নীল ক্যাফের ভালোবাসা | সেরা ভালোবাসার গল্প

ভালোবাসার কষ্টের স্ট্যাটাস

ভালোবাসার কষ্টের স্ট্যাটাস

 রাত পোহালেই আমার বউয়ের বিয়ে। দ্বিতীয় বিয়ে। যাকে আমি নিজের হাতে সাইন করে তালাক দিয়েছিলাম! এখন তারই বিয়ের আলো ঝলমলা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি।


কি অবাক হচ্ছেন তাই না? কেনই বা তাকে তালাক দিলাম, আর এখন কেনইবা এই পাগলামি! নাকি অন্যকিছু? 


.


ঘটনা আট বছর আগে শুরু হয়।

আমি তখন সদ্য এইচ.এস.সি পাশ করে একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি তে ভর্তি হয়েছি। চোখে রঙিন স্বপ্ন। যা দেখি তাই ভাল লাগে। যা ইচ্ছে হয় ঠিক তাই করতে মন চায় এমন একটা সময় পার করছি।


নীরার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল ভার্সিটির এডমিশন কোচিং করার সময়। সে দেখতে লম্বা, ফর্সা, সুন্দরী, চুল গুলো সব সময় দুপাশে বেণী করে রাখত। অনেকেই তাঁর রুপের প্রশংসা করে বলতো, ‘তোমাকে না কারিনা কপুরের মত লাগে।’


একদিন কোচিংয়ের ক্লাসে ঢুকতেই কে যেন মজা করে চেঁচিয়ে বলে উঠলো, ‘এই যে দেখ কারিনা কাপুরের সাইফ আসছে।’


হঠাৎ সারা ক্লাস হাসিতে ফেটে পড়ল। আমি বোকার মত কিছু না বুঝে দাঁড়িয়ে আছি। একজন কথার মানেটা বুঝিয়ে দিতেই আমি নীরার দিকে তাকালাম। দেখি সে ও আমার দিকে ঢ্যাবঢ্যাব করে তাকিয়ে আছে। তখন এক বন্ধু আমায় খোঁচা দিয়ে বললো, ‘এই সাইফ, মেয়েটা কিন্তু দেখতে হেব্বি। তোর সাথে মানাবে।’


তার কিছুদিনের মধ্যেই নীরার সাথে আমার প্রেম হয়ে যায়। আস্তে আস্তে বুঝতে পারি নীরা কিছুটা পাগলাটে জেদি ও একরোখা টাইপ মেয়ে, যা বলে তাই করে ছাড়ে। এডমিশন কোচিংয়ের পুরোটা সময় চুটিয়ে প্রেম করায় দু'জনের কারো পাব্লিক ভার্সিটি তে চান্স হয়নি।


একদিন নীরা হুট করে বলে, 

-- 'চলো আমরা পালিয়ে বিয়ে করি।'


-- 'মানে?'


-- 'মানে কিছুই না। বাবার বন্ধুর ছেলে কানাডা থেকে এসেছে, এখন তাকে নাকি আমার বিয়ে করতে হবে।'


আমি কাঁধ ঝাকিয়ে হতাশার স্বরে বললাম,

-- 'না। তোমার বাবা'র কথাই তোমার শোনা উচিত।'


কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই নীরা আমার গালে থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। বলে,

- 'আগামীকাল এখানে, ঠিক এই সময়ে, তুই আসবি। তুই যদি না আসিস তবু আমি বাসায় ফেরত যাবো না। দু'চোখ যেদিকে যায় সেদিকে যাব।'


পরেরদিন আমি নীরাকে কাজী অফিসে বিয়ে করি। আমার বয়স তখন কতইবা হবে? আঠারো উনিশ। নীরার বয়স সার্টিফিকেটে আঠারো হলেও, কাবিননামায় আমার বয়সটা বাড়িয়ে একুশ দিতে হয়েছিলো।


.


নীরার বাবা ছিল পুলিশ অফিসার। একজন পুলিশ অফিসারের মেয়েকে পালিয়ে নিয়ে বিয়ে করাটা অবশ্যই ভয়ংকর একটা ঝুঁকি ছিল। কিন্তু ভালবাসা, আবেগ, ও রক্তের গরমে সেই চ্যালেঞ্জ টা আমার নিতে হয়েছিল!


অনেক দূরে কোন এক বন্ধুর আত্মীয়র বাসায় আমাদের বাসরঘর হয়। নীরার লম্বা ছিপছিপে দেহের উত্তাপ  সারারাত আমার শরীর দংশন করেছিল। সে ক্ষুধার্ত হিংস্র বাঘিনীর আমাকে আঁকড়ে ধরেছিল। দুটি দেহের মিলনে একসময় অনুভব করছিলাম, স্বর্গীয় সুখ বোধয় একেই বলে!


ক্ষণস্থায়ী স্বর্গীয় সুখের মতই নীরা এসেছিল আমার জীবনে। আমারা চব্বিশ ঘন্টার ও কম সময় একসাথে থাকার সুযোগ পেয়েছিলাম। নীরার বাবা আমাদের দুজন কেই ধরে নিয়ে যায়। নীরা তাঁর বাবার সাথে বাসায় ঢুকে আর আমি হাজতে।


হাজতের মধ্যে আমার শ্বশুর সায়েম চৌধুরি প্রথম প্রশ্নটা করেই আমাকে বিব্রতর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিলেন।

তিনি বললেন,


-- 'তুই কি আমার মেয়ের সাথে শুয়েছিস?'


আমি শ্বশুরের দিকে হা করে তাকিয়ে রইলাম, মনে মনে বললাম, ‘এ আবার কেমন প্রশ্ন?’


তিনি রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে আবার বললেন, 

-- 'শুয়েছিস?'


আমি চুপ। জবাব দিলাম না।


পাশ থেকে এসে একজন পুলিশ শাটের কালার ধরে কষে দুটো থাপ্পড় দিয়ে বললো,

- 'স্যারের কথার জবার দিচ্ছিস না কেন হারামজাদা?'


আমি বরাবরের মতই মাথা নিচু করে নীরব রইলাম।


এবার সায়েম চৌধুরী হাতে কি যেন ইশারা দিলেন। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার শরীরে এলোপাথাড়ি লাঠির বারি আর অমানুষিক নির্যাতন শুরু হল।


সায়েম চৌধুরী কাকে যেন ফোন দিয়ে বলছেন,

- 'এই হারামজাদাটা ও কথার জবাব দিচ্ছে না। তুমি যেভাবে হোক নীরাকে পিল খাইয়ে দাও।'


তার দুইদিন পর সায়েম চৌধুরি একটা কাগজে সই করতে বললেন। ফোলা ফোলা রক্তিম চোখ নিয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে বুঝলাম তালাকনামার কাগজ।


তিনি হেসে বললেন, 

-- 'যদিও তুই সহজে ছাড়া পাচ্ছিস না, তোর পরবর্তীতে কোন ঝামেলা করার সুযোগ ও রাখছি না। তাই বলছি ভালই ভালই সাইনটা করে দে।'


আমি চোখ মুখ শক্ত করে বললাম, 

-- 'না।'


-- 'বাড়িতে তোর বিধবা মা, বড় একটা ভাই আছে। এখন সেই ভাইটা কে যদি জেলে ভরে দেই তোর মা কি করে বাঁচবে বলতো?'

 

কথাটা শেষ করে সায়েম চৌধুরি তীক্ষ্ণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি থতমত খেয়ে গেলাম। কুঁকড়ে গেলাম ভিতরে ভিতরে। গলাটা হঠাৎ করে শুকিয়ে গেল!


সায়েম চৌধুরি হিমশীতল কন্ঠে বললেন,

-- 'সাইন কি করবি?'


তাঁর চোখের দৃষ্টিতে ও বলার ধরনে এমন কিছু ছিল হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, কলম টা নিয়ে শক্ত করে ধরে বসে আছি।


.


মা অসুস্থ শরীরে দেখতে আসলেন। কিছুক্ষণ পর বড় ভাই একজন লোক কে সাথে নিয়ে আসলো, বুঝলাম লোকটা আমার উকিল।


আমার দিকে তাকিয়ে উকিল বললেন,

-- 'আপনার নামে নারী অপহরণ মামলা দেয়া হয়েছে। বড় কঠিন মামলা।'


উকিলের কথা শুনে মা ঢুকড়ে কেঁদে উঠলেন। আমি অসহায়ের মত মা'র দিকে তাকিয়ে আছি। 


উকিল সান্তনা দিয়ে বললেন,

-- 'হতাশ হবেন না। আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।'


.


আদালতে দাঁড়িয়ে নীরা আমার বিপক্ষে সাক্ষী দেয়। আমি একদম অবাক না হয়ে নীরার দিকে তাকিয়ে আছি। তাঁর ঠোঁট ফোলা, গালে কেমন যেন কালচে দাঁগ। বুঝলাম অমানুষিক নির্যাতন তাঁর উপরেও হয়েছে। সমস্ত অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ওই মামলার সর্বোচ্চ শাস্তি চৌদ্দ বছরের কারাদন্ড হয় আমার।


জেলখানায় প্রথম প্রথম খুব অসুবিধা হত। মশার কামড়ে গা গুটি গুটি ফুলে উঠত। আস্তে আস্তে মশার কামড়ালেও টের পেতাম না। স্যাতসেতে পরিবেশে পঁচা দুর্গন্ধ একটা কক্ষে আমরা ২০/২৫জন থাকতাম। একদিন টুটুল ভাইয়ের সাথে পরিচয় হয়।


প্রথম দর্শনেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন,

-- 'তুই তো থাকবি মায়ের আচঁল তলে এখানে কি করিস খোকা?'


ঘটনা শুনে তিনি খুব মর্মাহত হলেন। কিছু না বলে উঠে যান। পরে শুনেছি তিনি তাঁর বউকে খুনের দায়ের ফাঁসির আসামি ছিলেন। এখন বিশেষ ক্ষমায় আমৃত্যু জেল খাটছেন।


জেলখানায় প্রতি সপ্তাহে একটি করে মুভি দেখানো হতো।সবাই মিলে আনন্দ হইচয়ে একটা মুভি দেখছি, নাম ‘থ্রি ইডিয়ট।’ সিনেমার বেশ কিছুক্ষণ পর নায়িকার আবির্ভার ঘটে। আমি উঠে দাঁড়িয়ে চলে যেতে থাকলাম। টুটুল ভাই ডাক দিয়ে বললেন,


-- 'এই সাইফ, কই যাস সিনেমা দেখবি না?'

-- 'না ভাই কারিনার মুভি দেখতে ভাল লাগে না।'

বলেই চলে আসলাম।


.


জেলখানায় থাকার পাঁচ বছরের মাথায় মা মারা যান। পুলিশের কড়া পাহাড়ায়, পায়ে শিকল বাধা অবস্থায় মায়ের জানাজায় অংশ নেই। কবরে নামানোর সময় মায়ের মুখটা শেষ বারের মত দেখি। আমি সেসময় একটুও কাঁদিনি, চোখে এক ফোঁটাও পানি ছিল না।


কিন্তু সেদিন রাতে জেলখানায় পাগলের মত চিৎকার করে কাঁদি। টুটুল ভাই পরম মমতায় আমার মাথায় হাত বুলায়।


.


আট বছরের মাথায় বিশেষ জামিনে আমি ছাড়া পেয়ে যাই। চলে আসার সময় টুটুল ভাই ফ্যাকাসে কন্ঠে বললেন, 


-- 'এখনো সময় আছে মাথা ঠান্ডা করে ভাবিস। সবচেয়ে ভাল হবে অতীত ভুলে যা নতুন করে জীবন শুরু কর।'


---

-------

দুই মাস আগে জেল থেকে বের হয়েছি। চারপাশ টা কেমন যেন বদলে গেছে, কিছুই যেন ভাল লাগে না। যতক্ষণ বাড়িতে থাকি মা'র জন্য মন খারাপ থাকে। বারবার মনে হয় জেলখায় সঙ্গী সাথীদের সাথেই ভাল ছিলাম। পরক্ষণেই মুচকি হেসে নিজেকে সান্তনা দেই, আজ হোক কাল হোক আবার তো ঢুকতেই হবে...


অনেক কষ্টে নীরার নতুন বাসার ঠিকানা খুঁজে বের করি।এসেই দেখি বিশাল বাড়িটি লাল-নীল বাতিতে জ্বলছে নিভছে। বাড়ির গেইট খোলা, লোকজন অনায়াসেই আসা যাওয়া করছে। রাস্তার ওপাশ থেকে উঁকি দিয়ে দেখি একটা লেখা ঝলমল করছে।


–  " আজ নীরার গায়ে হলুদ। "


বুঝলাম,


রাত পোহালেই আমার বউয়ের বিয়ে। দ্বিতীয় বিয়ে!


.


আলো ঝলমলা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে মনে মনে নিয়তির লেখক কে ধন্যবাদ দিলাম। কাজটা সহজ করে দেয়ার জন্য। কোমরে হাত দিয়ে দেখলাম, জিনিসটা ঠিকঠাক মতই আছে কিনা। এবার টুটুল ভাইকে ধন্যবাদ দিলাম, তাঁর জন্যই জিনিশটা সহজে পাওয়া গেছে!


খুব সহজেই গেইট দিয়ে ঢুকে গেলাম। বাসার সামনে খোলা জায়গাটা তে মানুষজনে ভরপুর। আমার চোখ এদিক ওদিক ঘুরছে। হঠাৎ একদিকে দৃষ্টি আটকে যায়। আমি সেদিকে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছি। টুটুল ভাই বলেছিলেন, ‘সামনাসামনি থাকলে টার্গেট মিস হওয়ার সম্ভাবন কম!’


সামনে এসে দাঁড়াতেই সায়েম চৌধুরি চাপা স্বরে বললেন, 


-- 'তুই এখানে এলি কিভাবে?'


আমি জবাব দিলাম না। ওর দিকে তাকিয়ে দূরত্ব মাপছি। 

এবার গলার স্বর নরম করে বললেন,


-- 'দেখ মেয়ের বিয়েতে ঝামেলা হোক তা আমি চাই না। তুই যা চাস তা এখনি পাবি টাকাপয়সা, এখন বল কি লাগবে তোর?'


বুঝলাম আমাকে ফাঁসানোর জন্য একটা ফাঁদ পেতেছে, তাই কলিজায় আঘাত করার জন্য নির্লিপ্ত কন্ঠে জবাব দিলাম, – 'নীরাকে চাই।'


আশেপাশে একটা গুঞ্জন শুরু হয়ে গেছে। হঠাৎ দেখি নীরা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে আছে। এতক্ষণ আমার পিছনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনছিল। 


সায়েম চৌধুরি থতমত খেয়ে মেয়েকে বললেন,

-- 'নীরা মা তুই এদিকে আয়।'


তখনি নীরা আমার হাত ধরে। আমি আচমকা চমকে উঠলাম। কি হচ্ছে, কি ঘটছে কিছুই যেন মাথায় ঢুকছে না!

নীরা তাঁর বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,


-- 'নাটক করে দুটো জীবন নষ্ট করে দিয়েছ তুমি। এই বিয়েটাও তোমরা আমায় জোর করে দিচ্ছ।'


-- 'সব তো তোর ভালোর জন্যই করছি!'


-- 'না বাবা। তুমি আমার ভালো বুঝলে জঘন্য কাজটা করে এভাবে দুটি জীবন নষ্ট করতে না। এবার যদি কিছু করার চেষ্টা করো, মনে রেখো, আমি আর আগের মত বোকা মেয়ে না।'


এই বলে নীরা আমাকে টানতে টানতে গেইটের দিকে নিয়ে যেতে থাকলো। আমি পিছন দিকে তাকিয়ে দেখি, সায়েম চৌধুরি বরফের মত জমে গেছেন! হয়তো ঘটনার আকস্মিকতা কাটিয়ে উঠতে পারেননি।


.


সি.এন.জি দ্রুত বেগে ছুটে চলছে। নীরা সেই কখন থেকে আমায় জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। ভাবছি কি করতে এলাম, আর কি ঘটে গেল? নীরার হাত আমার কোমরে যেতেই বলে, ‘ওটা কি?’ আমি পিস্তল টা বের করে অন্ধকারে ঝোপের মাঝে ফেলে দিলাম।


নীরার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, পড়নে গায়ে হলুদের শাড়ি। বাতাসে চুল গুলো তাঁর মায়াবী মুখের উপর পড়ছিল। সে একটু পর পর চুল গুলো কানের পিছনে গুঁজে দিচ্ছে। রাস্তার ঝাপসা ঝাপসা আলোয় তাঁকে দেখতে অস্পরীর মত লাগছিল। 


তখনি আমার গালে খোঁচা দিয়ে বললো,

-- 'চলে যে এলাম, এখন কোথায় রাখবে শুনি?'


কপালে একটা চুমু দিয়ে জবাব দিলাম, ‘বুকের ভিতর।’


(সমাপ্ত)...


-ছোটগল্প || -ভালবাসার_পূর্ণতা 

-লেখা || -মাসুকুর_রহমান_মিয়াদ

----


মন ছুঁয়ে যাওয়া অসাধারন গল্প পড়ুন।