খুব কাছের মানুষের অবহেলা | অবহেলার কষ্টের গল্প

 স্ত্রীর প্রতি স্বামীর অবহেলা

স্ত্রীর প্রতি স্বামীর অবহেলা

তমালিকা বেশ সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠে আজকাল।সকালের নাস্তা রেডি করে, বাচ্চাকে স্কুলে নামিয়ে তবে কিছুটা সময় পায় নিজের মত করে।


এই সময়টুকু বেলকনির গাছগুলোয় পানি দেয়,আগাছা পরিষ্কার করে।মাঝে মাঝে নিউ মার্কেটে ঘুরতে যায়।ছোট ছোট মাটির জিনিস পাওয়া যায় এমন সব দোকানে ঘুরতে বেশ লাগে।কিংবা শপিং মল গুলোয় ঘুরে বেড়ায়।দরকার ছাড়াও এটা ওটা কিনে আনে।


সে দিন কি মনে করে একটা লাল রঙের মাটির হাড়ি কিনে আনলো।হাড়ির ওপর সাদা রঙের বাহারি নকশা করা।বেশ,দেখতে। কিন্তু বাসায় আসার পর হাড়িটা কেনো কিনেছে বুঝতে পারলো না।


একটা সময় আর্ট ইন্সটিটিউটে পড়ার খুব শখ ছিলো।টাকাও জমিয়ে ছিলো ভর্তি হবে বলে।জীবনের অনেক অপূর্ণ ইচ্ছের মত এই ইচ্ছেটাও ধরাছোঁয়ার বাহিরেই রয়ে গেছে।


যখন অনেক কিছু হতে মন চাইতো।নিজেকে অনেক স্বপ্নের মাঝে দেখতে ভালো লাগতো তেমনই এক সময় সব স্বপ্নকে স্বপ্নের রাজ্য আটকে ফেলতে হয়েছিলো।


 হঠাৎ এক সন্ধ্যায় মামি এসে বললো," তমা আজ তোমার কাবিন হবে। ভালো দেখে একটা শাড়ি পড়ও।"


তমালিকা তখন সবে এইচএসসি পাশ করেছে।বাচ্চা একটা মেয়ে।ঢাকায় মামার বাসায় এসেছিলো ভার্সিটি ভর্তি কোচিং করবে বলে। 


তমালিকা মাকে ফোন করার আগে মা নিজেই ফোন করে অনুনয়ের স্বরে বোঝালেন।তমা যেনো বিয়েটা করে।কারন পাত্র ছোট মামার বন্ধুর ভাই।খুব ভালো ছেলে। আমেরিকায় সিটিজেন পাওয়া ।উচ্চ শিক্ষিত।দেখতে ভালো।খুব ভালো পরিবার।৩ মাসের ছুটিতে দেশে এসেছে।কোথায় যেনো তমালিকাকে দেখেছে। ছেলের খুব পছন্দ। এমন ছেলে আর পাওয়া যাবে না... ইত্যাদি ইত্যাদি। 


তমালিকা বরাবরই চুপচাপ ধরনের মেয়ে।বাবা মারা গেছেন খুব ছোটবেলায়।মা স্কুলে চাকরি করে তিন ভাইবোনকে মানুষ করেছেন অনেক কষ্টে।


তমা মায়ের মুখের ওপর বলতে পারে না তার স্বপ্নটা অন্য রকম।কিংবা মামার কথার বিরুদ্ধেও যেতে পারে নাই।অতটুকু বয়সে হয়তো কি করা উচিৎ সেই সিদ্ধান্ত নেবার জন্যও পাশে কাউকে দরকার হয়।কোন বন্ধু,কোন আত্নীয়,কিংবা কাছের কেউ।কিন্তু তমালিকার কাছের তেমন কেউ ছিলো না।


বিয়েটা হয়ে গেলো হঠাৎ করেই।পরের ২ মাস কেমন কাটলো তমালিকার? ভালোই তো।তমালিকার বর আসিফ। সুদর্শন মানুষ সন্দেহ নেই।কিন্তু যখন তমালিকার শরীরের গঠন কোন পর্ন তারকার মত তার বর্ননা দিলো, তখন লোকটার ভেতরের কুৎসিত চেহারাটা যেনো দেখতে পেলো তমালিকা। একজন স্ত্রীর যা যা কর্তব্য সব তো করেছে তমালিকা।স্বামী চায় না বলে নিজের পড়ালেখা বন্ধ করেছে।স্বামী দেবতা আমেরিকায় যাবার আগে তার পরিবারকে খুশি করতে কনসিভও করেছে তমালিকা।কথা ছিলো আসিফ আমেরিকায় যেয়ে ৬ মাসের মধ্য তমালিকাকে নিয়ে যাবে।কিন্তু নানা অজুহাতে আজ ছয় বছর হয়ে গেলো আমেরিকায় আর যাওয়া হলো না।


মাঝে দুই বছর আগে এক বার এসেছিলো তিন মাসের জন্য।সেই আগের স্বভাবেই তাকে পেয়েছে তমালিকা।একটা শরীর স্বর্বস পুরুষ।শরীরের বাহিরেও যে একটা মন থাকে তা যেনো লোকটা জানে না। মেয়ের প্রতি ভালোবাসা আছে নিশ্চই।না হলে মাস শেষে বড় অংকের টাকা পাঠাতো না।ঢাকা শহরে বিত্তবান এলাকায় এতোবড় একটা ফ্লাট তমালকার থাকার খরচ তো মাস শেষে সেই পাঠায়।


সব আছে তমালিকার।দামি ফ্লাট, দামি শাড়ি,দামি আসবাবপত্র। কিন্তু আবার যেনো কিছুই নেই।অনেকে ফিসফাস করে আসিফের নাকি আমেরিকান বউ আছে।সেখানে কোন বাচ্চা নেই কিন্তু সেই আমেরিকান মেয়েকে হয়তো সে ছাড়তে পারছে না কিংবা ছাড়তে চাইছে না।


তমালিকা সবার কথা শুনে আর মনে মনে হাসে।সেই দিন ছোট মামি ফোন করে বলছিলো, "কিরে তমা শুনলাম আসিফ নাকি আমেরিকায় কোন মেয়ের সাথে লিভ টুগেদার করে। সত্যি নাকি? এমন চরিত্রের ছেলে ছি ছি ছি।"


তমা হেসে উত্তর দিয়েছিলো," কি যে বলো ছোট মামি। তোমরাই না বলেছিলে এমন ছেলে হয় না।এক মুখে কত কথা বলো?"


তমা মেয়েকে স্কুল থেকে নিয়ে আসে দুপুর দুইটার দিকে। মেয়েকে খাইয়ে, ঘুম পাড়ায়।সন্ধ্যায় মেয়ের হোমওয়ার্ক করাতেই বেশ সময় চলে যায়।মেয়েটা ঘুমিয়ে গেলে আবার বারান্দায় গিয়ে বসে থাকে।


মাঝে মাঝে আসিফ ফোন দেয়।আমারিকায় থাকা কত কষ্টের তার বর্ননা শুনতে শুনতেই হাই ওঠে তমালিকার।


এই লোক কবিতা বোঝে না।চাঁদ দেখে না।এই লোক এটাও বুঝে না যে প্রতিটা মানুষের ভেতর একটা আলাদা সত্ত্বা থাকে।একটা মন নামের বৃক্ষ থাকে।সেই বৃক্ষে একটু পানি দিতে হয়,আগাছা পরিষ্কার করতে হয়। না হলে, অযত্নে শুকিয়ে কখন মরে যায় কেউ বুঝে না। 


তমালিকার ভেতরটা কি মরে যাচ্ছে গ্রীষ্মের দাবদাহে? তমালিকা কি শুধু খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার জন্যই পৃথিবীতে এসেছিলো? তমালিকার কি কাউকে ভালো লাগতে নেই? উচ্চ কণ্ঠে কবিতা আবৃত্তি করে এমন কেউ,প্রান খুলে হাসতে পারে এমন কেউ, খুব বৃষ্টির দিনে বৃষ্টিবিলাসে কেউ তমালিকার সঙ্গী হবে এমন কেউ?


তমালিকা হাসে আপন মনেই। 


তার এই চাওয়া গুলোরসঙ্গী  মানুষটার অবয়ব কখনও কখনও মিলে যায় কায়সার ভাইয়ের সাথে।কিংবা কে জানে কায়সার ভাইয়ের ছায়াই হয়তো তমালিকা সবার মাঝে খোঁজে।


কায়সার ভাই তমালিকাদের পাশের বাসায় থাকতেন।তখন তমালিকা এসএসসি দেবে।কায়সার ভাই মাঝে মাঝে তমালিকাকে অংক বুঝিয়ে দিতেন।কায়সার ভাই কবিতা লিখতেন,ঝাকড়া চুল ছিলো তার।মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ি।লম্বা, সুদর্শন একজন মানুষ।


কখনও কখনও পড়ার মাঝে হঠাৎ বলতেন,"কবিতা শুনবি? গতকাল রাতে লিখেছি।দাড়া পড়ে শুনাই।"


কায়সার ভাই দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে গম্ভীর গলায় কবিতা আবৃত্তি করতেন।


তমালিকা তাকিয়ে থাকতো মুগ্ধ চোখে।কায়সার ভাইয়ের কবিতার নায়িকাদের কেমন দুঃখি মনে হতো তমালিকার।


রাতের পর রাত জেগে কায়সার ভাইয়ের কবিতার অর্থ বোঝার চেষ্টা করতো তমালিকা।তার শুধু মনে হতো কায়সার ভাই তাকে নিয়েই কবিতা লিখেছে।কায়সার ভাইয়ের প্রতি এক প্রচন্ড ভালো লাগা কাজ করতো।


বালিকা মনে প্রথম কাউকে ভালো লাগলে যে, এক আশ্চর্য ভালো লাগার জগৎ তৈরি হয়, সেই জগতে বেশ ছিলো তমালিকা। এভাবেই চলছিলো।


হঠাৎ একদিন কায়সার ভাই সপরিবারে ঢাকায় চলে গেলেন।কায়সার ভাইয়ের নাকি চাকরি হয়েছে।তাই তারা ঢাকায় থাকবে।


যাবার আগে তমালিকাকে কায়সার ভাই বলেছিলেন,


 "ভালো একটা রেজাল্ট করে ঢাকায় চলে আসবি।তত দিনে দেখবি আমার কবিতার বই বের হয়ে গেছে।বুঝলি,এখানে থাকলে লেখালেখির কোন গতি হবে না।এজন্য চাকরিটা নিয়ে নিলাম।চাকরিও হবে বইও বের করতে পারবো।কি বলিস?"


তমালিকা কিছু বলতে পারেনি। সে শুধু মনে মনে বলেছিলো, "যেও না তুমি।ঢাকায় তুমি কাকে কবিতা শোনাবে?"


সেদিন তমালিকার মনের আকুতি কায়সার ভাইয়ের মন  পর্যন্ত পৌছায় নাই বলেই হয়তো কায়সার ভাই চলে যেতে পেরেছিল। 


তারপর অনেকগুলো বছর চলে গেছে।

কায়সার ভাইয়ের পরিবারের সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায় এক সময়।


এরপর কত ঘটনা,দুর্ঘটনা গেলো তমালিকার জীবনে।

তমালিকা জানে কায়সার ভাই কবি হিসেবে বেশ নাম করেছেন।


বইমেলায় তার কবিতার বইয়ের জন্য লম্বা লাইনে দাঁড়ায় ভক্তরা।পত্রিকায়,টিভিতে প্রায়ই তাকে সাক্ষাতকার দিতে দেখা যায়।


একদিন টিভির এক চ্যানেলে তেমনই সাক্ষাতকার দিচ্ছিলেন কবি কায়সার মাহমুদ।

তমালিকা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছিলো তার কবি কায়সার ভাইকে।একটু যেনো রোগা হয়েছে।চোখের চশমার ফাঁকে সেই দৃষ্টি। প্রানখোলা হাসি।


উপস্থাপক যখন জানতে চাইলেন," কেনো বিয়ে করছেন না?"


কায়সার ভাই তার পরিচিত হাসি দিয়ে বললেন," এক কিশোরীকে খুব ভালোবাসতাম।আসলে সে ছিলো আমার কবিতার প্রতিটি লাইনে। তাকে খুঁজে পেলেই হয়তো বিয়ে করবো।"


উপস্থাপক অবাক হয়ে বললেন,"কোথায় তিনি এখন?"


কায়সার ভাই বিষন্ন হাসি দিয়ে বললেন,"আছে হয়তো কোথাও।হয়তো কারও ঘরনি কিংবা প্রেয়সী হয়ে। "


 তমালিকা জানে না কায়সার ভাই কাকে বোঝালেন তার কবিতার প্রেমিকা বলে?মাঝে মাঝে গভীর রাতে ঘুম ভেঙে যায়। অস্থীর লাগে।মনে হয় কায়সার ভাইয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে একবার।


বলবে,"দেখেন তো কায়সার ভাই, আপনার সেই কিশোরী কি না।"


আমরা যা ভাবি বা ভাবতে পারি তা সত্যি করাটা কোন কোন সময় শুধু কঠিনও তম কাজ নয়, অসম্ভবও বটে।


 তমালিকা যদি সমাজ, সংসার কে অগ্রাহ্য করে ছুটে যায় মুক্তির এক জগতে। বুক ভরে নিশ্বাস নিতে চায়,বাঁচার মত বাঁচতে চায় খুব কি অন্যায় হয়ে যাবে? খুব?


একটা অতৃপ্ত জীবন নিয়ে,মনের মাঝে কিশোরীকে বন্দি রেখে সারা জীবন নিজের সাথে, চারপাশের মানুষের সাথে শুধুই অভিনয় করে যেতে হবে?


মাঝে মাঝে গন্তব্যহীন পথে হেটে চলে তমালিকা।এ রাস্তা থেকে সে রাস্তায়।জীবনের এ বাঁক থেকে সে বাঁকে।মনের সাথে যুদ্ধ করে চলে সে। 


উদ্দেশ্যহীন ভাবে চলতে গিয়ে হঠাৎ কোন একদিন হয়তো নিজের চাওয়াটাকে নিজের মত করে পাবার সাহস করে উঠতে পারবে।কোন একদিন কায়সার ভাইয়ের দরজায় কড়া নাড়বে কিংবা কে জানে এভাবেই হয়তো কিছুই না পাওয়া জীবনে, প্রাপ্তির অভিনয় করেই কেটে যাবে।

                       সমাপ্ত

ছোটগল্প: প্রজাপতি মনের চাওয়া

লেখা: সেলিনা রহমান শেলী


মন ছুঁয়ে যাওয়া গল্প পড়ুন।