না পাওয়া ভালোবাসার কষ্টের গল্প | না পাওয়ার গল্প

 না পাওয়া ভালোবাসা

না পাওয়া ভালোবাসা

বিয়ের প্রথম রাতে ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে আমার নববিবাহিতা স্ত্রী তিন্নি সরাসরি আমার চোখের দিকে চেয়ে বললো, ‘আমি সৌভিক কে ভালোবাসি।’ যেকোনো পুরুষ মানুষ এতে চমকে উঠবে কিন্তু আমি চমকালাম না কারণ পুরো ঘটনাটাই আমি জানি।


আমি আস্তে ধীরে খাটের উপর এসে বসলাম। অসম্ভব সুন্দর লাগছে তিন্নিকে। যেন একটা জলপরী কিন্তু তিন্নির মুখ চোখ একদম কঠোর হয়ে আছে।


- 'আপনি কি বুঝতে পেরেছেন আমি কি বলেছি?'


- 'হ্যাঁ বুঝেছি।'

আমি সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলাম


- 'আমি দেড় বছর প্রায় পাগলের মত ছিলাম, এই খবর কি আপনি জানেন? বিয়ের আগে আপনার সাথে আমাকে একা কথা বলতে দেয়া হয়নি, এমনকি ফোন নাম্বার পর্যন্ত পাইনি যার কারণে কথাগুলো আপনাকে জানাতে পারিনি।'


- 'এখন তো সুস্থ, তাহলে আর সমস্যা কি?'


তিন্নি খানিকটা কৌতুহলী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো।


- 'এমনিতেই সারাদিন অনেক ধকল গেছে তুমি বরং ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়ো আর রাত জাগতে হবে না।'


তিন্নি অপলক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তার কৌতুহল বুঝতে পেরে বললাম,


- 'আমাদের জীবনে অনেক সময় পড়ে আছে আস্তে ধীরে সব কথা জানা যাবে, শোনা যাবে, বোঝাও যাবে এখন বরং ঘুমাও, তোমার ঘুম প্রয়োজন।'


কিছুক্ষণ পর ও ফ্রেশ হয়ে আমার পাশে এসে শুয়ে পড়লো অল্প সময়ের মধ্যে বুঝতে পারলাম সে গভীর ঘুমে অচেতন। আমার ঘুম আসছে না, রাত গভীর হচ্ছে।


মনে পড়ছে বছর তিনেক আগের কথা,

সন্ধ্যা তখন প্রায় সাড়ে সাতটা। আমরা তিন চারজন বন্ধু গাজীপুর থেকে ফিরছিলাম হঠাৎ রং সাইড থেকে একটা বাইক প্রচন্ড গতিতে এসে গাড়িতে ধাক্কা দেয়, গাড়ি চালাচ্ছিলাম আমি নিজে। ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটে যায় যে আমি পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে গেলাম।


বন্ধুরা সমানে বলে চললো, দ্রুত পালিয়ে যেতে, ওদের কথা মতো আমি প্রায় দুই তিন মিনিট পাগলের মত গাড়ি চালিয়ে সামনে গেলাম কিন্তু তারপর যেন বিবেক জাগ্রত হলো আবার গাড়ি ঘুরিয়ে পেছনে এলাম। বন্ধুরা গালিগালাজ করতে লাগলো। বিপদে ফেঁসে যাবো, থানা পুলিশ হবে হাবিজাবি আরো অনেক কিছু। শেষ পর্যন্ত আবার ওরাই সাহায্য করলো। বাইকে একটি মেয়ে আরেকটি ছেলে ছিল হ্যাঁ ওই মেয়েটি তিন্নি।


আমরা হাসপাতাল পর্যন্ত নিয়ে গেলাম কিন্তু সত্যি বলতে কি আমি তখন অনেক ভয় পাচ্ছিলাম। কেউ কোনো কথা শুনবে না যে, বাইকটি রং সাইডে ছিল এবং প্রচন্ড গতিতে আমার গাড়িতে ধাক্কা দিয়েছে আমি মোটেই ধাক্কা দেই না তাই বন্ধুদের কথা অনুযায়ী হাসপাতাল গেটের সামনে কোনোমতে ফেলে চোরের মতো চলে এলাম।


পরদিন সকালে বিক্ষুব্ধ মন নিয়ে খানিকটা লুকোচুরি করে হাসপাতালে গেলাম খবর নিতে। একাই গেলাম আর কাউকেই সাথে নেই নি। প্রচন্ড মন খারাপ হলো ছেলেটি মারা গেছে, মেয়েটির অবস্থাও আশঙ্কাজনক, মাথায় প্রচন্ড আঘাত পেয়েছে। আমার কিছু করার ছিল না। তারপর থেকে চুপচাপ ভাবে নিয়মিত খবর নিতাম।


তিন্নি শারীরিকভাবে সুস্থ হয়ে গেলেও মানসিকভাবে পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে যায়। সৌভিকের মৃত্যু সে কোনভাবেই মেনে নিতে পারেনি। ওদের অনেক দিনের সম্পর্ক ছিল, এমনকি বিয়ের কথাবার্তা চলছিলো।


.


তিন্নি শিক্ষিত এবং সুন্দরী হওয়া সত্ত্বেও তার বিয়ে হচ্ছিলো না, খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার কারণ আশেপাশের পাড়া-প্রতিবেশী সবাই জানতো মেয়েটি মানসিকভাবে খানিকটা বিকারগ্রস্ত ছিল। সে এখন সুস্থ স্বাভাবিক কিন্তু তারপরেও প্রত্যেকেই সেই কথা মনে রেখেছে। প্রতিটি বিয়ে ভেঙে যেতে লাগলো আর তিন্নি নিজেও বিয়ে করতে চাচ্ছিলো না। আমি জানি আমার কোন দোষ ছিল না কিন্তু তারপরেও চোখের সামনে এরকম একটা মৃত্যু কেমন যেন লাগছিলো, আমার বন্ধুদের কথায় যদি আমি সেই সময়টা নষ্ট না করতাম তাহলে কি ছেলেটি বেঁচে থাকতো? আসলে আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই।


.


সকাল বেলা মা ফিসফিস করে আমাকে বললেন,


- 'কিরে তোর বউ এখনো উঠেনি?'


- 'কাল সারাদিন ওর উপর দিয়ে অনেক ধকল গেছে মা একটু ঘুমাক।'


- 'তোর উপর দিয়েও তো গেছে, বাড়ির বউ সে একটু পরে সবাই দেখতে আসবে!'

মা কিছুটা ঝাঁঝের স্বরে বললেন।


- 'দেখতে আসলে বসাবে, চা-নাস্তা খাওয়াবে। আমি আস্তে ধীরে তিন্নিকে ডেকে দেবো।


বলে নিজের বেডরুমে এলাম ততক্ষণ তিন্নি  উঠে গেছে, ফ্রেশ হচ্ছে। আমার দিকে চোখ ফিরিয়ে বললো,


- 'আমি শাড়ি পরতে জানিনা।'


- 'পরতে হবে না। তোমার কাছে কি কোন সালোয়ার কামিজ আছে?'


- 'আছে আমার লাগেজে।'


- 'তাহলে তাই পরো।'


তিন্নির চোখে মুখে অনেকটাই কৌতুহল।


মেহমানদের সামনে তিন্নি খুব সহজ, সাধারণ আর স্বাভাবিক আচরণ করলো। যদিও মা আমাকে এক পাশে ডেকে নিয়ে বললেন,


- 'নতুন বউ গয়নাগাটি ছাড়া, সালোয়ার কামিজ পরে বসে আছে এটা কেমন কথা, যত মডার্ন মেয়েই হোক না কেন?'


আমি দূর থেকেই মাকে দেখালাম, তিন্নি কেমন প্রাণোচ্ছল ভাবে মেহমানদের সাথে কথা বলছে এবং ওরাও কথা বলে খুব অসন্তুষ্ট বলে আমার মনে হলো না।


- 'মা শোনো আমরা গ্রামের বাড়িতে থাকবোই এক দুই দিন তারপর তো চলেই যাবো, তুমি প্লিজ শাশুড়ি বউ ড্রামাটা করোনা, দোহাই লাগে।'


মা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললেন,

- 'আচ্ছা যা করবো না, তোদের সুখেই আমার সুখ।'


.


তিন্নিকে নিয়ে নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে এলাম। শুরু হলো আমাদের একান্ত জীবন যাপন। তিন্নি মাঝে মাঝেই সৌভিকের কথা বলে। স্বামী হিসেবে আমার ঈর্ষান্বিত হওয়া উচিত কিন্তু কেন যেন আমার খুব কষ্ট লাগে আমাকে কষ্ট পেতে দেখে ওর কৌতুহল দ্বিগুন বেড়ে যায়।


- 'আচ্ছা আমি যে আমার বয়ফ্রেন্ডের কথা বলি তোমার খারাপ লাগে না?'


- 'না প্রথম ভালোবাসা ভুলা যায় না।'


- 'তোমার কেউ ছিল?'


- 'ছিল কিন্তু তার গল্প তোমার সাথে আমি করবো না। সে আমাকে ধোঁকা দিয়েছে।'


আসলে আমার জীবনে কোন প্রেম ছিল না। এখন যদি তিন্নিকে আমি এটা বলি ও স্বাভাবিকভাবে হয়তো নেবে না ওর মনে হবে আমি কোন কিছু লুকাচ্ছি তাই এই মিথ্যাটা বলতেই হলো।


আমার প্রথম ভালোবাসা তিন্নি, জমাট বাধা সেই ভালোবাসা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে তিন্নিকে ঘিরে। জানিনা ও আমাকে কখনো ভালোবাসতে পারবে কিনা কিন্তু আমাদের সম্পর্ক অনেকটাই সহজ স্বাভাবিক হয়ে গেছে, এজন্য আমাকে অনেক সেক্রিফাইস করতে হচ্ছে। মাঝে মাঝে গভীর রাতে তিন্নি কেঁদে ওঠে, ওকে আমি সান্ত্বনা দেই ও নিজেও ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তখন চুপ করে যায়।


.


চারদিকে ঝিঁঝি পোকা ডাকছে। আমি আর তিন্নি বসে আছি বেলকনিতে। অন্ধকার, নিকষ রাত। দুই একটা তারা জ্বলজ্বল করছে।


- 'মানুষ মরে গেলে নাকি তারা হয়ে যায় এটা কি সত্যি তিন্নি।'


- 'জানিনা, তবে মরে যাবার পরে আফসোস করার চেয়ে পাশে বসে থাকা মানুষটিকে গুরুত্ব দেয়া বোধ হয় জীবনে বেশি মূল্যবান।'


আমি তিন্নির দিকে তাকালাম। আলো-আঁধারিতে শ্যামবরণ মেয়েটিকে অপূর্ব লাগছে। তিন্নি একটু করে হেসে আমার কাঁধে মাথা রাখলো। আমার ইচ্ছে করছিল তিন্নি কে সমস্ত ঘটনা খুলে বলি কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো, থাক না কিছু অজানা কথা, মেয়েটা এইমাত্র বাঁচার স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে হঠাৎ করে তার বেঁচে থাকার স্বপ্ন আমি কেড়ে নিতে পারি না আমি যে তাকে বড্ড বেশি ভালোবাসি।


না পাওয়া ভালবাসার কষ্টের গল্প পড়ুন।