বউ শাশুড়ি | বউ শাশুড়ির ঝগড়া | বউ শাশুড়ির ভালোবাসা

  • বউ শাশুড়ির সম্পর্ক

বউ শাশুড়ির সম্পর্ক

ইলিশ মাছের জন্য কারো সংসার ভাঙে? আমার মায়ের ভেঙেছে। মাত্র পাঁচশো টাকা দামের ইলিশ মাছের মাথা নিজে খেয়ে ফেলার অপরাধে আম্মা চিরতরে আব্বার বাড়ি ছেড়ে হাঁটা দেন। ঘটনা টা শুরু থেকেই বলি তবে।


আমার বাবা মায়ের ভালোবাসার বিয়ে। তাদের ই ভালোবাসার ফসল আমি। তবে আমার জন্মের সাত বছর হয়ে গেলেও, আমার দাদী কখনো আম্মাকে আপন করে নিতে পারেন নি। আম্মার প্রতিটা কাজ পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে দেখতো দাদী। একটা কিছু ভুল পেলে, তা নিয়েই গাল মন্দ করে দিন পার করা ছিল তার নিত্যদিনের কাজ। আম্মার প্রতি দাদীর এহেন আচরণের কারণ ছিল, দাদীর বোনের মেয়ে "মিতা ফুপি"। তিনি ছোট বেলা থেকেই আমাদের বাড়িতে থাকতেন। দাদীই তাকে বড় করেছেন। তাই দাদী সবসময় চাইতো, মিতা ফুপির সাথে আব্বার বিয়ে দিতে। কিন্তু আব্বা সে কথা অমান্য করে আম্মাকে বিয়ে করে নেন। বিয়ের আগ অব্দি আব্বা দাদীর সব কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করছেন। তাই দাদীর কথা অমান্য করে আম্মাকে বিয়ের ব্যাপারটা দাদী এত বছরেও হজম করতে পারেন নি। সেই রাগ আজ দশ বছর ধরে উনি আম্মার উপর তুলছেন।


আমার আম্মার ইলিশ মাছ খুব প্রিয় ছিল। তবে আব্বা ইলিশ মাছ আনতেন না সহজে। আনলেই দাদী চিৎকার জুড়ে দিত। আম্মা নাকি ইলিশ মাছের কাঁটা গলায় বিঁধিয়ে দাদীকে মারতে চান। কাঁটা শুধুই অযুহাত ছিল, মূলত দাদী চাইতেন না আম্মা নিজের পছন্দের খাবার খাক। এটা সবাই বুঝতো। তবে সাংসারিক শান্তির জন্য আম্মা ও আস্তে আস্তে ইলিশ খাওয়া ছেড়ে দিল। তার হয়ে আব্বা কোন দিন দাদীকে কিছু বলেন নি। যতকিছু ই হোক আব্বা সারাক্ষণ আম্মারে বলতো,

-" শেফালি, আম্মা বুড়া মানুষ। আর কয়দিন ই বা বাঁচবে? ওনার কথা কানে নিও না। একটু সহ্য করো। একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।"


আম্মা আব্বার কথা পুরোপুরি মান্য করতো না। তিনি চুপচাপ সহ্য করলেও, কথা ঠিক ই কানে নিতেন। আর চোখের পানি ফেলতেন। আমি ড্যাবড্যাব করে আম্মার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করতাম। কিন্তু বেশিরভাগ সময় ই কিছু বুঝে উঠতে পারতাম না। 


আম্মারে দেখতে না পারলেও দাদী আমাকে খুব আদর করতেন। হয়তো ওনার একমাত্র ছেলের অংশ বলেই। পুরো বাড়িতে যার সাথে উনি সব চেয়ে কম উঁচু স্বরে কথা বলতেন, সে হলাম আমি। আমারে উনি বুবু বলে ডাকত। কিছু খেলে, আমার জন্য খানিকটা রেখে দিত। আমিও দিনের বেশিরভাগ সময় দাদীর সাথে লেগে থাকতাম। উনি সারাক্ষণ ই আমার কাছে, আম্মার নামে এই সেই অভিযোগ করতেন। মিতা ফুপি কে বাদ দিয়ে আম্মাকে কেন বিয়ে করছে সেজন্য আব্বাকে নিয়ে আক্ষেপ করতেন।


আমার যখন সাত বছর বয়স, আম্মা আবার সন্তানসম্ভবা হলেন। সবাই মহাখুশি। সেই থেকে আমি আর আম্মা সারাদিন গুটুর গুটুর গল্প করতাম, নতুন বাবুকে নিয়ে। ওই সময় টা আমি সারাদিন আম্মার আগে পিছে ঘুরতাম। তখন অতশত বুঝতাম না। তাই ভাবতাম, এই বুঝি বাবুকে পরী রা দুনিয়ায় দিয়ে যাবে আর আমি বড় আপা হয়ে যাবো। দাদী আদর করে ডেকে কাছে বসালেও আমার মন পড়ে থাকতো আম্মার কাছে। বেশিক্ষণ দাদীর কাছে থাকতাম না। আমার এসব ব্যাবহারে দাদী ফুঁসে উঠতো আম্মার উপর। আম্মা নাকি, আব্বার মত আমাকেও তার থেকে দূরে সরাচ্ছে। আমি ঘুনাক্ষরে ও টের পাই নি, বড় আপা হওয়ার উত্তেজনায় আমি চির কালের জন্য আমার ছোট সাথী কে হারিয়ে ফেলবো।


এক রাতে আমি আম্মা আর আব্বার মাঝে শুয়ে ছিলাম। আব্বা নরম গলায় আম্মারে জিজ্ঞেস করলো,

-"শেফালি, এখন ভালা মন্দ খাইতে হইবো তোমার। নয়তো আমাগো শিমুল রানীর খেলার সাথী দুর্বল হইবো। কও তোমার কি খাইতে মন চায়?"


আম্মা আবেগী গলায় উত্তর দিল,

-"অনেক দিন থেকে ইলিশ মাছ খাওয়ার জন্য মন উথাল পাথাল করতাছে। এখন তো ইলিশের সিজন। আপনি কাল একটা ইলিশ আনবেন? আমি নিজ হাতে রান্না করে খামু।"


আব্বা হাসতে হাসতে সম্মতি দেয়। পরের দিন ঠিক ই সকালে উঠে আব্বা আমারে নিয়ে হাটে যায়। আমি হাটের সব থেকে বড় ইলিশ টার দিকে আঙুল দিয়ে আব্বারে ইশারা করি। আব্বা ওই ইলিশ টাই নেয়। খুশি মনে নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরেই আম্মার কাছে দৌড়ে যাই। আম্মা ও হাসি হাসি মুখে ইলিশ মাছ টা নিজে কেটে রান্না করে। সারাবাড়ি ইলিশের গন্ধে মো মো করছিল। 


দুপুরে আমাকে আর দাদীকে খেতে দেয় আম্মা। দাদী ইলিশের মাথা চায় খেতে। কিন্তু আম্মা ওটা আগেই খেয়ে ফেলছিলো। স্বভাব সুলভ ভাবে দাদী আবার গাল মন্দ করা শুরু করে আম্মারে। আম্মা তার পাতে মাছের বড় এক পিস দেওয়ার জন্য পাতিল নিয়া আসতেই, তিনি ছোঁ মেরে পাতিল নিয়ে উঠানে ছুড়ে মারে। 


ওই সময় আব্বা দোকান বন্ধ করে দুপুরের ভাত খেতে বাড়ি আসে। বাড়ি তে পা দিতেই দেখে উঠানে ইলিশ মাছের তরকারি পরে আছে। আব্বারে দেখেই দাদী নাক কান্না করতে করতে আব্বার দিকে ছুটে আসে। আব্বা তখন হতভম্ব হয়ে আম্মার দিকে তাকিয়ে আছে। দাদী সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে আব্বাকে বানিয়ে বানিয়ে বলেন,

-" দেখ আশরাফ, তোর বউয়ের কাছে ইলিশ মাছের মাথা টা খাইতে চাইছি দেইখা চেইতা গেছে। ওর জন্য আনা খাবার আমি চাইছি কেন? আমি নাকি তোর বউয়ের খানার দিকে নজর দেই। আমি শুধু কইলাম, বুড়া মানুষের মনের কি ঠিক আছে? কখন কি খাইতে মন চায়। তোর বউ আমারে কয়, ওই ইলিশের কাডা যেন আমার গলায় বাইজ্যা আমি মরি। এসব শুইন্যা আমি কান্দন শুরু করছি, তাই পাতিল সহ আমার সামনে ফালাইয়া দিয়া কইছে সব মাছ যেন আমি খাই।"


আব্বা উত্তরের আশায় পুনরায় আম্মার দিকে তাকায়। আম্মা শুধু নিচু গলায় বলে, 

-"পোয়াতি অবস্থায় একটা মাছের মাথা খাইছি বইলা এতো মিথ্যা কথা বলতে আপনার মুখে বাঁধতাছে না আম্মা? আপনিও তো একজন মা। জানেন ই তো এই সময় মনের অবস্থা। "


আম্মার কথা শুনে দাদী দ্বিগুন চেতে যায়। বিশ্রী ভাষায় গালাগাল শুরু করে। গালাগালির এক পর্যায়ে তিনি আম্মারে অভিশাপ দিয়ে বলেন,

-" তুই যদি মিথ্যা বলস, তোর যেন মরা বাচ্চা হয়।"


এটা শুনে আম্মা আর নিজেরে ধরে রাখতে পারলেন না। উঁচু গলায় দাদীকে কটু কথা বলে বসলেন। আব্বা সাথে সাথেই আম্মার গালে একটা চড় মেরে দেন। আম্মা অসুস্থ শরীরে টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যান। এরপর ই ঘটে যায় ভয়ংকর রক্তারক্তি কান্ড। আম্মা মাটিতে পড়ে পেটে হাত দিয়ে একনাগাড়ে চিৎকার শুরু করেন। আব্বা আর দাদী ভড়কে যান। কোন মতে ধরাধরি করব আম্মাকে তখনই হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিন্তু আম্মা বেঁচে গেলেও, বাচ্চা টা মরে যায়। আম্মা ওই রাতেই আমাকে নিয়ে নানা বাড়িতে চলে যায়। পরেরদিন সকালে আব্বা আম্মামে আনতে গেলে, আম্মা সোজা সাপ্টা বলে দেন, উনি আর ওই বাড়ি যাবেন না।

আব্বা নিজের কাজের জন্য অনেক ক্ষমা চান। উনি আম্মাকে বুঝাতে চেষ্টা করেন, দাদীর অভিশাপেই উনি রেগে গেছিলেন। তবে যতই হোক দাদী তো ওনার মা। তাই দাদী কে না পেরে আম্মাকে চড় দিয়ে বসেন।

আম্মা হিসহিসিয়ে বলেন,

-" আমারে যেমন দশ বছর ধরে সবকিছু চুপচাপ সহ্য করে মানিয়ে নিতে বলছেন, ওইরকম আপনার আম্মারেও যদি বুঝাতেন আমারে মানতে না পারলেও মানিয়ে চলতে। তাইলে আজ আমার বাচ্চা টা মইরা যাইতো না। আমার সাথে যা করছেন তার জন্য আপনারে আমি মাফ করলেও। আমার বাচ্চার মরার দায় থেকে আপনারে মাফ করমু না। নিজের বউয়ের উপর হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে যে পারে না, তার ঘর আমি করমু না।"


এরপর ও আব্বা বহুবার আমাকে আর আম্মাকে আনতে গেলেও আমরা আর যাই নি। আমাকে আম্মা যেতে কখনো নিষেধ করে নি। কিন্তু ওইদিন নিজের মায়ের উপর হওয়া অন্যায় দেখে আমার ছোট মনেও বাবা আর দাদীর জন্য ঘৃণা সৃষ্টি হয়। একসময় আব্বা ও আসা বন্ধ করে দিলেন।


বহুবছর কেটে গেলেও আম্মা আব্বার মধ্যে ডিভোর্স হয় নি। কিন্তু তারা একদিনের জন একসাথে ও থাকেন নি। প্রতি মাসে আব্বা লোক মারফত আমার আর আম্মার খরচ বাবদ টাকা পাঠিয়ে দিত। 


কিন্তু আজ হঠাৎ আব্বা আবার আমাদের দুয়ারে আসেন। এখন আমি মেট্রিক দিবো। আব্বা অনেক টাই বুড়িয়ে গেছেন। আম্মার হাত ধরে হাউমাউ করে কান্না করতে শুরু করেন। দাদী নাকি মৃত্যু শয্যায়। সারাদিন শুধু আম্মার নাম ধরে ডাকে আর কান্না করে। তার শেষ একটা ই ইচ্ছা আম্মার কাছে মাফ চাওয়া। মৃত্যুর কথা শুনে, আম্মা আর স্থির থাকতে পারলেন না। তৎক্ষনাৎ আমাকে বগলদাবা করে দাদীবাড়ির দিকে রওনা দিলেন। 


আম্মারে দেখেই দাদী চোখের পানি ছেড়ে,নিজের করা পাপের জন্য ক্ষমা চাইতে শুরু করলেন। আম্মা তারে বাচ্চাদের মতো জড়িয়ে ধরে বুঝাতে লাগলো। হঠাৎ দাদী আব্বাকে ডেকে বললেন,

- আশরাফ, বাজান একটা ইলিশ আনবি? অনেকদিন শেফালির হাতের রান্ধন খাই না। খুব ইচ্ছা করতাছে। ও মাছ রান্না কইরা আমার সামনে বইসা মাথা খাইবো। আমি মন ভইরা দেখমু। এতে যদি আমার পাপের ক্ষমা হয়।"


আম্মার দিকে ফিরে বলেন,

-"কিরে মা, এই বুড়ি টারে চাইরডা ভাত রাইন্ধা খাওয়াবি না?"


আম্মা কান্না করতে করতে সম্মতি দিলেন। এই ভালোবাসা টুকুই তো এতবছর মা চেয়েছিলেন। আমি এক কোনে বসে অবাক চোখে দেখি আমার পরিবারের পুণর্মিলন।


.

সমাপ্ত


- অণুগল্পঃ ইলিশ মাছের মাথা

- কলমেঃ  জান্নাতুল আক্তার মুন্নি


মন ছুঁয়ে যাওয়া গল্প পড়ুন।