রহস্যময় ঘটনা
রাত বারোটায় পাশের বাড়িতে ঝগড়া শুরু হলো। বাড়ির লোকটা ভীষণ জোরে চিৎকার করে বলতে লাগলো,
- 'আমি আর পারছি না। প্লিজ আমায় শান্তি দাও।প্রত্যেকটা দিন এমন অশান্তি আর ভালো লাগে না।'
তার স্ত্রীও চিৎকার করে বলতে লাগলেন,
- 'শান্তি দিবো মানে? আমি শান্তি দেয়ার কে? আমার শান্তি নষ্ট করেছো তুমি। তোমাকে বিয়ে করার পর থেকে আমার জীবনের সব শান্তি নষ্ট হয়ে গেছে।'
- 'মুখ সামলে কথা বলো। তোমাকে আমি কি জোর করে বিয়ে করেছি? তোমার বাবা চাচারা আমাদের বাসায় এসে বাবার পা ধরে অনুরোধ করেছিলো, তাই তোমাকে বিয়ে করেছি।'
- 'বাজে কথা বলবা না। আমার বাবা জীবনেও কারো পা ধরেন নাই। তিনি শুধু অনুরোধ করতে গেছিলো তোমার বাবার কাছে। কারণ তুমি মিথ্যা কথা বলেছিলা আব্বাকে।'
- 'কি মিথ্যা বলেছিলাম?'
- 'বলেছিলা তুমি একটা সরকারি পরীক্ষায় ভাইভা দিয়েছো। যেকোন সময়ই চাকরি হয়ে যাবে।'
- 'ভাইভা তো দিয়েছিলাম। না হলে আমার দোষ?'
- 'অবশ্যই তোমার দোষ। তুমি এমনভাবে বলেছিলে যে আমার বাবা চাচারা বিশ্বাস করেছিলো তোমার সত্যিই চাকরি হয়ে যাবে। যদি জানতেন এমন থার্ডক্লাস প্রাইভেট জবে সারাজীবন পঁচে মরবা জীবনেও তোমার ঘরে আমাকে বিয়ে দিতেন না।'
- 'পঁচে মরবো মানে? কে পঁচে মরবে? বিয়ের পর কি আমি তোমাকে একটুও কষ্টে রেখেছি তরু? যা চাইছো তাই দিছি। বিয়ের পর আমার ছোট দুরুমের ফ্ল্যাটটা তোমার ভালো লাগছিলো না, তাই এই বড় ফ্ল্যাটটা ভাড়া নিলাম। তুমি এলইডি টিভি, সোফা, বুক শেলফ এসব কিনতে চাইলা, কিনে দিলাম।
আমার বেতনের টাকা দিয়ে সংসার চলছিলো না দেখে দুটো টিউশনি নিলাম। বিকেলে অফিস থেকে এসে আরো তিন ঘন্টা টিউশনি করায়ে বাসায় ফিরতাম। আমার কোনো রেস্ট ছিলো না। অথচ তোমাকে একটা দিনও কষ্ট বুঝতে দেই নাই। তাও তুমি পঁচে মরার কথা বলো।'
- 'এগুলা তো সৌমিক হবার আগের কথা। সৌমিক হবার আগে আমিও তো অনেক শৌখিন ছিলাম, এইটা ঐটা কিনে বাসা ভরানোর ইচ্ছা ছিলো। সৌমিক হবার পর কি আমি নিজের জন্য কিছু চেয়েছি? সব তোমার বাচ্চার জন্য। একটা বাচ্চা মানুষ করা এখন কতো খরচের ব্যাপার, জানো না তুমি?'
- 'জানি, আমি সবই জানি। আমি কি কখনো এই জন্য অভিযোগ করেছি? আমাদের ছেলেটার পাঁচ বছর হওয়া পর্যন্ত ওর জামা, জুতা, খেলনা সব কিনে দিয়েছি, কোনো ব্যাপারেই না করি নাই। তবু তুমি পঁচে যাওয়ার কথা কেন বলো?'
- 'বলি কারণ তুমি আর পারছো না। তিনমাস বাড়ি ভাড়া দিতে পারছি না। সৌমিকের স্কুলের ফিস দুমাস ধরে দিতে পারছি না। ওর মিস আজকে আমাকে অনেক কথা শুনিয়েছে এসব নিয়ে। ওর বয়সী বাচ্চারা প্রত্যেকদিন ডিম দুধ খায়, তাও খাওয়াতে পারছি না ওকে। ফল খাওয়াতে পারছি না। ও বন্ধুদের কাছে দেখে একটা খেলনা কিনে দেওয়ার বায়না করছে। সেটাও কিনে দিতে পারছি না। তুমি জানো, ছেলেটার মুখটা দেখলে আমার কি পরিমান কষ্ট লাগে?'
- 'তোমার কষ্ট লাগে, আর আমার কষ্ট লাগে না? ও কি আমার ছেলে না? ওর কষ্টটা কি আমি বুঝি না? কিন্তু কি করবো বলো? করোনা এসে সব শেষ করে দিলো। তুমি তো সবই জানো। আমার চাকরিটা চলে গেলো, এখন এই ছোট চাকরিটা পেয়ে কোনোরকমে সংসারটা চালাচ্ছি। টিউশনিও নাই এখন। আমাকে তো একটু সময় দিতে হবে।'
- 'আর কতো সময় দিবো? একবছর ধরে সময় দিয়েই যাচ্ছি। আর পারছি না আমি।'
এইসময় স্ত্রী কান্না শুরু করলো। স্বামী চুপচাপ। বেশ কিছুক্ষণ কান্নার পর স্ত্রী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললো,
- 'প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমার মাথা ঠিক ছিলো না। এইভাবে আর সহ্য করতে পারছি না আমি। সংসারের এতো অভাব অনটন আর ভালো লাগে না আমার।'
স্বামীর কথাও তখন শোনা যায়। তার কণ্ঠটাও যেন কেমন যেন কাঁপা কাঁপা,
- 'প্লিজ, তুমি একটু শক্ত হও। সব ঠিক হয়ে যাবে। একটা চাকরির ইন্টারভিউ দিয়েছি। এই মাসের মধ্যেই চাকরিটা হয়ে যাবে। হয়ে গেলেই এই স্যালারির দ্বিগুণ স্যালারি পাবো আমি। রনি ভাইয়ের সাথে ঐদিন কথা বলেছি। দুটো টিউশনি ম্যানেজ করে দিবেন বলেছেন। দুটোই ইংলিশ মিডিয়ামের স্টুডেন্ট, কম করে হলেও মাসে প্রত্যেকে দশ হাজার করে দিবে।
চিন্টু ভাইকে বলেছি আমার ধারের টাকা ফেরত দিতে। উনিও পাঁচ দশদিনের ভেতরেই টাকাটা ফেরত দিবেন। ওটা দিলেই সৌমিকের স্কুলের ফিসটা দিয়ে দিতে পারবো। আর একটু অপেক্ষা করো, প্লিজ। এই মাসটা শুধু যেতে দাও। সামনের মাস থেকেই দেখবা, আমাদের আর কোনো অভাব অনটন থাকবে না। আমাদের সবগুলো শখ আমরা পূরণ করতে পারবো।'
এরপরেই বাতি নিভে যায়। তাদের কথা ফিসফিসে পরিণত হয়। সেই কথা আর কানে আসে না।
.
প্রত্যেকটা রাতেই এমন হয়। এক মধ্যবিত্ত পরিবারের কষ্টের কথাগুলো পাতলা দেয়াল ভেদ করে এপারে চলে আসে। সেই কথাগুলো শুনতে হয়। না চাইলেও শুনতে হয়। তাদের কথা শুনে আফসোস করা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না।
আমি আর এই বাসায় থাকবো না। ছেড়ে দিবো বাসাটা। কারণটা ভীষণ অদ্ভুত। আপনারা শুনলে আমাকে পাগল ভাববেন।
একমাস আগে, ঠিক আজকের মতোই রাতে স্বামী স্ত্রী দুজন ঝগড়া করে শুয়ে পড়েছিলো। রাত তিনটা বা চারটার দিকে আমি কেমন যেন একটা শব্দ পাই। মনে হলো কান্নার শব্দ। পাশের বাসা থেকেই আসছে। আমি ব্যাপারটা তেমন গুরুত্ব না দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। পাশের বাসায় যে কিছু হতে পারে এমন কোনো সম্ভাবনাই আমার মাথায় আসে নাই।
.
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি বাসায় পুলিশ। কি ব্যাপার? যে ব্যাপার দেখলাম, তা ভয়াবহ। পাশের বাসার স্বামী আনুমানিক রাত তিনটা কি চারটার দিকে তার বউ আর বাচ্চা দু'জনকেই খু'ন করে নিজে সুই'সা'ইড করেছে। সকালে ময়লাওয়ালা ময়লা নিতে এসে ওদের লাশ আবিষ্কার করে। পরে পুলিশে খবর দেয়।
পুলিশ ইনভেস্টিগেশনে আরো অদ্ভুত অদ্ভুত তথ্য বেরিয়ে আসে। জানা যায়, করোনার সময় স্বামীটার যে চাকরি চলে যায়, এরপর সে আর কোনো চাকরি পায়নি। এতোদিন বউকে যে ছোটখাটো একটা চাকরি পাওয়ার কথা বলেছিলো, এটা পুরোপুরি মিথ্যা। সে এর-ওর কাছ থেকে ধার দেনা করে সংসার চালাচ্ছিলো। কিছুদিন ধরে সব পাওনাদাররা মিলে তাকে পাওনা টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য চাপ দেয়।
টিউশনি পাবার যে গল্প সে বলেছিলো, সেটাও মিথ্যা, কেউ তাকে টিউশনি ম্যানেজ করে দেবার কোনো আশ্বাস দেয় নাই। বাচ্চার স্কুলের ফিস, বাড়িভাড়া, সংসার চালানোর ব্যয়, সব মিলিয়ে সে প্রচন্ড চাপের মধ্যে পড়ে যায়। সেই চাপ থেকেই মেন্টাল ব্রেকডাউন। আর সেখান থেকেই প্রথমে ফ্যামিলি মেম্বারদের খু'ন, আর পরে সুই'সা'ইড।
তাদের ঘরটা এখনো খালি পড়ে আছে। তাদের ঘরটা আমার ঘরের পাশেই। এখনো মাঝরাতে কান পাতলে আমি তাদের শব্দ শুনতে পাই। স্বামী স্ত্রীর ঝগড়ার শব্দ, স্ত্রীর কান্নার শব্দ, তাকে স্বামীর সান্তনা দেবার শব্দ। রাত তিনটায় সেই অদ্ভুত কান্নার আওয়াজটাও পাই। যে সময় সে তার পরিবারের লোকদের খু'ন করছিলো। এসব আমার কল্পনা না। আমি স্পষ্ট শুনতে পাই। শুনতে পাই, আর ভয়ে কুঁকড়ে থাকি। সারারাত ভয়ে ঘুম আসে না আমার।
আমি ভালো একটি বাসা খুঁজছি। পেলেই এই বাসাটা ছেড়ে দিবো। এই অভিশপ্ত বাড়িতে কোনোভাবেই আর থাকা সম্ভব না আমার।
(শেষ)
গল্প- হতাশার শব্দ
লেখা- সোয়েব বাশার