ছে টুপটাপ ছন্দে।অনন্যা তাঁকিয়ে আছে আকাশের দিকে।চাঁদটাকে বার বার আড়াল করে দিচ্ছে কিছু ভেসে যাওয়া মেঘ।আধো আলো আধো ছায়ার চেনা পৃথিবীটাও বড় অচেনা লাগছে। 

____________________🖤🖤_________________


    ........... ................. সমাপ্ত........................


পর্বের আরও গল্প পড়ুন।