অবহেলার কষ্টের গল্প | অবহেলার কষ্টের স্ট্যাটাস

 স্ত্রীর প্রতি স্বামীর অবহেলা

স্ত্রীর প্রতি স্বামীর অবহেলা

ছোট ফুফু কাঁদছেন।আম্মা তাকে আজ কঠোর একটা কথা বলেছেন।ফুফু আমায় টেনে কাছে নিতে চেয়েছেন বলেই আম্মা বলেছেন,'বকুলের কাছে তুমি ঘেঁষো না চম্পা।আমি চাই না আমার মেয়ের ভবিষ্যত নষ্ট হোক!'

ছোট ফুফু অবাক হয়ে আম্মার দিকে তাকালেন।আম্মা তখন বললেন,'  এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?আমি স্পষ্ট কথা বলার মানুষ তাই স্পষ্ট করে বলেছি। আমার মেয়েকে তুমি এভাবে কাছে টেনো না। তুমি বাজা মেয়ে।বন্ধ্যা। তোমার স্পর্শ পেলে আমার মেয়ের ক্ষতি হবে। আমার মেয়ের তুমি ক্ষতি করবে আর আমি তা চেয়ে চেয়ে দেখবো নাকি?'

তারপর আব্বাকে আঙুল উঁচু করে দেখিয়ে আম্মা বললেন, 'সব দোষ উনার। তিন মাস পর পর বোনরে নাইওর আনতে হবে তার!জামাই নি*র্যাতন করে বলে তিন মাস পর পর বাড়িতে এনে সেবা দিয়ে দিতে হবে।দরদ।দরদ একেবারে উতলে উঠে।আর কারোর বোন নাই বুঝি দেশে!তারা সারা বছরই বোন এনে ঘরে রেখে দেয়! যতসব নকরামি!'

আব্বা কিছুই বলতে পারেননি ‌।বলতে না পারার কারণ হলো তিন বছর যাবৎ তিনি বেকার। চাকরিটা চুরির মিথ্যা অভিযোগে চলে গেছে। এরপর আম্মাই সংসারের হাল ধরেছেন। বাড়িতে মেশিন কিনে এনে তিনি গ্রামের মেয়েদের কাপড় সেলাই করছেন।এতে কোন ভাবে সংসারের খরচা চলে যাচ্ছে। আব্বা চাকরি জোগাবার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কিছুতেই আর তার চাকরি মিলছে না। যেখানেই চাকরির জন্য যান সেখানেই কিভাবে যেন ওরা জেনে ফেলে চুরির অভিযোগে আব্বার চাকরি চলে গিয়েছে।তাই তারাও আর চোরকে চাকরি দেয় না। আবার অন্যের বাড়ি গিয়ে কাজও করতে পারছেন না তিনি। মধ্যবিত্ত পরিবার গুলোর এই এক ঝামেলা! পকেটে পয়সা না থাকলেও চোখ ভর্তি লজ্জাটা ঠিকই থাকে।

আব্বা চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।একটা নিঃশ্বাস পর্যন্ত ফেললেন না। আব্বা ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকেই ফুফু কাঁদছেন। হয়তোবা তিনি আব্বার উপর খুব অভিমান করেছেন।আম্মা অত কঠোর কথা বলার পরেও কেন তিনি তার বোনের পক্ষে দুটো কথা বলেননি। কেন আম্মাকে বকেননি?এটা ভেবে তার অভিমান করাটাই স্বাভাবিক!

আমারও খুব কষ্ট হচ্ছে। চোখের ভেতর জল কিলবিল করছে। ইচ্ছে করছে ফুফুর কাছে গিয়ে ফুফুর গলা জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে। কিন্তু মার জন্য পারছি না। আমার অতো সাহস নেই যে মাকে ডিঙিয়ে গিয়ে ফুফুর গলা ধরবো!

ফুফুর কান্না দেখেও আম্মার মন গললো না।আম্মা ফুফুকে আরেকটা কঠোর কথা বললেন। বললেন,'যদি মানুষ হয়ে থাকো তুমি তবে এই বাড়ির চৌকাঠ কোনদিন মাড়িও না!'

এই কথা শোনার পর ফুফু একেবারে চুপ হয়ে গেলেন।আর কাপড় চোপড়ের ব্যাগ গুছিয়ে সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বাড়ি ছেড়ে বিদায় হলেন।

এরপর আর কোনদিন ফুফু আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসেননি।বাবা কতবার কতবার যে আনতে গিয়েছেন তবুও আসেননি তিনি। ফুফুকে বড় অ*ত্যাচার করতো ফুপা।ঘরে এনে বাইরের মেয়ে রাখতো। ফুফুর সামনেই সেই মেয়ের সাথে মিলিত হতো। ফুফুর কিছুই করার ছিল না।কারণ তিনি জানেন ভাইয়ের বাড়িতেও তার আর আশ্রয় নাই! তার সবকিছুই মুখ বুজে সহ্য করতে হবে।

ফুপু সব সয়ে যেতেন।তার শাশুড়ি আছে। শাশুড়ির কাছেও তার আশ্রয় ছিল না।শাশুড়ি ফুফুকে বাড়ি থেকে বের করার জন্য সব রকম চেষ্টাই করতো।ফুপার কানে ফুপুর বিষয়ে মিথ্যা কথা লাগিয়ে বাজিয়ে ফুপাকে দিয়ে ফুফুকে মার খাওয়াতো।

ফুফু কাঁদতেন। বিছানার বালিশ ভেজাতেন কেঁদে কেঁদে।আর গভীর রাতে উঠে আল্লার কাছে নালিশ করতেন। প্রার্থনা করে বলতেন,'মাবূদ গো, তুমি তো ইব্রাহিম নবীকে তার বৃদ্ধ বয়সেও সন্তান দান করেছিলে। তুমি তো সবই পারো। আমার মতো আভাগীকেও তো তোমার দয়ায় রাখতে পারো।দান করতে পারো আমায় একটা সন্তান!'

ফুফুর এই দোয়া কবুল হলো।তার বিয়ের আট বছর পর তার গর্ভে জন্ম নিল ফুটফুটে এক ছেলে সন্তান।ফুপা খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠে ফুফুর নামে লিখে দিলেন বাজারের ঘর সহ ছয় শতাংশ জায়গা।গরু জবাই করে খাওয়ালেন সাড়া গ্রামের মানুষকে। এরপর থেকে ফুফুই হয়ে গেলেন বাড়ির হর্তা কর্তা।ফুপা সন্তান পাবার পর কিভাবে যেন বদলে গেলেন। এখন ফুপা যেন ফুফুকে ছাড়া দম ফেলতেও ভরসা পান না।সবই আল্লাহর খেলা। এই সময় ফুফুর শাশুড়িও অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে গেলো। বিছানা থেকে আর কোনদিন উঠবে বলে মনে হয় না।ফুফু কিন্তু তখন তার শাশুড়িকে অবহেলা করেননি। নিজের মাকে যেভাবে সেবা শুশ্রূষা করে মানুষ ঠিক সেভাবেই তিনি শাশুড়ির সেবা শুশ্রূষা করতেন। তার এই সুখ দেখে মানুষের ঈর্ষা হতো পর্যন্ত!


এরপরের গল্পটা বলি। 

আব্বা মারা গেলেন হুট করে।কী রোগ তার হয়েছিল জানতাম না আমরা। ঘুমের ভেতর সুস্থ স্বাভাবিক একটা মানুষ মরে গেলো! আব্বা মারা যাওয়ার পর আম্মা পড়লেন ঘোর বিপদে। গ্রামে তখন আরো দু তিনটে সেলাই মেশিন এসে গেছে।আম্মার কাছ থেকে আর এখন কেউ কাপড় সেলাই করে নিতে আসে না।আমরা মা মেয়ে পড়লাম তখন ঘোর বিপদে। এমন হয়েছিল যে সারাদিন আমরা ভাত না পেয়ে পানি খেয়ে থেকেছি। আমাদের এই দৈন্য দশার কথা ফুফু কার কাছ থেকে যেন শুনলেন। শোনার পর দিনই আমাকে আর আম্মাকে নিতে এলেন।আম্মা তখন লজ্জা এবং আত্ম অনুশোচনায় ফুফুর হাত ধরে কেঁদে ফেললেন। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বললেন,'আমি তো তোমার সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি। আমার বাড়ি থেকে এক রকম তাড়িয়ে দিয়েছিলাম তোমায়। তোমাকে আমি অপয়া মনে করতাম। তোমার কাছে আমার মেয়েকে ঘেঁষতে দিতাম না। এতো কিছুর পরেও তুমি কেন আমাদের সাহায্য করতে এলে?'

ফুফু মৃদু হেসে আমায় কাছে টেনে নিতে নিতে বললেন,'মনুষ্যত্বের কারণে।ভাবী,আমি আপনাকে দেখেই শিখেছি অহংকার পতনের মূল।আর মহান আল্লাহ অহংকারীকে কখনই পছন্দ করেন না!'


-অনুশোচনা

-অনন্য_শফিক


এমন আরও গল্প পড়ুন।