অবহেলার কষ্টের গল্প | গরিব বলে অবহেলা ২০২৪

 গর্ভাবস্থায় স্বামীর অবহেলা

গর্ভাবস্থায় স্বামীর অবহেলা

ছেমড়ি! তোরে কইছিলাম পেটে বাচ্চা বাঁধাইস না। তার পরেও তুই ঐ কাজটাই করলি। তোরে না কইছিলাম নিয়ম কইরা ঔষধ খাবি।


আফনে হুদাই গালাগালি করতাছেন। আল্লাহ যদি চায় তাইলে আমার কি করার আছে কন?


তোর তো কিছু করার নাই। খালি একের পর এক মাইয়া ছাওয়াল পয়দা করা ছাড়া। আর আমি হারাদিন গরুর মত খাটতাছি। বংশের বাত্তি কেমনে জ্বলবো হেইডাও জানি না। আমি মরলে আমার বংশ তো নির্বংশ হইয়া যাইবো।


আফসোস করতে করতে ঘাটের দিকে এগিয়ে যায় ছমির। বকুলডাঙা গায়ের অশিক্ষিত মাঝি। ঘাটে একটা নৌকা বাঁধা আছে। সেটাই ছমিরের। প্রতিজনে দশ টাকা বাবদ লোক পারাপার করায়। টেনেটুনে সংসার চলে। সংসারে তিন মেয়ে আর স্ত্রী। ছমিরের বড়ো আশা ছিলো তিন নম্বর সন্তানটা ছেলে হবে। কিন্তু ওটাও যখন মেয়ে হয়ে জন্ম নিলো তখন নিজের কপালে নিজে চাপড় মেরে নিজ নিয়তিকে মেনে নিয়েছিলো ছমির।


বড়ো মেয়েটা এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। ঘাটের পথে পারাপারের সময় লোকে নানান কথা বলে, "মাঝির মাইয়ার আবার পড়াশোনা কি? মাইয়া ডাঙ্গর হইলে জলদি বিয়া দিতে হয়।"


ছমির দাঁতে দাঁত চেপে অপমান সহ্য করে। তার মনে জেদ চাপে। সমাজের উপর থুঁ থুঁ ছিটায়। মাঝির মাইয়া কি করতে পারে সেইটা ছমির দেখায়ে ছাড়বে। তার নাম ছমির। আহ্লাদ কইরা বাপে নাম রাখছে। এই নাম মাটিতে মিশতে দেবে না।


ফেরার পথে বিল থেকে দুটো শাপলা ছিড়ে নেয় ছমির। সে জানে তার স্ত্রী আছিয়া না খেয়ে অপেক্ষা করছে। পোয়াতি বউটারে কষ্ট দেয়া তার মনে সইছে না। দুটো পয়সা কম কামাই হইলেও দ্রুত বাড়ির উদ্দেশ্যে হাটা দেয়। বউটা তারে খুব ভালোবাসে। তবুও মাঝে মাঝে ছমির নিয়তিকে মেনে নিতে পারেনা বলে রাগের বশে বউকে গালাগালি করে। কুপি জ্বালিয়ে দাওয়ায় বসে অপেক্ষা করছে আছিয়া। ছমির এগিয়ে যায়। শাপলা দুটো বউয়ের দিকে এগিয়ে ধরে। বলে, তোর জন্যে আনছি। বিলের ধারে হাজার হাজার ফুটছে। পারলে সবডি তোর জন্যে আনতাম। আছিয়া হাত বাড়িয়ে স্বামীর হাত থেকে ফুলদুটো নেয়। তার দুচোখ অশ্রুপূর্ণ। বদরাগী হইলেও মানুষটা তারে ভালোবাসে। সে কখনো ধনসম্পদ চায় নাই। চাইছে একটু ভালোবাসা। সে ছিলো ভালোবাসার কাঙালি।


ছমির বললো, খাওন দে। জেদ কইরা কিছু খাই নাই হারাদিন।


আছিয়া ভাত বেড়ে দেয়। খাওয়া শেষে শীতলপাটি পেতে দুজনে শোয়। নিভিয়ে দেয় কুপি। চারপাশে ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে। মাঝে মাঝে ঢুকরে কেঁদে উঠছে কয়েকটি কুকুর। আছিয়ার ফুলে উঠা পেটের উপর হাত রেখে ডলতে থাকে ছমির। সুড়সুড়ি লাগলেও কিছু বলে না সে। ছমির বলে, আল্লায় মাইয়া দিলে সত্যই আমাগো কিছু করনের নাই। শুকরিয়া আদায় করন লাগবো। সকালে রাগের মাথায় গালি দিয়া দিছি। উচিৎ হয় নাই। আছিয়া বলে, মাঝে মাঝে যে আফনের কি অয় আল্লায় ভালা জানেন। তারপর দুজনেই চুপ হয়ে যায়।


মানুষ আজন্ম ভালোবাসার কাঙাল। ভালোবাসা পেতে নিজেকে বিলিয়ে দেয়। ভালোবেসে শুদ্ধ করে আত্মা। দুটি মানুষ পাশাপাশি টিনের তৈরি ছাদের দিকে পলকহীনভাবে তাকিয়ে আছে। তাদের ছোট্ট ঘরটি বিত্ত-বৈভবে ঠাসা নয় ঠিকই কিন্তু বুকের ভেতর জমে আছে এক আকাশ পরিমাণ ভালোবাসা। বুকের ভেতর ভালোবাসা থাকলে যেকোনো পরিস্থিতিতে একসাথে টিকে থাকা যায়।


কিছুক্ষণ পর আছিয়া আলগোছে বলে, মাইয়াডা তো যতেষ্ট বড় হইছে। ডাঙ্গর হইছে। হের বিয়া-শাদীর কথা কিছু ভাবছেন? লোকে তো নানান কথা কয়? 


কি কয় লোকে?


কয়, মাঝির মাইয়া বয়স হইলে পরে কেডা বিয়া করবো? তার উপর নীচু জাত।


দাঁতে দাঁত চাপে ছমির। আছিয়ার পেটের উপর থেকে হাত সরিয়ে নেয়। বলে, মানুষ তোরে খাওন-পরন দেয় না। মানুষের কাজ হইতেছে বাজে কথা কওয়া। ভালা মানুষ কারো পিছে লাগে না। ভালা মানুষের হেই সময় থাকে না। হেইসব লোকের ফালতু কথার ধার এই ছমির ধারে না। আমার অলকানন্দারে আমি ব্যারেষ্টার বানামু। মাঝির মাইয়া হইবো ব্যারেষ্টার। অতনু মহাজনের থিকা আমাগো বান্ধা সব সম্পদ একদিন সে  উদ্ধার করবে।


ভাঙা খাটটার উপর শুয়ে ছিলো অলকানন্দা। নিঃশব্দে শুনছিলো বাবা-মায়ের কথা। অষ্টম শ্রেণীতে বেশ ভালো রেজাল্ট করেছিলো। বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা এবারও খুব আশাবাদী। মাধ্যমিকে অনায়াসে ভালো ফলাফল করবে সে। বাপের কথা শুনে বুকের ভেতর অসীম স্পৃহা জন্মে। বাপের জন্য গর্বে তার বুকটা ফুলে উঠে।


একদিন বিকেলবেলা নৌকায় উঠে আয়েশ করে বসে অতনু মহাজন। রাগে ছমিরের গা ছম ছম করে উঠে। নৌকার পাঠাতনে দাড়িয়ে অতনুর মাথার উপর ছাতা মেলে ধরে কালু। কাগজের মোড়ক থেকে এক খিলি পান বের করে অতনুর হাতে দেয় সে। তখনো অন্য যাত্রীরা নৌকায় উঠে নাই। 


অতনু বলে, নৌকা টান দে ছমির। কুড়ি জনের ভাড়া আমি একাই দিমু তোরে। ইজারার পয়সা থিকা কাইটা রাখিস। 


ঢেউয়ের তালে দুলতে দুলতে নৌকা মাঝে নদীতে আসে যখন ছমিরকে উদ্দেশ্য করে অতনু বলে, তোর মাইয়াডাতো যতেষ্ট ডাঙ্গর হইছে রে ছমির। বিয়া-শাদি দিবি না নাকি?


ছমির অন্যদিকে ফিরে বলে, দিমু সময় অইলে।


একখান ভালা প্রস্তাব ছিলো। হুনবি নি আমার কথা? 


ছমির চুপ করে থাকে। জবাব দেবার প্রয়োজনবোধ করে না।


কালু, আমার পোলার মত। আমার ঘরে থাকে,খায়। তোর মাইয়ারে হের খুব পছন্দ হইছে। বিয়া করবার চায়। বিয়া করলে আমি তারে ঘর বাইন্ধা দিমু। বউ লইয়া হেই ঘরে সুখে শান্তিতে থাকবো। তুই কি রাজি ছমির?


ছমির রাগে চিল্লিয়ে উঠে। কোনো হারামখোরের পোলা চামচার লগে আমার মাইয়া বিয়া দিমু ভাবলি কোন সাহসে? আমার নৌকা থিকা নাইমা সোজা হাটা দিবি। তোগোর লগে আমার কোনো কথা নাই। কালু পাঠাতন পেরিয়ে ছমিরের দিকে এগিয়ে যায়। পেছন পেছন অতনু এসে কালুকে ধরে ফেলে। বলে সব জায়গায় রাগ দেখাতে নাই কালু। জানস না? "পিপীলিকার ডানা গজায় মরিবার তরে।"


অতনুর পরিকল্পনা ছিলো আরো ভয়ঙ্কর। কালু যদি ছমিরের মেয়েকে বিয়ে করে তবে তালাক নিয়ে নিজেই তৃতীয়বার বিয়ে করবে। মেয়েটা স্কুলে যাবার পথে আড়তে বসে অতুন মহাজন চোখ দিয়ে গিলে খায় তার সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। হিংস্র কুকুরের মত গড়িয়ে পড়ে লালা।


ছমির খুব ভালো করেই জানে, ঘূর্ণিঝড় আসার পূর্বে পরিবেশ বেশ শান্ত থাকে। অতনু মহাজনকে দেখে ছমিরের অন্তত তাই মনে হলো।


বাসায় ফেরে আছিয়াকে ঘটনা খুলে বলে ছমির। ভীত সন্ত্রস্থ আছিয়া স্বামীর প্রাণের ভয়ে আকুপাকু করতে থাকে। স্বামীকে বলে, চলেন আমরা বাড়ি ছাইড়া পালায়ে যাই। ওরা যদি আপনের কোনো ক্ষতি কইরা ফালায়?


ছমির গর্জে উঠে, পালামু কেন? আমি চক্ষে চোখ রাইখা কথা কইতে পারি।


যেদিন হাটবার থাকে সেইদিন নদী পারাপারের ভীষণ ব্যস্ততা। ছমিরের দু'পয়সা ভালোই রোজগার হয়। হাটবারে তাই বাড়ি ফিরতেও রাত হয়। মেয়েটার রেজিস্ট্রেশনের টাকা জোগাড় করতে হবে তাই একটু গভীর রাত পর্যন্ত নৌকায় থাকে ছমির। গভীর রাতে নৌকায় উঠে চারজন মানুষ। ওপাড়ে গিয়ে নৌকা রেখে ছমিরও বাসায় ফিরবে। নৌকা এগিয়ে নেয় সে। মাঝপথে একটা কন্ঠস্বর ফিসফিস করে কি যেনো বলে উঠে। ওরা ছমিরের খুব কাছাকাছি ছিলো। খপ করে ধরে ফেললো ছমিরের হাত। মুখ থেকে কালো কাপড়টা হ্যাঁচকা টান দিতেই উন্মুক্ত হয়ে পড়ে কালুর মুখ। এরা চারজন শক্তিবান-সামর্থবান পুরুষ সহজেই ছমিরকে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে ফেললো। গলায় বেশ বড় একটা কলসি ঝুলিয়ে ফেলে দিলো নদীতে। তার পূর্বে কলসির মুখ বেশ কয়েকটা ইট দিয়ে ভর্তি করলো। ভারী কলসি ছমির মাঝিকে নিয়ে মাঝ নদীতে তলিয়ে গেলো।


পাড় থেকে সবুজ সংকেতটা গ্রহণ করলো অতনু। ধীরে ধীরে ফিরে গেলো বাড়িতে। মুখে বিজয়ীর হাসি। 


দিন যায়, মাস যায় ছমির ফেরে না। কাঁদতে কাঁদতে শুকিয়ে আসে আছিয়ার দুটো চোখ। ঘটনা কি ঘটেছে তা খুব ভালো করেই আঁচ করতে পারে। ইদানীং অতনুর লোকজন বাসার চারিধারে ঘোরাফেরা করে। একদিন পড়ন্ত বিকেলে চারমাসের পোয়াতি আছিয়া স্বামীর ঘরখানা ছেড়ে দিয়ে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি দেয়। কেউ জানেনা আছিয়া আর তার তিনটি মেয়ে কোথায় হারিয়ে গেলো।


বহুদিন পর গ্রামে এক নারীকে দেখা যায়। সবার সঙ্গে বেশ ভাব জমিয়ে ফেলে। সবাইকে সাহায্য সহযোগিতা করে। মামলা-মোকদ্দমা লড়ে দেয়। বহুদিন ঘুরতে ঘুরতে খুঁজে বের করে ছমিরের দুজন খুনীকে। দেয়ালেরও কান থাকে তাই বাকীদের খুঁজে বের করতে এবং প্রমাণ সংগ্রহে খুব একটা বেগ পেতে হয়না। অর্থের কাছে সবকিছু নস্যি। হাতে হাতকড়া আর কোমরে পড়িয়ে আটবছর পূর্বে ঘটা হত্যাকান্ডের দায়ে অতনু, কালু আর তার তিনজন সঙ্গীকে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। 


এলাকায় হই হই রই রই রব উঠলো। সবার মুখে মুখে শোনা যায়, ছমির মাঝির মেয়ে হয়েছে ব্যারেষ্টার। মাইয়া হইলে এমুন হোক। বাপের খুনের বদলা যে নিয়া ছাড়ছে। উদ্ধার করছে অবৈধ দখলে থাকা তাগো সম্পত্তি।


হাতে হাতকড়া আর কোমড়ে বেড়ি থাকা অতনুর চোখে চোখ রেখে মেয়েটা শুধু বললো, আমি অলকানন্দা ছমির মাঝির মাইয়া। তোর কত হেডম আমি দেইখা ছাড়মু রে অমাইনষের বাচ্চা।


গল্প: ফুলের নাম অলকানন্দা 

লেখক: সা" দ


মন ছুঁয়ে যাওয়া গল্প পড়ুন।