রহস্যময় গল্প | রহস্যময় | রহস্যময়ী

 রহস্যময় গোয়েন্দা গল্প

রহস্যময় গোয়েন্দা গল্প

অটোওয়ালা অটো চালাতে চালাতে হঠাৎ ব্রেক কষে বললো, 

- 'একটু অপেক্ষা করেন ভাই। হালকা হয়ে আসি।'


আমার প্রচন্ড বিরক্ত লাগলো‌।আমি অটোওয়ালার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। শীতের রাত, চারটা বাজে বোধহয়। ঢাকা থেকে আসা লঞ্চটা ঠিক সাড়ে তিনটায় আমাদের দক্ষিণ বঙ্গের এই অচেনা গ্রামে নামিয়ে দিয়েছে। প্রথমে একটু চিন্তাই হচ্ছিলো আমার, এতো রাতে নেমে শীতের মধ্যে কই থাকবো, কিন্তু ভাগ্য ভালো, লঞ্চঘাটেই অটো দাঁড়ানো পেয়ে গেলাম। অটোওয়ালা বললো, লঞ্চ আসার সময়সূচি অটোওয়ালাদের জানা থাকে, সেই মোতাবেক সারা রাতই কোনো না কোনো অটো পাওয়া যায় লঞ্চঘাটে। শুধু তাদের অন্য সময়ের থেকে একটু বাড়তি ভাড়া দিতে হয়, এই যা।


আমি ছাড়া আর এক যাত্রী সেসময় লঞ্চ থেকে নেমেছিলো, একটি মেয়ে। খুবই সাধারণ দেখতে, গায়ে সাদামাটা চাদর, মাথাটুকু ওরনা দিয়ে ঢাকা। সে আমার সাথেই অটোতে উঠলো, বসলো পিছনের সিটে, আর আমি বসলাম ড্রাইভারের পাশে। অটোওয়ালা বেশ মিশুক মানুষ, তার সাথে ভাব জমাতে বেশি দেরি হলো না। অন্ধকার নির্জন রাত, শুনশান নিরব গ্রামের রাস্তা। এরমধ্যে দিয়েই আমরা গল্প করতে করতে পথ চলছিলাম। পিছনের মেয়েটি ওঠার পর থেকে যেমন চুপ ছিলো, তেমনি চুপ করেই বসে আছে। সেটাই অবশ্য স্বাভাবিক, একটা মেয়ে এমন রাতে অপরিচিত দুজন মানুষের সাথে কেন কথা বলবে? তবে তার থেকেও ভাবার বিষয়, মেয়েটার এমন গভীর রাতে এমন নির্জন রাস্তা দিয়ে একা একা কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন কেন পড়লো? তাকে কি নিতে আসার মতো কেউ ছিলো না? যাক, এটা তার নিজের ব্যাপার, আমার এসব ভেবে লাভও নেই।


সময় বয়ে যাচ্ছে, অটোওয়ালা ফিরছে না। যে জায়গাতে আমরা দাঁড়িয়েছি, তার দুপাশে ঘন গাছের সাড়ি, আর সাড়ির ওপাশেই অবারিত ধানক্ষেত। চারপাশে কোনো ঘরবাড়ি চোখে পড়লো না। এমন জায়গায় কোনো বিপদ ঘটলে কাউকে ডেকেও সাহায্য পাওয়া যাবে না। বিপদ ঘটলে কি করবো ভাবছি, মেয়েটা হঠাৎ বলে উঠলো, 

- 'উনি তো এখনো ফিরছেন না।'


আমি মেয়েটার দিকে তাকালাম। মেয়েটার মুখটা বেশ সুন্দর, ভীষণ মায়াবী, এর আগে খেয়াল করিনি। সেই সুন্দর মুখে কেমন একটা অজানা আশঙ্কা আর বিষন্নতার ছাপ ফুটে উঠেছে। 


আমি তাকে সাহস দিয়ে বললাম, 

- 'ভয় পাবেন না। আমি নেমে দেখি আসি ও কোথায় গেল।'


মেয়েটা কাতর কণ্ঠে বলে উঠলো, 

- 'প্লিজ, যাবেন না...'


তখনই হইচই শুনতে পেলাম। একদল মানুষের হইচই। তারা হাতে টর্চ নিয়ে ধানক্ষেত পেরিয়ে ছুটে আসছে আমাদের দিকে।আমরা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম। 


লোকগুলো আমাদের সামনে এসে বললো, 

- 'আপনারা এই অটোতে যাচ্ছিলেন?'


আমি বললাম, 

- 'জি।'

- 'আপনারা দুজনই?'

- 'হ্যাঁ।'


একটা লোক আমার মুখে টর্চের আলো ফেললো। আমাকে দেখে টর্চের আলোটুকু পড়লো মেয়েটার মুখের ওপর। একটু বেশি সময়ই যেন টর্চের আলোটুকু স্থির হয়ে থাকলো মেয়েটার মুখে।


ওদের মধ্যে যে লোকটা নেতা গোছের, তিনি বললেন,

- 'একটা বিপদ ঘটে গেছে।'

- 'কি বিপদ?'

- 'আপনাদের নিয়ে যে অটোওয়ালা যাচ্ছিলো, তাকে সাপে কেটেছে।'


- 'বলেন কি।'

- 'হ্যাঁ। অন্ধকারে ঝোপের আড়ালে ছিলো, বুঝতে পারেনি। আমরা ঐ সামনেই ছিলাম, জমিতে ধান পাহাড়া দেবার জন্য। লোকটার চিৎকার শুনে দৌড়ে আসি।'


- 'সাপে কাটলো, অথচ শীতকালে তো সাপ বের হয় না জানি।'

- 'দংশমুনী সাপ শীত-গরম কিছুই মানে না। আপনারা তো শহরের মানুষ, জানেন না এসব। আচ্ছা যাই হোক, রাতে তো এদিক দিয়ে আর কোনো অটো যাবে না। আপনারা এক কাজ করেন, আমাদের বাসা সামনেই, রাতটা আমাদের বাসায় কাটিয়ে সকাল সকাল চলে যাবেন, আরেকটা অটো ডেকে দিবো নে।'


আমি মেয়েটার দিকে তাকালাম। মেয়েটাও চিন্তিত মুখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে, যেন আমার মতোই কি করবে বুঝতে পারছে না। 


নেতা গোছের লোকটা মেয়েটাকে দেখে বললেন, 

- 'ঘরে মেয়েছেলেও আছে। বইনের কোনো সমস্যা হবে না।'


অগত্যা আমরা তাদের সাথেই হাঁটা ধরলাম। আমার সাথে একটা ব্যাকপ্যাক বাদে তেমন কিছু ছিলো না, মেয়েটার সাথে ছিলো একটা লাগেজ, ওদের মধ্যেই একজন লাগেজটা মাথায় করে নিয়ে আসতে লাগলো। ওদের আতিথেয়তা দেখে সত্যিই খানিকটা মুগ্ধ হচ্ছিলাম।


নেতা গোছের লোকটা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,

- 'এই গ্রামে কি কোনো কাজে আসছিলেন?'

- 'জি, আমার বন্ধুর বোনের বিয়ে। ওই বিয়েতেই দাওয়াত খেতে আসলাম।'


- 'কি নাম আপনার বন্ধুর?'

- 'আসাদ।'

- 'ও, আসাইদ্যার বন্ধু আপনি। হ্যাঁ, ওর বোনেরই তো বিয়ে। তা, ও আপনাকে নিতে গেলো না কেন লঞ্চঘাটে?'


- 'আসলে আমিই মানা করেছিলাম। লঞ্চ ভোরে এসে পৌঁছাবে শুনে বলেছিলাম একাই চলে যাবো। কিন্তু ভোর বলতে যে একদম রাতেই এসে পৌঁছাবে লঞ্চটা, বুঝতে পারিনি।'


- 'ওহ আচ্ছা। তা বইন, আপনি কেন আসছিলেন এখানে?'


মেয়েটা বললো, 

- 'একজনকে খুঁজতে আসছিলাম।'

- 'কারে? টাকা পাইবেন নাকি কারো কাছে?'

- 'না।'

- 'তাইলে লাভ কেইস?'


মেয়েটা কিছু বললো না। নেতা গোছের লোকটা হাসলেন। আমি অবাক চোখে মেয়েটার দিকে তাকালাম। সত্যিই কি ও হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসার মানুষকে খুঁজতে এসেছে এতোদূর? সেজন্যই কি ওর মুখে অমন বিষন্ন ভাব?


আমরা ধানক্ষেতের আইল ধরে চলতে চলতে এক খালি জায়গায় এসে পৌঁছালাম। চারপাশে ধানগাছের মাঝে একটুকরো খালি জায়গা। সেসময়ই হঠাৎ নেতা গোছের লোকটা দাঁড়িয়ে গেল। আর তার সঙ্গী দুজন জাপটে ধরলো আমাকে।


আমি চিৎকার করে উঠলাম, 

- 'কি করছেন?'


নেতা গোছের লোকটা কিছু বললো না, কেবল চিৎকার করে উঠলো, 

- 'কামাইল্যা।' 


দেখলাম এক লোক অন্ধকার থেকে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমি লোকটিকে চিনলাম। আমাদের অটোওয়ালা।


নেতা গোছের লোকটা অটোওয়ালাকে ধমক দিয়ে বললেন,

- 'এইসব কি আনছোস এবার! মালকড়ি তো কিসু নাই।'


অটোওয়ালা ভয়ে ভয়ে বললো, 

- 'এই হপ্তায় এই পথ্থমবার প্যাসেঞ্জার পাইলাম ওস্তাদ। কি করুম? আপনেও তো গালমন্দ করবার লাগছিলেন শিকার পাই না দেইখ্যা।'


-  'যাক, যা হওয়ার হইসে। মালকড়ি না থাকলেও মালটা খাসা। ওরে দিয়াই হইবো।' 


বলেই নেতা গোছের লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে বললো, 

- 'আপনে আমাদের গ্রামের মেহমান। আপনারে ছাইড়া দিলাম। তয় আমরা যে আপনারে এইখানে আটকাইসি কাউরে কইতে পারবেন না।'


আমি বললাম, 

- 'আর মেয়েটা?'


পাশের একটা লোক বলে উঠলো,

- 'অই, ওস্তাদের কথা হুনছস না? নিজের জান বাঁচছে এই নিয়াই শুকরিয়া কর। আরেকজনের কথা চিন্তা করস ক্যান?'


আমি বললাম,

- 'আমি উনাকে রেখে কোথাও যাবো না।'


লোকগুলো হো হো করে হেসে দিলো। একজন বললো, 

- 'ওস্তাদ, আজকেও একটা হিরু পাইছি।' 


নেতা গোছের লোকটা বললেন, 

- 'ওরে বান্দ রশি দিয়া।'


তখনই লোকগুলো ঝাঁপিয়ে পড়লো আমার ওপর। কিল-ঘুষি-চড়ের এক স্রোত বয়ে গেল আমার ওপর দিয়ে। আমি নিজেকে ছাড়ানোর অনেক চেষ্টা করলাম, পারলাম না। লোকগুলো রশি দিয়ে আমাকে শক্ত করে বেঁধে মাটিতে ফেলে দিলো।


এতোকিছু যে হলো, মেয়েটা ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ। অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। 


আমি চিৎকার করে বললাম, 

- 'পালান, তাড়াতাড়ি পালান। এরা আপনাকে ছাড়বে না।'


আমার চিৎকার শুনে মেয়েটা নড়েচড়ে উঠলো, কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। লোকগুলো আমাকে ধরাশায়ী করে মেয়েটার দিকে এগিয়েছে। আমার নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছিলো তখন, মনে হচ্ছিলো শুধু আমার ব্যর্থতাতেই একটা মেয়ের সর্বনাশ হয়ে যাবে। ওরা যদি আমাকে মেরে ফেলতো, তবুও তো এই ঘটনাটা আর দেখা লাগতো না। তবু শেষ চেষ্টা হিসেবে জোরে জোরে চিৎকার করতে লাগলাম।লাভ হলো না। এই বিরান জায়গায় কেউ নেই আমার চিৎকার শোনার।


লোকগুলো মেয়েটার গায়ে হাত দিয়েছে। টান দিয়ে সরিয়ে ফেলেছে তার চাদর। সেসময়ই, মেয়েটার হাতে ধাতব কিছু একটা জ্বলে উঠতে দেখলাম। কি হতে কি হলো বুঝলাম না, হঠাৎ লোকগুলো গলা, পেট আর পা ধরে পড়ে গেল মাটিতে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছিটতে লাগলো চারপাশ। মেয়েটা হাতে দোফলা ছুরি নিয়ে ঘুরছে, যেন অজানা নাচের মুদ্রা প্র্যাকটিস করছে। আর তার প্রত্যেক স্টেপেই মরণ চিৎকার করে উঠছে কেউ। শেষ লোকটুকুর গলার রগ কেটে মেয়েটা আমার দিকে তাকালো। তার সুন্দর মুখটুকু রক্তে লাল। আমার বোধবুদ্ধি ততক্ষণে লোপ পেয়েছে। হা করে তাকিয়ে আছি মেয়েটার দিকে।


মেয়েটা বললো, 

- 'বজলু হাওলাদার কোথায়?'

- 'কে?'


মেয়েটা উত্তর না দিয়ে দূরে তাকালো। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে আমিও তাকালাম। নেতা গোছের লোকটা ক্ষেতের আল ধরে পালাচ্ছে। বেশি দূরে যেতে পারেনি। মেয়েটা ছুট লাগালো। একদম কাছে পৌঁছে গেল লোকটার। লোকটা ততক্ষণে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, ওর হাতেও বড় একটা ছুরি। মেয়েটার গায়ে পোঁচ দিতে গিয়েছিলো, মেয়েটা সটান সরে আঘাতটা এড়ালো। এরপর নিপুণ হাতে যেন নকশা আঁকলো লোকটার গায়ে। লোকটা পড়ে গেল যন্ত্রণায় চিৎকার করতে করতে। প্রচন্ড চিৎকারে তার ভবলীলা সাঙ্গ হলো। 


মেয়েটা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো লোকটার দিকে। এরপর আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু বললো। তারপর ফিরে এলো আমার কাছে।


আমি ভয়ে কাঁপছি। কাঁপা গলায় বললাম,

- 'আপনি কে?'


মেয়েটা বললো, 

- 'সেটা জানার আরো সময় পাবেন। এখন চলুন তাড়াতাড়ি। জলদি।'


বলেই মেয়েটা তার লাগেজ খুলে একসেট কাপড় বের করে ছুট লাগালো। আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। ছুটলাম তার পিছু পিছু। আইল ধরে গিয়ে মেইন রাস্তার পাশে পৌঁছাতেই দেখলাম কতগুলো বাইক রাখা, ঐ লোকগুলোর বাইকই হবে মনে হয়। একটা বাইকের চাবি লাগানোই ছিলো। 


মেয়েটা চাবি নিয়ে বাইক স্টার্ট দিয়েই আমাকে বললো, 

- 'উঠে পড়ুন, জলদি।'


আমি মেয়েটার পিছে বাইকে উঠলাম। মেয়েটা বাইকে টান দিলো, প্রায় আশি কিলো স্পিডে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা লঞ্চঘাটে পৌঁছে গেলাম‌। এরমধ্যেই মেয়েটা আমাকে নামিয়ে দিয়ে এক অদ্ভুত কাজ করলো। বাইকটা একটু পেছনে নিয়ে প্রচন্ড বেগে সামনের দিকে চালানো শুরু করলো। বাইকটা যখন নদীর ধারে পৌঁছে গেছে, তখনই মেয়েটা বাইক থেকে এক লাফ মেরে সরে গেল। বাইকটা একটা ডিগবাজি খেয়ে পড়লো নদীর ভেতর, এরপর তলিয়ে গেল। 


মেয়েটা তার নিয়ে আসা একসেট জামা নিয়ে আড়ালে চলে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার জামা পাল্টে আগের রক্তমাখা জামাগুলো ইটের সাথে বেঁধে ছুঁড়ে মারলো নদীতে। এরপর তার সাথে থাকা রক্তমাখা ছু'রিটাও ছুঁড়ে ফেললো নদীতে। নদীর তলে হারিয়ে গেল ছু'রিটা, চিরতরে।


ততক্ষণে ঢাকা যাওয়ার একটা লঞ্চ এসেছে ঘাটে। মেয়েটা লঞ্চে উঠে পড়লো। আমাকে বললো, 

- 'আপনিও উঠে পড়েন লঞ্চে। এখানে কখনো এসেছিলেন, জানলে বিপদ হতে পারে।'


আমিও মেয়েটার পিছু পিছু লঞ্চে উঠে পড়লাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভোঁ শব্দ তুলে ছেড়ে দিলো লঞ্চটা। 


ডেকের একপাশে ছোট জায়গায় আমরা বসলাম। কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে দম ফিরে পেয়ে আবার মেয়েটাকে একই প্রশ্ন করলাম,


- 'আপনি কে? কিভাবে এতোজনকে একসাথে ঘায়েল করে ফেললেন আপনি?'


মেয়েটা বললো,

- 'আমি যে সংস্থায় চাকরি করি, সেখানে এমন টুকটাক আত্মরক্ষা বা লড়াইয়ের কৌশল শিখতেই হয়। তবুও এই লোকগুলোকে ধরার জন্য আমি একবছর যাবত তৈরি হচ্ছিলাম। ছুরি নিয়ে লড়াইয়ের কৌশলগুলোও শিখতে হয়েছিলো নতুনভাবে।'


আমি জিজ্ঞেস করলাম,

- 'কেন?'


মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে বললো, 

❝ এক বছর আগে আজকে রাতের মতোই একটা ঘটনা ঘটেছিলো। একটা মেয়েকে স্বামীসহ এভাবে তুলে নিয়ে গিয়েছিলো জানোয়ারগুলা। স্বামীর সাথে দু:সম্পর্কের এক চাচাশ্বশুরের বাড়ি বেড়াতে এসেছিলো সে, রাতে এমন একটা বিপদে পড়বে সেটা তো জানতো না। মেয়েটাকে বাঁচানোর মতো আর কেউ ছিলো না সেদিন। জানোয়ারগুলো ওর স্বামীকে বেঁধে রেখে সারারাত ওর ওপর নির্যাতন চালায়। শেষে ভোরে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যায় মেয়েটা।'


মেয়েটা থামে, গলার কাছে উঠে আসা কান্না থামায়। আমিও চুপ করে থাকি। কিছুক্ষণ পর সে চোখের পানি মুছে আবার বলতে থাকে, 


- 'মেয়েটা ছিলো আমার বোন। আপন বোন। আপার বেবি হবার কথা ছিলো তিনমাস পরই। মায়ের সাথে বেবিটাও মারা যায়। লাশটা পর্যন্ত জানোয়ারগুলো আনতে দেয়নি, ওখানেই পুঁতে ফেলে। দুলাভাইকেও মেরে ওভাবেই পুঁতে ফেলা হয়। ওদের কুকর্মের আর কোনো স্বাক্ষী রাখে না ওরা।


এই গ্রামে এসে খোঁজ করতেই সব ঘটনা জেনে যাই আমরা। গ্রামের প্রত্যেকটা মানুষ ওদের কুকীর্তির কথা জানে। আরো কত মেয়েকে যে ওরা নষ্ট করেছে, কত মানুষের প্রাণ নিয়েছে তার হিসাব নাই। অথচ কেউ ওদের ভয়ে টু শব্দ করে না। অনেক চেষ্টা করেছিলাম ওদের শাস্তি দেবার, পারিনি। শেষে ঠিক করলাম নিজেই কিছু করবো। ওদের অনেক ভিক্টিম আছে জীবিত, যাদের ওরা মারেনি। তাদের প্রত্যেকের সাথে আলাদা করে কথা বলেছি। এই গ্রামে এসেছি কয়েকবার, জায়গাগুলো রেকি করে গেছি। এক বছর ধরে ওদের মারার প্ল্যান কষেছি, নিজেকে তৈরি করেছি। আজকের আগে আরো তিনবার ওদের ধরার জন্য এভাবে এসেছি, কিন্তু পাইনি। আজকে লাকটা ফেবার করলো। ❞


আমি মেয়েটার কথা শুনছিলাম। যেন কোন থ্রিলার উপন্যাসের কাহিনী শুনছি। আমি নিজে একবর্ণও বিশ্বাস করতাম না, যদি না নিজ চোখে ওকে ওভাবে খুনগুলো করতে দেখতাম।


মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

- 'আপনার কপাল খারাপ, এমন একটা ঘটনার মধ্যে পড়ে গেলেন। আমার প্ল্যান ছিলো এই ঘটনার কোনো স্বাক্ষী রাখবো না, কিন্তু আপনাকে কেন যেন বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করলো।'

আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। চুপ করে রইলাম। 


মেয়েটা এরপর চোখ বন্ধ করে জিরোতে লাগলো। তার মুখের ক্ষিপ্র-ভাবটুকু চলে গেছে ততক্ষনে। আগের মতো স্নিগ্ধ এক মায়া ফিরে এসেছে মেয়েটার মুখে।


লঞ্চ ঢাকা পৌঁছে গেল।


মেয়েটা সদরঘাটে নেমে বললো, 

- 'আমাদের আর দেখা হচ্ছে না তাহলে কোনোদিন। আমি আবারও খুবই দুঃখিত এমন একটা অবস্থায় আপনাকে ফেলবার জন্য।'


আমি কেবল বললাম,

- 'আপনি তো আর ফেলেননি। আচ্ছা, আপনার নামটা জানা হয়নি।'


- 'নির্ভয়া।'


বলেই মেয়েটা ভীড়ের মধ্যে মিশে গেল। তার সাথে আর দেখা হলো না আমার।


(সমাপ্ত)


-----------------

-ছোটগল্প 

-শোধ

-লেখকঃ_সোয়েব_বাশার

----------------------------------


আমাদের নতুন ওয়েব সাইটে এমন আরও গল্প পড়ুন।