স্বামীর সংসার | সংসার সুখী হয় রমনীর গুনে

 মেয়েদের সংসার জীবন

মেয়েদের সংসার জীবন

খুব ছোটবেলায় সকালে ঘুম থেকে উঠে চোখ কচঁলাতে কচঁলাতে দেখতাম আব্বু বাথরুমে গেলে আম্মা এদিক ওদিক তাকিয়ে আব্বুর পকেট থেকে টাকা সরিয়ে রাখতো। 


চোখ বড় বড় করে যখন বলতাম,

- 'আম্মা তুমি কি আব্বুর পকেট থাকে টাকা চুরি করো?'


আচমকা আম্মা আঁতকে উঠতেন। তারপর মুখে আঙুল দিয়ে ফিসফিস করে বলতেন,


- 'চুপ চুপ তোর আব্বু শুনতে পাবে।' 


ব্যপারটা আমার কাছে খারাপ লাগতো। ‘তুমি না বলে কেন টাকা নিবা? আব্বু চাইলেই তো টাকা দিবে তোমায়।’ কিন্তু সাহস করে বলতে পারতাম না।  


.


বাজার থেকে চালের বস্তা আনার পর রান্নার সময় মেপে মেপে যখন চাল নিতেন তখন সেখান থেকে এক মুঠ চাল একটা ডিব্বার মধ্যে রাখতেন। চালের বস্তা যখন শেষ হয়ে যেতো বা কোনো কারণে চাল আনতে দেরি হলে আম্মা সেই চাল রান্না করতেন।


মাছ মাংসের ক্ষেত্রেও তা। আব্বু বাজার থেকে মাছ মাংস আনলে এক টুকরো বা দুই টুকরো করে রেখে দিতেন ফ্রিজে। সেগুলো জমে যখন অনেকগুলো হতো সেদিন আম্মা বিরিয়ানি রান্না করতেন। খাবার টেবিলে বসে যখন আব্বু জিজ্ঞেস করতো,


- 'কি ব্যাপার আজ বিরিয়ানি? কিন্তু আমি তো আজ বাজার থেকে মাংস আনিনি।'


আম্মা চোখ রাঙানি দিয়ে বলতেন,

- 'এতো কথা বলো কেন? রান্না করেছি খাও। এতো কিছু জিজ্ঞেস করো কেন?"


তারপর আব্বু কোনো কথা না বলে চুপচাপ খেয়ে উঠে যেতো।


.


ইদের সময় আব্বু যখন আম্মার কাছে টাকা দিতো ইদের শপিং করার জন্য তখন আম্মা তিন ভাগের এক ভাগ টাকা রেখে দিতো নিজের কাছে। আর দুই ভাগ টাকা দিয়ে ইদের শপিং করতো। খুব রাগ হতো তখন। ভাবতাম সব টাকা আম্মা নিজের জন্য রাখে। নিজের জন্য ভালো ভালো কাপড় কিনে।


আমার সকল ধারনা ভুল প্রমাণিত হয় আমি সাবালিকা হওয়ার পর। কোনো এক বোর্ড পরীক্ষায় আমি খুব অসুস্থ হয়ে পড়লাম। ডাক্তার পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বললেন অপারেশন করতে হবে। আব্বুরও ব্যবসা লস। টানাটানি চলছে সেই সময় পুরো চিকিৎসার টাকা আম্মা দিলো। আমি তখনো জানতাম না এসব টাকা আম্মার। পরে অবশ্য জেনেছিলাম।


.


তারও কয়েক বছর পরের কথা গ্রাম থেকে খবর এলো আমাদের জমির পাশের জমি বিক্রি হবে। দুই জমির এক লাইল। আব্বু কিনবে না কিনবে না করেও বললেন কিনবো। সব টাকা যোগার করার পর দেখা গেলো আরো আড়াই লক্ষ টাকা সর্ট। হুট করে একসাথে এতোগুলা টাকা কেউ দিতে রাজি হলো না।


সেই সময় আম্মা দিলো আড়াই লক্ষ টাকা। একজন চব্বিশ ঘণ্টা সংসারের পিছনে ছুটে চলা নারীর আড়াই লক্ষ টাকা দেওয়া চাট্টিখানি কথা না। সবাই অবাক হয়েছিল কিন্তু সবার আড়ালে হেসেছিল আব্বু। আমার জহুরির চোখ সেটা ধরে ফেলেছিলো। আব্বু সেই জমি আম্মার নামে কিনলেন।


.


আমার বিয়ের দিন আমাকে সাজানোর পর আম্মা রুমে এলেন এবং সবাইকে বের করে দিলেন সেখান থেকে। দুটো বালা আমার হাতে পড়িয়ে দিতে দিতে বললেন,


- 'তোমার গুণধর বাপ বহু বার ব্যবসায় লস খাইসে। তার খেসারত দিতে হয়েছে আমাকে। প্রথম বার লস হয় তুমি ভূমিষ্ট হবার পর। সে সময় নিজের ধারদেনা দেওয়ার জন্য সে আমার শখের গয়না গুলো বিক্রি করে। আমি তোমাকে বুকে জড়িয়ে কান্না করেছিলাম।


টানা একমাস তোমার গুণধর বাপের সাথে কথা বলি নাই আমি অভিমানে। এরপর ব্যবসায় যখন লাভ হলো তখন তার থেকেও বেশি গয়না আমাকে গড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু সেগুলো?


সেগুলো আর তো পাইনি। ছোটবেলায় বলতে না, ‘আম্মা তুমি কি আব্বুর পকেট থেকে চুরি করো?’ এই চুরির টাকায় তোমার মা অনেক কিছু করেছে। এই বুদ্ধি তোমার নানু আমায় দিয়েছে। সংসারের মেয়েদের টাকা উড়ালে হবে না। বরং সঞ্চয়ী আর হিসেবি হতে হয়। মানুষের অবস্থান কই থেকে কই চলে যায় বলা তো যায় না। সংসার কিন্তু মেয়েরাই ধরে রাখে। সংসারের উন্নতি আর অবনতি একটা মেয়ের হাতে থাকে। আশা করি তুমিও আমার মতো হবে।'


.


এক বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় আব্বুর সাথে বারান্দায় বসে শ্বশুরবাড়ির গল্প করছি। আর আম্মা রান্নাঘরে খিচুড়ি রান্না করছে। গল্পের এক ফাঁকে আব্বু তার মোটা ফ্রেমের কালো চশমাটা চোখ থেকে নামালেন। আর বললেন,


- 'আমার দৃষ্টিতে তোমার আম্মা একজন আদর্শ নারী। ব্যবসায়িক খাতে অভিজ্ঞ হওয়ার পরও অসতর্কতার জন্য আমি বহুবার লস খেয়েছি। তোমার আম্মা আমাকে ততবারই সাপোর্ট করেছে। টানাটানির দিনও গেছে আমাদের তখন তুমি খুব ছোট।


অন্য সব নারী হলে অভাব দেখলে দৌড়ে পালাতো কিন্তু সে আমাকে মেন্টালি সাপোর্ট করে গেছে। আমার পকেট থেকে যে তোমার মা রোজ সকালে টাকা রাখে এই ব্যপার টা আমি জানি। আমি যে জানি সেটাও তোমার মা জানে। তাইতো সব সময় আমি আমার পকেটে পঞ্চাশ কিংবা একশো টাকা রাখতাম তোমার মায়ের জন্য। সে আমার পরিপূর্ণতা।


সে না থাকলে কবেই তলিয়ে যেতাম। একজন স্বামীর একজন স্ত্রীর সাপোর্ট পাশে থাকা যে কি বলে বোঝাতে পারবো না। আমি চাইবো তুমিও নিজেকে তোমার মায়ের মতো গড়ে তুলো। যেন তোমার স্বামীও একদিন তোমাকে নিয়ে গর্ব করে। তোমার আম্মাকে আমি মাঝে মাঝে বলি এতো কিছুর পরও আমাকে ছেড়ে কেন গেলে না? তোমার আম্মা কি বলে জানো?'


আমি আব্বুর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম।

তারপর তিনি বললেন,


- 'বলে তোমাকে বিয়ে করেছি তোমার হাড়মাস জ্বালিয়ে খাওয়া না অব্দি তোমার রেহাই নেই।'


বলেই তিনি হু হু করে হাসতে লাগলেন, তৃপ্তির হাসি! সেই হাসিতে ছিলো মনের মতো জীবনসঙ্গী পাওয়ার উপচে পড়া আনন্দ।


(সমাপ্ত)...


-ছোটগল্প

-আদর্শ_নারী 

-রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

----


মন ছুঁয়ে যাওয়া গল্প পড়ুন।