গল্পঃ চোখের__আলো | স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসা

 ভালোবাসার গল্প

ভালোবাসার গল্প

ডক্টরের চেম্বারের সামনে বসে আছি হঠাৎ মনে হলো ঘাড়ে কেউ হাত দিচ্ছে। পিছনে ফিরে দেখি একজন পুরুষ লোক! আর কোনো কথা নাই ঠাস্ করে এক চড় মেরে বসলাম!

-- " বদমাইশ, লুচ্চা কোথাকার মেয়ে মানুষ দেখলে মাথা ঠিক থাকেনা! এইসব মানুষ এখানে কিভাবে যে ঢুকে? "


এতোই রেগে গেলাম যে মুখে যা আসলো তাই বলে ফেললাম। লোকটি একবার কিছু বলতে চাচ্ছিলো কিন্তু এক ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলাম।এরপর লোকটি একটা টুঁ শব্দ পর্যন্ত করলো না।আশেপাশের লোকজন আমার অবস্থা দেখে এমন অবাক হলো যে তারাও আর কোনো কথা বলল না। শেষে আমিই ক্লান্ত হয়ে যাই আর শান্ত  হয়ে বসে থাকি। কিছুক্ষণ পর আমার সিরিয়াল আসে আর আমি ডাক্তারের চেম্বারের ভিতরে ঢুকে যাই।এরপর সেদিন আমি ডাক্তার দেখিয়ে বাসায় চলে আসি।


ঘটনার ১৫ দিন পর আজকে আবার আমি ডাক্তারের কাছে আসি।তিন তলায় উঠেই দেখি আজকেও সেদিনের লোকটা চেম্বারের সামনে বসে আছে। আমি লোকটাকে দেখতে পেয়ে একটু দূরে গিয়ে বসি। আর লোকটার উপর নজর রাখছি যে আজকে আবার পিছন থেকে কোনো মেয়ের শরীরে হাত দেয় কি না। আজকে যদি কারো শরীরে হাত দিতে দেখি তাহলে আজকে লোকটাকে ৯৯৯ এ কল দিয়ে পুলিশের কাছে সোপর্দ করবো।যেই ভাবা সেই কাজ আমি খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি।কিছুক্ষণ পর ডাক্তারের এ্যাসিস্ট্যান্ট – "তৌফিক সাহেব আছেন এবার আপনার সিরিয়াল" বলে ডাকলো।


আমি দেখলাম একজন ভদ্র মহিলা লোকটির হাত ধরে ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে গেল, লোকটির হাতে সাদা ছড়ি। আমি বুঝতে পারি লোকটি অন্ধ, চোখে কিছু দেখতে পায় না।আর এই অন্ধ লোকটাকে আমি সেদিন এত অপমান করলাম!এখন আমার নিজেকেই খুব ছোট মনে হচ্ছে।ইশ্ আমি না জেনেই সেদিন এই অন্ধ লোকটাকে চড় মেরেছি!কত বড় ভুল হয়ে গেছে।আমি বারবার অনুতপ্ত হতে লাগলাম।১০ মিনিট পর ভদ্রমহিলা লোকটিকে নিয়ে ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হতেই আমি তাড়াতাড়ি তাদের কাছে যাই। 


-- " এক্স কিউজ মি আন্টি। একটু কথা বলতে পারি? "

-- " হ্যা অবশ্যই বলো মা কি বলবে? "

-- " উনি কি আপনার ছেলে? "

-- " হ্যা, ও আমার একমাত্র সন্তান তৌফিক। "

-- " উনার চোখে কি হয়েছে? "


-- " সে অনেক কথা মা একটি দূর্ঘটনা আমার ছেলেটার চোখের আলো কেড়ে নেয়। ও এখন আর কিছুই দেখতে পায় না।কিন্তু তুমি কে মা?তোমাকে তো ঠিক চিনলাম না। "


-- " আমার নাম মিলি।আমিও ডাঃ আরিফুল ইসলাম স্যারের পেশেন্ট। "

-- " ও আচ্ছা। তা মা তোমার কি ডাক্তার দেখানো হয়ে গেছে? "

-- " না আন্টি আজকে আমার সিরিয়াল অনেক পরে। "

-- " তাহলে মা আমার একটু উপকার করবে? "

-- " জ্বি অবশ্যই বলুন আন্টি কি করতে হবে। "


এতক্ষণ লোকটি একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলো,এবার একটু এগিয়ে আসলো। 


-- " আম্মু কার সাথে কথা বলছো? "

-- " এইতো বাবা একটি মেয়ের সাথে। "

-- " ও আচ্ছা ঠিক আছে তুমি কথা শেষ করো আমি এখানেই বসছি। "

-- " আন্টি কি করতে হবে বলেন। " (আমি)


-- " হ্যা মা আমাকে এই ঔষধগুলো এনে দিতে পারবে?আমিই যেতাম কিন্তু ওকে একা রেখে যেতে পারছি না।সেদিন ওকে রেখে ৫ মিনিটের জন্য বাথরুমে গিয়েছিলাম।আমি ওর ছড়িটা সামনের চেয়ারে দাঁড় করিয়ে রেখে গিয়েছিলাম।এসে শুনি ওর ছড়িটা নাকি নিচে পড়ে যায় তারপর সেটা খুঁজতে গিয়ে সামনের চেয়ারে বসে থাকা কোনো একজন মেয়ের গায়ে হাত লেগে যায়।মেয়েটি সবার সামনে ওকে আজেবাজে নানারকম কথা তো বললোই এমনকি ওকে চড় মেরে বসে।তৌফিকের কথাটা পর্যন্ত মেয়েটা শুনলো না।সেদিন ও একটু প্রতিবাদও করেনি। কারণ না জেনে হলেও ও অন্যায়টা করেছে।সেদিন বাসায় গিয়ে নামাজ পড়ে নিজের অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য আল্লাহর কাছে অনেক কান্নাকাটি করে।জানো মা, আমার ছেলেটা অনেক মেধাবী ও ভদ্র-নম্র একটা ছেলে। ও মেকানিক্যাল ইন্ঞ্জিনিয়ার আবার কোরআন এ হাফেজ।খুব ভালো কবিতা লিখত ও আবৃত্তি করতো।দূর্ঘটনার পর এখন আর কিছুই করতে পারে না।নামাজটা পর্যন্ত মসজিদে গিয়ে পড়তে পারে না।আর আগে সে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে গিয়ে পড়ার চেষ্টা করতো।এখন আর সেটাও পারে না। আর এমন একটা সোনার টুকরো ছেলেকে কোন মেয়ে কত কি বাজে বাজে কথা বললো। "


ভদ্রমহিলা কাঁদতে লাগলো। আর এসব কথা শুনে আমার আরো বেশি নিজেকে অপরাধী মনে হতে লাগলো। আমার চোখেও জল গড়িয়ে পড়লো।


-- " একি মা তুমি কাঁদছো কেন? "

-- " আপনার কান্না দেখে আমি আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলাম না। আমি কারো চোখের পানি সহ্য করতে পারিনা। "


-- " ঠিক আছে মা এইতো আমি চোখের জল মুছে ফেললাম। "

-- " আন্টি প্রেসক্রিপশনটা আমাকে দিন, আর আপনি উনার সাথে বসুন আমি এখনি গিয়ে ঔষধগুলো নিয়ে আসছি। "


আমি প্রেসক্রিপশন নিয়ে নীচতলা থেকে গিয়ে ঔষধগুলো নিয়ে এসে ভদ্রমহিলার হাতে দিলাম।

-- " অনেক ধন্যবাদ মা তোমাকে। আল্লাহ তোমার মঙ্গল করুক। "

-- " ঠিক আছে আন্টি এ আর এমন কি। "

-- " তা মা তোমার বাসা কোথায়? "

-- " কলাবাগান ২ নাম্বার লেন। "

-- " ওহ তাই নাকি! আমার বাসাও তো কলাবাগানের ডলফিন গলিতে ৬৯ নাম্বার বাসা।তাহলে মা একদিন বিকেলে বাসায় চলে এসো, চা খেতে খেতে গল্প করা যাবে। "


-- " ঠিক আছে আন্টি অবশ্যই যাবো। "


মিস মিলি আছেন? মিস মিলি আপনার সিরিয়াল এখন।

-- " আন্টি স্যারের এ্যাসিস্ট্যান্ট আমাকে ডাকছে। "

-- " ঠিক আছে মা তুমি তাহলে ডাক্তারের চেম্বারে যাও।আমরাও বাসায় চলে যাচ্ছি।আর হ্যা একদিন কিন্তু অবশ্যই আসবে কথা দিয়েছ কিন্তু। "


-- " ঠিক আছে আন্টি আসবো। আপনারা সাবধানে যাবেন। আল্লাহ হাফেজ। "

-- " আল্লাহ হাফেজ। "


আমি ডাক্তার দেখিয়ে বাসায় আসতে আসতে রাত ১ টা বেজে যায়।আমার পরে আরও ১০ জন পেশেন্ট! মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই ডাক্তাররা একদিনে এত রোগীর প্রেশার কিভাবে নিতে পারে!আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে সেদিনের ঘটনাগুলো ভাবতে লাগলাম।আমার আসলে সেদিন ঐভাবে রিয়্যাক্ট করাটা একদমই ঠিক হয়নি। আমার উচিৎ লোকটির কাছে ক্ষমা চাওয়া। আমি কাল-পরশুর মধ্যেই উনাদের বাসায় যাবো ক্ষমা চাইতে।এরপর আমি ঘুমিয়ে পড়ি।


কিন্তু এরপর আমি নানারকম কাজের ঝামেলায় তৌফিক সাহেবের কথা একদম ভুলেই যাই।


তিনদিন পর।সকাল ৭.৩০।

আমি স্কুলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম।আমি একটা প্রাইভেট স্কুলের টিচার।মা-বাবা দুজনেই মারা গেছেন একমাত্র ছোট ভাই আমেরিকা প্রবাসী।তাই স্কুলই আমার আপন ঠিকানা।আজকে স্কুলের গুরুত্বপূর্ণ মিটিং থাকায় স্কুল নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ছুটি হয়ে গেছে।আমি একটা রিকশা নিয়ে বাসায় ফিরে আসছি। 


-- " মামা মামা একটু রিকশাটা দাঁড় করান তো। "

আমি রিকশা থেকে নেমে তাড়াতাড়ি রিকশা ভাড়া দিয়ে একটু পিছনে গেলাম। 


-- " আরে তৌফিক সাহেব আপনি এখানে কি করছেন? "

-- " আপনি নিশ্চয়ই মিলি? "

-- " ও মাই গড! আপনি আমাকে চিনতে পারলেন কেমন করে? "

-- " আপনার কণ্ঠস্বর আমার মনে আছে। "

-- " শুধুমাত্র আমার কন্ঠস্বর শুনে আপনি আমাকে চিনে ফেলতে পারলেন সত্যিই অবিশ্বাস্য! তো আপনার সাথে কাউকে দেখছি না যে? "


-- " আমার তো কেউ বলতে শুধু আম্মু। আর আম্মু তো এখন অফিসে। "

-- " একা একা বের হলেন কেন? যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যায়? "

-- " আসলে আমার ওষুধ শেষ হয়ে গিয়েছিল তো আম্মুকে বলতে মনে ছিল না। "

-- " তা ঔষধ কিনেছেন? "

-- " না যাচ্ছিলাম আরকি। "

-- " ঠিক আছে চলুন আমি আপনার সাথে যাচ্ছি। যদি আপনার কোনো আপত্তি না থাকে। "

-- " ঠিক আছে চলুন আপনি যেহেতু চাচ্ছেন। "


আমরা হেঁটে যাচ্ছি। কিন্তু আমার অপরাধবোধের জন্য আর কোনো কথা বলতে পারছি না।তৌফিক সাহেব নিজেই কথা বলতে শুরু করলেন।


-- " তো আপনি কোথাও যাচ্ছিলেন নাকি ফিরছেন? "

-- " আমি স্কুল থেকে ফিরছিলাম। "

-- " ওয়াও! আপনি তাহলে একজন টিচার! "

-- " আপনি এত অবাক হলেন কেন? "

-- " আসলে আমার খুব ইচ্ছে ছিল শিক্ষকতা করার। আমার বাবাও একজন টিচার ছিলেন তো। "

-- " আপনি চাইলে এখনো শিক্ষকতা করতে পারেন। "

-- " না তা আর সম্ভব না।আচ্ছা বাদ দেন এই প্রসঙ্গ। আপনার তো বাসায় ফিরতে দেরি হয়ে যাবে। আপনার ছেলে মেয়েরা নিশ্চয়ই বাসায় আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। "


-- " হা হা হা হা। "

-- " কি ব্যাপার আপনি হাসছেন কেন? "

-- " আপনার কথা শুনে। আমার তো বিয়েই হয়নি! "

-- " ও আচ্ছা আমি দুঃখিত। "

-- " আসলে আমার মা-বাবাও বেঁচে নেই।একটা ছোট ভাই আছে ও আমেরিকা থাকে।তাই আমার জন্য অপেক্ষা করার কেউ নেই। আমরা ফার্মেসিতে চলে এসেছি। আপনার প্রেসক্রিপশনটা দিন। "


আমরা ঔষধ কিনলাম। তারপর তৌফিক সাহেবকে নিয়ে উনার বাসায় আসি। 

-- " আপনি এখানে বসুন আমি আপনার জন্য একটু চা নিয়ে আসছি। আর এরমধ্যে আম্মু চলে আসবে। "

-- " না না আপনি এত ব্যস্ত হবেন না।তাছাড়া আমি চা খাই না।আমি শুধু ব্ল্যাক কফি খাই। "

-- " আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আমিতো চা কফি কিছুই বানাতে পারিনা, তাই আম্মু শুধু চা বানিয়ে ফ্লাস্কে রেখে যায়। "


-- " আপনি কফি খান তো? "

-- " তা খাই। "

-- " বাসায় কফি আছে? "

-- " হ্যা আছে। কিন্তু বানানোর মত কেউ নেই। "

-- " আপনি এখানে বসুন। আর রান্নাঘরটা কোথায় আমাকে বলুন আমি এক্ষুনি দুই কাপ কফি বানিয়ে নিয়ে আসছি। আমার হাতের বানানো কফি কিন্তু অনেক ভালো হয়। "


-- " আপনি অতিথি আপনি কেন শুধু শুধু কষ্ট করবেন? "

-- " আপনি বসুনতো তৌফিক সাহেব। "


আমি ঝট করে দুই কাপ কফি বানিয়ে নিয়ে আসি এবং তৌফিক সাহেবকে এক কাপ কফি দেই।


-- " বাহ্! অসম্ভব রকমের ভালো কফি হয়েছে। "

-- " ধন্যবাদ। ধন্যবাদ। আসলে এতটাও ভালো না, মোটামুটি।তৌফিক সাহেব আপনাকে কিছু কথা বলার ছিলো। "


-- " ওসব কথা ভুলে যান। আমি কিছু মনে করিনি আমিও সব ভুলে গেছি। "


তৌফিক সাহেবের কথা শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম।


-- " আপনি কি জানেন আমি কোন কথা বলতে চাচ্ছিলাম? "

-- " দেখুন মিস মিলি, সেদিন আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করার জন্য আপনি খুব অনুতপ্ত হয়েছেন, আপনি বুঝতে পেরেছেন প্রকৃত ঘটনা না জেনে কাওকে অপরাধী মনে করে শাস্তি দেওয়া ঠিক নয়। আপনি যেহেতু আপনার ভুল বুঝতে পেরেছেন তাই আপনাকে আর ক্ষমা চাইতে হবে না।  "


-- " আপনি আমাকে চিনতে পেরেছেন যে, আমিই সেদিনের সেই মেয়ে? "

-- " আপনার কণ্ঠস্বর আমি কখনো ভুলতে পারবনা। কাউকে চিনতে পারার এটাইতো আমার একমাত্র মাধ্যম। "


-- " সেদিনের ব্যবহারের জন্য আমি সত্যিই ভীষণ অনুতপ্ত। প্লীজ আমাকে দয়া করে ক্ষমা করে দিন। "


-- " ছিঃ আপনি ক্ষমা চেয়ে আমাকে আর লজ্জা দিবেন না তো। আমি আপনাকে অনেক আগেই ক্ষমা করে দিয়েছি। "


-- " যাক বাবা এখন মনে একটু শান্তি পাচ্ছি। "


এমন সময় হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠলো। 


-- " নিশ্চয়ই আম্মু চলে এসেছে! আপনি বসুন আমি দরজা খুলে দিচ্ছি। "

-- " আরে আপনি বসুন তো তৌফিক সাহেব, আমি দরজা খুলছি। "


-- " আরে এত দেখছি মিলি মা। তা কখন এসেছ মা? " (তৌফিকের মা)

-- " আসলে আন্টি আমি স্কুল থেকে বাসায় ফিরছিলাম, হঠাৎ তৌফিক সাহেবকে দেখি রাস্তায় আর তারপর আসি। "


-- " তৌফিক তুই আবারো একা একা বাসা থেকে বের হয়েছিস? তোকে কতবার করে মানা করেছি। "


-- " মা আসলে চোখের ড্রপটা শেষ হয়ে গেছে। " (তৌফিক) 

-- " ইশ্ আমারই মনে ছিলোনা কিনে দিয়ে যেতে। "

-- " তুমি একা মানুষ আর কত কি মনে রাখবে মা।আমি তো তোমার অভাগা ছেলে।আমার জন্যই তোমার এত কষ্ট। সব দোষ আমার। "


-- " তোর কোন দোষ নেই বাবা। সব দোষ ঐ মেয়েটার। "

-- " মা শুধু শুধু না জেনে একটা মেয়েকে দোষ দিওনা তো।মেয়েটি তো ইচ্ছে করে কিছু করেনি। মেয়েটি নিশ্চয়ই জানেও না তার জন্য আমার চোখের আলো নিভে গেছে। "


-- " তুই যতোই বলিস সব দোষ ঐ মেয়েটার। "

-- " আচ্ছা মা তুমি এসব কথা কেন তুললে? বাসায় একজন গেস্ট এসেছে, উনাকে কিছু খেতে দাও। "


-- " ওহো সরি মা, তুমি বসো আমি তোমার জন্য কফি নিয়ে আসছি। "

-- " আন্টি আপনি এত ব্যস্ত হবেন না। আপনি অফিস থেকে ফিরেছেন আপনি আগে ফ্রেশ হোন। তাছাড়া আমি আর তৌফিক সাহেব দুজনেই কফি খেয়েছি। "


-- " হ্যা আম্মু, আমি উনাকে মানা করেছিলাম কফি বানাতে, কিন্তু উনি আমার কোনো কথাই শুনলেন না। তবে আম্মু উনি অসম্ভব রকমের ভালো কফি বানিয়েছেন। তোমার ভাগ্য খারাপ তাই মিস করলে। "

-- " মোটেও ভাগ্য খারাপ না। আন্টি আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন তো আমি আপনার জন্য এক কাপ কফি বানিয়ে নিয়ে আসছি। "


-- " না মা আজ আর তোমাকে কষ্ট করতে হবে না। অন্য কোনো দিন বানিয়ে খাওয়াবে। "


-- " ঠিক আছে আন্টি। আন্টি আজকে আমি তাহলে আসি। "

-- " ও মা আসবে কি! বসো আমি তোমার জন্য পায়েস রেঁধে নিয়ে আসছি। "

-- " ওয়াও পায়েস! পায়েস আমার খুব প্রিয়। দিলেন তো লোভ দেখিয়ে আটকে। "

-- " হা হা হা হা। তাই নাকি! তৌফিকও পায়েস খেতে খুব পছন্দ করে।শেষে পাতিলে একটু লেগে থাকলে সেটা পর্যন্ত আঙ্গুল দিয়ে চেটে চেটে খায়! হা হা হা হা। "


-- " আম্মু তুমি কিন্তু আমাকে লজ্জা দিচ্ছ! তুমি যাওতো তাড়াতাড়ি পায়েস বানিয়ে নিয়ে আসো। পায়েসের নাম শুনলে যতক্ষন না খাবো ততক্ষণ আমার জিহ্বা শান্তি পাবেনা!হা হা হা হা। " (তৌফিক) 


এবার তিনজনেই হা হা হা হা করে হাসতে লাগলাম।

-- " অনেকদিন পর এভাবে প্রাণ খুলে হাসলাম। "

-- " আন্টি আমিও অনেকদিন পর হাসলাম। "

-- " ঠিক আছে মা তুমি বস আমি এখনি আসছি। "


আন্টি ভিতরে চলে গেলেন।


-- " আচ্ছা তৌফিক সাহেব কিছু মনে না করলে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি? "

-- " আপনি বলুন কি জানতে চান? "

-- " আচ্ছা আপনার দুর্ঘটনা কিভাবে ঘটেছিল? কোনো একটা মেয়ের কথা যেন আন্টি বলছিলেন। "


-- " সে অনেক কথা আপনি বিরক্ত হয়ে যাবেন। "

-- " না না আমি বিরক্ত হব না। আপনার যদি কোনো আপত্তি না থাকে তাহলে আপনি বলেন, আমি শুনবো। "


-- " একবছর আগের ঘটনা।সময়টা ছিলো বর্ষাকাল, বাইরে তখন ঝুম বৃষ্টি আমরা অনেকেই একটা শপিং মলের সামনে অপেক্ষা করছিলাম। তখন একটা গাড়ি আসে আর একটা মেয়ে গাড়িতে উঠার জন্য দৌড় দেয় আর আমার সাথে ধাক্কা লাগে। আমি নিজেকে ব্যালেন্স রাখতে পারিনি আমি পিছলে পড়ে যাই এবং মাথায় প্রচণ্ড রকমের আঘাত পাই। মেয়েটির খুব তাড়া ছিল তাই আমার পড়ে যাওয়া হয়তোবা লক্ষ্য করেনি। মেয়েটি গাড়িতে উঠে চলে যায়। আর লোকজন আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায় কিন্তু বৃষ্টির জন্য হাসপাতালে পৌঁছাতে অনেক দেরি হয়ে যায়। যখন আমার জ্ঞান ফিরে আসলো আমি আর চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না।তখন ডাক্তাররা সব পরীক্ষা করে জানাল আমার দুটি চোখই পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। একমাত্র নতুন চোখ প্রতিস্থাপন করতে পারলে আমি দেখতে পারবো।এই ছিলো সেদিনের ঘটনা। "


-- " তৌফিক সাহেব সেদিন আপনি কোন শপিং মলের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন? "

-- " স্টার ওয়ার্ল্ড শপিং মল। "

-- " কি! "

-- " সেদিন কত তারিখ ছিল? "

-- " ২২, শেষ আষাঢ়। "

-- " কি বললেন! "


তৌফিক সাহেবের কথা শুনে আমি বসা উঠে পড়লাম। 

-- " তৌফিক সাহেব আপনার কি ঠিক মনে আছে সেদিন ২২ তারিখ ছিলো? "

-- " আমি কি করে ভুলতে পারি সেদিনের ঘটনা? কিন্তু আপনি এত অবাক হয়ে গেলেন কেন? "

-- " কই নাতো। তৌফিক সাহেব আমি আজকে উঠি। "

-- " একি আম্মু আপনার জন্য পায়েস রেঁধে আনতে গেলো, একটু বসুন। "

-- " না তৌফিক সাহেব আমার শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। আমাকে এখুনি বাসায় যেতে হবে। "


আমি আর একমুহুর্ত দেরি না করে তৌফিক সাহেবের বাসা থেকে বের হয়ে যাই।


গল্পঃ চোখের__আলো

পর্ব [ ০১ ]

লেখক: সাইফুল ইসলাম


গল্পঃ চোখের_আলো

পর্ব [ ০২ ] সমাপ্ত

লেখক: সাইফুল ইসলাম


আমি বাসায় চলে আসি। আমি সারারাত আর ঘুমাতে পারলাম না।আমার বিবেক আমার অপরাধের জন্য আমাকে একমুহুর্তের জন্য স্বস্তিতে থাকতে দিলোনা।এভাবে কয়েকটা দিন কেটে যায়।অবশেষে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমি আমার ভুলের জন্য তৌফিক সাহেবের কাছে ক্ষমা চাইবো।আমি বলব যে, 


– "যেই মেয়েটির সাথে আপনার ধাক্কা লেগেছিল সেই মেয়েটি আমি ছিলাম।আপনি আমাকে যা শাস্তি দিবেন আমি মাথা পেতে নেবো। "


আজকে সাতদিন পর আমি তৌফিক সাহেবের বাসায় যাচ্ছি কি কি বলবো সবকিছু আগেই ভেবে ঠিক করে রেখেছি।কলিং বেল চাপ দিতেই তৌফিক সাহেব দরজা খুলে দিলেন।


-- " কেমন আছেন তৌফিক সাহেব? "

-- " ও মিলি এসেছেন? কেমন আছেন আপনি? "

-- " জ্বী আমি ভালো আছি।আপনারা কেমন আছেন? "

-- " আমি ভালো আছি।আম্মু একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছে। "

-- " কি হয়েছে আন্টির? "

-- " রিকশা থেকে পড়ে গিয়ে পা ভেঙ্গে গেছে। "

-- " কি বলছেন! কোথায় আন্টি? আপনি চলুন তো। "


আমি আন্টির রুমে যাই।

-- " আন্টি কিভাবে হলো,কবে ঘটলো এই ঘটনা? "

-- " গতকালকে অফিস থেকে ফেরার পথে হঠাৎ মাথা ঘুরে রিকশা থেকে পড়ে যাই। "

-- " কিছু খেয়েছেন? রান্না তো নিশ্চয়ই করতে পারছেন না। "

-- " হোটেল থেকে আনিয়ে খাচ্ছি মা। "

-- " আজকে থেকে আর হোটেল থেকে আনতে হবে না। যতদিন আপনি সুস্থ না হোন ততদিন আমি এসে রান্না করে দিয়ে যাবো। "


-- " না মা তুমি কেন শুধু শুধু কষ্ট করতে যাবে? "

-- " আন্টি আমাকে নিষেধ করবেন না।এতে যদি আমার পাপের বোঝা একটু কমে। "

-- " কিসের পাপের বোঝা মা? "

-- " না আন্টি, ও কিছু না।আমার মা-বাবা কেউ বেঁচে নেই তো, তাই আপনার সেবা করতে পারলে আমার ভালো লাগবে।আপনি আমাকে আর নিষেধ করবেন না মা।আপনি শুধু আমাকে বলে দিন কোথায় কি কি আছে।ও দুঃখিত আমি আপনাকে মা বলে ফেললাম। "


-- " ঠিক আছে এখন থেকে তুমি আমাকে মা বলেই ডেকো কেমন। "

-- " ঠিক আছে মা। এবার আপনারা বসুন আমি ঝটপট রান্না করে নিয়ে আসছি। "


তারপর আমি রাতের খাবার রান্না করে টেবিলে পরিবেশন করলাম।মা আর তৌফিক সাহেবের অনুরোধে আমাকেও উনাদের সাথে ডিনার করতে হলো।তারপর আমি আমার মোবাইল নাম্বার দিয়ে বাসায় ফিরে আসি।আমি আজকে আমার অপরাধের কথা আর তৌফিক সাহেবকে বলতে পারলাম না।যদি আজকে বলে দিতাম তখন তারা হয়তো পুলিশ ডেকে আমাকে থানায় দিয়ে দিতো তাহলে উনাদের খাওয়া দাওয়ার খুব বেশি কষ্ট হয়ে যেতো।তাই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম মা যতদিন সুস্থ না হবে ততদিন পর্যন্ত আমি উনাদের কিছু বলবো না।


এরপর থেকে সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে আর স্কুল থেকে ফেরার সময় আমি উনাদের বাসায় গিয়ে রান্না করে দিয়ে আসি।এভাবে কয়েকদিন পার হয়ে যায়।


আজকে মা আমাকে বললেন,

-- " মা তৌফিকের কিছু শপিং করা দরকার আমি তো যেতে পারছিনা, তুমি কি ওকে নিয়ে কাল পড়শু একটু বসুন্ধরায় যেতে পারবে? "

-- " জ্বী মা অবশ্যই। আমি আগামী শুক্রবার যাবো। "


আজকে শুক্রবার আমার সাপ্তাহিক ছুটির দিন তাই আমি তৌফিক সাহেবকে নিয়ে বসুন্ধরায় আসি এবং আমি নিজে পছন্দ করে উনার এবং মায়ের জন্য কেনাকাটা করি।শপিং শেষে আমরা ফাস্টফুড কর্নারে দু'জনে বসে হালকা খেতে খেতে অনেক গল্প করি।এভাবে আরো কয়েকটা দিন কেটে গেল। 


আজকে আমি বাসায় থেকে বের হবো এমন সময় মা আমাকে কল দিলো।মা আমাকে এমন একটা কথা বললো যা শোনার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না।মা আমাকে বললো,


-- " মা মিলি তুমি আর আমাদের বাসায় এসো না!কেন আসতে নিষেধ করছি সেটা জানতে চেয়োনা।তুমি যদি না আসো তবে তা তোমার এবং আমাদের সবার জন্য ভালো হবে। "


আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মা কলটা কেটে দিলো।আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। তবে কি মা কোনোভাবে জেনে গেছে উনার ছেলের চোখের আলো নিভে যাওয়ার পিছনে আমি দায়ী? কিন্তু তা কি করে সম্ভব। না এটা কারো পক্ষে জানা অসম্ভব।তাহলে আর কি কারণ থাকতে পারে?মা যতোই নিষেধ করুক আমি বিকেলে শেষবারের মতো একটিবার যাবো‌।আমার অপরাধের জন্য আমি ক্ষমা চাইবো।এরপর উনি যা শাস্তি দিবেন মাথা পেতে নিবো।


বিকেলে আমি অফিস শেষে তৌফিক সাহেবের বাসায় ঢুকতে যাবো এমন সময় দাঁড়োয়ান আমাকে গেটে জিজ্ঞাসা করলো,


-- " ভাবী সাহেবা তৌফিক ভাই কেমন আছেন? "

-- " আপনাকে কে বললো, আমি আপনার ভাবী হই? এসব ফালতু কথা বলেন কেন? "

-- " আপনি আমার উপর শুধু শুধু রেগে যাচ্ছেন,এই বিল্ডিং এর সবাই তো এই কথাই বলছে। গতকাল মিটিং এ এই বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। "


আমি আর একমুহুর্ত দাঁড়ালাম না তাড়াতাড়ি ভিতরের দিকে পা বাড়ালাম।ওহ এই ঘটনার জন্য তাহলে মা আমাকে আসতে নিষেধ করেছেন।আর আমি ভেবেছিলাম তারা হয়তো সেই ঘটনা জেনে গেছে।আমি বাসায় গিয়ে কলিং বেল চাপ দিলাম।


আজকে মা দরজা খুলে দিয়েই বললেন,

-- " কেন এসেছ‌ মা? তোমাকে তো আসতে নিষেধ করেছিলাম। "

-- " মা আপনাদের অনেক বেশি আপন ভেবে ফেলেছি অনেক ভালোবেসে ফেলেছি তাই আপনাদের না দেখে থাকতে পারছিলাম না। "


আমার আসার কারণ আমার অপরাধের জন্য ক্ষমা চাওয়া সেই কথা আমি আজকেও আর মাকে বলতে পারলাম না কারণ এই কথা বললে তারা আমাকে আর কোনোদিনই আসতে দিবে না।


-- " দেখো মা মিলি তুমি অনেক ভালো একটা মেয়ে আমরাও তোমাকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছি, আপন করে ফেলেছি কিন্তু আশেপাশের লোকজন তোমার এখানে আসাটা ভালোভাবে নিচ্ছে না। ওরা নানা ধরনের আজেবাজে কথা বলছে।যেটা তোমার জন্য কোনোভাবেই ভালো হবে না তুমি এখনো অবিবাহিতা মেয়ে,তোমার তো একটা ভবিষ্যৎ আছে। "


-- " মা আপনি এই বিষয় নিয়ে ভয় পাচ্ছেন আমার সামনে এসে বলতে দেন।আর যদি আপনি লোকজনের কথায় এতই ভয় পান তাহলে আপনি যদি চান আর তৌফিকক সাহেব যদি রাজি থাকে আমি আপনাদের বাড়ির বউ হয়ে আসতে চাই। "


-- " এ তুমি কি বলছো মা! এটা কখনো সম্ভব না। "

-- " মা কেন সম্ভব না? "

-- " তুমি বুঝতে পারছ না মা তৌফিক একটা অন্ধ ছেলে ওকে কোনো মেয়ে বিয়ে করতে রাজি হবে না।! "


-- " দেখুন মা আমি এই কয়েকদিনে যা বুঝেছি তৌফিক সাহেবের মতো ভালো মানুষ আর একটাও হয়না।উনার চোখের আলো নেই এটা কোনো সমস্যাই না।সত্যি কথা হলো আমার এই শহরে আপন বলতে কেউ নেই আমি আপনাদেরকে হারাতে চাইনা। "


এতক্ষণ তৌফিক সাহেব আড়ালে দাঁড়িয়ে থেকে আমাদের সব কথা শুনছিলেন এবার আড়াল থেকে বের হয়ে আসলেন।

-- " দেখুন মিস মিলি আমরা আপনাকে সম্মান করেছি, ভালোবেসেছি। তার মানে এই নয় যে আপনি আমাদের করুণা করবেন। আমি একজন অন্ধ মানুষ বলে আপনি আমাকে আজকে করুণা করে বিয়ে করতে চাচ্ছেন। "


-- " না! আপনি যা ভাবছেন তা ঠিক নয়, আমি আপনাদেরকে ভালোবাসি, তাছাড়া আমি সত্যিই আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি। "


-- " দেখুন এসব আপনার আবেগের কথা।আপনি আপনার বাসায় চলে যান।আপনি আর কখনো আমাদের এখানে আসবেন না। "


-- " ঠিক আছে আমি চলে যাচ্ছি আমি আর কখনো আসবো না।তবে হ্যাঁ আমি সত্যিই আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি আমি আপনার কলের অপেক্ষায় থাকবো। "


আমি উনাদের বাসা থেকে কাঁদতে কাঁদতে বের হয়ে চলে আসলাম।আমি আর তৌফিক সাহেবের বাসায় যাইনি। 

.

.

এভাবে প্রায় ১০-১৫ দিন কেটে যায়।আজকে আমি অফিসে বসে কাজ করছিলাম এমন সময় তৌফিক সাহেবের কল আসে।


-- " কেমন আছেন আপনি? "

-- " আমি ভালো আছি। আপনারা ভালো আছেন? "

-- " আমরা আছি মোটামুটি। মা আপনাকে খুব মিস করছিলো তাই মা বললো, আপনার সাথে একটু কথা বলতে। "

-- " শুধু কি মা মিস করছেন, আপনি মিস করছেন না আমাকে? "


তৌফিক সাহেব কোনো কিছু না বলে চুপ করে রইলো।

-- " আপনার এই নীরবতাই বলছে আপনি আমাকে মিস করছেন তারমানে আপনিও আমাকে ভালোবাসেন।তৌফিক সাহেব আমি আপনাকে ভালোবাসি, আপনি আমাকে ভালোবাসেন এখানে আপনার চোখের আলোকে আমাদের মাঝখানে দেয়াল করে রাখবেন না। "


-- " আপনি কি সত্যিই আমাকে ভালোবাসেন? "

-- " একজন মেয়ে মানুষ হয়ে আমি আপনাকে বারবার বলছি যে আমি আপনাকে ভালোবাসি। আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই।কারণ এই কথাগুলো বলার জন্য আমার আর কেউ।আর হ্যাঁ যদি আপনি আমাকে নাও ভালোবাসেন, বিয়ে না করেন তাহলে আমি আমার বাকি জীবন একাই পাড় করে দিবো। "


-- " এ আপনি কি বলছেন? "

-- " হ্যা আমি সত্যি কথাই বলছি। সিরিয়াসলি বলছি। "

-- " মিলি আপনি আমাকে এতটাই ভালোবাসেন!আমি আপনার ভালোবাসার জন্য আমার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছি।আমি আপনাকে বিয়ে করতে রাজি আছি। "


-- " আপনি সত্যি বলছেন তৌফিক সাহেব? "

-- " হ্যাঁ সত্যি বলছি। তবে... "

-- " তবে কি? "

-- " যদি আপনি রাজি থাকেন। "


-- " হা হা হা হা...

ঠিক আছে আমি কালকেই আমার খালা-খালুকে নিয়ে আপনাদের বাসায় আসব। বিয়ে নিয়ে যা কথা বলা দরকার মুরুব্বিরা বলে নেবেন। "


আজকে আমার অনেক আনন্দ লাগছে।আমার অনেক ভালো লাগছে এবার আমার উদ্দেশ্য সফল হবে।এবার আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করা হবে।


দুপুর ১২ টা...

আমি খালা খালু কে নিয়ে তৌফিক সাহেবের বাসায় আসি।মা আমাদের জন্য আজকে অনেক কিছু রান্না করেছেন।দুই পরিবার কথাবার্তা বলে সিদ্ধান্ত নিল যেহেতু ছেলে মেয়ে দুজনেই আছে এবং জানাশোনা আছে সেহেতু বিয়ের জন্য আর দেরি করা ঠিক হবে না।ঘরোয়া পরিবেশে আমাদের বিয়ে পড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেন তারা। সন্ধ্যার দিকে কাজী আসলেন তারপর আমাদের বিয়ে পড়ানো হয়।


রাতে আমি মায়ের দেওয়া মায়ের বিয়ের শাড়িটা পড়লাম আর তৌফিক সাহেব পড়েছে উনার বাবার বিয়ের পাঞ্জাবী।বাসর ঘরে আমি খাটে বসে আছি কিছুক্ষণ তৌফিক সাহেব রুমে ঢুকলেন, আমি ওনার হাত ধরে এনে খাটে বসালাম।


-- " কি থেকে কি হয়ে গেল! মিলি কখনো ভাবি নি আপনি আমার স্ত্রী হবেন।অথচ আমার দুর্ভাগ্য আমি আপনাকে দেখতে পাচ্ছি না।আম্মু বলেছেন আপনি নাকি অনেক সুন্দর। "


-- " তৌফিক সাহেব আপনি কিন্তু অনেক হ্যান্ডসাম। বড় কথা হলো আপনি অনেক ভালো মনের মানুষ। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি আপনি একদিন আমাকে দেখতে পাবেন। "


-- " এ আর সম্ভব না। আমি আর কখনো দেখতে পাবো না। " 

-- " আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি তো আপনি আমাকে দেখতে পাবেন। আচ্ছা আপনি কি আমাকে আপনি করেই বলবেন? "


-- " আপনিও তো আমাকে আপনি করে বলছেন। "

-- " ঠিক আছে আপনি এখন থেকে তুমি বলে ডাকবেন আর আমিও। "

-- " ওকে ঠিক আছে। "


এরপর তৌফিক আমাকে তার বুকের সাথে জড়িয়ে নিল।আমার কপালে তার উষ্ণ ছোঁয়া আমাকে সুখের সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।আমরা দুজন-দুজনার ভালোবাসায় পুরোপুরি ডুবে গেলাম।


এভাবে আমাদের দুজনের সংসার ভালই কাটছিল।আজ আমি স্কুল থেকে তৌফিককে ফোন দিলাম,


-- " তুমি তৈরি হয়ে থাকবে আমি স্কুল থেকে ফিরে তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। "

-- " আমিতো অসুস্থ না তাহলে কেন আমাকে শুধু শুধু ডাক্তার কাছে নিয়ে যাবে? "

-- " আমি তোমাকে বাংলাদেশের একজন সেরা চোখের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। "

-- " দেখো ডাক্তারের কাছে গিয়ে আর কোনো লাভ হবে না। "

-- " তুমি এত কথা বলো না। লাভ হবে কি, হবে না সেটা সময় বলে দিবে। "

-- " আচ্ছা ঠিক আছে আমি তৈরি হয়ে থাকবো। "


সন্ধ্যায় আমি তৌফিককে নিয়ে ডাক্তারের চেম্বারে আসি। ডাক্তার সব কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানালেন যে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চোখ প্রতিস্থাপন করতে হবে আর নয়তো তৌফিক কোনোদিন চোখে দেখতে পারবে না।আমরা তারপরে বাসায় চলে আসি। 


দুদিন পর ডাক্তার তৌফিকের নাম্বারে কল দেন।কল দিয়ে বললেন, যে একটা চোখ পাওয়া গেছে একজন স্বইচ্ছায় আপনাকে তার একটি চোখ দান করতে রাজি হয়েছেন সুতরাং আপনি চাইলেই আগামী পরশুদিন আপনার চোখ অপারেশন করা যাবে।


আমরা সবাই তখন অনেক খুশি হই।তৌফিক তো আমাকে এসে জড়িয়ে ধরে বলল,

-- " মিলি আমি আবার চোখে দেখতে পারবো, আমি আবার কবিতা লিখতে পারবো, আমি কবিতা আবৃতি করতে পারবো। আমি আবার মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তে পারবো। সবচেয়ে আনন্দের কথা আমি আমার ভালোবাসার মানুষকে দেখতে পারবো। আমি প্রথম তোমাকে দেখতে চাই তুমি আমাকে কথা দাও যেন আমি চোখ খুলে প্রথমে তোমাকে দেখতে পারি। "


-- " না! "

-- " কেন? "

-- " তুমি প্রথমে মাকে দেখবে তারপর আমাকে দেখবে। "

-- " ঠিক আছে আমি প্রথমে মাকে দেখবো তারপর তোমাকে দেখবো। "


দুইদিন পর।

সবকিছু তৈরি হয়ে গেল আজকে তৌফিকের চোখের অপারেশন।তৌফিককে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয়েছে মা অপারেশন থিয়েটারের সামনে অপেক্ষা করতে লাগলো।


আমি মাকে বললাম,

-- " মা আমার একটা জরুরী ট্রেনিং আছে আমাকে কক্সবাজার যেতে হবে। "

-- " তৌফিকের অপারেশন আর তুমি এখন কক্সবাজারে যাবে! "

-- " মা যেতেই হবে নয়তো চাকরিটা চলে যাবে।মা অপারেশনের জন্য তো অনেকগুলো টাকা লেগেছে, সবতো ধারদেনা করে দিয়েছি এগুলো তো পরিশোধ করতে হবে।তবে মা আমি কথা দিচ্ছি যেদিন তৌফিকের চোখের ব্যান্ডেজ খোলা হবে সেদিন আমি চলে আসবো। "


মা আমাকে আর মানা করলেন না যেহেতু চাকরির বিষয়।

.

.

তৌফিকের অপারেশন সাকসেসফুল হওয়ার কয়েকদিন পর।আজকে তৌফিকের চোখের ব্যান্ডেজ খোলা হবে।আমি ও মা তৌফিকের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, ডাক্তার রফিকুল ইসলাম তোফিকের চোখের ব্যান্ডেজ খুলে দিলেন।তৌফিক মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলো। তারপর আমাকে খুঁজতে লাগলো তৌফিক আমাকে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,


-- " অপারেশন হয়েছে আমার, কিন্তু তোমার চোখে কিসের ব্যান্ডেজ? আম্মু মিলির চোখে ব্যান্ডেজ কেন? বলো মিলির কি হয়েছে? "


-- " বাবা বিশ্বাস কর আমি কিছুই জানতাম না মিলি তোকে ওর একটি চোখ দিয়েছে। আর এইজন্য তুই চোখের আলো ফিরে পেয়েছিস। "


-- " এ কী বলছ আম্মু তুমি? "

-- " হ্যা বাবা, মিলি আমাকে আগে কিছু বলেনি যদি আমি ওকে বাঁধা দেই এইজন্য। "

-- " মিলি তুমি এটা কেন করলে? "


-- " তৌফিক সাহেব আপনি খুবই ভাগ্যবান আপনার স্ত্রী আপনাকে খুব ভালোবাসে উনিতো আপনাকে দুটি চোখ দান করতে চেয়েছিলেন।কিন্তু আমরা একটা সুস্থ মানুষের কাছ থেকে দুটি চোখ নিয়ে তার চোখের আলো নিভিয়ে দেওয়ার পক্ষে নই। তাই আমরা উনার একটা চোখ নিয়েছি। (ডাঃ রফিকুল ইসলাম) 


-- " মিলি তুমি এটা কেন করতে গেলে? "

-- " তৌফিক আমি তোমাকে কথা দিয়েছিলাম তুমি আবার সবকিছু দেখতে পারবে। তুমি আমাকে দেখতে পারবে। তুমি আবার শিক্ষকতা করতে পারবে। "


-- " তুমি আমাকে এত ভালোবাসো! আমি তোমার এই ঋণ কোনোদিন শোধ করতে পারব না। "


-- " এ কি বলছ তুমি? তুমি আমার স্বামী তোমার চোখেই তো আমার পৃথিবী। "

-- " আর আমার চোখে তোমার পৃথিবী। "


এরপর আমরা দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেই। আমার মনে হচ্ছিল যেন চোখের জলের সাথে আমার মন থেকে সকল অপরাধবোধ দূর হয়ে গেল।আর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম কোনোদিনও তৌফিককে বলবো না যে ওর চোখের আলো চলে যাওয়ার পেছনে আমিই দায়ী ছিলাম।যদি এই কথা তৌফিক জানে তাহলে তৌফিক ভাবতে পারে আমি ওকে ভালোবেসে নয় বরং করুণা করে আমার চোখ দিয়েছি।তৌফিক ভাববে, আমি হয়তো আমার অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করতে ওকে ভালোবেসেছি। তখন আমাদের মাঝে হয়তোবা দূরত্ব তৈরি হয়ে যাবে। আমি এটা কখনো সহ্য করতে পারব না।আমি যে তৌফিককে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসি।


সবাই শুভকামনা করবেন আমাদের ভালোবাসা যেন অমর হয়।


সমাপ্ত।


মন ছুঁয়ে যাওয়া গল্প পড়ুন।