মেয়েদের সংসার জীবন | সংসার জীবনের কষ্ট

 সংসার ভাঙ্গার কারণ

সংসার ভাঙ্গার কারণ

৬ মাসের প্রেগন্যান্ট অবস্থায় আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমি আমার স্বামীকে ডিভোর্স দিবো। ডিভোর্সের কথাটা যখন আমি ফোন করে আমার নিজের মাকে বলি তখন মা উত্তরে বললো,


-- 'আমি যদি নেক্সট টাইম এমন পাপের কথা মুখে আনি তাহলে উনি আমার পোড়ামুখ কখনো দেখবেন না।'


তখন আমি মাকে বললাম,

-- 'তোমাকে যা বলার বলেছি। আমি আর একদিনও স্বামীর ঘর করবো না।  তুমি বাবাকে শুধু কথাটা জানিয়ে দিও'


এইকথা বলে আমি ফোনটা রেখে দিলাম। আমার স্বামী যখন দেখে আমি ল্যাগেজে কাপড় রাখছি তখন সে অবাক হয়ে বললো,


-- 'কি ব্যাপার! তুমি ল্যাগেজ গুছিয়ে কোথায় যাবে?'


আমি শান্তভাবে ওকে উত্তর দিলাম,

-- 'বাবার বাসায় যাবো।'


-- 'তুমি বাবার বাসায় যাবে আগে বলবে না? এখন হুট করে বললে আমি তৈরি হবো কিভাবে?'


-- 'তোমার তৈরি হতে হবে না আমি একাই যাবো। আর শুনো কয়েকদিন পর উকিল আসলে ডিভোর্সের কাগজে সাইন করে দিও। আর চিন্তা করো না, আমাকে দেন-মোহরের বাকি টাকা তোমার শোধ করতে হবে না। সেটা আমি মাফ করে দিয়েছি। আর তোমরা আমায় বিয়েতে যে গহনা দিয়েছিলে সেগুলো রেখে যাচ্ছি। ইচ্ছে হলে দেখে নিতে পারো।'


আমার কথা শুনে ফাহিম অবাক হয়ে আমার দুই কাঁধে হাত রেখে বললো,


-- 'মানে! পাগলের মতো কি সব বলছো?'


আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে হেঁসে বললাম,

-- 'আমি যা বলছি সত্যি বলছি। তোমাকে এখন আমার আর ভালো লাগে না। তাই তোমার থেকে সরে যাচ্ছি।'


আমার স্বামী আমায় বারবার জিজ্ঞেস করছিলো ওর অপরাধ কি! জবাবে আমি শুধু বললাম, ‘তোমার কোন অপরাধ নেই। সব অপরাধ আমার। তোমাকে আমার ভালো লাগেনা তাই তোমার সাথে থাকবো না।’ ও আমায় বারবার আটকানো চেষ্টা করেছিলো কিন্তু আমি ওর কোন কথা না শুনে বাসা থেকে বের হয়ে যাই...  


.


কলিংবেলে বাজাতেই মা দরজা খুললো৷ মায়ের পাশে বাবা দাঁড়িয়ে। বাবাকে দেখলেই আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়। সেনাবাহিনীর কর্ণেল ছিলেন বাবা। চাকরি থেকে অবসর নিলেও মেজাজটা সেই আগের মতই আছে। কঠিন চোখে বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বললো,


-- 'তোর মা যা বলেছে তা সত্যি নাকি?'


আমি ক্লান্ত চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম,

-- 'সত্যি মিথ্যে পরে বলছি। এই শরীরে ল্যাগেজ নিয়ে এতোটা পথ এসে আমি খুব ক্লান্ত হয়ে গেছি। আমায় আগে ঢুকতে দাও... '


বাবা ভারী গলায় বললো,

-- 'আয় ভিতরে। আসার সময় কোন অসুবিধা হয় নি তো?'


-- "না কোন অসুবিধা হয় নি।'


.


গোসল করে ফ্রেশ হয়ে যখন খাবার টেবিলে বসে খাচ্ছিলাম তখন মা পাশে বসে আমার মাথায় হাত রেখে বললো,


-- 'মা, সত্যি করে বল তো.. তুই কি জামাইকে সত্যি সত্যি ডিভোর্স দিবি?'


-- 'হ্যাঁ মা।'


-- 'কিন্তুু কেন? জামাইয়ের মতো এমন একটা ভালো ছেলেকে তুই কেন ডিভোর্স দিবি?'


আমি হেঁসে বললাম,

-- 'এতো ভালো দেখেই ডিভোর্স দিবো।'


আমার কথা শুনে মা চোখ বড়বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো আর আমি আমার মতো করে খেতে লাগলাম...


.


পরের দিন আমার স্বামী শ্বশুর-শ্বাশুড়িকে নিয়ে আমাদের বাসায় আসলো।  ড্রয়িংরুমে যখন সবাই বসে আছি তখন শ্বশুর আমায় বললো,


-- 'তোমাদের সব কিছু তো ঠিক ছিলো। তাহলে শুধু শুধু ডিভোর্স দিতে চাইছো কেন?'


আমি মাথা নিচু করে বললাম,

-- 'ছিলো কিছু সমস্যা বাবা।'


আমার স্বামী তখন কিছুটা রেগে গিয়ে বললো,

-- 'কি সমস্যা ছিলো শুনি? বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত আমি কখনো তোমাকে কোন কিছুতে অভাব দেই নি। যখন যেটা চেয়েছো সেটাই দিয়েছি। তাহলে কেন আমায় ডিভোর্স দিবে?"


আমি নিচের দিকে তাকিয়ে জবাব দিলাম,

-- 'তুমি আমায় আমার প্রাপ্য সম্মান দাও নি।'


আমার স্বামী দ্বিগুণ রেগে গিয়ে বললো,

-- 'তোমায় কি অসম্মান করেছি?'


-- 'আমি সেটা সবার সামনে বলতে চাইছি না। আমি আমার মাকে আর শ্বাশুড়িকে আলাদাভাবে বলবো।'


-- 'তোমার যা বলার এইখানে সবার সামনে বলবে। আমারও জানা দরকার  কি এমন করেছি, যার জন্য তুমি আমায় ডিভোর্স দিতে চাইছো!'


তখন আমিও কিছুটা রাগান্বিত হয়ে আমার স্বামীকে বললাম,


-- 'আমি মেয়ে মানুষ চাইলেই সবকিছু সবার সামনে বলতে পারি না। কিন্তু তুমি যেহেতু, চাইছো সবার সামনে বলি তাহলে শুনো বলছি -


‘আমি তোমার বিয়ে করা বউ। ভাড়ায় ঠিক করা কোন পতিতা না, যে তুমি টাকা উসুল করার জন্য আমার উপর সমানে অত্যাচার করবে। তুমি আমার সাথে এমন ব্যবহার করো তখন নিজেকে তোমার স্ত্রী মনে হয় না। মনে হয় কোন পতিতালয়ের পতিতা। আমরা মানুষ জঙ্গলের কোন জীবজন্তু না যে ওদের মতো মিলিত হবো। কিন্তু বিশেষ মুহূর্তে তোমার মাঝে আমি মানুষ বাদে পশুত্ব দেখতে পাই যে কিনা আমার দেহটাকে ছিড়েখুঁড়ে খাচ্ছে। ইসলামের শরীয়ত মোতাবেক, ‘স্বামী-স্ত্রী সঠিক ভাবে মিলিত হওয়াটাও একধরনের ইবাদত’ কিন্তুু সেটা যদি বন্য প্রাণীর মতো হয় তখন সেই ইবাদতের কাজটাই গোনাহে্র কাজ হয়ে দাঁড়ায়। 

 

আমি জানি স্বামী যখন স্ত্রীকে কাছে চায় তখন স্ত্রীর উচিত দুনিয়ায় সবকাজ ফেলে হলেও স্বামীর ডাকে সাড়া দেওয়া। কিন্তুু স্বামীরও খেয়াল রাখা উচিত স্ত্রীর সুবিধা অসুবিধা বুঝা। আমি প্রেগন্যান্ট আর এই অবস্থায় একটা মেয়ের শরীরে নানা রকম সমস্যা দেখা দেয়, কিন্তু তুমি সেটা একবারের জন্যও খেয়াল করো না। তুমি শুধু তোমারটাই বুঝো। আমার কষ্ট হচ্ছে কিনা সেদিকে তোমার খেয়াল নেই। এত কিছুর পরেও আমি আস্তে-ধীরে চেষ্টা করছিলাম তোমায় সংশোধন করতে কিন্তু গতকাল রাতে তুমি যা করলে আমার ক্ষমতা নেই সেটা সহ্য করার।’ '


আমার স্বামী ভয়ার্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আমতা-আমতা করে বললো,

-- 'গতকাল রাতে আমি তো কিছু করি নি। আমি তো অফিসের কাজে ময়মনসিংহ গিয়েছিলাম।'


স্বামীর কথা শুনে আমি হেঁসে বললাম,

-- 'তুমি অফিসের কাজে ময়মনসিংহ গিয়েছিলে নাকি কোন মেয়েকে নিয়ে হোটেলে ছিলে সে সত্যিটা আমি জানি..!'


কপালে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘামের কণা গুলো মুছতে মুছতে আমার স্বামী বললো,

-- 'মিথ্যা কথা। আমি কোন মেয়ের সাথে হোটেলে থাকি নি।'


আমি তখন আমার স্বামীর চোখে চোখ রেখে বললাম,

-- 'তুমি যে হোটেলে ছিলে সে হোটেলে আমার পরিচিত একজন জব করে। তার কথা আমি প্রথমে বিশ্বাস করি নি। কিন্তু যখন নিজ চোখে তোমার আর মেয়ের সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ দেখলাম তখন কি করে অবিশ্বাস করি বলো তো?'


আমার স্বামী মাথা নিচু করে বসে রইলো। আমি তখন শ্বশুর-শ্বাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বললাম,


-- 'আপনারা বলেন যে স্বামী তার স্ত্রীর সাথে পতিতার মতো আচরণ করে আর দিন শেষে অন্য মেয়ের সাথে রাত কাটায় তার সাথে সংসার করা যায়?'


শ্বাশুড়ি আমায় অবাক করে দিয়ে বললো,

-- 'তুমি যদি স্বামীকে তৃপ্তি দিতে না পারো স্বামী অন্য মেয়ের কাছে যাবে এটাই স্বাভাবিক।'


শ্বাশুড়ির কথা শুনে আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই আমার বাবা আমার শ্বাশুড়িকে বললো,


-- 'আপনার গুণধর পুত্রকে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যান। মেয়ের গলাটিপে মেরে ফেলবো তবুও আপনার ছেলের সংসারে পাঠাবো না।'

'

'

'

'

আমার স্বামী আর শ্বশুর-শ্বাশুড়ির চলে যাবার পর থেকেই মা কান্না করছে আর বলছে,


-- 'আমার মেয়েটার কি হবে? আমার মেয়ের অনাগত সন্তানের কি হবে?'


খেয়াল করে দেখি বাবা বিছানার এক কোণে চুপচাপ বসে আছে। বাবার চোখের চশমার গ্লাসটা ঝাপসা হয়ে গেছে। যে বাবাকে আমি আমার বিয়েতেও কাঁদতে দেখি নি সেই বাবার চোখের কোণে আজ জল দেখলাম। আমাকে রুমে ঢুকতে দেখে বাবা ভারী গলায় বললো,


-- 'তুই কোন চিন্তা করিস না। আমি আছি তো। আমাদের এই নষ্ট সমাজ ডিভোর্সের জন্য শুধু মেয়েদের দায়ী করে। তোকে আমার আড়ালে আশেপাশের লোক অনেক কিছু বলবে সেসব কথা কানে নিবি না। প্রতিদিন একটু একটু করে শেষ হওয়ার চেয়ে একেবারে শেষ করে দিয়েছিস সেটাই ভালো হয়েছে। যে স্বামী নিজের স্ত্রীকে সম্মান করে না সেই স্বামীর সাথে একসাথে থাকার মানেই হয় না।'


বাবার কথা শুনে আমি অনেক কষ্টে নিজের চোখের জলটা আটকে রেখে বাবাকে বললাম, 'ঠিক আছে বাবা।'


নিজের রুমে এসে ভাবতে লাগলাম, ‘আমাদের সমাজে আমার মতো হয়তো অনেক মেয়ে আছে যারা স্বামীর কাছে স্ত্রীর সম্মানটা পায় না। দিনের পর দিন অসম্মানিত হয়েও সংসার করে যাচ্ছে আর প্রতিদিন একটু একটু করে শেষ হয়ে যাচ্ছে...।


(সমাপ্ত)


-ছোটগল্প || -সম্মান 

-লেখা || -আবুল_বাশার_পিয়াস

----------------------------


বাছাইকৃত সেরা গল্প পড়ুন।